মিহুর সংসার পর্ব-০১

0
6637

#মিহুর_সংসার
#পর্বঃ১
© খাদেমুল আলম মিঠুন

বিয়ের তিনদিন পর বুঝতে পারলাম তুলি মেয়েটা খুব বোকা।শুধু বোকা বললে ভুল হবে কারন তার আচরণ অনেকটা শিশু সুলভ।সারাদিন টিভির সামনে বসে বাচ্চাদের মতো কার্টুন দেখছে।বাসা ভর্তি মেহমান কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই।সে সোফায় বসে কার্টুন দেখে কখনও হাসছে আবার কখনও মন খারাপ করে বসে রয়েছে।

যে সকল মেহমানরা নতুন বউ দেখতে এসেছে সবার সাথেই সে হাসিমুখে কথা বলছে।পরিচিত হওয়ার পর তাদেরকেও খুব সুন্দর করে কার্টুনের কাহিনী বুঝিয়ে দিচ্ছে।
মেহমান গুলো বাসা থেকে যাওয়ার সময় আমাকে বলছে,
– মিহু,তুমি খুব ভালো মনের একটা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছো।খুবই সহজ-সরল।

কিন্তু বিয়ের চতুর্থ দিন খেয়াল করলাম তুলির ভীষন মন খারাপ।বারবার ফোন বেজে যাচ্ছে কিন্তু সে ধরছে না।সকাল পেরিয়ে বিকাল হয়ে যাচ্ছে তবুও তার মনের অবস্থার কোনো উন্নতি দেখছি না।

এরপর তার কাছে গিয়ে বললাম,
– সকাল থেকে দেখে যাচ্ছি, আপনি মনমরা হয়ে বসে আছেন।ফোন বেজে যাচ্ছে, ধরছেন না।কেউ কি অপরিচিত নম্বর থেকে বিরক্ত করছে?

কষ্ট লুকানোর হাসি দিয়ে আমাকে সে জবাব দিল,
– অপরিচিত কেউ না,বান্ধবীরা ফোন দিচ্ছে।
– তাহলে ধরছেন না কেনো?
ওদেরকে কী বিয়েতে দাওয়াত দেন নি?

– সেরকম কিছু না।আসলে আমরা ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত গার্লস স্কুলে পড়েছিলাম তো ।ছয় বছর আগে এসএসসি পাশ করেছি,এরপর অনেকের সাথে দেখাও হয়নি।খুব পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা-বার্তা হয়।আজকে বিকেলে ছোট একটা পুণর্মিলনীর আয়োজন করা হয়েছে।অনেকেই আসবে শুনলাম।আমাকেও যেতে বলেছিল।যেতে পারবো না তো এই ভেবে কিছুটা মন খারাপ।

– আপনিও দেখা করে আসুন।এই আয়োজন তো আর সব সময় করা হবে না।আবার কবে হবে,সেটাও তো বলা যাচ্ছে না।
– বিয়ে হয়েছে মাত্র তিনদিন।এখনও তো বাসায় মেহমান রয়েছে।এই অবস্থায় যদি নতুন বউ বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরতে যায়, তাহলে সেটা কেউ ভালো চোখে দেখবে না।

আমি একটু ধমকের সুরেই বললাম,
– রাখেন তো আপনার চোখের হিসাব।আপনি তো কোনো খারাপ কাজ করতে যাচ্ছেন না।আপনি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকুন।আমি আপনাকে নিয়ে যাবো।

তুলিকে কথা গুলো বলে আমি মায়ের কাছে গিয়া বললাম,
– মা,আমি একটু তুলিকে নিয়ে বের হবো কিছুক্ষণ পর।ওর মনটা খুব খারাপ। নতুন পরিবেশে এসেছে তো।একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসলে বোধহয় ভালো লাগবে।

– আমিও তোকে এই কথাই বলতে চাচ্ছিলাম।বাবা-মা ছেড়ে নতুন পরিবেশে এসেছে, মন খারাপ হওয়াটা তো স্বাভাবিক।

মা’কে রাজি করিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকে আমি রিতীমত আশ্চর্য। যেই মেয়ে কিছুক্ষণ আগে মনমরা ছিল মুহূর্তের মধ্যেই সেই মেয়ে বিছানার মধ্যে চারটা শাড়ি একসাথে রেখে হাসিমুখে বসে আছে।
আমাকে রুমে ঢুকতে দেখে বলল,
– দেখেন তো কোন শাড়িটা পরবো?
লালটা দিয়েছে মামা,নীলটা দিয়েছে চাচ্চু,সবুজটা দিয়েছে খালু।আর কালোটা কে দিয়েছে মনে পরছে না।
– আপনার যেটা ভালো লাগে সেটাই পরুন।
– শুধু আমার ভালো লাগলে তো চলবে না।এতদিন পর সবার সাথে দেখা হবে।দেখেই যদি বলে, তোকে এই শাড়িতে মানাচ্ছে না।তাহলে কি ভালো লাগবে?

আমি চারটা শাড়ি হাতে নিয়ে বললাম,
– কালো রঙেরটা আপনাকে খুব মানাবে মনে হচ্ছে।তবুও আপনার যেটা ভালো লাগে সেটাই পরুন।
-আচ্ছা, তাহলে কালোটাই পরছি।
-ঠিক আছে।আপনি তাহলে দ্রুত তৈরি হয়ে নিন।

আমি দশ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে আধাঘন্টা ধরে সোফায় বসে রয়েছি।কিন্তু তুলির এখনও সাজগোজ হয়নি।প্রায় একঘণ্টা পর রুমের দরজা খুলার শব্দ শুনে রুমে ঢুকলাম।
আমাকে দেখে বলল,
-চলুন,দেরি হয়ে যাচ্ছে।ভালোভাবে সময় করে একটু সাজতেও পারলাম না।কালো শাড়িটার সাথে মিলিয়ে কোনো চুড়ি পরে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না।যাওয়ার সময় চুড়ি কিনে নিয়ে যেতে হবে।আপাতত একজোড়া দিয়ে চালিয়ে দিয়েছি।

– তাহলে তো আরও দেরি হবে।
– বেশিক্ষন লাগবে না।শুধু চুড়িই তো।

তার কথা মতো শপিং মলে ঢুকলাম।একটার পর একটা চুড়ি দেখেই চলেছে কিন্তু কোনোটাই নিচ্ছে না।হাতে যতটা আগ্রহ নিয়ে ঢুকাচ্ছে ঠিক ততটাই মনমরা হয়ে আবার হাত থেক বের করছে।

আমি বুঝতে পারলাম আজকে সারাদিনেও এই মেয়ে চুড়ি পছন্দ করতে পারবে না।
শেষমেশ আমি একজোড়া চুড়ি তুলির হাতে পরিয়ে বললাম,
-বাহ,খুব সুন্দর মানিয়েছে আপনাকে।এদিকে আমি চুড়ির রংটাও পর্যন্ত জানি না।হালকা সবুজ আর নীলের মাঝামাঝি কিছু একটা হবে।

আমার মুখে চুড়ির প্রশংসা শুনে সে আর কোনো দেরি না করে এটাই নিয়ে নিলো।

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
“মেয়েদের বোকা বানানোর এই একটাই রাস্তা,যখন দেখবেন কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে তখন যেকোনো একটা হাতে নিয়ে বলে দিবেন খুব সুন্দর লাগছে।দেখবেন সে আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে না।কারন মেয়েরা নিজের থেকে নিজের ভালোবাসার মানুষের সীদ্ধান্তকে বেশি গুরুত্ব দেয়।”

আমার হাতের দিকে তাকিয়ে তুলি বলল,
-আপনার হাত তো দেখি খালি।হাতে একটা ঘড়ি পরলে খুব সুন্দর মানাবে।দাঁড়ান আপনার জন্য একটা ঘড়ি দেখি।

-আপনার দেখতে হবে না, আমিই দেখছি।আপনি আবার একঘন্টা লাগিয়ে দিবেন ঘড়ি পছন্দ করতে।

এরপর দুই মিনিটের মধ্যে একটা ঘড়ি কিনে শপিং মল থেকে বের হয়ে গেলাম।

তুলির গার্লস স্কুলে যেতে যেতে আরো কিছুক্ষণ লেগে গেল।স্কুলে গিয়ে দেখলাম তাদের অনুষ্ঠান মোটামুটিভাবে শুরু হয়ে গেছে।তুলিকে দেখে তার বান্ধবীরা রীতিমতো চমকে গেছে।

একজন এসে বলতে লাগলো,
-তুলি, তুই না বলেছিলি আসবি না?

-আরে তোদের কে চমকে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম।স্কুলের এত বড় অনুষ্ঠান হয়ে যাবে আর আমি থাকবো না, তা কি করে হয়।

আমি চারপাশে এক নজর তাকিয়ে দেখলাম যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু মেয়ে।যেহেতু গার্লস স্কুল তাই কোনো ছেলে থাকার কথাও না।তবে আমার মতো কিছু বেচারা স্বামীও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে।
তবে কোনো স্বামীর মুখেই হাসি নেই।সবাই কেমন যেন বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে রেখেছে।
বান্ধবীদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষ করে আমার কাছে এসে তুলি বলল,
-আপনি তাহলে আমাদের স্কুলটা ঘুরে দেখতে থাকুন।এমন সুযোগ আর পাবেন না।আমাদের স্কুলে ছেলেদের প্রবেশ নিষেধ।এই কথা বলে মূহুর্তের মধ্যেই সে চলে গেল।

এদিকে আমিও ভাবছি,
“নিষিদ্ধ কোনো কিছুই ভালো না।শুধু শুধু কেনো যে মেয়েটাকে নিয়ে আসলাম।বাড়িতে থাকলেই সময়টা ভালো কাটতো।”

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তুলি স্টেজে উঠে বলতে লাগলো,
– অনুষ্ঠানে যত পুরুষ লোক আছেন,তারা একটু দয়া করে প্রস্থান করুন।এখন এখানে মেয়েরা নাচবে, গাইবে।আমরা চাচ্ছি না,কোনো পুরুষ আমাদের নাচ দেখুক।খাবারের সময় হলে আপনাদের আবার ফোন করে জানানো হবে।এরপরেও যদি কোনো পুরুষ মানুষ বসে থাকেন, তাহলে ভেবে নিবো আপনি মহিলা।

এই কথা শুনার সাথে সাথে আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, সব পুরুষ মানুষ মুহূর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে পরেছে।এভাবে সবাইকে একসাথে দাঁড়াতে দেখে মনে হচ্ছে শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য এখন জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হবে।কিন্তু না একে একে সব পুরুষ মাথা নিচু করে জায়গা ত্যাগ করছে।বেশি পুরুষ হবে না, হাতে গুনা ১৫-২০ জনের মতো।আমিও তাদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্কুল গেইট পার হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

সবার মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছে, সবাই ব্যাপকভাবে অপমানিত।আমিও তাদের দলের অন্তর্ভুক্ত।

মনমরা হিয়ে গেইটের পাশে একটা বট গাছের নিচে বসে ভাবছি,
“একেই বলে খাল কেটে কুমির আনা অথবা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা।বাকিরাও হয়তো এটাই ভাবছে।কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারছে না।”
আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম,
-চলেন ভাই, মন খারাপ করে বসে না থেকে আমরাও কোনো একটা জায়গা থেকে ঘুরে আসি।”

আমার সাথে সহমত পোষণ করে কয়েকজন বলল,

-ঠিকই বলেছেন ভাই।মন খারাপ করে কোনো লাভ নেই।তারা যা ইচ্ছা তাই করুক,আমি আর ওর সাথে নেই।

একজন আবার দাঁড়িয়ে বলল,
-ভাইজানেরা আমরা কিন্তু একটা কাজ করতে পারি।এই বটগাছের উপরে উঠে কিন্তু আমরা চেষ্টা করলে আমরা আমাদের স্ত্রীদের নৃত্য উপভোগ করতে পারি।যখন যার স্ত্রী নাচবে শুধু সেই গাছে উঠে দেখবে।

তারমতো কয়েকটা বউ পাগল সম্মতি জানিয়ে বলল,
-ভালো বুদ্ধি দিয়েছেন, ভাইজান।
তাহলে শুনুন তো এখন কে নাচবে?
যখন যার বউ নাচবে তখন সেই শুধু গাছে উঠবে। বাকিরা হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করবো।

আমি আবারও মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
“ব্যাকবেঞ্চাররা স্বামী হলে যা হয় আরকি।তবে বুদ্ধিটা খারাপ দেয় নি।”

উপস্থাপিকা মেয়ের কথা গেইট থেকেও শুনা যাচ্ছে।
মেয়েটা বলল,
– এখন নৃত্য পরিবেশন করতে আসবে নিতু।
আমাদের এখান থেকে একজন বলল,

– ভাই নিতুর জামাই কি এখানে আছেন?
থাকলে গাছে উঠে পরুন,আপনার বউ এখন নাচবে।

সাথে সাথেই একটা ছেলে শত বাধা পেরিয়ে বট গাছের উপরে উঠে পরলো।
বুঝতে বেশি দেরি হলো না যে, এই নিতুর জামাই।
নিতুর নৃত্য শেষ হওয়ার পর যখন এই ছেলে গাছ থেকে নামবে তখন গাছের উপর থেকে বলল,
-ভাই গাছ থেকে নামতে পারছি না তো।
-তাহলে উঠেছিলেন কীভাবে?
-ভাই অতি আবেগে উঠে পরেছিলাম এখন তো নামতে পারছি না।কিছু একটা করেন।

উপস্থাপিকা এবার বলতে লাগলো,
– এখন নৃত্য পরিবেশন করতে আসবে রিমা।

এই কথা শুনে আমাদের এখানে থাকা রিমার বর গাছে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-ভাই আপনি নামেন তো।এখন আমার স্ত্রী নাচবে।আমি গাছে উঠবো।

এসব কান্ড দেখে আমার মনটাও ভালো হয়ে গেল।আমাদের এখানেও একটা বিনোদন শুরু হয়ে গেছে।সবাই অপেক্ষায় রয়েছে, কখন কার স্ত্রী নাচবে এই কথা শুনার জন্য।

অনেক কষ্টে ছেলেটাকে গাছ থেকে নামানো হলো।
সে নামার সাথে সাথেই রিমার বর গাছে উঠে পরলো।
এভাবে একে একে পাঁচজন গাছে উঠেছে।তারমানে পাঁচজন নৃত্য পরিবেশন করেছে।

এরপর উপস্থাপিকা বলল,
– এখন নৃত্য পরিবেশন করতে আসবে তুলি।

তুলির নাম শুনার পর বুকের বা পাশটা মুহূর্তের জন্য চিনচিন করতে লাগলো।

একজন বলল,
-তুলির বর কে আছেন?
জলদি গাছে উঠে পরুন।

আমি দাঁড়িয়ে বললাম,
-ভাই, আমি তুলির বর।কিন্তু জীবনে কোনো দিন গাছে উঠি নি।একবার উঠতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।

-তাহলে কীভাবে দেখবেন?
-কিছু একটা ব্যবস্থা করেন।

-দেয়াল টপকাতে পারেন?
-বলতে পারবো না।স্কুল্ব থাকতে কোনোদিন দেয়াল টপকাই নি।

-তাতে কি?
আজকে স্ত্রীর নৃত্য দেখার জন্য টপকাবেন।
আমরা আপনাকে ঘাড়ে তুলে দেয়ালের উপর তুলে দিচ্ছি।আপনি উপরে উঠে দেখবেন।

আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
-তাহলে তাই করেন ভাই।

সবাই মিলে আমাকে দেয়ালের উপর তুলল।
আমি দেয়ালের উপর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তুলি কালো শাড়ি পরে স্টেজে উঠছে।
সাথে সাথে শ্রেয়া ঘোষালের গান বেজে উঠলো,
“বারছো রে মেঘা মেঘা.. ”
সেই সাথে তুলিও পা দুলাচ্ছে।
আমি কেবল মুগ্ধতার দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য উপভোগ করে চলেছি।

(চলবে…)