মিহুর সংসার পর্ব-০৩

0
4131

#মিহুর_সংসার
#পর্বঃ৩

দুইমিনিটের মধ্যে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে দেখি তুলি তার ব্যাগ-ট্যাগ সব গুছানো শুরু করে দিয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-এভাবে তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছাচ্ছো কেন?

-যেই বাসায় মনের সুখে দুই-চার ফোঁটা চোখের জল ফেলা যাবে না, সেই বাসায় আমি আর থাকছি না।
– এটা কোনো কথা হলো। আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?

আমার কথায় কোনো ধরনের আগ্রহ না দেখিয়ে সে নিজের মতো করে সব কিছু ভালোভাবে গোছাতে গোছাতে বলল,
-কান্না হচ্ছে যার যার ব্যক্তিগত অধিকার।এই অধিকারে যে বাধা দিবে আমি তার সাথে থাকবো কেন?

আমি বললাম,
-আচ্ছা, ঠিক আছে।যত খুশী কাঁদো, আমি আর কিছুই বলবো না।তবুও এই সন্ধ্যা বেলায় নাটক টা বন্ধ করো।

– আচ্ছা,ওই প্রোগ্রামের দিন তো কালো শাড়ি পরেছিলাম।এখন কোন শাড়িটা পরবো,একটু দেখে বলুন তো?

-তুমি কি সত্যিই চলে যাচ্ছো?
-অবশ্যই, আমি মিথ্যে কথা বলি না আর যে বলে তাকেও পছন্দ করি না।আজকে নীল শাড়িটা পরতে হবে।নীল রঙ হচ্ছে বিচ্ছেদের দৃষ্টান্ত। আজকের পরিস্থিতির সাথে বেশ মানাবে।

আমি কোনো কথা না বলে বিছানার একপাশে বসে তুলির কান্ড কারখানা দেখছি।
কিছুক্ষণ কান্ড কারখানা সহ্য করে বললাম,
– কালকে গেলে হয় না।কালকে তো শুক্রবার।আমিও সাথে গেলাম তাহলে।অনেক দিন হয়ে গেলো তোমাদের বাড়িতে যাওয়া হয়না।এই সন্ধ্যার সময় হুটহাট না জানিয়ে চলে গেলে আব্বা-আম্মা কি ভাববে?
– যা ইচ্ছা ভাবুক।আমার বাসায় আমার যখন ইচ্ছা হবে যাবো, এতে ভাবার কি আছে?

– তাহলে এক কাজ করি।আমিও তোমার সাথে চলে যাই।তাহলে কেউ কিছু ভাববে না।
– আপনার শ্বশুর বাড়িতে আপনি যখন ইচ্ছা যাবেন, এটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।

– তাহলে আমিও হালকা কিছু খেয়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।শনিবার সকালে চলে আসবো।

রান্না ঘরে গিয়ে দেখলাম খাওয়ার মতো কিছুই নেই।

তুলিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আজকে কি রান্না করো নি?
– না। ভেবেছিলাম মুভিটা শেষ করে রান্না করবো।কিন্তু সেটা তো হলো না।
– ও, আচ্ছা।বুঝতে পেরেছি, মনের এই অবস্থা নিয়ে আর যাই হোক রান্নাবান্না তো সম্ভব না।তাহলে আমি মুড়ি দিয়ে চানাচুর মাখাচ্ছি দুজনে একসাথে খেয়ে রওনা দিব।তুমিও তো বোধহয় কিছু খাওনি?

-মুভি দেখতে দেখতে কয়েকটা বিস্কুট খেয়েছিলাম।মুভি দেখার পর কিছু খাইনি।আর কিছু খাবোও না।মন খারাপের সময় খেতে নেই।

সোফায় বসে বসে মুড়ি চাবাচ্ছি আধাঘন্টা হয়ে যাবে। তুলি এখনও সাজগোজ করছে।আগে জানতাম,
“মেয়েদের মন যখন প্রচন্ড রকমের ভালো থাকে তখন তারা সাজগোজ করে।মন খারাপের সময় মেয়েরা ইচ্ছে করলেও সাজতে পারে না।চুল গুলো থাকবে এলোমেলো, গালগুলো থাকবে ফোলা আর চোখ দুইটা চিন্তায় বড় হয়ে থাকবে তাহলেই বুঝে নিতে হবে এই মেয়ের মন খারাপ।কিন্তু তুলির ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটছে।প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম এই মেয়ের একেবারেই ধৈর্য্য নেই।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল।সে ধৈর্য্য নিয়ে একটা কাজই ভালোভাবে করতে পারে সেটা হচ্ছে সাজগোজ।শুধু সে না,বাঙালি প্রায় সব মেয়েই এই কাজে খুব ভালো ধৈর্যের পরিচয় দেয়।”

সন্ধ্যা সাতটার সময় রুমের দরজা বন্ধ করেছিল এখন ন’টা বাজে।এখনও সাজগোজ চলছেই।

সাড়ে ন’টার দিকে দরজা খুলে দুইটা ব্যাগ নিয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
এই মেয়েকে দেখে কে বলবে সে অভিমান করে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছে।

আমার হাতে ব্যাগ দুইটা দিয়ে বললো,
-নিচে গিয়ে রিকশা খুঁজুন।আমি ঘরের দরজা জানালা সব আটকে দিয়ে নিচে নামছি।

ব্যাগ দুইটার ওজন কমপক্ষে হলেও দশ কেজির নিচে হবে না।

তুলির বাপের বাড়ি এখান থেকে বেশি দূর নয়।রিকশা দিয়ে গেলে আধাঘন্টার মতো লাগে।

এখন বুঝতে পারছি,
“বিয়ে সব সময় দূরে করা উত্তম।তখন যত ইচ্ছা স্বামীর সাথে ঝগড়া করলেও বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা মুখে নেওয়ার আগে স্ত্রীরা কমপক্ষে দশবার ভেবে নিবে,
একা যেতে পারবো তো?
কিন্তু আফসোস আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোর সাথেই জুটি বাঁধতে পছন্দ করি।সেই বিচারে আমরা সবাই বোকা।”

একটা রিকশা নিয়ে দুজনে চলে আসলাম তুলির বাসার নিচে।যখনই ব্যাগ গুলো নিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকতে যাবো তখন-ই তুলি রাস্তা আটকে বলল,
-এভাবেই চলে যাবেন নাকি?

– কেনো কি হয়েছে?

– শ্বশুর বাড়িতে কেউ খালি হাতে যায় নাকি।আপনার মানসম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমার তো আছে এবং সেটা পরিমানে অনেক বেশি।

আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে দশটা বাজে।আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম,
কয়েকটা মুদি দোকান ছাড়া তেমন কিছুই খোলা নেই।শীতের রাতে এতক্ষন দোকান খোলা রাখার কথাও না।

আমি বললাম,
– আগে বলতে, এখন তো সব দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে।
– আমার বলতে হবে কেন?
এটা তো আপনার মাথায় থাকার কথা।

-আচ্ছা, তর্ক না করে বলো কি নিয়ে আসবো?
দেখি কিছু খোলা পাই কিনা।

– কয়েক কেজি মিষ্টি জাতীয় কিছু আনবেন আর সাথে একটা বড়সড় মাছ নিয়ে আসবেন।

– ঠিক আছে, তুমি একটু দাঁড়াও।আমি দেখে আসি কিছু খোলা আছে কিনা।

বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট ঘুরাঘুরি করে একটা মিষ্টির দোকান থেকে দুই কেজি মিষ্টি আর মাছের বাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল সেখানে কিছু জরিমানা দিয়ে বড়সড় একটা মাছ নিয়ে নিলাম।

মামা জিজ্ঞেস করলো,
– মাছটা কি কাইট্টা দিতাম, ভাইজান?
– না, মাছে হাত দিতে হবে না।শ্বশুরবাড়ি যাব তো এই মাছ নিয়ে।যদি দেখাতেই না পারি এত বড় মাছ তাহলে নিয়ে কি লাভ!

– তাইলে ভাইজান, হাতে দড়ি দিয়া ঝুলাইয়া লইয়া যাইন।
– হুম, তাই দেন।

মিষ্টি আর মাছ নিয়ে তুলির কাছে গিয়ে বললাম,
– চলো, এখন তো কোনো আপত্তি থাকার কথা না।

কিন্তু তুলি বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছে না।দেখলাম রাগে তার চোখ মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে।

– কি হলো?

আমার চোখার দিকে তাকিয়ে তুলি বলল,
– আপনার হাতে কি ওইটা?

আমি ডান হাত তুলির চোখের সামনে নিয়ে বললাম,
– মিষ্টি, দুই কেজিই অবশিষ্ট ছিল দোকানে।

-অন্য হাতে কি?

এবার বাম হাতটা তুলির দিকে এগিয়ে নিয়ে বললাম,
-চোখের কি মাথা খেয়েছো নাকি?
এত বড় একটা মাছ, আর তুমি বলছো এটা কি?

-মাছ তো দেখতেই পাচ্ছি।কিন্তু এটা কি মাছ?

– কি আবার?
পাঙ্গাশ মাছ, বেশ সুস্বাদু।

– শ্বশুর বাড়িতে কেউ পাঙ্গাশ মাছ নিয়ে যায়?
আর আমাদের বাসায় তো কেউ পাঙ্গাশ মাছ ছুয়েও দেখে না।

জরিমানা দিয়ে মাছ কিনে তুলির মুখে এই কথা শুনে কিছুটা কষ্ট আর সেই সাথে কিঞ্চিৎ অপমান বোধও লাগছে।

আমি বললাম,
– বিয়ে তো আগে কখনও করি নি।কীভাবে বুঝবো যে কি নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া যাবে আর কি নিয়ে যাওয়া যাবে না?

– পাঙ্গাশ মাছ পাল্টে অন্য মাছ নিয়ে আসুন।মাছটা দেখেও তো ভালো মনে হচ্ছে না, কেমন দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।

– এখন পাল্টে আনা সম্ভব না।দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।আর এই একটা মাছই ছিল।

-সেকারনেই আপনাকে বোকা বানিয়েছে দোকানদার।ইশ, এই নোংরা মাছটা নিয়ে এখন বাসায় মুখ দেখাবো কি করে!

– এসব চিন্তা না করে চলো ভিতরে যাই।মেয়ের জামাই শখ করে কিনেছে আব্বা-আম্মা কিছু মনে করবেন না।

পাঁচ মিনিট কলিং বেল বাজানোর পর তুলির মা দরজা খুলে দিলো।
আমাদের দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছেন।চোখ দেখে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পরেছিলেন।কাঁচা ঘুম ভেঙে দরজা খুলে দিয়েছেন।

আমাদের দেখে বললেন,
– এত রাতে তোমরা কিছু না জানিয়েই চলে আসলে যে?

তুলি কিছু বলার আগেই আমি আম্মাকে সালাম দিয়ে বললাম,
– তুলির ভীষন মন খারাপ করছিল আম্মা আপনাদের জন্য।সেকারনেই নিয়ে আসলাম,যদি মনটা কিছুটা ভালো হয়।মন ভালো হলেই আবার চলে যাবো আমরা।

মিষ্টির প্যাকেট টা ডাইনিং এ রাখলাম আর পাঙ্গাশ মাছটা আম্মার হাতে দিয়ে বললাম,

-ফ্রিজে রেখে দিন আম্মা মাছটা।এত রাতে বায়না ধরেছে আপনার মেয়ে যে ভালো কিছু কিনে নিয়েও আসতে পারলাম না।

আম্মা হাসিমুখে আমার হাত থেকে মাছটা নিয়ে বললেন,
-এগুলো আনার কি দরকার ছিলো।তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো, আমি ভাত নিয়ে আসছি।রাতের খাবার তো বোধ হয় কেউ খাওনি?

-জি, আম্মা।তবে না খেলেও চলবে।
-সে কি করে হয়?

তুমি বসো, আমি সব কিছু গরম করে নিয়ে আসছি।

তুলির একটা ছোট ভাই আছে বয়স বারো এর কাছাকাছি। এই রাতের বেলায় চিৎকার করে করে বলছে,
“কি মজা! আপু এসেছে।আজকে রাতে কিন্তু আমাকে গল্প শোনাতে হবে আপু।”

তুলিও তাকে আদর করে বলছে,
” শাড়িটা পাল্টে নেই, এরপর গল্প বলবো।”

আমি বললাম,
– দুই ঘন্টা সময় নিয়ে শাড়ি পরলে এখনই পাল্টে ফেলবে?

তুলি আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে তার ছোট ভাই তুহিনকে নিয়ে রুমে ঢুকে গেলো।

এদিকে আমি হাত-মুখ ধুয়ে খাবার-দাবার সেরে তুলির রুমে ঢুকলাম।

তুলি গল্প শুনাচ্ছে তুহিনকে।

আমি এসে বললাম,
-তুহিন, রাত বারোটা বেজে গেছে।তোমার রুমে যাও।আমরা এখন ঘুমাবো।

তুলি তুহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
” বাকি গল্প কালকে বলবো।এখন তুই তোর দুলাভাইকে নিয়ে তোর রুমে ঘুমাতে চলে যা।”

– আমি যাব মানে?

– অবশ্যই যাবেন।আপনি পাঙ্গাশ মাছ ধরেছেন,আজকে আপনাকে এই রুমে রাখা যাবে না।তুহিন তোর দুলাভাইকে নিয়ে তোর রুমে যা।আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিনঝিন করছে।একটু চা বানিয়ে খেতে হবে।

তুহিন আমাকে হাতে ধরে তার রুমে নিয়ে যাচ্ছে।আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে তুলিকে বললাম,
– আমার জন্যও এক কাপ চা ওই রুমে নিয়ে এসো, চিনি কম দুধ বেশি।

তুলি কিছু বলল না।

তুহিনের সাথে শুয়ে রয়েছি।তুহিন বলছে,
-দুলাভাই একটা গল্প শোনান।

-ঘুমিয়ে পরো।গল্প শুনতে হবে না।

-কালকে তো শুক্রবার দুলাভাই।স্কুল বন্ধ, দেরি করে ঘুমালে কিছু হবে না।

এই ছেলেকে গল্প না বললে ঘুমাবে না।

তাই শুরু করে দিলাম এক গল্প।

“এক দেশে ছিলো এক রাজপুত্র।আরেক দেশে ছিল এক রাজকন্যা।পরিবারের সিদ্ধান্তে রাজপুত্র আর রাজকন্যার বিয়ে হয়।বিয়ের পর রাজপুত্রটা বুঝতে পারে যে, সে এই রাজকন্যাকে বিয়ে করে জীবনে অনেক বড় ভুল করেছে।কারন রাজকন্যাটা ছিল খুবই বোকা।কিন্তু রাজপুত্রটা রাজকন্যাকে খুব ভালোবাসতো।একদিন রাজকন্যা অভিমান করে বাপের বাড়ি চলে আসে।রাজপুত্রও পিছু পিছু চলে আসে।”

এতটুকু গল্প বলার পর তুহিন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-থামেন দুলাভাই।এই গল্পটা তো মাত্রই তুলি আপু আমাকে বলেছে।কিন্তু এখানে রাজপুত্রের জায়গায় একটা ছাগল ছিল।রাজকন্যাটা ওই ছাগলটাকে ভালোবাসতো।

আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে তুলি আমাকে ছাগলের সাথে তুলনা করেছে।

এদিকে তুলি আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে রুমে ঢুকে বলছে,
– এই নেন আপনার চা।

আমি বিরক্তির সুরে বললাম,
” এসব চা-টা আমার পাকস্থলী দিয়ে নামবে না।তুমি বরং কিছু কাঁঠাল পাতা আর ঘাস নিয়ে আসো। বসে বসে সেগুলো চাবাই।
আমিতো ছাগল।”

(চলবে…)

© খাদেমুল আলম মিঠুন