মায়া পর্ব-০২

0
442

#মায়া
পর্ব ২
লেখা – #Alisia_Amber (ছদ্মনাম)

শুদ্ধরা চলে যাবার পর দু রাত দুদিন পার হয়ে গেছে। এই দুরাত ভালো করে ঘুমই হলো না। কেবল ঐ সুন্দর মুখস্রীর প্রতিচ্ছবি মনের অন্তস্থলে বার বার ভেসে উঠেছে। লোকটা ভীষণ পাষান একটা বার কি আমার কথা মনে পরে না?

দুপুরে খাবার খেতে বসেছি এমন সময় বাবা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করে বললেন, ‘শুদ্ধর বাবা আর নেই’

খাবারটা আর গলা অবদি নামলো না। স্তব্ধ হয়ে রইলাম। অমন ভালো মানুষটা নেই তা যেনো আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। কথা না বলে প্লেটে পানি ঢেলে জামা পালটে এসে বাবাকে বললাম, ‘বাবা আমায় নিয়ে যাবে? একটাবার মানুষটাকে দেখতে চাই’

বাবা আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলালেন। এর ভিতরে কায়া আর মামনিও রেডি হয়ে চলে এসেছেন।
.
.
আমরা পৌছুতে পৌছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। মানুষটার শেষ দেখা পেলাম না। নিজেকে আজ সবচেয়ে দুর্ভাগা মনে হলো। আচ্ছা এজন্য কি আমি কষ্ট পাবো? খুব কষ্ট? আমার কি এখন কান্না করা উচিত!

আমি ধীর পায়ে এগিয়ে শুদ্ধর কাছে গেলাম। সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি গায় শুদ্ধর। চেহারা মলিন। চোখ দেবে আছে। নিশ্চয় কেদেছে খুব। আলতু করে শুদ্ধর পাশে বসলাম। তার কোনো হেলদুল নেই। কতক্ষন এতিওতি করে শেষমেষ সাহস করে শুদ্ধর হাতের উপর হাত রাখতেই শুদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলো।

‘বাবা আমাকে ছেড়ে এত জলদি কেনো চলে গেলো মায়া! আমিত বাবার একটা কথার অবাধ্যও হই নি। নিজের ভালোবাসাকেও জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছি। তাহলে কেনো চলে গেলো মায়া কেনো’

আমি শুদ্ধর কথাগুলো আমলে নিলাম না। ভীষণ কষ্টে আছে সে। আমার তাকে সাপোর্ট দেয়া উচিত। আমি আলতো করে শুদ্ধর পিঠে হাত রাখলাম। সে আমায় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ব্যথায় আমি উহ করতেই শুদ্ধ আমায় ছেড়ে দিয়ে উঠে চলে গেলো। বড় বড় কদম ফেলে সে হাওয়া হয়ে গেলো। কি আশ্চর্য আমি কি তাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম? বুকের মধ্যে কেমন চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম। কি করবো ভেবে পেলাম না। হঠাৎ কায়া এসে বলল বাবা আমার খোজ করছেন।

একটা সুন্দর গোছানো রুমে প্রবেশ করতেই বাবার কর্কশ কন্ঠের আওয়াজ কানে এলো। সোফায় মাথায় হাত দিয়ে শুদ্ধ বসা। বাবা একজন যথেষ্ট সুন্দরী ভদ্র মহিলার সাথে বেশ আওয়াজ করে রাগারাগী করছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আগ বাড়িয়ে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছিলাম না। সে মূহুর্তে কায়া কানে কানে ফিশফিশ করে বলল, ‘শুদ্ধ ভাইয়ার মা উনি। উনারা তোর আর শুদ্ধ ভাইয়ের সম্পর্কটা আর এগুতে চান না’

প্রবল বেগে এক ঝড় এসে যেনো আমায় ধাক্কা দিয়ে গেলো। নিজেকে সামলাবো কি মনে মনে ভীষণ হাসি পেলো। আচ্ছা মায়ারা এত দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেয় কেনো?

যথেষ্ট সুন্দরী মহিলাটার চেহারায় বিষাদের ছাপ! স্বামী হারিয়ে এরকমই তো থাকার কথা!

উনি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি যথেষ্ট সুন্দরী মা। এবং শিক্ষিতাও। তুমিই বলো জোর করে কোনো সম্পর্ককে কি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত?
শুদ্ধ আর তোমার মধ্যে এখন অবদি তেমন কোনো সম্পর্কের সৃষ্টি হয় নি যার দরুন তোমাদের একত্রে থাকতেই হবে।
তুমি হয়তো জানো না কিংবা শুনেছো। শুদ্ধ এই বিয়েতে রাজি ছিলো না। এমনকি আমিও না। কারণ আমার ছেলের খুশির আগে আমার কাছে কিছুই নেই। শুদ্ধর বাবা ক্যন্সার লাস্ট স্টেজের রুগি ছিলেন।উনার খুশির কথা ভেবেই শুদ্ধ সবকিছু বাদ দিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো।
এখন তুমিই বলো এ সম্পর্কটাকে কি আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত?’

এতগুলো কথা হজম করতে আমার বেশ বেগ পেতে হলো। তবে এবারে বাবার দিকে তাকালাম না দ্রুত উত্তর দিলাম। ‘আপনারা ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেন’

মহিলা আমার মাথাত হাত রেখে বললেন, ‘সুখী হও’

পাহাড় সমান দুঃখের মুখে ছুড়ে ফেলে কেউ কি কখনো সুখী হওয়ার আশির্বাদ দেয়? হয়তো দেয়!

বাবা আমার দিকে রাগী চোখে তাকালেও কোনো কথা বললেন না। মামনি হুট করে এসে আমার গালে থাপ্পর মারলেন। আবারো একটাই কথা ‘অপয়া অলক্ষি, জন্মের পর যার মা পর পুরুষের হাত ধরে ভেগে যায় সেই মেয়েকে এতটা লাই দিয়ে মাথায় তুললে এমন অভদ্রই হয়’

মামনি কায়াকে নিয়ে চলে গেলেন। বাবাও কথা বললেন না চলে গেলেন।

আমার মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার তুলা শুভ্র মানবটির দিকে তাকালাম। আচ্ছা তার মনে কি কখনো আমার জন্য এক বিন্দু অনুভূতিরও সৃষ্টি হয় নি! মায়াদের কি ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই? মায়ারা কি সর্বদাই অসহায়? ঠিক এই মুহুর্তে নিজের নামটা নিয়ে বেশ আফসোস হলো। মায়া নামটা আমার সাথে বড্ড বেমানান।

নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা মায়া তোর এখন কি করা উচিত? কাদা উচিত নাকি মরে যাওয়া উচিত!’

গেট পেরিয়ে উঠোনে আসতেই বেশ মানুষের আনাগুনা পেলাম। একবার তিন তলা বিশিষ্ট বাড়িটিতে চোখ বুলালাম আমার হয়েও না হওয়া শশুড়বাড়ি। না হওয়া আপন কুঠির।

ঘড়ির কাটায় এখন কটা বাজে জানা নেই। তবে বাহিরে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস। ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। এই ঝড়ের তান্ডব এখনই কেনো আসবে? তার সাথে আমার মনের এত মিল কিভাবে সম্ভব? বৃষ্টির ফোটা গুলো যখন আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরবে। তখন আমার ভেতর শীতল হবে। মনে হবে আমি কাদছি। প্রকৃতিও আমার সাথে কাদছে।

গাড়ির কাছে আসতেই বাবা দরজা খুলে দিলেন। আমি উঠার আগেই মামনির গলা, ‘ এই অপয়া মেয়ে যে বাড়িতে যাবে সেখানে আমি আর আমার মেয়ে যাবে না’

পা নামিয়ে নিলাম। বাবা কঠিন গলায় মা’কে বললেন। আমার মেয়ে আমার বাড়ি যাবে।

বাবাকে আমি এখন কি বলবো, যে আমি যাবো না বাবা। তুমি তোমার স্ত্রী সন্তানের সুখের পরিবার আমার মত অপয়ার জন্য কেনো ছিন্ন করবে? তোমরা সুখে থাকো। আমিই বরং চলে যাই। কিন্তু না মায়াদের যে আশ্রয়স্থলের বরই অভাব। মায়াদের মুখ বন্ধ রেখে সব সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হয়।

আমাকে কিছুই বলতে হয় নি। পেছন থেকে অতি পরিচিত আমার বুকে ঝড় তুলা এক কন্ঠস্বর পেলাম।

‘মায়া কোথাও যাবে না আংকেল। ও এখানেই থাকবে। বাবার মেয়ে হয়ে।’

বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না। শুদ্ধ বেশ রাগারাগি করে বাবার সাথে। আংকেল মারা যাওয়ার আগে আমার সব দায়িত্ব শুদ্ধর উপর দিয়ে গেছেন। সে কিছুতেই তার দায়িত্ব থেকে সরতে চায় না। প্রয়োজনে সে সারাজীবন আমাকে স্ত্রীর পরিচয়ে রাখবে। কথাটা বললেও বাবা জানালেন শুদ্ধর মাকে তার সব কথা ফিরিয়ে নিয়ে বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় বাবা এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। শুদ্ধ দাতে দাত চেপে কিছু বলার আগেই শুদ্ধর মা এসে বললেন,

‘আমার ছেলে যা চাইছে তাই হবে। আগের কথাগুলোর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’

বাবা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি চাও?’

ঠিক এই মুহুর্তে আমার বাবাকে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘এখন কেনো জিজ্ঞেস করছো বাবা! কই বিয়ের সময় তো একটাবারও জানতে চাও নি বিয়েটা করবো কি না!
আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, আচ্ছা মেয়েরা কি বাবার ঘাড়ের বোঝা!’

উহু কিছুই বলা হলো না। সেই চুপ করে থাকলাম। শান্ত মনে প্রলয় ঘটানো শুদ্ধ আমার হাত চেপে ধরে বাসার ভিতর নিয়ে আসলো। একটা রুমে এনে বললো, ‘আজ থেকে তুমি এ রুমেই থাকবে মায়া’

‘আচ্ছা’

ব্যাস! এইটুকই কথোপকথন। সে চলে গেলো। ভাবতে লাগলাম আমার না হওয়া আপন কুঠির কি তবে আপন হয়ে উঠবে!

চলবে….

[কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না]