মায়া পর্ব-০৬

0
404

#মায়া
পর্ব ৬
লেখা- #Alisia_Amber
[কপি করা নিষেধ]
.
তাদের কথোপকথন শোনার অবস্থায় আর ছিলাম না। আমার হাত পা এখনো কাপছে। শুদ্ধ কি তবে তার প্রাক্তনের কাছে ফিরে যেতে চায়? শুদ্ধ আমার থেকে মুক্তি চাইছে প্রাক্তনের সাথে নতুন সম্পর্কের বাধনে পরতে? আমার হার্টবিট খুব দ্রুত গতিতে চলছে। আমি জানিনা তাদের মা ছেলের মধ্যে কেমন ধরনের কথা চলছে। মা কি তবে শুদ্ধকে সাপোর্ট করবে? করারই কথা একটা মাত্র ছেলে। কিন্তু আমি যে শুদ্ধর স্ত্রী! স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কি এতটাই ঠুংকু? কিছুতেই শান্তু পাচ্ছি না। আমার শান্তির ঘুম প্রয়োজন। হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিক ধুকধুকানি বন্ধের আর কোনো উপায় পাচ্ছি না।
ড্রয়ার খুলে দুটো টেবলেট পানি দিয়ে গিলে ফেললাম। ধীরে ধীরে চোখে ঘুম নেমে আসলো। আর কিছুই বলতে পারি না।

হঠাৎ মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। কেমন আমার সারাদেহ অনবরত নড়ে যাচ্ছে। কিন্তু চোখ মেলে তাকানোর একদম ইচ্ছে হচ্ছে না। হালকা চোখ খুলে তাকাতেই সামনে মাকে দেখতে পেলাম। চেহারায় কেমন আতংকের ছাপ। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম। কেমন সারা শরীর ব্যাথা হয়ে আছে। সামনেই শুদ্ধ দাঁড়ানো।

এগিয়ে এসে জিজ্ঞেসা করলো, ‘তুমি ঠিকাছো মায়া? অহ গড আমরা কতটা ভয়ে ছিলাম তুমি জানো? তুমি কি ঘুমের মেডিসিন নিয়েছো? কতগুলা খেয়েছো বলোতো? এমন কেউ করে? সব কিছুরই একটা লিমিটেশন আছে। তোমার শরীরে এই অসুধের কিরুপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে একবার ভেবেছো?’

শুদ্ধ এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে গেলো। শেষের কথাগুলায় কেমন রাগ স্পষ্ট। মা শুদ্ধকে থামিয়ে বললেন, ‘আহ শুদ্ধ থাম ! মেয়েটা বুঝতে পারেনি হয়তো। ’

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আর এমন করে না মা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ফ্রেশ হয়ে নে আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

মা বেড়িয়ে গেলে শুদ্ধ এগিয়ে আসলো। চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখো বসে বললো, ‘এমনটা কেনো করেছো মায়া? বাই এনি চান্স তুমি কি সুইসাইড করতে চাইছিলে?’

আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। আমি সুইসাইড! নাহ। এমন কোনো চিন্তাই আমার মাথায় আসে নি। আমি তো কেবল শান্তির একটু ঘুম দিতে চাইছিলাম।

শুদ্ধ আবারো বললো, ‘আর এমন করো না মায়া।’

শুদ্ধ কেমন আবেগ নিয়ে কথাটা বললো। আমি মাথা কাত করে সম্মতি জানালাম। সে হালকা হেসে বেড়িয়ে গেল।

হঠাৎ একদিন বাবা আসলেন বেড়াতে আমি বাবাকে দেখে অবাক হয়েছি। হুট করে বাবা কেনো আসবে?

বাবা আমার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কেমন আছিস মা?’

হাসিমাখা মুখে বললাম, ‘ভালো আছি বাবা। এখানে একবারের জন্যও মনে হয় নি অন্যের বাড়িতে আছি। অথচ নিজের বাড়িতে ক্ষনে ক্ষনে নিজেকে কেমন আশ্রিতা মনে হত!’

বাবা আমার কথায় হয়ত দুঃখ পেয়েছেন। যা উনার চেহারায় প্রকাশ পেলো। মায়ের সাথে কথা বলার ফাকে বাবা আমাকে বললেন, ‘ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নে। বাড়ি যাবো। কতদিন যাস না!’

আমি ছিটকে সরে গেলাম। বাড়ি যাবো মানে? ‘বাড়ি যাবো কেনো? তুমি রাগ করে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছো?’

শুদ্ধ বললো, ‘সামনের মাসেই তোমার সেকেন্ড ইয়ার পরিক্ষা মায়া। তুমি আমাদের জানাও নি কেনো? আর তোমার যেহেতু ন্যাশনালে পড়ার ইচ্ছা তাহলে শুধু শুধু এক বছর ড্রপ করার তো মানে হয় না। তাই আমি…’

শুদ্ধকে থামিয়ে মা বললেন, ‘হ্যাঁ মা। পরিক্ষাটা ভালো করে দে। যা যা লাগে সব শুদ্ধ তোকে দিবে। আবার পরীক্ষা শেষে শুদ্ধ তোকে নিয়ে আসবে। আমি যাবো তোকে আনতে।’

হুট করে বুকের মধ্যে প্রবল বেগে যেনো একটা ব্যথার আবাস পেলাম। কেমন অসহায় মনে হলো নিজেকে। এ পৃথিবীতে আদৌ কি আমার আপন বলতে কেউ আছে? উহু নেই। আর নেই বলেই তো কেউই আমাকে তাদের কাছে রাখতে চায় না। আমি আর কোনো কথা বললাম না। আমার অতি আপন কেউ। যার কাছ থেকে মা মা গন্ধ পেতাম। তার কথায় আমি মিথ্যের আবাস পেলাম। সে মিথ্যে বলছে। আমি জানি। শুদ্ধর নতুন সংসার সাজানোর পরিকল্পনা সব!

আমি প্রথম দিনের গায়ে জরানো জামাটা পরে আসলাম। ফোনটা শুদ্ধকে দিতে গেলে বলে, ‘এ কি করছো মায়া। এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার। না রাখলে ভীষণ কষ্ট পাবো।’

মায়ের কাছে গিয়ে সালাম করে বললাম, ‘এ পৃথিবীতে মায়ের স্পর্শ পাওয়াটা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার মা। আমি সে হিসেবে ভাগ্যবতী। ক্ষনিকের জন্য হলেও তোমার দেখা পেয়েছি মা। আজ তোমাকে ভীষণ আপন লাগছে তাই দেখো মুখ দিয়ে কেমন তুমি শব্দ বের হচ্ছে। রাগ করো নি তো?’

মা দুদিকে মাথা নাড়ালেন। চোখের কোনে পানি স্পষ্ট। আমি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তার পর বিদায়!

_________________________
বাড়ি ফিরতেই মামনি হাজার খানেক অভিশাপ দিয়ে দিলেন। গায়ে মাখলাম না। রুমে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুমালাম। চোখে আমার হাজার ক্লান্তির ছাপ বিদ্যমান।

মেসেজের টুং শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ২ টা বেজে ৩৫ ।
সেই সকালের পর আর খাওয়া হয় নি। পেটটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। ফোনটা হাতে নিতেই উপরে লেখা উঠলো, ‘প্রিয়’

তারমানে শুদ্ধ মেসেজ দিয়েছে। তৎক্ষণাৎ মেসেজটা ওপেন করে দেখলাম।

‘মায়া। তুমি জানো না তোমার নামের সাথে তোমার কত মিল। আমি যতবার তোমার দিকে তাকিয়েছি কেবল মায়ায়ই পরেছি। কিন্তু তোমার মত পবিত্র মেয়ের যোগ্য আমি নই মায়া।
আজ তোমাকে এক প্রকার মিথ্যে বলেই তোমার বাবার বাসায় পাঠিয়েছি। কারণ সরাসরি তোমাকে সত্য বলার মত সাহস আমার নেই। আমি জানিনা আদৌ কখনো আমাদের মধ্যে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক সৃষ্টি হত কিনা। তবে আমি বন্ধু হয়ে আজীবন তোমার পাশে আছি। যে কোনো প্রয়োজনে অবশ্যই আমাকে স্মরণ করবে।
আমি একটা মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসতাম মায়া। যদি জিজ্ঞাস করো এখনো ভালোবাসি কিনা। তবে বলবো হয়তো বা বাসি। কারন তার চোখের কোনে আসা জল আমার সহ্য হয়না মায়া।
সেদিন সে এসে যখন আমাকে তার কথা জানালো আমি ফেলতে পারি নি। সে কাদছিলো মায়া। চিৎকার করে কাদছিলো। সে যে আমায় বড্ড ভালোবাসে। আচ্ছা মায়া ভালোবাসার মানুষটিকে এভাবে কষ্ট দেয়া কি ঠিক হবে বলো? তাইতো দেখো তাকে আপন করে নিতে তোমাকে বড্ড বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। কখনো কাউকে ভালোবাসলে বুঝবে মায়া। ভালোবাসলে মাঝে মাঝে স্বার্থপর হতে হয়।
ভালো থেকো মায়া। কিছুদিনের ভেতরই ডিভোর্স পেপার রেডি হয়ে যাবে। এর আগে আমাদের অবশ্যই দেখা হবে। ভালো থেকো মায়া। খুব বেশি ভালো থেকো।
ইতি তোমার অপরাধী‘

অবাধ্য চোখের কোন থেকে এক ফোটা পানি কেমন গড়িয়ে পরে গেলো। ভালোবাসায় স্বার্থপর হতে হয় তাই না শুদ্ধ তবে কি আমিও স্বার্থপর হয়ে যাবো!

খাতা থেকে একটা কাগজ বের করে মনোযোগ দিয়ে লিখলাম,
‘এত কষ্ট করে এতদিন আমাকে খায়িয়ে পরিয়ে রাখার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা! মামনি আমাকে পছন্দ না করলেও আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু আমি তোমার ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা করো। রাতের আধারে আমাকে কেউ দেখবে না। তোমার সম্মান রক্ষার্থে নাহয় সবাইকে জানিয়ে দিও মেয়ে স্বামী সংসারে সুখে আছে।
ইতি তোমার মায়া’

ফোনটা সুইচ অফ করে বারান্দা থেকে বড় ডোবায় উড়িয়ে দিলাম। তোমার দেয়া কোনো স্মৃতিই আমি রাখবো না শুদ্ধ। মায়ার জীবন যুদ্ধে কেবল মায়াই থাকবে। মায়ার জীবনে থাকবে না কোনো পিছুটান। আর না থাকবে কোনো মায়া!

আর কত মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবো? থাকবো না। মায়ার একটা নিজের জগৎ হবে। যেখানে থাকবে কেবল মায়ার রাজত্ব।

আলমারীর ড্রয়ার থেকে লাল রঙয়ের বাক্সটা বের করলাম। একটা খামে বড় বড় অক্ষরে লেখা, মিরপুর ২। হাউস নাম্বার ২০২! (কাল্পনিক ঠিকানা)।
চিরকুট টা সহ বাক্সটা ব্যাগে নিলাম। আস্তে করে দরজা খুলে বেড়িয়ে পরলাম। সুনসান রাস্তায় দু একটা কুকুরের ডাক ছাড়া আর কিছুই শুনা যাচ্ছে না। আমার গন্তব্যে আমি একা । দম নিলাম। ছুটে চললাম। তাকালাম না আর পিছু ফিরে।

অজানার পথে একা পদচারণার ভবিষ্যৎ আদৌ কি সুখকর হবে মায়ার জন্য?

চলবে কি?

[মন্তব্যা করতে ভুলবেন না]