মিষ্টি রোদের হাতছানি পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
604

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_17

আজকাল অবনির মন ভীষণ খারাপ যাচ্ছে।কিছুই ভালো লাগছে না।প্রথম দিকে এর কারণ উদঘাটন করতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছে তার মন খারাপের কারণ আরজু।আরজু আর তার গলায় গলায় ভাব বিষয়টি তেমন না।বরং একজন অন্য জনের পেছনে পরে থাকে।উৎ পেতে থাকে ঝগড়া সৃষ্টি করার জন্য।তবে আরজুর অনুপস্থিতিতে অবনির কাছে বাসাটি জেল খানা মনে হচ্ছে।সারাদিন বাবা মা কাজের জন ও বাসার বাইরে থাকে।বাসায় থাকে তারা।তারার সাথেও তার ছত্রিশ আখড়ার ঝামেলার লেগেই থাকে।তারা হলো মোটা মাথার জটিল নারী।যাকে তার পছন্দ তার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত।আর যাকে পছন্দ নয় তাকে নাজেহাল করে ছারে।

তারার অপছন্দের লিস্টে প্রথমেই জুবায়ের আহমেদ তার পর অবনি ও মোস্ট অপছন্দ শুভ।সাবা খানম ও আরজু তার ভীষণ পছন্দের মানুষ। এরা তাকে ধমক দিলেও সেটা মধুর বাণী হিসেবে গিলে নিবে।

আজ সকালের ঘটনা।সকাল সকাল তারা অবনির ঘরে হামলা দিলো।অবনির সকালের মিষ্টি মধুর ঘুম ভাঙলো তারার কর্কশ কণ্ঠে।তারা বেশ কৌতহল হয়ে বললো

-“ছোট আপা আজ সকালে কি হইছে জানেন?”

অবনি ঘুমে ঠিক মতো চোখ খুলতে পারছে না।বিরক্ত হয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো

-“তারা আপু বিরক্ত করো না।তোমার মাসালাদার নিউজ আম্মুকে শুনাও।”

তারা তো দমে যাওয়ার পাত্রী নয়।সে অবনীকে ঝাকাতে ঝাকাতে উৎসাহ নিয়ে বললো

-“আজ বাজারে একটা বিরাট ঘটনা ঘটছে।বাজারে একটা ছেলে আমারে দেইখা কি সব ইশারা করছিল।আমি তো ভয়ে শেষ।ভিড়ের মধ্যে গায়ে হাত দিলে কেমন বাজে ব্যাপার হইবো।হঠাৎ ওই পোলা আমার কাছে আইসা গায়ে হাত দিতে নিলে কেউ ওর হাত ধইরা ফালায়। আমি তাকাইয়া দেখি সামনের বাড়ির কেয়ারটেকার রফিক।রফিক ওই পোলার গালে দুইডা থাপ্পড় বসাইয়া ইচ্ছামত গালি দিলো।একদম আমাগো এলাকার খাঁটি বকা।আমার কি যে খুশি লাগলো।কেউ আমার লাইগা এতো কিছু করবো ভাবতে পারি নাই।রফিক যহন আমার দিকে তাকাইয়া হাসি দিলো আমি তো সেই খানেই শেষ।আমার কাছে মনে হইলো এইডা তো আমার স্বপ্নের নায়ক।গুন্ডা থেকে আমারে বাচাইছে।আমি তো মনে হয় প্রেমে পিছলা খাইয়া পইড়া গেছি।”

অবনি বিস্ময় নিয়ে তারার দিকে তাকালো।তারার মতো খুঁতখুঁতে মেয়ে কারো প্রেমে পড়তে পারে অবনির জানা ছিলো না।অবনি বিস্ময় চোখে তাকিয়ে বললো

-“এক মুহূর্তেই প্রেমে পড়ে গেলে? এ আবার কেমন প্রেম?একটা ছেলেকে থাপ্পড় দিলো বলে প্রেমে পরে গেলে?”

তারা লাজুক হাসলো।আর বললো
-“প্রেমে পড়তে কি যুগ যুগ লাগে নাকি? এক মুহুর্তই যথেষ্ঠ।”

অবনি চিন্তায় পড়ে গেল।আচ্ছা ওই রোবট মানব লোকটিও তো তাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর পর থেকে লোকটিকে কিছুটা ভালো লেগেছিলো।যদিও সেদিন মুখে পানি ফেলা নিয়ে তুমুল কান্ড ঘটেছিল।তবুও লোকটির প্রতি তার কৃতজ্ঞতাবোধ আছে।কিন্তু সে তো প্রেমে পড়েনি।তাহলে তারা কি করে পড়লো?আর আরজু আপু, সেও মেয়র সাহেবের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে নাজেহাল অবস্থা।শুধু তার জীবনেই প্রেম নেই।সবার সাথেই তার ঝামেলা চলে।যেমন মায়ের সাথে চলে।মা তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে এইচ এস সি তে ভালো রেজাল্ট না করলে তাকে বড়ো মামার বাসায় রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়তে পাঠিয়ে দিবে।বড়ো মামার নাম শুনলেই সে আতঙ্কে থাকে।তার রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার মামার স্ট্রিক রূলস এর কবলে পড়ে তার মামাতো ভাই বোন গুলোর নেতিয়ে পড়া বকুল ফুলের মতো অবস্থা।তাদের নিঃশ্বাস ও পরে টাইম মেইনটেইন করে।সেখানে অবনির মতো বেখায়ালি,উড়নচণ্ডী,অগোছালো মেয়ে এক দিনও টিকতে পারবে না।

অবনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-“তারা আপু তোমার ওই পিছলা প্রেমের গল্পে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।নাস্তা দাও কলেজে যাবো।”

অবনির জবাবে তারা মনঃক্ষুণ্ণ হলো।সে ভেবেছে অবনি এই বিষয়ে বেশ আগ্রহ দেখাবে।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।মেজাজ গরম করে তারা চলে গেলো।

রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসতেই অবনির মেজাজ খারাপ হলো।রুটির সাথে পেঁপে ভাজি।সে কটমট করে তারার দিকে তাকালো।অবনি জানে তারা ইচ্ছে করে তার অপছন্দের নাস্তা রেডি করেছে।সকালে তার কথা গুরুত্ব না দেওয়ার শাস্তি দিচ্ছে।শুধু মাত্র মায়ের জন্য সে তারাকে কিছু বলতে পারেনা।রেগে অবনি নাস্তা না করেই চলে গেলো।

তারা নাস্তার বাটি রান্না ঘরে নিচ্ছে আর গুণ গুন করে গান গাইছে।আজ তার মনে রং লেগেছে।মূলত এই পেঁপে ভাজি সে করেছে জুবায়ের আহমেদকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্য।আজ সাবা খানম তার স্বামীকে বলেছে তারার সাথে বাজারে যেতে।কিন্তু তিনি বাজারে যাওয়ার পর শুধু পেঁপে কিনে কোন এক বন্ধুর সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছেন।আর তারাকে বাকি বাজার করতে বলেছে।সেই কাজের শাস্তি সে খালুজান কে দিয়েছে।অবশ্য এতে তার এক ঢিলে দুই পাখি মারা হলো।অবনি ও জুবায়ের আহমেদ দুজনই পেঁপে ভীষণ অপছন্দ করে।স্ত্রীর ভয়ে সে তারাকে কিছু বলতে পারে না।এই বাসায় তারার বিশেষ পাওয়ার আছে।

**********
সারাদিন প্রকৃতির সৌন্দর্যে ঢুবে ছিলো বন্ধু মহল।ঝর্নার পানিতে গোসল করে রিমির ঠান্ডা লেগে গেছে।বিকাল থেকে সে একের পর এক আদা চা খেয়ে যাচ্ছে।ফুয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো

-“একটু ভিজেই এই অবস্থা তোর?তোকে আস্ত বাসায় না পাঠাতে পারলে তোর মেজর বাপ আর ইঞ্জিনিয়ার ভাই আমাদের ঘাড় মটকাতে চলে আসবে।এই সব ননীর পুতুল নিয়ে ট্যুরে আসলে মহা সমস্যা।”

আরজু কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো
-“আমাদের না নিয়ে তোরা ট্যুরে আসতে পারতি?কেটে দুই ভাগ করে ফেলতাম না তোদের।”

-“হে মা!তুমি তো দেবী।তোমার ছত্রছায়ায় না আসলে আমরা এই মেঘের রাজ্যে কবেই হারিয়ে যেতাম।”

জারা ফুয়াদের পিঠে একটা কিল বসিয়ে বললো
-“নাটক কম কর ছাগল।তোর তিন নম্বর গফ মিম যা নেকা ছিলো।তাকে নিয়া তুমি বাছা কই কই ঘুরতে গেছিলা সব জানা আছে।শুধু আমাদের সাথে আসলেই তোর ঝামেলা লাগে।”

-“দেখ আমি মীমকে নিয়ে কোথাও যায়নি।একবার গাড়িতে করে লং ড্রাইভে বেড়িয়েছিলাম।বক বক করে আমার মাথা খারাপ করে ফেলেছে।তাই সেদিন রাতেই তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ব্রেকআপ করে দিয়েছি।এতো নেকামি আমার সহ্য হয়না।”

-“ছাগল তোর কপালে বউ জুটবে না।”

-“ওই সব বেকার রানীদের আমার বউ বানানোর ইচ্ছা নেই।যেদিন সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে পাবো সেদিন এই প্রেম করার ঝামেলায় যাবো না।সোজা বিয়ে করে বাসর ঘরে প্রেম শুরু করবো।”

জারা কপাল কুঁচকে বললো
-“তোর মত বেয়াদবকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে?”

-“তোর মতো নমুনার জন্য যদি ছেলে খুঁজে পাওয়া যায় তবে আমার জন্য বউ খুঁজে বের করা বড়ো ব্যাপার না।”

জারা ভাব নিয়ে বললো
-“আমার পিছে কত ছেলের লাইন পরে আছে তা নিশ্চই তোকে বলতে হবে না?আজকাল জুনিয়র পোলাপান ও সেই কাতারে যোগ হয়েছে।”

ফুয়াদ ভ্রু কুচকে জারার দিকে তাকিয়ে বললো
-“তুই ওই জাহিদ নামের ছেলেটিকে এতো সহজ ভাবিস না।এই পোলা বহুত চালাক।তোর আশিক দের কাতারে ওরে ফেললে ভুল করবি।”

জারা কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।ফুয়াদ ঠিক বলেছে।ওই অসভ্য,বাঁদর অনেক চতুর।নাহলে কি জারার মতো মেয়েকে চুমু খেয়ে চলে যায়?

রাতের দিকে রিসোর্টে সামনের বাগানে বার্বিকিউ পার্টির আয়োজন করা হলো। আসফি শুভোদের সকলকে সেখানে ইনভাইট করলো।ভদ্রতার খাতিরে শুভ মানা করতে পারলো না।

আরজু বেশ অসস্তিতে পড়ে গেলো।সেই ঘটনার পর আরজু বেশ অস্থির হয়ে আছে।নাহিদের এতটা কাছে আসা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।তীব্র অস্থির করা অনুভূতিরা তাকে ঘিরে ধরেছে।বার বার নাহিদকে জড়িয়ে ধরার মুহূর্ত চোখে ভাসছে।লোকটি আসলেই অদ্ভুত।তাকে পাত্তা দেয়না।কিন্তু তার বিপদে কোনো কিছু না ভেবেই কেমন করে পাহাড়ের নিচে চলে এসেছিল।আরজু লাজুক হাসলো।নাহিদ নামক মানুষটি তার হৃদয়ের গভীর স্থানে খুঁটি গেড়ে বসে আছে।তাকে আরো আকৃষ্ট করে তুলছে।

আরজু তৈরি হয়ে বাগানে আসতেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পেলো।নাহিদ বার্বিকিউ করতে ভীষণ ব্যাস্ত।তার গায়ে জড়ানো কালো টিশার্ট।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।কালো রঙে উজ্জ্বল শ্যামলা নাহিদকে আগুন লাগছে।কালো রঙ দুর থেকেই ভীষণ চোখে লাগছে আরজুর।চোখ কেমন জ্বালাপোড়া করছে।কে বলবে এই ছেলে রাজনীতিবিদ?এমন সুদর্শন যুবক নির্বাচনে দাড়ালে মেয়েরা তো চোখ বুজেই ভোট দিতে বাধ্য।

নাহিদ কথা বলতে বলতে একবার তাকালো আরজুর দিকে।ব্লু জিন্সের সাথে হোয়াইট টপস।খোলা চুল বার বার আরজুর মুখে এসে পড়ছে।শুভ দৌড়ে গেলো আরজুর কাছে।আরজুর অবাধ্য চুল নিজ হাতে খোপা করতে করতে বলতে লাগলো

-“এই বাতাসে চুল খুলে এসেছিস কেনো?চুপ চাপ দাড়িয়ে থাক।খোপা করতে দে।”

-“তুই আমাকে ধমকাচ্ছিস কেনো?আমি কি জানতাম এতো বাতাস বাইরে?”

শুভ বুজলো আরজু অভিমান করেছে।সে তার অভিমান ভাঙ্গাতে বললো
-“আচ্ছা লক্ষ্মী সোনা রাগ করিস না।রাগলে তোকে পটল ভাজার মতো লাগে। এন্ড ইউ নো আই লাভ পটল।”

আরজু রেগে শুভকে মারতে লাগলো।আর শুভ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে।
নাহিদ সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আসফি মুচকি হেসে বললো

-“দোস্ত কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে না?”

নাহিদ ক্ষুব্ধ চোখে তাকাতেই আসফি মেকি হেসে বললো
-“এমন লুক দেস কেনো?নিজের চোখে দেখে মুরগীটা পুড়ে গেছে।”

নাহিদ তাকিয়ে দেখলো আসলেই মুরগীটা এক পাশ অনেকটা পুড়ে গেছে।

আস্ত খাসি সহ চিকেন বার্বিকিউ করা হলো।সকলেই বেশ মজা করে খেলো।কিন্তু তীব্র অনুভূতির ঝড়ে আরজু তেমন খেতে পারলো না।অনেকক্ষণ আড্ডার পর ফুয়াদ একটা গিটার শুভর হাতে ধরিয়ে দিলো।শুভ সবার সামনে একটু লজ্জা পেলেও পরে ঠিক গান ধরলো।আরজুকে আজ অন্য ভাবে মনের কথা বলা যাক।

Kaise Bataye Kyun Tujhko Chahe
Yaara Bata Na Paaye
Baatein Dilon Ki Zuban Aankhon Ki Tujhe Samjhayen
Tu Jaane Na…
Tu Jaane Na…

Tu Jaane Na..
Tu Jaane Na..

শুভ এক দৃষ্টিতে আরজুর দিকে তাকিয়ে গান গাইছে।ফুয়াদ ভালো করেই জানে শুভ নিজের মনের কথা গুলো আরজুকে গানের মাধ্যেমে বলতে চাইছে।এই দুজন এক হলে ফুয়াদ সবচাইতে বেশি খুশি হবে।কারণ শুভর চাইতে বেশি কেউ আরজুকে আগলে রাখতে পারবে না।এই মা বাবা হীন সবার আদরের আহ্লাদী মেয়েটিকে একমাত্র শুভ সামলাতে পারবে।শুভ হাজারো জমানো কথা আজ আরজুকে বলছে কে জানে বোকা মেয়েটা আদো বুঝতে পারছে কিনা?শুভ আবার গেয়ে উঠলো

Nigahon Mein Dekho Meri Jo Har Bas Gaya
Woh Hai Milta Tumse Hoo Bahu
Ooo Jane Teri Aankhen Thi Ua
Ya Baatein Thi Wajah
Huye Tum Jo Dil Ki Arzooo

নাহিদ শুভর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।অসম্ভব মায়া জড়ানো কণ্ঠ।নাহিদ শুভর দৃষ্টি অনুসরণ করে আরজুর দিকে তাকালো।আর মুদূর্তেই তাদের দৃষ্টি মিলিত হলো।লজ্জায় আরজু চোখ নামিয়ে নিলো।এতক্ষণ আরজু গানের মাঝে হারিয়ে নাহিদকে দেখছিলো।মানুষটি ফোনে হাত চালাতে ব্যাস্ত ছিল।সবাই বেশ এনজয় করেছে মুহূর্তটিকে।রিমি শুভর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।তার মনের হাজারো অনুভূতিরা ডানা মেলে উড়ছে।

জারা ফিসফিসিয়ে আরজুকে বললো
-“আরজু মনের কথা ওই রসকষহীন প্রাণীটিকে বলে দে।কারণ ওই বেটারে না বললে জীবনেও বুজবে না।নেতা মানুষ তো!এদের কানে আবার তুলা থাকে।জনগনের আহাজারি সহজে এদের কানে যায় না।”

আরজু বিরক্ত হয়ে বললো
-“মজা নিস না।আমি কিছুই বলতে পারবো না?কি বলবো?এটাই যে আমি আপনার প্রেমে পরে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছি?আমার ব্রেইন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।এই কারণেই আপনার শত ইগনোর করার পর ও নাচতে নাচতে আপনাকে প্রপোজ করতে চলে এসেছে।নিজের আত্মসম্মান সব ওই আস্ত খাসির সাথে ঝালিয়ে পুড়িয়ে আপনার কাছে এসেছি। এটাই বলবো?”

জারা বিরক্তি প্রকাশ করে বললো
-“এইসব কেনো বলবি?একটু রোমান্টিক ওয়েতে বলবি।তোর মতো সুন্দরী মেয়ে প্রপোজ করলে বেটার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।দেখবি এই মেয়র কেনো তার বাপ ও পটে গেছে।”

-“তার বাপকে পটানোর কোনো ইচ্ছা আমার আপাতত নেই।যে আমার দিকে ঠিক মতো তাকায়না পর্যন্ত তাকে আমি প্রপোজ করে রেজেক্টের মালা গলায় ঝুলাবো?ইম্পসিবল!তাছাড়া এতো দিনে আমি বুঝে গেছি তিনি রূপের মোহে হারানোর মতো মানুষ না।তিনি কঠিন ব্যাক্তিত্বের মানুষ।”

-“তাহলে বসে বসে ইগোকে নিয়ে মুরগির ঠ্যাং খা।”

অনেক্ষন আড্ডার পর আসফি সবার জন্য ড্রিংস নিয়ে আসলো।নাহিদ এইগুলো দেখে বেশ বিরক্ত হয়ে বললো

-“মেয়েদের সামনে এইগুলো কেনো আনলি?”

-“আরে বেটা আজকাল এইগুলো মেয়েরাই বেশি পছন্দ করে।মজার কথা কি জানিস?এই সব লাবণ্য এনেছে।বিদেশি ইমপোর্টের জিনিস। চল সবাই জাস্ট এক প্যাক করে খাবো।”

নাহিদ বিরক্ত হয়ে বললো
-“তোরা খা।আমার জরুরী কল করতে হবে।আমি রুমে যাচ্ছি।আর শোন এখান থেকে ফিরে তোর হয়তো একটা কেস হাতে নিতে হতে পারে?”

-“আবার কি ঝামেলা ঘটিয়েছিস?তোর নিজের রাগকে কন্ট্রোল করা উচিৎ।সব কিছু গরম মাথায় হয়না।তোর বর্তমান পজিশনের ব্যাপারটা মাথায় রাখিস।”

নাহিদ প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বললো

-“আমার মাথা যথেষ্ঠ ঠান্ডা আছে।তবে তারা যদি আমাকে দাদাজানের মতো সহজ সরল নেতা ভেবে থাকে তবে সেটা তাদের ভুল।আমি মোটেও তেমন না।ঠান্ডা মাথায় শত্রুকে কুপোকাত করার টেকনিক আমার জানা আছে।তবে নরম ভাবে কাজ না হলে আগের নাহিদ হতে আমি দুবার ভাবি না। শান্ত আছি বলে দমে গেছি এমন না।”

আসফি দেখলো নাহিদের উজ্জ্বল মুখ কেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।নাহিদকে সে ভালো করে চেনে।তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো

-“আচ্ছা আমি বিষয়টা দেখবো।”

-“আমি যাচ্ছি।”

বলেই নাহিদ চলে গেলো।নাহিদকে যেতে দেখে আরজুর মন খারাপ হলো।মানুষটিকে আজকাল সে চোখে হারায়।কাছে থাকলে অসস্তি ঘিরে ধরে দূরে গেলে বুকের ভেতর জ্বালা পোড়া করে।মহা সমস্যায় আছে সে।

শুভ আরজুকে শাসিয়ে বললো ভুলেও যাতে এক প্যাক এর বেশি না খায়।সিনিয়র আপুরা অনেক জোর করছে বলে শুভ এক প্যাক খাওয়ার পারমিশন দিলো।সে আর রামিম গেলো কোল্ড ড্রিংকস আনতে। আর ফুয়াদকে বলে গেলো মেয়েদের দেখে রাখতে।আরজুর মন খারাপ দেখে লাবণ্য তার পাশে বসে বললো

-“এইযে মিষ্টি মেয়ে?মন খারাপ?bf এর সাথে ঝগড়া হয়েছে বুজি?”

-“না আপু তেমন কিছু না।আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড।”

-“হুম বুঝি বুঝি।আচ্ছা আর একটু খেয়ে দেখো দেখবে মন ভালো হয়ে গেছে।”

আরজু লাবণ্যর কথা শুনে আরো বেশ কয়েক প্যাক গিলে ফেললো।এই মুহূর্তে তার আসলেই ভালো লাগছে।ভীষণ ভালো লাগছে।

লিজা বেশি ড্রিংস করায় অনিক তাকে নিয়ে রুমে চলে গেলো।নাহলে সবার সামনেই তাকে গালিগালাজ করে মান সম্মান ডুবিয়ে ফেলবে।

শুভ আর রামিম কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে আসতে আসতে দেখে এই জায়গায় লংকা কান্ড বেধে গেছে।সাবিহা উল্টা পাল্টা কথা বলছে।মূলত সে রামিমকে বকা ঝকা করছে।আরজু ঝিম ধরে বসে আছে।জারা খিলখিল করে হেসে সেলফি তুলে নিচ্ছে।আর সবচাইতে বেহাল অবস্থা রিমি ও ফুয়াদের।তারা দুজন গানের তালে তুমুল নাচানাচি করছে।শুভর ফুয়াদের উপর বেশ রাগ হলো।সে ফুয়াদকে রেখে গেছে ওদের পাহারা দিতে।কিন্তু এই বাঁদর নিজেই মাতাল হয়ে নাচানাচি করছে।শুভ দেখলো জারা কিছুটা স্বাভাবিক আছে।সে রামিম কে বললো

-” তুই সাবিহা আর আরজুকে নিয়ে যা।আর জারা তুই ঠিক আছিস?”

জারা মুচকি হেসে বললো
-“আমি ঠিক আছি।মাথা ঝিম ঝিম করছে।মনে হচ্ছে কেউ বার বার গালে চুমু খাচ্ছে।কি জ্বালা বলতো। গালে কেউ চুমু খায়।চুমু খেতে হয় ঠোঁটে।কিন্তু পিচ্ছি ছেলেকে কে বুঝাবে? কিছুই জানে না।”

বলেই জারা হেসে দিল।শুভ হতাশ হয়ে কপাল চাপরালো।রামিম বললো
-” আমি এদের তিন জনকে নিয়ে যাচ্ছি।তুই ওই দুই বেকুবদের নিয়ে আস।”

রামিম প্রথমে আরজু আর জারাকে তাদের রুমে দিয়ে আসলো।তার পর সাবিহাকে তার রুমে নিয়ে গেল।সাবিহাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই সে রামিমের জামার কলার চেপে ধরলো।রামিম কিছুটা হচকিয়ে গেলো।সাবিহা কাদো কাদো মুখ করে বলে উঠলো

-“তুই ভীষণ খারাপ রামিম।”

রামিম ভ্রু কুচকে বললো
-“কি করেছি আমি?”

-“অনেক কিছু করেছিস?”

-“অনেক কিছু কি?”

-“আমার মন চুড়ি করে এখন সাধু সাজা হচ্ছে?এই আমার মন ফিরিয়ে দে।সব বুঝেও না বুঝা লোক আমার একদম পছন্দ না।”

রামিম শুকনো ঢোক গিললো।এই মেয়ে কয় প্যাক খেয়েছে কে জানে?রামিম নিজেকে সামলে বললো

-“তুই ঘুমা।সকালে কথা বলবো।”

-“না আমার মন ফেরত চাই। এক্ষুনি। এক্ষুনি।”

রামিম অন্য দিকে তাকিয়ে বললো
-“তোর মন আমার কাছে নেই।”

সাবিহা ক্ষিপ্ত হয়ে রামিমের বুকে মারতে মারতে বললো
-“মিথ্যাবাদী।আমার মন তুই নিয়েছিস।আর তাতে ইচ্ছে মতো আঘাত করছিস।”

রামিমের ইচ্ছে হলো সাবিহাকে জড়িয়ে ধরে বলতে
-“হে আমি নিয়েছি তোর মন।আর সেটা সযত্নে আগলে রেখেছি।মোটেও আঘাত করছি না।শুধু তোকে কঠিন বাস্তবতা থেকে বাচাচ্ছি।”

কিন্তু রামিম এমন কিছুই করলো না।সাবিহাকে শান্ত করতে তার কপালে গভীর চুমু একে বললো

-“ঘুমিয়ে পর।আদর করে দিলাম।”

সাবিহা শান্ত হলো।রামিম উঠে চলে যেতে নিলে সাবিহা মায়া জড়ানো কন্ঠে বললো

-“আমাকে তোর বউ বানাবি?এমন আদর আমার সব সময় চাই।”

রামিম থমকে গেলো।কিন্তু পেছন ফিরে তাকালো না।মূলত তাকানোর সাহস পেলো না।ওই চোখের দিকে তাকালে সে আজ ধ্বংস হয়ে যাবে।রামিম দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে শুভর কাছে গেলো।

***********
নাহিদ ফোন কথা বলে একটু ফ্রেস হয়ে নিলো।ওয়াস রুম থেকে বেরুতেই দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনতে পেলো।নাহিদ ভাবলো নিশ্চই আসফি এসেছে।সে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো তার সামনে আরজু দাড়িয়ে আছে।নাহিদ কপাল কুচকে দরজার আসে পাশে তাকালো।না অন্য কাউকে দেখা যাচ্ছে না।সে আরজু কে উদ্দেশ্য করে বললো

-“মিস আরজু আপনি এখানে,এই সময়?”

আরজু নেশাত্ব দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকালো।আরজুর এমন চাহুনিতে নাহিদের বুকের বা পাশে মোচড় দিয়ে উঠলো।সে দৃষ্টি সরিয়ে বললো

-“কোনো সমস্যা?”

-“আপনি ইদানিং খুব বেশি জ্বালাচ্ছে আমাকে?”

নাহিদ অবাক চোখে তাকালো আরজুর দিকে।কি বলছে এই মেয়ে?নাহিদ বললো

-” আমি আপনাকে কবে জ্বালালাম?”

-“প্রতিদিন আমার স্বপ্নে এসে ভীষণ জ্বালাতন করেন।”

নাহিদ অবাক হয়ে বললো
-“আমি আপনার স্বপ্নে আসি?”

আরজু মাথা ঝাঁকালো।আর বললো
-“গত কাল তো ভীষণ ভয়ঙ্কর কাজ করেছে আপনি।আমি ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠেছিলাম। পরে সারা রাত আর ঘুমাতে পারিনি।”

নাহিদ কি বলবে বুঝতে পারছে না।সে বুজলো আরজুর নেশায় বুদ হয়ে গেছে।আরজুর কথা কিছুটা জড়িয়ে আসছে।নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে আসফিকে কয়েকটা গালি দিল।আর আরজুকে বললো

-“আপনার নেশা হয়ে গেছে মিস আরজু।আপনি রুমে চলুন।আমি আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।আপনার বন্ধুরা কোথায়?”

আরজু তাৎক্ষণিক নাহিদের রুমে ঢুকে পড়ল।আকস্মিক ঘটনায় নাহিদ ভরকে গেল।সে অস্থির হয়ে বললো

-“আপনি ভেতরে কেনো এসেছেন আরজু?”

আরজু কৌতহল নিয়ে বললো
-“আচ্ছা আমি কী আপনার দিকে কু- দৃষ্টিতে তাকাই?সেদিন আপনি বললেন আমি বেহায়া।আবার আমার ফ্রেন্ড জারা বলেছে আমার নজর খারাপ।আসলেই কি তাই?”

নাহিদ হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে বললো
-“আপনি একদম ঠিক নেই আরজু।কি বলছেন বুঝতে পারছেন না।চলুন আপনাকে রুমে দিয়ে আসি।”

আরজু পিটপিট চোখে নাহিদের দিকে তাকালো।আর বললো

-“আপনি আমার স্বপ্নে এসে কি করেছেন জানেন?”

নাহিদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা মেরে না জানালো।আরজু মুচকি হেসে বললো

-“দাড়ান আমি দেখাচ্ছি।”

বলেই নাহিদের একদম কাছে চলে আসলো।নাহিদ ব্রু কুচকে বললো

-“কি করছেন আরজু?”

আরজু দুষ্ট হেসে বললো
-“আমার স্বপ্নে আপনি যা করেছেন।”

বলেই নাহিদের ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ জোড়া ছুঁয়ে দিলো।যাকে বলে টুপ করে চুমু খাওয়া।নাহিদ কয়েক মুহূর্তের জন্য থম মেরে গেলো।মুহূর্তেই কি হলো বুঝতে পড়লো না।তার বুকে ডিপ ডিপ শব্দ হচ্ছে।নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো।
আরজুর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মাথা নিচু করে মুচকি হাসছে।নাহিদ অপলক দৃষ্টিতে আরজুর দিকে তাকালো।একটু পর নাহিদ তার কপাল চুলকে আরজুর দিকে দৃষ্টি ফেলে বললো

-“এমন হালকা কাজ আমি করতেই পারি না।দেখুনতো স্বপ্নটা এমন ছিলো কিনা?”

বলেই তার এক হাত আরজুর পেছনের চুল খামচে ধরে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসলো।অন্য হাত গলিয়ে দিলো আরজুর কোমরে।একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ফেললো আরজুকে।আরজুর নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে নাহিদের মুখে। আরজু কিছু বুঝে উঠার আগেই নাহিদ আরজুর ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ জোড়া মিলিয়ে দিলো।নাহিদের স্পর্শ গভীর থেকে গভীরে হতে লাগলো।

অনুভূতির জোয়ারে আরজুর সারা শরীরে কম্পন ধরে গেলো।আরজুর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে বহু গুণ। নাহিদও সেটা শুনতে পাচ্ছে।তীব্র উত্তেজনায় আরজু নাহিদের গলায় খামচে ধরলো।আরজুর ধারালো নখ ঢেবে গেলো নাহিদের গলায়।নাহিদ উফফ! শব্দ অব্দি করলো না।আরজুর মাঝেই সে আজ হারিয়ে যাচ্ছে।যেনো বহুদিনের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।
এক সময় আরজুর মনে হলো সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।সে নাহিদকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু নাহিদ তখন হয়তো নিজের মধ্যে নেই।সে আরজুর কোমরে আরো করে চেপে ধরলো।আরজুর ভাবছে আজ তার ধ্বংস নিশ্চিত।আজ হয়তো ভালোবাসার অতল গভীরে ডুবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবে।।ভালোবাসার মানুষের স্পর্শ বুঝি এতো অসহ্য রকমের অনুভূতির সৃষ্টি করে?

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_18

শুভ্র স্নিগ্ধ সকালে নিজের বারান্দায় বসে কফি হাতে সূর্যোদয় উপভোগ করছে সাবা খানম।হাজারো ব্যাস্ততার মাঝে নিজেকে একটু সময় দেওয়াটা খুব প্রয়োজন। এতে মন প্রফুল্ল থাকে।আর মন প্রফুল্ল থাকলে তার জটিল কেস গুলো সমাধান করতে সুবিধা হয়। তার বারান্দায় নানান প্রজাতির গাছ রয়েছে।এই সব গাছ আরজু নিজে পছন্দ করে লাগিয়েছে।মেয়েটাকে ভীষণ মিস করছেন তিনি।গতকাল কথা হয়েছে।কথা শুনে বুঝতে পেরেছে সব বন্ধুরা মিলে ভীষণ আনন্দপূর্ণ সময় কাটাচ্ছে।মেয়েটা চোখের আড়ালে গেলেই অস্থির লাগে তার।তবে শুভ আর বাকি সবাই আছে বলে তিনি নিশ্চিন্ত।আরজুকে তিনি সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছেন।কখনো কোনো কিছুতে বাধা দেননি।জীবনকে নিজের মতো উপভোগ করুক।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে তিনি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন পাশে বসা স্বামী নামক মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে আছে।এই মানুষটি এতো বছরেও একটুও বদলায়নি। আজো মানুষটির দৃষ্টিতে সেই মুগ্ধতা জড়িয়ে আছে।সাবা খানম হালকা কেসে গলা পরিষ্কার করে বললেন

-“এই ভাবে তাকিয়ে কি দেখছো?”

জুবায়ের আহমেদ মুচকি হেসে বললেন
-“তোমাকে।”

-“আমাকে এই ভাবে দেখার কি হলো?মধ্যে বয়সে এসেও তোমার তারুণ্য কমেনি।”

-“তারুণ্যের সাথে বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই।তারুণ্য থাকে মানুষের ব্যাক্তিত্বের মাঝে।এইযে আজও তোমাকে দেখলে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়,কেমন নেশা নেশা লাগে,তোমাকে স্পর্শ করার ব্যাকুলতা তৈরি হয় এটাই তারুণ্য।”

সাবা খানম বেশ লজ্জা পেলেন।মানুষটির মুখে কিছুই আটকায় না।তবে মানুষটির এই ব্যাক্তিত্বের প্রেমেই তো পড়েছিলেন তিনি।তাকে লজ্জা পেতে দেখে জুবায়ের আহমেদ বলেন

-“লজ্জা পেলে নাকি।লজ্জা পেলে তোমাকে ঠিক সুচিত্রা সেনের মতো লাগে।”

-“আমি মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না।তবে তোমার এই তারুণ্যের জোয়ার একটু কমিয়ে আনো।কারণ মেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে।”

-“তুমি যে কি বলো?আমিতো সারা জীবন তোমাকে এই ভাবেই ভালোবেসে যাবো।বাচ্চারাও জানবে আমি তাদের মায়ের পাগল প্রেমিক।”

সাবা খানম বুজলেন তার স্বামী বেশ রোমান্টিক মুডে আছে।তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন
-“আমার সিনিয়র অ্যাডভোকেট আতিক স্যার কে মনে আছে তোমার?”

-“হে।ওই যে টাক পড়া লোকটা?”

সাবা খানম রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন
-“এইসব কোন ধরনের কথা?”

জুবায়ের আহমেদ মুচকি হেসে বললেন
-“আচ্ছা সরি।কি বলছিলে বলো?”

-“ওনার ছেলে রওশান কে একবার দেখিয়েছিলাম মনে আছে?”

-“হুম মনে আছে।বেশ সুদর্শন ছেলেটা।”

-” হুম। এমবিবিএস করে বর্তমানে একটি সুনামধন্য হসপিটালে জয়েন করেছে।সেদিন আবার দেখা হলো ছেলেটির সাথে।বেশ সুদর্শন ও মার্জিত ব্যাবহার দেখলাম।আতিক স্যার তার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।”

-“বলো কি?ওই বাচ্চা ছেলের জন্য ওই টাকলা তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?”

সাবা খানম ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।মানুষটি কখনোই সিরিয়াস হতে পারে না।তিনি রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন
-“খবরদার আমাকে রাগবে না।আমার বিয়ের প্রস্তাব দিবে কেনো?তিনি আরজুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।”

-“আরজুর বিয়ে? এখনো আরজুর স্টাডি শেষ হয়নি।তার আগে কিসের বিয়ে?”

-“আরে বাবা তারা তো এক্ষনি বিয়ের কথা বলছে না।যদি সবার পছন্দ হয় তবে এনগেজমেন্ট করে রাখতে চাইছে।”

-“যাই হোক।তবে আরজুর মতামতের বাইরে আমি কিছুতে মত দিবো না।আমি চাইনা আমাদের কোনো ডিসিশন আরজুর উপর চাপিয়ে দিতে।”

-“অবশ্যই আরজুর মতামতের ভিত্তিতে আমরা আগাবো।আগে আরজু দেখুক তার পর ওর ইচ্ছেতেই সব হবে।তবে ছেলেটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।আমার মেয়েটা ওই পরিবারে বেশ ভালো থাকবে।স্যারের ওয়াইফ বেশ আন্তরিক।আরজুকে মেয়ের মতো রাখবে।আমি জানি আরজু বেশ সেনসিটিভ আর ইমোশনাল।তাইতো ওকে আমি সব সময় ভালোবেসে আগলে রেখেছি।মায়ের অভাব যেনো ফিল না করে সেই প্রচেষ্টা করেছি।এই মেয়েটাকে দায়িত্বশীল হাতে তুলে দিতে পারলে আমি শান্তি পাবো।মেয়েটা অবহেলা জিনিসটা একদম নিতে পাড়ে না।আরজুকে নিয়ে আমার ভয় হয়।ও বেশ আবেগী মেয়ে।আবেগী হয়ে যদি জীবনে কোনো ভুল ডিসিশন নিয়ে ফেলে।”

জুবায়ের আহমেদ সাবা খানমের কাধে হাত রেখে বললেন

-“তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো।আমাদের আবেগী,আহ্লাদী আরজু কোনো ভুল ডিসিশন নিবে না।ওর উপর আমার ভরসা আছে।আরজুর সংবেদনশীল হলেও তার মধ্যে একটা শক্ত ব্যাক্তিত্ব বোধ আছে।যেটা সে সব সময় প্রকাশ করে না।কিন্তু সময় আসলে এই ইমোশনাল মেয়েটাই শক্ত রূপ ধারণ করার ক্ষমতা রাখে।শুনো,আরজুকে সেই ছোট বেলা থেকে দেখেছি।মেয়েটা ভালোবাসার কাঙাল।প্রিয়জনদের সামান্যতম ভালোবাসা পেলে মেয়েটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।তোমাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।তোমার সব ডিসিশন কে আরজু যথাযথ সম্মান করবে সেটা আমি জানি।কিন্তু আমি চাইনা সে বিয়ের বিষয়টি কোনো প্রেসারে বা তোমাকে আমাকে খুশি করতে করুক।আরজুর মন যদি সায় দেয় তবেই এই বিষয়ে আগাবো।”

সাবা খানম সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন
-“আরজু শুধু আমাকে না তোমাকেও ভীষণ ভালোবাসে।”

জুবায়ের আহমেদ হেসে বললেন
-“আমাকে তো তোমার চাইতেও বেশি ভালোবাসে।তার সবচাইতে প্রিয় মানুষটি তার বাবা।আমাকে সেই স্থানটি দিয়েছে।”

সাবা খানম হাসলেন।প্রশান্তির হাসি।

**********
দরজার করাঘাতে আরজুর নিদ্রায় বেঘাত ঘটলো।সে চোখ মুখ কুঁচকে পিটপিট করে তাকালো।মাথা তুলতে যেয়ে বুঝতে পারলো মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।মনে হচ্ছে মাথার শিরা উপশিরা ফেটে যাচ্ছে।সে দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো।ততক্ষনে দরজার বাইরে শুভর গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।আরজু পাশে তাকিয়ে দেখলো জারা গভীর নিদ্রায় মশগুল।আরজু উঠে হেলতে হেলতে দরজা খুলতেই শুভ রেগে বললো

-“এতো সময় লাগে দরজা খুলতে?”

শুভর উচ্চ বাক্য আরজুর মাথার যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে তুললো।মাথায় চেপে ধরে রেগে বললো
-“চেচাচ্ছিস কেনো?উফফ!ব্যাথায় শেষ হয়ে যাচ্ছি।”

শুভ কড়া চোখে তাকিয়ে বললো
-“এখন ব্যাথা হচ্ছে তাই না?রাতে ওইসব ছাই পাস গিলতে মানা করে গেছিলাম না?শুনিস নি কেনো?তোদের সব কয়টারে পাহাড় থেকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া প্রয়োজন ছিলো।”

-“উফফ!সকাল সকাল লেকচার দিচ্ছিস কেনো?বিরক্ত লাগছে।”

শুভ বুজলো আরজুর মাথায় হয়তো খুব বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে।সে নিজের রাগকে গিলে নিয়ে দুই গ্লাস ল্যামোনেট এনে এক গ্লাস ছোট্ট টেবিলে রেখে অন্য গ্লাসটি আরজুর হাতে দিয়ে বললো

-“ঝটপট গ্লাসটি ফাঁকা কর।দেখবি হ্যাংওভার কেটে গেছে। যন্ত্রণাও কমে যাবে।”

আরজু চোখ মুখ কুঁচকে গ্লাসটি ফাঁকা করলো।শুভ বললো
-“এখন শাওয়ার নিয়ে নে।দেখবি ফ্রেস লাগছে।”

বলেই শুভ আরজুর ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে দিলো।আরজু ওয়াসরুমে জামা নিয়ে ভেতরে চলে গেল।শুভ বিছানায় তাকিয়ে দেখলো জারা শান্তিতে ঘুমুচ্ছে।শুভর জারার এই শান্তির ঘুম মোটেও সহ্য হলো না।রাতে এতো কিছু করে কি নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে সে।শুভ এক গ্লাস পানি জারার মুখে ছুড়ে মারলো।জারা লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করে বললো

-“ও মাগো! ডুবে গেলাম।বাঁচাও বাঁচাও।”

শুভ ব্রু কুচকে দিলো এক ধমক।জারা ভালো করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো শুভ তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।জারা বেশ বিরক্ত হলো।হঠাৎ অনুভব করলো মাথায় বেশ ব্যথা করছে। শুভ রেগে বললো
-“তোদের সব কয়টাকে যে কি করতে ইচ্ছে করছে?গরু ছাগলের দল নিয়ে ঘুরছি।”

-“সমস্যা কি তোদের?এইখানে আসার পর থেকে একদিনও শান্তি মতো ঘুম থেকে উঠতে পারিনি।সবাই খালি পানি ছুড়ে মারছিস।”

-“তোকে তো পাহাড় থেকে ছুড়ে মারা দরকার।”

-“সকাল সকাল আমার পেছন পড়েছিস কেনো?এমনি মাথা ব্যাথা করছে।”

শুভ জারার দিকে লেবু পানি এগিয়ে দিয়ে বললো
-“এইটা খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর।আর জলদি রেডি হয়ে নে।নাস্তা করেই আমরা সাজেক ছাড়বো।”

শাওয়ারের নিচে বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে আছে আরজু।রাতে আসলেই এতো বেশি ড্রিংক করা ঠিক হয়নি।মাথাটা খুব ধরে আছে।কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে আরজু ভিজতে লাগল।এতে করে যদি মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হয়।কিছু একটা মনে পড়তেই চট করে চোখ দুটো খুলে ফেললো।হঠাৎই বিস্ময় নিয়ে আরজু দুই হাত দিয়ে নিজের ওষ্ঠ জোড়া চেপে ধরলো।চোখ বড় বড় করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।ওই সব নিশ্চই স্বপ্ন ছিল।বাস্তবে এমন কিছু হওয়াটা অসম্ভব।হাজারো ভাবনার মাঝে আরজু দ্রুত আয়নার সামনে দাড়ালো।নিজেকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে স্তব হয়ে গেলো।তার সারা শরীর অস্বাভাবিক কাপতে লাগলো।তার ঠোঁট জোড়া ফুলে আছে।আর নিচের ঠোঁট হালকা কেটে গেছে।আরজু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে।

*******
সবাই ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে।আজ তারা সাজেক ছেড়ে বিলাইছড়ি যাবে।সেখান থেকে আর্মি ক্যাম্প থেকে পারমিশন নিয়ে মুপ্পোছড়া ঝর্ণা ও ন- কাটা ঝর্ণা দেখবে।তারপর আজ রাতের বাসে বাসায় ফিরে যাবে।শুভ সবাইকে নাস্তা শেষ করে ব্যাগ প্যাক করতে বললো।সবাই চুপচাপ নাস্তা করছে।সকাল সকাল শুভর ঝাড়ি খেয়ে আজ সবাই অনেকটা শান্ত।তবে সবচাইতে বেশি বকা শুনতে হয়েছে ফুয়াদকে।বেচারা মুখটা মলিন করে রেখেছে।

সাবিহা ঘুম থেকে উঠে কাল রাতের কথা কিছুই মনে করতে পারছে না।লাবণ্য আপুর চক্করে পরে ওদের এতো ড্রিংক করা ঠিক হয়নি।রামিম ও সকাল থেকেই তাকে এভোইট করে চলছে।সাবিহার এখন কষ্টে কাদতে মন চাইছে।মুখ ফস্কে উল্টা পাল্টা কিছু বলে ফেলেছে কিনা কে জানে?

রামিম মনোযোগ দিয়ে নাস্তা করছে।একবারও সে সাবিহার দিকে তাকায়নি।সকাল থেকে কোনো কথাও বলেনি।সে সাবিহার মনে কোনো রকম আশার সঞ্চার করতে চায় না।তার জীবনের কঠিন বাস্তবতার সাথে এই মেয়েটি কোনো দিনও মানিয়ে নিতে পারবে না।

সব সময় বেশি কথা বলা ফুয়াদ আজ অনেকটা নিশ্চুপ।ফুয়াদকে চুপচাপ দেখে শুভর খারাপ লাগলো।এতো বকা ঝকা করা ঠিক হয়নি।তাই শুভ বললো

-“কীরে আমার উপর রাগ করেছিস?দেখ রাগ করলেও কিছুই করার নেই।তোর দায়িত্বে আমি ওদের রেখে গেছিলাম।তোর একটু সিনসিয়ার হওয়া দরকার ছিলো।ওই অবস্থায় অচেনা একটা জায়গায় মেয়েগুলার যে কোনো বিপদ হতে পারত। এখন মুখ গুমরা করে রাখিস না।তাহলে পুরো ট্রিপ টাই মাটি হয়ে যাবে।”

ফুয়াদ হেসে বললো
-“শালা তোর ওই বকা আমার গায়ের পশমেও লাগে নাই।বেটা হাংওভার এখনো কাটে নি।মাথা ধরে আছে।এই সব আমাদের অভ্যাস আছে নাকি?তাই শরীর খারাপ লাগছে।একটা কড়া করে কফি অর্ডার দে।একদম চাঙ্গা হয়ে যাবো।”

ফুয়াদের কথায় সবাই হেসে উঠলো।কিন্তু আরজু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।শুভ আরজুর কানে ফিসফিসিয়ে বললো

-“বকেছি বলে রাগ করেছিস?আচ্ছা সরি।মাফ করে দে।আর বকবো না।”

বলেই ফুয়াদ দুই হাতে কান ধরলো।আরজু মুচকি হেসে বললো

-“কান ধরলে হবে না।বাসায় ব্যাক করে আমাকে শপিং করে দিতে হবে।তবেই তোকে মাফ করবো।”

আরজুর কথা শুনে জারা বললো
-“ওই ছাগল তুই আমাকেও বকা ঝকা করেছিস।আমাকে ও শপিং করতে নিয়ে যাবি।আড়ংয়ে টুয়েন্টি ফাইভ পারসেন্ট অফ চলছে।”

শুভ মুচকি হেসে বললো
-“যা নিয়ে যাবো।তোদের সব কয়টাকে ক্যান্ডেল কিনে দিবো।জারা ক্যান্ডেল এ অফার চলছে তো?”

জারা মুখ ভেংচে বললো
-“কুত্তা! একশো টাকার ক্যান্ডেল কিনে দিবে বলছে তার উপর আবার অফারও চাইছে।হার কিপটা কোথাকার।”

আরজু ওদের কথা শুনে হেসে উঠলো।কিন্তু ওর ভেতরে কি উথাল পাথাল চলছে কাউকেই বুঝতে দিলো না।

ফুয়াদ কফিতে চুমুক দিতে দিতে আড়চোখে রিমির দিকে তাকালো।গতকাল রাতে রিমি যা বলেছে সেটা কি আসলেই সত্যি?নাকি সবটাই নেশার ঘরে বিলাপ করেছে?রিমি শুভকে ভালোবাসে এইটা সে ভাবতেই পারেনি।রিমি একটু চাপা সভাবের মেয়ে।কিন্তু ওর বিহেভিয়ার দেখে কখনোই বিষয়টি ফুয়াদ ধরতে পারেনি।আচ্ছা শুভ কি বিষয়টি জানে?

রিমি নেশার ঘোরে নিজের মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত অনুভূতি ফুয়াদের কাছে প্রকাশ করে ফেলেছে।ফুয়াদ তখন বেশ চমকে গেছিলো।শুভর মনে যে শুধুই আরজু এটা সে ভালো করেই জানে।কিন্তু আরজু কি চায় কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।তবে নাহিদের প্রতি আরজুর বেশ দুর্বলতা আছে সেটা ফুয়াদ বুঝতে পারছে।কিন্তু সেটা জাস্ট আবেগ নাকি আরো গভীর কিছু সেটা বুঝতে পারছে না।অন্যদিকে সাবিহা আর রামিমের মধ্যে তো অনেক আগে থেকে একটা লুকোচুরি চলছে।এই অনুভুতির লুকোচুরি তাদের এই বন্ধুমহলকে ভেঙে চুরমার করে দিবে না তো? আগামী সময় গুলোতে তাদের এই বন্ধুত্ব সম্পকে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হবে না তো?এমন হাজারো চিন্তা ফুয়াদের মাথায় চলছে।রাতে সে এইসব চিন্তার মাঝেই খুব বেশি ড্রিংক করে ফেলেছিল।

*********
আরজু রুমে ঢোকার পূর্বে আশেপাশে তাকাচ্ছিল।মনে মনে সে কাউকে খুঁজছে।জারা বুঝতে পেরে বললো
-“তোর নেতা সাহেবকে খুঁজছিস?”

আরজু স্থির হয়ে বললো
-“কই না তো।”

-“বুঝি বুঝি।আমার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই।”

-“তুই বেশি বুঝিস।”

তাদের কথার মাঝেই দূরে লাবণ্যকে দেখতে পেলো তারা।হাতে ব্যাগ নিয়ে এই দিকেই আসছে।আরজুর চোখ তখন শুধু একজনকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে।আরজু আর জারাকে দেখে লাবণ্য মুচকি হেসে বললো

-“কি অবস্থা তোমাদের?হাংওভার কেটেছে?”

জারা হেসে বললো
-“জি আপু।আপনারা কি ব্যাক করছেন?”

লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-“হুম।আরো একদিন আমাদের থাকার কথা ছিলো।কিন্তু আমাদের বিজি ম্যান মহা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।একের পর এক কল আসছে তার।তাইতো একদিন আগেই ব্যাক করতে হচ্ছে।”

জারা কপাল কুঁচকে বললো
-“বিজি ম্যান?”

লাবণ্য শব্দ করে হেসে বললো
-“আরে নাহিদের কথা বলছি।আমাদের মেয়র সাহেব।ওর তো হাজারো ব্যস্ততা।দম ফেলার টাইমটুকু নেই।খুব কষ্টে ওকে রাজি করিয়ে নিয়ে এসেছিলাম এই ট্রিপে।কিন্তু এসেও আমাদের ঠিক মত সময় দিতে পারছিল না।পার্টি অফিস থেকে একের পর এক কল আছে।তাই তো গতকাল রাতেই ও আর আসফি চলে গেছে।”

আরজু বিস্ময় নিয়ে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে আছে।নাহিদ চলে গেছে?সে এভাবে কি করে চলে যেতে পারে?একটা বার কি তার মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না?
এই লোকটিকে সে যতোটা ভালো ভেবেছে ততটা ভালো সে না।ধূর্ত লোক। কাল রাতে তার নেশার সুযোগ নিয়ে চুমু খেয়েই সাজেক থেকে পালিয়েছে?ভীতুর ডিম একটা। আরজু না হয় নেশার ঘোরে আগে পাগলামিটা শুরু করেছিল।কিন্তু ওই ভন্ড নেতা কেনো এমন করলো?লোকটি তো তার দিকে ঠিক মতো তাকায়না পর্যন্ত।তাহলে হঠাৎ এমন ব্যাবহারে মানে কি?

এই সব ভাবতে ভাবতে আরজুর দু চোখ ভিজে উঠলো।জারা আরজুর মন খারাপ বুঝতে পেরে বললো

-“কিন্তু হঠাৎ এভাবে চলে গেলে কেন কোন সমস্যা হয়েছে?”

-“ঠিক জানি না।মনে হয় কোনো ইমারজেন্সি এসে পড়েছিল।তাই তো এতো রাতেই তাদের ব্যাক করতে হয়েছে।আসলে রাজনীতি বেশ জটিল বিষয়।নিজের পার্সোনাল লাইফ বলতে কিছুই থাকে না।দিন নেই রাত নেই।চব্বিশ ঘণ্টাই তারা কাজে ডুবে থাকে।”

জারা বললো
-“কিন্তু আসফি ভাইয়া কেনো গেলো?তিনি তো পলিটিক্সে জড়িয়ে নেই।”

লাবণ্য হেসে বললো
-“আসফি হলো আরো বড়ো পলিটিশিয়ান।”

জারা বিষয় নিয়ে বললো
-“মানে?”

-“বর্তমানে লয়াররা পলিটিক্সের শিরা উপশিরা অব্দি অবগত থাকে।এদের মাথা থেকেই বরং কুটিল বুদ্ধি গুলো আসে। আসফি নাহিদের বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে সাথে নাহিদের লয়ার ও।নাহিদের সকল লিগ্যাল বিষয় গুলো আসফি হ্যান্ডেল করে। মানে নাহিদের সকল কাজকর্মের আইনের দিকটা তাকেই সামাল দিতে হয়।আর লয়েরদের প্রফেশন তো বুঝোই। ইলিগ্যাল কেও লিগ্যাল করে ফেলতে এক মিনিটও লাগে না।”

জারা মুচকি হাসলো। আসফি কে যতোটা সহজ সরল ভেবেছে মানুষটি মোটেও তেমন নয়।দুই বন্ধুই কেমন রহস্যজনক। লাবণ্য হেসে তাদের কাছথেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।জারা আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো

-“এতো আপসেট হচ্ছিস কেনো?কিছু হয়েছে? ব্যাক করে তো নেতা সাহেবকে আবারও দেখতে পারবি।আচ্ছা বাসায় যেয়ে একটা লম্বা চওড়া চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিস। নাও চিল কর।”

আরজু কিছু না বলেই রুমে চলে গেলো।তার শরীর ও মন কোনোটাই ভালো লাগছে না।যখন মন অসুস্থ হয় তখন শরীরের তার প্রভাব পড়ে।তার মনের ভেতর অনুভূতির তুমুল ঝড় সৃষ্টি করে লোকটি পালিয়ে গেলো।আরজু তো কিছুতেই সেই সময়টাকে ভুলতে পারছে না।সেই স্পর্শ তার হৃদয়ে গভীর অব্ধি ছুঁয়ে গেছে।সেই মুহূর্তের পাগল করা অনুভূতি গুলো কি করে ভুলবে আরজু?এমন হৃদয় ঝালানো স্পর্শ আগে অনুভব করেনি।এতো কিছুর পরও তার বেহায়া মন সেই হৃদয়হীন মানুষটির কাছে ছুটে যেতে চাইছে।হাজারো প্রশ্ন করতে চাইছে।এই ভাবে অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে নিজেই কেনো হাওয়া হয়ে গেলো মানুষটি?নাকি মানুষের মন পড়ার ক্ষমতা ওই পাষাণ হৃদয়ের নেই?

#মিষ্টি_রোদের_হাতছানি
#israt_jahan_arina
#part_19

প্রচন্ড রকম অস্থিরতা আর অসস্তি নিয়ে সারাটা দিন বিলাইছড়ি কাটিয়েছে আরজু।কেনো যেনো বিগত দিন গুলোর মত এই দিনটিতে উৎসাহ খুঁজে পেল না। জারা বার বার প্রশ্ন করলেও আরজু তেমন কিছুই বলেনি।মন কেনো এত এলোমেলো হয়ে আছে কি করে বলবে?

এই দিনটি ঠিক এতটাই অস্থিরতায় কেটেছে সাবিহার।রামিম তাকে প্রচন্ড রকম উপেক্ষা করছে।এই কয়েকদিন তো বেশ ভালোভাবে তার সাথে মিশেছে।সাবিহার কত খেয়াল রেখেছে।তবে গত কাল থেকে আবার এভয়েড করছে।রামিম এর এই ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন সাবিহাকে প্রচন্ড রকম কষ্ট দিচ্ছে।কি চায় এই ছেলে?সাবিহাকে তার পেছনে চরকির মতো ঘুরিয়ে মজা নিতে চায়?

রাতে বাসে উঠার আগেই আরজুর গা কাঁপিয়ে জ্বর চলে আসলো। শুভ ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল।স্থানীয় একজন ডক্টর কে দেখিয়ে আরজুকে মেডিসিন দেওয়া হল।ফুয়াদ আরজুর ঘাড়ে হালকা চাপর মেরে বললো

-“তোদের মতো ফুল কলিদের নিয়ে আমি আর এই জনমে কোনো ট্রিপে যাবো না।এক একটার অবস্থা দেখ?মনে হচ্ছে আর্মি ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরছে।এক একটা ননীর পুতুল।আন্টি তোর এই জ্বর দেখে আমাদের নামে কেস ঠুকে দিবে।বিশেষ করে শুভর নামে।”

আরজু বাসের সিটে কম্বল চাপিয়ে শুভর কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ রেখেই বিরক্ত হয়ে বললো
-“মাথা ধরে আছে।কথা কম বল।নিজের সিটে যেয়ে বস তো।আমাকে একটু ঘুমাতে দে।”

শুভ বললো
-” তুই যা।আমি দেখছি।বাঁদর টা একটু ঘুমাক।”

সাবিহার পাশে রিমি বসেছে।ফুয়াদ পেছনের সিটে যেয়ে দেখলো জারা রামিমের পাশের সিটে আরাম করে বসেছে।ফুয়াদ কপাল কুঁচকে বললো

-“এই ফাজিল তুই আমার সিটে কি করিস?”

জারা নিরলস ভাবে বললো
-“তোর সিট মানে?নাম লেখা আছে নাকি?”

-“মজা পড়ে নে।তুই পিছনের সিটে যা।”

-“অসম্ভব।ওই সিটে পাশে কে না কে বসে।আমি রমিমের সাথেই ঠিক আছি।তুই সিঙ্গেল সিট কেনো নিলি না?সিঙ্গেল হলে নাচতে নাচতে চলে যেতাম।”

ফুয়াদ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-“কুত্তী তুই সিঙ্গেলই মরবি।”

-“যা যা আমার কথা ভাবতে হবে না।”

ফুয়াদ মন খারাপ করে পেছনের সিটে বসে পড়লো।মিনিট খানেক পরই একজন সুন্দরী রমণী ফুয়াদের পাশের সিটে এসে বসে।ফুয়াদ তো রীতিমতো অবাক।মনে যেনো লাড্ডু ফুটতে লাগল।জারার নম্বরে এসএমএস পাঠালো

-“থ্যাংকস দোস্ত।তুই কুটনামি না করলে এই সুন্দরীর সান্নিধ্য পেতাম না।”

জারা দ্রুত পিছন ফিরে তাকালো।পিটপিট করে তাকিয়ে আছে সে।ফুয়াদ জারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চোখ টিপ মারলো।জারা নাক মুখ কুচকে সামনে ফিরে তাকালো।একটু পর শুনতে পেলো ফুয়াদের কথার শব্দ।সে ওই মেয়ের সাথে অলরেডি কুসলাদী বিনিময় পর্ব শেষ করে ফেলেছে।মেয়েটার হালকা হাসির শব্দ জারার কানে ভেসে আসছে।সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রামিমের উদ্দেশে বললো

-“এই ছাগল কি জীবনে সুধ্রাবে না?মেয়ে দেখলেই ফ্লার্ট করা শুরু হয়ে যায়।”

-“কি জানি?হয়তো একসময় ওর জীবনে এমন কেউ আসবে যে এই দুষ্টু ফুয়াদকে নিজের ভালোবাসায় কুপোকাত করে ফেলবে।”

-“আল্লাহ!!জলদি যেনো আসে।আর এই ছাগলের গলায় যেনো শক্ত দড়ি ঝুলিয়ে দেয়।”

রামিম জারার কথায় হাসলো।
**********
সকালে বাসায় পৌঁছেই শুভকে এক ঘাধা বকা শুনতে হলো সাবা খানমের কাছে।আরজুর জ্বর তখন কিছুটা কমেছে।কিন্তু আরজুর শুকনো মুখ দেখে সাবা খানমের অস্থিরতা বেড়ে গেলো।আরজু তাকে শান্ত করে শুভকে বাসায় পাঠিয়ে দিলো।

-“এমন জ্বর বাধালি কি করে?নিশ্চই ঝর্নার পানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিজেছিস?”

আরজু কি বলবে বুঝতে পারছে না।পানিতে তো সে খুব বেশি ভিজেনি।তবুও কেনো জ্বর এলো?তবে কি এটা অনুভূতির জ্বর?” নাকি মানুষটি তাকে স্পর্শ করায় তার গা কাঁপিয়ে জ্বর চলে এসেছে?” সঠিক কারণ আরজুর জানা নেই।
সারাদিন আরজুর শরীর বেশ ভালো ছিলো।জুবায়ের আহমেদের সাথে আর অবনির সাথে অনেক গল্পঃ করলো।মেঘের রাজ্যের গল্পঃ।অবনির তো বর্ণনা শুনে তখনই সাজেক চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। সারাদিনে শুভ বেশ কয়েকবার এসে দেখা করে গেছিলো।আরজুর পছন্দের নানান খাবার নিয়ে এসেছে।কিন্তু অরুচির জন্য তেমন কিছুই আরজু খেতে পারেনি।আরজুর অসুস্থতায় ছেলেটা বড্ডো অস্থির হয়ে পড়ে।

সারাদিন ভালো কাটলেও মধ্যে রাতে তার আবার জ্বর আসে।উত্থাল পাথাল জ্বর।তার পাশে তখন অবনি ঘুমিয়ে ছিলো।আরজু অসুস্থ ছিলো বলে সে আজ আর আরজুকে ঝালায় নি।কোনো ঝগড়াও বাঁধায়নি।আরজুর বির বির শব্দে অবনির ঘুম ভেংগে যায়।সে উঠে দেখে আরজু ভীষণ কাপছে।আর কিছু বির বির করছে।অবনি চিন্তিত হয়ে দ্রুত কম্বল আরজুর গায়ে চাপিয়ে দেয়।গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।অবনি ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করে আরজু কি বলছে।

-“না..নাহিদ, না…হিহি.. দ।”

আরজুর কথা শুনে অবনির মাথায় হাত।এই জ্বরের ঘোরে তার পাগল বোন ক্রাসের নাম জপছে? আব্বু আম্মু শুনলে সর্বনাশ।অবনি দ্রুত আরজুর মাথায় জল পট্টি দিতে শুরু করে।এতে যদি একটু জ্বর কমে।অবনির ভীষণ কান্না পাচ্ছে।আরজু অসুস্থ হলেই অবনির এমন কান্না পায়।মিষ্টি আরজুর মুখে বিষাদ যেনো অবনি একদম সহ্য করতে পারে না।কিন্তু তার বোন যেই ভাবে নাহিদ নাহিদ করছে সেই ভয়ে তো বাবা মাকেও ডাকতে ভয় পাচ্ছে।

একটু পরই সাবা খানম আসে রুমে আরজুকে দেখতে।তার কিছুতেই ঘুম আসছিলো না।আরজু বা অবনি একটু অসুস্থ হলেই তার খাওয়া, নিদ্রা সব উড়ে যায়।অবনীকে জল পট্টি দিতে দেখে তিনি হন্ত দন্ত করে রুমে ঢুকলেন।তাকে না ডাকার কারণে অবনীকে বেশ কিছুক্ষন বকা ঝকা করলেন।আর বললেন দ্রুত বালতিতে করে পানি আনতে।অবনি দ্রুত ওয়াসরুমে চলে গেলো।জুবায়ের আহমেদ এসে আরজুর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।ঠিক তখনই আরজু আবার বির বির করতে লাগলো।সাবা খানম আরজুর মুখে নাহিদ নামটি শুনে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন। ভীত চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন।আরজুর মেয়র নাহিদকে ভালো লাগে এই বিষয়টি তিনি জানতেন।কিন্তু বিষয়টি এতটা গভীর সেটা তিনি ধারণা করতে পারেননি।নিতান্তই দুষ্টুমি ভেবে নিয়েছেন।হঠাৎ করেই সাবা খানমের সারা শরীর কেঁপে উঠলো।জুবায়ের আহমেদ সব বুঝতে পেরে স্ত্রীকে সান্তনা দিলেন।

-“আরে জ্বরের ঘোরে উল্টা পাল্টা কথা বলছে।তুমি অযথা চিন্তা করছো কেনো?”

-“জুবায়ের আমার ভীষণ অস্থির লাগছে।মেয়েটা ভুল পথের দিকে আগাচ্ছে।এমনটা কখনোই সম্ভব না।ওকে থামাতে হবে।”

-“তুমি শান্ত হও সাবা।এমন কিছুই হবে না। রিলেক্স।”

সারাটা রাত বাসার কেউই ঠিক মত ঘুমাতে পারলো না।সে রাতে আরজু কখনো নাহিদ তো কখনো নেতা সাহেব বলে বির বির করেছে।

সাবা খানমের মাথায় চলছে হাজারো চিন্তা।সময় থাকতেই আরজুকে সামলাতে হবে।নাহলে পড়ে আফসোস করা ছাড়া উপায় থাকবে না।জীবনটা যতোটা সহজ ভাবে আরজু জীবন আসলে ততটা সহজ নয়।জীবনের কঠিন বাস্তবতা আজও দেখেনি আরজু।তাই সব কিছু রঙিন মনে হচ্ছে।এই ইমোশনাল মেয়েটা না জানি কোন বোকামি করে বসে।সাবা খানম মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।আরজুর জীবনে আসা সকল বিপদকে তিনি উপড়ে ফেলবেন।

**********
সকালে ফুয়াদের মা বাবা বসেছেন ব্রেকফাস্ট করতে।টেবিলে পরোটা,গরুর মাংস দেখে কপাল কুঁচকে লামিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন

-“সকাল সকাল এইসব ভারী নাস্তা কেনো বানিয়েছো?তুমি জানোনা আমরা এতো হেভি ব্রেকফাস্ট করতে পছন্দ করিনা?”

লামিয়া টোস্ট আর ডিমের অমলেট তাদের পাশে এগিয়ে দিয়ে বললো

-“ম্যাম আপনাদের জন্য লাইট ব্রেকফাস্টের বেবস্থা করে রেখেছি।এই সব তো ছোট স্যারের জন্য বানিয়েছি।”

তারা দুজনেই অবাক হয়ে লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো
-“ফুয়াদ বাসায় এসেছে?”

-“জি খুব ভোরেই নাকি এসেছে।দারোয়ান চাচা তো তাই বললো।”

ঠিক তখনই ফুয়াদ ফোন চাপতে চাপতে টেবিলে এসে বসলো।ফুয়াদের মা খুশি হয়ে বললেন

-“গুড মর্নিং মাই বয়।কখন এসেছ তুমি?”

ফুয়াদ দৃষ্টি ফোনের দিকে রেখেই বললো
-“ভোরে।”

ফুয়াদের বাবা হেসে বললেন
-“তা কেমন কাটলো তোমাদের ট্রিপ।”

-“ভালো।লামিয়া নাস্তা দাও।”

ফুয়াদের বাবা বুঝতে পড়লেন ছেলে তাকে ইগনোর করছে।তাই তিনি তেমন কথা বাড়ালেন না।ফুয়াদের মা লামিয়ার দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন

-“এইসব কেনো বানিয়েছো?ফুয়াদ এইসব মোটেও পছন্দ করে না।তোমার পছন্দ মতো আমাদের নাস্তা করতে হবে নাকি?যতসব!! ওকে টোস্ট করে দাও।নেক্সট টাইম এমন হলে আর কাজে আসার প্রয়োজন নেই।”

লামিয়ার দু চোখ ভরে উঠলো।ভীষণ কান্না পাচ্ছে।কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো।সেদিন ফুয়াদ এই নাস্তা বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিল।তাই তো আজ সে এইসব বানিয়েছে।সে টেবিল থেকে পরোটার প্লেট নিতে গেলে ফুয়াদ হাতের ফোন রেখে দুইটা পরোটা নিজের প্লেটে নিয়ে নিল।গরুর মাংস নিতে নিতে বললো

-“সকাল সকাল আমার পছন্দের ব্রেকফাস্ট তৈরি করার জন্য থ্যাংকস লামিয়া।নাহলে অনেকেই জানেনা যে এটা আমার ভীষণ পছন্দের ব্রেকফাস্ট।তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে এতো দিক সামলাও কি করে? ভেরি ইমপ্রেসিভ।”

তারপর সে বেশ তৃপ্তি সহকারে খেতে লাগলো।ফুয়াদের মা আহত দৃষ্টি নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।ছেলের সাধারণ পছন্দ গুলোও তিনি জানেন না?নাকি নিজের পছন্দ এতদিন ছেলের উপর চাপিয়ে এসেছেন?

লামিয়া কয়েক মুহূর্ত ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো।এই মানুষটিকে তার অদ্ভুত লাগে।ভীষণ অদ্ভুত।

*********
রামিমের সকালের ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের মিষ্টি ডাকে।তার মা পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।রামিম মুচকি হেসে বললো

-“আই মিস ইউ মা।”

-“বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘুরতে যেয়ে এই মাকে মিস করেছিস? অদ্ভুত তো?”

মায়ের কোলে মাথা রেখে রামিম বললো
-“ট্রাষ্ট মী মা।তোমাকে আমি অলয়েজ মিস করি।তোমাকে কয়েকদিন না দেখলে চোখে অন্ধকার দেখি।”

-“তুই তো আমার ছেলের বউয়ের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিবি?”

রামিম কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো
-“মানে?”

-“শোন ছেলেদের মায়ের আঁচলের নিচে পড়ে থাকা বউদের পছন্দ না।তোর বউয়ের চোখের কাটা হয়ে যাবো।”

রামিম বির বির করে বললো
-“সাবিহা মোটেও এমন না মা।”

-“কিছু বললি?”

-“হুম!!না বললাম এমন মেয়ে আমি বিয়েই করবো না।”

তিনি হেসে বললেন
-” সাবিহাকে কিন্তু আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।মেয়েটা মনে হয় তোকে পছন্দ করে।”

রামিম থতমত খেয়ে গেলো।মেয়েটা নিজের অনুভূতি একটুও সামলাতে পারে না।তার মা অব্দি এই অনুভূতি পড়ে ফেলেছে।রামিম চট করে মায়ের কোল থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো

-“তুমি ভুল ভাবছো মা।সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো মেয়ে আমার মত চাল চুলোহীন একজনকে বন্ধুর বাইরে কিছুই ভাবতে পারে না।”

-“আর তুই?তুই ও শুধু বন্ধুই ভাবিস?”

রামিম কিছুটা থমকাল।পরমুহূর্তেই মায়ের কাছে এসে চিবুকে আলতো হাত রেখে বললো
-“আমার মত ছেলের এই অনুভুতির মায়ায় জড়ানোর সময় নেই মা।ওই রাজকন্যাকে রাজপ্রাসাদ থেকে এই কুঠিরে কি করে আনি বলো?সে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে।তাছাড়া আমাকে জীবনে অনেক ভালো কিছু করতে হবে।সফলতার জন্য সকল পরিশ্রম আমি করতে রাজি।শুধু দিন শেষে তুমি আমার পাশে থেকো মা।তাতেই চলবে।”

ছেলের কথায় ক্ষীণ বিষাদের ছাপ পেলেন তিনি।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-“আমি সব সময় পাশে থাকবো কিনা জানিনা।তবে দোয়া করবো তুই জীবনে সফল হ।কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস।যতই সফলতা অর্জন করিসনা কেনো দিন শেষে একান্ত নিজের করে কাউকে খুব প্রয়োজন পড়ে।তাই যে তোকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসবে তাকে নিজের কাছে ধরে রাখিস।জীবনের সবচাইতে বড় সফলতা হলো আপনজনদের খুশি রাখা।”

রামিম মুচকি হেসে ওয়াসরুমে চলে গেলো।ছেলের এই হাসির আড়ালে জমানো যন্ত্রণার ছাপ ঠিকই এই মমতাময়ী ধরে ফেললেন।

**********
সকাল থেকেই আরজু বাসার পরিবেশ কিছুটা থমথমে দেখলো।গত রাতে সে কি কাণ্ড ঘটিয়েছে সেটা মনে পড়তেই চুপসে গেলো।জ্বরের ঘোরে ওই অসভ্য লোকের নাম জপেছে সে?খালামণি কেমন রিয়েক্ট করে কে জানে।পলিটিক্স আর পলিটিশিয়ান দুটোই তার খালামনির ভীষণ অপছন্দের।নাহিদকে ও তার খালামণি খুব একটা পছন্দ করেনা।আর আরজু কিনা সেই মানুষটিকে ভালোবেসে বসে আছে।
সাবা খানম আরজুকে সকালের নাস্তা খাইয়ে মেডিসিন দিয়ে দিলো।তেমন কোনো কথাই বললো না।সবার নাস্তা শেষে করে তিনি চলে গেলেন অফিসে।জুবায়ের আহমেদ নিজেও আরজুকে এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি।আরজু বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়ে এই সবই ভাবছিল।ঠিক তখনই তার ফোন বেজে উঠে।আরজু দেখলো আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে।কল রিসিভ করে অপর পাশ থেকে গাম্ভীর্যপূর্ণ পুরুষালী কণ্ঠ পেয়ে সে থমকে গেলো।সারা শরীর শিউরে উঠলো।

-“মিস আরজু বলছেন?”

আরজু ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে।ওই গম্ভীর ব্যাক্তিত্বের মানুষটি তাকে কল করেছে?এটা ও কি সম্ভব?এই কণ্ঠস্বর চিনতে আরজুর মোটেও ভুল হবে না।কিন্তু মানুষটি তার নম্বর পেলো কোথায়?ইসস! কি ভাবছে আরজু?এই মেয়র নাহিদের লিংক কতো দুর পর্যন্ত বিস্তৃত সেটা হয়তো আরজু আন্দাজ করতে পারছে।

আরজুর মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বেরুচ্ছে না।বহু কষ্ট আরজু বললো
-“কে আপনি?”

-“আমি কে সেটা আপনি ভালো করেই জানেন আরজু।”

আরজু শুকনো ঢোক গিললো।নাহিদ কি মাইন্ড রিড করতে পারে নাকি?না ! মোটেও না।তাহলে আরজুর মনের খবর নিশ্চই বুঝতে পারতো।এই ভন্ড নেতা কোনো মাইন্ড রিডার টিদার কিছু না।আরজু বললো

-“আপনি হঠাৎ আমাকে কল করলেন?”

নাহিদ গলা পরিষ্কার করে বললো
-“শুনলাম জ্বরের ঘোরে নাকি কেউ আমার নাম জপছিল।ঘটনা কি সত্যি?”

আরজু থতমত খেয়ে গেল।নাহিদ কি করে এইসব জানে?আরজু কাপা কাপা গলায় বললো

-“না।”

নাহিদের মুচকি হাসির আভাস ফোনের এপাস থেকে আরজু উপলব্ধি করতে পারলো।ভীষণ লজ্জা আর অভিমান হলো আরজুর।

-“আপনি মিথ্যাটাও ঠিকমত বলতে পারেন না। যাই হোক, ভাবলাম একজন সচেতন,দায়িত্ববান মেয়র হিসেবে আপনার খোঁজ খবর নেওয়া প্রয়োজন।সামনে নির্বাচন আসছে।এক একটা ভোট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।আপনি নিশ্চই আমাকেই ভোট দেবেন?”

মুহূর্তেই রাগে আরজুর সারা শরীর জ্বলে উঠলো।অসভ্য লোক।ভোট পাওয়ার জন্য তার খোঁজ খবর নিচ্ছে?আর কে বলেছে তাকে দায়িত্ব পালন করতে?আরজু কারো দায়িত্ব হয়ে থাকতে চায় না।আরজু ক্ষিপ্ত হয়ে বললো

-“সাজেক থেকে না বলেই চলে এসেছেন কেনো আপনি?”

নাহিদ গলা খাদে নামিয়ে গম্ভীর হয়ে বললো
-“আমার কি বলে আসার কথা ছিলো মিস আরজু?”

আরজু থমকলো।আসলেই তো।আরজুকে কেনো বলে আসবে সে?তাদের মধ্যে তো কোনো সম্পর্কই নেই।আরজু মলিন গলায় বললো

-“আমার অসুস্থতার খবর আপনি জানলেন কি করে?”

-“একজন রেসপন্সিবল মেয়র হিসেবে অনেক কিছুই আমাকে জানতে হয়। যাই হোক।নিজেকে সামলে রাখতে শিখুন।নাহলে পরবর্তীতে শুধু আফসোস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।আবেগ জিনিসটি বড্ডো খারাপ।আপনাদের বয়সের মেয়েরা প্রায়য়শি আবেগে ভেসে যায়।আপনি নিশ্চই অতটা বোকা নন? ভালো থাকবেন আরজু।নিজের খেয়াল রাখবেন।”

বলেই নাহিদ কল কেটে দিলো।আরজু হ্যালো হ্যালো করতে লাগলো।সেই নম্বরে আবার কল ব্যাক করলো।কিন্তু নম্বরটি বন্ধ বলছে।আরজুর দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়লো।এই মানুষটি তাকে তুমুল অনুভূতির ঝড়ে ঘায়েল করেই পালিয়ে যায়।বিধ্বস্ত আরজুর হৃদয়ে খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। হৃদয়হীন মানুষটি কত সহজেই তার অনুভূতিকে আবেগ বলে তাচ্ছিল্য সাথে উড়িয়ে দিচ্ছে।নাহিদ নামক রহস্য মানবের রহস্য এই জনমে হয়তো সে ভেদ করতে পারবে না।মানুষটি তার শরীরের খবর নিলো কিন্তু মনের খবর নিলোনা।নেতারা বুঝি এমনি হয়।অনুভূতি শূন্য।

হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই আরজু জোরে চিৎকার করে অবনীকে ডাকতে লাগলো।অবনি দরজার পেছনেই লুকিয়ে ছিলো।আরজুর ডাক শুনেই ভয়ে দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।আর মনে মনে ভাবলো যেচে আর কোনো দিন কারো উপকার করবে না।