#মায়া
পর্ব ৪
লেখা – #Alisia_Amber (ছদ্মনাম)
.
[কপি করা নিষেধ]
বিয়ের পর থেকে আমার আর শুদ্ধর মধ্যে ১০ মিনিটের কথোপথনও স্থায়ী হয় নি। সেখানে আজ আমি আর শুদ্ধ এক রুমে। ভাবতেই অদ্ভুত রকমের এক ফিলিংস হচ্ছে। অসস্থিবোধ বোধে কুকড়ে যাচ্ছি আমি।
শুদ্ধর তিন ফুফু এসেছেন। উনাদের আসার আগেই শুদ্ধ আমাকে তার রুমে যেতে বলেছে নিজে এসে। আমি ফেলতে পারি না। এই মানুষটাকে আমার বড্ড কাছের কেউ মনে হয়! আমি বাধ্য মেয়ের মত এসেছি। শুদ্ধর ব্যবহারে মাও বেশ অবাক হয়েছেন। কিন্তু কিছু বলেন নি। আমি বুঝতে পারি নি উনি ঠিক খুশি হয়েছেন নাকি না! নাকি শুদ্ধর মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে উনার মনোভাব প্রকাশ করেন নি।
দরজায় হালকা নক করে শুদ্ধ রুমে প্রবেশ করে। সাথে আরেকজন মহিলা। আমি চিনতে পেরেছি। মা আমাকে দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে বলেছিলেন উনারা তোর ফুফু শাশুরি। তুই রুমে যা পরে পরিচয় করিয়ে দিবো।
আমি দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। উনি কাছে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন।
‘কি থেকে কি হয়ে গেলো মা! বউমার মুখ এভাবে দেখতে হবে ভাবি নি। দেখো না তোমাদের বিয়ের কদিনই বা হলো আর এমন অঘটন! তুমি তো আর ইচ্ছে করে এমন করো নি! সবই ভাগ্য! শুধু এটুকুই চাই যে শুদ্ধটার যেনো কিছু না হয়’
আমি উনার কথায় অবাক হলাম। মহিলা এভাবে আমাকে খোচা দিলো? জন্ম মৃত্যু বিয়ে তো আল্লাহর হাতে। এখানে তো আমার কিছু না। শুদ্ধ চুপচাপ সোফায় বসে ফোন চালাচ্ছে। আমি কিছুই বললাম না। হঠাৎ পেছন থেকে মা বলে উঠলেন,
‘হ্যা আপা ঠিক বলেছো। শুদ্ধর বিয়েটা তাড়াহুড়ো করে দেয়া হয়েছিলো বলেই মৃত্যুর আগে বউমাকে দেখে যেতে পারলো মানুষটা। আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুন দোয়া করো’
মহিলা আর কিছু না বলে ‘আসি’ বলেই বেড়িয়ে গেলেন। মা আমায় বললেন, ‘কিছুদিন রুম থেকে কম বের হবি মা। নানা রকমের মানুষের আনাগুনা থাকবে। আর শুদ্ধর ফুফুদের থেকে একটু সাবধান। মন খারাপ করিস না। ‘
মা শুদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘সারাদিন কিছুই খাস নি বাবা। একটু খেয়ে নে?’
শুদ্ধ মায়ের হাত ধরে বলল, ‘তুমিও তো খাও নি মা’
মা খালাকে হাক ছাড়লেন খাবার নিয়ে আসার জন্য। খালা খাবার নিয়ে এলে নিজের হাতে শুদ্ধকে খায়িয়ে দিলো। সাথে জোর করে আমাকেও। আমি যখন বললাম, ‘আমাকে কখনো এভাবে আদর করে কেউ খায়িয়ে দেয় নি মা’
শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেও মা এক হাতে আমায় জড়িয়ে নিলেন। এত অল্প সময়ে কারো সাথে আপন হয়ে যাওয়া যায় তা মনে হয় মায়ের সাথে দেখা না হলে বুঝতেই পারতাম না। কেমন মনের কথাগুলো মুখ ফোটে বেড়িয়ে যায়!
রাতে শুদ্ধ চুপচাপ খাটের একপাশে শুয়ে পরলেও আমি এপাশ উপাশ করতে থাকলে শুদ্ধ বলল, ‘ঠিক ভাবে ঘুমাও মায়া। সকালে অনেক কাজ আমার। তোমার নড়াচড়ায় ঘুমাতে পারছি না।’
শুদ্ধর কথায় কেমন বিরক্তিভাব। তা কি শুধু ঠিক ঠাক ঘুম না আসার জন্যই! নাকি সে কি আমায় সহ্য করতে পারছে না?
চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। পা টিপে টিপে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। আজ আকাশে মস্ত বড় এক চাদের দেখা মিলল। কেমন চারিদিক আলোকিত করে দিলো। হালকা বাতাসের ঝাপ্টা গুলো এসে আমার খোলা চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। জীবনের এই দাড়প্রান্তে এসে আমি নিজেকে নিয়ে বড্ড বেশি কনফিউজড। আমাকে নিয়ে কি হচ্ছে আমি তা বুঝতে পারছিনা। সবার সিদ্ধান্তের চাপাকলে কি একদিন আমি পিষ্ট হয়ে যাবো? আমার একান্ত আমার কি কখনো কোনো স্থায়ী জীবন হবে না?
__________________________
‘আপনার চা’
শুদ্ধ চায়ের কাপ নিলো। বলল, ‘এসব করার জন্য মানুষ আছে। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না মায়া’
‘হু’
খুব বেশি কোনো কথা বলার ইচ্ছে হলো না। চা আমি বানাই নি। খালা এসে দিয়ে গেছেন আমি কেবল উনার হাতে পৌছে দিলাম। এই!
একটা জিনিস আমি বেশ খেয়াল করেছি শুদ্ধ আমার সাথে যতটা বাক্যই আদান প্রদান করে তাতে ‘মায়া’ থাকে। তার এই মায়া উচ্চারনের কারণেই আমার তার কন্ঠটা আরো মধুর মনে হয়। এত আবেগ নিয়ে আমায় শুদ্ধ ছাড়া আর কেউ ডাকতে পারেনা।
‘তুমি এত চুপচাপ থাকো কেনো মায়া?’
তার আকস্মিক এই কথায় আমি থ মেরে গেলাম। আমি কিভাবে বলবো যে, আমি তো চুপচাপ থাকি না। আমি কথা বলি নিজের সাথে বলি। আমার সাথে কেউ কথা বললে আমারও ইচ্ছে হয় বলতে। আপনি কি আমার কথা বলার সাথী হবেন শুদ্ধ?
‘কি হলো চুপ যে?’
শুদ্ধর আবারো ডাকে হুশ ফিরলো। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘না মানে কই চুপ থাকি? আসলে কি বলবো!’
শুদ্ধ হালকা হাসলো। বলল, ‘আমি তোমার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না মায়া। বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেলো। তোমার সম্পর্কে না জানলে সম্পর্কটা কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবো বলো? জানতে হবে না? নাকি তুমি আমার সম্পর্কে সব জানো?’
‘উহু’ -তার এতগুলা কথার উত্তর একটা শব্দে এভাবে দেবো সে ভাবতেও পারে নি। খানিক লজ্জা পেলাম। শুদ্ধ হালকা হেসে উঠে বলল, ‘কালকে রাতের জন্য সরি মায়া। মাথাটা ভীষণ ধরেছিলো। তাই মোডটাও ভালো ছিলো না। এজন্য তোমার সাথে অমন ব্যবহার মোটেও উচিত হয় নি। এজন্য কি মন খারাপ করেছিলে?’
আমি তৎক্ষনাৎ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘না না’
সে হেসে দিলো। বলল, ‘তাহলে বেড ছেড়ে উঠে চলে গিয়েছিলে কেনো? সারারাত কোথায় ঘুমিয়েছো? ভোর বেলা পাই নি কেনো তোমায়?’
আমি চুপ করে রইলাম। কিছুই বলতে পারলাম না। শুদ্ধ শার্টের হাতা গুটিয়ে বেড়ুতে বেড়ুতে বলল, ‘উত্তরটা তৈরি রেখো মায়া। রাতে আর ছাড়ছি না বলতেই হবে’
কথাটা বলে মুচকি হেসে বেড়িয়ে গেলো। ইস! লোকটা এমন কেনো? সে কি জানে তার মুখ নিয়ে বেরুনো প্রত্যেকটা শব্দ আমায় যেমন মুগ্ধ করে তেমনি লজ্জায় ফেলে!
___________________________
বাহিরে রান্না হচ্ছে। বাড়ির সবাই সজাগ। ঘড়িতে বাজে একটা পঞ্চান্ন। আমি নামাজ শেষে জায়নামাজটা রেখে বাহিরে উকি দিলাম। শুদ্ধ যে সেই সকালে বেড়িয়েছিলো আর আসে নি। উনি খাওয়া দাওয়া করেছেন কিনা তাও জানি না। দরজার বাইরে উকি দিতেই দেখলাম মায়ের রুমের দরজা বন্ধ। কিন্তু বাতি জ্বলছে। তাই ভাবলাম একবার মায়ের সাথে দেখা করে আসি। দরজার সামনে যেতেই শুদ্ধর গলা পেলাম। সে কাদছে আর বলছে, ‘মা আমার সাথেই কেনো এমন হয় মা? আমি শক্ত হতে চেয়েও পারছি না মা। কি করবো আমি বলো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে’
দু হাত জামায় মুষ্ঠিবদ্ধ করে ফেললাম। শুদ্ধ কাদছে কেনো। এত কষ্ট পাচ্ছে কেনো সে! বুকটায় হালকা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম। শুদ্ধর কষ্টে আমারও কষ্ট হচ্ছে। আমার চোখ কাপছে। আমিও কাদতে চাইছি। আমি কি তবে শুদ্ধকে ভালোবেসে ফেলেছি?
হুট করে দরজা খুলে গেলো। ধ্যান ভংগ হলো আমার। মুখের সামনে শুদ্ধর লাল মুখখানি ভেসে উঠলো। স্পষ্ট। সে ঠোট নেড়ে বলছে, ‘এখানে তুমি?’
আমি কি বলবো এখন? সে কি ভাববে আমি আড়ি পেতে সব শুনছিলাম? আমি কোনোমতে বললাম, ‘মায়ের রুমে বাতি জ্বালানো দেখে কথা বলতে আসলাম’
‘তাহলে নক করো নি কেনো?’
শুদ্ধ কি আমাকে জেরা করছে? আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। শুদ্ধ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমার দৃষ্টি মাটিতে নিবদ্ধ।
চলবে….
[মন্তব্য করতে ভুলবেন না]