মায়ার বাঁধন পর্ব-১৪

0
240

মায়ার বাঁধন-১৪তম পর্ব
©শাহরিয়ার

কিছুটা সময় কথা বলে ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি মায়ের সাথে আরও কিছুটা সময় কথা বলে ফোন রেখে দিলাম।

দেখতে দেখতে দিন কেটে যেতে থাকলো। সময় খুব দ্রুত চলে যায়। সময়কে ধরে রাখার ক্ষমতা আমাদের কারো নেই। আমি প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহর কাছে মানুষটাকে পাবার জন্য প্রার্থনা করে চলছি। কেননা আল্লাহ বলেছেন “তোমরা সিজদায় বেশি বেশি দোয়া করো। “কেননা সিজদা দোয়া কবুলের উপযুক্ত স্থান” [সহিহ মুসলিম- ৮৭০]

এভাবেই কেটে গেলো একটি মাস। আমাকে জয় আর কালো বলে কিছু বলে না। কিংবা কোন কারণে ছোটও করার চেষ্টা করে না বরং বন্ধুর মতই আচরণ করে। কিন্তু সব কিছুর শেষেও আমি তার স্ত্রী এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না। বিছানায় আমাদের দূরত্ব সেই আগের মতই রয়েছে।

প্রায় দেড় মাস পর একদিন খাবার টেবিলে আমাদের দু’জনের সামনেই মা বলে উঠলো।

মা: তোরা তাড়াতাড়ি একটা বাচ্চা নিয়ে নে। আমাদেরতো বয়স হয়েছে নাতী নাতনীর মুখটাতো দেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেই।

মায়ের এমন কথায় আমাদের কারো মুখেই কোন রকম কথা নেই। বাবাও মায়ের সাথে যোগ দিলেন কিন্তু তারাতো জানেন না আমাদের দু’জনের মাঝে কতটা দূরত্ব রয়েছে। আর আমি আর কিছু দিনের অতিথি মাত্র এ বাড়িতে।

জয় নাস্তা শেষ করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো। আমি নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে কান্না করতে লাগলাম। সবার সামনে চোখের পানি লুকিয়ে রাখতে পারলেও সবার অন্তরালে তা আর সম্ভব হয়নি। দিনের পর দিন সবার সামনে হাসি মুখে অভিনয় করলেও সকলের আড়ালে চোখ অঝোরে পানি লুটিয়ে পরে। প্রতিটা সিজদায় প্রতিটা প্রার্থনায় শুধু তাকেই যে আমি চাই।

এতো কিছুর পরেও মানুষটা হয়তো আমাকে বুঝে না। আমাকে ভালোবাসতে পারে না। কারণ আমার গায়ের রং কালো। কালো মেয়েদের সত্যিই এ সমাজে কাউকে ভালোবাসতে নেই। নেই কারো আপন হবার অধিকার। বাবারা যতই বলুক না কেন মেয়ে তার রাজকন্যা কিন্তু বাবার বাড়ির বাহিরে যে জগৎ সে জগৎ এর মানুষ গুলো কখনোই কালো মেয়েদের আপন ভাবতে পারে না।

দিনের পর দিন যাচ্ছে আর আমি বুঝতে পারছি আমাকে এ বাড়ির মানুষ গুলোর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে। বাড়িতে বাবা মা, ভাইটাকেই বা কি বলবো? কি জবাব দিবো তাদের আমি।

জয় নিজের চেয়ারে বসে আছে, ইদানিং কোন কিছুই ভালো লাগে না দু’টানায় দোলছে মন। নিজের স্ত্রী হবার পরেও তাকে আপন করে কোন ভাবে মেনে নিতে পারছে না। এ সমাজ বন্ধু মহল সব কিছুকে কোন ভাবেই তুচ্ছ করে উপমাকে আপন ভাবতে পারছে না। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেরই কাছে। কেনই বা বিয়েটা করতে গেলাম, কেনই মা বাবাকে বলতে পারলাম না কালো মেয়েকে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। সব দোষ আমার আর আমার জন্য একটা মেয়ের সব স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হাজার রকম ভাবনা মনের ভিতর এসে জমা হচ্ছে।

সন্ধ্যার পর জয় বাসায় এসে ফ্রেশ হতেই চায়ের মগ নিয়ে এসে এগিয়ে দিলাম। জয় কেমন জানি চুপচাপ দেখে প্রশ্ন করলাম আপনার কি মন খারাপ?

জয়: কই নাতো।

ওহ আচ্ছা, বলে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম রান্না ঘরে মা রান্না করছে আমি এসে মাকে সাহায্য করবো বলে বসতেই মা বলে উঠলো।

মা: তুই এখন এখানে কেন? জয় এসেছে তুই ওর কাছে থাকবি। নতুন বিয়ে হয়েছে কিছু দিন হলো। স্বামীর যত কাছে থাকবি ততই ভালোবাসা বাড়বে।

মা কি যে বলো না তুমি। ভালোবাসা কি কাছে থাকলেই বাড়ে? ভালোবাসা হয় মন থেকে মনের মিলে। দূরত্বতো শুধুই একটা বাহানা। এই বাহানায় যারা ভালোবাসার মানুষটাকে ভুলে থাকে তারা আর আসলে কখনো ভালোই বাসে না। শুধু শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে।

মা: কি জানি তোদের এ যুগের ভালোবাসার কোন কিছুই আমি বুঝি না। আমাদের সময় ছিলো একদমই অন্য রকম। বিয়ের পর যখন এ বাড়িতে আসি। তখন আমার শাশুড়ি আমাকে জোর করে তোমার শ্বশুড়ের ঘরে পাঠিয়ে দিতো। আর বলতো শোন বউমা যেমন করে পারো ছেলেকে শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখবা। ছেলে জেনো অন্য কোন দিকে মনযোগ দিতে না পারে। আমার যে কি পরিমাণ লজ্জা লাগতো তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। উনি আমাকে জোর করে তোমার শ্বশুড়ের ঘরে ঢুকিয়ে দিতো। তোমার শ্বশুড়ের যা যা লাগতো সব উনি নিজেই দিয়ে যেতেন। আমি কোন কিছুর জন্য রুম থেকে বের হলে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাতেন। আমিতো উনার চোখ দেখে ভয়ে আবার দৌঁড়ে ঘরে চলে আসতাম। সে সব দিনের কথা মনে পরলে এখনো একা একাই হাসি। তোমার শ্বশুড়তো আমাকে খুব বকা দিতো, বলতো মা একা একা কাজ করছে আর তুমি ছাড়া দিন ঘরে আমার পাশে বসে থাকো এটা কি ঠিক? এই কাজ সেই কাজ করে মাকেতো একটু সাহায্যও করতে পারো। আমি তখন কাঁপা কাঁপা গলায় উনাকে বলতাম আপনার মা আমাকে কোন কাজ করতে দিলেতো করবো। তার আশেপাশে গেলেও বড় বড় চোখ করে আমাকে দৌঁড়ানি দেয়। আমার কথা শুনে সে কি হাসি তোমার শ্বশুড়ের। তার হাসিতে আমি পাগল হতাম সে মানুষ হিসেবে অমায়িক। তুমি হয়তো জানো না। তোমাকে আমার আগে তোমার শ্বশুড় মশাই দেখেছিলেন। সে তোমাকে দেখে ভীষণ পছন্দ করে তারপর আমাকে তোমার কথা বলে। তারপর তোমার বাবার সাথে কথা বলে, আসলে তোমার বাবা আর উনি একই সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছিলেন। তো তোমার সম্পর্কে খোঁজ নিতে যেয়ে তোমার বাবার সাথে দেখা। এতো দিনের পুরনো বন্ধুর মেয়ে হওয়াতে উনি বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য তোমাকে জয়ের বউ বানিয়ে নিয়ে আসে।

আমাকে বাবা কোথায় দেখেছিলেন মা?

মা: উনিতো বললো সে দিন ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিলো। রাস্তায় নাকি তোমার ছাতীটা তুমি কোন বাচ্চাকে দিয়ে নিজে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরছিলে তখন উনি তোমার পিছু নেয়। প্রথমেতো আমি খুব রেগে যাই এটা কোন গুন হলো একটা মানুষের এটাতো সামান্য একটা বিষয়। অনেকেই এমনটা করে। পরে উনি আমাকে বললেন উনি অনেকের কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছে এবং সবাই বলেছে ঐ এলাকাতে তোমাদের মত ভালো পরিবার আর একটাও নাই। তোমার বাবা মা এবং তোমরা সব ভাই বোন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো। কোন প্রকার খারাপ কোন কাজে কখনোই তোমার পরিবারের লোকজন জড়ায়নি। উনার কথায় আমারও মন ভরে গেলো। কেননা উনি কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এটা আমি ভালো করেই জানি। যখন বললো তুমি দেখতে কিছুটা কালো তখন খুব ভয় লাগছিলো, যদি জয় বিয়ে করতে রাজী না হয়। কিন্তু জয়কে যখন বললাম তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। আর মেয়ে আমাদের পছন্দের তখন সে কোন রকম প্রতিক্রিয়া না করে রাজী হয়ে গেলো। ব্যস তারপর তো আর কথাই নেই দুই বন্ধু মিলে বিয়ের তারিখ ঠিক করলো এবং এখন তুমি এখানে। বলেই মা হেসে দিলো।

আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ভালোবাসাকে বাঁধতে হয় মায়া দিয়ে। জোড় করে কি আর ভালোবাসা হয় মা? আপনার ছেলে যদি আমাকে ভালোবাসে তাহলে সে নিজেই আমার মায়ায় আমার কাছে ছুটে আসবে। আর যদি মানুষটা আমার না হয় তবে শত চেষ্টাতেও আমি তাকে আমার করে নিতে পারবো না।

আমার কথায় মা কিছুটা অবাক হলো। আমি মায়ের হাত ধরে বললাম আপনাদের ছেলে অনেক ভালো মানুষ। তাছারা আমার আল্লাহ জানেন আমার মনের কথা, তিনিতো বলেই দিয়েছেন “ভয় পেয়োনা! আমি তোমাদের সাথেই আছি। আমি সব শুনি এবং দেখি।” [সূরা ত-হা, আয়াত:৪৬], তাই আমি আমার আল্লাহর উপরই ভরসা রেখেছি। নিশ্চই আল্লাহ আমাকে নিরাশ করবেন না।

গল্প করতে করতে রান্না শেষে সবাই এক সাথে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে যার যার রুমে চলে আসলাম। আমি বিছানা গুছাচ্ছি আর জয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। জয় খুব চিন্তায় আছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তাই আমার বিছানা গুছানো শেষ হতেই আমি উনার পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম।

জয়: কিছু বলবে?

না তেমন কিছু না, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমাকে বলতে পারেন আপনি কি নিয়ে এতো চিন্তা করছেন।

জয়: আমি কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করছি তা তোমাকে কে বললো?

কেউ বলেনি তবে আপনার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। তাই প্রশ্ন করলাম। দেখুন কোন বিষয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ যত মুশকিল দিয়েছেন তার থেকে বেশী তার সমাধান দিয়েছেন।? আচ্ছা এটা বলেন আপনি কি আমাকে নিয়ে চিন্তা করছেন?

আমার প্রশ্নে জয় এবার কিছুটা চমকে উঠলো। আমি জয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে চিন্তার কিছু নেই। আমি আপনার কাছে যে ওয়াদা করেছি তা অবশ্যই পালন করবো। আর সবচেয়ে বড় কথা কোথাও কোন রকম ভাবে আপনার উপর দোষ চাপাবো না। এই বিশ্বাসটা রাখতে পারেন।

জয়ের চোখের কোনে পানি জমে এসেছে, কেন এই পানি আমি বুঝতে পারছি না। আর বুঝতেও চাচ্ছি না আরতো মাত্রই কয়েকটা দিন। তারপর থেকে আমার পথ আমার জয়ের পথ জয়ের।

চলবে…