মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
532

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_14

চোখের পলকেই সপ্তাহ চলে গেলো।আজ তাদের পরীক্ষা।ফুয়াদ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে যেতেই লামিয়া পেছন থেকে ডেকে উঠলো।আর বললো

-“আজ তো আপনার পরীক্ষা।না খেতে যাবেননা প্লিজ।আমার মা বলতো গুরুত্বপূর্ন কাজে খালি মুখে বেরিয়ে যেতে নেই।”

ফুয়াদ নির্লিপ্ত ভাবে লামিয়াকে দেখলো।তার মা কখনোই তার পরীক্ষায় এই ভাবে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করেনি।শুধু অফিসে যাবার আগে অল দ্যা বেস্ট উইশ করে বেরিয়ে যেতো।ফুয়াদ বরাবর ভালো স্টুডেন্ট।তাই স্কুল,কলেজে থেকে কোনো প্রকার অভিযোগ আসতো না।তাছাড়া তার চার্মিং বিহেভিয়ার সকলকেই আকৃষ্ট করতো।

ভাবনা থেকে বেরিয়ে ফুয়াদ টেবিলে বসে দ্রুত ব্রেকফাস্ট করে নিলো।ঠিক তখনই তার মা ঘুম থেকে উঠে আসে। হাই তুলে ফুয়াদকে দেখে বললো

-“বাবু এক্সামে যাচ্ছিস?ভালো করে পরীক্ষা দিস।মা কিন্তু ভালো রেজাল্ট দেখতে চাই।”

ফুয়াদ তাচ্ছিল্য হাসলো।আর বললো
-“আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।”

-“তুই আমার এক মাত্র ছেলে।তোকে নিয়ে ভাববো না তো কাকে নিয়ে ভাববো?”

-“তোমাদের ভাবার নমুনা আমার দেখা হয়ে গেছে।আসি।আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।আর লামিয়া তোমাকে ধন্যবাদ আমার এতো খেয়াল রাখার জন্য।আমার পরীক্ষার কথা ভেবে এতো সকালে এসে আমার পছন্দের ব্রেকফাস্ট তৈরি করার জন্য।তোমার মতো প্রতিটি মানুষ যদি দায়িত্ববান হতো তবে কোনো সন্তানকে আর আক্রোশ নিয়ে বাঁচতে হতো না।”

কথাটা বলে ফুয়াদ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।লামিয়া আড়চোখে ফুয়াদের মায়ের দিকে তাকালো।ভদ্র মহিলার উজ্জ্বল চেহারায় অন্ধকার নেমে এসেছে।মা ছেলের মধ্যে যে বিস্তর দূরত্ব বিরাজমান সেটা লামিয়া আগেই আন্দাজ করতে পেরেছে।অদ্ভুত এই পৃথিবী।কেউ বাবা মায়ের ছায়া হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে।আর কেউ কেউ পাশে থেকেও সন্তানের ছায়া হয়ে উঠতে পারে না।

**********
শুভ আর আরজু এসেই ক্লাসের বাইরে জারাকে দেখতে পেলো।বেচারীর মুখখানা লাল হয়ে আছে।রিমি হাতে পানি নিয়ে জারার মাথায় দিচ্ছে।আরজু জারার অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো।পরীক্ষা আসলেই জারার এই অবস্থা হয়।শুভ বাইক পার্ক করতে করতে বললো

-“দেখ ঐটার কি অবস্থা?আংকেল আন্টি ওকে সামলায় কি করে?সারা বছর টই টই করে ঘুরবে আর পরীক্ষার হলে আসলেই এর মাথা গরম হয়ে যাবে।”

-“আচ্ছা চল। ম্যাডামের মাথায় আমিও একটু পানি ঢেলে আসি।”

আরজুকে দেখেই জারা অসহায় গলায় বললো
-“দোস্ত আমি তো টেনশনে মরে যাচ্ছি।এই নিজাম বেটার সাবজেক্ট আমার মাথার উপর দিয়ে যায়।আর এই বালের সাবজেক্ট এর পরীক্ষাই সবার আগে।”

রিমিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বেশ বিরক্ত।আসছে পর থেকে জারার এই নাটক দেখছে।পরীক্ষার জন্য সে নিজেও বেশ চিন্তিত।তাই বলে এমন হাহাকার তো করছে না?সে জারার উদ্দেশ্য বললো

-“আচ্ছা টেনশন নিচ্ছিস কেনো?তোকে তো সেই দিন আমি অনেক গুলো প্রবলেম সলভ করে দিয়েছি।তাছাড়া তোর সামনের সিটে আমি আছি।সো চিল মার।”

আরজু কিঞ্চিৎ হেসে বললো
-“অ্যাকজেক্টলি।তুই শুধু শুধু প্যারা নিচ্ছিস।আমাদের ক্লাসের টপার তোর সামনে।”

ফুয়াদ এসে পাশে বসতে বসতে বললো
-“কীরে তোর নাটক শুরু হয়ে গেছে?”

-“আমি মোটেও নাটক করছি না।আর পরীক্ষার আগে তুই কোনো কথা বলবি না।আমার মাথা গরম হয়ে যাবে।”

রামিম হেসে বললো
-“এই ফুয়াদ তুই জারার সাথে এখন কোনো কথা বলবি না।নাহলে তোদের ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে।আর এই সময় কোনো গেঞ্জাম চাই না।”

ফুয়াদ শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বললো
-“ঠিক আছে বললাম না।”

রামিম আসে পাশে তাকিয়ে বললো
-“সাবিহা এখনো আসেনি?এই মেয়ের কোনো কমনসেন্স নেই।ফার্স্ট পরীক্ষায় লেট।”

পরীক্ষার সময় হয়ে আসছে কিন্তু ওরা সকলেই ক্লাসের বাইরে সাবিহার জন্য অপেক্ষা করছে।বার বার সাবিহার নম্বরে কল করে যাচ্ছে।কিন্তু সাবিহা কল ধরছে না।ওদের মাঝে যতই ঝগড়া,মনোমালিন্য হোকনা কেনো একে ওপরের জন্য জান দিতে প্রস্তুত।তাদের এই বন্ধুত্ব দেখে ভার্সিটির অনেকেই যেমন পুলকিত হয় তেমনি অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়।ভার্সিটিতে তাদের বন্ধুমহলের বেশ পরিচিতি আছে।

টিচার ক্লাসে চলে আসলে রামিম সকলকে এক প্রকার জোর করে ক্লাসে পাঠিয়ে দেয়।রামিমের ভীষণ চিন্তা হতে লাগলো।সাবিহা তো কখনোই এমন করে না।কোনো সমস্যা হলো নাতো?এই মুহূর্তে নিজের উপর রাগ হচ্ছে।সকালে ওকে বাসা থেকে পিক করে নিয়ে আসলেই পারতো।রামিম আবার সাবিহাকে কল লাগায়।কিন্তু এইবারও রিসিভ হচ্ছে না। রামিমের মধ্যে অস্থিরতা ভর করলো।এই মেয়েটার কোনো ক্ষতি হলে সে একদম সহ্য করতে পারবে না।রামিম নিজের পরীক্ষার চিন্তা বাত দিয়ে ডিসাইড করলো সাবিহার বাসায় যাবে।এক্ষনি যাবে।নাহলে সে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না।সে কিছুটা এগিয়ে আসতেই দেখলো সাবিহা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকছে।রামিম ছুটে গেলো সাবিহার কাছে।আর অস্থির হয়ে বললো

-“এই তোর পায়ে কি হয়েছে?”

সাবিহা প্রথমে একটু অবাক হলো।তার জানা মতে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।তাহলে রামিম এই জায়গায় কি করে?সে বললো

-“রিক্সা থেকে পড়ে গেছিলাম। পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছি।”

রামিম এবার রেগে বললো
-“কতবার কল করেছি?ধরিস না কেনো?কত টেনশন হচ্ছিল তোর কোনো আইডিয়া আছে?বেকুব একটা।”

সাবিহা প্রশান্তির হাসি হাসলো।রামিম রাগের মাঝেও সে কত সহস্র ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছে।সে হেসে বললো

-“ফোনের ডিসপ্লে ইন্তেকাল করেছেন।কি করে ধরবো?”

রামিম হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো
-“ওহ শিট! জলদি চল।হাঁটতে পারবি?”

-“হে পারবো।”

রামিম ধরে ধরে তাকে ক্লাসে নিয়ে আসলো।বন্ধুমহলের বাকি সবাই সাবিহাকে দেখে অস্থির হয়ে পড়লে সাবিহা চোখের ইশারায় বুঝালো সে ঠিক আছে।রামিম সাবিহাকে তার সিটে বসিয়ে নিজের সিটে চলে গেলো।

পরীক্ষা শেষে সবাই সাবিহাকে ঘিরে ধরলো।সাবিহা সবটা বললো।শুভ ফুয়াদের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো

-“দেখলি বেটার কি অবস্থা হয়েছিল?তবুও স্বীকার করবে না সাবিহাকে ভালোবাসে।এতো ইগো আসে কোথা থেকে?”

-“তোর যেখান থেকে আসে।তুই স্বীকার করেছিস?”

-“আমার ব্যাপার আলাদা।আরজু বন্ধুত্বের বাইরে আমাকে নিয়ে কি ভাবে সেটা আমি জানিনা।কিন্তু সাবিহা ওকে ভালোবাসে সেটা এই বেকুব ভালো করে জানে।সাবিহা না হয় মেয়ে হয়ে আগে কিছু বলতে পারছে না।কিন্তু এই বেকুবের সমস্যা কি?একদিন ওর কান বরাবর থাপড়াবো আমি।”

-“আমি ও কয়েকটা দিবো।ওকে প্লাস তোকে।”

রামিম নিজ দায়িত্বে সাবিহাকে তার বাসায় পৌছে দিয়ে গেলো। এই দায়িত্ববান মেয়েটা নিজের খেয়াল কেনো রাখে না?অথচ রামিমের প্রতিটি বিষয়ে সে কতটা যত্নশীল।

*******
শরতের এক উষ্ণ বিকেলে আরজু ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।আজ তিনদিন হলো তাদের ইয়ার ফাইনাল শেষ হয়েছে।এতদিন পড়ার চাপে নেতা সাহেবকে মিস করলেও আজ অনেক বেশি মিস করছে।অন্য কিছুর চাপ কম থাকলে এই নেতা সাহেবের ভুত তার মন, মস্তিষ্ককে আরো বেশি করে চেপে বসে।অনেক দিন হলো মানুষটিকে দেখেনি।বুকটা কেমন খা খা করছে।সে এমন একটি মানুষকে মন দিয়ে বসে আছে যার দেখা কালে ভদ্রেও পাওয়া যায়না।হুটহাট গায়েব হয়ে যায়।
নেতা সাহেব নাকি সমাজের সেবা করে।তবে কি সে সেই সমাজের মধ্যে পরে না?একটা মানুষের মুখোদর্শনে জন্য তার সেই সমাজের নিরীহ এক নারী ব্যাকুল হয়ে থাকে সেটা কি এই ভন্ড নেতা দেখে না?সমাজের সবার অসুবিধা,কষ্ট লাঘব করতে তার পার্টি সদা প্রস্তুত।কিন্তু এই নারীর মন যে কষ্ট আর বিষাদে ছেয়ে গেছে সেটা কি এই নেতা দেখে না?এমন ভন্ড নেতাকে তো মেয়রের পদ থেকে বহিস্কার করা দরকার।

আজকাল আরজু চিঠি দেওয়াও কমিয়ে দিয়েছে।সেই পাষাণ মানুষটি আদো তার চিঠি হাতে পায় কিনা কে জানে?হঠাৎ ফোনের শব্দে তার চিন্তার বেঘাত ঘটে।শুভ কল করেছে।আরজু রিসিভ করতেই বুজলো সে এখন কনফারেন্স কলে আছে।ফুয়াদ বললো

-“এই আরজু শোন।পরীক্ষার চিপায় পড়ে মাথা একদম ক্ষয় হয়ে গেছে।তাই আমাদের একটা রিফ্রেশমেন্ট দরকার।তাই আমি আর শুভ মিলে একটা প্ল্যান করেছি।”

-“কি প্ল্যান?”

শুভ বললো
-“সবাই মিলে একটা ট্যুর দিবো।”

আরজুর মন মুহূর্তেই উচ্ছ্বাসে ভরে উঠলো।বন্ধুদের সাথে ট্যুর মানেই হৈ হুল্লোর।চরম ঘুরাফেরা আর জম্পেশ খানাপিনা।সে বললো

-“যাবি কোথায়?”

শুভ বললো
-“সাজেক।”

শুভর কথা শুনে সবার মধ্যে উদ্দীপনা কাজ করলো।তবে রিমি চিন্তায় পড়ে গেলো।তার বাবা রাজি হবে কিনা সন্দেহ।জারা সান্তনা দিয়ে বললো সে কথা বলে পারমিশন নিয়ে দিবে।তার সৃজনশীলতা কবে কাজে আসবে?ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করতে সে উস্তাদ।তার মেজর বাপকে ঘোল খাইয়ে দিবে।তাছাড়া আরো মেয়েরা আছে জানলে নিশ্চই তিনি মানা করতে পারবে না।

জারা,আরজু ,সাবিহা সকলে মিলে সেই দিনই রিমির বাসায় হামলা দিলো।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন রিমির বাবাকে রাজি করানো যাচ্ছে না তখন রিমির ভাই নিশান বাবাকে বুজিয়ে বলে পারমিশন নিয়ে দেয়।রিমি খুশি হয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে।তার রোবট ভাই তাকে ভীষণ ভালোবাসলেও কখনোই সেটা প্রকাশ করতে চায়না।নিশান রিমির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-“অবশ্যই নিজের খেয়াল রাখবি।তোর চাইতেও অনেক ছোট বাচ্চারাও দেখলাম বন্ধুদের নিয়ে ট্যুরে চলে যায়।ওই সব বাচ্চারা কেয়ারলেস হলেও আমি জানি তুই যথেষ্ট ম্যাচিউর।”

রিমি পারমিশন পেতেই তাদের শপিংয়ের তোর জোর শুরু হয়ে যায়।অনেকদিন পর বন্ধুরা মিলে দূরে কোথাও যাচ্ছে।শপিং না করলে তো চলছেই না।

*********
বর্তমান সময়ে ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের মধ্যে সচাইতে জনপ্রিয় সাজেক।রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন হিসেবে খ্যাত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ১৮০০ ফুট।সাজেকের অবস্থান রাঙামাটি জেলায় হলেও ভৌগলিক কারণে খাগড়াছড়ির দিঘিনালা থেকে সাজেকের যাতায়াত অনেক সহজ।খাগড়াছড়ি জেলা থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার এবং দীঘিনালা থেকে ৪০ কিলোমিটার।

রাত বাজে পৌনে দশটা।কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে আছে ফুয়াদ।মেজাজ তার তুঙ্গে।বাস ছাড়বে দশটায়।অথচ একজনও বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছায় নি।একটুপর রামিম আসলো।আর বললো

-“হায় আল্লাহ আর সবাই কই?ভাবলাম আমিই সবার চাইতে লেট।কিন্তু ঢিলা কোম্পানিদের দেখি আমার চাইতেও খারাপ অবস্থা।”

ফুয়াদ রেগে বললো
-“শালার বেটা শুভ নিজে সব প্ল্যান করে নিজেই লেট।আসলে একটা উষ্ঠা দিবো আগে।”

-“আরে চটে যাচ্ছিস কেনো?দেখবি এসে পড়বে।”

রামিম বার বার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।সাবিহাকে নিজেই পিক করে নিয়ে আসতো।কিন্তু ওর বাবা তাকে বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে আসবে বলেছে।কিন্তু এত লেট কেনো করছে?”
ঠিক তখনই রিমি আসলো।সাথে তার বড়ো ভাই।ফুয়াদ নিশানকে দেখে রামিমকে বললো

-“এসে পড়েছে মেজর সাহেবের দুই নমুনা।”

রামিম চোখ পাকিয়ে তাকালে ফুয়াদ হালকা হেসে নিশানের সাথে হ্যান্ডসেক করলো।নিশান আসে পাশে তাকিয়ে বললো
-“কীরে রিমি তোর বাকি বান্ধুবীরা কোথায়?”

-“মে বি রাস্তায় আছে ভাইয়া।”

ফুয়াদ আবার ফিসফিসিয়ে বললো
-“দেখলি বেটা কেমনে ইনভেস্টিগেশন করছে?যেনো ওর বোনরে নিয়ে পাচার করে দিবো।পুরো পরিবার রোবট যন্ত্র ছিলো।এই রিমিকে আমরা ধরে বেধেই না মানুষ বানালাম।”

-“চুপ থাক।”

কিছুসময়ের মধ্যে আরজু আর শুভ চলে আসলো।তাদের সবাইকে দেখে বললো

-“সরি রে,একটু লেট হয়ে গেলো।”

ফুয়াদ বললো
-“একটু লেট?কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিতো।তখন বাসের পেছনে দৌড়াইতে দৌড়াইতে খাগড়াছড়ি যাস।”

সাবিহা কে তার বাবা নিয়ে আসলো।সাবিহাকে দেখেই রামিম মুগ্ধ হলো।ঢিলেঢালা টিশার্ট আর লেডিস জিন্স পরা এই মেয়েটাকে ভীষণ মিষ্টি লাগছে।সাবিহার সাথে চোখাচোখি হতেই সে চোখ নামিয়ে নিলো।তার নেশাময় দৃষ্টি আড়ালের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাবিহা লাজুক হাসলো।জারা পৌঁছালো একদম দশটা পাঁচ মিনিটে।ফুয়াদ রেগে বললো

-“আর এক মিনিট দেরি করলে এই আবালটারে রেখেই চলে যেতাম।”

জারা মুখ ভেংচি কেটে তার বাবার কাছথেকে বিদায় নিলো।জারার বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বার বার কপালে চুমু খেলেন।তাদের আহ্লাদ দেখে ফুয়াদ বললো

-“এইটার পুরো পরিবার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।দেখে মনে হচ্ছে শশুরবাড়ি যাচ্ছে।এদের আদিখ্যেতার জন্যই জারার এই অবস্থা।প্রয়োজনে সময় দুইটা ধমক দিলেই এই বাঁদর নেকার রাণী না হয়ে মানুষ হতো।”

রামিম বললো
-“আরে এতো চেটে যাচ্ছিস কেনো?মাথা ঠাণ্ডা রাখ।আর মেয়েরা বাবার আদুরে হয়ে থাকে।”

ফুয়াদের এই সব আদিখ্যেতা লাগছে।হয়তো হৃদয়ের কোথাও পুড়ছে।এমন ভালোবাসা যে সেও চায়।নিজের বাবা মায়ের কাছ থেকে একটু কেয়ার চায়।তার বাবা মাও তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলুক ‘ খবরদার বেশি ফাজলামো করবি না।নিজের খেয়াল রাখবি ‘ কিন্তু তাদের সময় কই? আজ ট্যুরে যাবে শুনেও তারা তেমন কোনো রিয়্যাক্ট করেনি।বরং বাবা তার ক্রেডিট কার্ডে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। একটাবার ‘সাবধানে যাস ‘ বলার সময় নেই।আর মা তো ভুলেই গেছে আজ তার বাস।

অবশেষে দেশ ট্রাভেলস এর বাসটি তাদের গন্তব্যের দিকে রওনা হলো।অনেকক্ষণ তারা বন্ধুরা মিলে হইহুল্লোড় করলো।গভীর রাত হতেই তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।ভোরের দিকে তারা পৌঁছালো খাগড়াছড়িতে।বাস থেকে নেমে হাই তুলতে তুলতে শুভর চোখ পড়লো আরজুর দিকে।আরজু তখনও ভালো করে চোখ খুলতে পারছেনা।তার আখিযুগল ঘুমের রেশ কাটাতে পারেনি।তাই অনেকটা ফুলে আছে।গায়ের টিশার্ট কিছুটা কুচকে আছে।আর আরজুর সেই আহ্লাদী অপভ্রংশে লাল আভা ছেয়ে গেছে।সিল্কি বাদামি বর্ণের কেশ অনেকটা এব্রথেব্র।শুভ আবারও প্রেমে পড়লো এই চিরচেনা নারীটির।আর কতবার এই নারীর প্রেমে মাতোয়ারা হতে হবে কে জানে?তবে সে মোটেও ক্লান্ত হবে না।

সবাই কিছুটা ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা করে নিলো।তারপর এলো শাপলা চত্বরে। এখান থেকে তারা চাঁদের গাড়ি করে যাবে সাজেক ভ্যালিতে।আজ তেমন একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে না।বেশির ভাগ বুক হয়ে গেছে।শুভ বললো

-“কি ঝামেলায় পড়লাম।গাড়ি না পেলে যাবো কি করে?”

ফুয়াদ বললো
-“আমি কি ভাবে বলবো।আগে আসছি নাকি?”

জারা মুখে বিরক্তি ভাব এনে বললো
-“এমন ফালতু প্ল্যান কে করেছে?গাড়ি আগে অনলাইন বুক করতে পারলি না?”

শুভ বললো
-“আরে মা!চাঁদের গাড়ি অনলাইন কেমন করে বুক করবো?এটা এখানে এসেই বুক করতে হয়।”

ঠিক তখনই সেখানকার স্থানীয় একজন বললো
এখানে গ্রুপে গাড়ি ভাড়া করা যায়।তারা চাইলে অন্য কোনো গ্রুপের সাথে শেয়ার করে গাড়ি নিতে পারে।শুভ বললো

-“রামিম,ফুয়াদ তোরা ওই দিকে দেখ কোনো ছোট গ্রুপ পাস কিনা।আমি এই দিকে দেখি।”

রামিম অনেক ক্ষন খোঁজার পর একজনকে দেখলো গাড়ির সামনে দাড়িয়ে করো সাথে কথা বলছে।লোকটিকে দেখে তার যথেষ্ট মার্জিত মনে হলো।সে এগিয়ে যেয়ে বললো

-“এক্সকিউজমি ভাইয়া!”

ছেলেটি পাশের মানুষটির সাথে কথা বলা থামিয়ে বললো
-“হে বলো।”

-“ভাইয়া আমরা গাড়ি পাচ্ছিনা।আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে সাজেক যাচ্ছেন।আমরা কি আপনাদের সাথে গাড়ি শেয়ার করতে পারি?”

ছেলেটা কিছুক্ষণ ভেবে বললো
-“কতজনের গ্রুপ তোমাদের?”

-“জি ভাইয়া আমরা সাত জন।”

-“আচ্ছা এসো। বাই দা ওয়ে আমি আসফি।”

-“আমি রামিম। নাইস টু মিট ইউ।”

রামিম দ্রুত চলে গেলো বন্ধুমহলের কাছে।রামিমের কথা শুনে সবাই সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।গাড়ির কাছে আসতেই দুইজন ছেলে ও দুইজন মেয়েকে দেখতে পেলো।তাদের দেখেই বেশ বুঝা যায় তারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য।অন্তত বেশভূষায় তো তেমনি লাগছে। আসফি তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে আরজুকে দেখে কিছুটা থমকালো।জারা মুচকি হাসলো। এ আর নতুন কি? তার লাবণ্যময়ী অতি সুন্দরী বন্ধুবিকে দেখে বেশিরভাগ ছেলেরাই থমকে যায়।

ওই গ্রুপে অন্যদের নাম অনিক,লিজা ও লাবণ্য। অনিক আর লিজা স্বামী স্ত্রী। এরা সকলেই তাদের বেশ সিনিওর।সকলের সাথেই তাদের কুশলাদি বিনিময় হলো। আসফি আশেপাশে তাকিয়ে বলে উঠলো

-“ওই শালা গেলো কই?ওর ফোন কলের যন্ত্রণায় পুরো ট্রিপ টাই মাটি হয়ে যাবে। এর কাজ কোনো দিনও শেষ হবে না।”

অনিক বললো
-“ও আসতে রাজি হয়েছে এটাই বেশি।নাহলে এসবের সময় কই ওর কাছে।”

ফুয়াদ ব্রু জোড়া কুচকে বললো
-“কার কথা বলছেন ভাইয়া?”

-“আমাদের আরেক ফ্রেন্ডের কথা বলছি।বেটা আসলেই চমকে যাবে।”

কথাটা বলেই আরজুর দিকে তাকালো।জারা রিমিকে খোঁচা মেরে বললো
-“বুঝলী এই বেটা আরজুকে দেখে কাইত হয়ে গেছে।বার বার কেমন করে তাকায়।আজ আমাদের সিনিওর সাঈদ ভাইকে মিস করছি।ওই খামব্বা থাকলে কেউ আরজুর দিকে নজর দেওয়ার সাহস পায়না।আফটারল বেচারা আরজুর ধর্মের ভাই।”

শুভ কৌতহল নিয়ে বললো
-“চমকে যাবে কেনো?”

আসফি মুচকি হেসে বললো
-“ওতো জানেই না আমরা এতগুলো কিউট কিউট ছেলে মেয়েদের সাথে যাচ্ছি।ঐতো আসছে।”

সবাই সেদিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো।একজন ব্যাক্তি ফোন কথা বলতে বলতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।ব্যাক্তিটির দিকে চোখ পড়তেই আরজু চমকালো।তার বুকের ধুক ধুকানি বাড়তে লাগলো।তার দৃষ্টি কিছুতেই সংযত করতে পড়ছে না।সে পাশে দাড়ানো জারার হাত চেপে ধরলো।নাহলে হয়তো সে মাথা ঘুরে পড়ে যেতো।আরজু ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো।সেই নিঃশ্বাস জানান দিচ্ছে তার হৃদস্পন্দনের গতিবিধি।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_15

পূর্ব আকাশে মেঘ জমেছে।চারিদিকে বহিছে স্নিগ্ধ হাওয়া।চারিপাশে সবুজের সমারোহ।দুর দূরান্তে ছোট ছোট পাহাড়ের দেখা মিলছে।যেখানে খেলা করছে মেঘরাশী।খাগড়াছড়ির বাতাসে রয়েছে বিশুদ্ধতার ছোঁয়া।সরু পথ দিয়ে এগিয়ে চলছে আরজুদের চাঁদের গাড়ি।পাহাড়ের আকা বাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে চলছে তাদের গাড়ি।আরজু মুগ্ধ হয়ে দেখছে প্রকৃতিকে।দুই রাস্তার ধরে নানান প্রজাতির গাছগাছালি।আসলেই আল্লাহর সৃষ্টি অদ্ভুত সুন্দর।বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মিষ্টি সুভাষ।আরজুর মনে হচ্ছে এই সুভাষ বাতাসের না বিশেষে করো কাছ থেকে আসছে।যা আরজুকে মাতাল করে তুলছে।

আরজু আড়চোখে সামনে বসা মানুষটির দিকে তাকালো।চোখে সানগ্লাস পরা এই মানুষটি আরজুর চোখে পৃথিবীর একমাত্র সুদর্শন পুরুষ।যার চোখে সমুদ্রের মতো গভীর মায়া কিন্তু মুখে রয়েছে রাজ্যের গম্ভীরতা।এই মানুষটিকে দেখলেই আরজুর শরীর ঝিমঝিম করে।মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তারা ভর করে।

তখন নাহিদ গাড়ির সামনে এসে দাড়াতেই আরজুর ঘোর কাটে।মানুষটি কেমন তীক্ষ্ণ নজরে তার দিকে তাকিয়েছে।পরমুহূর্তেই আবার চোখ সরিয়ে নিয়েছে।কিন্তু এই জায়গাতে আরজু কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা পাবে ভাবতেই পারেনি।জারা আরজুর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো

-“আমার হাত ছার বেকুব।তোর নেতা সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাক।তবুও আমার হাতকে রেহাই দে।”

আরজু জারার হাত ছেড়ে দিলো।বাকি সবাই নাহিদকে এই জায়গায় দেখে বেশ অবাক হলো।এমন গণ্যমান্য ব্যাক্তি তাদের চলার সঙ্গী হবে ভাবতেই অবাক হচ্ছে।সবাই আরজুর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।বেচারীর অবস্থা দেখে সবাই মুচকি হাসছে।

শুভ একবার আড়চোখে আরজুর দিকে তাকালো।নিজের সো কল্ড ক্রাশ কে দেখে নিশ্চই আকাশে উড়ছে।আরজুকে নাহিদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভর ভেতরে অদ্ভুত যন্ত্রণা হলো।তার মন চাইছে আরজুকে বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে। যাতে করে দুনিয়ার বৃথা মায়ায় না জড়িয়ে পরে এই ইমোশনাল ফুল মেয়েটা।শুধু তার হৃদস্পন্দন মেপে দেখুক এই মেয়েটা তবে বুজবে আরজু নামটি কত সহস্রবার উচ্চারিত হয়।

নাহিদ আরজুকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আসফিকে যাবার তারা দিলো। আসফি মুচকি হেসে নাহিদের সাথে সকলের পরিচয় করালো।নাহিদ সভাব সুলভ গম্ভীর স্বরে বললো

-“হে মনে পড়েছে।আমাদের ক্যাম্পাসে অনেক আগে দেখেছিলাম মনে হয়।কিন্তু তেমন পরিচয় নেই।”

আরজু অবাক হলো।কয়েকদিন আগেও লোকটি তার নাম মনে রেখেছিল।আর আজ কিনা তাকে চিনতেই পারছেনা?এই লোকটির কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়ে মাথায় আঘাত পায়নি তো? বা সর্ট টাইম মেমোরি লোসের মতো কান্ড ঘটেনি তো? না! এমন হলে নিউজে নিশ্চই খবর আসতো।

চাঁদের গাড়িটি চলছে আপন গতিতে।জারা ক্যামেরায় সব সুট করছে।মূলত সে তার রেগুলার লাইফ ব্লগের জন্য ফুটেজ নিচ্ছে।ফুয়াদ বেশ বিরক্ত জারার উপর।জারার সোসিয়াল মিডিয়াতে এতো বেশি এক্টিভ থাকা আর ডেইলি ব্লগিং ফুয়াদের একদম পছন্দ না।এতে করে পার্সোনাল লাইফ বলতে কিছুই থাকে না।জারা যখনই স্মাইল করতে বলছে ফুয়াদ মুখ ভেংচি কাটছে।

সাবিহা বেশ ভয়ে আছে।উচু নিচু পাহাড়ের পথ বেয়ে চলা গাড়ির ঝাঁকুনিতে সে বেশ ভয় পাচ্ছে।বার বার তার পাশে বসা রামিমের হাত চেপে ধরছে।এই বুজি গাড়ি থেকে ছিটকে পরে যাবে।আর রামিম ও পরম যত্নে সাবিহার হাতে নিজের হাত জোড়া মিলিয়ে দিয়েছে। রামিমের কাছে মনে হচ্ছে এই রাস্তা যদি কখনো না ফুরাত তবে বেশ ভালো হতো।সকল কঠিন বাস্তবতাকে দূরে ফেলে সে অনন্তকাল এই হাত জোড়া শক্ত করে ধরে দূরে পাড়ি জমাতো।

জারা আরজুর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।নেতা সাহেবের সামনে বসে তার প্রিয় বান্ধবী বেশ অসস্তিতে আছে সেটা সে বেশ বুঝতে পারছে।জারা এবার নাহিদের দিকে তাকালো।লোকটি দেখতে নিঃসন্দেহে সুদর্শন।তবে লোকটির ভাব অনেক বেশি।মুখে যেনো হাসির রেশ মাত্র নেই।এই গম্ভীর লোকটির চোখে নিশ্চই সমস্যা আছে।নাহলে আরজুর মতো এমন ভয়ঙ্কর সুন্দরী মেয়েকে কি করে পাত্তা দেয় না?আরজুকে দেখে সে নিয়েই মাঝে মাঝে চোখ ফেরাতে পারে না।সেখানে এই লোকটি আরজুকে ইগনোর করছে।অথচ তার প্রাণ প্রিয় বন্ধুবী এই গুমরা মুখো লোকটিকে ভালোবেসে ঝাঁজরা হয়ে যাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষন পর তাদের গাড়িটি থামায় একটি চায়ের দোকানে।দোকান বললে ভুল হবে। বাঁশের বেড়া দেয়া মাচার মধ্যে বসে চা বিক্রি করছে।লোকটি সম্ভবত এখানকার স্থানীয় হবে।

সকলেই নেমে দাড়ালো।আশেপাশের পরিবেশ বেশ মনোমুগ্ধকর।এই আবহাওয়ায় দাড়িয়ে বেম্বো টি খাওয়ার অনুভূতিটাই অন্য রকম।খোলা আকাশের নিচে গরম চা ভাবতেই মন আনন্দে ভরে উঠে।

শুভ সবার জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে আশেপাশের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে লাগলো।হঠাৎ তার ক্যামেরা পড়লো আরজুর দিকে।বাতাসে এলোমেলো হওয়া চুলের মাঝে আরজুর স্নিগ্ধ মুখখানা ভীষণ মায়াবী লাগছে।আরজু এক হাতে চুল সরাচ্ছে আর চায়ে ফু দিয়ে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে।শুভ ঝটপট এই সুন্দর মুহূর্তটি ক্যাপচার করে নিলো।
আরজু চায়ে চুমুক দিতে দিতে আড়চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।নাহিদ লাবণ্য মেয়েটির সাথে কিছু বলছে আর চায়ে চুমুক দিচ্ছে।হঠাৎ তাদের চোখাচোখি হয়ে যায়।নাহিদের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়তেই অসাবধানতায় গরম চায়ে তার জিহবা পুড়ে যায়।আরজু ভাবছে এই লোকের তার অন্তর কে জ্বালিয়ে স্বাদ মেটেনি। এখন ঠোঁট ও জ্বালিয়ে ছাড়লো।আরজু নাক মুখ কুচকে ‘ আহহ ‘ শব্দ করে উঠে।তাৎক্ষণিক শুভ দৌড়ে আসে আরজুর কাছে আর অস্থির হয়ে বলতে থাকে

-“গরম চা দেখে খাবিনা?ঠোঁট তো পুড়িয়ে ফেলেছিস।এই রিমি পানি দে।”

রিমি দ্রুত ব্যাগ থেকে পানি বের করে দিল।শুভ দ্রুত পানি নিয়ে আরজুকে বললো
-“ঝটপট পানি খেয়ে নে।আর কিছুক্ষণ কুলি কর।”

আরজু তাই করলো। এক্ষন মনে হচ্ছে জ্বালাপোড়া কম হচ্ছে।শুভ মুখটা মলিন করে বললো

-“কীরে বেশি জ্বলছে?’

-“এতো অস্থির হচ্ছিস কেনো?সেই ছোটবেলার অভ্যাস একটুও বদলায়নি।আমি ঠিক আছি।হাইপার হওয়ার কিছু নেই।”

আরজু আবার নাহিদের দিকে তাকালো।সে রাস্তার ওপারে তার বন্ধুদের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত।অকারনেই আরজুর মন খারাপ হয়ে গেলো।মানুষটি কি একবার তার অবস্থা জিজ্ঞেস করতে পারলো না?

******
লাবণ্য চা খেতে খেতে আরজুর দিকে তাকিয়ে বন্ধুদের উদ্দেশে বললো

-“শুভ ছেলেটা আর ওই আরজু মেয়েটা কি গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড?”

আসফি কপাল কুচকে বললো
-“ওরা তো বললো সবাই ফ্রেন্ড।কিন্তু তোর এমন মনে হলো কেনো?”

লাবণ্য আবার চায়ে চুমুক দিয়ে বললো
-“না এমনি মনে হলো।ছেলেটা মেয়েটার প্রতি বেশ কেয়ারিং।আর মেয়েটা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর।আমি আমার লাইফে এতো সুন্দর মেয়ে আর একটাও দেখিনি।”

আসফি শব্দ করে হাসলো।আর বললো
-“তুই কি কম সুন্দরী নাকি?ভার্সিটিতে তোর পেছনে ছেলেদের লম্বা লাইন থাকতো।”

লিজা হেসে বললো
-“যাই বলিস!আমি মেয়ে হয়েও চোখ ফেরাতে পারছি না।”

অনিক সম্মতি সূচক বললো
-“ঠিক বলেছো।সব গুলো মেয়েই সুন্দরী আর বেশ স্মার্ট।”

লিজা বাঁকা চোখে অনিকের দিকে তাকালো।অনিক এবার কিছুটা ঘাবড়ে গেল।লিজা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো

-“মেয়ে দেখলেই তোর মাথা ঠিক থাকে না তাই না?আর একবার যদি মেয়ে গুলির দিকে তাকিয়েছিস চোখ একদম গেলে দিবো।”

-“আরে সোনা রাগ করছো কেনো?আমার চোখে সবচাইতে সুন্দরী নারী তুমি।তাইতো তুমি আমার বউ।এতো কাঠখড় পুড়িয়ে কি এমনি এমনি শশুর মশাইকে রাজি করিয়েছি?”

লিজা রেগে বললো
-“একদম নাটক করবে না।তুমি কচু করেছো।নাহিদ বাবাকে রাজি না করালে তোমার মতো বেকার ছেলের কাছে আমার বাবা কোনো দিনও বিয়ে দিতো না।”

নাহিদ বিরক্ত হয়ে ধমকে বললো
-“এই কি শুরু করেছিস তোরা?ঘুরতে এসেও তোদের ওয়ার থামে না।তোদের এই ঝগড়া দেখতে সব কাজ ফেলে আমি এসেছি এই ট্রিপে?”

লাবণ্য হেসে বললো
-“এই তোরা ঝটপট বেবি নিয়ে নে।তখন আর ঝগড়া করার সময় পাবি না।বাচ্চার পটি পরিষ্কার করতে করতে দিন যাবে।”

লিজা রেগে বললো
-“ইম্পসিবল।এই এক গাধাকে সামলাতেই আমার জান শেষ তখন আবার গাধার বাচ্চাকে সামলাতে হবে।”

-“এই কি বললি?আমার বাচ্চাকে গাধার বাচ্চা বললি কোন সাহসে?আমার বেবিকে নিকে কিছু বলবি না।”

নাহিদ কপাল কুঁচকে বললো
-“এরা কি এখন না হওয়া বাচ্চা নিয়েও ঝগড়া করবে?সিরিয়াসলি?”

আসফি হেসে বললো
-“তুইও বিয়ে করে ফেল। দেখবি আরো কতো কিছু নিয়ে ঝগড়া করা যায়।”

-“এইসব বিয়ে,সংসার আমার দ্বারা হবে না।এসবের জন্য আমার সময় নেই।আমাকে কিছুতেই লক্ষ্যচ্যুত হওয়া যাবে না।”

মুহূর্তেই লাবণ্যর মন খারাপ হয়ে গেলো।নাহিদকে সে ভার্সিটি লাইফ থেকেই পছন্দ করে।এতো বছর পর কানাডা থেকে সে ফিরে এসেছে শুধু মাত্র নাহিদের জন্য।কিন্তু আগে থেকেই নাহিদের হৃদয় ঘটিত ব্যাপারে ছিলো ব্যাপক অনীহা।সে তখন পুরোদমে পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েছে।মিটিং,মিছিল,হরতাল,পার্টি অফিস এসব নিয়ে সে ছিলো ভীষণ ব্যস্ত।রাজনীতি তার জন্য পেশন।নাহিদের রক্তে মিশে আছে রাজনীতি।মানুষের সেবা করার অদম্য ইচ্ছাশক্তি তার প্রথম থেকেই ছিলো।তাই তো আজ এই অব্দি আসতে পেরেছে।আর লাবণ্যও হায়ার স্টাডির জন্য কানাডা পারি জমিয়েছে।নাহিদকে সে কখনোই নিজের মনের কথা বলতে পারেনি।

চা শেষ করতেই নাহিদের ফোন বেজে উঠলো।স্ক্রিনে নামটি দেখে সে ফোন কেটে দিলো।তখনই আবার ফোন বেজে উঠলো।নাহিদের চোখে মুখে বিরক্তি।সে কল রিসিভ করতেই নাঈম মাহমুদ ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠলেন

-“নাহিদ কোথায় আছো?”

-“আপনি জেনে কি করবেন?”

-“সিকিউরিটি ছাড়া তুমি সাজেক কেনো গেলে?জানোনা যে কোন বিপদ হতে পারে?”

-“আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি।”

-“কি খেয়াল রাখবে তুমি?রাজনীতিতে নেমে হাজারো শত্রুর জন্ম দিয়েছ।এতই যখন লাইফ এনজয় করতে চাও তবে এই রাজনীতি ছাড়ছ না কেনো?”

নাহিদ সামনে তাকিয়ে বললো
-“আমার পছন্দের জিনিস গুলোকে আমি ছার দিয়েই রাখি।কিন্তু সেটা যদি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠ ধরে বা আঘাত করে তবে এই নাহিদ প্রাণ থাকতে সেটাকে হাতছাড়া করে না।”

নাঈম মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।এই ছেলেকে কিছুতেই তিনি বুঝাতে পারবে না।হাজারো শত্রুর মাঝে এই ভাবে গার্ড ছাড়া বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরিয়ে পড়াটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ না।একরোখা এই ছেলেটা একমাত্র তার দাদাজানের সকল আদেশ মান্য করতো।কিন্তু আজ তিনি বেচেঁ নেই।তাইতো ছেলেটাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।কে থামবে তাকে?

**********
মেঘের রাজ্য সাজেক। এখানে দাড়িয়ে মেঘকে ছুঁয়ে দেয়া যায়।যেনো স্বর্গীয় অনুভুতি হয় মেঘের রাজ্যে।পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত রিসোর্ট সারি সারি করে দাড়িয়ে আছে।সেখানকার একটি রিসোর্টে তারা পৌঁছালো।সবাই আশেপাশের সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। ফুয়াদ তিনটি রুমের চাবি নিয়ে এসে বললো

-“রুম রেডি চল।”

একটিতে শুভ,রামিম ও ফুয়াদ থাকবে।বাকি দুইটির একটিতে আরজু ও জারা।আর অন্য রুমটিতে থাকবে রিমি ও সাবিহা। তারা সকলেই রুমে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলো।জারা তো গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলো।আরজু গোসল সেরে বারান্দায় এসে দাড়ালো।দূরে রাশি রাশি পাহাড় ও মেঘের মেলা চলছে।তার অবস্থান ঠিক মেঘের উপরে।আরজু যেনো হারিয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্যের ভিড়ে। সে চোখ বন্ধ করে মন ভরে নিঃশ্বাস নিলো। বিশুদ্ধ, স্নিগ্ধ হাওয়া।আরজুর ভাবনার রেশ কাটলো কারো গম্ভীর রাগী শব্দে।সে পাশের বারান্দায় তাকালো।আর কিছুটা চমকালো।নাহিদ ফোন কারো সাথে কথা বলছে।আসলে ঝাড়ি দিচ্ছে।

-“আচ্ছা বিষয়টা আমি এসে দেখছি।ওই শালার হাত পা ভেঙে হসপিটালে ফেলে আসবো।আমার সাথে খেলতে আসছে?আমি অনেক পুরনো খেলোয়াড়।আমাকে এখনো চিনেনা ভালো করে।”

নাহিদ কথাগুলো বলতে বলতে চোখ পড়লো আরজুর দিকে।আরজু চোখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।নাহিদ দৃষ্টি স্থির রেখে বললো

-“আচ্ছা আমি এই বিষয়ে পড়ে কথা বলছি। বায়।”

কল কেটে নাহিদ আরজুকে উদ্দেশ্য করে বললো
-“অন্যের বারান্দায় এই ভাবে উকি ঝুকি দেওয়া ঠিক না।পড়ে দেখা গেলো সামনের গভীর খাদে পড়ে গেলেন।সেখান থেকে উঠা আর সম্ভব হবেনা।”

কথাটি বলেই মুচকি হেসে রুমের ভেতরে চলে গেল।আরজু হা করে তাকিয়ে আছে।এই ইতর প্রজাতির প্রাণীর প্রেমে সে কেনো পড়লো?আরজু একবার নিচের দিকে তাকালো।আসলেই গভীর খাদ। এখান থেকে বেচেঁ ফেরা অসম্ভব।আরজু ভয়ে বুকে ফু দিলো।

**********
জারা ঘুমের মাঝে অনুভব করলো কেউ তাকে ঝাপটে ধরে আছে।তার কানে ফিসফিসিয়ে বলছে
-“অসভ্যতামো কি করে করতে হয় জানেন জারা?”

বলেই জারার জবাবের অপেক্ষা করলনা।জারার চিবুকে অনবরত চুমু খেতে লাগলো কেউ।জারা চোখ মেলে জাহিদ কে দেখে তাকে সরানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু জাহিদ তার ওষ্ঠের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।জারা ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো

-“বদমাইশ ছেলে আজ তোর ঠোঁট কেটে রেখে দিবো।”

হঠাৎ জারার দেখলো জাহিদ তাকে ছুড়ে গভীর খাদে ফেলে দিয়েছে।আর সে পাহাড়ে না পড়ে সোজা সমুদ্রে ভাসছে।জারা লাফ দিয়ে উঠে বসলো।সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা সাদা ঢিলেঢালা শার্ট ও লেডিস জিন্স পড়ে সামনে দাড়িয়ে আছে আরজু।আরজুর হাতে গ্লাস দেখে সে বুঝতে পারলো সে আসলে সমুদ্রে ভাসেনি ভেসেছে গ্লাসের পানিতে।জারা চোখ মুখ কুচকে মুখের পানি হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বললো

-“এই ভাবে কেউ ঘুম থেকে তুলে?পানি মারলি কেনো?”

আরজু প্যান্টের পকেট এ দুই হাত রেখে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো
-“কতবার ডেকেছি খবর আছে? বাই দ্যা ওয়ে কোন বিশেষ ইন্টিমেট স্বপ্ন দেখছিলি নাকি? মানে চুমু ঘটিত কোন ব্যাপার নাকি?”

জারা থতমত খেয়ে গেলো।আসলেই সে এমন কিছুই দেখছিলো। শয়তান ছেলেটা তার মাথায় জেকে বসে আছে।সে দৃষ্টি আড়াল করে বললো

-“আজাইরা কথা কম বল।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

আরজু খাটে বসে পায়ে স্নিকার্স পড়তে পড়তে বললো
-“জলদি রেডি হো।সবাই বাইরে ওয়েট করছে।আমি বাইরে যাচ্ছি।”

-“আচ্ছা যা।”

আরজু রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে দাড়ালো।মেঘলা আকাশ।ঠান্ডা পরিবেশ।আরজু পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো এক জোড়া কাপল পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছে।আরজু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।কোনোদিন কি ভালোবাসার মানুষটির হাতে হাত রেখে হাঁটতে পারবে?মানুষটি যে তাকে মোটেও পছন্দ করেনা।অথচ সবাই বলে তাকে দেখে সব ছেলে থমকে যায়।সব মিথ্যা।নাহলে সে যেই মানুষটিকে মন দিয়ে বসে আছে সে কেনো তার দিকে ফিরেও তাকায় না?

বন্ধুমহলের সকলেই বসেছে একটা রেস্টুরেন্টে।পাহাড়ের উপর বসে মেঘরাশী দেখতে দেখতে খাবে তারা।নানান পদের ভর্তা, মিক্স সবজি, ব্যাম্বু চিকেন অর্ডার করেছে তারা।রিমি ব্যাম্বু চিকেন দেখে বললো

-“সারাজীবন পরীক্ষার বাঁশ খেয়ে আজ সত্যি সত্যি বাঁশ খেতে হচ্ছে।”

ফুয়াদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো
-“প্যারা নাই চিল মার। জীবনে কতবার বাঁশ খাইতে হবে। আজ সত্যি সত্যি বাঁশ খাইয়া দেখ। অবশ্য বাঁশ তো খাওয়া লাগছে না খাবি তো বাঁশের ভিতরের চিকেন।”

শুভ বললো
-“রিমি খেয়ে দেখ।বেশ মজা পাবি। এখানকার বেশ পপুলার খাবার এটা।”

সাবিহা খুঁতখুঁতে ভাব নিয়ে বললো
-“এই বাঁশের ভেতরে চিকেন সেদ্ধ হয়েছে কিনা কে জানে?”

রামিম আশ্বস্ত করে বললো
-“কি বলিস চিকেন কেনো খাসি সুদ্য সেদ্ধ হয়ে যায়।”

-“তবুও আর বাঁশ ভালো করে পরিষ্কার করেছে কিনা কে জানে?না জানি কোন জঙ্গলের বাঁশ।পোকা মাকড় সাপ কতো কিছু আছে।”

ফুয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো
-“এই আজকে কি তোকে জারার ভূতে ধরছে?ওর ধাচের কথা বলছিস কেনো?”

জারা ক্ষেপে গিয়ে ক্যামেরা নামিয়ে বললো
-“একটা উষ্টা খাবি ছাগল। আমার পিছে না পড়লে তোর পেটের ভাত হজম হয়না?”

-“ভাত হজম হবে কেমন করে? পেটে ভাত তো এখনো পরেই নি।তোর গভীর নিদ্রা আর সাজুগুজোর যন্ত্রণায় লাঞ্চের এত দেরি হল।”

জারা ওয়েটারকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে বললো
-“ওই যে খাবার চলে আসছে। এবার গলা পর্যন্ত গিলতে থাক।”

-“গিলবোই তো। তোর মতন না খেয়ে না খেয়ে ডায়েট করবো নাকি?”

রামিম দুজনকে ধমকে থামালো।আর বললো
-“তোরা দুইটা যদি এখানে এসেও ঝগড়া লাগিস তবে একটা লাথি দিয়ে এই পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে দিব।”

জারা মুখ ভেংচে খেতে মনোযোগ দিলো।শুভ আরজুকে দেখে বললো
-“অনেক ঝাল আছে।খেতে পারবি?নাকি অন্য কিছু অর্ডার করবো।”

আরজু খাবার মুখে পুরে বললো
-“আরে না।চিকেন টা বেশ মজা। আই লাইক ইট।”

রিমি শুভর দিকে তাকালো।শুভ আরজুর কতটা খেয়াল রাখে।অথচ রিমিও তেমন একটা ঝাল খেতে পারেনা।কিন্তু এই জিনিসটি শুভ কখনোই লক্ষ করেনি।রিমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ভালোবাসা জিনিসটি বড্ডো অদ্ভুত।মানুষ ভালোবাসার মানুষটির সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি আশা করে।তবে আরজুকে নিয়ে তার মনে কোনো বিদ্বেষ নেই।কারণ আরজুর সবচাইতে খারাপ সময়ে শুভ ছায়ার মতো আরজুর পাশে ছিলো।সেই ছোটবেলা থেকে এক সাথে বড়ো হয়েছে।কাজেই তাদের বন্ধুত্ব গভীর হবে এটাই স্বাভাবিক।আরজুর পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে সবটাই সে জানবে।রিমির সাথে তো ততটা সময় কাটাইনি যে তার অভ্যাস সম্পর্কে ধারণা হবে।রিমি আরজুর দিকে তাকালো।এই মিষ্টি মেয়েটা বাবা মাকে হারালেও অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে।সবচাইতে বড় কথা শুভর মত একজন সত্যিকারের বন্ধুকে পেয়েছে।

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_16

মেঘের রাজ্যে সাজেক।এই রাজ্যে যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু পাহাড় আর মেঘের মিলনের দেখা মেলে।মনোরম এই পরিবেশে এসে রিমি বার বার বিমোহিত হচ্ছে।আগে কখনোই বন্ধুদের সাথে এই ভাবে ট্যুরে তার আসা হয়নি।প্রকৃতির এতো রূপ আছে আজ না আসলে জানতেই পারতো না।নিয়মের বেড়াজালে ভেদ করতে পেরে সে আজ আনন্দিত।বন্ধুমহলের সকলে দুপুরের লাঞ্চ শেষ আশেপাশে ভিউ এনজয় করলো।শুভকে দিয়ে মেয়ের দল বেশ কিছুক্ষন ফটোশুট করলো।সাথে ফুয়াদ আর রামিম যোগ দিলো।শুভ সকলকে তাড়া দিয়ে বললো

-“আর ছবি তুলতে পারবো না। এখন নেক্সট ডেস্টিনেশনে যেতে হবে।”

আরজু কৌতুহলী হয়ে বললো
-“এখন কোথায় যাব?”

ফুয়াদ হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললো
-“কংলাক পাহাড়ে যাবো সূর্যাস্ত দেখতে।অনেকেই সেখানে সূর্যোদয় ও দেখতে যায়।কিন্তু আমরা কাল সময় পাবো না।সূর্যোদয় দেখবো হেলিপ্যাডে বসে।”

সবাই দ্রুত সেদিকেই রওনা দিলো।পাহাড়ের মাঝে বেয়ে চলা কাচা রাস্তা দিয়ে তাদের চাঁদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে।তারা সকলেই গাড়িতে বসে হৈ হুল্লোর করছে।অনেক দূর যাওয়ার পর তারা গাড়ি থেকে নামলো। এখান থেকে বিশ পঁচিশ মিনিট ট্রেকিং করে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে।পাহাড়ের উচ্চতা দেখে জারা ঘাবড়ে গেল।আর বললো

-“এতো উচু পাহাড়ে উঠবো কি করে?”

শুভ হেসে বললো
-“কেনো তোর জামাইয়ের কোলে চরে।”

জারা বিরক্ত হয়ে বললো
-“শালা জামাই পাবো কই?অবশ্য আগে জানলে চিরুনি তল্লাশি করে জামাই খুঁজে নিয়ে আসতাম।”

রামিম বললো
-“সুন্দরী মেয়েদের জন্য ছেলের অভাব আছে নাকি।তুই ইশারা দিলে দেখবি এইখানকার আদিবাসী লুঙ্গি পরা ছেলেরা অব্দি দৌড়ে চলে আসবে।এদের পাহাড়ে চরার অভ্যাস আছে।তোর মতো শুটকি মাছকে দেখবি কোলে করে পাহাড়ে উঠাবে।”

-“কোনো দরকার নেই আমার লুঙ্গি পরা আদিবাসীদের কোলে চরার।তবে তোর ইচ্ছা থাকলে সাবিহাকে কোলে করে নিয়ে উঠতে পারিস।দেখ বেচারি বেশ ভয়ে আছে।”

রামিম সাবিহার দিকে তাকালো।মেয়েটা আসলেই কিছুটা ভয়ে আছে।তবে পার্পেল টপস আর টাইট জিন্স প্যান্টে মেয়েটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।ঠিক মেঘের রাজ্যের পরীর মতো।না! ভীতু পরীর মতো।

সাবিহা জারার কথায় কিছুটা লজ্জা পেলো।মিনমিনে বললো
-“আমি মোটেও ভয় পাচ্ছিনা।তোরা সবাইতো পাশেই আছিস।”

শুভ বললো
-“আগে চল লাঠি বা বাঁশ কিনে আনি।ট্র্যাকিংয়ে সুবিধা হবে।”

তারা সকলেই হাতে লাঠি নিয়ে ট্র্যাকিং শুরু করলো।মিনিট পাঁচেক যেতেই আরজুর চোখ পড়লো সামনের গ্রুপের দিকে।সেই গ্রুপের একজনকে আরজু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।হোয়াইট টিশার্ট এর উপর ব্ল্যাক জেকেট পরিহিত মানুষটিকে আরজুর মারাত্মক সুদর্শন লাগছে।মানুষটিকে সব সময় সাদা পাঞ্জাবি বা উপরে মুজিব কোট পড়া দেখে অভ্যস্থ সে।আজ এই পুরুষের সৌন্দর্যে চোখ ঝলসে যাবে তার।আরজুর বুকের ধকধকানি বেড়ে গেলো।জারা তার পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বললো

-“এবার তো চোখ নামা ছেমরি।চোখ দিয়ে গিলে খাবি নাকি?তোর এই কুদৃষ্টির কবলে পড়ে একদিন নেতা সাহেব ঝলসে যাবে।”

-“আমার দৃষ্টিকে তুই কুদৃষ্টি বলছিস?”

-“অবশ্যই।এই নেতাকে দেখে তোর মনে কি কি কুমন্ত্রণা চলে আমি জানিনা ভেবেছিস?”

আরজু কপট রেগে বললো
-“বাজে কথা বলবি না।আমাকে তোর ইফটিজার মনে হয়?”

-“তুই তো তার চাইতেও ভয়ঙ্কর।”

আরজু রেগে আর জারার সাথে কথা বললো না।এই মুহূর্তে সে মোটেও ঝগড়া করার মুডে নেই।আরজু সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।ফুয়াদ আসফিকে দেখে বললো
-“আপনারা এইখানে দাড়িয়ে পড়েছেন যে?উপরে যাবেননা?”

আসফি মলিন মুখে জবাব দিলো
-“আমাদের লেডিস গণ পাঁচ মিনিট ট্র্যাকিং করেই মহা টায়ার্ড হয়ে পড়েছেন।তাই বিরতি নিয়েছি।”

ফুয়াদ হাসলো।তার হাসি দেখে লাবণ্য কিছুটা বিরক্ত হলো।জুনিয়রদের সামনে তাদের প্রেস্টিজ পাঞ্চার করে ছাড়বে এই ছেলে।সে বসা থেকে দাড়িয়ে বললো

-“আমরা মোটেও টায়ার্ড না।এই লিজা উঠ তো।”

অনিক লিজার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।লিজা হাত না ধরেই উঠে দাড়ালো। কড়া চোখে অনিকের দিকে তাকালো।তাদের মধ্যে ঝগড়া চলছে। বিশাল ঝগড়া।না চাইতেও আবার টেকিং শুরু করলো তারা। এর মাঝে আরজুর সাথে নাহিদের একবার চোখাচোখি হলো।কিন্তু নাহিদ বরাবরের মতো তাকে অগ্রাহ্য করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।

সরু পাহাড়ের রাস্তা ধরে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি হওয়ায় মাটি অনেকটা ভেজা আর পিচ্ছিল।রামিম সাবিহার হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।এই মেয়ের বিশ্বাস নেই।যখন তখন পিছলে পাহাড় থেকে পড়ে যেতে পারে।সাবিহা মনে এক আকাশ সুখ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।কারণ সবচাইতে নিরাপদ হাত তাকে শক্ত করে ধরে আছে।তার আর কিসের চিন্তা?

আরজু অনেকটা হাপিয়ে উঠছে।সে কয়েক সেকেন্ড দাড়াতেই পেছন থেকে কেউ একজন পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো
-“আই থিঙ্ক ইউ নিড দিস।”

আরজু পেছন ঘুরে দেখলো নাহিদ।সে কিছুটা চমকে গেলো। গালের খোঁচা খোঁচা দারিতের ভীষণ কিউট লাগছে তাকে।আরজুর ইচ্ছা জাগলো একটু ছুঁয়ে দিতে।তবে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা হাতে সে বোতলটি নিয়ে ডক ডক করে পানি পেটে চালান করলো।বোতলের ঢাকনা লাগাতে যেয়ে খেয়াল করলো তার ঠোঁটের লিপস্টিক বোতলে লেগে আছে।সে অসহায় ভাবে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো

-“সরি।আমি ভুল করে বোতলে মুখ লাগিয়ে ফেলেছি।”

নাহিদ কিছুই বললো না।শুধু আরজুর হাত থেকে বোতলটি চট করে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।আরজু হা করে সে দিকে তাকিয়ে রইলো।উনি কি রাগ করলেন কিনা কিছুই সে বুঝতে পারলো না। এবার আরজু নিজের উপর বিরক্ত হলো।মানুষটি যেচে তাকে উপকার করতে আসলো আর সে কিনা লোকটির বোতলে মুখ লাগিয়ে দিলো।রাগ করাটাই স্বাভাবিক।নিমিষের আরজুর মন খারাপ হয়ে গেলো।

অনেক কষ্টে তিরিশ মিনিট পর তারা কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠলো।সকলেই বেশ হাপিয়ে উঠছে।কিন্তু পাহাড়ের চুরার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এতক্ষণের কষ্টকে নিমিষের দুর করে দিয়েছে।আরজু অবাক দৃষ্টিতে চারপাশে দেখছে।পুরো সাজেক দেখা যাচ্ছে এই স্থান থেকে।মেঘের খেলা দেখে আরজু,জারা, সাবিহা ও রিমি বেশ উচ্ছ্বাসিত হয়ে লাফাতে থাকে। শুভ দ্রুত তাদের বেশ কয়েকটি ছবি ক্লিক করে ফেলে।এই সুন্দর মুহূর্ত গুলোকে ফ্রেমে বন্দী করে রাখে।কে জানে পরবর্তীতে এই মুহূর্তগুলি আর পাবে কিনা?

আরজুর হঠাৎ চোখ পড়ে নাহিদের দিকে।সে চারপাশের ভিউ দেখছে আর বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি পান করছে।আরজু খেয়াল করলো এটি সেই বোতলটি।মুহূর্তেই আরজুর সারা শরীর শিউরে উঠলো।তার মনে হচ্ছে মানুষটি যেনো তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে।আরজু নিজের মাথায় নিজেই থাপ্পড় মারলো।আর বিড়বিড় করে বললো

-“জারা ঠিক বলেছে।আমার দৃষ্টি আসলেই খারাপ।”

বন্ধুমহল হৈ হুল্লোর করে সূর্যাস্ত দেখছে।শুভ আরজুর মাথায় হাত রেখে বললো
-“কীরে কেমন লাগছে?”

আরজু অশ্রুসিক্ত চোখে শুভর দিকে তাকালো।আরজুর এই অশ্রুর কারণ শুভ জানে।সে এক হাতে আরজুকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো।আরজু শুভর কাধে মাথা রেখে কাপা সুরে বললো

-“পাপা লাস্ট টাইম আমাকে প্রমিজ করেছিল একদিন উচু কোনো পাহাড় থেকে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় দেখাবে।কিন্তু এর পর আর পাপা ফিরে এলো না।তাদের আমি ভীষণ মিস করছি।”

-“পাগলী কান্না বন্ধ কর।তারা নিশ্চয়ই দুর থেকে তোর ভ্যা ভ্যা করা দেখে বিরক্ত হচ্ছে।আর বলছে “কি ইমোশনাল ফুল মেয়েরে বাবা।আমরা থাকলে পিটিয়ে সোজা করে ফেলতাম।আমরা নেই তাই সবার আদরে আদরে আহ্লাদী হয়ে যাচ্ছে।”

আরজু ফিক করে হেসে দিলো।আর বললো
-“নো ওয়ে।পাপা আমাকে কখনোই মারত না।আমি তার আহ্লাদী প্রিন্সেস ছিলাম।”

শুভ মুচকি হেসে আরজুর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো
-“আমার কাছেও তুই আহ্লাদী প্রিন্সেস। বুঝলি?”

আরজু হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।লিজা দুর থেকে তাদের দেখে বললো
-“ওহহ! কি কিউট কাপল।তোমার এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে কিছু শেখা উচিৎ।আনরোমান্টিক ছাগল একটা।”

সকলেই আরজু ও শুভর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।নাহিদ আড়চোখে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
অনিক অবাক হয়ে বললো
-“আমি আনরোমান্টিক ছাগল?ওকে চলো তোমাকে রোমান্টিকতা দেখাই।সবার সামনে দুইটা চুমু খাই।আসো।”
-“এই দূরে থাকো।লাগবেনা তোমার চুমু।”

আসফি হেসে বললো
-“হে দ্রুত চুমু খেয়ে ফেল।আমি ভিডিও করছি।”

লিজা আসফির পিঠে কিল বসিয়ে বললো
-“এক ধাক্কায় পাহাড় থেকে ফেলে দিবো তোকে।সিনেমা চলছে নাকি?তোর গফকে নিয়ে পাবলিকে চুমু খাস।”

-“এই অনিক তোর বউ সামলা।আমি মরলে আমার গফ এর কি হবে?”

লাবণ্য ধমক দিয়ে বললো
-“প্লিজ এইবার থাম।”

তারা ঝগড়া থামিয়ে দিলো। তবে লিজা ইশারায় বুজিয়ে দিলো পরে দেখে নিবে সে অনিককে।আসফি খেয়াল করলো নাহিদের দৃষ্টি ও মনোযোগ অন্যদিকে।সে নাহিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো।সামনের দৃশ্য দেখে মুচকি হেসে বললো

-“দোস্ত কেমন ফিল করছিস?”

নাহিদ দৃষ্টি স্থির রেখেই গম্ভীর স্বরে বললো
-“নট গুড।পরিবেশটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।”

আসফি নীরব হাসলো। গা জ্বালা করা হাসি।

*****************
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে তারা রিসোর্টে ফিরে আসলো।ক্লান্তিতে সকলের চোখে ঘুম নেমে আসলেও আরজুর চোখে ঘুম নেই।আরজুর মধ্যে অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে।মনকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারছে না।পাশে তাকিয়ে দেখলো জারা গভীর ঘুমে মগ্ন।আরজু বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো।কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস তার গা ছুয়ে যাচ্ছে।আরজু চোখ বুজে সেটা অনুভব করলো।অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

পাশের বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখলো নাহিদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মনের সুখে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে।নাহিদের দৃষ্টি দূরের পাহাড়ের দিকে।তার মুখে রাজ্যের বিষণ্ণতা।আরজু বুঝতে পারেনা এই মানুষটির জীবনে কিসের অভাব?তার কাছে তো সবই আছে।অর্থ সম্পদ,ক্ষমতা,পরিবার পরিজন সব আছে।তবে কিসের বিষণ্ণতা?আরজুর মনের অস্থিরতা বাড়লো বৈকি কমলো না। এই মুহূর্তে নাহিদের হাত থেকে সেই সিগারেটি ছুড়ে ফেলতে পারলে তার ভীষণ শান্তি লাগতো।আরজু আর এক মুহুর্ত দাড়ালো না।রুমে চলে আসলো।তার মনে নাহিদ নামক মানুষটিকে নিয়ে কৌতহল বেড়েই যাচ্ছে।এমন হাজারো চিন্তার মাঝে এক সময় গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো।

**********
পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তারা সকলে চলে গেলো হেলিপ্যাডে।উদ্দেশ্য সূর্যোদয় দেখা। ভোরের শিশির বিন্দু ঘাসে পড়ে মুক্তার মতো ঝলমল করছে।তারা অনেকটা পথ হেঁটে উপরে পৌঁছে সূর্যোদয় দেখলো।সূর্যের কিরণ ধীরে ধীরে সমস্ত আঁধারকে কাটিয়ে ধরণীকে আলোকিত করে তুলেছে।সকলেই মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করলো।তারপর তারা গেলো তাদের নেক্সট ডেস্টিনেশন কংলাক ঝর্ণা।তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে নাহিদ ওরাও।

আজুর যেমন অসস্তি লাগছে অন্যদিকে কেমন সুখ অনুভব হচ্ছে।মানুষটিকে এতো কাছে থেকে খুব কম দেখা হয়েছে।ভালোবাসা অনুভূতিটাই ভীষণ রঙিন।আরজুর কাছে সব কিছুই ভালো লাগছে।জারার নেকামি,ফুয়াদের খোচামারা কথা,সাবিহার বকবক সব ভালো লাগছে।পায়ের নিচের কাদা মাটি পর্যন্ত আরজুর কাছে সর্গীও কিছু মনে হচ্ছে।আরজুর ইচ্ছে করছে নাহিদের বলিষ্ঠ হাত ধরে এই পাহাড়ের পথ পারি দিতে।কিন্তু সেটা সম্ভব না।লোকটি তো তার দিকে ঠিক মতো তাকায়না পর্যন্ত।হাজারো কল্পনার মাঝে আরজু অনেকটা অমনোযোগী হয়ে পড়লো।ফলে একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো।

পাহাড়ের সরু পথের ভেজা মাটিতে পা পিছলে গেল তার।মুহূর্তেই আরজু গড়িয়ে পাহাড়ের গভীর খাদে পড়ে যাচ্ছিল।কিন্তু কয়েকটি গাছের ডালে ঝাপটে ধরে সে ঝুলে রইলো।আকর্ষিক ঘটনায় আরজুর ভয়ে সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।আরজু জোরে চিৎকার করে কাদতে লাগলো।

মুহূর্তের মধ্যেই কি ঘটে গেলো কেউ বুঝতেই পারলো না।বন্ধু মহলের সকলেই ভয়ে আতঙ্কে দ্রুত পাহাড়ের কিনারায় চলে আসলো।প্রচন্ড ভয়ে শুভর সারা শরীর কাপছে।সে নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো।কেনো সে আরজুর হাত শক্ত করে ধরে রাখলো না।শুভ পাগলের মত সেই পাহাড়ের নিচের দিকে নামতে গেলে ফুয়াদ আর রামিম তাকে আটকায়।এই ভাবে নিচে নামলে নির্ঘাত পাহাড় থেকে শুভ পড়ে যাবে।ফুয়াদ জানে আরজুর জন্য শুভ এই পাহাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়তে দুবার ভাববেনা।রিমি,সাবিহা,জারা চিৎকার করে আরজুকে ডাকতে লাগলো।ফুয়াদ উকি দিয়ে দেখলো আরজু অনেকটা নিচে গড়িয়ে পড়েছে।এই মুহূর্তে কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না।তবে মাথা গরম করে কিছুই করা যাবে না।আগে চিন্তা করে তবেই কোনো স্টেপ নিতে হবে।অন্য দিকে শুভ নিচে নামার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে।রামিম কিছুতেই তাকে আটকে রাখতে পারছে না।ফুয়াদ আসে পাশে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে যা দিয়ে আরজুকে উপরে তুলে আনা যাবে।

তাদের পেছনেই নাহিদ ওরা ছিলো।নাহিদ দ্রুত কিনারায় এসে আরজুর অবস্থান দেখে নিল।আর এক মুহুর্ত দেরি না করে পাহাড় ঘেঁষে নিচে নামতে শুরু করলো।নাহিদের এই কাণ্ডে উপস্থিত সকলেই ভরকে গেলো।লাবণ্য তো জোড়ে কেঁদে নাহিদকে বলতে লাগলো

-“নাহিদ কি করছিস? পাগল হয়ে গেছিস? এখান থেকে পা পিছলে পড়লে কি হবে জানিস? আসফি, অনিক ওকে থামা।”

কিন্তু নাহিদ কারো কথাই কানে নিলো না।সে খুব সাবধানে পাহাড়ের গা ঘেসে আরজুর কাছে পৌঁছালো।আরজু তখন ভয়ে চোখ বন্ধ করে কাদছে।নাহিদ বললো

-” মিস আরজু এখানে ঝুলে ঝুলে কি পাহাড় গুনছেন?পাহাড় গুনার আরো অনেক পদ্ধতি আছে।এমন অভিনব পদ্ধতি তো আমার জানা ছিলনা।”

আরজু চমকে উপরের দিকে তাকালো।সে তো ধরেই নিয়েছে আজ তার মৃত্যু নিশ্চিত।কিন্তু নাহিদকে দেখে সে বেশ চমকে গেলো।এমন পরিস্থিতিতে ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে আরজু ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল। নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“কাদলে কি উপরে উঠা যাবে?কান্না বন্ধ করে লক্ষী মেয়ের মতো হাত দিন।”

আরজু কেদেই যাচ্ছে।নাহিদ বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বললো
-“কান্না বন্ধ করতে বলেছি না?দিন হাত দিন।”

নাহিদের ধমক খেয়ে আরজুর কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো।সে কেঁদে কেঁদে বললো
-“আমি পারবো না।আপনি চলে যান।নাহলে আমার সাথে আপনাকেও মরতে হবে।”

-“আপনার সাথে মরতে আমার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা নেই।তবে চাইলে এক সাথে বাঁচতে পারি।তাই দ্রুত হাত দিন।”

চাইলে এক সাথে বাঁচতে পারি কথাটা আরজুর মনে গেঁথে গেলো।এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিও আরজু শিউরে উঠলো।এক অদৃশ্য শক্তি পেলো সে।তাকে তো বাঁচতেই হবে।এই গুমরো মুখো ভন্ড নেতার উপর বার বার ক্রাশ খাওয়ার জন্য হলেও বাঁচতে হবে।ডান হাতটি সে নাহিদের দিকে বাড়িয়ে দিল।নাহিদ পরম যত্নে শক্ত করে আরজুর হাতটি ধরে এক টানে নিজের বুকে নিয়ে আসলো।প্রচন্ড ভয়ে আরজু নাহিদের গলা ঝাপটে ধরলো।নিজেকে মিশিয়ে নিলো নাহিদের সাথে।সেই মাতাল করা গ্রান নাকে এসে লাগছে আরজুর।আরজুর হার্টবিট বেড়ে গেলো বহুগুণ।আরজু ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো।

নাহিদ বললো
-“আমাকে শক্ত হাতে ধরে রাখুন।”

আরজু মাথা ঝাঁকালো।
শুভ যখন দেখলো নাহিদ আরজুকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে তখন সে সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।শুভ পাহাড়ের কাছে ঝুঁকে নাহিদকে হাত বাড়িয়ে দিলো।নাহিদ শুভর হাত ধরে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসলো।উপরের উঠার পরো আরজু নাহিদকে ঝাপটে ধরে রেখেছে।প্রচন্ড ভয়ে আরজুর সারা শরীর তখনও কাপছিল।তাদের দুজনের শরীর কাদায় মাখামাখি।নাহিদ ফিসফিসিয়ে আরজুর কানের কাছে বললো

-“সারা জীবন এই ভাবে ঝাপটে ধরে রাখার ইচ্ছে আছে নাকি মিস আরজু?”

নাহিদের কথায় আরজুর হুস ফেরে।সে দ্রুত নাহিদের কাছথেকে দূরে সরে আসে।ভীষণ লজ্জা আর ভরে আরজুর সারা মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।শুভ দ্রুত আরজুকে ঝাপটে ধরে মাথায় চুমু খায়।আজ আরজুর কিছু হলে সে নিজেকে শেষ করে ফেলতো।এই মেয়েটাকে ছাড়া সে জীবনের একটা দিনও কল্পনা করতে পারে না।বন্ধুমহলের সকলেই আরজুকে ঝাপটে ধরলো।আরজু সকলের অবস্থা দেখে হেসে বললো

-“আরে বাবা আমি ঠিক আছি।”

লাবণ্য দৌড়ে আসলো নাহিদের দিকে।অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বললো
-“তুই কি জীবনেও চেঞ্জ হবি না।মানুষের বিপদ দেখলেই তোকে ঝাপিয়ে পড়তে হবে?যদি তোর কিছু হয়ে যেতো?”

নাহিদ মুচকি হেসে বললো
-“আমার জীবনটা তো সেই কবেই জনগণরে সেবায় উৎসর্গ করেছি।আমার পলিটিক্স এ আসার মূল উদ্দেশ্যই মানুষের সেবা করা।”

নাহিদের কথায় সকলেই খুশি হলেও আরজু খুশি হতে পারলো না।তার মুখটি মুহূর্তেই মলিন হয়ে উঠলো।সে ভেবেছে নাহিদের মনেও নিশ্চই তাকে নিয়ে কোনো অনুভূতি আছে।তাইতো নিজের জীবন বাজি রেখে তাকে বাঁচিয়েছে।কিন্তু না।তার সকল ধারণা নাহিদ ভুল প্রমাণ করে দিলো।
বন্ধুমহলের সকলেই নাহিদকে ধন্যবাদ জানালো। কিন্তু আরজু একটা কথাও বললো না।তার মনে বিশাল অভিমান জমা হয়েছে নাহিদের উপর।সে জানে নাহিদের তাতে কিছুই আসে যায় না।

বাকি পথ শুভ আরজুর হাত শক্ত করে ধরে রাখলো।এই হাত সে মোটেও ছাড়বে না।আরজুর সকল ভয়,অভিমান কেটে গেলো ঝর্ণা দেখে।পাহাড়ের গা ঘেসে সচ্ছ পানির ফোয়ারা নেমে এসেছে।আরজু প্রচন্ড খুশিতে লাফাতে লাগলো।এই প্রথম সে ঝর্ণা দেখছে।বাকি সবারই মন ভালো হয়ে গেলো।বন্ধু মহলের সকলেই খুশিতে ঝর্নার পানিতে গা ভিজাতে শুরু করলো। আসফিরাও ভিজতে শুরু করলো।নাহিদ প্রথমে ভিজতে না চাইলেও লাবণ্যর জোরাজুরিতে নেমে পড়লো।এমন মুহূর্ত হয়তো আর পাওয়া যাবে না।তার ব্যাস্ত জীবনে একটু বিরতি পেয়েছে।সেটা যথাযথ কাজে লাগাতে হবে।