মায়ার বাঁধন পর্ব-১২+১৩

0
241

মায়ার বাঁধন-১২তম পর্ব
©শাহরিয়ার

জয় রুম থেকে বের হয়ে কিছুটা সময় বাড়ির বাউন্ডারির ভিতর ঘুরাঘুরি করে আবার বাড়ির ভিতর চলে আসলো। ততক্ষণে উপমার নামাজ পড়া শেষ। নিচে এসে খালার সাথে বসে গল্প করছে। অতীতের গল্প দু’জন গল্প করছিলো আর হাসছিলো। আজ জয়ের কাছে উপমার হাসিটা বেশ লাগছিলো। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে এসব আমি কি ভাবছি। না এ মেয়েকে বেশী পাত্তা দেয়া যাবে না যতটা দূরত্ব বজায় রাখা যায় রাখতে হবে। ভাবতে ভাবতে দুতলার দিকে উঠতে যাবে এমন সময় খালা ডাক দিয়ে।

খালা: কিরে কোথায় যাচ্ছিস? দুপুরের খাবার খাবি না?

জয়: হ্যাঁ খাবো ফ্রেশ হয়ে আছি।

খালা: আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয় আমরা খাবার রেডি করছি।

জয় হেঁটে উপরে উঠে যেতেই ডাইনিং এ খাবার সাজানো শুরু হয়ে গেলো। খাবার সাজাতে সাজাতে খালা, বুঝলি মা। আমাদের জয় হয়েছে ওর নানার মত। বাবাও এমন ছিলো উড়নচণ্ডী। কখন কি করতো তা আমরা কেউ বুঝতে পারতাম না। তবে মনের দিক দিয়ে যথেষ্ট্য ভালো ছিলো। ঠিক আমাদের জয়ও সেই রকম। বাহিরে খুব শক্ত মনের কিন্তু ভিতরটা একদম তুলার মত নরম।

দু’জন কথা বলতে বলতে জয় চলে আসলো। জয় আসার পর পর পরী আর পারুও চলে আসলো। খেতে খেতে পারু ভাবী চলো না বিকেলে নদীর ঘাট থেকে ঘুরে আসি।

উপমা: এখানে নদী আছে?

পরী: ওমা! কি বলো এসব? ভাইয়া কি তোমাকে কিছু বলেনি? আমাদের এখানে বিশাল একটা নদী রয়েছে।

আমি ওদের কথায় কোন রকম অবাক হলাম না, কেননা জয়ের আমাকে কোন কিছু সম্পর্কে বলার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। সে আমাকে তার জীবনে রাখতে চায় তা জেনেও আমি তার জীবনে থাকার লড়াই চালাচ্ছি।

জয়: আরে কি বলবো এতো সময় কোথায় বলার মত হুট করেইতো এখানে আসার প্রোগ্রাম হলো।

খালা: হয়েছে হয়েছে এটা নিয়ে এতো ঝগড়া করার কি আছে। কিছুক্ষণ পর সবাই মিলে যেয়ে ঘুরে আয়। তাহলেই হয়ে গেলো।

সবাই এক সাথে সে কথায় সাড়া দিয়ে বললো ঠিক আছে।

রুমে এসে নীল রঙের একটা শাড়ি পরে নিলাম।সাথে ম্যাচিং করে কাঁচের চুড়ি , চোখের নীচে হালকা একটু কাজল ব্যস এইতো আমার আমি। যে সব সময় নিজেকে নিজের মত করে সাজিয়ে তুলি। শরৎ এর আকাশ নদী আর কাশফুল সত্যিই একটা এমন বিকেলে যদি জয় পাশে থাকে এক জীবনে আর কিছু না লাগে। ভাবতে ভাবতে পরী চলে আসলো।

পরী: আরে ভাবী তোমাকেতো বেশ সুন্দরি লাগছে।

কি যে বলো না কালো মানুষকে আবার সুন্দরি লাগে নাকি?

পরী: হুর তুমি আবার এসব কি বলো? কালো হলেই কি মানুষ অসুন্দর হয় নাকি? মানুষের মনের সুন্দর্য্যই আসল। আর তা ছাড়া তুমি মোটেও অতটা কালো না যতটা তুমি নিজে নিজেকে ভাবো। তুমি দেখতে সত্যিই অনেক সুন্দর। আর সবচেয়ে বেশী সুন্দর তোমার হাসি। উফ কত সুন্দর করে তুমি হাসো।

পরীর কথায় আমি হেসে দিলাম। সত্যিই মেয়েটার কথায় যাদু আছে। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম পরীতো দেখছি আমাকে কথার যাদুতে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে।

পরী উচ্চ শব্দ করে হাসছে অপূর্ব সে হাসি। আমি ড্রেসিং এর উপর থাকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে পরীর একটা হাস্য উজ্জল ছবি তুলে নিলাম। হাসি থামিয়ে পরী বললো এবার চলো সবাই নিচে বসে রয়েছে তোমার জন্য।

হ্যাঁ চলো, পরীকে সাথে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। এরপর সবাই মিলে বের হয়ে আসলাম বাহিরের শরৎ এর নীল আকাশ। এতো সুন্দর লাগছে আমি জয়কে প্রশ্ন করলাম কত সমৃয লাগতে পারে নদীর কাছে পৌঁছাতে?

জয়: এইতো দশ পনের মিনিট লাগবে হেঁটে যেতে বেশী সময় লাগবে না। কেন তোমার কি হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে?

না না তেমন সমস্যা হচ্ছে না, আসলে আমি খুব একটা শাড়ি পরিনাতে তাই কিছুটা আন ইজি লাগছে।

জয়: তবে তোমাকে কিন্তু শাড়িতে ভালোই মানায়। আজ তো তোমার শাড়ির রঙ আর আকাশের রঙ এক হয়ে গিয়েছে। কথাটা বলেই জয় হাত বাড়িয়ে দিলো।

আমার হাত পা কাঁপছে ওর হাতে হাত রাখবো কি রাখবো না ভেবে পাচ্ছিনা। এমন সময় জয় বলে উঠলো ধরতে পারো হাত বন্ধু হিসেবে, যেহেতু তোমার শাড়ি পরে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে আমার হাতে হাত রেখে হাঁটতে সুবিদা হবে।

আমি দ্বিতীয় বার আর না ভেবে জয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলাম। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম। পরী আর পারু এক প্রকার দৌড়ের মত করেই আমাদের সামনে দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। কিন্তু আমার কেন জানি এতো দ্রুত যেতে ইচ্ছে করছে না। জয়ের হাতে হাত রাখার পর থেকেই মনে হতে থাকলো এই সময়টা থমকে যাক। যেন আর একটি মুহুর্তও সামনে না আগায়। কিন্তু আমরা চাইলেও সময়কে আটকে রাখার ক্ষমতা রাখতে পারি না। আল্লাহ যে নিয়মে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সে নিয়মেই চলবে। নানান চিন্তায় এক সময় বিশাল এক নদীর সামনে এসে দাঁড়ালাম।

পরী: ছুটে এসে ভাবী দেখছো কত বড় আর কত সুন্দর নদী।

বলেই পরী ছুটে চললো নদীর দিকে যেয়ে নদীর পাড়ে পা ভিজিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। সাথে পারুও যোগ দিলো। দুই বোন দু’জনের হাতে হাত রেখে খিলখিল করে হাসছে আর হেঁটে চলছে।

দূর থেকে দূর পর্যন্ত শুধু পানি আর পানি সেই পানিতে এসে নীল আকাশটা মিশে গিয়েছে। যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছি। কিছুটা সামনের দিকে হাঁটার পর চোখে পরলো শরৎ এর কাশফুল। চারিদিকে সাদা ধবধবে সাদা কাশফুলের পাপড়ি বাতাসে ছুটে চলছে এদিক সেদিক। বিশাল কাশফুল গাছ গুলো বাতাসে যেন দল বেধে নিত্য করে চলেছে এক অপূর্ব দৃশ্য আমি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কিছুটা মুহুর্ত ভিডিও করে নিলাম। হয়তো জীবনে এমন মুহুর্ত আর কখনো আসবে না।

এক পাশ দিয়ে হেঁটে চলছে নদীতে পা ভিজিয়ে পারু আর পরী তাদের। সে নদীর শেষ কোথায় তা আমি জানি না। আমার কয়েক পা সামনে দিয়ে হেঁটে চলছে জয়। তার গন্তব্য কোথায় তাও আমি জানি না। তার পেছনে এই আমার গন্তব্য বলতে কিছু নেই। নীল আকাশ বহমান সুন্দর নদী সাদা কাশফুল সব কিছুতেই আমি নিজের আনন্দ খুঁজে নিচ্ছি। জানি না এ আনন্দ কতক্ষণ থাকবে। যদি কখনো মানুষ গুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই,তবে আজকের এই ভিডিও দেখে কিছুটা সময় থমকে যাওয়া যাবে। “ভালোবাসি যাকে বলতে পারিনি, সে মানুষটাকে যে আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। হয়তো সে কখনো বুঝবে না, হয়তো কোন দিন জানবে না। তবুও তার পেছন থেকেই বলছি খুব ভালোবাসি প্রিয় আপনাকে।”

বলেই ভিডিওটা বন্ধ করে দিলাম। কিছুটা লজ্জা লাগছে যদি শুনে ফেলতো জয়। কিংবা কখনো এই ভিডিও দেখে ফেলে? অবশ্য জয় কখনো আমার ফোনে হাত দিবে বলে মনে হয়না। কেননা আমার নাম্বার নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই সে মনে করে না।

এসব ভাবছি এমন সময় হুট করেই জয় পাশে চলে এসে।

জয়: হাতে থাকা কাশফুল গুলো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নাও তোমার জন্য নিয়ে এসেছি।

আমি হাসি মুখে তা নিলাম।

জয়: পা ভেজাবে নদীর পানিতে? ভয় নেই আমি পাশে থাকবো।

কিন্তু শাড়ি পরে হাঁটতে কষ্ট হবে। আর শাড়ি ভিজে যাবে।

জয়: শাড়ি ভিজলে সমস্যা নেই, আমরা আর বেশী সময় থাকবো না। সন্ধ্যা হয়ে আসবে কিছু সময় পর। তার আগেই আমরা ফিরে যাবো।

কথাটা বলেই জয় হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি তার হাতে হাত রেখে এক’পা দু’পা করে এগিয়ে চললাম নদীর দিকে। নদীর চকচকে পানিতে দু’জন পা পাশাপাশি ভিজিয়ে হাঁটছি। মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিচ্ছি আল্লাহ তার সকল বান্ধার মনের গোপন সব ইচ্ছের কথা জানেন। আজ তিনি আমার একটা ইচ্ছেও পূরণ করে দিলেন।

“ছোট বেলা থেকেই আমার খুব ইচ্ছে ছিলো, শরৎ এর কোন এক বিকেলে শাড়ি পরে এমনি করে নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটবো। নদীর একপাশে এসে মিশে যাবে নীল আকাশ, একপাশে কাশবন আর মাঝে আমার ভালোবাসার মানুষটি যার হাতে হাত রেখে হেঁটে চলবো নদীর পানিতে শব্দ করে।”

বেশ কিছুটা সময় জয়ের হাতে হাত রেখে হাঁটার পর জয় সামনের দিকে তাকিয়ে পরীকে বললো উঠে পর বাড়ি ফিরতে হবে।

জয়ের কথা শোনার সাথে সাথেই ওরা দু’বোন নদীর পানি ছেড়ে উপরে উঠে এলো। ওরা উঠার পর পর জয়ও আমাকে বললো উপরে উঠার জন্য। আমি জয়ের দিকে একবার তাকালাম, বললাম, সামনে কোথাও বালুমাটি নেই? এখান দিয়ে উঠতে খুব কষ্ট হবে এমন কি পরেও যেতে পারি।

জয়: কিছুই হবে না। দেখছো না ওরা দু’বোন কত সুন্দর উঠে গেলো। আর তাছাড়া আমিতো আছি।

তবুও আমার ভয় করছে চলুন না সামনে যেয়ে দেখি।

জয়: সামনেও একই রকম। কোথাও যেতে হবে না তুমি উঠো।

আমি আর কথা না বলে উঠার জন্য পা বাড়ালাম। এক’পা দু’পা করে তৃতীয় পা দিতেই পিছলো পেছনে পরতে শুরু করলাম। তখনি শক্ত হাতে জয় আমার কোমর চেঁপে ধরলো। আমি পেছনে ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করছি। আর এদিকে মাটি এতোই পিছলে যে জয় আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তা পা পিছলে দ্রুতই এগিয়ে চলছে নদীর দিকে। একটা সময় ভয়ে আমার দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম। উপর থেকে শুনতে পেলাম পরী আর পারু বলছে ভাইয়া সাবধানে পরে যাবেতো। ঠিক সেই মুহুর্তেই নদীতে পরে গেলাম দু’জন। আমি বুঝতে পারলাম আমার মাথা যেয়ে ঠেকেছে জয়ের বুক বরাবর। আমি ভয়ে দু’হাতে জয়কে শক্ত করে চেপে ধরলাম।

দ্রুত জয় আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো। তখনো আমি ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করে রেখেছে। উপর থেকে পরী আর পারু উচ্চ স্বরে হাসছে। আমি চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম জয় আমার দিকে লাজুক চোখে চেয়ে রয়েছে। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিলো ওদের হাসিতে। জয় হয়তো আমার মনের কথা বুঝতে পারছিলো তাই চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকালো। মুহুর্তেই ওরা নিরব হয়ে গেলো। ওদের ভয়ার্ত মুখ দেখে আমারই প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিলো। কিন্তু আমিও ভয়ে নিশ্চুই হা করে জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

চলবে…

মায়ার বাঁধন-১৩তম পর্ব
©শাহরিয়ার

জয় রাগি চোখে আমার দিকে তাকাতেই আমি দ্রুত চোখ নিচে নামিয়ে বন্ধ করে নিলাম। আর মনে মনে দমক খাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম যখন জয়ের হাত আমার কোমরে পরলো। আর সে আমাকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো। কিছুটা ভয় আর কিছুটা আনন্দ হৃদয়ের গহিনে এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিলো। নদীর পাড়ে উঠে আমাকে নামিয়ে দিয়ে শাড়ি পরে নড়াচড়া করতে পারো না তবে কেন পরেছো? আর আগে কি কোন দিন নদীতে নামোনি?

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই পরী বলে উঠলো, ভাইয়া মনে হয় বৃষ্টি শুরু হবে আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার।

জয়: হ্যাঁ চল, বলেই হাঁটা শুরু করলো।

ভেজা কাপড়ে আমার হাঁটতে বেশ অসুবিদাই হচ্ছিলো। আমি ওদের সাথে পা ফেলে হাঁটতে পারছিলাম না। আমি ওদের থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পরলাম। হঠাৎ করেই সামনে তাকিয়ে দেখি জয় দাঁড়িয়ে গিয়েছে। পরী আর পারুকে দ্রুত হেঁটে যেতে বললো। আমি জয়ের কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করলাম আপনি ওদের সাথে গেলেন না?

জয়: আমারতো দ্রুত যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমিতো ভিজেই গিয়েছি, বৃষ্টি আসলেই আমার কি আর না আসলেই আমার কি?

আমি মুগ্ধ নয়নে জয়ের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। খুব ইচ্ছে করছে মানুষটাকে একটু জড়িয়ে ধরি। খুব ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলি যে মানুষটাকে ভালোবাসেন না তাকে কেন এতো কেয়ার করতে হবে? আগের মতই অবহেলা করেন না। আপনি যত বেশী কেয়ারিং করবেন ততবেশী আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলবো।

বৃষ্টির পানির ছিটা মুখে আসতেই কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসলাম। বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। মনে মনে একটু হেসে নিয়ে জয়ের দিকে তাকালাম। সে ভাবলেশহীন ভাবে আমার পাশেই হেঁটে চলছে। মনে মনে আল্লাহকে বললাম আল্লাহ কি হচ্ছে এসব আমাকে এতোটা দূর্বল কেন করছেন আমাকে তার উপর? যে আমাকে ভালোবাসে না।

দু’জন বাড়ির ভিতর ঢুকতেই খালাম্মা বলে উঠলো কি করেছিস দু’জন ভিজে একাকার হয়ে এসেছিস? ইস তাড়াতাড়ি যেয়ে দু’জন জামা কাপড় চেঞ্জ করে নে, নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।

জয়: কিছু হবে না খালা তুমি অযথাই চিন্তা করছো। আর আমরা কি ছোট মানুষ যে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে ঠান্ডা লেগে যাবে?

খালা: শোন হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আর ঠান্ডা লাগতেই পারে এজন্য বড় ছোট হবার প্রয়োজন হয়না। তোরা জামা কাপড় পরিবর্তন করে আয়। তারপর তোদের সাথে মজার গল্প করবো।

জয়: আচ্ছা ঠিক আছে তুমি থাকো আমরা চেঞ্জ করে আসছি। পরী আর পারু কোথায়?

খালা: ওরাও আসবে নিজেদের রুমে গিয়েছে একটু পরেই চলে আসবে।

আমরা দু’জন আর কথা না বলে উপরে চলে আসলাম। জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম। জয় রুমের ভিতরেই চেঞ্জ করে নিলো। আমি একেবারে ওযু করে বের হলাম।

জয়: চলো নিচে যাই খালা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

আপনি যান আমি কিছুক্ষণ পর আসছি নামাজ শেষ করে।

জয়: আচ্ছা ঠিক আছে বলে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়ালাম। কেননা আল্লাহর ইচ্ছেতেই জীবনে এই খুশির মুহুর্ত এসেছে। তার প্রতি কৃতজ্ঞ না হলে হবে না। সকল প্রশংসাই মহান আল্লাহর।

নামাজ শেষে নিচে নেমে এসে দেখি সবাই মিলে চা নাস্তা করছে। আমাকে দেখে খালাম্মা বললো আমার পাশে এসে বস মা। খালাম্মার পাশের চেয়ারে বসলাম। সে নিজেই চা বানিয়ে দিলো। চা খেতে শুরু করতেই খালাম্মা বলতে শুরু করলো।

খালা: শোন তাহলে গল্প, তখন মাত্রই আমার বিয়ে হয়েছে কয়েকদিন হয়েছে। এমনি শরৎ এর একদিন আমি আর তোর খালু এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। তো সন্ধ্যায় দু’জন মিলে গল্প করছি ছাঁদে বসে হঠাৎ চারিদিক আঁধার হয়ে গেলো। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। মাত্রই আকাশ নীল ছিলো আর এখুনি কালো হয়ে আসলো। তো উনার দিকে তাকিয়ে বললাম চলুন নেমে যাই। খুব বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। উনি হেসে বললো আসুক বৃষ্টি। বৃষ্টি আসলে দু’জন এক সাথে ভিজবো। আমি হেসে বললাম ইস কি বলেন? শ্বশুড় বাড়িতে এসে বৃষ্টিতে ভিজবেন। সবাই কি মনে করবে? উনি হেসে দিয়ে বললেন সব সময় এমন পরিবেশ পাওয়া যায় না বুঝলে। এই সুন্দর সন্ধ্যা এলোমেলো বাতাসে তোমার খোলা চুলের ঘ্রাণ সেই সাথে যদি হয় ঝুম বৃষ্টি হয় তাহলেতো আর কথায় নেই। ঠিক যেন কবির বলা কোন এক বর্ণনা হয়ে যাবে। আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। উনার পাশ থেকে উঠে দৌঁড় দিতে যাবো, ঠিক তখনি সে পেছন থেকে হাত ধরে টান দিলো মুহুর্তেই আমি তার বুকের মাঝে চলে আসলাম আর মুহুর্তেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি।

পরী আর পারু খুব উৎসাহ নিয়ে খালার কাছে জানতে চাইলো তারপর কি হলো বলোনা তাড়াতাড়ি বলো না? আর এদিকে আমি গল্পের মাঝে মাঝে জয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছি, তার মনের মাঝে কি চলছে তা আমি বুঝতে পারছি না। তবে সেও যে গভীর মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনছে এটা বুঝতে পারছি।

খালা: তারপর আর কি। দু’জন খুব ভিজলাম, মাঝে মাঝে আকাশে খুব জোরে বিজলি চমকালেই আমি দৌঁড়ে তার বুকের মাঝে গিয়ে আশ্রয় নেই। সে আমার পিঠে আস্থার হাত রাখে মুহুর্তেই মনের সব ভয় দূর হয়ে যায়। সে যে কি আনন্দের মুহুর্ত ছিলো তোদের বলে বুঝাতে পারবো না।

পরী আর পারু খিলখিল করে হাসছে সাথে খালাও হাসছে। মুখ টিপে টিপে জয়ও হাসছে, শুধু আমি হাসতে পারছি না। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। এমনি করে অনেক রাত অব্দি গল্প চললো। খালাম্মা তার জীবনের সুখ দুঃখের গল্প বললো। উনার মুখ দেখে মনে হলো অনেকদিন যাবৎ উনি এসব বলার জন্য অস্থির হয়ে ছিলেন কিন্তু বলার মতো কাউকে পাচ্ছিলেন না। আজ বলতে পেরে উনার মন খুব হালকা হয়েছে। একটা সময় খালাম্মা চোখের পানি মুছতে মুছতে আমার হাত চেঁপে ধরে বলতে শুরু করলো।

খালা: শোন মা জীবন মানেই সুখ দুঃখে ভরা একটা গল্প। হয়তো কখনো সুখ আসবে কখনো বা দুঃখ। তাই বলে প্রিয় মানুষ স্বামীর মনে কষ্ট দিবা না। সে যেমন চাইবে তেমনি চলবে। মনে রাখবে পৃথিবীর সব মানুষ তোমার বিপরীতে থেকেও যদি তোমার স্বামী তোমার পক্ষে থাকে তবে তুমি সবাইকে হারিয়ে দিতে পারবে। পারবে পুরো বিশ্বকে জয় করতে।

আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো, জয়ের দিকে তাকালাম সে নিরব ভূমিকায় এখনো। আমি বলতে পারলাম না খালাম্মাকে আমি যে আপনাদের ছেলের মনের মত না। আর মাত্র কিছুদিন তারপর দু’জনের গন্তব্য দু’দিকে হবে।

একটা সময় খালাম্মা আর পারু মিলে টেবিলে খাবার দিলো। খেয়ে সবাই যার যার রুমে চলে আসলাম।

পরদিন খালাকে সাথে করে ছাঁদে উঠলাম। দীর্ঘ সময় আমাদের মাঝে গল্প হলো। কোথায় কোথায় দু’জন বসেছিলো সে সব দেখালো। খালা যখন অতীতের গল্প বলছিলো মনে হচ্ছিলো সে সেই দিন গুলোতেই ফিরে গিয়েছিলো।

আমি খালার দিকে তাকিয়ে বললাম, এই পৃথিবীতে কালো মেয়েদের অতিরিক্ত ভালোবাসা চাইবার অধিকার নেই।

খালা: কিছুটা সময় চুপ থেকে তোদের মাঝে কি কোন রকম সমস্যা হয়েছে? ওকি তোকে কিছু বলেছে?

কি যে বলোনা তুমি খালা, তোমাদের ছেলের মত মানুষই হয়না। সে খুবি ভালো মানুষ এমন মানুষ এখনকার দিনে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

দু’জন বেশ অনেকটা সময় ছাঁদে গল্প করে একটা সময় নিচে নেমে আসলাম।

দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কেটে গেলো এ বাড়িতে। চলে আসার সময় হয়ে এলো আমাদের আর কিছু সময় পর আবার আমরা রওনা হবো ঢাকার পথে। খালাম্মা জয়কে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।

জয়: আহা কান্না করো না তো, তোমার যখন মন চাইবে তুমি ঢাকা চলে আসবে নয়তো আমিই তোমার কাছে চলে আসবো।

খালা: তুই একা আসবি কেন? বউমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। আর খবরদার এতো লক্ষ্মী একটা মেয়েকে কখনো কষ্ট দিবি না।

জয়: আচ্ছা ঠিক আছে এবারতো হাসো।

খালাম্মা হেসে দিলো। পরী আর পারুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলাম। খালা মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বিদায় জানালো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছুটে চললো ঢাকার পথে। অনেকটা পথ আসার পরে জয় আমার দিকে তাকিয়ে বললো তোমাকে ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ কেন?

জয়: এই যে খালাকে কোন কিছু বুঝতে না দেবার জন্য।

আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি আর কিছুই না। দীর্ঘ জার্নি শেষে ঢাকায় এসে পোঁছালাম। শ্বশুড় শাশুড়ি আমাদের দেখে ভীষণ খুশি হলো। সবার সাথে কথা বলে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে রুমে যেতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেলাম বাবার নাম্বার। এই কয়েক দিনের ব্যস্ততায় বাড়ির কারো সাথে কথা বলা হয়নি। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করলাম। বাবা মা ছোট ভাই সবার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। কথা বলতে বলতে মা জয়ের সাথে কথা বলতে চাইলো। তাকিয়ে দেখলাম জয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। আমি সেখানে যেয়ে ফোনটা দিয় বললাম মা কথা বলতে চাচ্ছে। বুঝতে পারলাম উনার ইচ্ছে না থাকা সত্যেও কথা বলছে।

চলবে…