মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-৯+১০

0
564

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_9

অপেক্ষা জিনিসটি বড্ডো বিরক্তিকর।সময় তখন কচ্ছপ গতিতে চলে।রিক্সায় বসে রামিম বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।সন্ধার আগ মুহূর্ত বলে বাচা গেছে।সূর্যি মামার তাপ এখন নেই বললেই চলে।সাথে বাইরে মিষ্টি হাওয়া বইছে।সে আবার সামনের বাড়িটির দিকে তাকালো।এই বাড়ির চতুর্থ তলায় সাবিহারা থাকে।একটু আগেই সে কল করে বললো তাকে বাসা থেকে পিক করে নিয়ে যেতে।শুভর বাসা থেকে সাবিহার বাসটি সবচাইতে দূরে।রামিম শুভদের বাসায় ঘর ডেকরেশনের ব্যাস্ত ছিল।সব কাজ ফেলে সে দৌড়ে এখানে আসলো।আর এই মেয়ের খবর নেই।বিরক্ত হয়ে আবার কল করলো সাবিহার নাম্বারে।সাবিহা রিসিভ করতেই রামিম বললো

-“এই তুই কি নামবি?নাকি চলে যাবো?সব কাজ ফেলে আমি চলে আসলাম আর তুই মহারানী সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে পারছিস না?”

-“আরে আমি এসে পড়েছি।গেটের দিকে তাকা।”

রামিম গেটের দিকে তাকাতেই ভরকে গেল।তার চোখ জোড়া স্থির ভাবে আটকে গেলো সাবিহার দিকে।সে কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো।সাবিহা রিক্সার সামনে এসে হাত নেড়ে বললো

-“কীরে কোথায় হারিয়ে গেলি?”

রামিম চোখ নামিয়ে বললো
-“ন…না।আমি ঠিক আছি।”

সাবিহা এক হাতে কান ধীরে বললো
-“সরি।আসলে শাড়ি পড়তে লেট হয়ে গেলো।আমাকে কেমন লাগছে?”

-“হুম।ভালো।আচ্ছা চল।”

সাবিহার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।সে হয়তো আরো বেশি কিছু রামিম কাছ থেকে আসা করছিল।
রিকশা চলছে আপন গতিতে।রাস্তায় আজ তেমন একটা ট্রাফিক নেই।রামিম বার বার কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে। এতো মিষ্টি আবহাওয়ায় এতো ঘামার কথা না।রামিম বুঝতে পারলো তার হাত কাপছে,হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে চলছে।একবার আড়চোখে সাবিহাকে দেখে নিল।মেয়েটা তার দেয়া সেই নীল শাড়িটি পড়েছে।কি অপুরুপ লাগছে।ঠিক চোখ ধাঁধানো।চুলের খোঁপায় বেলি ফুলের মালা।যার মিষ্টি ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগছে।সামনের ছোট চুল গুলো বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে।রামিম আবার ঢোক গিললো।তার বুকে কেমন উথাল পাতাল হচ্ছে।ঠিক যেমনটা ভার্সিটির প্রথম দিন হয়েছিল।ক্লাসে ঢুকতে যেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই এই মেয়েটার সাথে ধাক্কা লাগে।সেদিন এই মেয়েটাকে দেখে রামিম কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে গেছিলো।তীব্র অস্থিরতা হয়েছিল।ধীরে ধীরে এই মেয়েটা তার ভালো বন্ধু হয়ে উঠে।বন্ধুত্বের খাতিরে সে নিজের সেই অদ্ভুত অনুভূতিকে দমিয়ে রেখেছিল।তাছাড়া সাবিহা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।আর সে পিতৃহীন একটা ছেলে।তার মা অনেক কষ্ট তাকে বড়ো করেছে।বিলাসিতা তার জীবনে তেমন একটা নেই।কি ভাবে সে এই আদরের দুলালী কে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করবে?

*********
আরজু আকাশি রঙের জর্জেটের একটি শাড়ি পরেছে।চুলে হালকা ব্রাশ করে খোঁপায় বেলি ফুলের মালা পড়ে নিলো। চার বান্ধবী আসার সময় বেলি ফুলের মালা গুলো কিনে নিয়ে এসেছে। সবাই আজ একই রকম সাজবে বলে ঠিক করেছে।রুম থেকে বেরিয়ে খালামনির রুমে উকি দিয়ে দেখলো সে ফাইল মুখ গুজে আছে।আরজু একটা শিস বাজলো।সাবা খানম দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল আরজু।তিনি বললেন

-“উকি কেনো দিচ্ছিস?ভেতরে আয়।”

আরজু দরজা ঠেলে ভেতরে এসে বললো
-“দেখোতো খালামণি আমাকে কেমন লাগছে?”

কথাটা বলে সে ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলো।সাবা খানম মুগ্ধ চোখে তাকালেন।মেয়েটা অতি মাত্রায় সুন্দরী।
ঠিক মায়ের মতো হয়েছে।তার কাছে মনে হলো সেই বাচ্চা আরজু তার সামনে দাড়িয়ে।ছোট বেলায় নতুন জামা পড়লে ঠিক এমন ঘুরে ঘুরে দেখাতো।তবে সত্যি কথা হলো মেয়েটা বড়ো হয়ে গেছে।চোখ ধাঁধানো রূপবতী যুবতী।সাবা খানম বিছানা ছেড়ে উঠে ড্রেসিং টেবিল থেকে কাজল নিয়ে আরজুর কানের নিচে দিয়ে দিলেন।আরজু খিল খিল করে হেসে বললো

-“খালামণি এত মর্ডান একজন মানুষ হয়ে তুমি এরকম কুসংস্কারের বিশ্বাস করো? সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি তুমি এই কাজটি কর।আম্মুও এই কাজ করতো। এই সামান্য কাজল কি আমাকে সকল রকমের খারাপ নজর হতে বাঁচাতে পারবে?”

-“আমি কোন রকম কুসংস্কারে বিশ্বাসী নই। কিন্তু আমার মেয়েটার সৌন্দর্যের অন্য কেউ যেন ক্ষতবিক্ষত না হয় তাই এটা করি।তোকে না, অন্যদের বাঁচাতে তোর সৌন্দর্যের তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করি।”

আরজু আবার হেসে উঠলো।আর বললো
-“তাই নাকি?ভালো অন্যের উপকার করা ভালো।আচ্ছা আমি আসি।অনেক দেরী হয়ে গেছে।”

-“আচ্ছা সাবধানে যাস।আর বেশি রাত করিস না।”

-“ওকে মাই ডেয়ার সুইটি।”

************
শুভদের বাসায় পৌছে আরজু দেখলো বাকি সবাই সেখানে অলরেডি উপস্থিত। শোভা দ্রুতই আরজুকে জড়িয়ে ধরলো।আরজু শোভার গাল টেনে ধরলো
আর বললো

-“কীরে পিচ্ছি কেমন আছিস?”

-“এইতো ভালো আপু।তুমি এখন আগের মতো বাসায় আসো না কেনো?আম্মু কিন্তু তোমার সাথে অভিমান করে বসে আছে।”

-“আরে ক্লাস নিয়ে ব্যাস্ত থাকি।আর আন্টিকে একটা হাগ দিলেই দেখবি সে আইসক্রীমের মতো গলে যাচ্ছে।”

শোভা একবার নিজের ভায়ের দিকে আড়চোখে তাকালো।শুভকে স্থির দৃষ্টিতে আরজুর দিকে তাকাতে দেখ শোভা মুচকি হাসলো।ভাইকে এমন নাজেহাল অবস্থায় সে বহুবার দেখেছে।আরজু আপুকে ভাবী হিসেবে তার বেশ লাগে।এমন সুন্দরী মেয়ে সে আর দ্বিতীয়টি দেখেনি।সে নিজেই চোখের পলক ফেলতে পড়ছে না।তাহলে ভায়ের কি অবস্থা আন্দাজ করতে পারছে।

আরজুকে দেখে ফুয়াদ বললো
-“মানুষ ঠিক বলে ‘মক্কার মানুষ হজ পায়না।’ তোর বাসা সবার কাছে।অথচ দেখ তুই সবচাইতে লেট।”

রামিম বললো
-“সব গুলা কি সাজ দিয়েছে দেখেছিস?মনে হচ্ছে শুভর বিয়ে খেতে আসছে।”

জারা এক পিস অ্যাপল খেতে খেতে বললো
-“বিয়ে খেতেই তো এসেছি। মেরেজ এনিভার্সারি মানেই বিয়ে।”

ফুয়াদ ঠাট্টার ছলে বললো
-“তুই তো নিজের প্রতিটি অ্যানিভার্সারিতে আবার বিয়ে করবি। জানিতো সব গিফট পাওয়ার ধান্দা। গিফট দিতে পারবো না। মজার মজার রান্না করে দাওয়াত করবি কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে চলে আসব।”

জারা ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-“তোকে আমি আমার অ্যানিভার্সারি দূরের কথা, আমার বিয়েতে অব্ধি দাওয়াত দিব না।”

-“তোর বিয়ে খাইতে আমি বসে নাই।”

রিমি এদের থামিয়ে বললো
-“ঝগড়াঝাঁটি পড়ে করিস।আমি কিন্তু বেশিক্ষন থাকতে পারবো না।”

শুভ বললো
-“ok বেশি দেরি করা লাগবে না।আমি তোকে আগেই বাসায় পৌঁছে দিবো।তোর বাপ রাইফেল নিয়ে দাড়িয়ে থাকবে নাতো?”

শোভা টেবিলে কেক সাজাতে সাজাতে বললো
-“সমস্যা কি ভাইয়া?ফ্রেন্ডের জন্য দুই চারটা বুলেট বুকে নেওয়াই যেতে পারে।”

ফুয়াদ হেসে বললো
-“দুই চারটা?একটা খেলেই শালা পটল তুলবে।”

শোভা মুচকি হেসে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো।মানুষটিকে তার বেশ ভালো লাগে।ভাইয়ার সব ফ্রেন্ডেদের ভালো লাগলেও তাকে একটু স্পেশালি ভালো লাগে শোভার।
শুভর মা শাড়ি ঠিক করতে করতে এসেই মুচকি হেসে বললো

-“সবাই এসে পড়েছ?তোমাদের পাগলামি আর গেলো না।আর এই শুভ টা বেশি পাগল।এই বয়সে এইগুলি মানায়?”

আরজু তাকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললো
-“আন্টি ভীষণ কিউট লাগছে তোমাকে।একদম রেড স্ট্রবেরি।আংকেল দেখলে আবার ক্রাশ খেয়ে যাবে।”

শুভর মা ভীষণ লজ্জা পেলেন।তিনি আরজুর কান টেনে ধরে বললেন
-“পাজি মেয়ে বলে কি?”

-“আল্লাহ!কান ছিঁড়ে যাবে তো? পরে আর আমার বিয়েই হবে না।কান কাটা বউ কে নিবে?”

-“কোনো সমস্যা নেই।তোকে আমার কাছেই রেখে দিবো।”

কথাটি বলে তিনি শুভর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।শুভ ভীষণ লজ্জা পেলো।মাথা চুলকে আশেপাশে তাকাতে লাগলো।আরজুকে সে ভালোবাসে এই বিষয়টি তার বাসার সবারই জানা।শুভর মা অনেক আগেই আরজুকে ছেলের বউ করবেন বলে ভেবে রেখেছেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
শুভ কাজের ফাঁকে ফাঁকে বার বার আরজুকে দেখছে। এতো মিষ্টি কেনো মেয়েটা?শুভর আজো মনে আছে স্কুলের প্রথম দিন তাদের ক্লাসে একটা মেয়ে এসেছিলো।দুই ঝুটি করা,গোলগাল চেহারা মিষ্টি মেয়েটি বাবা মায়ের হাত ধরে ক্লাসে প্রবেশ করেছিলো।সারা ক্লাস মেয়েটি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বারবার জানালার বাইরে দাঁড়ানো বাবা-মার দিকে তাকাচ্ছিল।আর শুভ আরজুর অবস্থা দেখে মিটি মিটি হাসছিলো।সারা ক্লাসে এমন আদুরে বাচ্চা মনে হয় এই একটাই ছিলো।আরজুর বাবা মাকে প্রায় বেশ কয়েকদিন জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে।চোখের আড়াল হলেই নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলত।এই সব দেখে শুভ ভীষণ হেসেছিল।বাচ্চা আরজু তখন বেশ কড়া চোখে শুভর দিকে তাকিয়েছিলো।ফর্সা মসৃণ চেহারায় লাল চোখ জোড়া দেখতে কতো না ভালো লাগছিলো শুভর। সেই বাচ্চা রাগী অভিমানী মেয়েটি আজ তার স্বপ্নের রানী।

ফুয়াদের খোঁচায় শুভ চমকালো।ফুয়াদ মুচকি হেসে বললো
-“খালি দেখেই যাবি? বুজলি সুন্দরী মেয়ে গুলা একটু বেকুব হয়।জারার অবস্থা দেখিস না?এদের মনের অনুভূতি পই পই খুলে না বললে এরা বুঝে না।আর আমাদের আরজু ম্যাডাম তো আরো বোকা।ইমোশনাল ফুল যাকে বলে।তার উপর পাগলাটে।এক নেতার উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে।ভালোবাসা আর আবেগের মধ্যে পার্থক্য করতে পড়ছে না।তাই সময় থাকতে বলে দে।”

-“কি করবো বল?ছোট বেলা থেকে এক সাথে বড়ো হয়েছি।কত ঝগড়া করেছি।হঠাৎ ওকে যদি বলি যে আমার দৃষ্টি ভঙ্গি ওর জন্য পরিবর্তন হয়েছে।ওকে বন্ধুর চাইতে অনেক বেশি কিছু মনে করি।সেটা আরজু কি ভাবে নিবে কে জানে?”

-“আগেই এতো কিছু ভেবে চিন্তে বসে থাকিস না।”

***********
রিমি আর সাবিহা শুভর মাকে রান্না ঘরে লেমন জুস তৈরি করতে হেল্প করছে।শুভর মা রিমিকে বললো
-“রিমি মা তোমাকে দেখে অনেক খুশি হয়েছি।তোমাকে বাসায় তেমন একটা আসতে দেখি না।আন্টিকে বুঝি পছন্দ হয়নি?”

-“না তেমন কিছু না আন্টি।আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।আসলে আব্বু ভীষণ স্ট্রিক।সন্ধার পর বাসা থেকে বের হওয়াটা পছন্দ করে না।সব সময় নিয়মের মধ্যে চলতে পছন্দ করে।”

-“হুম আর্মি অফিসারা সব সময় রুলস রেগুলেশন মধ্যে চলতে পছন্দ করে।তবুও মাঝে মাঝে এসে পড়বে আন্টির সাথে দেখা করতে।প্রয়োজনে তোমার বাবার সাথে আমি কথা বলবো।”

-“জি আন্টি।”

তার পর বেশ আড্ডা আর মজা করে সময় কেটেছে।শুভর বাবা তার স্ত্রী কে বললেন
-“আরজুকে শুভর সাথে ভীষণ মানায় তাই না?”

-“হুম।আমার আর তর সইছে না।কবে মেয়েটা আমার ঘরে এসে এমন মাতিয়ে রাখবে? সাবার সাথে কথা বলবো ভাবছিলাম।”

-“আরে এখন না।শুভ আরজু স্টাডি শেষ করুক।শুভ একটা জবে ঢুকে গেলেই আরজুকে নিয়ে আসবো।বেকার ছেলের কাছে সাবা মেয়ে বিয়ে দিবে নাকি?”

-“হুম ঠিক বলেছো।তবে আমি সাবার সাথে আগেই কথা বলে রাখব।”

বেশ কিছুক্ষন এই ভাবে আড্ডা দেওয়ার পর রিমি বললো
-“আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে।আব্বু বার বার কল দিচ্ছে।”

শুভ কোল্ড ড্রিংকসে শেষ চুমুক দিয়ে বললো
-“দারা আমি তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।আর আরজু তুই বাসায় থাক।আমি এসে তোকে দিয়ে আসবো।পাকামো করে একা বের হয়ে যাবি না।”

আরজু কপাল কুঁচকে বললো
-“আমি বাচ্চা নাকি?একাই যেতে পারবো আমি।সামনের গলিতে যেতে তোকে লাগবে নাকি?”

-“আমি আসার আগে বের হলে তোর ঠ্যাং ভেঙে আমাদের বাসায় রেখে দিব।”

-“এই রিমি এইটাকে নিয়ে বের হয়ে যা।খালি লেকচার দেয়।”

শুভ রাগী চোখে তাকিয়ে রিমিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।ফুয়াদ হেসে বললো
-“তোকে যে ফিউচারে শুভ কেমন করে সামলাবে আল্লাহ জানে।”

-“আমাকে সামলানোর প্রয়োজন নেই।আমি একাই একশো।”

সবাই আরো কিছুক্ষণ মজা করে একে একে বেরিয়ে পড়ল।আরজু শোভার সাথে বসে বসে কেক খাচ্ছে।ঠিক তখনই আরজুর নম্বরে কল আসলো।আরজু দেখলো অবনি কল করেছে।সে কল রিসিভ করে বললো

-“এতদিনে আমার কথা মনে পড়লো?ট্যুরে যাবার পর তো আমাকে ভুলেই গেছিস।”

-“আর আমি নেই বলে তুমি জমিয়ে পার্টি করছো?”

-“তো কি করবো?তোর বিরহে কাদবো?”

-“কাদা লাগবে না।বাসায় আসো।আম্মু আব্বু কেউ বাসায় নেই।তাদের আসতে লেট হবে।আমার একা বোর ফিল হচ্ছে।”

-“কখন এসেছিস?”

-“অনেকক্ষণ আগে।বাসায় আসো।”

-“আচ্ছা আসছি।”

শোভা বললো
-“অবনি এসেছে?”

-“হুম।আচ্ছা আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে।অবনি বাসায় একা।”

-“আরে কি বলো?ভাইয়া আসুক তখন যেও।”

-“শুভর আসতে সময় লাগবে।আমাকে এখনি যেতে হবে।”

-“ভাইয়া কিন্তু রাগ করবে।”

-“ব্যাপার না।তোর ভাইকে মানানো আমার বা হাতের খেলা।”

শোভা হেসে উঠলো।আরজু সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় উদ্দেশে বেরিয়ে গেলো।

********
আকাশে মিটি মিটি তারারা হাসছে।তাদের মধ্যে মনি হয়ে আছে উজ্জ্বল চাঁদ।রাতের শহরে ঘুরতে আরজুর বেশ লাগে। রিকশা তাদের বাসার গলির সামনে এসে থামলো।সামনের রাস্তায় কাজ চলছে।তাই রিকশা ভেতরে যাবে না।আরজু রিকশা ভাড়া মিটিয়ে শাড়ি ধরে হাঁটতে লাগলো। পায়ে পেন্সিল হিল থাকায় হাটতে বেশ সমস্যা হচ্ছে। যদিও আরজু হিল পড়ে অভ্যস্থ,তবুও রাস্তার বাজে অবস্থার জন্য সমস্যা হচ্ছে।

কিছু দূর এগুতেই আরজু সামনে কাউকে দেখতে পেলো।কেউ একজন এই দিকেই আসছে।কালো টিশার্ট পড়া মানুষটির মুখে মাস্ক।আরজুর মনে হলো মানুষটি তার পরিচিত।আর একটু সামনে আসতেই আরজু কিছুটা থমকে গেলো।মানুষটির চোখ জোড়া দেখেই আরজু নিশ্চিত হলো মানুষটি সম্পর্কে।এই চোখ জোড়া চিনতে আরজুর কখনো ভুল হবে না।আরজুর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসলো।সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।সামনের মানুষটিও আরজুকে দেখে থেমে গেলো।সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আরজুকে দেখে যাচ্ছে।

আরজুর পিট পিট করে তাকালো মানুষটির দিকে আর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো

-“নেতা সাহেব?”

নাহিদ আরজুর দিকে কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।সামনের অপুরূপ সুন্দরী রমণী যেকোনো পুরুষের রাতের ঘুম হারাম করার ক্ষমতা রাখে।নাহিদের মনে হলো তার চোখ জোড়া ভীষণ জ্বলছে।সে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকলে এই মেয়ে তার চোখ ঝলসে দিবে।আরজু অবাক হয়ে বললো

-“আপনি এখানে?”

নাহিদ নিজেকে স্বাভাবিক করে হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো।আর তার দাম্ভিকতা বজায় রেখে বললো

-“কেনো কোনো সমস্যা?পুরো এলাকা আমার।যেখানে খুশি থাকতে পারি।”

আরজু মাথা নিচু করে নিল।মানুষটার চোখের দিকে সে বেশিক্ষন তাকাতে পারে না।কখন কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে কে জানে।যেমন এখন তার ইচ্ছে করছে মানুষটির বুকে ঝাপিয়ে পড়তে।আর বলতে

-“আপনি আমার সমস্যা।আপনার জন্য আমি একটুও শান্তি পাচ্ছি না।আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে আপনি।”

কিন্তু আরজু তেমন কিছুই বলতে পারলো না।নাহিদ বুজলো সে বেশ কঠিন হয়ে কথা বলেছে।তাই আবার বললো
-“এখানে এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

আরজু আড়চোখে আবার নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ দ্রুত তার চোখ ফিরিয়ে আশেপাশে তাকালো।আর কিছুটা রেগে বললো
-“আপনাকে না মানা করেছি রাতে বাহিরে বের হতে?এইভাবে বের হয়ে ছেলেদের মাথা খারাপ করতে চান?”

-“আপনার মাথা কি খারাপ হয়েছে আমাকে দেখে?”

কথাটা মুখ ফস্কে বলে ফেললো আরজু।মুহূর্তেই জিবে কামড় দিলো। ছি!!কি ভাবছে উনি।আরজু তুই আসলেই একটা বেকুব।

নাহিদ অবাক হয়ে আরজুর দিকে তাকিয়ে রইলো।মুহূর্তেই চোখ,মুখ শক্ত করে আরজুর দিকে এগিয়ে আসলো।আরজু কিছুটা ভয় পেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। তার গাল বরাবর দুই চারটা দিয়ে বসবে নাতো?নাহিদ আরজুর একদম কাছে চলে আসলো।আরজুর মনে হচ্ছে দম আটকে মরেই যাবে।এমন মাতাল করা সুঘ্রাণ কোন পুরুষের কি করে হতে পারে? আরজু মনে হয় মাথা ঘুরে এক্ষনি পরে যাবে।এই পুরুষ তার সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_10

রাতের স্নিগ্ধ শীতল মনোরম হাওয়ার মাঝে সামনের কাঙ্ক্ষিত পুরুষটি দেহের সুঘ্রাণ রিমিকে বার বার শিহরিত করছে।বাইকের পেছনে বসে রিমি চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো।সচরাচর শুভর বাইকে তার বসার তেমন সুযোগ হয় না।এই জায়গাটা যেনো বরাবর আরজুর জন্য বরাদ্দ। এতে অবশ্য রিমির তেমন কষ্ট নেই।আরজু শুভর সেই বাল্যকালের বন্ধু। স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যোকার বন্ডিংটা অন্য সবার চাইতে বেশি। আরজুর প্রতি শুভ বেশ যত্নশীল।শুভর এই সভ্যাব গুলো রিমির বেশ ভালো লাগে।সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝে ছেলেটি।

রিমির বাসার সামনে এসেই শুভ বাইক থামালো।রিমি নেমে বললো

-“শুভ বাসায় চল।আম্মু বেশ খুশি হবে।”

শুভ হেলমেট খুলে বললো
-“আর তোর হিটলার বাপ দেখলে সুট করে দিবে।বলবে আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় ভাগছিস?আজ তোর শেষ দিন।তখন তার লাইসেন্স প্রাপ্ত রাইফেল দিয়ে ডিসকাউ ডিসকাউ করে দিবে।বাপ মায়ের একমাত্র পুত্র আমি।নাতি নাতনী মুখ না দেখিয়ে মরতে চাইনা।”

রিমি খিল খিল করে হেসে দিলো।আর বললো
-“আব্বু কিন্তু এতটাও রাফ না।তোরা বেশি ভাবিস।তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।কিন্তু মুখে বলে না।গম্ভীর মানুষ তো তাই।”

শুভর চোখ পড়লো উপরের বারান্দায়।সে দ্রুত হেলমেট পড়তে পড়তে বললো

-“তোর বাপ আমাকে মারবে কিনা জানিনা।কিন্তু তোর ভাই ডেফিনেটলি আমাকে শুট করে দেবে।দেখ কেমন শকুনের নজরে তাকাচ্ছে।যেনো তার বোনকে আমি উঠিয়ে নিতে যেতে এসেছি।তোর বাপের চাইতে তোর ভাইকে আমার বেশি ভয় লাগে।বেটা সুন্দর চেহারার গম্ভীর মানুষ।একে যেই মেয়ে বিয়ে করবে তার জীবন শেষ।”

রিমি উপরে তাকিয়ে দেখলো তার ভাই ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে তাদের দিকেই তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে।
রিমি কিঞ্চিৎ হেসে বললো

-“ভাইয়ার বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।তবে একটা কথা ঠিক বলেছিস,ভাইয়ের ভবিষ্যৎ বউকে নিয়ে আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে। আমার এক্সপ্রেশন লেস ভাইকে বুঝবে এমন মেয়ে যে কই পাবো আল্লাহ জানে?”

শুভ হেসে বললো
-“টেনশন নিস না।এমন মানুষ গুলো বউ পাগল থাকে।তোর ভাই দেখবি একদিন কোনো এক মেয়ের জন্য এমন পাগলামি করবে যে তোরা চিন্তা করতে পারবি না।”

রিমি হেসে বললো
-“এমনটিই যেনো হয়।আচ্ছা তুই কি বউ পাগলা থাকবি?”

শুভ মুচকি হাসলো। বাইক স্টার্ট দিয়ে দিয়ে বললো
-“আমিতো ছোট বেলা থেকেই বউ পাগলা।”

কথাটা বলেই শুভ চলে গেলো।রিমি তখনও অবাক হয়ে সে দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো।”ছোট বেলা থেকে বউ পাগলা মনে?”

*********
অবনি সেই কখন থেকে রুমে পায়চারি করছে।আর আড়চোখে আরজুর দিকে তাকাচ্ছে।তার পাগলাটে বোনটার কি হলো বুঝতে পড়ছে না।বাসায় আসার পর থেকে কেমন চুপ মেরে বসে আছে।অবনি আবার আরজুর পাশে বসলো।আর বললো

-“আপু কি হয়েছে বলবে?”

আরজু করুন চোখে তাকিয়ে নরম সুরে বললো
-“আমার নজর কি বেহায়া?”

অবনি ব্রু যুগল কুচকে বললো
-“মানে?”

আরজু এবার বেশ বিরক্ত হলো।সে অবনীকে ধমকে বললো
-“চোখের সামনে থেকে যা তো অবনি।আর তারা কে বল আমাকে গরম গরম কফি দিতে।”

অবনি মুচকি হেসে বললো
-“আই থিঙ্ক তোমার এই সময় কোল্ড কফি প্রয়োজন।মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।”

আরজু অগ্নি চোখে তাকাতেই অবনি দ্রুত সেই রুম ত্যাগ করলো।এই মুহূর্তে আরজু কে রাগানো ঠিক হবে না।আরজু বেশি রেগে গেলে জিনিস পত্র ভাঙার বাজে সাভাব আছে।
আরজু ভাবতে থাকলো কিছুক্ষন আগের কথা।তার সেই বেফাঁস কথায় নাহিদ তার অনেকটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল।আরজুর তখন নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়।নাহিদ দুই চারটা থাপ্পড় তার কোমল গালে বসিয়ে দিতে পারে সেই চিন্তা তার ছিলো না।বরং সে ভাবছিলো এই লোক কাছে আসলে সে যদি সেন্স হারিয়ে ফেলে তবে বিষয়টা বেশি লজ্জাজনক হবে। একটা মেয়ে তাকে দেখে ফিট খেয়ে পড়ে গেছে দেখলে এই লোকের ভাব আরো তিন চার গুণ বেড়ে যাবে।এমনি নেতা সাহেবের নারী ভক্তের অভাব নেই।

নাহিদ আরজুর সামনে দাড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বললো

-“নিবরাস নাহিদের মাথা খারাপ করা অত সহজ নয়।আপনি কি ভেবেছেন এই ফিনফিনে শাড়ি,আর খোঁপার বেলি ফুলের মালা নাহিদের হৃদস্পন্দন থমকে দিতে পারবে?আপনার এই লেপটানো কাজল আর মুছে যাওয়া গোলাপী লিপস্টিক এই নাহিদের ব্যক্তিত্বকে নাড়িয়ে দিতে পারবে?আপনার গায়ের মাতাল করা পারফিউম এই নাহিদের হৃদয়কে চঞ্চল করে তুলবে? মোটেও না।সুন্দরী রমণীদের মোহনীয় রূপ দেখে গলে পড়ার মানুষ এই নাহিদ নয়।”

আরজু তখনও নাহিদের দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে ছিল।রক্তলাল চোখের মাঝে মুখ ভর্তি খুঁচা খুঁচা দাড়ি আর এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল অসম্ভব আকর্ষণীয় লাগছে।এই মানুষটি সব সময় বেশ পরিপাটি অবস্থায় থাকে।কিন্তু এমন এলোমেলো অবস্থায় মানুষটিকে এতটা কিউট লাগবে সেটা আরজু ভাবতে পারেনি। আরজু কিছুতেই নিজেকে সংযত করতে পারছে না।ভীষণ ইচ্ছে করছে এই দাড়ি গুলো ছুঁয়ে দিতে।কিন্তু এটা করা মোটেও যুক্তি সংগত হবে না। অবচেতন মনে হঠাৎ মুখ ফস্কে আবারও আরজু বলে উঠলো

-“তার মানে আপনার চোখে আমি মোহনীয় সুন্দরী?”

নাহিদ যেনো কিছুটা চমকালো।হয়তো আরজুর কাছে থেকে এমন জবাব আশা করেনি।এই মেয়ের মাথায় নিশ্চিত কোনো সমস্যা আছে।নাহিদ এবার তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে ফিচেল সুরে বললো

-“আপনি ভীষণ বেহায়া মিস আরজু।তার চাইতে বেশি বেহায়া আপনার নজর।পর পুরুষদের দিকে এই নজরে তাকানো হারাম।নিজের দৃষ্টি সংযত করুন।কারণ সব পুরুষ এই নাহিদের মত সুপুরুষ নয়।”

আরজুর এবার আরো বড়ো বড়ো চোখে তাকালো নাহিদের দিকে।এই লোকটি কি তাকে অপমান করছে? এর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এতক্ষনে আরজু তার গালে দু চারটা দিয়ে বসত। নেহাৎ এই লোককে সে কিছু বলতে পারে না।এই লোকের দিকে তাকালেই তার কেমন প্রেম প্রেম পায়। উথাল পাতাল প্রেম।ভারী যন্ত্রণার মধ্যে আছে আরজু।

আরজু নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।মনে মনে নাহিদকে কয়েকটা গালিও দিলো।তার নজরকে বেহায়া বলছে।অথচ এই লোকটি তাকে পুরো স্কান করে বসে আছে।তার লেপটে যাওয়া লিপস্টিকে অব্দি নজর দিয়েছে।অথচ তার নজর নিয়ে প্রশ্ন করছে।নাহিদ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো

-“এই রাতে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসটি পরিবর্তন করুন।নাহলে কোন একদিন বড়ো কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হবেন।দ্রুত বাসায় যান।রাইট নাও।”

শেষের কথাটা বেশ ধমকের সুরে বললো।আরজু কিছুটা কেপে উঠলো।এই মানুষটি এতো রাগী কেনো?একটু মিষ্টি করে কি কথা বলতে পারে না?আরজু শাড়ির কুচি ধরে সামনে এগিয়ে গেলো।আবার পেছন ফিরে তাকালো।নাহিদ রাগী চোখে তাকিয়ে তাকে সামনে এগিয়ে যাবার ইশারা করলো।আরজু আর দেরি করলো না।দ্রুত বাসার দিকে এগিয়ে আসলো।

আরজুর ধ্যান ফেরে ফোনের রিংটোনে।স্ক্রিনে ভাসছে শুভর নাম।আরজু কল রিসিভ করতেই শুভ তাকে ধমক দিলো।আর বললো

-“তোকে বাসায় থাকতে বলেছিলাম না?পাকামো করে একা বেড়িয়েছিস কেনো?”

-“এতো রাগিস কেনো?অবনি একা ছিলো তাই চলে এসেছি।সমস্যা হয়নি আসতে।”

-“আমার মাথা খারাপ করবি না।রাতে একা কোন আক্কেলে বেড়িয়েছিস?”

আরজু বিরক্ত হয়ে বললো
-“তুই ও আবার শুরু করিস না।আজ সবার জ্ঞানের বাণী শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে গেছি।”

-“ঠিক মতো পৌঁছেছিস তো?”

-“হে।তুই টেনশন নিস না।”

-“বারান্দায় আয়।তোকে না দেখা অব্ধি মন শান্তি পাবে না।”

আরজু দ্রুত বারান্দায় এসে দেখলো শুভ বাইকে বসে আছে।আরজু হাত নেড়ে বললো
-“এই ফাজিল তুই এতো রাতে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

শুভ নরম সুরে বললো
-“সেটা যদি তুই বুঝতি তাহলে ভালই হতো।আচ্ছা আমি গেলাম।যা ঘুমিয়ে পড়।”

-“তুই আসলেই একটা পাগল।”

শুভ মনে মনে বললো
-“শুধু তোর জন্য।”

*************
সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি চোখে পড়তেই ঘুম ভেংগে গেল ফুয়াদের।রাতে ভুল করে জানালার পর্দা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।ঘড়িতে চোখ পড়তেই দেখলো নয়টা বাজে।ফোন তার মায়ের একটা মেসেজ।

“মাই বয় আজ অন্তত নাস্তা করে নিস।তোর পছন্দের নাস্তা রেডি করতে বলেছি।আজ খেতে খারাপ লাগবে না।”

মেসেজটি দেখে ফুয়াদ তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে নিয়ে ভাবলো
-“আজ এমন কি স্পেশাল নাস্তা বানাল?যার জন্য তার মা জননী নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে ছেলেকে মেসেজ করলো?”

ফুয়াদ ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসলো।রান্না ঘরে শব্দ পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখলো একটা মেয়ের পেছন ফিরে কিছু একটা করছে।এই মেয়েকে আগে দেখেছে বলে মনে হয়না।মেয়েটাকে দেখে ফুয়াদ একটু অবাক হলো।কারণ মেয়েটি হাঁটু অবধি লম্বা চুল। এতো লম্বা চুল সে আগে কখনোই দেখেনি।তার গার্লফ্রেন্ডেদের বেশির ভাগ ছোট চুল।যা রং বেরঙের কলার করা।এমন কালো লম্মা কেশ দেখার সুযোগ তার আগে হয়নি। বেনি করা চুলের ঘোচ্ছা দেখে ফুয়াদের মাথায় একটাই কথা আসলো “কেশবতী কন্যা।”

ফুয়াদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে মেয়েটি পেছন ফিরে তাকালো।ফুয়াদ কিছুটা চমকালো।কি স্নিগ্ধ মুখ?সে মনে মনে “কেশবতী কন্যা” শব্দটির আগে ” স্নিগ্ধময়ী কেশবতী কন্যা” নামকরণ করলো।

মেয়েটি প্রথমে একটু চমকে গেলো।কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামনে ফুয়াদকে বললো

-“আপনি টেবিলে বসুন।আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”

ফুয়াদ ব্রু জোড়া কুচকে বললো
-“তুমি কে?”

মেয়েটি একটু ইতোস্থ বোধ করে বললো
-“আমি আপনাদের নিউ শেফ।আমাকে গতকাল ম্যাডাম নিয়োগ দিয়েছেন।”

ফুয়াদ যেনো কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না।এই মেয়েকে দেখে আর যাই হোক সেফ মনে হয় না।সে কিছু না বলে টেবিলে যেতে যেতে তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে এনে ভাবলো সেদিন সে নাস্তা না করায় মা নিউ সেফ রেখেছে।কিন্তু ফুয়াদ তো সেফের হাতে না,মায়ের হাতের রান্না খেতে চেয়েছিলো।কিন্তু তার মা সেটা বুজলো না।ছেলের মন বুঝার ক্ষমতা তার নেই।

একটু পর মেয়েটি টেবিলে নাস্তা দিতেই ফুয়াদ চলে যেতে চাইলে মেয়েটি মিষ্টি সুরে বললো

-“কি ব্যাপার নাস্তা না করে কোথায় যাচ্ছেন?”

-“তোমাকে কষ্ট করে আমার জন্য রান্না করতে হবে না।আমি বাহিরে খেয়ে নেবো।”

-“বাহিরে খাবেন মানে?আমি যে সকাল থেকে নাস্তা রেডি করলাম সেটার কি হবে?”

ফুয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো
-“তুমি খেয়ে নাও নাহলে ডাস্টবিনে ফেলে দাও।”

কথাটি বলে ফুয়াদ বাসার বাহিরে বেরিয়ে এলো।মায়ের উপর ভীষণ অভিমান জমা হয়েছে তার। ছোট বেলা থেকেই সে বাবা মায়ের একটু আদরের জন্য সারা দিন অপেক্ষা করতো।কিন্তু তারা বাসায় ফিরে বেশ টায়ার্ড থাকার কারণে তাকে তেমন একটা সময় দিতো না।সে সারা দিনে এক গাদা কথা জমা করে রাখতো।কিন্তু সেই কথা শোনার সময় তাদের কখনোই ছিলো না।ফুয়াদ ভীষণ চাইতো আট দশজনের মতো তার মা তাকে নাস্তা বানিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে।কিন্তু তেমনটা কখনোই হতো না।গৃহ কর্মীদের হতেই তাকে নাস্তা খেয়ে ড্রাইভারের সাথে স্কুলে যেতে হতো।ফুয়াদ বেশ সাধারণ জীবন চেয়েছে।কিন্তু সে তেমনটি কখনোই পায়নি।কর্পোরেট জগতে তার মা বাবা বেশ সফল হলেও বাবা মা রূপে তারা ব্যর্থ।ভীষণ ব্যর্থ।

***********
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে সাবা খানম অবনীকে বললেন
-“তিনদিন বেশ ঘুরাঘুরি হয়েছে। এবার পড়ায় মনোযোগ দে।এইচ এস সি পরীক্ষার আগে আর কোনো ট্যুর চলবে না।”

-“আম্মু আমি কই এতো ঘুরি?আপু তো সারা বছরই বেড়াতে যায়।তাকে তো কিছু বলো না।”

-“আরজু যাই করুক ফাইনালে ভালো রেজাল্ট করে।বাই দা ওয়ে আরজু তোর ইনকোর্স এর রেজাল্ট দেয়নি?”

এবার আরজুর খাওয়া থেমে গেলো। এতোসময় নিজের প্রশংসায় ভাসালেও এবার তার তরী ডুবতে বসেছে। একটা সাবজেক্টে সে ফেল মেরে বসে আছে জানলে খালামণি তাকে ছাড়বে না।আরজু আমতা আমতা করে বললো

-“ন..না দেইনি।দিলে তো তোমাকেই আগে জানাতাম তাইনা?”

-“হুম।অবনি জলদি নাস্তা শেষ কর।তোর কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে।আর আরজু শুভ কি আসবে নাকি আমি তোকে ড্রপ করে দিবো।”

-“না খালামণি শুভ আসবে।”

-“আচ্ছা।”

সাবা খানম নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে যেতে যেতে তারা কে ফিসফিসিয়ে বললেন
-“আরজুর মুড তো ভালই দেখছি।তুই কি সিওর গত কাল রাতে ওর মুড অফ ছিলো?”

-“সত্যি বলতাছি খাল্লামা।বাসায় ঢুইকা আমারে এক ধমক দিলো।কিন্তু আমি তো ঠিক সময়েই দরজা খুলছিলাম।”

-“আচ্ছা বাত দে।আমি যাচ্ছি।”

-“জি খালাম্মা।”

অবনি নাস্তা খেতে খেতে বললো
-“আপু আমি একটা কথা ভাবছিলাম।”

-“কি?”

-“আমার মনে হয় নেতা সাহেব এটা ভালো মতোই বুঝে গেছে তুমি তাকে নিয়ে কি ভাবো।”

আরজু চমকে তাকালো অবনির দিকে।আর বললো
-“আমি আবার কি ভাবি?”

-“ইসস!এমন ভাব করছ যে কিছুই জানোনা।তুমি যে নেতা সাহেবের প্রেমে হাবু ডুবু খাচ্ছো সেটা তোমার নেতা সাহেব টের পেয়েছে।তুমি যে তার দিকে মুগ্ধতার নজরে তাকাও সেটাকেই সে বেহায়া নজর বলে দাবি করেছে।এই বেটা বেশ চতুর।”

আরজু চিন্তিত সুরে বললো
-“তোকে কে বললো এই কথা নেতা সাহেব বলেছে?আমি তো বলিনি?”

অবনি মুচকি হাসলো।পরোটা মুখে পুড়ে বললো
-“একমাত্র এই মানুষটির কথা আসলেই তুমি এতটা বিচলিত হয়ে পর।আপু তুমি কিন্তু দারুন ভাবে এই নেতার মায়া জালে আটকে পড়েছো।”

আরজু নিজের ঠোঁট কামড় গভীর চিন্তায় ডুব দিলো।সে কি আসলেই ওই মানুষটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে?আরজুর মুখে হালকা হাসির আভা ছড়িয়ে পড়লো।ভালোবাসা নামক অনুভূতি আসলেই দারুন।কেমন ব্যাথাময় সুখ অনুভূত হয়।
অবনি বললো

-“বুজলে আপু এই ভালোবাসা হলো কিছুটা চুলকানির মতো।”

আরজু কপাল কুঁচকে বললো
-“কি?”

-“চুলকানি হলে যেমন চুলকাতে বেশ মজা পাওয়া যায় তেমনি প্রেমে পড়লে এমন ভালোলাগা কাজ করে।আর যখন চুলকানো শেষ হয় তখন জ্বালা শুরু হয়।ঠিক তেমনি প্রেমে পড়ার পর মানুষ ঠিক এতটাই মানুষিক যন্ত্রণায় থাকে।প্রেম মানেই প্যারা।”

আরজু বিরক্তি সুরে বললো
-“এতো কিছু রেখে তোর উদাহরণ হিসেবে চুলকানির কথাই মাথায় আসলো?”

-“এই উদাহরণ টাই প্রেমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”

-“তোর মাথা।যা কলেজে যা।”

-“যাচ্ছি তো।সত্যি কথার দাম নেই।”

অবনি যেতেই আরজু হেসে দিলো।এই মেয়ে আসলেই একটা জিনিস।