মৃণালিনী পর্ব-১২

0
304

#মৃণালিনী
#পর্ব ১২
দুপুরের রোদ পোহাতে পোহাতে ছাদে বসেই চুল বাঁধতে বাঁধতে গল্প গুজব চলছিলো, আশে পাশের বাড়ির বউ ঝিরাও তাতে যোগ দেয় প্রতিদিন। এই সময়ে ছাদে বসে থাকা বাধ্যতামূলক মৃণালের, দুপুরে নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া পারুল বালা পছন্দ করেন না, বিশেষ করে সৌম্য বাড়ি থাকলে তো নয়ই। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই ছাদের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে গল্প শুনছিল মৃণালিনী, সকাল থেকে একবারের জন্যেও আজ ঘরে যাবার সুযোগ সে পায়নি।

যে কয়েকবার সৌম্য কোনো কাজে ডেকেছে, প্রতিবারই করুণা দৌড়ে গেছে, দূর থেকে সবটাই লক্ষ্য করেছে মৃণাল, কিন্তু বড়ো মা র শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে দোতলায় ওঠা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। সৌম্য যে রেগে আছে সেটা ও ভালোই জানে, গত রাতের গোলমাল মেটানোর কোনো সুযোগই আসেনি, উল্টে নতুন করে রাগের কারণ বেড়েছে। তাই মন টা খুব অস্থির লাগছিলো, কোনো কথা না বলে চুপ করে বসেছিলো ও। পানের বাটা পাশে রেখে সুপুরি কাটতে কাটতে বউয়ের মুখ দেখে মনে মনে খুব খুশি হচ্ছিলেন পারুল বালা।

সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো, পাড়ার মেয়ে বউরা বিদায় নিচ্ছিলো আস্তে আস্তে, বামুন দিদি রান্না ঘরে চায়ের আয়োজন করছে, কুমুদ তুলসিতলায় সন্ধ্যে প্রদীপ দেখাতে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।

আজ থেকে বউ মা সন্ধ্যে দেবে, অনেকদিন তো শেখানো পড়ানো হলো, এবার ওকেই করতে দাও,

বড়ো জা এর গলার আওয়াজে দাঁড়িয়ে পড়লেন কুমুদ, মৃণালের দিকে তাকালেন ফিরে। তুলসী মঞ্চ টা একটু দূরে, উঠোনের মাঝখানে প্রায়, মৃণালিনী সন্ধ্যে বেলায় এখনও ঘরের বাইরে যেতে একটু ভয় পায়, তাই ওটা এখনও নিজেই করেন কুমুদ।

আমি দিয়ে দিই দিদি, ও তো অন্ধকারে উঠোনে যেতে ভয় পায়, আর কিছুদিন যাক না হয়!

বড়ো জার দিকে তাকিয়ে একটু অনুনয়ের গলায় বললেন কুমুদ, এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা তাঁর নেই!

না, ওই যাবে! করুণা তুই দাদার চা টা দিয়ে আয়!

কতগুলো বলেই দ্রুত পা চালিয়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন পারুল বালা, কুমুদ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। মৃণাল সব কিছু বুঝছিল, বামুন দিদির তৈরি করা চা যাতে সে সৌম্যর কাছে নিয়ে যেতে না পারে, তাই এই ব্যবস্থা। মুখ নিচু করে সে তুলসী মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো, মনের মধ্যে ভয়, চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকা র ডাক ভেসে আসছে। প্রদীপ জ্বেলে যখন তুলসী মঞ্চের সামনে পৌঁছালো তখন দেখলো একটু দূরে দরজার গায়ে হেলান দিয়ে একটা লন্ঠন হাতে শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছেন। কুমুদ কে দেখেই বুকে বল এলো মৃণালের, সন্ধ্যে দেখিয়ে ঘরে এলো তাড়াতাড়ি।

চা পর্ব শেষ হবার কিছুক্ষন পরেই খাওয়া দাওয়া শুরু হয় এখানে। বিকেলে চা এর চল এবাড়িতে খুব একটা ছিলো না, সৌম্য কলকাতা যাবার পরে সেটা শুরু হয়েছে। তাই বিকেলের চা সবাই খায়না। বামুন দিদির রাতের রান্না হয়ে এসেছিলো প্রায়, করুণা খাওয়ার জায়গায় আসন পেতে জলের গ্লাস রাখছিলো, এমন সময় বাড়ির কর্তা শ্যাম সুন্দরের ঘর থেকে ডাক ভেসে এলো।

বউ দিদি বাবা তোমাকে ডাকছেন,

মৃণাল একটু অন্য মনস্ক ছিলো সকাল থেকেই, শ্বশুরমশাই এর ডাক তার কানে পৌঁছয়নি, সরমা র কথা শুনে তাড়াতাড়ি দোতলায় উঠতে লাগলো। দোতলার টানা বারান্দার পাশাপাশি পর পর অনেকগুলো ঘর, তার একদম শেষের ঘর টা শ্বশুর শাশুড়ির, সৌম্যর ঘর পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। নিজের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় সৌম্য কে বই হাতে টেবিলে বসে পড়তে দেখলো মৃণালিনী, মুখটা বেশ গম্ভীর, বাবার ডাক সেও শুনেছে, বউ এক্ষুনি ওপরে আসবে জেনেই মুখটা আরো বেশি গম্ভীর হয়ে আছে।

বাবা আমায় ডাকছিলেন,

ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো মৃণাল,

হ্যাঁ, বউমা ভেতরে এসো, এই খাতাটা একটু দেখো তো,

একটা মোটা লাল শালু তে বাঁধা খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন শ্যাম সুন্দর।

এসব হিসেব নিকেশ মাঝে মাঝেই দেখে থাকে মৃণাল, লন্ঠন টা সামনে এগিয়ে এনে খাতা টা খুলে বসে সবে মাত্র মেলাতে শুরু করেছিলো, সৌম্যর গলার আওয়াজে চমকে তাকালো।

বাবা আপনার সঙ্গে আমার একটু প্রয়োজন ছিলো,

শ্যাম সুন্দর নিজেও একটা খাতা নিয়ে হিসাব দেখছিলেন, ছেলের কথা শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকালেন,

আপনি এসব জমি জমা সংক্রান্ত ব্যাপারে মৃণাল কে ডাকবেন না, এসব কিছু তে আপনাকে সাহায্য করার জন্যে তো আলোক দা আছেন তো, বাড়ির বউদের এসব ব্যাপারে না টানাই ভালো,

বেশ গম্ভীর গলায় বললো সৌম্য, ছেলের কথা তে যত টা শ্যাম সুন্দর অবাক হলেন তার থেকেও বেশি অবাক হলো মৃণালিনী, সে সৌম্য কে যথেষ্ট প্রগতিশীল বলেই জানতো। তার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে সৌম্য মনে মনে লজ্জা পেলো, কিন্তু তার কিছু করার নেই, বড়মা র আদেশ অমান্য করা কোনোমতেই সম্ভব নয় তার পক্ষে।

কারোর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই সৌম্য বেরিয়ে গেলো, মৃণাল খাতা রেখে উঠে দাঁড়ালো। শ্যাম সুন্দর বিষয়ী মানুষ, কিছুদিন ধরেই তাঁর আলোকের ওপর বিভিন্ন কারণে খটকা লাগছিলো, তাই তিনি বউমা কে দায়িত্ব দেবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ছেলের কথার পরে এই মুহূর্তে তিনি আর কিছু মনস্থির করতে পারছিলেন না।

আসছি বাবা,

বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মৃণালিনী, অন্ধকার বারান্দায় বেরিয়ে এসে এতক্ষনের অপমান চোখের জল হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সে খুব শক্ত মনের মেয়ে, কিন্তু সৌম্যর কাছ থেকে অপমানিত হওয়া তার কল্পনার মধ্যে ছিলো না। বারান্দার এক কোনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো মৃণাল, পরীক্ষার আর মাত্র মাস খানেক বাকি, কেরোসিনের অভাবে রাতে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্যে সৌম্য কে কিছু বলার আগেই তার সঙ্গে মনো মালিন্য শুরু হয়েছে, চারিদিক থেকে চাপে মনটা এমনিতেই বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিলো এই ঘটনাটা তাতে নতুন করে আরও বেশি ইন্ধন যোগালো।

মনের মধ্যে আস্তে আস্তে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিলো মৃণালের। নিজেদের খোলা মেলা প্রগতিশীল বাড়ি থেকে এসে এমনিতেই এই বাড়ির গোঁড়ামি তে দম বন্ধ হয়ে আসে ওর, তার মধ্যে সৌম্যর এই পরিবর্তন ওকে আরো বেশি করে ক্ষুব্ধ করে তুলছিলো।

রাতে খেতে বসে বাবা ছেলে দুজনেই যথেষ্ট গম্ভীর হয়ে গেছে, পাশে বসে পাখার বাতাস করতে করতে লক্ষ্য করছিলেন কুমুদ, তিনি খুব বেশি কোনো ব্যাপারেই মাথা ঘামান না কিন্তু অন্য বারের তুলনায় এবার ব্যাপারটা একটু অন্য রকম লাগছিলো। ছেলে বউয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে মান অভিমান এর পালা চলে সেটা তিনি দেখতে অভ্যস্ত, কিন্তু এবার যে সেটা শুধুই অভিমান নয় সেটা তিনি মৃণালিনীর মুখ দেখেও বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু এসবের সঙ্গে তাঁর স্বামীর গম্ভীর হয়ে থাকার কারণ ঠিক অনুমান করতে পারছিলেন না।

রাতের কাজ কর্ম মিটে যাবার পরে ঘরে এসে খাটে বসে পান সাজতে সাজতে স্বামী কে আস্তে করে রাগের কারণ জানতে চাইলেন কুমুদ,

তোমার ছেলে শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলো না! কি হবে সেই শিক্ষার, যদি কোনো কাজেই না আসে? সে চায় না তার বউ আমার কাজ কর্ম দেখুক!

রাগের গলায় বললেন শ্যাম সুন্দর, তাঁর রাগের কারণ যতটা না সৌম্যর ধৃষ্টতা, তার থেকেও বেশি খরচ করে শেখা পড়াশুনার উপযুক্ত ব্যবহার না হওয়া। তিনি খুব হিসাবী মানুষ, বউ যখন শিক্ষিত তখন তিনি আবার আর একজন লোক কে আলোকের ওপর নজর রাখার জন্যে পয়সা দিয়ে রাখবেন কেনো! কুমদ সবটাই বুঝলেন, তাঁর বড়ো জা যে মৃণালিনী কে খুব বেশি পছন্দ করেন না সেটা তিনি জানেন, তাই ছেলের বকলমে পেছনে থাকা মানুষটি কে চিনতে তাঁর একটুও দেরি হলো না। কিন্তু স্বামী কে বললে তিনি বিশ্বাস করবেন না, নিজের বৌদি কে তিনি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন।
ক্রমশ