মিহুর সংসার পর্ব-০২

0
5614

#মিহুর_সংসার
#পর্বঃ২

সবাই মিলে আমাকে দেয়ালের উপর তুলল।
আমি দেয়ালের উপর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তুলি কালো শাড়ি পরে স্টেজে উঠেছে।
সাথে সাথে শ্রেয়া ঘোষালের গান বেজে উঠলো,
“বারছো রে মেঘা মেঘা.. ”
সেই সাথে তুলিও পা দুলাচ্ছে।
আমি কেবল মুগ্ধতার দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য উপভোগ করে চলেছি।

তুলির নৃত্যের ভেতরে এতটাই ঢুকে পরেছিলাম যে নৃত্য শেষ হওয়ার পর ভুলেই গিয়েছিলাম আমি দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে।হঠাৎ একটা পা সামনে দিতেই ঠাস করে স্কুল ক্যাম্পাসের ভিতর মাটিতে পরে গেলাম।

উপর থেকে বড় কিছু পরার শব্দ শুনে দারোয়ান মামা দৌড়ে এসে আমার নিকট উপস্থিত হলো।

মামা গেইট থেকে চলে আসায় গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইয়েরাও আমার কাছে চলে আসলো।

আমি মাটিতে শুয়ে আছি আর আমার মুখের উপর চার-পাঁচজনের মাথা।

একজন বলল,
-মিহু ভাই, বেশি ব্যাথা পেয়েছেন কি?
হাসপাতালে নিতে হবে মনে হয় নাকি?

আমি আস্তে ধীরে শুয়া অবস্থা থেকে বসে বললাম,
-তেমন ব্যাথা পাইনি,তবে প্যান্টটা বোধহয় ছিড়ে গেছে।
-যাক ভাই, তাও ভালো।সব কিছু প্যান্টের উপর দিয়ে গেছে ভাই।

দারোয়ান মামা একবার আকাশের দিকে আরেকবার মাটির দিকে তাকিয়ে কৌতুলের সুরে বলল,
-ভাইজান,আপনি পরলেন কোন থাইকা?
আমি তো গেইটের কাছেই ছিলাম, কোনো পুরুষ মানুষরে তো ভিতরে ঢুকতে দেখলাম না।

আমি জবাব দিলাম,
-আমিও বুঝতে পারছি না, কিছুক্ষনের জন্য মনে হয় মহাশূন্যে ভাসছিলাম।এরপর অভিকর্ষজ ত্বরনের প্রভাবে নিচে পরে গেছি।

-কি বলেন ভাইজান এইগুলা। আপনার মাথা ঠিক আছে?

– মাথা ঠিকই আছে, তবে প্যান্টটা বোধহয় ছিড়ে গেছে।

এবার আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম, প্যান্টটা সত্যিই ছিড়ে গেছে এবং তা খুব বাজে ভাবে ছিড়েছে।

নিতু নামক মেয়েটির বর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-মিহু ভাই, প্যান্ট এর ভিতর থেকে শার্টটা বাইরে বের করে রাখুন আপাতত।তারপর চলুন মার্কেট থেকে প্যান্ট কিনে নিয়ে আসি।মার্কেট বেশি দূরে না এখান থেকে।

আমি প্যান্টের ভিতর থেকে শার্টটা বাইরে বের করে দেখলাম এখন আর ছেড়া বুঝা যাচ্ছে না।আপাতত চলা যাবে।তবে এভাবে তো বাসা পর্যন্ত যাওয়া যাবে না।কিছুক্ষণ পর আবার সবাই একসাথে বসে খেতে হবে।মোট কথা প্যান্ট একটা কিনতেই হবে।

আমি সবাইকে বললাম,
– চলুন ভাই, প্যান্ট একটা কিনেই নিয়ে আসি।

সবাই মিলে মার্কেটে চলে গেলাম প্যান্ট কিনার জন্য।

দোকানদার আমাদের সবার উদ্দেশ্যে বলল,
-কি লাগবে স্যার আপনাদের?

আমি বললাম,
-আমার জন্য মজবুত একটা প্যান্ট বের করুন তো।যে প্যান্ট থেকে মনে করুন অন্তত ১০ ফুট লম্বা দেয়াল থেকে পরলেও ছিড়বে না।

আমার কথা শুনে দোকানদার হাসি দিয়ে বলল,
-স্যার,আমাদের সব গুলো প্যান্ট-ই খুব মজবুত।আপনি যদি পাঁচতলা ছাদ থেকে লাফ দেন তাহলে আপনার মৃত্যু হলেও আমাদের দোকানের প্যান্ট ছিড়বে না।

-ভাই চাপাবাজি একটু পরে কইরেন, আপাতত ভালো একটা প্যান্ট দেখান।আর আপনাদের এখানে ট্রায়াল দিতে পারবো তো?

-শুধু ট্রায়াল কেন স্যার?
আপনি প্যান্ট পরে সেলফিও তুলতে পারবেন।এইজন্য আলাদা কোনো টাকা দিতে হবে না।

-আচ্ছা ভাই,তাহলে আমাকে ওই কালো আর সাদা এই দুইটা প্যান্ট দেখান তো।

দোকানদারের কাছ থেকে দুইটা প্যান্ট নিয়ে ট্রায়াল রুম থেকে কালোটা পরে চলে আসলাম।

দোকানদার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– এই প্যান্টটা আপনাকে খুব মানাইছে স্যার।দেখে মনে হচ্ছে প্যান্টটা আপনার জন্যই তৈরি করা হইছে। সাদাটাও নিয়ে নিন স্যার, ওইটাও আপনাকে খুব ভালো মানাবে।আসলে আপনি যেটা পরবেন সেটাই মানাবে।

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
“সকাল বেলা তুলিকে একবার এগুলো বলে বোকা বানিয়েছিলাম এখন দোকানদার আবার আমাকে বোকা বানাতে চলেছে।এইজন্যই বোধহয় বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছেন,
” প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে।”

দোকানদারের সাথে আর তর্কে না জড়িয়ে দোকানদারকে শুধু কালো প্যান্টের দাম দিয়ে চলে আসলাম।যেহেতু ফিক্সড রেটের দোকান তাই দামাদামি করারও কোনো মানে হয় না।

এদিকে আবার দেখলাম তুলি ফোন দিয়েছে।
ফোন ধরতেই তুলি বলল,
– আপনি কোথায় আছেন?
চলে আসুন তাড়াতাড়ি, এখন খাবার দেওয়া হবে।

-আমি আশেপাশেই আছি।অপেক্ষা করুন কিছুক্ষণ, চলে আসবো।

-হুম, দ্রুত আসুন।পরে খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার বলবেন, আমাদের স্কুলের খাবার ভালো না।

সবাই যার যার স্ত্রীদের সাথে কথা শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে চলে গেলাম।

খাবারের টেবিলে বসে খেয়াল করলাম,
মেয়েদের জন্য একধরনের খাবারের ব্যবস্থা আর ছেলেদের জন্য অন্যধরনের খাবারের ব্যবস্থা।
ছেলেদের খাবারের টেবিলে এমন কোনো খাবার রাখা হয়নি যেটা খেলে ভুড়ি জমতে পারে।
ছেলেদের খাবার টেবিলে গরুর মাংস নেই কিন্তু মেয়েদের টেবিলে রয়েছে।
ছেলেদের খাবার টেবিলে শশা আর গাজরের পরিমানটাই বেশি।
এত অপমান মুখ বুজে সহ্য করে নিলেও খাবার নিয়ে কোনো ধরনের অবহেলা মেনে নেওয়া যায় না।
তবুও কিছু বলার নেই,সবার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে দেশে দুর্ভিক্ষ লেগে গেছে।সামনে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
কথায় আছে,
“নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।”
খাবার পর্ব শেষ এবার বিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

এদিকে মেয়েরা এতক্ষণ হৈ-হুল্লোড় করে এখন আবার একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।মেয়েরা এই কাজে খুব দক্ষ।ওরা নিজের মন খারাপ বোঝানোর জন্য কাঁদে আর ছেলেরা নিজেদের মন খারাপ কাউকে বুঝতে না দেওয়ার শত প্রতিকূলতার মধ্যেও হাসে।

তুলির কান্না দেখে ভাবছি,
“মেয়েটা তো বিয়ের দিনেও এত কান্না করে নি।আমার কাছ থেকে কেবল মাত্র চার-পাঁচটা টিস্যু নিয়েই পুরো রাস্তায় চোখের জল মুছেছিল। কিন্তু এখন তো বৃষ্টির মতো চোখ দিয়ে জল পরেই চলেছে।দেখে কিছুটা মায়াও লাগছে আবার ভালোও লাগছে।পুরো মুখ টকটকে লাল হয়ে গেছে।
এদিকে আমরা ছেলেরাও হাসিমুখে বিদায় নিয়ে নিলাম।

কান্নার পর্ব শেষ করে তুলি আমার কাছে এসে বলল,
-দুইটা টিস্যু দেন তো,আমি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে টিস্যু নিতেই ভুলে গেছি।কিন্তু এমন ভুল আমি কখনও করি না,এরকম অনুষ্ঠান হলে সবার প্রথম আমি যেই জিনিসটা সংগ্রহে রাখি সেটা হলো টিস্যু।

আমি দশ টাকার একটা টিস্যুর প্যাকেট তুলির হাতে দিয়ে বললাম,
-যতগুলো প্রয়োজন ব্যবহার করুন।

-এতগুলো লাগবে না।একটা রিকশা দেখুন।বাসায় যেতে হবে তো,রাত হয়ে গেছে।

কথাগুলো শেষ করে আমার প্যান্টের দিকে তাকিয়ে তুলি বলল,
-বের হওয়ার সময় তো দেখেছিলাম সাদা রঙের একটা প্যান্ট পরে এসেছিলেন।এই কিছুক্ষনের মধ্যে প্যান্টের কালার পরিবর্তন হলো কীভাবে?

আমি তার কথায় আগ্রহ না দেখিয়ে হতাশ মুখে বললাম,
-আপনি শুধু প্যান্টের কালার দেখলেন, এই কিছুক্ষনের মধ্যে আমার জীবনের কালার টাই বদলে গেছে।এসব কথা না বলে চলুন বাসায় যাই, সবাই মনে হয় অনেক চিন্তা করছে।

সেদিন বাসায় আসার পর জীবনে নতুন এক ব্রত নিয়েছিলাম,
” জীবনে আর কোনোদিন তুলির সাথে তাদের স্কুল-কলেজের প্রোগ্রামে আমি আর যাচ্ছি না।এইসব প্রোগ্রামে না গিয়ে বাসায় শুয়ে ঘুমানো উত্তম।”

বিয়ের দুইমাস হয়ে গেছে।বাবা-মা দুজন বিশেষ কাজে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে গিয়েছেন।বাসায় আমি আর তুলি থাকি শুধু।আমি সকালে বের হয়ে অফিস শেষে সন্ধ্যায় আসি, তুলি শুধু সকালে নাস্তা তৈরি করে আর রাতের জন্য কিছু খাবার তৈরি করে।বাকি সময় টিভিতে কার্টুন আর মুভি দেখেই পার করছে।

এই কয়েকদিন আমি তুলিকে তুমি বলে সম্মোধন করলেও সে আমাকে আপনি বলেই ডেকে চলেছে।
একবার বলেছিলাম,
-এখন থেকে তাহলে তুমি আমাকে আর আপনি না ডেকে তুমি করে ডেকো।

সে আমাকে জবাব দিয়েছিলো,
” আমি কাউকে তুমি বলে ডাকতে পারি না।যাদের সাথে খুব বেশি মিশে যাই তাদেরকে তুই করে ডাকি আর বাকি সবাইকে আপনি করেই ডাকি।”

আমি তখন বলেছিলাম,
-তাহলে আপনিই থাক।তুই এর থেকে আপনি ভালো।আমার দাদীও দাদাকে আপনি করে ডাকতো।বেশ ভালোই শুনা যেতো।

আজকে সকালে খাবার টেবিলে নাস্তা করার সময় রুটির আকৃতি দেখে আমি হতবাক।জীবনে অনেক সাইজের রুটি দেখেছি, এই যেমন গোলাকার,চতুর্ভুজাকার,ত্রিভুজাকার ও হয় শুনেছি।
কিন্তু আমার সামনে যেটা রাখা হয়েছে সেটাকে কোনোভাবেই রুটি মনে হচ্ছে না।
রুটিটা হাতে নিয়ে একটু গবেষণা শুরু করে দিলাম।আট থেকে দশটা কোণা বের হয়েছে এই রুটি নামক বস্তুটির।
দেখে মনে হচ্ছে আটা-ময়দা থাকা অবস্থায় বোধহয় জীবনে অনেক বড় কোনো ভুল করে ফেলেছিলো এই রুটিটা।এখন সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছে।

আমি বসে বসে ভাবছি,
“এটাকে কি খাওয়া ঠিক হবে?
সারাজীবন শুনে আসলাম পরিবারের পছন্দে বিয়ে করলে বউয়ের রুটি গোল হয়।কিন্তু এখন দেখছি বাস্তবতা ভিন্ন।

এরমধ্যেই তুলি আরেকটা একই আকৃতির রুটি আমার কাছে নিয়ে আসলো।
আমার হাতে রুটি দেখে বলল,
-রুটি না খেয়ে হাতে নিয়ে বসে আছেন কেন?

-আমি ভাবছি এত সুন্দর রুটি বানানো তোমাকে কে শিখিয়েছে!
-কেউ শেখায়নি তো।নিজের মতো করে বানিয়েছি।
-এটাকে রুটি বললে ভুল হবে।এটা হচ্ছে তুটি।তুলি থেকে তু আর রুটি থেকে টি।নামটা সুন্দর না?

তুলি রেগে গিয়ে আমার হাত থেকে রুটি কেড়ে নিয়ে বলল,
-আপনি রুটির সাথে আমার তুলনা করলেন কেন?
আপনাকে রুটি খেতে হবে না।হোটেল থেকে খেয়ে নিবেন।আধাঘণ্টা সময় নষ্ট হয়েছে এই দুইটা রুটি বানাতে আমার।

আমি আর তর্কে না জড়িয়ে সোজাসুজি বাসা থেকে কেটে পরলাম।রুটির সাইজ দেখেই পেট ভরে গেছে এখন অন্য কিছু খেলে পেটে সমস্যা হতে পারে।

সন্ধ্যার দিকে আবার অফিস শেষে বাসায় ফিরে দেখি নতুন কাহিনী। তুলি বিছানায় বসে বসে কাঁদছে আর রুমের চারপাশে পনেরো থেকে বিশটা ভেজা টিস্যু পরে রয়েছে।

আমি তার কাছে গিয়ে বললাম,
-কি হয়েছে,তুলি?
তোমার এই অবস্থা কেনো?

তুলি কোনো কথা বলছে না।টিস্যু দিয়ে চোখ মুছায় ব্যস্ত।
– সকালের ব্যবহারে কি মন খারাপ করেছিলে?
রুটির সাথে তুলনা দেওয়াতে?

সে না সূচক মাথা নাড়ালো।

-তাহলে কাঁদছো কেন?

-একটা মুভি দেখেছি।মুভিটার শেষটা ছিল অনেক করুণ। কিছুতেই চোখের জল আটকে রাখতে পারছি না।

– আরে বোকা মেয়ে, মুভি দেখে এভাবে কেউ কাঁদে নাকি।মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু এভাবে কাঁদার কোনো মানে হয় না।

-আমার চোখ যখন ইচ্ছা ভেজাবো তাতে আপনার কি?

-আমার কিছু না।এভাবে অকারনে যখন তখন চোখের জল ছিটালে চোখের জল তো শেষ হয়ে যাবে।এরপর দেখবে এমন সময় আসবে যখন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করবে কিন্তু তখন চোখে জল আসবে না।চোখ মুছে ফেলো,আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

দুইমিনিটের মধ্যে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে দেখি তুলি তার ব্যাগ-ট্যাগ সব গুছানো শুরু করে দিয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-এভাবে তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছাচ্ছো কেন?

-যেই বাসায় মনের সুখে দুই-চার ফোঁটা চোখের জল ফেলা যাবে না, সেই বাসায় আমি আর থাকছি না।

(চলবে…)

© খাদেমুল আলম মিঠুন