মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-১১+১২+১৩

0
552

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_11

ক্লাস শেষ করে ব্রেক আওয়ারে বন্ধুমহল বসেছে ক্যাফেটেরিয়াতে।প্রচন্ড গরমে জারা ঘেমে একাকার অবস্থা।সে ব্যাগ থেকে ছোট পকেট ফ্যান বের করে মুখের সামনে ধরলো। গরমে বেচারীর নাক লাল হয়ে গেছে।সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো

-“টুডেস ওয়েদার ইজ ভেরি হট।”

ফুয়াদ জারার চুলে টান দিয়ে বললো
-“এই ভাব কম নে। পাপা কি পরী ভাব বাসায় যেয়ে দেখা।সবারই গরম লাগছে।আরজুকে দেখ কেমন রেড টমেটো হয়ে আছে।কিন্তু তোর মত ঢং কেউ করছে না।তাছাড়া ক্যান্টিনে এসি চলছে।ইসস!এমন ভাব যেমন বিশাল মাপের সেলিব্রেটি সে।”

জারা রেগে বললো
-“ডোন্ট টক টু মি। তোর মতো বন মানুষ কি করে বুজবে মানুষের সমস্যা।”

-“বন মানুষ আমি না।তুই?তোর অ্যাকটিভিটি তো মানুষের কাতারে পড়ে না।আসমান থেকে নেমে আসা পেত্নীর মত তুই।”

সাবিহা ব্রু যুগল কুচকে বললো
-“আসমান থেকে নেমে আসা পরী শুনেছি পেত্নী হয় সেটা তো শুনে নি।”

শুভ বললো
-“আমার কাছে পরী আর পেত্নী দুইটাই এক লাগে।”

রিমি কৌতহল হয়ে বললো
-“পরী আর পেত্নী এক হয় কেমন করে?”

-“আরে দেখ,পরী দেখতে কেমন হয় তুই জানিস?দেখেছিস কখনো?”

রিমি মাথা নেরে না জানালো।শুভ বাকিদের উদ্দেশ্য করে বললো
-“পরী মানে সুন্দর,আকর্ষণীয় হবে এমন কোনো কথা নেই।সেটা দেখতে বিভৎস,কুৎসিত ও হতে পারে।তাই দুটোই এক।আমাদের কবি গণ এদের আজাইরা বর্ণনা দিয়ে মানুষের মাথায় সেট করে দিয়েছে পরী মানে সুন্দর কিছু।বাস্তবিক অর্থে যার কোনো প্রমাণ নেই।”

সাবিহা কিছুটা ভেবে বললো
-“আসলেই বিষয়টা ভেবে দেখার মতো।”

শুভ আরজুর দিকে তাকাতেই দেখলো সে রাগে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আরজু দুই হাতে শুভর চুল টেনে ধরলো। আকর্ষিক হামলার জন্য শুভ মোটেও প্রস্তুত ছিল না। শুভ বললো

-“কি করছিস?আমার এই সুন্দর,সিল্কি চুল গুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলবি নাকি?”

-“হে একদম সব চুল ছিঁড়ে ফেলবো।জীবনে প্রথম যেদিন শাড়ি পরে স্কুলের প্রোগ্রামে গেছিলাম তখন কি বলেছিলি?”

-“কি বলেছিলাম?”

-“শয়তান তুই বলেছিলি আমাকে পরীর মতো লাগছে।সারা দিন না হলেও বিশ বার এই কথা বলেছিস।তাছাড়া আমি যেদিনই একটু সেজে আসি তুই তখনই বলেছিস পরীর মতো লাগছে।আমি বোকা তোর কথা শুনে খুশি হতাম।কিন্তু আজ বুঝতে পারছি।কুত্তা তুই আসলে মনে মনে আমাকে পেত্নী বুঝিয়েছিস।”

শুভ ব্যাপারটা এতক্ষনে বুজলো। তার ফিলোসফি মার্কা কথাবার্তা যে তার মাথার উপরে বোম হয়ে ফুটবে সেটা কি বেচারা জানতো?রামিম আরজুকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে ধমকের সুরে বললো

-“কি শুরু করেছিস?তোরা কি এখনো সেই স্কুলে আছিস যে এইভাবে চুল টানাটানি করছিস?”

-“এই বাদরের সব চুল আমি টেনে ছিড়ে ফেলবো।”

শুভ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।এমন আক্রমণের শিকার আজ প্রথম হয়নি সে।সেই স্কুল লাইফ থেকেই আরজু নিজের সব রাগ শুভর চুলের উপর দিয়েই ঝারে।শুভ চুলে হাত ঘষতে লাগলো আর বললো

-“বেয়াদব মহিলা।আমি কি বুঝিয়েছিলাম তুই ভালো করেই জানিস।তবুও আমার চুলের উপর দিয়ে টর্নেডো চালিয়েছিস।”

আরজু কপট রেগে বললো
-” তুই আমার সাথে কোনো কথা বলবি না।তোর মনে কি শয়তানি চিন্তা ছিলো আমি বুজবো কি ভাবে?”

-“বুজবি কেনো?যেটা বুঝার সেটা তো জীবনেও বুজবি না।বেকুব একটা।”

চিকেন প্যাটিসে কামড় বসিয়ে জারা বললো
-“চিকেন প্যাটিস খেতে খেতে তোদের দুজনের ঝগড়া দেখতে কি যে জোস লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না।চালিয়ে যা,চালিয়ে যা।”

ফুয়াদ জারার আদ খাওয়া প্যাটিস ছিনিয়ে নিয়ে মুখে পুরে বললো
-“একাই মজা নিবি?আমিও নেই।”

আরজু বিরক্ত হয়ে ক্লাসের দিকে চলে গেলো।রিমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো

-“এই সুন্দরী রমণীকে তো সবাই মিলে ভালই রাগিয়ে দিলি। এবার বাকি দিন ওর অভিমান ভাগতে ভাঙতে কাটা।আমি ক্লাসে গেলাম।”

সারা ক্লাস আরজু শুভকে ইগনোর করলো।শুভ মনে মনে ভাবছে সুন্দরী মেয়েদের মাথার উপরের ডিস্ক মনে হয় ফাঁকাই থাকে।নাহলে এই সুন্দরী রমণী এত দিনে তার চোখের ভাষা ঠিক বুঝে নিতে সক্ষম হতো।সারা ক্লাস শুভ আরজুকে নানা কায়দায় মানানোর চেষ্টা করলো।আরজু মনে মনে হাসলো। শুভকে মাঝে মাঝে এমন বেকায়দায় ফেলতে আরজু বেশি মজা পায়। কারণ সে রেগে গেলে রাগ ভাঙ্গানোর শুভ সকল চেষ্টাই তার মনে প্রশান্তি দেয়।তার এই স্বভাবকে অবনী আহ্লাদীপনা বললেও তার কাছে সকলের ভালোবাসা পেতে ভীষণ ভালো লাগে। হয়তো সবার ভালোবাসার মাঝে বাবা মায়ের ভালোবাসার অভাব মোচন করতে চায়।

শেষ পর্যন্ত ক্লাস শেষে ক্যাফেট এরিয়াতে চকলেট পেস্টি খাওয়ার পরই আরজু মান অভিমান ভাঙ্গে। ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হওয়ার সময়ই তার দেখা হয় তাদের সিনিয়র ভাই সাঈদের সাথে।জারা আরজুর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো

-“এসে গেছে তোর শুভাকাঙ্ক্ষী।তোর ধর্মের ভাই।”

-“চুপ।”

সাঈদ আরজুকে দেখেই মুচকি হেসে বললো
-“কি অবস্থা আরজু? কেমন আছো?”

আরজু মিষ্টি হেসে বললো
-“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

-“এইতো চলে যাচ্ছে।আজ অনেক দিন পর তোমার দেখা পেলাম।”

-“জি ভাইয়া সামনে ইয়ার ফাইনাল তাই ব্যাস্ত আছি।”

-“ভালো।কোনো সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই বলবে কিন্তু?”

-“জি ভাইয়া।”

সাঈদ জারার দিকে তাকিয়ে বললো
-“কি খবর জারা?”

জারা কিঞ্চিৎ হেসে বললো
-“এইতো ভালো ভাইয়া।”

সাঈদ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে বললো
-“তোমাদের তো ক্লাস শেষ।আচ্ছা বাসায় যাও।”

সাঈদ চলে যেতেই ফুয়াদ বললো
-“শালা খবিস একটা।মেয়েদের দেখলেই সাহায্যের জন্য লেলিয়ে পড়ে।আমাদের দিকে কিন্তু ফিরেও তাকালো না।”

আরজু বিরক্ত হয়ে বললো
-“সাঈদ ভাইকে নিয়ে তোদের সমস্যা কি বলতো? এই লোকটা কত ভাবে আমাদের হেল্প করেছে জানিস?”

সাবিহা বললো
-“আসলেই সাঈদ ভাইকে খুব ভালো লাগে। এই মানুষটা না থাকলে কি পরিমান রাগিং এর শিকার যে হতাম সেটা বলে বুঝাতে পারবো না।বিশেষ করে আরজু কে তো উনি বহুবার হেল্প করেছে।ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই আরজুকে এই সব ঝামেলা থেকে বাচয়েছে।পরবর্তীতে ওর ফ্রেন্ড হওয়ার পর থেকে আমরাও এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে পেরেছি।”

জারা ব্যঙ্গ করে বললো
-“সুন্দরী মেয়ে দেখলে এরা এমন করেই হেল্প করতে দৌড়ে আসে।আমি ড্যাম শিওর এই বেটা আরজুর উপর প্রথম দিনেই ক্রাশ খেয়েছে।তাছাড়া ভার্সিটিতে এই পাতি নেতার ভালই দাপট আছে।তাইতো এই ভার্সিটিতে আরজুকে কখনো কেউ রেগিং দেওয়ার সুযোগ পায়নি। তাছাড়াও ইউনিভার্সিটি সকল ছেলেই আরজুকে দেখে ইমপ্রেস হলেও কখনোই সামনে এসে কিছু বলার সাহস পায়নি।নাহলে এতো দিনে আমাদের আরজুর ম্যাডামের রূপের আগুনে ঝলসে কত ছেলেই প্রপোজ করে বসত।”

ফুয়াদ হেসে বললো
-“এমন দুই একটা ছাত্রদলের নেতা আশিক হয়ে পিছে ঘুরলে ভালো ফায়দা আছে।বাকি ছেলেদের খপ্পর থেকে বাঁচা যায়।”

আরজু কপট রেগে বললো
-“তোদের সবার ধারণা ভুল। সাঈদ ভাই আমাকে সবসময়ই নিজের ছোট বোনের চোখে দেখে। এই মানুষটার চোখে আমি সবসময় আমার নিজের জন্য সম্মান দেখেছি। কোন বাজে নজরে আমার দিকে তাকায়নি।”

শুভ বললো
-“আমার কাছেও সাইদ ভাইকে দেখে তেমনি মনে হয়।আরজুকে যথেষ্ট স্নেহ করে।”

জারা হেসে বললো
-“আরজু, তোর পুরো জীবনটাই তো নেতাময় হয়ে গেছে। কিছু নেতা তোর পিছে ঘুরে আর তুই কিছু নেতার পিছনে ঘুরিস।তোর মনে হয় নেতা রাশি।”

আরজু মিনমিনিয়ে বললো
-“আমি কোনো নেতার পিছে ঘুরি না।”

********
বিকেলে রামিম বাসায় পৌছে দেখলো তার মা সোফায় বসে পরীক্ষার খাতা দেখছে।রামিম মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।তিনি পরম আদরে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন

-“কীরে বাবা আজ অনেক টায়ার্ড?”

-“কিছুটা মা।একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।”

-“তোকে কতবার করে বলেছি এই সব টিউশন ছেড়ে দে।সবটা আমি সামলে নিবো।”

-“মা তুমি তো সেই ছোট বেলা থেকেই দেখছি সামলাচ্ছো। তখন ছোট ছিলাম বলে কিছু করতে পারিনি কিন্তু এখন তো বড় হয়েছি তাই তোমাকে একটু হেল্প করতে চেষ্টা করছি।”

-“আজ তোর বাবা বেচেঁ থাকলে এই বয়সে তোকে এতো কষ্ট করে টিউশন করতে হতো না।এই সবের মাঝে নিজের পড়াশোনার ক্ষতি করিস না।তোকে নিয়ে আমার অনেক আশা ভরসা।”

-“তুমি চিন্তা করোনা।খুব জলদি একটা জবের বেবস্থা করে নিবো।তখন আর তোমাকে কোনো কাজ করতে দিবো না।”

-“আমি কিন্তু একা বাসায় থাকতে পারবো না।তোকে বিয়ে দিয়ে বউ এনে তবেই আমি রিটায়ার্ড নেবো।”

রামিম তাচ্ছিল্যের হেসে বললো
-“চাল চুলোহীন ছেলের কাছে কোন মেয়ে কষ্ট করতে আসবে মা?আমার কি অত যোগ্যতা আছে নাকি?”

-“আমি জানি আমার ছেলের যোগ্যতা কি।আমার ছেলে কম কিসে?একটা চাকরি পেলে দেখবি মেয়ের বাবারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।”

রামিম মুচকি হাসলো।তার মা ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনে রেখেছে। এবার তাকে এই টুকরো টুকরো সপ্ন গুলো জোড়া লাগাতে হবে।সব সুখ এই মমতাময়ী পেয়ে এনে দিতে চায় রামিম।

***********
সারা দিনের কর্ম বেস্ততা শেষে নাহিদ বাসায় পৌঁছালো মধ্যে রাতে।ডোরবেল বাজাতেই তার বাসার গৃহ কর্মী দরজা খুলে দিলো।নাহিদ দেখলো মেয়েটি ঘুমে হেলে দুলে পড়ে যাবার জোগাড়।সে গম্ভীর মুখে বললো

-“এক্ষনি পড়ে মাথা ফাটাবি।যা রুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

কথাটি বলে নাহিদ ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।পেছন থেকে সুমি নামক মেয়েটি বলে উঠলো
-“ভাইজান বড়ো স্যার আসছে।”

নাহিদ যেতে যেতে বললো
-“আমি এখন ভীষণ ক্লান্ত সুমি।আগে ফ্রেশ হবো।”

সুমি আড়চোখে পাশের সোফায় বা পায়ের উপর ডান পা তুলে রাখা ভদ্রলোকটির দিকে তাকালো।তিনি আয়েশি ভঙ্গিতে কফি খাচ্ছেন।প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যে ভদ্রলোক এই নিয়ে তিন কাপ কফি শেষ করলেন।সুমি চোখ জোড়া কচলে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো।এমন রাত জাগা তার প্রতিদিনের কাজ।কারণ নাহিদ অধিকাংশ সময় গভীর রাতে বাসায় ফেরে।

নাহিদ নিচে নেমে আসলো প্রায় ঘন্টা খানেক পর। নাঈম মাহমুদ ঘড়িতে সময় দেখে নিলেন।তখন সময় রাত 2 টা। এতো রাত অব্ধি বসে থেকে তারও বার বার চোখ লেগে আসছিলো।তাই কফি দিয়ে সেই ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করছিলেন।বাসায় ঢুকেই যে নাহিদ তাকে দেখেও না দেখার ভান করে উপরে চলে যাচ্ছিলো সেটা তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন।

নাহিদ সামনের বিশাল সোফায় এসে বসলো।তার সকল মনোযোগ ফোনের মাঝে। নাঈম মাহমুদ বুঝতে পারলেন ছেলে তাকে ভদ্রভাবে ইগনোর করছে।তিনি গলা পরিষ্কার করে নড়ে চড়ে বসলেন।এতেও যেনো সামনের সুদর্শন যুবকটির দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যার্থ হলেন।আর সময় ব্যায় না করে তিনি বললেন

-“তুমি কি প্রতিদিন এত রাত করে বাসায় ফেরো?”

নাহিদের নির্বিকার জবাব
-“হ্যাঁ।”

-“আজকাল বাসায় তেমন একটা যাওনা কেনো?তোমার দাদী এই নিয়ে কতবার তোমাকে খবর পাঠিয়েছে?”

নাহিদ তার ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বললো
-“ব্যাস্ত ছিলাম। দাদীর সাথে আমার কথা হয়েছে।”

নাঈম মাহমুদ যেন এবার কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। কি অদ্ভুত নিজের ছেলের সাথে কথা বলতেও কত রকম দ্বিধাবোধ কাজ করছে। দুজনই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে রইলো।তারপর নাহিদ গম্ভীর স্বরে বললো

-“আর কিছু বলবেন?নাহলে আসতে পারেন।”

নাঈম মাহমুদ কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললেন
-“আবারও বলছি এই পলিটিক্স ছেড়ে বেরিয়ে এসো।তোমার আর একটা রাস্তার গুন্ডার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।তারা রাস্তায় মাস্তানি করে আর তুমি গদিতে বসে।”

নাহিদ এবার নাঈম মাহমুদের চোখের দিকে তাকালো।ক্রোধের সাথে বললো
-“আমি তো কখনোই বলিনি যে আমি ভালোমানুষ।রাজনীতির মাঠে কোনো ভালোমানুষ টিকে থাকতে পারে না।আর আমাকে নিয়ে আপনার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।কারণ সমাজে আমি আপনার নাম ইউজ করে ক্ষমতায় টিকে আছি এমন তো নয়।বরং আমার এই পজিশন আমি তিলে তিলে তৈরি করেছি।”

-“তুমি কি মনে করো মানুষ তোমাকে খুব ভালোবাসে?তোমার ভাষণ শুনে হাজারো করতালির মাঝে হাজারো মানুষের ঘৃনা,গালি লুকিয়ে থাকে সেটা পরিমাপ করেছ?”

নাহিদ বাঁকা হাসলো।আর বললো
-“এই পজিশনে আসার আগে বহুবার মাঠে নেমে কাজ করেছি।তালি আর গালি দুইটাই হজম করার মনোভাব আমার আছে।তাই আপনাকে আমার চিন্তা করতে হবেনা।আপনার অন্য সন্তানদের না হয় মন মতো তৈরি করে নিন।কারণ আপনার আদর্শবান সন্তান হবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

নাঈম মাহমুদ ক্রোদে ফেটে পড়লেন।সোফা ছেড়ে উঠে বললেন
-“তুমি অত্যন্ত অসভ্য হয়ে গেছো।বাবার সাথে কি করে কথা বলতে হয় সেটা অব্দি ভুলে বসে আছো।যে সারাদিন গুন্ডা,মাস্তানদের বগলের তলায় নিয়ে ঘুরে তার কাছে এর চাইতে ভালো ব্যাবহার আশা করা যায়না।”

নাহিদ কিছু বললো না।বসে বসে রগে ফুঁসতে লাগলো।আসলে এই মুহূর্তে তার সামনের মানুষটির সাথে কোনো প্রকার তর্কে জড়াতে ইচ্ছে করছে না।

নাঈম মাহমুদ দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লেন। কখনো নাহিদের প্রতি রাগ হচ্ছে তো কখনো নিজের প্রতি।তার উদাসীনতার কারণেই ছেলেটা একদম বখে গেছে।তার উপর পলিটিক্সে আসার পর থেকে যেনো নাহিদ আরো বেশি কঠোর হয়ে পড়েছে।

নাহিদ সোফায় তখনও বসে আছে।তার চোখ জোড়া রক্তিম আকার ধারণ করেছে।এই অযাচিত অধিকারবোধ সে মোটেও পছন্দ করেনা।প্রচন্ড ক্ষোভে সে সামনে থাকা কফির মগটা ফ্লোরের দিকে ছুঁড়ে মারলো।এতেও যেনো তার রাগ কমছে না।

সুমি দ্রুত সোফার রুমে এসে দেখলো নাহিদ উপরে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে।সে জানতো এমনি হবে।কারণ যতবার বড়ো স্যার এই বাসায় এসেছেন ততবারই ভাইজান রেগে কিছু না কিছু ভাঙচুর করে।বাবা ছেলের সম্পর্কে এতো তিক্ততা থাকতে পারে সেটা সে আগে জানতো না।সে জন্মের পর নিজের বাবাকে দেখেনি।তার জন্মের আগেই তার বাবা মারা যায়।আসলে সামনে থাকতে আমরা সেই জিনিসের কদর করতে জানিনা।

খোলা বারান্দায় বসে নাহিদ নিকোটিনের ধোঁয়া উড়তে লাগলো।সারাদিন হাজারো মানুষের মানুষের মাঝে ঘেরাও থাকলেও রাতের আধারে সে একা।হয়তো এই একাকীত্ব তার বেশি ভালোলাগে।নাহলে সবাই থাকতেও সে নিজেকে কেনো সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে?

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_12

বিকেলে কোচিং শেষ করে অবনি আর তার বান্ধুবিরা বেরিয়েছে বাসার উদ্দেশ্যে।রাস্তায় হঠাৎ ফুচকার দোকান দেখে তাদের জিভে পানি চলে এসেছে।তিন বান্ধুবী মিলে হামলা দিলো দোকানে।বিথী বললো

-“মামা তিন প্লেট ফুচকা দিবেন।একটা কড়া ঝাল দিয়ে আর দুইটা একটু কম ঝাল।”

অবনি বললো
-“এত ঝাল কেমন করে খাস?আমার তো নাক মুখ জ্বলে যায়।”

বিথী হেসে বললো
-“তুই কেমন করে বুজবি ঝাল খাওয়া কি মজা।”

অবনি হাসতে হাসতে বললো
-“দেখিস এখন বেশি ঝাল খেলে কাল সকালে বাথরুমে সেটার ঝাঁঝ টের পাবি।”

অবনির কথা শুনে সুরভী হেসে দিলো।কিছুক্ষণ পর ফুচকা চলে এলে তারা রীতি মতো ঝাপিয়ে পড়লো।কয়েকটা খাওয়ার পর অবনি দেখলো ঝালের মাত্রা একটু বেশি।কিন্তু বাঙালী নারী ফুচকার মায়া ছাড়তে নারাজ।হু হা করতে করতে আরো দুটি মুখে পুড়ে নিলো।কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে মুখ জ্বলে যাচ্ছে।সে হাপাতে হাপাতে হাত দিয়ে মুখে বাতাস করতে করতে বললো

-“ওই আমার ফুচকা এতো ঝাল কেনো?কোনো ভাবে ওই বিথী চুন্নির ঝাল ফুচকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায়নি তো?”

সুরভী আরেকটা ফুচকা মুখে পুরে বললো
-“কই আমারটা তো ঠিক আছে।”

বিথী মাথা চুলকে বললো
-“এর জন্যই তো বলি এতো ঝাল দিতে বলার পর ও ঝাল লাগেনা কেনো?বেটা মনে হয় ভুল করে আমারটা তোকে দিয়ে গেছে।”

অবনি ঝালে অস্থির হয়ে পড়ল।আর বললো
-“ও মা।মুখ জ্বলে গেলো।ওই পানি দে।”

সুরভী ব্যাগ থেকে দ্রুত পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলো।অবনির ফর্সা মুখ ইতিমধ্যে লাল হয়ে উঠেছে।অবনি দ্রুত কয়েক ঢোক পানি গিলেও সুবিধা করতে পারলো না।আবারও মুখ ভর্তি পানি নিয়ে বসে রইলো।এতে যদি ঝাল একটু কমে।কিন্তু কিছু সময় পরই সেই পানিও উত্তপ্ত হয়ে উঠলো।সে পেছন ফিরে মুখে রাখা পানি ফুস করে ফেলে দিলো।কিন্তু সেখানে ঘটলো এক দুর্ঘটনা।

অবনি দেখলো সে বাইকে বসা কোনো ছেলের মুখে সেই পানি ফেলেছে।ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো এটা সেই ছেলে।যার সাথে সিলেটে যাবার সময় দেখা হয়েছে।অবনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।এই লোককে সে দেখবে ভাবতে পারেনি।অবনি জিভ কাটলো।এই রোবট মানব ছেলের উপরই সে পানি ফেলতে গেলো?তার যত অপকর্ম এই লোকের সামনেই প্রকাশ পায়?

নিশান প্রচন্ড রেগে অবনির দিকে তাকালো।তার সারা মুখে পানি লেগে আছে,যা বেয়ে বেয়ে তার গ্রে কলার শার্ট টি ভিজে দিয়েছে।অবনীকে দেখে যেনো তার মেজাজ আরো বেশি বিগড়ে গেলো।মাত্রই সে এই জায়গাতে বাইক থামিয়েছিল।বার বার কল আসছে তাই বাইক থামিয়ে কল রিসিভ করতে চেয়েছিল।কিন্তু বাইক থামানোর সাথে সাথেই কেউ যেনো তার মুখে পানি ছুড়ে মারলো।যেই সেই পানি না।কুলি করা নোংরা পানি।কিন্তু ওই বাঁদর মেয়েটাকে দেখে তার মেজাজ বিগড়ে গেলো।নিশান বাইক থেকে নেমে অবনির সামনে এসে ক্ষিপ্ত হয়ে বললো

-“এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার?সব জায়গাতেই কি তোমার ঝামেলা না পাকালে হয়না?মুখের পানি কোথায় ফেলতে হয় জানো না?”

অবনি চোখ পিট পিট করে তাকালো।তার নিঃশ্বাসের গতি বাড়লো।
-“কথা বলছনা কেনো?”

অবনি স্বাভাবিক হয়ে মিনমিন স্বরে বললো
-“আসলে সরি।আমি খেয়াল করিনি।”

-“তোমার খেয়াল থাকে কোথায়? বাবা মায়ের হাত ছের রাস্তায় কেনো নেমে এসেছো?এই কারণেই বাচ্চা কাচ্চা আমার একদম পছন্দ না। ”

অবনির এবার রাগ হলো।এই লোকের সমস্যা কি?কলেজ পড়ুয়া স্টুডেন্ট বাচ্চা কাচ্চা হয় কি করে?এমনি ঝালে তার কান দিয়ে ধোঁয়া উঠছে।অবনি কিছুটা রেগে বললো

-“আরে আজব! সমস্যা কি আপনার?সরি বলার পরও ফুটেজ কেনো খাচ্ছেন?”

-“একই বলে চোরের মায়ের বড়ো গলা।একে দোষ করেছ তার উপর তর্ক করছো।বাচ্চা মানুষ বাচ্চা মানুষের মতো থাকবে।”

অবনি এবার বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে হাতে থাকা বোতলের পানি নিশানের মুখে ছুড়ে মারলো।অবনির এই আকর্ষিক কাণ্ডে সকলেই চমকে উঠলো।সুরভী অবনির পাশে দাড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো

-“এইটা কি করলি?দোষ কিন্তু তোর ছিলো।”

অবনি রাগে গজগজ করতে করতে বললো
-“সরি বলেছিলাম না?তার পরও কেমন ভাব দেখাচ্ছে দেখিসনি?”

হঠাৎ নিশান অবনির খুব কাছে এসে তার গলার স্কর্ফটি খুলে নিলো।অবনি ও তার বন্ধুবিরা রীতি মতো ঘাবড়ে গেলো।অবনি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলো।নিশান স্কার্ফটি দিয়ে নিজের মুখ মুছে অবনির মুখের উপর ছুড়ে মারলো।আর ক্ষিপ্ত হয়ে বললো

-“নেক্সট টাইম এমন করলে তোমাকে এই ভাবে আছাড় দিবো।বাচ্চা বলে ছেড়ে দিলাম।”

নিশান অবনীকে শাসিয়ে বাইকে উঠে চলে গেলো।অবনি তখনও নিশানের যাওয়ার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো।

***********
শুভ আজ সকাল সকাল রেডি হয়ে নিলো।দরজার কাছে আসতেই শোভা বলে উঠলো
-“এতো সকাল সকাল হিরো সেজে কোথায় যাচ্ছো?আজ তো অফ ডে?”

শুভ জুতার ফিটা লাগাতে লাগাতে বললো
-“আরজু দের বাসায়।ওকে নিয়ে বের হবো।”

-“ডেট এ যাচ্ছো নাকি?”

-“এক থাপ্পর খাবি।আরজু কি আমার গার্লফ্রেন্ড?”

-“ইসস!কি ভাব?আরজু আপু তোমার অফিসিয়াল গার্লফ্রেন্ড নাই হতে পারে কিন্তু যে কেউ দেখলেই বুজবে তোমাদের মধ্যে কিছু তো চলছে।”

-“তোর মাথা চলছে।আরজু আমাকে বেস্ট ফ্রেন্ডের বেশি কিছু ভাবে না।”

-“আর তুমি?”

শুভ শোভার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুচকি হেসে চলে গেলো।

**********
বাসার ডোর বেল বাজতেই তারা দরজা খুলে দিলো।শুভকে দেখেই তার মুখে অন্ধকার নেমে আসলো।শুভকে তার তেমন একটা পছন্দ না।ছেলেটা যখন তখন আরজুর রুমে ঢুকে পরে।সারাদিন আরজু আর শুভকে কাছাকাছি দেখে সে বিরক্ত হয়।তার মতে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে কখনোই বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারে না।কিন্তু তার কথা কেই বা শুনবে। খালাম্মা নিজেই এদের বাধা দেয় না।বড়োলোকের এতো ফ্রি মাইন্ডেড বিহেভইয়ার তার মোটেও পছন্দ না।শুভ তারাকে দেখে শান্ত দৃষ্টি রেখে বললো

-“কি অবস্থা তারাবানু?”

তারাবানু ডাকা টি তারার বেশ অপছন্দের।আর শুভ ইচ্ছে করে তাকে এই নামে ডাকে।যখন তারা রেগে মুখটা বাংলার পাঁচ করে ফেলে সেটা দেখতে শুভ বেশ মজা পায়।তারা যে তাকে অপছন্দ করে সেটা শুভ ভালো করেই জানে।তারা বেশ অনাগ্রহ প্রকাশ করে বললো

-“ভালো।”

শুভ ভেতরে প্রবেশ করে বললো
-“আরজু কোথায়?”

-“বড়ো আপা ঘুমায়।”

শুভ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো
-“কয়টা বাজে এখনো ঘুমে?ওর ঘুম বের করছি।”

-“আপনি বসেন আমি আপারে ডাইকা দিতেছি।”

-“তোমাকে কষ্ট করতে হবে না তারাবানু।তুমি তো এই রাজ্যের শাসক।আমি তোমার গোলাম।তুমি তোমার আসন গ্রহণ করো।”

তারা মুখ ভেংচে চলে গেলো।আরজুকে নিয়ে তার মহা চিন্তা।সুন্দরী মেয়ে মানুষের পেছনে এমন ছেলেরা লেগেই থাকে।আর আরজু হলো আগুন সুন্দরী।শুভর আরজুর প্রতি দুর্বলতা অনেকটা সে বুঝতে পেরেছে।এই ছেলে যে আরজু আপাকে অন্য নজরে দেখে সেটা সে বুঝতে পারে। তার মতে আরজুর মতো সুন্দরীর কোনো রাজপ্রাসাদের রাণী হওয়া দরকার।

ডাইনিংয়ের পাশে আসতেই দেখতে পেলো জুবায়ের আহমেদ ও সাবা খানম নাস্তা করছেন।শুভকে দেখেই জুবায়ের আহমেদ উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললেন

-“আরে শুভ কেমন আছো? কতো দিন পর তোমার দেখা পেলাম।”

-“এইতো আংকেল ভালো আছি।আপনি তো দেখছি আরো ইয়াং হয়ে গেছেন।”

-“তাই নাকি?”

-“একদম।”

সাবা খানম বলে উঠলেন
-“শুভ এই লোককে পাম দিও না।নাহলে দেখা যাবে জমিনে পা পড়বে না।”

জুবায়ের আহমেদ মলিন মুখে বললেন
-“এই একমাত্র তুমিই আমার কদর বুঝলে না।এতো ডেসিং জামাই পেয়েও পাত্তা দাও না।”

-“ফালতু কথা কম বলো।বয়স বাড়ছে এখনো নিজেকে যুবক ভাবা তোমার বোকামি।”

-“আমি তো যুবকই।বয়স আর কতো কুড়ি হবে।”

শুভ হেসে উঠলো।বললো
-“একদম ঠিক।”

সাবা খানম বললেন
-“এসব কথা ছাড়। শুভ নাস্তা করতে বসো।”

-“খালামণি ওই দুই বাঁদর কোথায়?”

-“বাঁদরের দল ঘুমায়। বন্ধের দিনে বারোটা না বাজলে এদের ঘুম ভাঙ্গে না।”

-“ব্যাপারনা খালামণি।আমি এসে গেছি তো এবার এদের দুজনের ঘুম উড়ে যাবে। ওদের নিয়ে আসি তারপর একসাথে নাস্তা করব।”

শুভ চলে গেলো আরজুর রুমে।অন্যদিকে তারা খাবার সার্ভ করতে লাগলো।

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আরজুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ।এতো মিষ্টি কেনো এই মেয়েটি।শুভর মনে পড়ছে সেই ছোট্ট গাল ফোলা কিউট আরজুর কথা।কথায় কথায় মেয়েটা তার সাথে অভিমান করতো।আর তাদের মধ্যে ঝগড়া হলেই সে আরজুর চুলের ঝুঁটি ধরে টানাটানি করতো।তবে তারা এক দিনের বেশি ঝগড়া করে থাকতে পারতো না। এখনো ঝগড়া হলে শুভ যদি তার রাগ না ভাঙ্গে তবে ম্যাডামের আরো অভিমান হয়। রাত হলেই কল করে কেঁদে কেঁদে শুভকে ধমকায়।যত রাতই হোক এই ম্যাডামের রাগ ভাঙাতে শুভকে আইসক্রিম চকলেট নিয়ে আসতে হয়।
শুভ কয়েক বার আরজুকে ডাকার পরও আরজু উঠলো না। পাশের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আরজুর মুখে ছুড়ে মারতেই আরজু এক লাফে উঠে বসলো।আর বললো

-“এই কে রে?”

শুভ হো হো করে হেসে বললো
-“তোর জম।”

-“একটা লাথি মারবো ছাগল।এই ভাবে কেউ পানি ছুড়ে মারে?”

-“তাহলে কি করবো?ভালো করে ডেকে কোনো লাভ হলো না।তাই এই পদ্ধতি এপ্লাই করেছি।”

-“কুত্তা দেখিস বউয়ের হাতে মার খেতে খেতে তোর দিন যাবে।”

-“ব্যাপার না।ছোট বেলা থেকেই তোর হতে মার খেয়ে অভ্যাস আছে। এখন জলদি উঠ।”

আরজু চোখ কচলাতে কচলাতে বললো
-“কেনো?ঘুমাতে দে।”

-“ঘুম পড়ে।আজ তোকে নিয়ে সারাদিন ঘুরবো।”

আরজুর চোখ চক চক করে উঠলো। কতো দিন আগের মতো ঘুরা হয়না।আরজু বললো
-“আমার ডিপি চেঞ্জ করা লাগবে।ক্যামেরা এনেছিস?”

-“হে।”

-“ইয়া হূ।আজকে ছবি তুলে ফাটিয়ে ফেলবো।কি পরবো বলতো।”

শুভ মুচকি হেসে বললো
-“শাড়ি।”

************
কাশফুল ঘেরা মাঠে আরজু নানান পোজ দিয়ে ছবি তুলছে।আর শুভ বেশ উৎফুল্ল নিয়ে ক্যামেরায় ক্লিক করছে।বেশ কিছুক্ষন পর আরজু বললো

-“আর না।আমি টায়ার্ড।একটু বসি।”

দুজনই বসে পড়লো ছোট্ট ঝিলের পাশে।আরজু নিরবে বেশ কিছুক্ষন প্রকৃতিকে উপভোগ করলো।স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাস।আরজু মনে মনে ভাবলো এই মুহূর্তে পাশে নেতা সাহেব থাকলে মন্দ হতো না।নেতা সাহেবের কাধে মাথা রেখে হাজারো গল্পঃ করতে ইচ্ছে হচ্ছে।কিন্তু সেটাকী আদো সম্ভব?আরজুর নিজের উপর রাগ হলো।এমন আকাশের চাঁদ হয়ে থাকা মানুষটিকে কেনো মন দিয়ে বসলো?একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরজু বললো

-“শুভ,দুর্বোধ্য কোনো কিছুর মায়ায় পড়ে গেলে কি করা উচিৎ?”

শুভ এতো সময় একটা ঘোরের মাঝে ছিলো।মুগ্ধ চোখে আরজুকে দেখছিলো। হঠাৎ আরজুর কথায় স্বাভাবিক হয়।শুভ বুজলো আরজুর এই কথার মানে।তাই মুচকি হেসে বললো

-“মায়া জিনিসটা বড্ডো খারাপ।মায়া মানুষকে দুর্বল করে তুলে।তখন মানুষ ঠিক বেঠিক যাচাই করতে পারে না।তাই অনেকেই মায়াকে ভালোবাসা মনে করে ভুল করে।”

আরজু পাশের ঝিলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললো
-“ভালোবাসা এতো কমপ্লিকেটেড কেনো?”

-“ভালোবাসা হলো গভীর সমুদ্রের মতো।যার মাঝে একবার পড়লে শুধু তলিয়ে যেতে থাকে। এর থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই।”

-“ঠিক বলেছিস।যেমনটা সাবিহার হয়েছে।মেয়েটা তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো রামিমের ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।”

-“ঠিক বলেছিস।”

-“দেখিস না আজকাল রামিম সাবিহাকে অনেকটা এড়িয়ে চলে।আমরা সবাই জানি সাবিহা রামিমের প্রতি কতটা দুর্বল।মেয়েটা ওকে অসম্ভব ভালোবাসে।কিন্তু রামিম বুঝেও না বুঝার ভান করছে।”

-“বিষয়টা আমিও জানিনা কেনো।তবে আমার মনে হয় রামিম ও সাবিহাকে ভালোবাসে। হয়তো ওর ফিনান্সিয়াল কন্ডিশন এর জন্য ইতস্ত বোধ করছে।”

-“হোয়াট রাবিশ। ভালোবাসা কি ফিনান্সিয়াল কন্ডিশন দেখে হয় নাকি। এই ছেলেটা এত সহজ বিষয় বুঝবে কবে?”

-“আল্লাহ জানে।”

আরো কিছুক্ষন তারা নানান গল্পঃ করলো।দুপুরের দিকে তারা গেলো রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে।আরজু তির্যক দৃষ্টি ফেলে বললো

-“কি ব্যাপার!এতো দামী রেস্টুরেন্টে আনলি? আংকেলের ওয়ালেট মেরে দিয়েছিস নাকি?”

-“জি না।তোকে নিয়ে বের হবো শুনে আমার বাপ পকেট গরম করে দিয়েছে।আমার বাপকে কি ভাবে পটিয়েছিস বলতো?তোর কথা শুনলেই সে একদম গলে যায়।”

-“সেটা বুজবি না।আঙ্কেলকে তো আমি ছোট বেলা থেকেই পটিয়ে ফেলেছি। আগে এটা বল আমার কথা বলে নিজের পকেট কতবার গরম করেছিস?”

-“অগণিত বার।”

বলেই শুভ হাসতে লাগলো।আরজু টেবিলের নিচে শুভর পায়ে লাথি মেরে বললো

-“দারা তোর বাটপারি আংকেলের কাছে ফাঁস করে দিবো।”

-“দিস আমি ভয় পাই নাকি? এখন অর্ডার কর।”

খাবার চলে আসলে তারা খেতে শুরু করলো।আরজু হেসে বললো
-“বুঝলি আমার মনে হচ্ছে কোনো ডেটে এসেছি।পুরাই ফরমাল সব কিছু এই জায়গায়।”

-“ভাবতেই পারিস সমস্যা কি?”

আরজু খিল খিল করে হেসে উঠলো।আর বললো
-“ডেটে আর তোর সাথে।এটা ভাবতেই আমার হাসি পাচ্ছে।রাগ উঠলে দেখা যাবে সব খাবার তোর মাথায় ঢালা শুরু করেছি।”

শুভ চোখ নামিয়ে আপন মনে সুধালো
-“আমার জন্য তো এটা ডেট।কিন্তু তুই কবে বুজবি?কবে আমাকে একটু সিরিয়াসলি নিবি?”

কিছুক্ষণ পর আরজু গেলো ওয়াসরুমে দিকে।কিন্তু সেখানে অনেক ভিড়।একজন ওয়েটার বললো উপরের ফ্লোরের ওয়াস রুম ফাঁকা আছে।তাই আরজু লিফটে চরে উপরে চলে গেলো।ওয়াশরুমের সামনে এগুতেই অসাবধানতা বশত হঠাৎ কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেল আরজু।আকর্ষিক ধাক্কায় সে পড়ে যেতে নিলেই একটি শক্ত রুক্ষ হাত তাকে আটকে ফেললো।আরজুর সারা শরীর রীতি মতো কাপছে।কারণ সে বলিষ্ঠ হাত তার উন্মুক্ত উদরে বিচরণ করছে।সামনের মানুষটির শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে মাতাল করা সুবাস।যা আরজুর মস্তিষ্ককে নাড়িয়ে তুলছে।আরজু মাথা তুলে সামনের মানুষটিকে দেখলো।তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া তার দিকেই নিবদ্ধ।আরজুর শরীর অসাড় হয়ে আসছে।আরজু মন ভরে নিঃশ্বাস নিলো।সামনের মানুষটি তার কাছথেকে খানিকটা সরে দাড়ালো।আর বললো

-“আপনি বড্ডো বেসামাল মিস আরজু।সাথে অন্যদের ও বেসামাল করে তুলেন।এটা কিন্তু ঘোর অন্যায়।”

আরজু ঘোরের মাঝে থেকেই বললো
-“আমার উপস্থিতি আদো আপনার মতো দাম্ভিক ও গম্ভীর মানুষকে বেসামাল করতে সক্ষম হয় মেয়র সাহেব?”

-“আমার কথা বাত দিন।অন্য কেউ হলে তো আপনার নরম, কোমল উদরেই স্লিপ করে যেত।”

আরজু কিছুটা লজ্জা পেলো।মানুষটির নজর এই জায়গাতে এসেছে।ভীষণ লজ্জা পেলেও সে শাড়ির আঁচল ঠিক করে বললো

-“আপনি কোনো ভাবে স্লিপ করেননি তো?”

নাহিদ কুটিল হাসলো।যায় মানে আরজুর মস্তিষ্ক বুঝতে সক্ষম হলো না।মানুষটি বড্ডো রহস্যজনক।নাহিদ হেসে বললো

-“নাহিদ ক্যারেক্টার টিকে আপনি এখনো বুঝে উঠতে পারেননি।আপনার নরম কোমল উদর কেনো আপনি স্বয়ং বস্ত্রহীন আমার সামনে দাড়িয়ে থাকলেও এই নাহিদকে এক বিন্দু বিচলিত করতে পারবেন না।”

আরজু ভীষণ লজ্জা পেলো।এই লোকের মুখ যে এতটা বেলাগাম সেটা আরজু জানতো না।আরজু তো মোটেও ইচ্ছে করে লোকটির সামনে এমন করেনি।নাহিদ কি তাকে অন্য সব মেয়েদের মতো ভাবছে? ছি!!লজ্জা আর অভিমান নিয়ে আরজু নাহিদকে পাস কাটিয়ে চলে যেতে নিলে হঠাৎ নাহিদ আরজুর হাত ধরে আটকায়।আরজু চমকে পিছন ফিরে তাকায়।তার সারা শরীর বেয়ে শীতল রক্তের ফোয়ার বেয়ে যায়।অদ্ভুত অনুভূতি।তার স্বপ্ন পুরুষের প্রথম ছোঁয়া।নাহিদ আরজুর সামনে দাড়িয়ে তার কপালের টিপ খুলে নিলো।আরজু আবারও চমকালো।নাহিদ কুটিল হেসে বললো

-“টিপ পরা মুসলিম মেয়েদের জন্য হারাম।তাই খুলে নিলাম। নারীর কপালে টিপ নয় বিশেষ করো উষ্ণ ছোঁয়া শোভা পায়।আচ্ছা আরজু রাগলে কি আপনার নাক লাল হয়ে যায়?প্লিজ অন্য কারো সামনে এই ভাবে নাক লাল করা রাগ দেখবেন না।নাহলে সেই মানুষটির হৃদয়ে ক্ষতর সৃষ্টি হবে।একজন দায়িত্বশীল মেয়রের হওয়ায় আমি চাইনা কারো ক্ষতি হোক।”

নাহিদের কথা আরজুর মাথার দুই তিন হাত উপর দিয়ে গেলো।মানুষটি ভীষণ অদ্ভুত।আরজুর বিস্ময় চেহারা দেখে নাহিদ নিরব হাসলো।আরজুকে বিব্রত করে সে বেশ তৃপ্তি অনুভব করলো।আর সেখান থেকে চলে গেলো।আরজু তখনও সে ভাবেই দাড়িয়ে রইলো।একদিকে আরজুর রাগ হলো অন্য দিকে অদ্ভুত ভালোলাগা ছুঁয়ে গেলো।মানুষটিকে এতো কাছ থেকে দেখতে পেরে।বাদামি বর্ণের চোখ জোড়ায় অদ্ভুত রহস্য খেলা করে।যা আরজুকে আরো কয়েক ধাপ দুর্বল করে তুলে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_13

ফকফকা রোদে প্রজ্জ্বলিত শহর।শিউলির মৃদু সুভাষ লেগে আছে সমীরে।এই স্নিগ্ধ সকালে ভার্সিটির কৃষ্ণচূড়া গাছের সামনে দাড়িয়ে আছে জারা।মূলত তার বন্ধুমহলের অপেক্ষা করছে।আজ কিছুটা আগেই চলে এসেছে সে।সকালের রোদ তীর্যক আলো ছড়াচ্ছে।ফলে ধরণীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।তবে এই বৃদ্ধ বৃক্ষটি তাকে অনেকটা সস্থি দিচ্ছে।চাইলেই ক্যান্টিনে বসে এসির হাওয়া উপভোগ করা যায়।কিন্তু বন্ধুমহল ছাড়া সেখানে তার কিছুতেই মন বসে না।নিজেকে কেমন এতিম এতিম মনে হয়।অপেক্ষার প্রহর যখন শেষ হচ্ছে না তখনই কেউ পেছন থেকে বলে উঠলো

-“এই তীক্ষ্ণ রোদে বসে আপনার মুখখানা মলিন হয়ে গেছে।একটু ঠাণ্ডা খান।দেখবেন বেটার ফিল করবেন।”

বলেই একটা কোকের বোতল এগিয়ে দিলো জারার দিকে।জারা ব্রু জোড়া কুচকে দাড়িয়ে বললো

-“তোমাকে বলেছি আমার জন্য কোক আনতে?”

জাহিদ পেছনের চুলে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো।সেই হাসি দেখে জারার গলা শুকিয়ে গেলো।বার কয়েক ঢোক গিললো।অসহ্যকর হাসি।এই রকম বিচ্ছিরি হাসি জারা আগে কখনো দেখেনি।জারা দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। জাহিদ বললো

-” না বলেননি।কিন্তু আমি দায়িত্ববোধ থেকে নিয়ে আসলাম।”

জারা প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো
-“কিসের দায়িত্ববোধ?”

-“একজন মানুষ হিসেবে আমার দায়িত্ব আছে না?”

জারা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে জাহিদের কিছুটা কাছে এসে বললো
-“এই ছেলে আমার সাথে চালাকি করবে না।তুমিযে প্রতিদিন আমাকে ফলো করো আমি জানিনা ভেবেছ? তোমার কপাল ভালো এখনো সুস্থ ভাবে দাড়িয়ে আছো।আমার বন্ধুদের দেখেছো? ঠ্যাং ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেবে।”

জাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“তাই নাকি?ভীষণ ভয় পেলাম।”

জারা বিরক্ত হলো।আবার সেই অসহ্যকর হাসি।জারার কেনো যেনো এই হাসি পরিচিত মনে হয়।সে বললো

-“এই ছেলে তুমি কিসে পরো?”

-“ফার্স্ট ইয়ারে।”

-“আর আমি থির্ড ইয়ার ফাইনাল দিবো।গুনে গুনে দুই থেকে তিন বছরের বড়ো আমি।আর তুমি কিনা সিনিয়র আপু সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছো? অসভ্য ছেলে।”

জাহিদের এবার রাগ হলো।এই মেয়েটা সব সময় তার সাথে রাফ বিহেভ করে।সে হঠাৎ জারার অনেকটা কাছাকাছি দাড়ালো।জারা খানিকটা চমকালো।লম্বা চওড়া দেহ খানির সামনে জারার নিজেকে তেলাপোকা মনে হলো।জাহিদ চোখ কুচকে বললো

-“কি অসভ্যতামো করেছি আমি?কি বলবেন বন্ধুদের?আমি কি আপনাকে রাস্তায় দার করিয়ে বাজে কথা শুনিয়েছি?নাকি আপনার গায়ে হাত দিয়েছি?”

জারা হতবম্ব হয়ে পড়লো।ছেলেটা এতো নিকটে কেনো আসলো?ভীষণ অস্থিরতা ভর করলো জারার উপর।পুরুষালি মিষ্টি সুঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগছে।

তবে জারা ভাবলো ছেলেটা সত্যি বলছে।সে তাকে ফলো করলেও কখনো রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বাজে কথা বা দৃষ্টি কোনোটাই দেয়নি।তবে কি সে ছেলেটার সাথে বেশি রাফ বিহেভ করছে?

জাহিদ কুটিল হাসলো।আর জারার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো

-“এইজ ডাজেন্ট মেটার ফর মি।ভালোলাগা তো বয়স দেখে হয় না।তবে আপনি যখন আমাকে অপরাধী ভেবেই নিয়েছেন।তখন একটা অপরাধ করাই যায়।কি বলেন?”

কথাটা বলেই সে জারার গালে টুপ করে চুমু খেয়ে নিলো।জারা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল।জারার পিঠ বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত বেয়ে গেলো।কয়েক মুহূর্তের জন্য সে স্থির হয়ে গেলো। ডান হাত আপনাআপনি চলে গেলো সেই স্পর্শকৃত স্থানে।জাহিদ মুচকি হেসে বললো

-“এবার আপনার বন্ধুদের বলতে পারেন আমার অপরাধ।তাদের সকল শাস্তি মাথা পেতে নেব।”

কথাটি বলেই জাহিদ কোকের বোতল জারার হাতে গুজে দিয়ে চলে গেলো।জারা তখনও গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে।কয়েক মুহূর্ত পর সে স্বাভাবিক হয়ে দেখলো জাহিদ চলে যাচ্ছে।রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে।সে সেখানে দাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো

-“বেয়াদব,অসভ্য,আর কোনো দিন আমার সামনে পড়লে চাপড়িয়ে তোর গাল লাল করে দিবো।”

জারা হাতের কোকের বোতলটি ছুড়ে ফেলে দিলো।তার সারা শরীর কাপছে। রাগে নাকি অন্য কারণে সেটা ঠিক বোঝা গেলো না।

জাহিদ জারার কথা শুনেও থামলো না।না শুনার ভান করে হাঁটতে লাগলো।সে মুখ টিপে হাসছে।এই মুহূর্তে চলে না আসলে ঘায়েল বাঘিনী যে থাবা মারবে তাতে কোনো সন্ধেহ নেই।মেয়েটাকে জ্বালাতে তার বেশ লাগে।রাগী রাগী চোখ জোড়া জাহিদের মনের অনুভূতি গুলুকে আরো তীব্রতর করে তোলে।

জারাকে সে প্রথম দেখেছিল একটা টিভিসি তে।প্রথম দেখেই তার মেয়েটার প্রতি অজানা আকর্ষণ কাজ করে।তবে সেই আকর্ষণ তীব্র হয় ভার্সিটিতে সেদিন জারাকে দেখে।এই মেয়েটা যে তারই ভার্সিটির সিনিওর হবে সেটা ভাবতে পারেনি।আর এই মেয়ে আর তার বন্ধুরাই কিনা তাকে রেগিং দিলো।তবে সেই শাস্তি সে সানন্দে গ্রহণ করেছে।এই মেয়েটা দেখতে যত সুইট তার মেজাজ ততই ঝাল।এই বাঘিনী যে সহজে বশে আসবেনা সেটা জাহিদ জানে।তবুও সে ঘায়েল হয়ে ক্ষত বিক্ষত হয়ে এই বাঘিনীকে জয় করতে চায়।

বেশ কিছুক্ষন পর শুভ আসলো ভার্সিটিতে।তার বাইকের পেছনে আরজু। দূরে জারাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আরজু বাইক থেকে নেমে দ্রুত কাছে এসে বললো

-“কীরে তোর চেহারাটা পাঙ্গাস মাছের মতো করে রেখেছিস কেনো?”

জারা কিছুই বললো না।রাগে ফুঁসতে লাগলো।আরজু শুভর দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো।শুভ বললো

-“কিগো সুন্দরী?মুখটা ম্যানহোলের ঢাকনার মতো কালো করে রেখেছিস কেনো?কেমন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।”

জারা রেগে শুভর পিঠে একটা কিল বসলো।শুভ চোখ মুখ কুচকে চেঁচিয়ে বললো

-“ও মা।মেরে ফেলবি নাকি?আমার ব্যাক বোণ ভেঙে ফেলেছিস।এমন রোগা শরীরে এতো শক্তি?পিঠটা ভেঙেই গেলো মনে হয়।”

জারা রেগে বললো
-“ফালতু কথা বললে আরো একটা খাবি।এমনি মেজাজ গরম আছে।”

আরজু চিন্তিত সুরে বললো

-“কি হয়েছে বলবি?”

জারা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কি বলবে সে?এটাই যে একটা জুনিয়র পিচ্ছি ছেলে তাকে চুমু খেয়ে চলে গেছে?শুনতেই কেমন বিৎঘুটে লাগছে।জারা বললো

-“রোদের মধ্যে তোদের জন্য দাড়িয়ে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।”

শুভ বললো
-“তাহলে ক্যান্টিনে বসতি।”

-“একা ভালো লাগছিলো না তাই।”

-“আচ্ছা চল এখন।তোর মাথায় ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলে দেখবি মেজাজ একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে।”

জারা ভাবলো আসলেই তার মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালা প্রয়োজন।নাহলে তার মস্তিষ্ক রাগে ফেটে পড়তে পারে।

*********
ফুয়াদ নিচে নামতেই দেখলো সেই মেয়েটা আজও নাস্তা রেডি করে বসে আছে।এই কয়েক দিন ফুয়াদ মেয়েটাকে ইগনোর করলেও আজ করতে পারলো না।তার একটাই কারণ মেয়েটির তীক্ষ্ণ রাগান্বিত দৃষ্টি।সেই দৃষ্টি বলছে আজ এই খাবার নষ্ট হলে সব তার মাথায় ঢালবে।ফুয়াদ কিছুটা ঘাবড়ে গেল।কয়েক দিনে সে বুঝতে পেরেছে মেয়েটাকে দেখতে শান্ত মনে হলেও আসলে অনেকটা রাগী।ফুয়াদ যতবার খাবার না খেয়ে বের হয়েছে ততবার মেয়েটা ক্ষুব্ধ হয়েছে।কিন্তু ফুয়াদকে কিছুই বলতে পারেনি।অবস্থা বুঝে ফুয়াদ ভাবলো খেতে বসাটা বেটার হবে।টেবিলে বসে ফুয়াদ কিছুটা চমকালো।আলু পরোটা,মিক্স সবজি আর পায়েস।সব গুলো তার পছন্দের খবার।সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো

-“এই সব কে বানাতে বলেছে?”

মেয়েটা একটু ঘাবড়ে গেলো।উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা যে এতো রিচ ফুড সকাল সকাল গিলবেনা সেটা কেনো ভুলে গেলো?সে মলিন মুখে বললো

-“কেউ বলেনি।আমি ভাবলাম লাইট খবর দেখে হয়তো আপনি ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন না।তাই রিচ কিছু ট্রাই করলাম।আপনি বললে আমি ঝট পট লাইট কিছু করে দিতে পারি।”

-“প্রয়োজন নেই।”

ফুয়াদ খাবার মুখে পুড়ে চমকে মেয়েটির দিকে তাকালো।মেয়েটা হয়তো ফুয়াদের মুখভঙ্গি বুঝতে পারছে না।ফুয়াদ মুচকি হেসে বললো

-“এই খাবার তুমি রান্না করেছ?”

-“জি।কেনো আপনার ভালো লাগেনি?”

-“অনেক টেস্টি হয়েছে।অনেক দিন পর জোস একটা ব্রেকফাস্ট করছি।”

মেয়েটি মুচকি হাসলো।সে ভেবেছে এই ছেলেটি হয়তো ভীষণ মুডি।বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান।বেশ কয়েকবার দেখেছে কোনো মেয়ের সাথে ফোনে লুতুপুতু টাইপ কথা বলে। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ছেলেটি ভীষণ প্রাণোচ্ছল।যতোটা খারাপ ভেবেছে ততটা না।

ফুয়াদ খেতে খেতে বললো

-“আচ্ছা তোমার নাম তো জানা হলো না।”

-“জী আমার নাম লামিয়া।”

-“লামিয়া! নাইস নেম।কিসে পরো তুমি?”

-“এইবার এইচ এস সি দেবো।”

ফুয়াদ অবাক হয়ে তাকালো।মেয়েটাকে দেখেই সে বুঝেছিল ছোট।কিন্তু এত ছোট ধারণা করতে পারেনি।সে কপাল কুচকে বললো

-“এইচ এস সি বোর্ড এক্সামের তো বেশি সময় নেই।প্রিপারেশন কেমন?”

লামিয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।লেখাপড়া সে বহু কষ্টে কন্টিনিউ রেখেছে।এতো সবের মাঝে বই হাতে নেওয়ার তেমন সময় পায়না।সে মুচকি হেসে বললো

-“মোটামুটি।”

-“তোমার পেরেন্টস রা কোথায়?”

লামিয়া খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।ফুয়াদ লামিয়ার অবস্থা দেখে বুজলো হয়তো ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে।তাই কথা ঘুরিয়ে বললো

-“তোমার রান্না কিন্তু সেই মজার হয়েছে। কার কাছ থেকে শিখেছো?”

-“আমার মায়ের কাছ থেকে।”

-“ভেরি গুড।তাকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও।”

লামিয়ার মুখে আবারও মেঘ জমা হলো।সে বললো
-“তিনি বেচেঁ নেই।বছর খানেক আগে মারা গেছে।”

ফুয়াদের ভীষণ খারাপ লাগলো।সে আফসোস করে বললো
-“আই এম সরি।”

-“ইটস ওকে।”

-“তাহলে তোমার পরিবারে কে কে আছে?”

প্রশ্নটি শুনে লামিয়ার নয়নের অশ্রু কনা জমা হলো।এই প্রশ্নটি হয়তো তার জীবনের সব চাইতে অপছন্দের।সে লুকিয়ে সে অশ্রু মুছে বললো

-“আমি আর আমার ছোট বোন।”

ফুয়াদ কপাল কুঁচকে বললো
-“তোমার বাবা নেই।”

লামিয়া অশ্রু সিক্ত চোখে মাথা নেড়ে না জানালো।আসলে শব্দ তার গলায় আটকে আছে।তাই কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।

লামিয়ার কথা শুনে ফুয়াদের খাবার গলায় আটকে গেলো।কেনো যেনো খাবার নিচে নামছে না।এই বয়সেও সে বাবা মায়ের কাছ থেকে পকেট মানি নিয়ে চলে।অথচ তার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে কিনা জীবিকার জন্য কাজে নেমে পড়েছে।ভেতরে ভেতরে তার ভীষণ খারাপ লাগা কাজ করলো।সত্যি বাস্তবতা অনেক কঠিন।

*************
আজ সবাই মিলে গ্রুপ স্টাডির জন্য হামলা দিলো আরজু দের বাসায়। সামনের সপ্তাহে তাদের ইয়ার ফাইনাল।জুবায়ের আহমেদ আরজুর রুমে উকি দিয়ে বললো

-“আরে বাবা! আজ দেখি আমাদের বাসায় তারার মেলা বসেছে।বিউটিফুল লেডিসরা,যদি কিছুর প্রয়োজন পরে অবশ্যই বলবে।”

ফুয়াদ বললো
-“আংকেল আপনার সব কনসার্ন শুধু লেডিস দের জন্যই?আমরা আদম জাতি কি দোষ করলাম?”

জুবায়ের আহমেদ হেসে বললেন
-“তোমাদের জন্য আমার কাছে স্পেশাল সার্ভিস আছে।”

বলেই তিনি কিছু ইশারা করলেন।মেয়েরা না বুঝতে পারলেও ফুয়াদরা ঠিকই বুঝতে পারলো।তারা মিটি মিটি হাসতে লাগলো।জুবায়ের আহমেদ দরজা ছেড়ে পেছন ফিরতেই ভয় পেয়ে গেলেন।ভয়ে গলাও শুকিয়ে আসলো।তার সামনেই সাবা খানম রাগান্বিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।তাকে দেখেই রাগে কটমট করে বললো

-“তোমার মধ্যে কি মিনিমাম কমন্সেস নেই।যেখানে বাচ্চাদের ভালো উপদের দেবার কথা,সেখানে কিনা বাজে জিনিসে ইনকারেজ করছো?”

জুবায়ের আহমেদ মুচকি হেসে সাবা খানমের কাছে যেয়ে বললেন
-“তোমার কি এদের এখনো বাচ্চা মনে হয়?শুনো নিউ জেনারেশনের সাথে তাদের স্ট্যালেই মিশতে হয়।তাহলেই তো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়।”

-“শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করবে না।রুমে চলো।ওদের স্টাডি করতে দাও।”

-“যথা আজ্ঞা অ্যাডভোকেট সাহেবা।”

************
জারা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।তাকে দেখে ফুয়াদ হাসছে।রামিম ফুয়াদকে ধমক দিয়ে বললো

-“হাসি বন্ধ কর।”

জারা অসহায় মুখ করে বললো
-“সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা আর আমি এই চ্যাপ্টার আজ নতুন দেখছি।সব তো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।”

সাবিহা হেসে বললো
-“এই চ্যাপ্টার পড়ানোর সময় তুই ক্লাসে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলি।আমি ডাকার পরো উঠিস নি।গন্ডারের মতো ঘুম তোর।”

জারা রেগে বললো
-“কথা বলবি না আমার সাথে।এইবার রিটেক দেওয়া লাগলে আমি শেষ।”

রিমি জারার পাশে বসে বললো
-“সেন্টি খাস না।আমি বুজিয়ে দিচ্ছি।একদম ইজি।”

জারা রিমিকে জড়িয়ে ধরে বললো
-“তুই আমার শেষ ভরসা। এক্সামে তো তুই আমার সামনে থাকবি।সো কোনো চিন্তা নাই।”

ফুয়াদ জারার মাথায় থাপ্পড় মেরে বললো
-“তুই তো চিটিং ও ঠিক মত করতে জানিস না। লাস্ট ইনকোর্স পরীক্ষায় রামিমের খাতা নকল করতে যেতে ধরা খাইছিলি। স্যার তো তোর খাতাই বাতিল করে দিতো।কিন্তু তুই তোর ধারালো অস্র দিয়ে স্যারের মন গলিয়ে নিয়েছিস।কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়েছি দেখিয়েছি।আর নিজাম স্যারও ভালো লুচ্ছা আছে।সুন্দরী মেয়ে দেখলেই গলে যায়।”

জারা রেগে বললো
-“এই আমার সাথে তোর কোন জনমের শত্রুতা আছে?সবাইকে রেখে আমার পিছেই পড়ে থাকিস?আমাকে পছন্দ করিস নাকি?”

বলেই জারা মুচকি হাসলো।ফুয়াদ কপাল কুঁচকে মুখে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বললো
-“ইয়াক! তোকে আমি পছন্দ করবো?তোর মতো ঢঙ্গী মেয়ে আমার পছন্দ না।”

শুভ হেসে বললো
-“ফুয়াদের জারিনের মতো মেয়ে পছন্দ।একদম ওর সাথে চিপকে থেকে বাবু, সোনা ডাকবে।”

সাবিহা হেসে বললো
-“ফুয়াদ তুই কি দেখে ওই জারিনের সাথে রিলেশনে গেলি?আমাদের জারা একটু ঢঙ্গি হতে পারে।কিন্তু ওই মেয়ের মতো ছেলে দেখলেই চিপকে থাকে না।”

জারা রেগে সাবিহার দিকে তাকালো।সাবিহা মুচকি হেসে জারাকে চুমু দেখলো।ফুয়াদ চুলে হাত বুলিয়ে বললো
-“ওর সাথে তো ব্রেকআপ করে দিয়েছি।”

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।ফুয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো

-“এই ভাবে তাকানোর কি আছে? ওই মেয়ে আমার টাইপের না।বেশি নেকামি করে।জারার সামান্য নেকামিই আমি সহ্য করতে পারিনা।সেখানে গফ এর ওভার নেকামি, কেমন কি?”

আরজু নোট খাতায় আবার লিখতে লিখতে বললো
-“একদম ভালো ডিসিশন নিয়েছিস। সি ডাজেন্ট ডিজার্ভ ইউ।”

রিমি বললো
-“আচ্ছা তোর কেমন টাইপের মেয়ে পছন্দ?অলরেডি সব টাইপের মেয়েকে ডেট করে ফেলেছিস।কোনোটাই দুই তিন মাসের বেশি টিকে নি।”

ফুয়াদ হাতের বইটা উল্টাতে উল্টাতে নরম সুরে বললো
-“আমার সিম্পল এবং দায়িত্বশীল মেয়ে পছন্দ।যেই মেয়ে নিজের পরিবারকে সবসময় গুরুত্ব দিবে।পরিবারের জন্য যে কোনো অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে পারবে।যে নিজের স্বামীকে সম্মান করবে আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসবে।”

ফুয়াদের কথায় সাড়া রুমে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল।সবাই বুঝতে পারলো ফুয়াদ তার মায়ের উপর কতটা অসন্তুষ্ট।একটা সুস্থ পরিবার মানুষের জীবনে ভীষণ প্রয়োজন।একটা বাচ্চা হাজারো খেলনার চাইতেও বেশি বাবা মায়ার ভালোবাসা চায়।তাদের সাথে নিজের সকল সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে চায়।একটি সন্তানের মানুষিক প্রশান্তি নির্ভর করে বাবা মায়ের উপর।অথচ বর্তমানে অনেক বাবা মাই নিজেদের ক্যারিয়ারের পেছনে এতটাই মরিয়া হয়ে পরে যে সন্তানদের নূন্যতম সময় দিয়ে পারে না।এতে সন্তানদের উপর কতটা বিরূপ প্রভাব পড়বে সেটা তারা গুরুত্ব দেয়না।