মায়ার বাঁধন পর্ব-১০+১১

0
220

মায়ার বাঁধন-১০ম পর্ব
©শাহরিয়ার

নামাজ পড়ে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় শেষে, মোনাজাতে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করলাম যেন এমনি করে সারা জীবন সুখ আর আনন্দে থাকতে পারে যেখানে আর যেভাবে থাকি। তখন আল্লাহর একটি আয়াত বার বার কানে ভেসে আসছিলো। “নিশ্চয় তোমার রব তোমাকে এত বেশি দিবেন যে তুমি অচিরেই খুশি হয়ে যাবে” (আল কোরআন।),

নামাজ শেষে খালাম্মার সাথে নাস্তার জন্য ডাইনিং এর দিকে রওনা হলাম। ডাইনিং এ যাবার পথে বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন। সেই সাথে দেয়ালা টাঙানো ছবি গুলো দেখিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম এরা কারা? খালাম্মা তখন একগাল হেঁসে বললেন এরা আমাদের পূর্ব পুরুষরা। এরা সবাই জমিদার ছিলেন। এভাবেই গল্প করতে করতে একটা সময় ডাইনিং এর সামনে এসে উপস্থিত হলাম। বিশাল বড় ডাইনিং হল। সেই সাথে বিশাল একটা টেবিল। যার সমস্ত জুড়ে প্লেটে সাজানো রয়েছে নানান রকম পিঠা, ফিরন্নী,পায়েস, ফলমূল এবং রঙ্গীন শরবত দিয়ে। আমি অবাক চোখে খালাম্মার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম এগুলো কখন করলেন?

খালা: এক গাল হেঁসে তোমার শাশুড়ি যখন গতকাল ফোনে বললো তোমরা আসবে, তখনি লোকজন কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। তারাই সব করেছে আমাকে কিছু করতে হয়নি। টেবিলের দু’পাশে সেই দু’জন মেয়েকে দেখিয়ে দিয়ে ওরা আমার মামাতো ভাইয়ের মেয়ে, আমার এখানেই থাকে। আসলে আমার সাথে এখানে থাকার মত তো আর কেউ নেই তাই ওদের আমার সাথে রাখি। তোমার খালু মারা গিয়েছেন বেশ কিছু বছর হলো। আমাদের একটা মাত্র মেয়ে সেও বহু বছর আগে লন্ডনে পড়ালেখা করতে যেয়ে আর ফিরে আসেনি। সেখানেই বিয়ে করে সংসার বেঁধেছে। মানুষ কোথায় কি করবে বলা যাবে না। আমার মেয়েটা যখন খুব ছোট তখন আমার স্বামী মারা যায়। সবাই বলেছে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য, কিন্তু আমি করিনি। আসলে সংসার জীবন একটা মায়া। যে এই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যাবে। তার কাছে পৃথিবীর সমস্ত কিছুই ফিকে হয়ে যাবে। কখনো কারো মায়ায় জড়ালে দেখবে এক জীবনে আর তার মায়া কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। এটাই বাস্তবতা এটাই প্রকৃতির নিয়ম। যেমন আমি আজও তোমার খালুজানের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে রয়েছি। আর ঐদিকে মেয়েটা কোন এক বিদেশীর মায়ার বাঁধনে আটকা পরে আমাকে এ দেশকে ভুলেছে। সে তার দেশে আটকা পরেছে।

জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত মানুষকে সংগ্রাম করতে হয়। কখনো অন্যের সাথে, কখনো বা নিজের সাথে। সর্বশেষ নিজেকে নিজে বুঝ দিতে হয়, নারী মানেই ত্যাগ, যে নারী যতত্যাগ স্বিকার করতে পারবে সে নারী ততবেশী সুখি হতে পারবে। মেয়েটাকে একটু দেখার জন্য, একটু স্পর্শ করার জন্য কখনো কখনো বুকের ভিতরে হাহাকার করে উঠে। অথচ তাকে দেখতে পাই না। একটু ছুঁয়ে দিতে পারি না, তখন আমিই শুধু বুঝি কেমন যন্ত্রনা হয়। কতটা কষ্ট লাগে অথচ, সে কষ্ট লুকিয়ে সবার সামনে হাসি মুখে নিজেকে উপস্থাপনা করা মানুষ আমরা নারীরা।

দু’জন গল্প করতে করতে ডাইনিং এ জয় এসে উপস্থিত হলো। খালাম্মার চোখের ইশারায় মেয়ে দু’টো সেখান থেকে বের হয়ে আসলো। এদিকে খুব দ্রুত খালাম্মার চোখের কোনে জমে থাকা পানি গুলো সে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিলো, যেন কারো চোখে না পরে তার চোখের পানি। কিন্তু আমার চোখ যে তা এড়িয়ে যেতে পারেনি। আমি খুব সহজে একটা জিনিস বুঝলাম পাওয়া না পাওয়ার হাহাকার সবার মাঝেই রয়েছে। তাই বাহিরের কাঠিন্য দেখে কারো ভিতরটা বিবেচনা করা বোকামি। আবার কারো বাহিরের মিথ্যা অভিনয়ে ভিতরের কুলশিত মানুষটা চিনতে আমাদের ভুল হয়ে যায়।

তিনজন এক সাথে নাস্তা খেতে বসে খালাম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম, ওদের কেন চলে যেতে বললেন? ওরাও আমাদের সাথে নাস্তা করতো।

খালা: ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে ওরা এখন নাস্তা করবে না। কিছুক্ষণ পর একেবারে রাতের খাবার খাবে।

জয়: খালা মনি তোমার কি আপুর সাথে কথা হয়?

খালা: একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হয় আর কি মাঝে মাঝে, সে তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে এখন। আসলে সন্তানরা বড় হচ্ছে তাদের লেখা পড়া, এই সেই নিয়ে সারা দিন খুব ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে।

খালার মুখটা মুহুর্তে কালো বর্ণের হয়ে গেলো চোখ দু’টোতে আবার পানি জমতে শুরু করছে। কি এক তীব্র যন্ত্রনা তার অন্তর জুড়ে। কেউ বুঝে না, কেউ কখনো বুঝতে চায়নি হয়তো। কেন জানি না হুঁট করে আমার হাতটা এগিয়ে যেয়ে খালার হাত চেঁপে ধরলো। সাথে সাথে খালাম্মা হাউমাউ করে কান্না করে দিলো। বাঁধ ভাঙা কান্না, জয় এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।

জয়: একি হলো তুমি কান্না করছো কেন খালা?

খালাম্মা কিছুটা সময় পর কান্না থামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছু না। চোখের পানি মুছে কিছুনা। তোরা খাওয়া শুরু কর।

খালাম্মার চোখের পানি দেখে হয়তো জয়ের ও পেটের ক্ষুধা মিটে গিয়েছে। আমার ও আর খেতে ইচ্ছে করছে না। জয় হাত ধুয়ে খালাম্মার কাছে এসে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে তোমার মন খারাপ করে দিলাম তাই না?

খালা: ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে পাগল ছেলে বলে কি? আমি ভালো আছি একটুও মন খারাপ নেই। এই যে তুই বিয়ে করেছিস বউ মাকে নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছিস। আমার কি মন খারাপ করলে চলবে বল? এখনতো আমার খুশির সময় আনন্দের সময়। এখন কি আমার মন খারাপের সময় রয়েছে?

তিনজন গল্প করতে করতে ডাইনিং থেকে বের হয়ে আসলাম। খালাম্মা আমাদের দু’জনকে দু’তলার আমাদের রুমে নিয়ে আসলো। খালাম্মা নিজেই ঘরের সব জানালা গুলো খুলে দিলো। দক্ষিনের জানালাটা খুলে সে সেখানে থেকেই বাহিরে তাকিয়ে রইলো। আমি খুব আস্তে করে তার পাশে যেয়ে কাঁধে হাত রাখলাম।

খালা: জানিস মা একটা সময় দু’তলার রুমে থাকতাম। এখন উঠতে নামতে কষ্ট হয় তাই থাকি না। কত স্মৃতি রয়েছে এ সকল রুমে। কত রাত জেগে ঐ যে পুকুরে চোখ রেখেছি। সেখানে পূর্নিমার চাঁদের আলো এসে পরতো। সে আলোয় পুকুরের ফুটে থাকা শাপলা গুলো বাতাসে খেলে যেতো। সে কি সোনালি দিন ছিলো। তোমার শাশুড়ি আমি আর সব বান্ধবীরা সকলে মিলে ঐ পুকুরে কত সাঁতার কেটেছি। এখন সবই অতীত। সকলে যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত শুধু ব্যস্ততা নেই আমার।

বেশ কিছুটা সময় খালাম্মা সাথে গল্প করলাম। একটা সময় খালাম্মা রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো। আমি দক্ষিণের জানালাটা দিয়ে তাকালাম। সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। যেমনটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বহুগুন সুন্দর এই জায়গা আর তার পরিবেশ।

আমি আর জয় বেশ কিছুটা সময় বসে বসে গল্প করলাম, টুকটাক ঘরটা গুছিয়ে নিলাম। যেহেতু কয়েকটা দিন থাকবো সেহেতু ঘরটা আমার মনের মত করেই আমি গুছিয়ে নিলাম। নামাজ পড়ে উঠে বিছানায় বসার পর পর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। যেয়ে দরজা খুলে দিতেই। বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার শাশুড়ির মামাতো ভাইয়ের মেয়েদের একজন। আমাকে দেখে হাসি দিয়ে ভাবী ফুপু তোমাদের রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে।

উপমা: আচ্ছা যাবো তার আগে তুমি ভিতরে আসো। আর তোমার নাম কি?

পারু: না না ভাবী এখন আসবো না, অন্য আরেক সময় আসবো। আর আমার নাম পারু।

বাহ্ তোমার নামটাতো খুবি মিষ্টি আর তোমার ঐ বোনের নাম কি?

পারু: ওর নাম পরী ও ছোট আমি বড়। ও আমার চেয়ে দেখতে সুন্দর বলে বাবা মা ওর নাম রেখেছে পরী। বলেই একগাল হেসে নিলো পারু।

কি মায়িবী চেহারা মেয়েটার সেই সাথে হাসিটাও মাশাআল্লাহ। যতদিন বেঁচে থাকবো এই হাসিটা ভুলবো না। আচ্ছা পারু তুমি যাও আমরা আসছি।

জয়কে সাথে নিয়ে কিছু সময় পর সেই বিশাল ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলাম। সেখানে আগে থেকেই খালাম্মা বসে রয়েছেন। আমরা তার সাথে টেবিলে যোগ দিলাম। পরী আর পারু তিনজনকে প্লেট এগিয়ে দিলো। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম পরী আর পারু তোমরাও বসো আমাদের সাথে।

পরী: মিষ্টি কণ্ঠে না না ভাবী আপনারা হইতাছেন মেহমান আগে আপনারা খাবেন তারপর আমরা খাবো।

আরে বসোতো আমি সবাইকে খাবার তুলে দিচ্ছি। কে বলেছে আমি মেহমান? আমি এ বাড়ির বউ, কথটা বলেই পরী আর পারুর হাত ধরে তাদেরকে টেবিলে বসালাম। খালাম্মা বেশ খুশিই হলেন আমি ওদের টেবিলে বসিয়েছি এটা দেখে। আমি পরীর দিকে তাকিয়ে, শোন তোমরাও আমার বোন, আমরা যে কয়দিন আছি এক সাথে খাবো, এক সাথে ঘুরবো। আর তাছাড়া আমিতো আর তেমন কিছু চিনি না বা জানি না। তোমরাইতো আমাকে ঘুরিয়ে সব দেখাবে। সেই তোমরাই যদি দূরে দূরে থাকো, তাহলে কেমন করে হবে বলোতো? কথা বলতে বলতে সবার প্লেটে খাবার তুলে দিলাম।

গল্প করতে করতে একটা সময় রাতের খাবার শেষ করলাম। খালাম্মা আর পরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের রুমের দিকে রওনা হলাম।

পরী: পেছন থেকে ভাবী রাতে কোন কিছুর দরকার হইলে আমাদের ডাক দিয়েন। আমরা আপনার পাশের রুমেই থাকবো।

আমি ওর দিকে ঘুরে হেসে আচ্ছা বলে হাঁটা শুরু করলাম। দু’তলায় নিজেদের রুমে ঢুকতেই মিষ্টি একটা গন্ধ এসে নাকে লাগলো। আমি জয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম কিসের ঘ্রাণ এটা?

জয়: সম্ভবত কোন ফুলের ঘ্রাণ হবে বাহির থেকে আসছে।

আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে তেমন কাছে কোথাও ফুলের গাছ দেখতে পেলাম না। তাই জয়কে বললাম গাছতো দেখছি না। আমি বরং পরী বা পারুকে জিজ্ঞাসা করে আসি এটা কিসের ঘ্রাণ।

কথাটা বলে হেঁটে বের হতে যাবো এমন সময় পেছন থেকে জয় আমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো। বুকের ভিতরটায় ধকধক করে উঠলো।

চলবে…

মায়ার বাঁধন-১১তম পর্ব
©শাহরিয়ার

হৃদয়ের মাঝে ধকধকানি সেই সাথে সমস্ত শরীর কেমন জানি কেঁপে উঠলো। কিছুটা ভয় নিয়েই পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠলাম!

মুহুর্তেই সব যেন বরফ হয়ে গেলাম। জয় আমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরেনি। জয় খাটের উপর শুয়ে রয়েছে আর আমার আঁচল টেবিলের এক কোনায় লেগে আটকে পরেছে। নিজের এমন বোকামির জন্য মনে মনে বেশ লজ্জা পেলাম। আসলেইতো যে আমাকে ভালোবাসে না। মন থেকে ঠিকমত পছন্দ করে না, সে কেন আমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরবে তা একবার ও ভাবলাম না? মাথা নিচু করে টেবিলের কোনা থেকে শাড়ির আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে রওনা হলাম পরীদের রুমের দিকে, দরজার সামনে আসতেই পেছন থেকে জয় বলে উঠলো এতো রাতে যাওয়ার দরকার নেই। কাল সকালে জেনে নিও। জার্নি করে এসেছো শুয়ে ঘুমিয়ে পরো। কথাটা বলেই বিছানায় শুয়ে পরলো।

আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার ফিরে আসলাম বিছানার সামনে। জয়ের দিকে তাকিয়ে আপনি বিছানায় ঘুমান আমি না হয় নিচে শুয়ে পরি।

জয়: পাগল নাকি তুমি? নিচে ঘুমাবে মানে? কেউ যদি দেখে তাহলে কি একটা অবস্থার সৃষ্টি হবে? শোন আমরা আমাদের বাসায় যেমন থাকতাম ঠিক তেমনি থাকবো। আর হ্যাঁ তুমি আমাকে এতোটুকু বিশ্বাস করতে পারো। তোমার উপর কোন রকম স্বামীর অধিকার খাটাতে আসবো না।

জ্বি সে আমি ভালো করেই জানি, আপনি যে আমার উপর স্বামীর অধিকার খাটাতে আসবেন না। এতোটুকু এই কয়েক দিনে আমি বুঝে ফেলেছি। বলতে বলতে ঘরের ড্রীম লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে জয়ের পায়ের কাছ দিয়ে যেয়ে জানালার পাশ দিয়ে উঠে শুয়ে পরলাম। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। বাহিরে অবাক হবার মত জ্যোৎস্না উঠেছে আজ। নাকি জয় পাশে শুয়ে রয়েছে তার জন্য এতোটা ভালো লাগছে? কিন্তু যে মানুষটা আমাকে ভালোবাসে না সে আমার পাশে থাকলেই কি না থাকলেই কি? আস্তে আস্তে চাঁদের আলো ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। আমি কিছুটা উঠে বসে বাহিরে তাকালাম। পুকুরের পানি চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। পুকুরে ফুটে থাকা শাপলা ফুল গুলো দেখতে বেশ লাগছে।

কিছুটা আগ্রহ নিয়ে জয়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে গভীর ঘুমে মগ্ন। চাঁদের আলোয় বেশ লাগছে জয়কে। ইচ্ছে করছে কাছে যেয়ে গালে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু মন চাইলেই সব কিছু সম্ভব নয়। চোখের সামনে দেখতে পাওয়া চাঁদকে যেমন ধরা যায় না। ঠিক তেমনি আমার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাকেও চাইলে আমি ধরতে পারবো না। ভাবতে ভাবতে ঘুরে জানালা লাগিয়ে শুয়ে পরলাম। নানান রকম কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম।

পরদিন সকালে নাস্তা শেষ করে পরীকে জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ির পাশে কি ফুল গাছ রয়েছে যা থেকে এতো সুন্দর মিষ্টি ঘ্রাণ আসে?

পরী: হাসতে হাসতে ওমা! তুমি জানো না ভাবী?

না আমি জানি না তুমি আমাকে বলো।

পরী: নিচে অনেক ফুল গাছ আছে, বেলীফুল হাসনা হেনা, মাধুবী লতা। সম্ভবত হাসনা হেনার ঘ্রাণই তুমি পেয়েছো।

হুম খুব মিষ্টি ঘ্রাণ।

জয়: পরীর দিকে তাকিয়ে তোরা ওকে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আয় চারিপাশটা।

খালা: ও একা যাবে কেন? তুই ও সাথে যা।

জয়: না আমি এখন যাবো না। তাছাড়া আমারতো আর কোন কিছু অপরিচিত না। সব কিছুই আমার জানাশুনা।

খালা: সে ঠিক আছে কিন্তু আগেতো একা ঘুরে দেখেছিস আর এখনতো সাথে বউ রয়েছে। এখনকার ঘুরা কি আর আগের মত হবে? দু’জন ঘুরবি ভালো লাগবে।

জয়: সমস্যা নেই পরে যাবো আমি, আপাতত ও একাই যাক ওদের সাথে।

খালা: যা তোদের ইচ্ছে আমাদের একটা সময় ছিলো। তোর খালুর সাথে কোথাও বেড়াতে গেলে তোর খালুতো আমাকে এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দিতো না। আর তুই নতুন বউকে পাঠাচ্ছিস একা ঘুরতে।

আমি একটু হেসে খালাম্মার দিকে তাকিয়ে, সবার কি আর আপনার মত সৌভাগ্য আছে বলেন?

খালা: এসব বলতে হয়না মা। আল্লাহ নিশ্চই তার প্রতিটা বান্ধার সম্পর্কে জানেন। এবং কার কি প্রয়োজন তা তিনিই পূরণ করেন।

খালাম্মার কথা গুলো আমার বেশ ভালো লাগে। মুহুর্তেই মন আনন্দে ভরে উঠে উনিতো ঠিকই বলেছেন। আল্লাহ অবশ্যই তার প্রতিটা বান্দার ভালো চান। ভাবতে ভাবতেই পরী বলে উঠলো ভাবী চলুন আমরা নিচে যেয়ে ঘুরে আসি। আর ঘুরতেও অনেক সময় লাগবে বিশাল বড় জায়গা।

খালা: আচ্ছা তাহলে আর কি তোরা তিনজন মিলে ঘুরে দেখ যেয়ে জয়ের যখন মন চাইবে তখন যাবে।

পারু আর পরী দু’জন দু’হাত ধরে আমাকে নিয়ে বাড়ির বাহিরে বের হলো। এদিক সেদিক নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো আর একে একে সব কিছুর বিবরণ দিতে লাগলো। বাড়ির পেছনে এসে অনেক রকম ফুল গাছ দেখতে পেলাম। যার অনেক ফুলের নাম আমি জানিও না। সত্যিই আল্লাহর সৃষ্টি অপূর্ব।

খুব সুন্দর করে সাজানো বাগানের ভিতরে এসে দেখতে পেলাম একটা দোলনা লাগানো। পারু আমার দিকে তাকিয়ে বললো ভাবী এসো দোলনায় দোল খাবে।

আরে না না কি বলছো? এসবের বয়স কি আর এখন আমার আছে?

পরী: ভাবী কি যে বলো না। এটা কি ছোটদের জন্য নাকি? এ দোলনা বড়দের জন্যই। আর এই দোলনা অনেক বছর আগের। এটাতে আমাদের পূর্ব পুরুষরা। তাদের অর্ধাঙ্গিনীকে সঙ্গে নিয়ে বসতো। আর এখন আমরা নিজেরাই বসি। কখনো আমি বসি ও ধাক্কা দেয়। আবার কখনো ও বসে আমি ধাক্কা দেই।

ওদের কথামত দোলনায় যেয়ে বসলাম, ওরা দু’বোন হাসছে আর আস্তে আস্তে দোলনায় ধাক্কা দিচ্ছে। মুহুর্তেই বাতাসে মাথার খোলা চুল উড়তে শুরু হয়ে গেলো, এতো ভালো লাগছিলো বলে বুঝানোর মত না। মনে মনে চাচ্ছিলাম জয় যদি পাশে থাকতো তবে আরও বেশী মজা হতো। কিন্তু সব চাওয়ারা পূর্ণতা পায় না সে আমি ছোট বেলা থেকেই বুঝতে শিখেছি। তাই তার পাশে না থাকার অপূর্ণতায় আমার মন ঠিক ততটা খারাপ হলো না যতটা খারাপ হবার কথা ছিলো। বরং ওদের দু’বোনের মিষ্টি হাসিতে মুহুর্তে মন ভালো হয়ে গেলো। আমিও ওদের সাথে সাথে হাসতে লাগলাম। এই অল্প সময় আমরা তিনজন বেশ ভালো বন্ধ হয়ে গেলাম।

দু’জন মিলে আমাকে ধরে দোলনা থেকে নামিয়ে নিয়ে আসলো ছোট পুকুরটার কাছে। রাতে জ্যোৎস্নার আলোয় দূর থেকে না যতটা সুন্দর লেগেছিলো কাছ থেকে তা আরও বেশী সুন্দর লাগছে। তিনজন পাথরে বাঁধা সিঁড়ি ধরে নেমে যেয়ে পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়ালাম। পরী কিছুটা হাত দূরে হাত দিয়ে শাপলা গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ে এনে আমার কানের পাশে গুজে দিলো। বলতে লাগলো ভাবী তোমাকে বেশ মানিয়েছে। হেসে দিয়ে বললাম তোমরা দু’জন এতো সুন্দর যে তোমাদের আলোয় আমি মনে হয় আজ আলোকিত হচ্ছি।

পরী: কি যে বলো না ভাবী, তুমিও অনেক সুন্দর বুঝলে। মানুষের বাহিক সুন্দর্য্যই কি আসল নাকি? এই যে তুমি কত সুন্দর ভাবে আমাদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছো কথা বলছো, আমাদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছো এটাইতো আসল সুন্দর্য্য, সব মানুষ তোমার মত সুন্দর মনের অধিকারী হয়না বুঝলা ভাবী। অনেকের জমিদার বাড়ির বউ সে অহংকারে পা মাটিতেও পরতে চাইবে না।

সিঁড়িতে বসে পানিতে পা ভিজিয়ে দীর্ঘ সময় ওদের সাথে গল্প করতে করতে একটা সময় যোহরের আজানের সুর কানে ভেসে আসলো। পরী আর পারুকে বললাম চলো বাসার ভিতর যাই ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়বে।

পরী আর পারু বলে উঠলো আর একটু থাকি ভাবী তারপর না হয় যাবো।

আমি না না এমনটা বলো না, শোন নামাজের সময় কোন রকম অযুহাত দিয়ো না তোমরা। কেননা নামাজের সময় কোন কাজ করা যাবে না। তোমরা হয়তো জানো না, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
“যে যুবক-যুবতী যৌবনে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকবে, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে আরশে পাকের ছায়া তলে আশ্রয় দান করবেন। “[সহীহ বুখারী-৬৮০৬],

তাই যখনি নামাজের আওয়াজ কানে আসবে, সাথে সাথে সকল কাজ কর্ম বাদ দিয়ে নামাজে চলে যাবে। আল্লাহ সকল মুশকিলের সমাধান করে দিবে দেখবে।

পরী: ভাবী আমরাতো আগে কখনো এমন করে ভেবে দেখেনি।

পারু: হ্যাঁ ভাবী তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবার জন্য। এখন থেকে যখনি নামাজের সময় হবে আমরা নামাজ পড়তে চলে যাবো।

তিনজন খুশি মনে বাসার ভিতর চলে আসলাম। ওযু করে নামাজ পড়তে রুমে চলে আসলাম। জয় রুমে শুয়ে ছিলো আমাকে দেখে।

জয়: কি ঘুরাঘুরি শেষ?

হ্যাঁ আপাতত শেষ। নামাজ পড়বো, তারপর যদি আবার সময় পাই ঘুরবো। আপনি নামাজ পড়বেন না?

জয়: তুমি পড়, বলেই খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো।

শুনেন, নামাজ পড়লে মনের সকল অশান্তি দূর হয়ে যাবে। মন শান্ত থাকবে সব কিছু ভালো লাগবে। আর যত মুশকিল আছে তারও সমাধান হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।

জয় কিছু বলতে চেয়েও না বলে চলে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পরলাম। নামাজ শেষে আমার মনে হলো আচ্ছা আমি কেন এভাবে ভেঙে পরছি? আশাহত হচ্ছি যেখানে, আল্লাহর নবী (স.) বলেছেন: ‘আশা-আকাঙ্খা আমার উম্মতের জন্য একটি রহমত স্বরূপ, যদি আশা না থাকতো তবে কোন মা তার সন্তানকে দুধ পান করাতো না এবং কোন মালিই গাছ লাগাতো না’ (তথা কোন কৃষকই চাষাবাদ করতো না)। (সাফিনাহ, আমাল, পৃ. ৩০)।

আমাকেও শেষ দিন শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত জয়ের মনে জায়গা পাবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কেননা আল্লাহ চাইলে অবশ্যই জয়ের মন নরম হবেই।

চলবে…