মায়া পর্ব-০৩

0
414

#মায়া
পর্ব ৩
লেখা – #Alisia_Amber (ছদ্মনাম)
.
[কপি করা নিষেধ]

রাতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম খেয়ালই নেই। পাখির কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঝিড়িঝিড়ি বাতাসে মন যেনো জুড়িয়ে যায়। জানালা খোলা থাকার দরুন রৌদ্র এসে একদম মুখ বরাবর ঠেকছে।

‘আম্মা আইবাম?’

অপরিচিত কন্ঠস্বরে দরজায় তাকালাম। একজন অর্ধবয়স্ক মহিলা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়ানো। হাতে একটা টাউয়েল আর ব্রাশ দিয়ে গেলেন আমায়।

ইস্তত করে বললাম, ‘মানে আপনি?’

উনি বললেন, ‘শুদ্ধ বাবা আমারে খালা ডাকে আম্মা। আমনেও তাই ডাইকেন’

‘আচ্ছা।’ -বললাম আমি।

‘শুদ্ধ বাবা এগুন পাডাইছে। আমনের আর কিছু লাগলে মোরে কইবেন’

‘আচ্ছা খালা।’

ভাবলাম ছেলেটা এতকিছুর খেয়াল রাখে কিভাবে? খালা চলে গেলেন। সারাদিন কেটে গেলো রুমেই। সন্ধার দিকে দরজায় নক হতেই দেখলাম আমার শাশুড়ী এসে রুমে প্রবেশ করছেন। আমার হাতে একটা সুতি শাড়ি আর প্রয়োজনীয় টুকটাক জিনিস দিয়ে বললেন ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আমার দুহাত উনার হাতের মুঠোয় ভরে বললেন, ‘তখনকার কথায় কষ্ট পেয়েছিলে?’

‘না আন্টি’ -আস্তে করে কথাটা বললাম।

উনি আবারো বললেন, ‘আমি চেয়েছিলাম তুমি সুখী হও। তোমাকে সম্পর্কের দোহায় দিয়ে বেধে রাখতে চাই নি। তবে আমি বুঝতে পারি নি আমার কথার কারণে তোমাকে ভাবী এতগুলা কথা শুনাবেন। আমিও মেয়ে মা, আমি বুঝি। তবে সবক্ষেত্রে মাথা নিচু করে সবার কথা কেনো শুনবে? তোমার নিজের ব্যাক্তিত্ব শক্ত করো। নিজের পরিচয় তৈরি করো। শুদ্ধর বাবা তোমাকে নিজের মেয়ে বানিয়ে এ বাড়িতে আনতে চেয়েছিলো। তাই কখনোই এখানে থাকতে কিংবা কিছু করতে সংকুচ বোধ করবে না।

আর হ্যাঁ! শুদ্ধর বউ নয় নিজের পরিচয়ে তোমার বাবার বাড়িতে পা রাখবে। অতীতে অজানা তথ্যের উপর ভিত্তি করে নয় বরং লোকে যেনো অতীন নয় বর্তমানে বলে, তোমার মা ধন্য এমন মেয়ে জন্ম দিয়ে!

কথা দিচ্ছি কখনো আমার মেয়েটাকে কষ্ট পেতে দিবো না! আমার মেয়ে হয়ে থাকবি না?’

আজ আমি কাদলাম। সত্যি কাদলাম। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি কাদছি। হেচকি তুলে কাদছি। আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘মা! কেউ এভাবে বলে নি মা! কখনো বলে নি! এই মা মা গন্ধটাই কখনো পাই নি!’

মাও চোখের পানি মুছলেন। আমাকে নিয়ে বিছানায় বসে বললেন,
‘শুদ্ধর বাবা ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন। তোকে যেদিন প্রথম দেখলো সেদিনই ঠিক করলো তোকেই ছেলের বউ করে আনবেন। আমরা মা ছেলের কোনো কথাই শুনলেন না। উনার এক কথা শুদ্ধর বউ হবে মায়া’

কথাটা বলেই মা কেদে দিলেন। আবার বললেন, ‘সেদিন বেশ খারাপ ব্যবহার করি। কারণ ভার্সিটিতে শুদ্ধর তিথি নামের একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। শুদ্ধ আমার সাথে সব কিছু শেয়ার করে। ছেলেটার কথা ভেবে আমিও মেনে নিতে পারি নি অন্য কাউকে ছেলের বউ হিসেবে। কিন্তু শুদ্ধর বাবা তিথিকে কোনো ভাবেই পছন্দ করেন নি। রাগারাগির এক পর্যায়ে শুদ্ধর বাবার বুকে ব্যাথা শুরু হয়। আর ছোট খাটো স্ট্রোক করে। তার পরেই শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয় যাই হয়ে যাক শুদ্ধ তোকেই বিয়ে করবে। এর মধ্যে শুদ্ধর বাবার অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ। একের পর এক মেন্টাল প্রেসার দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা মা ছেলে। তাই তাড়াহুড়ো করে বিয়ের আয়োজন করি। সামনের মাসে ইন্ডিয়া যাওয়ার কথা। এসেই ভেবেছিলাম তোকে ঘরে তুলবো। কিন্তু দেখ কি থেকে কি হয়ে গেলো।

তুই জানিস তোর চেহারায় বিশাল এক মায়া। এই অবুঝ মেয়েটাকে আমি বেধে রাখতে চাই নি রে! তবে বুঝতে পারিনি ছেলের কথা ভেবে এই মা টা অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আমাকে ক্ষমা করিস মা!

আর শোন! শুদ্ধটার মন ভালো নেই। ক’টা দিন যাক তার পর বলবো তোকে এখানকার ভালো একটা ভার্সিটিতে এডমিশনের ব্যবস্থা করে দিতে। ঠিকাছে!

আমার মেয়ে হয়ে থাকবি এ বাড়ি তুই। আমি আমার ছেলেটাকে চিনি সে কখনো তার দায়িত্ব থেকে পিছপা হবে না। তবে আমার ছেলেটাকে কখনো কষ্ট দিস না মা। তোমাদের দুজনের সিদ্ধান্তকেই আমি সম্মান করি।

নিজেকে কখনো বেধে রাখবি না। নিজের মনোবল নিজেকেই তৈরী করতে হয়। মেয়ে হয়ে বেচে থাকা মানেই মুখ বুজে সব সহ্য করা নয়। নিজের পরিচয়ে মাথা উচু করে বাচতে শিখতে হয়’

খুব মনোযোগ দিয়ে মায়ের কথা শুনছিলাম। এত সুন্দর করে কেউ কথা বলতে পারে? আমার জানা ছিলো না। আমি সায় দিলাম। চোখ বুঝে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। এত সুখ আমার মত অভাগীর কপালে সইবে তো!

আমি আবারো মা’কে জড়িয়ে ধরলাম।
‘দেবো না মা। কষ্ট দেবো না। শুধু আমায় একটু মায়ের মত ভালোবেসো। আমি যে ভালোবাসার কাঙ্গাল।’

মা হালকা হাসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মাইর ও দেবো’

আমি হাসলাম। ভেতর থেকে কেমন শান্তি পাচ্ছিলাম। কিছু না ভেবেই বললাম, ‘আচ্ছা মা শুদ্ধ যে মেয়েটাকে ভালোবাসে সে এখন কোথায়?’

‘আজই সব কথা শুনে ফেলবি? ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পর। বাকি কথা পরে হবে। অনেক কাজ বাকি!’

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। আমার প্রথম প্রেমিক পুরুষ আমার না অন্য কারো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম। এই ভালো মানুষগুলোর পথের কাটা হয়ে কখনো থাকবো না। শুদ্ধর ভালোবাসা শুদ্ধর কাছে ফিরিয়ে দিবো। আমি নাহয় আমার এক মুঠো মুগ্ধতা নিয়ে আমার প্রেমিক পুরুষের জন্য হঠাৎ হওয়া প্রথম প্রেমের ছোয়াকে হৃদয়ে আজীবন গেথে রাখবো! মন্দ কি এতে?

মা আমার কাছে এসে আবারও বললেন, ‘রাগের মাথায় তোদের বিয়েতেও যাই নি। জানি না ভাগ্যে কি আছে। আমি অন্য শাশুড়িদের মত নই। আমি চাই শুদ্ধ আর তোর মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক।’

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। শুদ্ধর সাথে আর দেখা হলো না। সে হস্পিটালে। কত কি ফরমালিটি বাকি!

রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। শুদ্ধ হালকা কেশে তার জানান দিলো। চোখ বন্ধ করে লম্বা দম নিয়ে মাথায় ঘোমটা টানলাম। সেই প্রথমে বললো, ‘মায়া আমার কিছু কথা ছিলো’

‘জ্বি’ অত্যন্ত নরম স্বরে বললাম।

‘কালকের ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত। আসলে… আসলে আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না।

আর তোমার বাবার সাথে মায়ের ওভাবে কথা বলাটাও ঠিক হয় নি। আমি এর জন্য আংকেলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো। কি থেকে কি হয়ে গেলো মায়া। সব এতটাই দ্রুত ঘটেছে বুঝতেই পারি নি কি করা উচিত কিংবা যা করছি তা ঠিক না বেঠিক।

আরেকটা ইম্পোর্টেন্ট কথা পরশু বাবার জন্য দোয়া পাঠদান হবে। সে জন্য সমস্ত মেহমান উপস্থিত থাকবে। তাই কাল আমার রুমে শিফট হয়ে যাওয়াটাই বেটার হবে তোমার জন্য। কাউকেই আর কোনো রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। তাছাড়া তোমাকে তেমন কেউই চেনে না। পরিচয় করানোর সময় আমার মাকে যেনো কোনো রকমের কথা শুনতে না হয়।’

‘জ্বি’ -আমার সম্মতি পাওয়ার সাথে সাথেই শুদ্ধ রুম থেকে চলে গেলো। নিরব সুন্দর সাবলীল ভাষায় ধমক দিয়ে গেলো। মানুষটা এমন কেনো? প্রতিনিয়ত তার প্রতি সম্মান প্রেম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ মানুষটাকে নিজের থেকে দূরে সরাবো কিভাবে আমি? আচ্ছা সে কি আমায় গ্রহণ করার ইংগিত দিলো? নাকি সবই মায়ের সম্মান রক্ষার্থে করা?

চলবে কি?

[মন্তব্য আশা রাখছি]