মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৩+৪

0
661

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_3

নির্জন সন্ধায় রাস্তায় দাঁড়ানো এক সুন্দরী রমণীকে রক্তে ভেজা শাড়িতে দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে।হয়তো সেই কারণেই কেউ তাকে দেখেও দারাচ্ছে না।আরজু রাস্তায় দাড়িয়ে গাড়ি দার করানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু কেউ দাড়ায় নি। আশেপাশে অন্য কোনো যানবাহন ও তার চোখে পড়ছে না।তার চোখে মুখে তখন আতঙ্ক।আরজুর এখন চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে।মানুষের মধ্যে কি কোনো মানবতা নেই।একটা ছেলে এই ভাবে চিকিৎসার অভাবে রাস্তায় পড়ে মারা যাবে?না আরজু কিছুতেই এমনটা হতে দিতে পারে না।

সামনেই একটা গাড়িকে আসতে দেখে আরজু সোজা রাস্তায় মাঝখানে দাড়িয়ে গেলো।সে চোখ বন্ধ করে আছে।এই গাড়িটা কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।গাড়িটি আরজুর সামনে ব্রেক করে দাড়ালো।আরজু চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস নিলো।অল্পের জন্য বেঁচে গেছে।নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে ড্রাইভার বেশ দক্ষ।সে দ্রুত গাড়ির সামনে যেয়ে গ্লাসে নক করলো।গ্লাসটি নামাতেই আরজু লক্ষ করলো একজন লোক কপাল কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আরজু বুঝতে পারলো তার এমন কাজে লোকটা বেশ বিরক্ত।সে সব ভুলে লোকটিকে রিকোয়েস্ট করলো সাহায্য করার জন্য।

হসপিটালের করিডোরে বসে আছে আরজু।আজকের ঘটনায় সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।সে চোখ তুলে সামনে তাকালো।সেই লোকটি ডক্টরের সাথে কথা বলছে।লোকটি না থাকলে কি যে হতো?তখন লোকটি সেই ছেলেটিকে কোলে তুলে নিজের গাড়িতে করে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।রাস্তার সোডিয়ামের নিয়ন আলোয় সে মানুষটিকে তখন খেয়াল করতে না পারলেও এখন তার দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে।মানুষটিকে লোক না বলে ছেলে বললে ভালো হয়।বলিষ্ঠ গড়নের মানুষটি উচ্চতায় বেশ লম্বা।উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ আর মাথায় ঝাঁকড়া চুলের সমাহার।গায়ের ব্লু টিশার্ট রক্তে মাখামাখি।কথা বলার সময় মানুষটি এক হাত নাড়িয়ে কথা বলছে।যেনো কোনো বক্তিতা দিচ্ছে।অন্য হাত তার ব্লু ডেনিম প্যান্টের পকেটে।এমন বিধ্বস্থ পরিস্থিতিতেও আরজু লোকটির প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করছে।অজানা এক আকর্ষণ আছে লোকটির মাঝে।

আরজু খেয়াল করলো লোকটি তার দিকে এগিয়ে আসছে।যতই মানুষটি তার কাছাকাছি আসছে ততই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে।আরজু চোখ বন্ধ করে বির বির করে বললো

-“ওহ গড! এই ছেলে আমার হার্ট ব্লাস্ট করে ছাড়বে নাকি?”

চোখ খুলতেই সে লোকটিকে তার অতি নিকটে ব্রু যুগল কুচকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো।আরজু দ্রুত উঠে দাড়ালো।মানুষটি অত্যন্ত বিরক্তি মাখা কন্ঠে ধমকের সুরে বলে উঠলো

-“আপনি এখনো এই অবস্থায় বসে আছেন কেনো?বাসায় যাননি কেনো?”

আরজু কিছুটা থতমত খেয়ে বললো
-“আ…আসলে ওই ছে…..ছেলেটার কি অবস্থা জানার জন্য বসে ছিলাম।”

-“ছেলেটা ভালো আছে।মাথায় অনেকটা আঘাত লেগেছিল। বাট নাও হি ইস ফাইন।আর তার ফেমিলিকেও ইনফ্রম করা হয়েছে।”

-“ওও!আচ্ছা।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।আপনি হেল্প না করলে কি যে হতো?”

-“ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই।এটা আমার দায়িত্ব।আর ছেলেটার সাথে যারা এমন করেছে তাদের যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা ও আমি করবো।”

আরজু এক দৃষ্টিতে মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ করছে।মানুষটির কণ্ঠেও কেমন যেনো গাম্ভীর্যতা বিদ্যমান।
আরজু বললো

-“আচ্ছা আমি আসছি।”

লোকটি গম্ভীর স্বরে বললো
-“আমার সাথে চলুন আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিবো।”

কথাটা বলেই লোকটি সামনে এগিয়ে গেলো।আরজু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।লোকটি তার মতামত শুনার প্রয়োজন বোধ করলো না।আরজু ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো বেশ রাত হয়ে গেছে।আজ খালামণি আর তাকে আস্ত রাখবে না।সে দ্রুত লোকটির পিছু পিছু ছুটলো।

সারা রাস্তা লোকটি আর একটা কথাও বললো না।আরজু কিছু সময়ের মধ্যে বুঝে গেলো লোকটি স্বল্পভাষী আর গুরুগম্ভীর প্রকৃতির।সে বার বার আড়চোখে লোকটিকে দেখতে লাগলো। এতো গম্ভীর লোকটির চোখ জোড়া এতো মায়াময় কি করে?তার বাসায় পৌঁছাতেই আরজু গাড়ি থেকে নেমে লোকটিকে ধন্যবাদ জানালো।

লোকটি গম্ভীর স্বরে বললো
-“ইটস ওকে।বাই দা ওয়ে এতো রাত অবধি বাহিরে কেনো ঘুরছিলেন?নেক্সট টাইম যেনো এমন না হয়।”

আরজু কিছুটা চমকে গেলো।লোকটি শেষের কথাটি ভীষণ কঠিন হয়ে বলেছে।লোকটি আর সময় ব্যায় না করে দ্রুত গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।আরজু বেশ কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে লোকটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।মানুষটি ভীষণ অদ্ভুত।যার মুখে এক রাশ বিরক্তি কিন্তু চোখে এক সমুদ্র মায়া।এমন অদ্ভুত সুদর্শন পুরুষের খোঁজ সে আগে কখনো পায়নি।

********
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর একদিন রাতে হসপিটাল থেকে খবর আসে ফুয়াদ বাইক এক্সিডেন্ট করেছে। তাই তারা সব ফ্রেন্ডরা ছুটে গেছে তাকে দেখতে।ফুয়াদ খুব একটা আহত না হলেও পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে।ফুয়াদ সবাইকে দেখে বিরক্তি নিয়ে বললো

-“তোরা সবাই এমন ভাবে ছুটে এসেছিস যেনো আমি কোমায় চলে গেছি।”

জারা ব্রু জোড়া কুচকে বললো
-“আমি তো এমনই ভেবেছিলাম।যেই ভাবে কল করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিস।আমি ভাবলাম এখানে আসার পর না জানি কত কান্নাকাটি করতে হবে তাই চোখে কাজল অব্ধি পড়িনি।পড়ে আবার আমাকে দেখতে বাজে লাগবে।”

ফুয়াদ বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বললো
-“ওই!!!এরে কে নিয়া আসছে?আমার মেজাজ কিন্তু খারাপ হচ্ছে।”

আরজু বললো
-“আচ্ছা এমন হলো কি করে? কোন গার্লফ্রেন্ড এর কাছে দিন দুনিয়া ভুলে ছুটে যাচ্ছিলি?”

জারা মুখ বাঁকিয়ে বললো
-“নিশ্চই কোনো একটা রুমডেট অফার করেছিলো।তাই তো উড়ে যেতে চাইছিল।বেচারা রুমডেট রেখে হসপিটাল ডেটে এসে পড়েছে।”

ফুয়াদ রেগে এক ধমক দিলো দুজনকে।
তখনই তার কানে আসলো সাবিহার ফুপানোর শব্দ। এমনি ফুয়াদের মেজাজ গরম তার উপর সাবিহার কান্না তার মাথা আরো গরম করে দিচ্ছে।সে বেশ জোড়ে ধমক দিয়ে বললো

-“রামিম এইটারে ও আমার চোখের সামনে থেকে নিয়া যা।যাদের কান্না করার কথা তারা দেখতে অব্ধি আসেনি।আর এইগুলা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।আজাইরা যত্তসব।”

শুভ বুঝতে পারলো ফুয়াদের রাগের কারণ। ফুয়াদ তার বাবা মার কথা বলছে।তারা কাজে মাঝে এতটাই ডুবে থাকে যে ছেলের এমন খবর শুনেও আসার সময় পায়নি।ফুয়াদ ছোট বেলা থেকেই এমনটা দেখে এসেছে।তার বাবা মা তাকে কখনোই সময় দেয়নি।ছেলেটা কাজের লোকেদের হাতেই মানুষ হয়েছে।সে কোনো কিছুর অভাব না পেলেও পিতা মাতার ভালোবাসার বেশ অভাব অনুভব করেছে।

ফুয়াদের কথায় সবারই মন খারাপ হয়ে গেলো।আরজু পরিস্থিতি সামাল দিতে বললো

-“যাই বলিস একটা জিনিষ ভালই হলো,ফুয়াদের বাহানায় রাতে মুভি দেখতে বের হতে পারবো।নাহলে খালামণি কিছুতেই আমাকে বের হতে দেয় না।কতদিন ধরে রাতের শো দেখিনা।এই তোরা যাবি?”

জারা খুশি হয়ে বললো
-“আমার কোনো প্রবলেম নেই।নতুন একটা মুভি রিলিজ হয়েছে।কালকের টিকেট বুক করি?”

ফুয়াদ মন খারাপ করে বললো
-“আমার এই অবস্থা আর তোরা মুভি দেখার প্ল্যান করছিস?অমানুষের দল।”

রামিম বিরক্ত হয়ে বললো
-“আরে বাবা আমরা তোর কাছে আসলেও সমস্যা আবার না আসলেও সমস্যা।যাবো কোথায়?”

জারা খুশি হয়ে বললো
-“কোথায় আর যাবি?আমাদের সাথে মুভি দেখতে যাবি।এই ফাজিলকে দেখতে এসেছি বলে কত কথা শুনলো।আর আসবো নাকি এই জায়গায়?হুম!!”

বলেই মুখে ভেংচি কাটলো। শুভ আর সাবিহা এদের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে।ফুয়াদ মলিন মুখে বললো
-“যা যা আমার আর কাউকে লাগবে না।”

সাবিহা বললো
-“আমাদের বিদ্যাসাগর আসেনি?নাকি খবর পায়নি?”

শুভ বললো
-“আমি জানিয়েছি।ওর আর্মি বাপ আজ বাসায়।ওকে কিছুতেই বের হতে দিবে না।বললো কাল সকালে আসবে।”

ফুয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো
-“অনেক রাত হয়ে গেছে।তোরা বাসায় চলে যা।”

রামিম বললো
-“হে তোরা যা আমি থাকবো।”

ফুয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো
-“থাকার কোনো দরকার নেই।বাসায় যা।আমি অতটা ও অসুস্থ না।”

-“বেশি কথা বলিস না তো।আমি থাকছি।তোরা চলে যা।”

জারা সাবিহাকে নিয়ে তার গাড়িতে উঠে চলে গেলো।আর আরজু শুভর বাইকে উঠে রওনা দিলো।বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় আরজু কিছুটা চিন্তিত।কিছু দূর যাওয়ার পর ট্রাফিক সিগন্যালে পুলিশ তাদের দার করালো।আরজু কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।কারণ সামনের পুলিশটি অদ্ভুদ নজরে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।পুলিশটি শুভকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“এতো রাতে মেয়ে মানুষ নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

শুভ বললো
-“আসলে স্যার আমরা হসপিটাল থেকে আসলাম।আমাদের এক বন্ধু এক্সিডেন্ট করেছে। তাকে দেখতেই হসপিটালে গিয়েছিলাম।”

লোকটি অদ্ভুত হেসে বললো
-“বলদ পাইছোস আমারে? এত রাত্রে মানুষ বন্ধুরে দেখতে হসপিটালে যায়? নাকি কাহিনী অন্য কিছু? আবোশ্‌ন্ কড়াইতে নিয়ে যাস নাই তো?”

মুহূর্তেই শুভর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।আরজুকে নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য সে সহ্য করতে পারে না।আরজু শুভর পিঠ খামচে ধরলো।তার চোখ ফেটে কান্না আসছে।শুভ কিছুটা রেগে বললো

-“ফালতু কথা বলবেন না।না জেনে এমন কথা কি করে বলতে পারেন।আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড।”

-“এমন আগুন সুন্দরী মেয়ে নিয়ে রাতবিরাতে ঘুরে বেড়াবি আর আমরা জিজ্ঞেস করলেই ফ্রেন্ড হয়ে যায়। এমন অনেক দেখছি।ফ্রেন্ড বইলা রাতভর ফুর্তি করে।”

শুভর ভীষণ রাগ হচ্ছে।লোকটি পুলিশ না হলে এতক্ষনে কয়েক গা বসিয়ে দিতো।তবুও সে থেমে থাকলো না।কথায় কথায় একসময় দুজনে মধ্যে তর্ক বিতর্কর সৃষ্টি হয়।আরজু ভীষণ ভয় পাচ্ছে।আজ কোনো ঝামেলা হলে খালামণি তার বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিবে।

ঠিক সেই সময় সেখানে একটা গাড়ি এসে থামে।গাড়িটি দেখেই এই দুজনের তর্ক থেমে যায়।গাড়ি থেকে মানুষটি বেরিয়ে আরজু দের সামনে এগিয়ে আসে।আরজু লোকটিকে দেখে থমকে গেছে।সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মানুষটির দিকে।সেদিনের সেই গম্ভীর ছেলেটি।মানুষটির সাথে এক পলক তার চোখাচোখি হলো।আরজুর বুক ধক ধক করতে শুরু করলো।আরজু চোখ না সরালেও মানুষটি চোখ সরিয়ে পুলিশটির দিকে তাকালো।পুলিশটি সাথে সাথে একটা সালাম দিলো।আরজু কিছুটা অবাক হলো।লোকটি সেই অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“কি সমস্যা?কি হচ্ছে এখানে?”

অফিসারটি কাচু মাচু করে বললো
-“কি আর বলবো স্যার? বর্তমানে ছেলে মেয়েদের যা অবস্থা।এই রাতে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাল এইসব মেয়েরাই থানায় এসে রেপ কেস করবে।রাতে এদের হুস থাকে না।এদের ফ্যামিলি কেমন আল্লাহই জানে।”

শুভ রেগে বললো
-“মুখ সামলে কথা বলুন।আমরা ডিসেন্ট ফ্যামিলির ছেলে মেয়ে।”

অফিসারটি বাঁকা হেসে বললো
-“দেখলেন স্যার ডিসেন্ট ফ্যামিলির নমুনা?”

লোকটি চোখ গরম করে অফিসারের দিকে তাকালো।অফিসারটি মুহূর্তেই মাথা নত করে নিল।এইবার লোকটি শুভকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“হোয়াটস হাপেন ব্র?”

-“আসলে স্যার আমি আর আমার ফ্রেন্ড হসপিটালে গেছিলাম।সেখান থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেছে।আর এই অফিসার তখন থেকে বাজে কথা বলে যাচ্ছে।”

লোকটি অফিসারের দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো।আরজু অবাক হলো।সেদিন তো সে এই চোখে অসীম মায়া দেখেছে।কিন্তু আজ দেখছে আগ্নেয়গিরি। লোকটি দমকের সুরে অফিসারটিকে বললো

-“এসব কি? আপনারা কি নিজেদের দায়িত্ব ভুলে গেছেন? পুলিশদেরকে মানুষের নিরাপত্তা প্রধানের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে।আর আপনারা বর্তমানে মানুষের বড়ো আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।রক্ষক যখন ভক্ষকদের মতো আচরণ করবে তখন সিস্টেম কি ভাবে চলবে?এমন চলতে থাকলে মানুষ আইন এর উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।”

অফিসারটি কাচুমাচু হয়ে সরি বললো। লোকটি শুভর উদ্দেশ্যে বললো
-“আচ্ছা তুমি লাইসেন্স দেখিয়ে চলে যাও।লাইসেন্স ঠিক আছে তো?”

-“জি।”

শুভ অফিসারকে লাইসেন্স দেখাতে চলে গেল। অন্যদিকে আরজু এখনো লোকটির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আজও তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। লোকটি তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে ধমকে বললো

-“আপনি আবার এত রাতে বাইরে বেরিয়েছে? একবার মানা করেছি না বাইরে বের হতে এত রাতে? কথা কি কানে যায় নি?”

আরজুর সারা শরীর কেঁপে উঠলো। কি ভয়ানক ধমক টাই না দিলে তাকে।আরজু ওই ভয়ঙ্কর সুন্দর চোখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না।মাথা নিচু করে নিলো।লোকটি যেমন চোখ ধাঁধানো ঠিক তেমন রাগী।তবে আরজু অবাক হলো লোকটি তাকে মনে রেখেছে।শুভ আসতেই লোকটিকে ধন্যবাদ জানালো।আরজু বাইকে উঠে বসতেই লোকটি সামনে এসে দাড়িয়ে শুভ কে উদ্দেশ্য করে বললো

-“লিসেন ব্রো।আমার মনে হয় এত রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে এই ভাবে বের হওয়াটা নিরাপদ না।রাস্তায় যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে।”

-“জি স্যার।আমি বিষয়টা মাথায় রাখবো।”

-“আচ্ছা বাসায় যাও।”

কথাটি বলতে বলতে আবার আরজুর সাথে চোখাচোখি হয়। এবার আরজু চোখ নামিয়ে নিলো।ওই ভয়ংকর চোখ দেখে সে ভয়ের চাইতে বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।বাইক কিছু দুর যেতেই আরজু আবার পেছন ফিরে তাকালো।আর মুহূর্তেই তার মুখ হা হয়ে গেলো।কারণ অফিসারটি এক হাত তার গালে রেখে অন্য হাতে ওই লোকটির পা জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।আরজু ঘটনা কিছুই বুজলো না।ততক্ষনে তারা সেই রাস্তা ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছে।আরজুকে চুপ থাকতে দেখে শুভ বললো

-“কীরে ঠিক আছিস?”

-“হুম।”

-“মন খারাপ?”

-“না।আচ্ছা ওই লোকটা কে?”

-“কোন লোকটা?”

-“আরে যে আমাদের হেল্প করলো?”

-“নিবরাস নাহিদ।এমপি নিজামুল হকের নাম শুনেছিস?”

-“হে টিভিতে দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে।উনি তো মারা গেছেন।”

-“নিবরাস নাহিদ উনার নাতি।উনি নিজেও রাজনীতিবিদ।এইবার মেয়র পদে দাড়িয়েছে।আমার বেশ ভালোলাগে উনাকে।আমি সিওর উনি জিতবে।আমিতো ভোট উনাকেই দিবো।তুইও না এইবার ভোটার হয়েছিস?আমি সাজেস্ট করবো ভোট উনাকেই দিস।”

আরজু বেশ অবাক হলো।এই লোক তাদের সিটির ফিউচার মেয়র?সে বিস্ময় নিয়ে বললো

-“উনাকে দেখে তো নেতাদের মতো অত বয়স্ক মনে হয় না।”

-“আরে গাধী নেতা মানেই কি বয়স্ক নাকি?উনি জাস্ট চার বছর আগে আমাদের ভার্সিটি থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করে বেরিয়েছে।”

-“বলিস কি?? এতো ইয়ং নেতাকে আমি জীবনে দেখিনি।”

-“তোর জীবনটাই আর কতটুকু যে দেখবি?”

-“আজাইরা।আচ্ছা উনি না আসলে কি হতো?আর ওই অফিসার কেমন বাজে ছিলো।আমার এখনো ভয় করছে।”

-“ভয় পাচ্ছিস কেনো?আমি আছি না?নিজের শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে তোকে রক্ষা করবো।”

-“ফিল্মি ডায়লগ কম ছার।আর জলদি আমাকে বাসায় পৌছে দে।”

শুভ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।এই মেয়েটা কখনোই তার অনুভূতি বুঝে না।সব সময় মজার ছলে উড়িয়ে দেয়।অথচ এই মেয়েটা কি জানে মেয়েটার চোখের এক ফোঁটা অশ্রু তার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়? শুভ মুচকি হেসে বললো

-“জো হুকুম মহারানী।”

সেদিন রাতেই আরজু বাসায় পৌঁছে খালামনির কাছে অনেক বকা শুনেছে।কিন্তু তার তাতে মোটেও মন খারাপ হয়নি।কেনো জানি তার মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিলো।সে রুমে এসেই ফেইসবুকে নিবরাস নাহিদ নামে সার্চ দিলো।সেখানে বেশ কিছু ইনফরমেশন পেলো নাহিদ সম্পর্কে।সাথে বেশ কিছু ছবি।ছবি গুলো আরজু বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো।বেশিরভাগ ছবিতে সাদা পাঞ্জাবি পরা।চোখ ধাঁধানো হ্যান্ডসাম লাগছে নেতা সাহেবকে।আরজু যেনো ব্লাস করছে।ছবি দেখে কে বলবে লোকটা এত গম্ভীর?সে নাহিদের ভেরিফাইড পেজে লাইক ফলো দিলো।কিন্তু নাহিদের রিয়েল আইডি খুঁজে পেলো না।অনেক অনেক আইডি আছে।কোনটা রিয়েল বুঝতে পারলো না।সারা রাত সে সেই ছবি গুলো দেখে পার করলো।তার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।এমন গুমরো মুখ লোককে দেখে তার হার্ট অত জোরে বিট করবে সে ভাবতে পারেনি। কেমন ব্যাথাময় সুখ অনুভব হচ্ছে।সব কিছুই ভালো লাগছে।আজ এই অমাবশ্যার রাতটাও তার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছে।সে গুন গুন করে গাইতে লাগলো

“প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে।”❤️❤️

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_4

রাতের আঁধার কাটিয়ে সকাল হয়েছে অনেক আগেই।সাবিহা তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন।হঠাৎ চেঁচামেচির শব্দ শুনে ঘুম ভেংগে গেল তার।সে ভীষণ বিরক্ত বোধ করলো।প্রায় প্রতিদিন তার ঘুম এই ভাবেই ভাঙ্গে।সে বিরক্তিতে কানে বালিশ চাপা দিলো।না কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা।বালিশটা ছুড়ে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।ডাইনিংয়ে তার ছোট ভাই বোনের তুমুল ঝগড়া চলছে।সাবিহা দুজনকে ধমক দিলো।আর বললো

-“তোদের জন্য কি শান্তি মতো ঘুমোতে পারবো না?”

সজীব বললো
-“আপু আমার কোনো দোষ নাই।এই সাজিয়া আমার আমার রং তুলি সব নষ্ট করে ফেলছে।কালো রং অন্য সব রঙের সাথে মিক্স করে রাখছে।কি পরিমান ফাজিল চিন্তা করেছ?”

সাজিয়া বিরক্ত হয়ে বললো
-“বেশ ভালো করেছি।আমি কাল যখন একটু রং করতে চেয়েছিলাম তখন আমাকে দিলেনা কেনো?আব্বু তো কিনে দেওয়ার সময় বলেছে দুজনকেই রং করতে।কিন্তু তুমি আমাকে দাওনি।”

-“তাই বলে সবগুলো পটে কালো রং মিক্স করবি?একটা রং ও এখন ইউজ করা যাবে না।তাছাড়া এই রং তো তুই ইউজ করতেই পারিস না।শুধু শুধু নষ্ট করিস।তাই তোকে দেইনি বেয়াদব।”

-“আমি পারিনা না নাকি তুমি পারনা?কি সব ফালতু ছবি আঁকো।কাকের ঠেং বগার ঠেং।”

-“কি বললি দারা তোর খবর আছে।”

বলেই সে সাজিয়ার চুল ধরে টানতে লাগলো।
সাবিহার মা রুটির বেলুন হাতে নিয়ে এসে দুজনকে ধমকে বললো
-“রং নষ্ট করেছিস না?আর কিনে দিবো না।আমার সামনে যদি আর রঙের নাম নিস তাহলে এই বেলুন দিয়ে পিটাবো।”

তারা তবুও থামলো না।সাবিহা এবার এসে দুজনকে ছড়িয়ে ধমক দিলো।
দুজনেই এবার ঝগড়া থামালো।সাবিহা সাজিহাকে বললো
-“তোরা মারা মারি বন্ধ কর।সাজি এই ভাবে রং নষ্ট করবি না।তোর জন্য আমি আলাদা রং কিনে দিবো।সজীবের টা নিবি না।”

সাজিয়া খুশি হয়ে বললো
-“তাহলে আজকেই কিনে দিবে।”

-“আচ্ছা।”

সজীব আর সাজিয়া চলে গেলো স্কুলের উদ্দেশে।সজীব এবার এসএসসি দিবে।আর সাজিয়া জেএসসি।দুই ভাইবোন সারাদিন ঝগড়া লেগেই থাকে।সাবিহা ঠিক যতোটা শান্ত ছোট দুইজন ঠিক ততটাই অশান্ত।

সাবিহার মা সাবিহাকে বললো
-“তুই দাড়িয়ে আছিস কেনো?তোর ক্লাস নাই?”

-“আছে আম্মু।আচ্ছা আব্বু কোথায়?”

-“সে তো সকালেই অফিসে চলে গেছে।”

-“আচ্ছা আমি রেডি হয়ে আসি।”

সাবিহা নিজের রুমে এসে রামিম কে কল করলো।বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে রামিমের ঘুমন্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো।

-“হেলো কে?”

সাবিহা শুকনো ঢোক গিললো।কেমন মাতোয়ারা কণ্ঠ।প্রতিদিন এই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলে মন্দ হয় না।সে মুচকি হেসে বললো

-“তোর রাজ্যের রাণী।”

রামিম ঘুমের মাজেই বির বির করে বললো
-“যার রাজ্যই নাই তার আবার রানী।”

সাবিহা নরম সুরে বললো
-“আমি রাজ্যহীন রাজার রাণী।”

এবার রমিমের ঘুম ছুটে গেলো।সে দ্রুত ফোন সামনে এনে দেখলো সাবিহা কল করেছে।সে গলা পরিষ্কার করে বললো
-“সকাল সকাল ঘুমের ডিস্টার্ব করছিস কেনো?”

-“সকাল কোথায়?সাড়ে নয়টা বাজে।”

-“আল্লাহ বলিস কি?এত ঘুমালাম?আচ্ছা রাখছি আমার কাজ আছে।ভার্সিটিতে দেখা হবে।”

-“আচ্ছা।আর শোন তোর প্র্যাক্টিক্যাল খাতা আমি রেডি করে ফেলেছিস।আজ নিয়ে আসবো।”

-“থাংস রে।অনেক উপকার হলো।আমার হাতে একদম সময় ছিলো না।”

-“ব্যাপার না।ok রাখছি।”

রামিম দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠলো। ওয়াস রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে আসলো।টেবিলে নাস্তা সাজানো। সে দ্রুত মায়ের রুমে গেলো।মা নেই।নিশ্চই স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে গেছে।সে মাকে দ্রুত কল করে বললো

-“আমাকে আজ ডাকলে না কেনো?”

-“তুই ঘুমিয়ে ছিলি তাই ডাকিনি।আর আমার স্কুলে আজ কাজ আছে তাই জলদি এসেছি।তুই নাস্তা করে ভার্সিটিতে যা।”

-“নেক্সট টাইম এমন করবে না।যত কাজ থাকুক আমি নিয়ে যাবো। ওকে?”

-“আচ্ছা বাবা।তুই নাস্তা করে নে।”

রামিম কল কেটে নাস্তা করতে বসে পড়লো।এই পৃথিবীতে একমাত্র আপন বলতে তার মা ছড়া আর কেউ নেই।সেই তেরো বছর বয়সে সে বাবাকে হারিয়েছে।বাবার মৃত্যুর পর মা বহু কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে।বহু অভাব অনটনের মাঝে তাদের দিন কেটেছে।বাবার ছায়া হারানোর পর সব আত্মীয়স্বজনরাও কয়েক কদম পিছিয়ে দাড়িয়েছে।আসলে আত্মীয়স্বজনদের ভালোবাসা নির্ভর করে আর্থিক পরিস্থিতির ওপর।ভাগ্যিস বাবা এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিলো।মা হাই স্কুলে জব করে।মা অনেক পরিশ্রম করে রমিমকে এই অবস্থান অব্ধি নিয়ে এসেছে।

মাকে একটু সাপোর্ট করার জন্য রামিম বেশ কয়েকটা টিউশন করে।এতে করে নিজের হাত খরচ চলে যায়।মা একা আর কত করবে?একবার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারলে একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে।চাকরি পেলেই মাকে সে আর কষ্ট করতে দিবে না।অনেক করেছে মা।নিজে না খেয়ে হলেও তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। এবার তার পালা।

রিমি আজ কিছুটা ভয়ে ভয়ে ডাইনিং রুমে এসেছে।আজ সে আধা ঘণ্টা দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। নির্ঘাত বাবার বকা খাবে। কারণ তার বাবা কড়া ভাবে ডিসিপ্লিন মেনটেন করে চলে।টেবিলের সামনে এসে সে নীরবে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।তার বাবা মনোযোগ দিয়ে ব্রেকফাস্ট করছে।পাশেই তার বড়ো ভাই নিশান বসে আছে।ভাইয়ের মাঝে সে বাবার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।ভীষণ গম্ভীর আর শান্ত।সে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা জবে ঢুকেছে মাত্র।মাঝে মাঝে তার ভাইকে আর বাবাকে দেখলে যন্ত্রমানব মনে হয়। সেও কিছুটা এমন ছিলো।কিন্তু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।রিমি কিছুটা ভয়ে ভয়ে নাস্তা করতে লাগলো।ঠিক তখনই তার বাবা গম্ভীর স্বরে বললো

-“রিমি আজ তুমি আধা ঘণ্টা লেট।”

রিমি একটু ভয়ে ভয়ে জবাব দিলো
-“সরি আব্বু।আর এমন হবে না।”

-“আজকাল তুমি বেশ ইনডিসিপ্লিন হয়ে পড়েছ।সবই বাজে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গ দোষে। জানো তো সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।তোমার অবস্থাও তেমন।বাজে বন্ধু দের কাছথেকে দোষ হাত দূরে থাকবে।বুঝেছ?”

-“জি আব্বু।”

রিমি মনে মনে ভাবলো তার যেই বোল্ড ফ্রেন্ডস গ্রুপ আর ওদের যেই ভাষা,এদের দেখলে বাবা নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবে।সে দ্রুতই খাবার শেষ করে ভার্সিটির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো।

********
আরিফা ম্যামের ক্লাস চলছে।সবাই মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করলেও জারার কোনো মনোযোগ নেই।এই চ্যাপ্টারের সব কিছুই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।যা মাথায় ঢুকছে না সেখানে মাথা খাটানো নেহাত বোকামি।সে জানালার বাইরে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ তার চোখ পড়লো একটা ছেলের দিকে।সেই দিনের জুনিয়র ছেলেটা।অবাক করা বিষয় হলো আজ কাল প্রায়ই এই ছেলেটা তার চোখের সামনে পড়ে।এটা কি কোন কোইন্সিডেন্ট?ছেলেটা প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে পাশের ছেলেটা সাথে কথা বলছে।জারার সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়ে গেলো।ছেলেটা কেমন করে তার হাতে চুমু খেয়েছিল।সাবিহার ধাক্কায় তার ধ্যান ফিরলো।সে সামনে তাকাতেই দেখলো আরিফা ম্যাম কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সাবিহা ফিসফিসিয়ে বললো

-“কোন অচিন পুরে হারিয়ে গেছিস?”

-“আরে কিছু না।এই ক্লাস আমার গলায় কাটা হয়ে বিধে আছে।শেষ হবে কখন?”

-“গত টেস্টে কিন্তু এই সাবজেক্টে ফেল মেরেছিস।ফাইনালে ফেল মারলে খবর আছে।”

-“ইসস!! আমি একা মেরেছি নাকি?ওই ফুয়াদ আর আরজু ও মেরেছে।খালি আমাকে বলিস কেনো?”

-“ওরা শুধু এইটাতে ফেল করেছে কিন্তু তুই আরো দুই সাবজেক্ট ফেল করেছিস।”

-“আমার কি দোষ! কোশ্চেন এত কঠিন করছে কেন? আমার মত মাসুম বাচ্চা সারা দিন-রাত পরেও পাস করতে পারলো না।”

ঠিক তখনই আরিফা ম্যাম জারাকে দার করালো।জারা জানে এই মহিলা এখন তাকে সারা ক্লাসের সামনে বকা শুনবে।ঠিক তাই হলো।সাথে ক্লাস থেকে বের করে ও দিলো।জারাকে যেতে দেখে ফুয়াদ হুট করে হেসে দিলো।জারা চোখ গরম করে তাকিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো।যাক ভালই হলো।এই বোরিং ক্লাস থেকে মুক্তি পেয়ে জারা বেশ খুশি।সে সোজা ক্যান্টিনে চলে গেলো।ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে মাথা ঠান্ডা করতে হবে।

জারা বসে বসে কোলড্রিংস খাচ্ছে আর আশেপাশে তাকাচ্ছে। হঠাৎ তার পাশের চেয়ারে কাউকে বসতে দেখে চমকে উঠলো। সে দেখতে পেল সেই ছেলেটা। আশ্চর্য একটু আগেই তো ছেলেটিকে মাঠে দেখেছে।এই জায়গায় আসলো কখন?

ছেলেটা মুচকি হেসে বললো
-“কেমন আছেন আপনি জারা?”

জারা বেশ অবাক হলো।তার চাইতে তিন বছর জুনিয়র ছেলে তার নাম ধরে ডাকছে?সে কপাল কুচকে বললো
-“এই ছেলে তুমি তো ভারী বেয়াদব?সিনিয়র দের নাম ধরে ডাকছো।আপু বলো।”

জাহিদ ফিক করে হেসে বললো
-“এই ভার্সিটির সব মেয়েই আমার আপু।কিন্তু আপনি ছাড়া।”

-“লিসেন সেদিন আমরা জাস্ট তোমার সাথে মজা করছিলাম।কোনো ভাবে বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়ে নাওনি তো?”

-“আপনার বিষয়ে আমি অলওয়েজ সিরিয়াস।”

জারার এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।এই ছেলে গভীর জলের মাছ।সে বিরক্তি নিয়ে বললো
-“তোমার সাহস আছে বলতে হয়। সিনিয়রদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? আজকালকার ছেলেদের মধ্যে কোন ম্যানার্স নেই।ফালতু যতসব।”

বলেই জারা ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসলো।তার মেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছে।অন্যদিকে জাহিদ জারার যাবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো।জারাকে বিরক্ত করে সে ভীষণ মজা পেয়েছে।মেয়েটা একটু পাগলাটে আর অনেক রাগী।

আরজু বাসায় এসে দেখতে পেলো তার খালুজান কে।তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে।আরজু তার পাশের সোফায় বসে বললো

-“কি খবর মিস্টার হ্যান্ডসাম?বাসায় কখন আসলে?”

জুবায়ের আহমেদ মুচকি হেসে বললো
-“এইতো সুইটি দুপুরের দিকে।তোর কি অবস্থা?”

-“আমি বিন্দাস আছি। ম্যাডামের সাথে দেখা হয়েছে?”

-“হুম হয়েছে।রান্নাঘরে আছে। আসছি পর থেকে কোনো কথাই বলছে না।ভীষণ রেগে আছে।”

-“থাকবেই তো।এক সপ্তাহ বলে দুই সপ্তাহ পর বাসায় এসেছ।”

-“আরে অফিসে কাজ শেষ করতে না পারলে কি করে আসি?কিন্তু তোর খালামণিকে কে বুঝাবে?অথচ ঢাকায় থাকলে সে নিজেই কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। তখন অ্যাডভোকেট সাবা খানম এর দেখাই পাওয়া যায়না।”

-“তোমাদের দুজনের সংসার করা দেখলে মাঝে মাঝে আমার ভীষণ রাগ হয়। সারাদিনই দুইজন নিজেদের কাজে ব্যস্ত।”

-“কি করবো বল? কিন্তু হাজারো ব্যস্ততার মাঝে আমি তোর খালামণির খেয়াল ঠিকই রাখি। কারণ ওই রাগের রানীকে ভীষণ ভালোবাসি।”

আরজু খিল খিল করে হেসে উঠলো।তার খালুজান আর খালামনির লাভ ম্যারেজ।খালামণি ঠিক যতোটা রাগী খালুজান ঠিক তেমনি মজার মানুষ।বাসায় থাকলে সারাক্ষণ খালামণিকে বিরক্ত করবে আর রাগিয়ে দিবে।আবার একটু পর বিভিন্ন ভাবে খালামনির রাগ ভাঙাবে।

আরজুর হঠাৎ মনে পড়ে গেলো তার মাও ঠিক এমন রাগী ছিলো।আর তার বাবাও ঠিক এই ভাবে মায়ের রাগ ভাঙাতো। মুহূর্তেই আরজুর দুচোখ ভরে আসলো।ভীষণ মিস করে সে বাবা মাকে।জুবায়ের আহমেদ আরজুর বিষণ্ণ মুখ দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-“বাবা মার কথা মনে পড়ছে?”

আরজু জুবায়ের আহমেদের কাঁধে মাথা রেখে বললো
-“আব্বু আম্মু এত জলদি আমাকে রেখে চলে গেল কেন?”

জুবায়ের আহমেদ আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-“কে বলেছে তারা চলে গেছে?তারা তো সব সময় তোর পাশেই আছে।এইযে তুই মন খারাপ করছিস সেটা দেখে তাদেরও মন খারাপ হচ্ছে।”

-“আব্বু আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো।”

-“কেনো আমি বাসি না?”

-“হুম তুমি ও বাসো।অবনির চাইতেও বেশি বাসো।”

জুবায়ের আহমেদ মুচকি হাসলেন।আরজুকে তিনি নিজের মেয়ের চাইতেও বেশি ভালোবাসেন।আরজুর জন্মের পর তার মিষ্টি হাসি দেখে তিনি কেঁদে দিয়েছিলেন।এমন সুন্দর আর মিষ্টি বাচ্চা এর আগে তিনি দেখেননি।

আরজু যখন ক্লাস সিক্সে পড়ত তখন তার বাবা মা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়।আরজুর মা স্পট ডেথ ছিলো।আর বাবা আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।পাঁচদিন পর তিনিও মারা যান।মারা যাওয়ার আগে তিনি তার মেয়ের দায়িত্ব জুবায়ের আহমেদ আর সাবা খানমের কাছে দিয়ে যান।আরজু সেদিন অনেক কেঁদেছিল।কয়েকদিনের মাঝেই সে বাবা মাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেছিলো।সেই সময় গুলিতে আরজু অনেক নিশ্চুপ হয়ে গেছিলো। কারো সাথে কথা বলতো না।হাস্য উজ্জ্বল মেয়েটা কেমন মলিন হয়ে পড়েছিল।তখন তার আত্মীয় স্বজন সকলেই আরজুকে সামলিয়েছে।।

শুভ তখন সারাক্ষণই আরজুর পাশে ছিলো।তাকে সারাক্ষণ নানান বাহানায় বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতো।স্কুলে তার খেয়াল রাখতো। ধীরে ধীর আরজু আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল। আরজুর ছোট চাচা তাকে তার সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তিনি ও তার একমাত্র ভাতিজিকে ভীষণ ভালোবাসতেন। কিন্তু সাবা আর জুবায়ের আহমেদ আরজুকে নিয়ে যেতে দেননি।কারণ আবির তাদের কাছে আরজুর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।

আরজু লাঞ্চ শেষ করে নিজের রুমে এসে টেবিলে বসে পড়লো।আজ নেতাসাহেবকে একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে হলো।একটা পেপার আর পেন নিয়ে লিখতে বসে পড়লো সে।

প্রিয় নেতা সাহেব,
সাদা কি আপনার ভীষণ পছন্দের রং?নাহলে সব সময় শুধু সাদা পাঞ্জাবি কেনো পড়েন?সাদা পছন্দের রং হয় কি করে আমি বুঝতে পারিনা?এতে তো কোনো রঙই নেই।কেমন মলিন আর ফ্যাকাসে।আপনার কমলা রঙের পাঞ্জাবি ট্রাই করা উচিত।গতকাল আমার স্বপ্নে আপনি কমলা রঙের পাঞ্জাবিতে এসেছিলেন।ভীষণ মিষ্টি করে হেসে নিজের হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন

“বসন্ত এসে গেছে। এখন অন্তত চলো আমার সাথে।”

আমি বিমোহিত হয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলাম।কারণ আপনাকে প্রথম হাসতে দেখেছি।এতো মিষ্টি হাসি আপনি লুকিয়ে রেখেছিলেন কেনো?তাছাড়া আপনার সাথে যাওয়ার জন্য তো আমি সেই কবেই তৈরি।আপনি এতদিনে বুঝলেন?কিন্তু আমি যখন আপনার হাত ধরতে গেলাম তখন কেমন ধোয়ার মাঝে আপনি হারিয়ে গেলেন।আপনি জানেন আপনার হাত ধরতে না পারায় আমি কেমন অস্থির হয়ে পড়েছিলাম?আমাকে অস্থিরতায় ফেলে ভীষণ মজা পান তাইনা?আমি ও আপনাকে একদিন এতো অস্থিরতায় ফেলবো।তখন বুজবেন হৃদয়দহন কাকে বলে।
ইতি
আপনার বিশেষ কেউ।

আরজু চিঠিটা ভাঁজ করে খামে ভরে নিলো। এবার এটা নেতা সাহেবের কাছে পাঠানোর পালা।এই দুঃসাহসী কাজটি প্রথম করেছিল বছরখানেক আগে।অনেকটা আবেগের বসেই সে নেতা সাহেবের কার্যালয় অফিসে একটা চিঠি পাঠায়। এর পর থেকেই সে মাঝে মাঝেই চিঠি পাঠায়।তার এই কাজে জারা প্রথমে অনেক বকা ঝকা করলেও আরজুর মনে অবস্থা বুজে আর কিছুই বলতো না।আরজুর এই পাগলামিতে সেও সারা দিতো।
*******