মায়া পর্ব-০৫

0
371

#মায়া
পর্ব ৫
লেখা- #Alisia_Amber (ছদ্মনাম)
.
[কপি করা নিষেধ]
মা শুদ্ধকে থামিয়ে দিলেন। আমাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন। আমি যেনো হাফ ছেড়ে বাচলাম। মাথা উচিয়ে শুদ্ধর চেহারায় তাকানোর সাহস পেলাম না। লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছি। আমি রুমে প্রবেশ করতেই মা আমাকে বললেন,
‘কালকের দিনটা যাওয়ার পর তোর জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হবে।’

আমি তড়িঘড়ি করে বললাম, ‘না না মা’

শুদ্ধ মধ্য থেকে বলে উঠলো, ‘লাগবে না কেনো? তুমি কি জামা কাপড় ছাড়াই থাকতে চাচ্ছো? নাকি আমাদের টাকা বাচিয়ে আমাদের বিশাল বড়লোক করে দেয়ার চিন্তাধারা করছো’

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। একটু আগেই না লোকটা কিভাবে কাদছিলো। এখন আবার মজা করছে! একটা জিনিস বেশ ভালো লাগলো লোকটা সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। আমি আর কিছুই বললাম না। চুপ করে থাকলাম। মা শুদ্ধকে বাইরে পাঠালেন দেখার জন্য কাজ কতদূর এগুলো তা দেখার জন্য। শুদ্ধ চুপচাপ বেড়িয়ে গেলো।

মা আমাকে বললেন, ‘আমার ছেলেটা ভীষণ দুষ্টু হলেও মনটা খুব ভালো রে! আমি জানি সে এই মুহুর্তে পাহাড়সমো কষ্ট মনে গেথে রেখেছে। অথছ দেখ কি সুন্দর কথা বলে গেলো’

আমারও মাকে বলতে ইচ্ছে হলো, হ্যাঁ মা তোমার ছেলেটা ভীষণ অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। তার এই আলাদা ব্যাক্তিত্বের প্রেমে বার বার পরতে বাধ্য হচ্ছি মা। আমি যে তোমার ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলেছি।‘

‘যা যা গিয়ে কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নে। সকালেই এতিম খানার বাচ্চারা চলে আসবে। সারাদিন দোয়া পাঠদান, খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত সময় পার হবে।‘

‘আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন মা। নাহলে শরীর খারাপ হবে’

আমার কথায় মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হালকা হাসলেন। শুদ্ধর ফুফুদের আর দেখা পাই নি। হয়তো বা ঘুমিয়ে। আমি রুমে চলে আসলাম। বারান্দা থেকে স্পষ্ট শুদ্ধকে দেখা যাচ্ছে। সে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি যেনো বুঝাচ্ছে একটা ছেলেকে। হঠাৎ উপরে তাকাতেই চোখ চোখ পরে গেলো। আমি সরে গেলাম। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুবো এমন সময় শুদ্ধ রুমে নক করে প্রবেশ করে।

মাথায় জল দিয়ে এসে বেডে লম্বা হয়ে শুয়ে পরে। আমাকে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘আজকেও নির্ঘুম রাত্রি কাটানোর প্লেন নাকি মায়া?’

আমি তৎক্ষণাৎ দুদিকে মাথা নাড়ালাম। সে হালকা হাসলো। তারপর চোখ বুজে বলল, ‘লাইটটা অফ করে দিও মায়া। মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে। কিছুক্ষন রেস্ট নিবো’

আমি লাইট অফ করে আসলাম। বারান্দার লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম। হালকা আলো আসছে এখন রুমে। শুদ্ধর মাথার কাছে বসে বললাম। ‘বেশি ব্যাথা করছে? আমি ম্যাসাজ করে দেই?’

শুদ্ধ কেবল ‘হু’ আওয়াজ করলো। বুঝলাম ব্যাথাটা হয়তো বেশি। ড্রয়ার থেকে একটু বাম নিয়ে হালকা করে ম্যাসাজ করতে থাকলাম।

কিছুক্ষন পরেই শুদ্ধর ভারী নিশ্বাস পরতে লাগলো। বুঝতে পারলাম ঘুমিয়ে পরেছে। মাথাটা পেছনে হেলিয়ে কখন যে এভাবেই ঘুমিয়ে পরেছি জানি না।

শুদ্ধর বাবার সিরনির পর ধীরে ধীরে সবাই চলে গেলো। বাড়িতে আমি মা শুদ্ধ আর দুজন কাজের লোক। মা বেশির ভাগ সময়ই উনার রুমে কাটান। আমি গিয়ে উনার মাথায় তেল দিয়ে দেই, গল্প করি।

মা দেখতে ঠিক আগের দিনের নায়িকাদের মত। ঘন কালো কেশ আর জোরা ব্রু। একদিন গল্প করতে করতে মা’কে বলেই দিয়েছি, ‘মা আপনি দেখতে অনেক সুন্দরী। ঠিক আগের দিনের নায়িকাদের মত।’

মা আমার কথায় বেশ হেসেছিলেন। তারপর বাবা আর মায়ের প্রেম কাহিনী শুনালেন। উনাদের বয়সের পার্থক্য ছিলো ষোল বছর। মা বাবা থেকে ষোল বছরের ছোট। তবুও তাদের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না। শুদ্ধর পরে মায়ের কষ্টের কথা ভেবে বাবা নাকি আর বাচ্চাই নিতে দেন নি। শুদ্ধ মায়ের কলিজার টূকরা। বাবাও শুদ্ধকে অনেক ভালোবাসতেন। মা যখন বাবার সম্পর্কে কথা বলেন চোখে মুখে কেমন উৎফুল্লতা থাকে। ভালোবাসার দিনের কথা গুলো বলতে বলতে আবার কেদে দেন। আমিও তখন স্বপ্ন বুনি শুদ্ধকে নিয়ে। আমাদেরও তো সুন্দর একটা সংসার হতে পারে!

এতদিনে এটা বুঝে গেছি যে শুদ্ধ মায়ের একান্ত বাধ্যগত সন্তান। মায়ের কথার তিল পরিমাণ অবাধ্যও সে হয় না। মা আমাকে আর শুদ্ধকে নিয়ে বিরাট চিন্তায় আছেন। কারণ মেহমান সবাই বিদায়ের পর শুদ্ধ হুট করেই আলাদা রুমে থাকা শুরু করে দিয়েছে। প্রতিদিন রাতে খাবারের সময় একবার দেখা ছাড়া আমাদের তেমন কথাই হয় না।

খাবার টেবিলে মা শুদ্ধকে বললেন, ‘মায়াকে এখানকার কোনো উনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দেয়া যায় না?’

আমি তড়িঘড়ি করে বললাম, ‘মা আমি ন্যাশনালে এপ্লাই করি এইবার? আমার প্রাইভেটে পড়ার একদম ইচ্ছে নেই’

মা আমার দিকে চোখ নাড়ালেন। শুদ্ধ কিছু বললো না। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।

‘মা আমাকে কিছু দিনের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হবে। অফিশিয়াল কাজে। বাবা মারা যাওয়ার পর সেখানকার পরিস্থিতি আরো খারাপের পথে। না গেলে হবে না। আর চিন্তা করো না আমার সাথে মহসিন যাবে।’ – খাবার শেষে শুদ্ধ জানালো।

শুদ্ধ হুট করে চট্টগ্রাম যাবে শুনে আমার খারাপ লাগলো। মানুষটাকে দিনে একবার অন্তত দেখতে পারতাম! আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম শুদ্ধ যাবার কথা বলতেই মায়ের মুখে কেমন আতংকের ছাপ পরে গেলো।

‘মহসিনকে পাঠিয়ে দিলে হয় না?’- মা ব্যাতিগ্রস্থ হয়ে শুদ্ধকে বলল।

‘মহসিনকে পাঠিয়ে দিলে যদি হয় তাহলে আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতাম না মা। তুমি চিন্তা করো না। খুব দ্রুতই চলে আসবো।’- শুদ্ধর দ্রুত উওর।

মা সায় জানালে শুদ্ধ রুম ত্যাগ করলো। আমি আর কিছু বললাম না।
রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এমন সময় শুদ্ধ দরজায় নক করলো। আমি ঠিকঠাক দাড়ালাম। শুদ্ধ ভেতরে প্রবেশ করে আমার হাতে একটা ফোন দিলো।

‘অনেক আগেই তোমার জন্য কিনেছিলাম মায়া। আর দেয়া হয় নি। একটা ফোনের তোমার বিশেষ প্রয়োজন। দেখো কথাটা মাথা থেকেই কেমন বেড়িয়ে গিয়েছিলো।

আর তোমার বাবা ফোন দিয়েছিলো। তোমার সিদ্ধান্ত জানতে চান উনি। আমি বলেছি এ ব্যাপারে যেনো তোমার সাথেই কথা বলে।’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। শুদ্ধ আমার কোন সিদ্ধান্তর কথা বললো। বুকটা হঠাৎ করেই কেপে উঠলো। শুদ্ধ কি তবে আমায় চায় না? সে না সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় তবে কি আমার ধারণা ভুল ছিলো। নাহ! সে তো নিজের মুখেই বলেছিলো। তবে?

শুদ্ধ বেড়িয়ে যাওয়ার সময় আমি হুট করেই বললাম, ‘আপনি কি এই সম্পর্কের ইতি টানতে চাইছেন শুদ্ধ?’

শুদ্ধ লম্বা শ্বাস টেনে বললো, ‘যদি তাই মনে করো তবে তাই মায়া’

শুদ্ধ আর দাড়ালো না। তার আমার থেকে দূরত্ব বাড়ানোর কারণ ধরা পরলো আমার কাছে। এই মুহুর্তে বুকের ভেতর তুলপাড় শুরু হয়ে গেলো। আমি কাদতে চাইছি। চিৎকার করে কাদতে চাইছি কিন্তু মায়াদের যে কান্না আসে না। মায়ারা বড্ড নিষ্ঠুর হয়। বড্ড নিষ্ঠুর।
______________________________

শুদ্ধ চট্টগ্রাম গেছে আজ আট দিন। মায়ের মনটাও ভালো না। আমাকেও বার বার জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। বিকেলে মা আর আমি ছাদে হাটছিলাম। এমন সময় মা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘শুদ্ধর সাথে আমি কথা বলবো মায়া। তুই একদম চিন্তা করিস না। আমার মেয়েটাকে সারাজীবন আমি আমার কাছেই রাখবো।’

আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলাম। এই মা’টা আমার ভীষণ আপন। কেমন গা ঘেষলেই চোখের পানি ঝড়ের বেগে গড়িয়ে পরে ভেতর শান্ত করে দেয়। মা বেশ ভালো ভাবেই টের পেয়েছে আমি শুদ্ধকে চাই। ভালোবাসি। কিন্তু সে না আমায় কিছু বলতে পারছিলো। আর না শুদ্ধকে।

এর দুদিন পর শুদ্ধ বাড়িতে ফিরে। বেশ শুকিয়ে গেছে সে। মা’কে জানায় কাজের চাপ বেশি ছিলো।
রাতে ঘুম আসছিলো না। তাই ভাবলাম মায়ের রুম থেকে একবার ঘুরে আসি। দরজার সামনে যেতেই শুদ্ধর গলা পাই, ‘মা তিথি ফিরতে চায়! আমি আর পারছিনা মা!’

চলবে কি?

[মন্তব্য করতে ভুলবেন না]