মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৭+৮

0
549

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_7

পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়ছে।ব্যাস্ত রাস্তায় ছুটে চলছে অবনিদের বাস।অনেকক্ষণ হইহুল্লোড় করে কাটালেও এই মুহূর্তে সবাই বেশ ক্লান্ত।সবাই নিজেদের সিটে বসে ঝিমুচ্ছে।কিন্তু অবনি মোটেও আরাম করে বসে থাকতে পারছেনা।বেশ অনেক্ষণ আগেই তার টয়লেটে যাবার প্রেসার এসেছে।তখন হইহুল্লোড় করে বেশ কয়েক বোতল কল্ড্রিংস গিলেছিলো।যার ফলে এই মুহূর্তে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।সে শক্ত হয়ে বসে আছে।একটু পর নাকি বাস বিরতি দিবে।অবনি আল্লাহ আল্লাহ করছে।আরজু আপুর বদদোয়া লেগে গেছে। এখন তার সিট নষ্ট হবার যোগাড়।

কিছুক্ষণ পর বাস থামতেই অবনি রীতিমত হুড়মুড়িয়ে বাস থেকে নামলো।তার বেশিরভাগ ফ্রেন্ডরা তখন গভীর ঘুমে।সে এক প্রকার দৌড়ে আগে ওয়াসরুমে গেলো।বেশ কিছুক্ষন পর বের হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। একটুর জন্য সিট নষ্ট হয়নি।সে রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে বসে এক গ্লাস পানি খেলো।এক কাপ কফি ও অর্ডার করলো।নিজেকে চাঙ্গা করার জন্য কফিটা ভীষণ জরুরি।বেশ আয়েসি ভঙ্গিতে কফি খেতে খেতে তার চোখ পড়ল ঘড়ির দিকে।সাথে সাথেই তার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো।তার বাস মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য বিরতি দিয়েছিলো।এখন প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।

অবনি হাতের কফি ফেলেই এক দৌড় দিলো।রেস্টুরেন্টের গেটের কাছে যেতেই অসাবধানতা বশত কারো সাথে বেশ জোড়ে ধাক্কা খেল।অবনির সে দিকে তাকানোর সময় নেই।সে দৌড়ে রাস্তায় আসলো।রিতিমত হাপিয়ে গেছে সে।কিন্তু রাস্তায় সে তার বাসটিকে দেখতে পেল না। মুহুর্তেই তার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো। তার মানে সে বাসটি মিস করেছে?তার ফ্রেন্ডরা কেউ তার খবর রাখলো না?পর মুহূর্তেই মনে পড়লো ওরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলো।আর সে কাউকে না বলেই বাস থেকে নেমে গেছে।নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই বার বার গালি দিচ্ছে।

ঠিক সেই সময় পেছনে একটা ছেলে তাকে ডাকতে লাগলো।ছেলেটা এসেই ধমকের সুরে বললো
-“ওই আপা বিল না দিয়া দৌড় দিলেন কেন?কফির বিল দেন।”

অবনির মনে পড়লো সে তার ব্যাগ, পার্স সব বাসে রেখেই নেমে পড়েছে।এই মুহূর্তে তার কষ্টে কাদতে মন চাইছে।সে ছেলেটার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো

-“সরি ভাইয়া।আমার কাছে এই মুহূর্তে কোনো টাকা নেই।”

ছেলেটা বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-“টাকা নাই মানে?টাকা না থাকলে অর্ডার কেন দিছেন?দেইখা তো ভালো ঘরের মনে হয়।কিন্তু কাম ছোট লোকের মতন করছেন।”

অবনির এবার বেশ রাগ হলো। এমনিতেই সে মহা ঝামেলায় ফেঁসে গেছে।তার উপর এই ছেলে।সে একটু কড়া ভাবে বললো
-“মুখ সামলে কথা বলুন।নেহাত একটা বিপদে পড়েছি।নাহলে আপনার খবর করে ছাড়তাম।”

ছেলেটাও রেগে তর্ক শুরু করলো।অবনির মন চাইছে এই ছেলেটার কানের নিচে একটা বসিয়ে দিতে।কিন্তু ভুল তো তার ছিলো।তখনই পাশে একটা লোক এসে বললো
-“কি সমস্যা?”

ওয়াটার ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বললো
-“দেখেন ভাই মানুষ কতো বাটপার হয়ে গেছে।এই আপায় কফি খেয়ে বিল না দিয়েই ভাগতে চেয়েছে।আমি ধরে বিল চাইলে বলে টাকা নাই।”

অবনি রেগে বললো
-“আমি মোটেও পালিয়ে যায়নি।আমার বাস মিস হয়ে গেছে।আমার ব্যাগ বাসেই ছিলো।”

লোকটি সেই ছেলেটিকে টাকা দিয়ে বিদায় করে অবনীকে বললো
-“বর্তমান জেনারেশনের এই এক সমস্যা।তোমরা পিচ্চিরা বুঝ কম।বাস কখন ছাড়বে সেই খেয়াল থাকে না।আর এই ভাবে দৌড়ানোর আগে আসে পাশে দেখে নিতে হয়।তোমার জন্য আমার ফোনটা ভেঙে গেছে।”

বলেই লোকটি ফোনটি দেখলো।অবনি দেখলো ডিসপ্লে ফেটে গেছে।সে বুঝতে পারলো তখন এই লোকটির সাথেই তার ধাক্কা লেগেছে।
লোকটি আবার বললো

-“তোমাদের মধ্যে তো সরি বলার মেনার্স টুকুও নেই।”

অবনির রাগ হচ্ছে।তবে লোকটি সাহায্য করেছে তাই সরি বলাই যায়।
-“সরি।আসলে আমি আমার বাস মিস করে ফেলেছি।আমার ব্যাগ ফোন সব বাসে।”

-“হুম বুজলাম। তা তোমার মা বাবাই কেমন?বাচ্চাকে একা বাস থেকে নামতে দিয়েছে?”

অবনির বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে।এই লোক তাকে বাচ্চা কেনো বলছে?সে কি মা বাবার হাত ধরে হাঁটার মতো বাচ্চা নাকি?সে রেগে বললো

-“আমি মোটেও বাচ্চা নই।আমি এই বছর এইচ এস সি এক্সাম দিবো।আর আমি ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে এসেছি।”

অবনির কথা শুনে লোকটি ফিক করে হেসে দিল।আর বললো
-“ও মাই গুডনেস।তুমি এতো বড়ো?”

অবনি বুঝতে পারলো লোকটা তাকে নিয়ে মজা করছে।সে বললো
-“একটা মেয়ে বিপদে পড়েছে দেখে মজা নিচ্ছেন?এইটা বুজি মেনার্স এর মধ্যে পড়ে?”

লোকটি এবার গম্ভীর হয়ে বললো
-“আমার ফোন থেকে ফ্রেন্ডকে কল করে দেখো বাস কোথায়?”

অবনি দ্রুত তার ফ্রেন্ড সুরভীকে কল করলো।জানতে পারলো তাদের বাস অনেকটা এগিয়ে গেছে।অবনি লোকটিকে জানাতেই লোকটি বললো

-“আমার সাথে চল তোমাকে বাসে তুলে দিবো।”

অবনি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো।অচেনা কাউকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে?কিন্তু তার করার কিছুই নেই।সে একবার লোকটিকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো।ব্লু ও হোয়াইট কম্বিনেশনে একটা টি-শার্ট গায়ে দেওয়া।আর ব্লু ডেনিম প্যান্ট।শরীর স্বাস্থ্য বেশ পারফেক্ট।লোকটির বয়স ঠিক আন্দাজ করতে পারলো না।হবে হয়তো ছাব্বিশ সাতাশ।দেখে তেমন খারাপ মনে হচ্ছে না। অন্তত গায়ে পড়ার স্বভাবটা নেই।ব্যাক্তিত্বে গাম্ভীর্যতা বিদ্যমান।এই সব ভাবতে ভাবতে সে লোকটির গাড়িতে উঠে গেলো।

********
আজ আরজুর মন ভীষণ খারাপ।তার মনের আকাশে মেঘ জমেছে।নেতা সাহেব এমন কেনো?মানুষটি কি চোখের ভাষা বুঝে না?তার চোখে এই মানুষটি জন্য অজস্র অনুভূতি আছড়ে পড়ছে সেটা কি এই লোক দেখে না?
জুবায়ের আহমেদ আরজুর রুমে টোকা দিলো।আরজু ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। তাকে ভেতরে আস্তে বললো।তিনি হাসি মুখে এসে বললেন

-“কি ব্যাপার সুইটি? ডিনার করবি না?”

-“না ভালো লাগছে না।”

জুবায়ের আহমেদ আরজুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
-“কি মন খারাপ?”

-“না।”

-“তাহলে এই সুন্দর মুখটি কালো হয়ে আছে কেনো?”

আরজু তার খালুজানের দিকে তাকিয়ে বললো
-“আচ্ছা খালুজান কোনো দুর্লভ জিনিসের প্রতি যদি কেউ ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন তাহলে কি করা উচিৎ?জিনিসটির মায়া কি ছেড়ে দেয়াই ভালো হবে?”

-” পরিশ্রম আর ইচ্ছা শক্তি থাকলে যে কোনো দুর্লভ জিনিস পাওয়া সম্ভব।নিজের উপর বিশ্বাস রেখে যে এগুতে পারে সে সব কিছুই পেতে পারে।মানুষ চেষ্টা করলে সবই করতে পারে।তবে তার জন্য ধৈর্য প্রয়োজন।”

আরজু তার খালুজানের কথায় আস্থা ফিরে পেলো।মুচকি হেসে বললো

-“চলো ডিনার করে আসি।ভীষণ ক্ষুদা পেয়েছে।”

জুবায়ের আহমেদ হাসলেন।মেয়েটা আসলেই পাগল।
ডিনার শেষে আরজু নতুন উদ্যমে নেতা সাহেবকে চিঠি লিখতে বসলো

*****************
প্রিয় নেতা সাহেব,

অনেক দিন যাবত আমি কঠিন এক রোগে ভুগছি।ঠিক মতো খেতে পারিনা,ঘুমাতে পারিনা।লেখাপড়ায় ও আমার মন বসেনা।অলরেডি আমি পরীক্ষায় এক সাবজেক্টে ফেল করে বসে আছি।কেমন টাল মাতাল অবস্থা আমার।

আমার মন আমার নিজের কন্ট্রোল নেই।কখন ভীষণ খুশি হয়ে যায়।আবার কখনো কখনো এক ঝাঁক বিষণ্ণতা আমার মনকে ঘিরে রাখে।অনেক ভেবে চিন্তে আমি এই রোগের নাম চিহ্নিত করতে পেরেছি। আমি-আপনি নামক অসুখে ভুগছি।এই অসুখ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি বলেন তো?

রোজ আপনি আমার স্বপ্নে আসেন।তবে মজার বিষয় হলো আজকাল আমার কল্পনায় ও ঘুরে বেরান।যেমন সেদিন রাতে বারান্দায় দাড়িয়ে দখিনা বাতাস উপভোগ করতে যেয়ে রাস্তায় আপনাকে দেখলাম।আপনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।আমি শুধু হা করে তাকিয়ে ছিলাম।সপ্ন কিনা সত্যি জানার জন্য চোখ কচলে আবার তাকালাম।কিন্তু কাউকেই দেখলাম।এইবার বুজলেন তো আমি কতো গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছি?আমাকে এই ভাবে জ্বালানো বন্ধ করুন নেতা সাহেব।

ইতি
আপনি নামক অসুখে আক্রান্ত অবলা মেয়ে।

নাহিদ চিঠিটা ভাঁজ করে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রইলো।এই মেয়ে নির্ঘাত পাগল। এর মধ্যে ভয় বলতে কিছু কি নেই?এমন দুঃসাহস দেখানোর জন্য তাকে আমি বড়ো কোনো শাস্তি দিতে পারি সেটা ভুলে বসে আছে?যেই দিন ধরবো এই মেয়ের ছাই দিয়েই ধরবো।সব সাহস বের করে ছাড়বো।তখনই আসিফ এসে বললো

-“ভাই উপসচিব এসেছেন।”

-“আসতে বল।”

আসিফ নাহিদের হাতে চিঠি দেখে বললো
-“ভাই আপনি বললে চিঠি প্রেরোককে খুঁজে তুলে আনতে পারি। জাস্ট আধা ঘন্টা সময় লাগবে।”

নাহিদ গম্ভীর স্বরে বললো
-“দরকার নেই আসিফ।প্রয়োজন পড়লে আমি নিজেই তুলে আনতে পারবো।”

-“জি ভাই।”

নাহিদ দ্রুত মিটিং শেষ করে বেরিয়ে গেলো।একটা অনুষ্ঠানে তাকে বক্তিতা দিতে হবে।গাড়িতে বসে সে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো।জনসাধারণের সাথে কানেক্ট করতে সে বেশ পছন্দ করে।

*********
অবনি বসে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে।এটা তার মুদ্রা দোষ।টেনশনে সে এই বাজে কাজটি করে থাকে।আড়চোখে পাশের লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।লোকটি নাক কুচকে বললো

-” ইয়াক!!!এসব কি ধরনের বাজে অভ্যাস?বাচ্চা কাচ্চা দের এই এক বাজে সভাব। দাঁত দিয়ে নখ কাটবে,আঙ্গুল নাকে দিয়ে বসে থাকবে।”

অবনি বিরক্ত হয়ে বললো
-“আমি মোটেও আঙ্গুল নাকে দিয়ে বসে রইনি।”

লোকটা বেশ বিরক্তি নিয়ে মাথা দুলাতে লাগলো।মনে হচ্ছে সে গাড়িতে পি করে দিয়েছে।বাজে লোক একটা।বিপদে পড়েছে বলে সব সহ্য করছে।প্রায় অনেক্ষণ পর তারা বাসটি ধরতে পারলো।অবনির বন্ধুবি সুরুভি বললো

-“এই ফাজিল তুই বাস থেকে নামার আগে কাউকে বলিসনি কেনো?”

-“তখন আমার ওয়াসরুমে যাওয়াটা ভীষণ জরুরি ছিল।”

লোকটি সুরুভিকে উদ্দেশ্য করে বললো
-“তোমার ফ্রেন্ডকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখো।নাহলে আবার হারিয়ে যাবে।”

অবনি রেগে তাকালো।লোকটি সেটা দেখে বললো
-“তোমার ফ্রেন্ডের মধ্যে কোনো মেনার্স নেই।কেউ হেল্প করলে ধন্যবাদ বলতে হয় সেটাও জানে না।”

সুরুভী নিজেই লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল। বাসে উঠার সময় অবনি আবার লোকটির দিকে তাকালো।লোকটি ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বসছে।লোকটি অবনির দিকে তাকাতেই সে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে বাসের ভেতরে চলে গেলো।লোকটি তখনও অবনির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

***********
ফুয়াদ সকালে ভার্সিটির উদ্দেশে বেরিয়ে যেতেই দেখতে পেলো ডাইনিং টেবিলে বসে তার বাবা ও মা নাস্তা করছে। তার মা ফুয়াদকে দেখে বললো

-“ফুয়াদ মাই বয়। কাম হ্যাভ ইউর ব্রেকফাস্ট।”

ফুয়াদ অনাগ্রহ প্রকাশ করে বললো
-“এই গুলি ব্রেকফাস্ট?এদের রান্না মুখেই তোলা যায় না।তাছাড়া আমার চিন্তা তোমাদের করতে হবে না।আমার নিজের বেবস্থা আমি নিজেই করতে পারবো।”

ফুয়াদের বাবা কিছুটা ধমকের সুরে বললো
-“ফুয়াদ বিহেভ ইউর সেলফ।সে তোমার মা হয়।”

ফুয়াদ তাচ্ছিল্য হেসে বললো
-“তাই নাকি?আমার তো মনেই ছিলো না। থ্যাংকস মনে করে দেওয়ার জন্য।”

ফুয়াদ বাবা রেগে কিছু বলতে চাইলে তার মা আটকে দিলো।আর ফুয়াদ রেগে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।ফুয়াদের বাবা রেগে বললেন

-“দেখলে কেমন বেয়াদব হয়ে গেছে?”

-“তাই বলে আমার ছেলেকে ধমকে কথা বলবে?”

-“তোমার জন্যই ছেলেটা বখে গেছে।ছেলের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেছ?”

-“তাই নাকি?আমার দিকে হাত তোলার আগে নিজের দিকে দেখো।তুমি কোন দায়িত্ব পালন করেছ?”

এভাবেই তাদের মাঝে তর্ক বিতর্ক শুরু হলো।এই সব ফুয়াদের জন্য নতুন কিছু না।ছোটবেলা থেকেই এদের এই ভাবেই নিজেদের উপর কাদা ছোড়াছুড়ি করতে দেখে সে অভ্যস্থ।ফুয়াদ গাড়ি নিয়ে সোজা ভার্সিটিতে চলে আসলো।
ফুয়াদ কেন্টিনি এসে দেখতে পেলো জারা বসে বসে ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছে।এটা দেখে ওর মেজাজ খারাপ হলো।সে পেছন থেকে জারার মাথায় একটা ধাক্কা মারলো।জারা বিস্মিত হয়ে হা করে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে দ্রুত আয়নায় নিজেকে দেখলো।লিপস্টিক ঠোঁটে লেপটে গেছে।সে রেগে ফুয়াদের পিঠে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে বললো

-“অসভ্য জানোয়ার। দিলিত আমার লিপস্টিক নষ্ট করে।”

ফুয়াদ বেশ বিরক্তি নিয়ে বললো
-“ভার্সিটিতে ক্লাস করতে আসিস নাকি মডেলিং করতে?”

-“তার মানে মানছিস আমি ভালো মডেল?”

-“বা**র মডেল।দুই একটা টিভিসি করে নিজেকে মডেল ভাবতে শুরু করেছিস?ওই অ্যাড গুলো যতবার আমার সামনে পড়ে জাস্ট বিরক্ত লাগে।তোর ওভার অ্যাক্টিং দেখলে বমি পায়।”

জারা আরো কয়েক ঘা ফুয়াদের পিঠে বসিয়ে দিলো।আরজু খাবারে ট্রে এনে টেবিলে বসতে বসতে বললো

-“তোদের মারামারি শুরু হয়ে গেছে?”

ফুয়াদ বললো
-“এই বান্দর শুরু করেছে।”

-“তুই বান্দর, শিম্পাঞ্জি।”

ফুয়াদ ট্রে থেকে একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল। জারা রেগে বললো

-“কুত্তা ঐটা আমার ছিলো।”

ফুয়াদ এমন ভাব করে খেতে লাগলো যেনো কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।ফুয়াদ আরজুকে বললো

-“শুভ কই?”

-“ওয়াসরুমে গেছে।”

কিছুক্ষণ পরই সবাই হাজির হলো কেন্টিনে।শুভ বললো
-“কাল সন্ধায় সবাই আমার বাসায় হাজির হয়ে যাবি।”

রিমি বললো
-“কেনো?”

আরজু বললো
-“কাল আঙ্কেল আন্টির ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি রাইট?”

শুভ বললো
-“রাইট।আম্মু আব্বুকে সারপ্রাইজ দিবো।তোরা সন্ধার আগেই চলে আসবি।”

সবাই মিলে প্ল্যান করতে লাগলো কি করা যায়।জারা,সাবিহা,আরজু আর রিমি কি গিফট্ করবে সেটা নিয়ে প্ল্যান শুরু করলো।ক্লাস শেষে শপিংমলে যাবে বলে ঠিক করে নিল। অন্যদিকে তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে রামিম,শুভ,ফুয়াদ।শুভ বললো

-“মেয়ে জাতি!! পাশের বাসায় কারো বিয়ে হলেও এদের তিনদিন শপিং করতে হয়।”

শুভর কথা শুনে রামিম আর ফুয়াদ হেসে উঠলো।আর আরজু ওরা তাদের দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_8

একটা কেসের ফাইলে গভীর ভাবে মজে আছে সাবা খানম।একটা রেপ কেস স্টাডি করছে।বেশ কিছুদিন যাবত এই কেস নিয়ে সে ভীষণ ব্যাস্ত।যার জন্য বাসায় তেমন সময় দিতে পারছে না।মানুষের মুখোশ ধারী এই জানোয়ার গুলোকে উপযুক্ত শাস্তি না দিতে পারলে এরা আরো পার পেয়ে যাবে। এসব জানোয়ার গুলো মেয়েদের ভোগ্য পণ্য মনে করে। তাই এদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

কাজের ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ তার কেবিনের দরজায় কেউ টোকা দিলো।সাবা খানম বেশ বিরক্ত হয়ে মানুষটিকে ভেতরে আসতে বললেন।কাজের সময় কোনো রকম ডিস্টার্ব তার পছন্দ না।এতে মনোযোগ নষ্ট হয়।চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলেন জুবায়ের আহমেদ এসেছেন।সাবা খানম চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন

-“তুমি এই সময়?কিছু হয়েছে?”

জুবায়ের আহমেদ আয়েসি ভঙ্গিতে চেয়ার টেনে বসে বললো
-“কেনো আসতে পারি না?নাকি ম্যাডামের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লাগবে?”

-“একদম ঠিক। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ছাড়া আমি আবার কারো সাথে মিট করি না।”

-“তাই নাকি?”

-“জি! তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কি আজ কাজ নেই?অসময়ে আমার অফিসে?”

-“অবশ্যই আছে।তার জন্যই তো এলাম।জলদি এই ফাইল পত্র রেখে আমার সাথে আসো।”

বিস্ময় নিয়ে সাবা খানম বললেন
-“কোথায় যাব?”

-“ডেটে যাব।”

সাবা খানম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে বললেন
-“বুড়ো বয়সে ভীমরতি উঠেছে?”

জুবায়ের আহমেদ কলার ঠিক করতে করতে বললেন
-“কে বুড়ো?আমিতো এখনো তাগড়া জোয়ান।”

-“আমার কাজ আছে।বিরক্ত করোনা।”

জুবায়ের আহমেদ সাবা খানমের হাত থেকে ফাইলগুলো নিয়ে পাশে রেখে বললেন
-“তোমার এই ব্যস্ততা জীবনের শেষ হবে না। বাচ্চারা বাসায় নেই তাই আমাদের উচিত এখন সময় টা উপভোগ করা।”

-“ওকে।তবে বেশি সময় দিতে পারবো না।চলবে?”

-“চলবে না দৌড়বে।”

সাবা খানম মুচকি হাসলেন।এই সুপুরুষ টি সারা জীবনই তাকে মুগ্ধতায় জড়িয়ে রেখেছে। ভীষণভাবে ভালবাসতে জানে মানুষটা। মেয়ে দুটির জীবনেও ঠিক এমনই সুপুরুষ যেন আসে।তার মেয়ে দুটিও যেনো সুখী হতে পারে।তবেই তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবেন।

তবে আরজুকে নিয়ে তার বেশি ভয় হয়। মেয়েটা ভিষণ ইমোশনাল। যেকোনো পরিস্থিতি অবনী সামলাতে পারলেও আরজু পারেনা। কারণ মেয়েটা কে ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের চোখের মণি ছিলো।তারা মারা যাবার পর তিনি ভীষণ আদর করে বড় করেছে আরজুকে। বাবা মায়ের অভাব যেন টের না পায় সেটার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।

তার বড় বোন তাকে ভীষণ ভালবাসতেন। জুবায়ের এর সাথে যখন রিলেশন ছিল তখন সে ছিলো বেকার।তার বাবা মা এমন বেকার ছেলের সাথে কিছুতেই বিয়ে দিবেন না বলে জানিয়েছেন।কিন্তু তার আপা আর দুলাভাই মিলে সবাইকে রাজি করিয়েছেন।ওই মানুষ দুটো না থাকলে আজ নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে হয়তো সংসার করা হতো না।তাই তাদের একমাত্র মেয়েকে তিনি ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করেন।তাছাড়া মেয়েটা ভীষণ আদুরে।ওকে ভালো না বেসে পারা যায় না।

***********
চারজন সুন্দরী রমণী শপিং কমপ্লেক্সের ভেতরে প্রবেশ করলো।মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী। এমন রূপবতী নারীদের দিকে যে কারো নজর আটকাতে বাধ্য।আশেপাশের অনেক ছেলেরাই আড়চোখে তাদের দেখছে।ওয়েস্ট্রান ড্রেসে এদের দেখে যে কারো চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।জারা বার বার ফোনের ক্যামেরায় নিজেকে দেখে নিচ্ছে।মানুষের অ্যাটেনশন পেতে জারা ভীষণ ভালোবাসে।এটা সে বেশ উপভোগ করে।বাকি তিনজনের এদিকে খেয়াল নেই।তারা বিভিন্ন দোকান ঘুরতে ব্যাস্ত।

********
নাহিদ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিলো।প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে সে তার ছোট বোন জেরিনের সাথে ঘুরছে।আজ সকাল সকাল তার বাসায় এসে হামলা দিয়েছে মেয়েটা। ভায়ের সাথে শপিংয়ে বের হবে।আসলে অনেকদিন যাবত জেরিন আসতে বলছিলো।কিন্তু নাহিদ কিছুতেই সময় বের করতে পারছিলো না।কিন্তু আজ মেয়েটা আর কোনো বাহানাই শুনলো না।

তবে এখন বেশ বিরক্ত হচ্ছে সে।কেউ যাতে চিনতে না পারে তাই মুখে মাস্ক পড়ে আছে।সাধারণ জীবন যাপনের সুযোগ অনেক আগেই হারিয়েছে সে।সারাক্ষণ সিকিউরিটির ভেতরে চলতে হয়।তবে কিছুই করার নেই।এই জীবন সে নিজেই বেছে নিয়েছে। গরমে ঘামে তার পাঞ্জাবি আধভেজা হয়ে গেছে। এয়ারকন্ডিশন সিস্টেম থাকা সত্বেও সে ঘেমে একাকার অবস্থা।

জেরিন শপ থেকে বেরুলেই নাহিদ বললো
-“পিচ্ছি আর কতক্ষন?আমার কিন্তু একটা মিটিং আছে।”

-“ভাইয়া সহজে তোমাকে পাওয়া যায়না।আজ বাটে পেয়েছি।সো তোমার অ্যাকাউন্ট খালি করে ছাড়বো।”

নাহিদ বেশ গম্ভীর স্বরে বললো
-“আর মাত্র পনেরো মিনিট পাবি।তার পর আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।”

জেরিন মুখ ভেংচে পাশে তাকালো।দুজন গার্ড তাদের পেছন পেছন ঘুরছে।সে বেশ বিরক্ত হলো।আট দশজনের মতো একান্তে সে ভাইকে কখনোই পায়না।ভাইয়া কে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে শান্তি নেই। এরা পিছু ছাড়েনা।আবার তার ভাইয়ের দিকে তাকালো।এমন সুদর্শন পুরুষ খুব কম দেখেছে সে।কিন্তু এমন গুমর মুখ মানুষটি তার ভাই হলো কি করে?তাকে সবাই বাচাল বলে।আর অন্য দিকে তার ভাই প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলবে না।এই যন্ত্র মানব কবে যে বিয়ে করে একটা ভাবী আনবে আল্লাহ ভালো জানে।
জেরিন হঠাৎ সামনে তাকিয়ে তার ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“ভাইয়া দেখো চারপাশে সুন্দরী মেয়েদের ছড়াছড়ি।এক একটা পরী।এদের থেকে একটাকে চুস করে আমার ভাবী বানিয়ে দাও।”

নাহিদ বেশ বিরক্ত হলো।এই মেয়ে জাতীয় টপিক তার বেশ অসহ্য লাগে।সে ধমকের সুরে বললো
-“ফাজলামো বন্ধ কর।”

-“সত্যি বলছি ভাইয়া।সামনের মেয়ে গুলো দেখো কি সুন্দর।একটা চাইতে আরেকটা বেশি রূপবতী।”

কথাটা বলেই সে নাহিদকে জোর করে সেদিকে ফেরালো।না চাইতেও নাহিদের চোখ গেলো মেয়ে গুলোর দিকে।চারটা মেয়ে পাশের শপ গুলো ঘুরে ঘুরে দেখছে।তবে নাহিদের চোখ আটকে গেলো আরজুর দিকে। ব্ল্যাক জিন্সের সাথে নেবি ব্লু টি শার্ট। আটসাট ড্রেসে তাকে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে।খোলা সিল্কি চুল গুলো বার বার কপালে এসে ভিড় জমাচ্ছে।যাতে মেয়েটার বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই।সে বান্ধবীদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।তার গাল আর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে।নিশ্চই মেয়েটা গরম সহ্য করতে পারে না।

নাহিদ দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।নিজেকে সংযত করল।জেরিন উৎসাহ নিয়ে বললো
-“নেবী ব্লু টিশার্ট পরা মেয়েটাকে তোমার সাথে বেশি মানাবে। মানে হাইটে একদম তোমার সাথে ম্যাচ করবে। তোমার মত এমন লম্বা তাল গাছের সাথে এমন লম্বা মেয়েই মানাবে।”

কথাটা বলতে বলতে জেরিন ফোন কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।নাহিদ দ্রুত ফোনটা কেরে নিয়ে ধমকে বললো

-“একটা মাইর দিবো ফাজিল।ছবি তুলছিস কেনো?আর শোন এই মেয়ে টেয়ে দেখে লাভ নেই।আমি বিয়ে টিয়ে করবো না।”

জেরিন মুখটা মলিন করে বললো
-“এখন করবে না।পড়ে ওই বুড়ো নেতার মতো শেষ বয়সে এসে কচি মেয়ে বিয়ে করবে?নানার বয়সে বাবা হতে চাও?”

নাহিদের এবার বেশ মেজাজ খারাপ হলো।নাহিদ রক্ত চক্ষু নিয়ে জেরিনের দিকে তাকিয়ে হাতের সানগ্লাস চোখে পড়ে নিল।আর সেখান থেকে চলে গেলো।আর যাবার আগে একজন গার্ডকে বললো জেরিনকে বাসায় পৌছে দিতে।
জেরিন চিন্তিত মনে বললো

-” ভাই কি চিরো কুমার থাকার প্ল্যান করেছে নাকি?তাহলে আর ভাবির মুখ দেখা হবে না।”

আরজু আর বাকি সবাই এলিভেটরের সামনে দাড়িয়ে আছে। ডোর ওপেন হতেই দুজন লোককে দেখতে পেলো।লম্বা শুভ্র পাঞ্জাবি পরা লোকটির মুখে মাস্ক আর চোখে সানগ্লাস।আরজুর মনে হলো লোকটিকে কোথাও দেখেছে।সে চোখ টিপটিপ করে তাকালো।পরক্ষণে ভাবলো হয়তো সাদা পাঞ্জাবি দেখে তার অবচেতন মন মানুষটিকে নাহিদ ভাবছে।
এলিভেটরে চড়ে চার বান্ধবীর কথার শেষ হচ্ছে না।নাহিদের ঠিক সামনেই দাড়িয়েছে আরজু।মানুষের ভিড় বেশি হওয়ায় আরজু তার অনেকটা কাছাকাছি।নাহিদ খেয়াল করলো খুব মিষ্টি একটা ঘ্রাণ তার নাকে আসছে।একটু পর বুঝতে পারলো আরজুর রেশমি কোমল কেশ থেকেই এই মাতোয়ারা সুগন্ধির উৎপত্তি হয়েছে।নাহিদ মন ভরে নিঃশ্বাস নিলো। মুহূর্তটি তার ভালো লাগছে।পরক্ষণে নিজেকে সংযত করে নিলো।

পাশে চোখ পড়তেই দেখলো একটি ছেলে আড়চোখে আরজুর আর তার বন্ধুবিদের দিকে বাজে নজরে তাকাচ্ছে।নাহিদের বেশ মেজাজ খারাপ হলো। নাহিদে সাথে চোখাচোখি হতেই নাহিদ সানগ্লাস খুলে কড়া চোখে তাকালো।মনে হচ্ছে এই চোখ দিয়েই ছেলেটাকে ভৎস করে দিবে।ছেলেটা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়ালো।ভীষণ ভয় পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।

সেখান থেকে বেরুতেই নাহিদের দিকে আবার চোখ আটকে যায় আরজুর।আরজু কিছুটা চমকালো।এই চোখ জোড়া তার ভীষণ চেনা।নাহিদের ফোনে একটা কল আসায় সেটা রিসিভ করে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল। এবার আরজু হানডেট পারসেন্ট কনফার্ম হলো মানুষটা নাহিদ ছিল। এই কণ্ঠস্বর তার চিনতে ভুল হবে না।আরজু সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।রিমি সেটা দেখে বললো

-“কি ব্যাপার?এমন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?”

জারা আর সবিহাও একই প্রশ্ন করলো।আরজু অস্থির হয়ে বললো
-“উনি আমার এতো কাছে ছিলো আর আমি চিনতে পারলাম না?”

জারা বললো
-“কার কথা বলছিস?”

-“নেতা সাহেব এখানে ছিলো।”

সাবিহা বললো
-“নিবরাস নাহিদের কথা বলছিস?”

-“হে।মুখে মাস্ক পড়া লোকটি আমার নেতা সাহেব ছিলো।”

জারা ছাড়া বাকি সবাই ভীষণ অবাক হলো।আরজু লোকটির প্রতি এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে?সাবিহার একটু চিন্তা হলো।তার মনে হয় শুভ আরজুর প্রতি বেশ দুর্বল।ছেলেটার চোখে আরজুর জন্য অগাত ভালবাসা দেখেছে।এই সব কিছু ভবিষ্যতে কোন জটিলতা সৃষ্টি করবে নাতো?

*********
রিসোর্টে লবিতে বসে কফি খাচ্ছে অবনি ও তার বান্ধুবি সুরভী।একটু পরই তারা বেরুবে জাফলং এর উদ্দেশে।সুরভী বললো
-“এবার আমার সাথে সাথে থাকবি।তোর বিশ্বাস নেই। আবার কোথায় হারিয়ে যাস।সব জায়গায় ওই ভাইয়াটার মতো ভালো মানুষ পাবি না।”

-“ওই ব্যাটা ভালো মানুষ?”

-“অবশ্যই।উনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে আস্ত ফিরে আসতে পারতি না।”

হেয়ালি করে অবনি বললো
-“হে একদম ফেরেশতা ছিলো।”

তারা বাকি সবার সাথে বেরিয়ে পড়লো সেখান থেকে জাফলংয়ের উদ্দেশে।
সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলংয়ের অবস্থান।প্রকৃতি কন্যা হিসাবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং।পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ইনডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি,উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে। এসব দৃশ্যপট দেখতে প্রতিদিনই দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে। প্রকৃতি কন্যা ছাড়াও জাফলং বিউটি স্পট, পিকনিকস্পট, সৌন্দর্যের রাণী- এসব নামেও পর্যটকদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। ভ্রমনপিয়াসীদের কাছে জাফলং এর আকর্ষণই যেন আলাদা। সিলেট ভ্রমনে এসে জাফলং নাগেলে ভ্রমনই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।

সেখানে পৌঁছে অবনি মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো।কি অপরূপ সৌন্দর্য।অবনি ক্যামেরাটা সুরুভির হাতে দিয়ে বললো

-“আমার কয়েকটা পিক তুলে দে।আপুকে দেখিয়ে জ্বালানো যাবে।বেচারি এখনো সিলেট আসতে পারেনি।”

-“তুই আপুর সাথে এমন লেগে কেনো থাকিস?আরজু আপুর মতো এমন সুন্দরী আমি খুব কম দেখেছি।”

-“আমার বোনকে তুই চিনিস না।একদম পাগল।একজন নেতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে ।কোনদিন কোন অঘটন ঘটায় কে জানে?”

-“আপুকে কোনো ছেলেই ইগনোর করতে পারবে না।তাহলে সমস্যা কি?ওই নেতাও দেখবি আপুকে দেখলে পাগল হয়ে পিছে পিছে ঘুরবে।”

-“সমস্যা ঠিক এখানেই।ওই নেতা আমার আপুকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না।তাই তো আমার বোন তার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে।অন্য দিকে আপুর বেস্ট ফ্রেন্ড আপুর উপর ছোট বেলা থেকেই লাট্টু।কিন্তু আমার বোন সেটা আজও বুঝতে পারেনি।আমি কিন্তু ঠিকই বুঝে গেছি।”

-“বাপ রে!বেশ জটিলতা আছে দেখা যায়।”

-“হুম।”

তারা আবার গুরাঘুরিতে মনোযোগ দিলো।সব বন্ধু বান্ধবরা মিলে মজা করতে লাগলো। সুরভী হঠাৎ বললো
-“অবনি দেখ সেই ভাইয়াটা।”

অবনি তাকিয়ে দেখল সেই গুমড় মুখ লোকটি।আরেকটি ছেলের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে। এখনো কেমন গম্ভীর মুখ করে রেখেছে।এই লোক কে তার কেমন রোবট মনে হয়।হঠাৎ তাদের মধ্যে চোখাচোখি হলো।অবনি চোখ ফিরিয়ে নিলো।

ঘুরতে ঘুরতে দুই বন্ধুবী দল ছেড়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো।মূলত অবনি ধরে নিয়ে এসেছে সুরভীকে।এই জায়গাতে বেশ নির্জন।ছবি বেশ ভালো আসবে।অবনি বিভিন্ন পোজে পিক তুলতে লাগলো।

-“একা একা পিক তুলবে আমাদের ও সাথে নিয়ে তুলো।”

হঠাৎ করো শব্দ শুনে অবনি আর সুরভী চমকে পেছনে তাকালো।দেখলো তিনটি ছেলে দাড়িয়ে শব্দ করে হাসছে।অবনি বিরক্ত হয়ে চলে যেতে চাইলে একটি ছেলে বলে উঠলো

-“আরে কোথায় যাও? চলো এক সাথে ছবি তুলি।”

অবনি রেগে বললো
-“অসভ্য।”

-“তোমরা চাইলে অসভ্যতা ও করতে পারি। এতো সুন্দরী রমণীদের ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখা যায়?”

-“সঠিক সময়ে আপনাদের বাবা মা কানের নিচে দুটা দিলে আজ আপনাদের এই অবস্থা হতো না।”

-“তাই নাকি?তুমি বরং একটা চুমু দাও।দেখবে আমরা একদম শুদ্রে গেছি।”

সুরভীর ভয়ে শরীর কাপতে লাগলো। সে এমনি ভীষণ ভীতু।তারা যে বিপদে পড়ে গেছে সেটা বেশ ভালই বুঝতে পারল। এই ছেলেগুলোকে মোটেও ভালো মনে হচ্ছে না। সে অবনীকে জোর করে নিয়ে চলে আসতে গেলে একটা ছেলে অবনির হাত ধরে ফেললো।আর বললো

-“আরে সোনামনি চুমু না খেয়ে কোথায় যাচ্ছ?”

অবনি রেগে বললো
-“অসভ্য জানোয়ার।হাত ছার।নাহলে এমন জায়গাতে মারবো কাউকে দেখাতে পারবি না।”

সুরভী বারবার অবনীকে থামানোর চেষ্টা করছে। এসব ছেলেরা যে এ ধরনের কথা শুনলে আরো পেয়ে বসবে সেটা এই মেয়েকে কে বোঝাবে?সে তো তার সাহসিকতা দেখতে ব্যস্ত।পাশের অন্য ছেলেটি বললো

-“তাই নাকি বেবি?আমরাও দেখতে চাই ঠিক কোথায় কোথায় মারতে পারো।”

অবনি রেগে এক হাতে ছেলেটির গালে একটা চর মেরে বসলো। সুরুভী এবার বেশ ভয় পেয়ে গেল।ছেলেটি রেগে অবনির দুই হাত আটকে ফেললো।অবনি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।অন্য একটি ছেলে অবনির ক্যামেরাটা নিয়ে নিল।আরেকটি ছেলে অবনির গাল চেপে ধরলো।আর ক্ষিপ্ত হয়ে বললো

-“এমন তেজ আমার বেশ ভালো লাগে।তোমাকে তো আমার বেশ পছন্দ হয়েছে বেবি।”

এবার অবনি কিছুটা ভয় পেলো।তিনটি ছেলের সাথে সে কিছুতেই পারবে না।তার চোখ ভিজে উঠলো।অন্য ছেলেটি সুরুভীর হাত ধরলো।অবনি নিজের হাত কিছুতেই ছাড়াতে পারছিনা।তার সারা শরীর কাপছে।চোখ বন্ধ করে মনে মনে শেষ বার মা বাবা আর আরজুর মুখটা মনে করলো।ঠিক তখনই একটা ছেলের চিৎকারের শব্দ পেলো।চোখ খুলে দেখলো তার গাল চেপে ধরা ছেলেটি নিচে পড়ে আছে।সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো সেই গতকালের গম্ভীর লোকটি।রাগান্বিত হয়ে দুইটা ছেলেকে বেশ কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।অন্য ছেলেটিকে লোকটির সাথে যে ছিলো সে থাপ্পড় মারছে।লোকটি রেগে বললো

-“কীরে মেয়ে দেখলে চুলকায়? গায়ে হাত দিতে মন চায়?আজ এমন মাইর দিবো সারা জীবন মনে থাকবে।”

আরো বেশ কয়েকটা থাপ্পড় খেয়ে ছেলে গুলো পালালো।অবনি ভেজা চোখে মানুষটির দিকে তাকালো।এই মানুষটি বার বার তাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাচ্ছে।
সুরভী অস্থির গলায় বললো

-“ধন্যবাদ ভাইয়া।আপনি না থাকলে কি যে হতো?”

লোকটি অবনির সামনে দাড়িয়ে বললো
-“একা এই পাশে কেনো এসেছো?এমন নির্জন জায়গাতে যে কোনো সময় বিপদ হয়ে পারে সেটা কি জানো না?বাচ্চা তুমি?মন তো চাইছে তোমার গালেও দুইটা দেই।”

অবনি কিছুই বলতে পারলো না।শুধু ডেব ডেব করে তাকিয়ে রইল।
সুরভী বললো
-“সরি ভাইয়া আমরা বুঝতে পারিনি।”

-“ইটস ওকে।নেক্সট টাইম স্মরণ রেখো।”

-“ভাইয়া আমাদের এত উপকার করলেন অথচ আপনার নামটাই জানা হলো না।”

-“আমি নিশান।ও আমার ফ্রেন্ড কবির।”

-“জি আমি সুরভী আর ও অবনি।”

নিশান আড়চোখে অবনির দিকে তাকিয়ে বললো
-“তোমার বান্ধবীকে দেখে রেখো।নাহলে এই মেয়ে নিজেও বিপদে পড়বে আর তোমাকেও বিপদে ফেলবে।”

-“জি ভাইয়া।”

নিশান তাদের বাকি দলের কাছে এগিয়ে দিয়ে বিদায় জানালো।অবনি তখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছে।সে নিশানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

রিসোর্টে পৌঁছে রাতের ডিনারে বাইরে আসলে অবনি নিশানকে লবিতে দেখতে পেলো।নিশান সেই কবির নামের ছেলেটির সাথে কফি খেতে খেতে কথা বলছে। সুরভী দূরে নিশানকে দেখে বললো

-“এই ভাইয়াটা হয়তো এই রিসর্টের উঠেছে।দেখলি বলেছিলাম না এই ভাইয়াটা ভালো।কি ভাবে তোকে বার বার বিপদের হাত থেকে রক্ষা করলো।তুই তো লোকটিকে খারাপ ভেবে বসে আছিস।”

অবনি এক দৃষ্টিতে নিশানকে দেখছে।লোকটিকে অন্য রকম লাগছে।নাকি তার দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টেছে বলে এমন হচ্ছে।অবনি হঠাৎ অনুভব করলো লোকটিকে তার বেশ ভালো লাগছে।গম্ভীর মুখটা দেখে তার অন্য রকম অনুভুতি হচ্ছে।মানুটিকে প্রথমে বিরক্ত লাগলেও হঠাৎ করেই বেশ ভালো লাগছে।অবনি মুচকি হাসলো।তারপর সবার সাথে ডিনারের উদ্দেশে চলে গেলো।