মায়ার বাঁধন পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
336

মায়ার বাঁধন- ১৫তম শেষ পর্ব
©শাহরিয়ার

দেখতে দেখতে দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে জয়ের টেনশন যেন বেড়েই চলছে। সে নিজের সাথে যুদ্ধ করছে, চারিপাশের মানুষের মাঝে নানান রকম জিনিস খুঁজে চলছে। না কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে উপমাকে। যত বারই আপন করে পাবার জন্য চেষ্টা করছে ততবারই সমাজের কথা ভেবে পিছিয়ে পরছে। কাল সকালেই বিদায় হবে উপমা। তাই সে আর উপমাকে নিয়ে চিন্তা করতে চাচ্ছে না। তাই সে সব বন্ধুদের ফোন দিলো অনেক দিন পার্টি করা হয়না। বিকেলে সব বন্ধুদের একটা রেস্টুরেন্ট এ আসতে বললো।

উপমা: প্রতিদিনের মত আজও হাসিখুশি সব কাজ শেষ করে নিয়ে। একটা সাদা কাগজ নিয়ে বসে পড়লো চিঠি লেখতে। চিঠিটা লেখে টেবিলের উপর রেখে নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বের হলো রুম থেকে।

উপমাকে হুট করে এভাবে বের হতে দেখে মা ছুটে আসলেন।

মা: কোথায় যাচ্ছিস মা?

আমার নিজের ঠিকানায় মা।

মা: মানে কি তোদের কি কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া হয়েছে?

না মা আমাদের কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া হয়নি তবে আমি ব্যর্থ হয়েছি আপনার ছেলের হৃদয়ে আমার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে।

মা: কি সব উল্টা পাল্টা কথা বলছিস? এসব রাখতো আর তোর বাবাও বাসায় নেই আসুক তারপর কি সমস্যা দেখা যাবে।

না মা আমাকে আটকাবেন না। তাহলে যে আমি আমার আল্লাহর কাছে অপরাধী হয়ে যাবো। আমি আপনার ছেলের কাছে ওয়াদা করেছি তিন মাসের বেশী এখানে থাকবো না। মা আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?

মা: কি অনুরোধ?

আপনার ছেলেকে কোন কিছুই বলবেন না। আপনার ছেলেকে তার পছন্দ মত কারো সাথে বিয়ে দিবেন। এটা আমার আপনার নিকট অনুরোধ। সে অনেক ভালো একজন মানুষ আমারই ভাগ্য খারাপ। কালো হয়ে জন্মেছি,আসলে কালো মেয়েরা কবিদের কাব্যেই সুন্দর বাস্তবতায় তাদের কোন মূল্য নেই। সব খানেই অবহেলিত হতে হয়। তাই সব দোষ আমি আমার উপর নিয়েই এ বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।

মা: আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আর একটু পরেই রাত হয়ে যাবে। এভাবে রাত করে বাড়ি থেকে বের না হলে হয়না?

কথাটা বলেই মা কান্না করে দিলো। মাকে জড়িয়ে ধরে মা আপনি কাঁদবেন না। আপনার চোখের পানি যে আমি সহ্য করতে পারবো না। আমি চলে যাচ্ছি মা পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।

কথাটা বলে আর দাঁড়ানোর মত শক্তি পেলাম না। দ্রুত হেঁটে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। বাসায় যেয়ে কি জবাব দিবো? মিথ্যা কথা বলা সম্ভব নয়। তাই সব সত্যি সত্যিই বলবো। রাস্তায় এসে একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসলাম।

জয় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে হতে রাত নয়টা বেজে গেলো। আজ অনেক দিন পর হালকা ড্রিংক ও করেছে। মাথাটা কেমন ঝিম ধরা ভাব এসেছে। সব বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি স্ট্রার্ট দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। গাড়িটা সিগনালে এসে দাঁড়ালো, রাস্তার পাশে ফুলের দোকানে নজর পরতেই দেখতে পেলো একজন সুন্দর সুদর্শন ছেলে তার পাশে একজন কালো বোরখা পরা মেয়ে আর সে মেয়ের কোলে ছোট একটা কিউট মেয়ে। ছেলেটা এক হাতে ফুলের তোড়া আর এক হাতে মেয়েটার হাত শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটছে যেন কেউ তাদের দু’জন কে আলাদা না করতে পারে। ব্যস্ত শহর কতশত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। তাদের কাছ থেকে নিজের স্ত্রীকে কত সুন্দর ভাবে আগলে রাখছে। মুহুর্তেই মাথার ঝিমঝিম ভাবটা কেটে গেলো। ভালোবাসাতো একেই বলে। আসলেইতো মানুষের সুন্দর্য মনে থাকে তার বাহিরের চাকচিক্যতে নয়। আমি একজন শিক্ষিত ছেলে হয়েও কেমন করে এতো বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। না আর না নিজেকে নিজেই আমি ক্ষমা করতে পারবো না। আমাকে আজই যেয়ে উপমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। আর ওকে অনেক অনেক ভালোবাসা দিতে হবে।

সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে গাড়ির হর্ণে বাস্তবতায় ফিরে আসে। দ্রুতই গাড়ি সাইড করে ফুলের দোকান থেকে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে দ্রুতই গাড়ি স্ট্রার্ট দিয়ে বাড়ির পথে ছুটলো।

রাত সাড়ে এগারোটা পঁচিশ মিনিটে বাড়িতে আসলো জয়। নিচেই বাবা মা বসে রয়েছে মুখ গম্ভীর করে। জয় মা বাবার দিকে তাকিয়ে বললো কি হয়েছে তোমাদের? উপমা কোথায়?

মা: কিছু না তুমি রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।

বাবা মায়ের এমর আচরণের সাথে জয় পরিচিত না। তবুও নিজেকে সামলে উপরে উঠে এসে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। ঘর প্রতিদিনের মত খুব সুন্দর করে সাজানো। ঘরের কোথাও উপমা নেই। টেবিল ল্যাম্পের নিচে একটা সাদা কাগজ রাখা দ্রুতই ফুলের তোড়াটা সেখানে রেখে সাদা কাগজটা হাতে নিতেই সুন্দর হাতের লেখায় একটা চিঠি। চিঠিটা যে উপমাই লেখেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

চিঠিতে লেখা।

আসসালামু আলাইকমুস, আশা করছি আপনি এতো সময়ে জেনে গেছেন আপনার পথের কাটা আপনার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আমি আপনাকে করা আমার ওয়াদা রক্ষা করেছি। আপনি জানেন না হয়তো আপনাকে আমি কতটা ভালোবেসে ফেলেছিলাম। হয়তো কখনো বলতে পারিনি ভালোবাসি আপনাকে। আর হয়তো কখনো বলতেও পারবো না। আমি মাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলে যাবো। আপনার কোন চিন্তা করতে হবে না। আর সময় করে কাল আপনার আর আমার ডিভোর্সের পেপারটাও পাঠিয়ে দিবো। জানেন যখন বাবা মা বললো তোর জন্য যে বর ঠিক করেছি সে কোন রাজ পুত্রের চেয়ে কম না। তখন থেকেই আমার মনটা আপনাকে দেখার জন্য কেমন অস্থির হয়েছিলো। বিয়ের দিন যখন আড়চোখে আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম। আমার মুখ থেকে প্রথম বের হয়ে এসেছিলো সুবাহানাল্লাহ। সত্যিই আপনি রাজ পুত্রের চেয়ে কোন অংশে আপনি কম না। যাই হোক আপনি আপনার মনের মত কাউকে খুঁজে নিবেন এটাই আমার বিশ্বাস। আমি আমার আল্লাহকে বিশ্বাস করি। আর যে তার আল্লাহর উপর ভরসা রাখে তার জন্য আর কিছুরই প্রয়োজন নেই। আপনি খুব গুছানো মানুষ সব সময় এমনই থাকবেন এটাই আমার প্রতাশা। ভালো থাকবেন আসসালামু আলাইকুমস।

উপমার চিঠিটা পড়ে কেমন জানি সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো দাঁড়ানো থেকে বিছানায় বসে পরলো। মেয়েটার ফোন নাম্বার ও কখনো নেয়া হয়নি। দ্রুত নিচে নেমে আসলো জয় মায়ের কাছে এসে মা উপমা চলে গেলো তোমরা আমাকে একবার ফোন দিবে না? ওকে তুমি আটকাবে না?

মা: আমরা কেন আটকাবো? তোর মত শিক্ষিত বুদ্ধিমান ছেলের কাছ থেকে আমরা এতোটা নিচু মন মানুষিকতা আশা করিনি।

বাবা: আমি কি করে ওর বাবার সামনে দাঁড়াবো? কোন মুখে ওদের সাথে কথা বলবো এটাই ভেবে পাচ্ছি না।

জয়: মা তোমার কাছে ওর নাম্বার আছে?

মা: না আমার কাছে নেই।

জয়: কি করছো নাম্বারটাও রাখোনি? আমি না হয় বোকা তোমরাতো ওর নাম্বারটা রাখতে পারতে। আমার খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছে মা। আমাকে এখুনি বের হতে হবে।

মা: এতো রাতে বের হবি?

জয়: আর কোন উপায় নেই মা। নয়তো অনেক দেরী হয়ে যাবে।

বাবা: কি করবে না করবে আমি জানি না। আমি শুধু জানি আমার বউমা আমার বাসায় ফিরে আসব। কেমন করে পারবে কোথায় থেকে পারবে তা একান্তই তোমার ব্যাপার।

জয় আর কোন কথা না বলে বাসা থেকে বের হয়ে পরলো। গাড়ি দ্রুত এগিয়ে চলতে থাকলো উপমাদের বাড়ির দিকে। আজ যেন রাস্তা শেষই হচ্ছে না। গাড়ির স্পীড যতই বাড়ানো হচ্ছে মনে হচ্ছে ততই রাস্তা বেড়ে যাচ্ছে। দু’চোখ থেকে কেমন জানি টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরছে।

রাত তিনটার সময় গাড়ি এসে দাঁড়ালো উপমাদের বাড়ির নিচে। কেমন করে কোন মুখে বাড়ির ভিতর ঢুকবো নানার রকম চিন্তা ভাবনা সব কিছুকে দূরে ঠেঁলে অবশেষে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলো জয়। কলিং বেল চাপবো কি চাপবো না ভাবতে ভাবতে একটা সময় হাত একাই চলে গেলো কলিং বেলটার উপর। পরপর দুইবার চাপ দিয়ে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো জয়। তৃতীয় বার চাপ দেবার আগেই দরজাটা খু্লে গেলো। অবাক চোখে দরজার ওপাশে জয় তাকিয়ে রয়েছে।

উপমা: দরজা ছেড়ে সরে যেয়ে ভিতরে আসুন।

জয় কোন কথা বলতে পারছে না মাথাটা নিচু করে ভিতরে ঢুকলো।

কি ব্যাপার কোন সমস্যা আপনি এতো রাতে এখানে? আমি চিঠিতে লেখে দিয়েছি কাল আপনাকে ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দিবো।

জয়: দু’হাতে উপমার দু’হাত চেপে ধরে আমার ভুল হয়ে গিয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কখনো এমনটা হবে না। আমাকে আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও। আমার সাথে চলো।

অনেক রাত হয়েছে রাতে কিছু খেয়েছেন? নিশ্চিই এখনো কিছু খাওয়া হয়নি আপনার। আপনি বসুন আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।

কথাটা বলে ঘুরতে যাবো ঠিক সেই মুহুর্তে পেছন থেকে হাত ধরে টান দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো জয়। মুহুর্তেই জয়ের বুকের সাথে যেয়ে মিছে গেলাম।

জয়: আমার মুখে খাবার যাবে না এখন তুমি বাড়ি ফিরে চলো।

আপনি এসেছেন আমি যাবো। কিন্তু এতো রাতে গেলে সবাই খারাপ মনে করবে। শ্বশুড় বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে বের হয়না। আপনি বসেন আমি খাবার নিয়ে আসি।

বলে ডাইনিং থেকে যেয়ে খাবার নিয়ে আসলাম। প্লেটে খাবার পরিবেশন করলাম।

জয় খাবার হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে তুমিও নিশ্চই রাতে খাওনি। আমি খাবার তুলে নিতেই দু’চোখ থেকে পানি পরতে শুরু হলো।

জয়: আরে আরে তুমি কাঁদছো কেন?

কিছু না এমনি আপনি খান। দু’জন একই প্লেটে খাবার খেতে খেতে ভোর হয়ে আসলো। দূর মসজিদ থেকে ফজরের নামাজের সুর আসছে। আপনি বিছানায় শুয়ে পরেন আমি নামাজ পড়ে নেই।

জয়: তুমি একা কেন পড়বে? আজ থেকে আমিও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বো।

জয়ের মুখ থেকে নামাজের কথা শুনে আমার হৃদয়টা আনন্দে ভরে উঠলো। দু’জন এক সাথে নামাজ শেষে আমি কোরান তেলোয়াত শুরু করে দিলাম। জয় গভীর মনোযোগ দিয়ে তেলোয়াত শুনছে।

যখন আমি আল্লাহর সাহায্য চাই, কোরআন বলে। “ভেঙে পড়না, নিরাশ হইওনা, আল্লাহর সাহায্য আসবেই এটা আল্লাহর ওয়াদা। জেনে রেখ আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।” [সূরা বাক্কারা :২১৪]। তিনি আর একটি আয়াতে বলেন, “আল্লাহ কষ্টের পরেই সুখ দিবেন!”[সূরা তালাক : ০৭]

এর চেয়ে ভালো এর চেয়ে সুন্দর আর কি হতে পারে? এখন শুধুই আগামি দিনের অপেক্ষা যেখানে আমার আল্লাহ আমার জন্য সুখ লেখে রেখেছেন।

সমাপ্ত।