মৃণালিনী পর্ব-১৩+১৪

0
204

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৩
সকাল থেকেই বাড়িতে তাড়াহুড়ো পড়ে গেছে, সৌম্য আর একটু পরেই ফিরে যাবে কলকাতায়। হারু সৌম্যর বাক্স নিয়ে গাড়ির পেছনে ঢুকিয়ে রেখেছে, ড্রাইভার এসে গাড়ি বার করে রেখেছে, ট্রেনের সময় হয়ে যাবে আর কিছুক্ষন পরেই, তাই ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছানোটা জরুরী।

মৃণাল একটু শুকনো মুখে সৌম্যর শেষ মুহূর্তের জিনিসপত্রগুলো হাতের কাছে গুছিয়ে রাখছিলো। লাইব্রেরীর বইয়ের মধ্যে সরমার লেখা চিঠিটাও ঢুকিয়ে দিলো সুযোগ মতো, বই পাল্টানোর আগে বিমল দা সেটা বার করে নেবে।গত কাল সারাদিনে একবারের জন্যেও দোতলায় না আসার জন্যে নিজেদের ঝগড়া মেটানো সম্ভব হয়নি। গত দুদিন ধরে যে কষ্ট মনের মধ্যে রেখে সে চলছিলো, তার পরে সন্ধ্যেবেলায় সৌম্যর মুখে ওইসব কথা শুনে নিজেও এতটাই দুঃখ পেয়েছিলো যে রাতে আর মিটমাট করার কোনো ইচ্ছে জাগেনি। সৌম্যও একটুও চেষ্টা করেনি মিটিয়ে নিতে, বড়ো মার বলা কথা আর তার সঙ্গে সারাদিনে একবারের জন্যেও বউয়ের ওপরে না আসা, দুজনের মধ্যেই যথেষ্ট জমে থাকা ক্ষোভ নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছিলো।

বাবা, সব নিয়ে নিয়েছো তো ঠিক করে?

জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে তাকিয়ে দেখলো মৃণালিনী, পারুল বালা ঘরে ঢুকে এসেছেন। বড়ো মা কে দেখেই শশব্যস্ত বলে উঠলো সৌম্য,

তুমি আবার উঠলে কেনো সিঁড়ি ভেঙে, আমি নিজেই তোমার ঘরে যেতাম তো,

সে বললে কি হয় বাছা, তুমি এখন কতদিন আসবে না, তোমার খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে নে! হারুর হাত দিয়ে গাড়ির পেছনে সব গুছিয়ে দিয়েছি, মনে করে খেয়ো কিন্তু,

চমকে উঠলো মৃণাল, সৌম্য এখন অনেকদিন আসবে না! কই তাকে তো কিছু জানায়নি সৌম্য! মনের ভেতরে জমে থাকা কষ্টটা যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো ওর, বড়ো মা না বললে তো সে কিছুই জানতে পারতো না!

তুমি এই সপ্তাহে বাড়ি আসবে না? কই আমাকে বলোনি তো কিছু!

পারুল বালা বেরিয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সৌম্যর দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় প্রশ্ন করলো মৃণালিনী, কান্নায় তার গলা বুজে আসছিলো। সৌম্য একটু থতমত খেলো, সে নিজেও বাড়ি আসবে বলেই ঠিক করেছিলো, বড়মা যে কালকের বলা কথা কে এই সপ্তাহেই শুরু করার জন্যে চাপ দেবেন এটা ভাবে নি সে। কিন্তু এখন আর বড়ো মার কথার অবাধ্য হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু বড়মার আদেশের কথা বউ কে জানতে দিয়ে সে বড়ো মা কে বউয়ের চোখে হেয় করতে চায় না।

হ্যাঁ, আমার কাজের চাপ বেড়েছে, তাই এখন আর প্রতি সপ্তাহে আসা সম্ভব হবে না,

যতটা সম্ভব গম্ভীর গলায় বললো সৌম্য, মৃণালিনী আর একটা কথাও উচ্চারণ করলো না, সে যথেষ্ট অভিমানী, যেখানে অনুরোধের কোনো দাম নেই, সেখানে সে অনুরোধ করে না।

সৌম্যর বাড়িতে ঢোকা বা বেরোনোর সময় বাড়ির সবাই উপস্থিত থাকে, সেখানে শ্বশুর মশাইয়ের সামনে স্বামী কে বিদায় জানানোর জন্যে মৃণালিনীর উপস্থিত থাকা পারুল বালা পছন্দ করেন না বলে এই সময়টা মৃণাল তার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ি যখন দরজা দিয়ে বেরোয় তখন সৌম্য গাড়ির জানলা দিয়ে ওপরে তাকায়, মৃণালের সঙ্গে চোখাচোখি হয় তার, শুধু এই মুহূর্তটির জন্যেই সে উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিবার।

এবারও গাড়ি ছাড়ার পরে ওপর দিকে তাকালো সৌম্য, কিন্তু মৃণালিনী সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো না এই প্রথম বার। সারাটা রাস্তা মন খারাপ হয়ে থাকলো সৌম্যর, তার মৃণাল কে না জানিয়ে কলকাতায় থেকে যাবার সিদ্ধান্তে যে সে খুবই আঘাত পেয়েছে সেটা সৌম্য এখন স্পষ্টই বুঝতে পারছিলো। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই, বড়ো মা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হবেন যদি সে এই সপ্তাহে বাড়ি আসে।

সৌম্য বেরিয়ে যাবার পরে নিজের ঘরে এসে চুপ করে বসেছিলো মৃণাল, এতো তাড়াতাড়ি সৌম্যর এতটা পরিবর্তন বোধহয় আশা করে নি সে। যে সৌম্য শুধু তাকে দেখার জন্যেই প্রতিদিন কোনো না কোনো অজুহাতে তাদের বাড়িতে উপস্থিত হতো, সে এতো দিন মৃণাল কে না দেখে থাকতে পারে এটা তার একবারের জন্যেও মনে হয়নি। সৌম্যর প্রতিদিন তাদের বাড়িতে উপস্থিত হওয়া নিয়ে বাড়ির ঠাকুর চাকররা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতো, মুখে কিছু না বললেও নিজেও সে সবটাই বুঝতো। সেখানে বিয়ের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এই সৌম্য কে তার সম্পূর্ন অচেনা লাগছিলো।

বউ দিদি নিচে চলো, মা ডাকছে,

সরমা র কথায় চমক ভাঙলো মৃণালের, ননদের পিছু পিছু রান্না ঘরের দরজায় উপস্থিত হলো সে। বামুন দিদি রান্না করছে, করুণা হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে জিনিসপত্র, হারুর মা পুকুর ঘাট থেকে মেজে আনা বাসন একধারে ঝুড়িতে উপুড় করে রাখছে, আর সবার সব কিছু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মালা জপতে জপতে নজর রাখছেন পারুল বালা। কুমুদ একধারে বসে কুটনো কাটছিলেন, বউ কে আসতে দেখে নরম গলায় ডাকলেন,

এদিকে এসো বউমা, কথা বলার ছিলো তোমার সঙ্গে,

মৃণাল কোনো কথা না বলেই ওনার পাশে একটা পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসলো। পারুল বালা মালা জপতে জপতে এদিকেই মন দিলেন, কুমুদ এর আবার বউয়ের সঙ্গে কি কথা!

দিদি এখন তো করুণা কে পেয়ে গেছেন তাই তোমার দায়িত্ব অনেক কমে গেছে, সৌম্যর সব কাজ তো এখন ওই করছে, তোমাকে আর ছোটাছুটি করতে হচ্ছে না। আমারও তো বয়স বাড়ছে, আমিও আর ছোটাছুটি করে ওপর নিচ করতে পারিনা বাপু, তাই এবার থেকে আমার কাজ গুলো তুমিই করবে বুঝলে তো? আর শোন তেলের যা দাম, সৌম্য না থাকলে তোমার আর সরমার আর রাতে আলাদা ঘরে শোয়ার দরকার নেই, দুজনেই আমার ঘরে এসে শুয়ে পড়বে। তাতে একটা লণ্ঠনেই হয়ে যাবে, আর তোমারও ভয় লাগবে না, ঠিক বলিনি দিদি?

শেষ কথাগুলো বড়ো জা এর দিকে তাকিয়ে বললেন কুমুদ, পারুল বালা জপ করছিলেন তাই কথা না বলে শুধু মাথা হেলালেন, আপাত দৃষ্টিতে তিনি কোনো খারাপ কিছু অভিসন্ধি পেলেন না কুমুদ এর কথায়। মৃণাল মাথা হেলালো, এমনিতেও এই ব্যাপারে শুধু নির্দেশ পালন করা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই!

যাও তাহলে বউমা আমার বিছানাটা সেই সকাল থেকেই পড়ে রয়েছে, ছেলে বেরোবে বলে আর সময় দিতে পারিনি আজ, তুমি স্নান সেরে ঘর টা একটু গুছিয়ে ফেলো গে!

মাথা নেড়ে উঠে এলো মৃণালিনী, বাসি কাপড় তার ভোর বেলায় উঠেই ছাড়া হয়ে গিয়েছিলো, এখন সে স্নান সেরে পারুল বালার ফুল তুলতে যাবে। অন্য দিন আরও আগে তার এসব কাজ হয়ে যায়, কিন্তু সোমবার দিনটা অন্য রকম, সৌম্যর যাবার তাড়া থাকায় সে বাসি কাপড় ছেড়েই সৌম্যর কাজে লেগে পড়ে। এখন সৌম্য চলে গেছে, আর কোনো তাড়া নেই, সে ধীরে ধীরে হাতের কাজ সারতে লাগলো। মনের মধ্যেকার চাপা কষ্ট তার মুখের মধ্যে প্রকাশ পেতে লাগলো, কোনোটাই কুমূদের নজর এড়ালো না। পারুল বালার শ্যেন দৃষ্টি কেও সে ফাঁকি দিতে পারলো না, তার করুন মুখ দেখে মনে মনে যথেষ্টই পুলকিত হচ্ছিলেন তিনি।

রাতের দিকে যখন কাজ করো তখন তো মাঝে মাঝে বউমা কে ডেকে নিলেই পারো, সে তো এখন থেকে পাশের ঘরে আমার সঙ্গেই থাকছে, কে আর জানতে আসছে তখন! বাইরের লোক জানা নিয়েই তো আপত্তি তোমার ছেলের, বাইরের লোক না জানলেই হলো,

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরে খাটে বসে পান সাজতে সাজতে স্বামী কে উদ্যেশ্য করে বললেন কুমুদ, শ্যাম সুন্দর একটু অবাক হয়ে গেলেন।

তোমার সঙ্গে থাকবে সে! কেনো? বেশ তো সরমা আর সে থাকছিল! কি হলো আবার?

তেলের যা দাম! মিছিমিছি দুটো লণ্ঠনে কাজ কি! একটা জ্বালালেই চলে যায় যখন!

বিষয়ী মানুষ শ্যাম সুন্দরের প্রস্তাবটা মন্দ লাগলো না, সত্যিই তো তেলের খরচ যদি বেঁচে যায় সে তো ভালোই। তিনি একটু অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, অনেক কাজ জমে আছে, কয়েকদিনের মধ্যেই খুব বড়ো একটা কেস আছে সেটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে আছেন একটু।

কি হলো! বললে না তো কিছু! বউ মা আসবে তো?

স্বামীর দিকে পান টা এগিয়ে দিয়ে বললেন কুমুদ,পান টা মুখে দিয়ে একটু অন্য মনস্ক হয়েই জবাব দিলেন শ্যাম সুন্দর,

হ্যাঁ, পাঠিয়ে দিও তাকে! আমি এমনিতেও সময় পাচ্ছি নে একদম! আজকাল আলোক কে যেনো ঠিক বিশ্বেশ হচ্ছে না, বউদি কে কিছু বলো না, যতই হোক তাঁর ভাইপো!

কুমুদ মাথা নাড়লেন, তিনি তো নিজেই জানাতে চান না পারুল বালা কে, উল্টে এই কথায় তাঁরই সুবিধা হলো। বড়ো জা কে এড়িয়ে কি করে বউ কে স্বামী কে সাহায্য করতে ডাকা যায়, গত রাত থেকেই তার পরিকল্পনাই তো করে চলেছেন তিনি। বড়ো জায়ের বিরুদ্ধে স্বামী কে অভিযোগ করে কোনোদিনই তাঁর কোনো লাভ হয়নি, তাই অনেকদিনই সে পথে যাওয়া বন্ধ রেখেছেন। উকিল স্বামীর সঙ্গে থাকতে থাকতে অল্প হলেও কিছু বুদ্ধি তিনিও ধরেন বৈ কি!

পাশা পাশি দুটো ঘর তাঁদের স্বামী, স্ত্রীর। সারাদিন এই ঘরে থাকলেও রাতে শ্যাম সুন্দর অনেক রাত অবধি কাজ করেন বলে তিনি পাশের ঘরে শোন। সেই ভোর থেকে উঠে কাজ কর্ম সেরে আর রাতে জেগে থাকতে ইচ্ছে হয় না কুমুদ এর। দুজনের ঘরের মাঝখান দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা আছে, এঘর থেকে ওঘরে যাওয়ার জন্যে বাইরের বারান্দায় বেরোনোর দরকার পড়ে না। তাই ওই ঘর থেকে মৃণাল এই ঘরে এলে বাইরের কারোরই পক্ষে সেটা জানা সম্ভব হবে না!

যাই, তাকে পাঠিয়ে দিই তাহলে!

কুমুদ উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন। মলিন মুখে নিজেদের ঘর থেকে চাদর, বালিশ নিয়ে সরমা আর মৃণালিনী ধীরে ধীরে মায়ের ঘরে উপস্থিত হলো। তাদের পড়া যে মোটামুটি বন্ধই হয়ে গেলো সেটা তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, একই ঘরে শুয়ে কুমুদ কে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় তাদের জানা ছিলো না। মনটা খুব খারাপ লাগছিলো মৃণালের, আর মাত্র দিন কুড়ি পরেই তার পরীক্ষা দেওয়ার কথা প্রাইভেটে, অথচ সৌম্য এক মাসের আগে আর বাড়ি আসবে না। যদিও বা আসে তাহলেও কিছু না পড়ে সে পরীক্ষা দেবেই বা কিভাবে!

ঘরে বড়ো করে পাতা পালঙ্ক, তার একদিকে পালঙ্কের বাটামে হেলান দিয়ে পান মুখে বসে ছিলেন কুমুদ, দুজনে এসে তাদের বালিশ চাদর রেখে ম্লান মুখে বসলো। দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন কুমুদ, বউ মা নাহয় ছেলে চলে যাওয়ার দুঃখে দুঃখিত, কিন্তু মেয়ের দুঃখী মুখের কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না।

যাও মা, তোমার শ্বশুর মশাই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, কিসব কাজ আছে বুঝি ওনার!

মৃণাল চমকে উঠলো, কাল সৌম্যর বলার পরেও বাবা ডেকে পাঠিয়েছেন! তার কি যাওয়া উচিত হবে! সৌম্য জানলে আরও বেশি বিরক্ত হবে না তো!

কি হলো? যাও!

উনি কাল বারণ করে দিয়েছিলেন, বাবা জানেন সবটাই। আমার কি যাওয়া উচিত হবে! উনি জানতে পারলে রাগ করবেন!

শাশুড়ির কথার উত্তরে একটু দ্বিধা জড়ানো গলায় বললো মৃণাল।

আরে! জানবে কি করে? তুমি তো ঘরের ভেতর দিয়ে যাবে! আর সৌম্য বারণ করেছে কারণ সে চায়না তুমি আলোকের সামনে বসে এসব দেখো, এখন তো আলোক নেই, তাই তোমার যেতে কিছু অসুবিধা নেই, শুধু দিদি না জানলেই হলো!

নিচু গলায় বললেন কুমুদ, তার পরেও মৃণাল ইতস্তত করছে দেখে আসল কথাটা আর লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন না তিনি,

আসলে তোমার শ্বশুর মশাই মনে করেন আলোক হিসাবে কিছু গরমিল করছে, কিন্তু তিনি দেখার সময় পাচ্ছেন না। তবে একথা দিদি জানুক সেটি তিনি চান নে, কারণ আলোক হলো গিয়ে দিদির ভাইপো, এসব কথা তিনি সহ্য করতে পারবেন নে।

এই কথা শোনার পর আর কোনো দ্বিধা রইলো না মৃণালের, সৌম্য রাগ করলেও শ্বশুর মশাইয়ের সম্পত্তি সে বেহাত হতে দিতে পারে না কিছুতেই। সে দ্রুত উঠে শ্বশুর মশাই এর ঘরে গিয়ে ঢুকলো,

বাবা, মা বললেন আপনার কিছু সাহায্যের প্রয়োজন,

বৌমার গলার আওয়াজে মুখ তুলে তাকালেন শ্যাম সুন্দর,

হ্যাঁ, বউমা, ওই ওপরের তোরঙ্গের থেকে খাতাগুলো নামিয়ে আনো, ওতে আলোকের করা হিসেব গুলো আছে, ওগুলো তোমার সময় মতো, একটু একটু করে আবার মিলিয়ে নিও!

কথা শেষ করেই আবার কাজে মনোনিবেশ করলেন শ্যাম সুন্দর, মৃণাল খুব উৎসাহ নিয়ে খাতা গুলো মেলাতে লাগলো। যেকোনো পড়াশোনা সংক্রান্ত ব্যাপারেই তার খুব উৎসাহ, মনের মধ্যেকার কষ্টগুলো একটু একটু করে সম্পূর্ন ভুলে গিয়ে হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো মৃণালিনী।

যাও এবার ঘুমিয়ে পড় গে বউমা, অনেক রাত হলো,

শ্বশুর মশাইয়ের কথায় খাতা থেকে মুখ তুলে তাকালো মৃণালিনী,

আপনি কি এখন ঘুমিয়ে পড়বেন বাবা?

হ্যাঁ, আমার হয়ে গেছে,

তাহলে আমি লন্ঠন টা ওঘরে নিয়ে যাই বাবা? আমার ঘুম আসছে না আমি একটু গল্পের বই পড়তাম,

ঠিক আছে, নিয়ে যাও তাহলে,

বলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন শ্যাম সুন্দর, উনি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেন বলে ওনার লন্ঠন এ অনেক বেশি তেল ভরে হারুর মা। শাশুড়ি ঘুমিয়ে পড়েছেন, লন্ঠন হাতে মৃণাল নিজের ঘরে ঢুকে এলো, যা তেল আছে তাতে আজ অনেকক্ষন পড়তে পারবে ও। পারুল বালা নিচের ঘরে থাকেন, হাঁটুর ব্যথায় ওপরে ওঠেন কদাচিৎ, আর গল্পের বই না পড়ার বই সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা কুমুদ এর নেই, তাই আজ অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়ে পড়তে বসলো মৃণালিনী।
ক্রমশ

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৪
গত দিন সাতেক ধরেই রাতে এভাবেই সুন্দর পড়াশোনা চলতে লাগলো মৃণালের, পারুল বালা জানতেও পারছিলেন না। উপরন্তু ছোটো জা এর ঘরে বউমা থাকছিল বলে যথেষ্টই নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি। মৃণাল কেনো দুপুরে ছাদে বসে ঢোলে সেই সমস্যার কোনো সমাধান না বার করতে পারলেও এটাকে তিনি বউয়ের অপদার্থতা এবং অলসতা বলেই ধরে নিয়েছিলেন।

কুমুদ নিজেও নিশ্চিন্ত হয়ে ছিলেন, লণ্ঠনের তেল বাঁচানো তাঁর উদ্যেশ্য ছিলো না, তিনি বউমা কে স্বামীর সাহায্যের জন্যে আনতে চেয়ে ছিলেন। মৃণালের পড়া শোনা চললেও সরমা র পড়াশুনা মায়ের ঘরে এসে বন্ধ হয়েছিল। বেশ কয়েকদিন এইরকম চলার পরে একদিন মা কে ধরে বসলো সরমা, সে যে ইতিমধ্যেই বেশ এগিয়ে গেছে সেটুকু মা কে জানতে না দিয়েই নতুন করে পড়া শুরুর আবদার করলো,

মা, আমি বউ দিদির কাছে পড়বো, বড়ো মা কিছু জানতে পারবে না,

কুমুদ অনুমতি দিলেন, কেউ যে জানতে পারবে না সেটা জেনেই তো বউমা কে এই ঘরে এনে রাখা, মেয়ের এই আবদার রাখা খুব কিছু দূরহ ব্যাপার নয়।

বউ দিদি আমি তোমার কাছে পড়বো, মা অনুমতি দিয়েছে,

এক রাতে মৃণাল ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বললো সরমা, মৃণাল নিজেও খুশি হলো। সরমা কে পড়তে শাশুড়ি অনুমতি যখন দিয়েছেন তখন এই সুযোগে তার পড়াটা আরো বেশি সহজ হয়ে গেলো। আর কুমুদ যে রকম মানুষ তাতে তিনি খুব বেশি এসব ব্যাপারে মাথাও ঘামাবেন না।

এতো কিছুর মধ্যেও সৌম্যর যাওয়ার আগের করা ব্যবহারের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলো না মৃণালিনী। এই ঘটনার পেছনে যে বড়ো মার হাত আছে সেটা বুঝেই মনে মনে পারুল বালার ওপর ক্ষিপ্ত হচ্ছিলো সে। কিন্তু তার রুচি বোধ, শিক্ষা এই সব কিছুই তাকে কিছুতেই পারুল বালার স্তরে নিজেকে নামিয়ে ফেলতে দিচ্ছিলো না। তাই মনের ক্ষোভ মনেই পুষে রাখছিলো সে।

এ সপ্তাহে আসবে না বলে যাওয়া সত্বেও, তার খুব আশা ছিলো শেষ পর্যন্ত সৌম্য আসবে শনিবারে, কিন্তু সে না আসায় মৃণালিনী যতটা দুঃখ পেলো পারুল বালা ঠিক ততটাই খুশি হলেন। তার কথা মান্য করে সৌম্য থেকে গেছে কলকাতায় এটা তাঁকে ভীষণ শান্তি দিচ্ছিলো। কলকাতার মেয়ে মৃণালিনী যে তার হাজার চেষ্টাতেও স্বামী কে হাত করতে পারেনি এটা ভেবেই রীতিমত প্রফুল্ল ছিলেন তিনি।

কিন্তু কুমুদ ছটফট করছিলেন, বড়ো জা র বারণ সত্বেও স্বামী কে অনেক বুঝিয়ে তিনি এই শনিবারও গাড়ি পাঠিয়েছিলেন স্টেশনে, আশা ছিলো ছেলে ফিরবে নিশ্চয়ই। খালি গাড়ি ফিরতে দেখে বউ এর সঙ্গে তিনিও যথেষ্টই দুঃখ পেলেন।

দিদি, সৌম্য কে মাসে একবার করে আসতে বলেছেন! আমার ছেলে, তাও আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই!

প্রতিকার হবে না জানা সত্বেও বড়ো জার বিরুদ্ধে স্বামীর কাছে অভিযোগ জানালেন তিনি। শ্যাম সুন্দর বৈঠকখানায় বসে কাজ করছিলেন, এমনিতেও ছেলে আসবে না জানা সত্বেও, এই প্রথম বার বউ এর কথায় গাড়ি পাঠিয়েছিলেন স্টেশনে। খালি গাড়ি ফিরে এসেছে, কিন্তু তেল তো খরচ হয়েছে! তাই বিরক্ত হয়েছিলেন মনে মনে।

ছেলে শুধু তোমার নয়, ও এবাড়ির ছেলে। বৌদি যদি ভেবে থাকেন যে ও এক মাস বাদে বাদে বাড়ি এলে ওর শরীর ভালো থাকবে, ওর পরিশ্রম কম হবে তাহলে তিনি ভালোর জন্যেই বলেছেন। আসবে না সে জানা সত্বেও, তোমার কথায় গাড়ি পাঠিয়েছি, এর বেশি আর কিছু আশা কোরো না!

শ্বশুর মশাইয়ের ঘর থেকে আসা কথোপকথন মৃণাল তার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনছিল। নিজের কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ির জন্যেও খারাপ লাগছিলো তার। এই বাড়িতে যে ওনার কথার কোনো মূল্যই নেই সেটা সে প্রথম দিন এবাড়িতে পা দিয়েই বুঝেছিলো। সারা জীবন বড়ো জা র দাপটে কুঁকড়ে থাকা কুমুদ আস্তে আস্তে মৃণালের মনে জায়গা করে নিচ্ছিলেন।

অনেকক্ষন ধরেই পশ্চিম দিকের শরিকি পুকুর থেকে জেলেদের হৈ চৈ শুনতে পাচ্ছিলো মৃণালিনী, পুকুরে জাল ফেলা হচ্ছে। আজ দুপুরে সরমার সই বিভা কে দেখতে আসবে। ছেলে নাকি কলকাতায় থাকে, কানাঘুসোয় শুনেছিলো মৃণাল, যদিও বিভার মা এসব ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানাতে চান না। বিভাদের সঙ্গে পাশের শরিকি জমি নিয়ে ইদানিং মাঝে মাঝেই গন্ডগোল হচ্ছে, তাই একটু মন কষাকষি চলছে দুই বাড়িতেই।এই গ্রামে বিভাই প্রথম মেয়ে যার কলকাতায় সম্বন্ধ হচ্ছে, তাই তাঁরা কর্তা গিন্নি দুজনেই খুব গর্বিত।

হারুর মা এ সব বিষয়ে যথেষ্টই খবর রাখে, তার কাছ থেকে কিছু চেপে রাখা মুশকিল। ওবাড়ির কাজের লোকের কাছ থেকে পাকা খবর নিয়ে এসেছে সে। এই কথা শোনার পর থেকেই পারুল বালা সরমার বিয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, কথায় কথায় দেওরের কাছে ছেলে দেখার কথাও পেড়ে ফেলেছেন। সেই থেকে সরমা খুব মনমরা হয়ে আছে।

এখন নিচের উঠোনে মাছ ভাগা ভাগি হচ্ছে, মৃণাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলো। এই পুকুরে ওদেরও ভাগ আছে, তাই মাছ ধরা হলেই ওরাও ভাগ পায়। প্রথম প্রথম এতো বড় বড় মাছ জালে জড়িয়ে নিয়ে এসে উঠোনে ভাগ করা দেখতে ওর খুব ভালো লাগতো, এখন এগুলো দেখে আর অবাক হয় না ও।

বউমা কোথায় গো? একটু নিচে এসো দিকিনি,

বিভার মায়ের গলার আওয়াজে বারান্দা থেকেই নিচে উঁকি দিলো মৃণালিনী,

হ্যাঁ, কাকিমা বলুন,

তোমার ননদ কে যে আজ কলকেতা থেকে ছেলে দেখতে আসছে গো! ওকে একটু কলকেতার মেয়েদের মতো করে সাজিয়ে দাও তো!

এতক্ষনে ওনার এখানে আসার কারণ বুঝতে পারলো মৃণাল। ওর প্রসাধন সামগ্রী সরমা আর বিভা দুজনেই ব্যবহার করে, বৌদির সাজার জিনিসে ওদের অধিকার আছে বলেই মনে করে ওরা। মৃণালও ওদের এসবের ব্যবহার শিখিয়েছে যত্ন করেই। কিন্তু এখন বিভা কে সাজাতে যাওয়ার অনুমতি বড়ো মা দেবেন কিনা ও বুঝতে পারছিলো না, বিভা কে দেখতে আসার খবর চেপে রাখার জন্যে তিনি যথেষ্টই বিরক্ত হয়ে আছেন।

কুমুদ এতক্ষনে গলার আওয়াজ পেয়ে মৃণালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর চোখ মুখ ফুলে আছে, সম্ভবত কাঁদছিলেন, স্বামীর ব্যবহারে তিনি খুব দুঃখ পেয়েছেন।

বড়ো মা র কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে কাকিমা,

মৃদু গলায় বারান্দা থেকে বললো মৃণাল, বিভার মা একটু থমকালেন, পারুল বালা যে মেয়ের বিয়ের খবর চেপে রাখার জন্যে তার ওপর রেগে আছেন, সে খবর তিনি পেয়েছেন ইতি মধ্যেই।

তুমি যাও বউমা, বিভাকে সাজিয়ে দিয়ে এসো, আমি বলছি,

পাশ থেকে বলে উঠলেন কুমুদ, তাঁর কথার কোনো মূল্য নেই সেটা বুঝেই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, তাই একবারের জন্য হলেও নিজের পুত্রবধূর ওপর অধিকার বোধ দেখাবার চেষ্টা করলেন। মৃণাল এক মুহুর্ত ভাবলো, এটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার, এ ব্যাপারে শাশুড়ির মতই তার জন্যে যথেষ্ট, না হয় আজকের দিনটা একটু কুমুদ এর কথার দামই দিলো সে!

কাপড়টা পাল্টে আসি কাকিমা, একটু দাঁড়ান,

বলেই নিজের ঘরে ঢুকে গেলো সে, কুমুদ খুশি হলেন, এই প্রথম বাড়িতে তাঁর কথার মান রাখলো কেউ! কাপড় পাল্টে নিচে নেমে এসে কোথাও পারুল বালা কে দেখতে পেলো না মৃণালিনী, কিন্তু করুণা ঘর ঝাঁট দিতে দিতে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে লক্ষ্য করলো। করুণার জানা মানেই যে পারুল বালা জানবেন এটা জানা সত্বেও এই প্রথম বার বড়ো মা র অনুমতি ছাড়াই বিভাদের বাড়ি যাবার জন্যে বেরিয়ে পড়লো।

বিভার মা যথেষ্টই চালাক চতুর মহিলা, তিনি শুধু যে মৃণাল কে দিয়ে মেয়েকে সাজালেন তাই নয়, পাত্র পক্ষ আসা পর্যন্ত ওকে বসিয়ে রাখলেন। কলকাতার থেকে আসা পাত্র পক্ষের সঙ্গে কথা বলার জন্যে মৃণালের থেকে আদর্শ আর কেই বা হতে পারে। পাত্র রা যথেষ্টই বিত্তশালী এবং উচ্চ শিক্ষিত, উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির মানুষ, তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যে সময় কোথা দিয়ে কেটে গেলো মৃণালিনী নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না। অনেক দিন পরে এই গ্রাম্য জটিলতার মধ্যে থেকে বেরিয়ে অনাবিল কিছু হাসি আনন্দের মুহূর্ত কিছুটা হলেও তার মনের ভার লাঘব করলো।

যখন খেয়াল হলো তখন বেলা বেশ অনেক হয়ে এসেছে, আর কিছুক্ষনের মধ্যেই খাওয়া দাওয়া শুরু হবে, তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো মৃণালিনী। এই হাস্যোজ্বল পরিবেশ ছেড়ে তাকে আবার ওই বড়ো মার টেনে দেওয়া গণ্ডির ভেতরে ঢুকতে হবে ভেবেই তার মন খারাপ হয়ে গেলো।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছিলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাত্র পক্ষের লোকজন কে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখলো মৃণালিনী। এ গ্রামে একমাত্র তার শ্বশুর বাড়িতেই গাড়ি আছে, সে গাড়ি সবাই চেনে, তাই আজ অন্য গাড়ি দেখে গ্রামের বউ ঝি রা নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করছিলো। কিছু টুকরো টুকরো কথা কানে আসছিলো মৃণালের, হারুর মা তাদের মধ্যে মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালার সময় হয়ে এসেছে, দেরি হলেই বড়ো মা বিরক্ত হবেন, এমনিতেও মুখে কিছু না বললেও করুণা র কাছে বিভাদের বাড়ি যাবার খবর তিনি পেয়েছেন নিশ্চয়ই। তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়া কাপড় পাল্টে নিচে নামলো মৃণাল।

শ্বশুর মশাই চাটাইয়ে বসে চা খাচ্ছেন, পাশে পাখা নিয়ে বসে রয়েছেন পারুল বালা। সাধারণত স্বামীর খাওয়া বা বিশ্রামের সময় কুমুদ পাখার বাতাস করেন, যেদিন কোনো বিশেষ কিছু আলোচনা থাকে সেদিনই পারুল বালা পাখা হাতে বসেন। সেই বিশেষ আলোচনার লক্ষ্য আজকে তার বিভা দের বাড়ি যাওয়া কিনা সেটা নিয়েই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো মৃণালিনী।

তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে বারান্দা দিয়ে দোতলার সিঁড়ি তে ওঠার জন্যে যাচ্ছিলো মৃণালিনী, পেছন থেকে ডাকলেন পারুল বালা,

দাঁড়াও বাছা, তুমি নাকি বিভা কে সাজাতে গিয়েছিলে?

ততোক্ষনে কুমুদও এসে দাঁড়িয়েছেন ওখানে,

হ্যাঁ, কাকিমা ডাকতে এসেছিলেন আমাকে,

ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো মৃণালিনী,

সেতো ভালো কথা! কিন্তু আমাকে জানাবার কথা টুকুও কি মনে হয়নি তোমার! একা একাই ঠিক করে ফেললে! এ বাড়ির বউরা এমন যেখানে সেখানে যায় না!

আমি মা কে জিজ্ঞেস করে গিয়েছিলাম,

বড়ো মা র কথার উত্তরে খুব শান্ত গলায় জবাব দিলো মৃণাল। ছোটো জা র কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার কথায় যেনো আগুনে ঘি পড়লো, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন পারুল বালা,

কি বললে বাছা! আমি থাকতে তুমি ছোটর কাছে অনুমতি নিয়েছো! কেনো আমি কি মরে গেছি গা!

বলেই কুমুদ এর দিকে ঘুরলেন পারুল বালা,

আর তুই বা কোন সাহসে ওকে যেতে বলিস লা! এ বাড়ির কি কোনো মান সম্মান নেই গা! ওদের মেয়ে ওরা বুঝবে! আজ তোর গুনোধরী বউ না থাকলে ওর মেয়ের বিয়ে হতনি বুঝি! এই শেষ বার বলে দিলুম, আর কোনোদিনও যদি এ সাহস দেখাস তবে ওই বউ শুদ্ধ যদি তোকে ঘর থেকে বার করে না দিইছি, তবে আমিও পারুল বালা নই।

কুমুদ স্বামীর দিকে তাকালেন, পুত্রবধূর সামনে এতোটা অপমানিত হয়ে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। মৃণালিনী অবাক হয়ে শ্বশুর মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো, বউ কে বৌদির কাছে এতো অপমানিত হতে দেখেও নির্বিকার ভাবে চা এ চুমুক দিয়ে যেতে লাগলেন শ্যাম সুন্দর।

বড়ো মা কি মা কে এই ভাবে বলতে পারেন বাবা? এই বাড়ি তো মাযেরও তাই না!

শ্বশুর মশাই এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মৃণালিনী, শ্যাম সুন্দর চমকে তাকালেও নির্বাক হয়েই থাকলেন।

থাক মা, চুপ করো, কথায় কথা বাড়ে!

চোখ মুছতে মুছতে বললেন কুমুদ, মৃণালিনী তাঁকে থামিয়ে দিলো।

সব কিছুতেই চুপ করে থাকলে চলে না মা, নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হয়। আর বড়ো মা যে অন্যায় বলছেন সেটা তো তাঁকেও বুঝিয়ে দিতে হবে তাই না? নাহলে এরকম ভুল তো উনি আবার করবেন ভবিষ্যতে। ওনার তো জানা উচিত যে এই বাড়িতে আপনার ঠিক ততটাই অধিকার আছে যতটা ওনার আছে, তাই বাড়ি থেকে বার করে দেবার কথা উনি কখনই বলতে পারেন না।

বউ এর সাহস দেখে পারুল বালা একদম অবাক হয়ে গেলেন, তাঁর কথায় প্রতিবাদ করার সাহস এখানে আগে কেউ দেখায় নি। ওখানে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে মৃণালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, হারুর মা আর করুণা তাদের মনিব এবার পাল্টে ফেলা উচিত কিনা চিন্তা করতে লাগলো কিন্তু এতো কথার পরেও শ্যাম সুন্দর নিরুত্তর রইলেন।

তিনি যথেষ্টই বুদ্ধি ধরেন, এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে কোনো এক পক্ষের হয়ে কথা বলা যে তাঁর পক্ষে একটুও সুবিধাজনক নয় সেটা বুঝেই তিনি একদম মৌনব্রত ধারণ করলেন। বৌমার এতো বড়ো কথার উত্তরেও দেওর কে নিরুত্তর থাকতে দেখে ধৈর্য্য হারালেন পারুল বালা,

বলি কানের কি মাথা খেয়েছো ঠাকুর পো! এতো বড়ো কতা বললো তাও তুমি চুপ করে থাকলে!

বাবা কি করে কিছু বলবেন বড়ো মা, আপনি যখন মা কে বলছিলেন উনি তো তখনও চুপ করেই ছিলেন! মা এমন কি অপরাধ করেছিলেন বলুন তো? বিভা তো সরমার বয়সী একটা মেয়ে, একটু না হয় সাজাতেই গিয়েছি, তাতে কি ক্ষতি হয়েছে!

পারুল বালা অসহায় বোধ করছিলেন, যে দেওরের প্রশ্রয়েই তিনি এতো দিন ছড়ি ঘুরিয়েছেন আজ সেই দেওরের চুপ করে থাকার জন্যে কিছুতেই একটা যুতসই ব্যবস্থা করে উঠতে পারছিলেন না, পাছে তাঁর নিজস্ব কাজের লোকেরা আর তাঁর কথাকে গুরুত্ব না দেয় এরকম একটা সম্ভাবনার কথাও তাঁর মাথায় আসতে লাগলো। এদিকে তিনি সৌম্য কে আসতে বারণ করে দিয়েছেন ফলে বউয়ের বিচার তিনি কিভাবে করবেন সেটাও তাঁর কাছে একটা বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো।

ঠিক সেই মুহূর্তেই সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো খুব জোরে জোরে, এই ভর সন্ধ্যে বেলায় সাধারণত খুব প্রয়োজন ছাড়া গ্রামের মানুষজন বাড়ির বাইরে বার হন না। তাই এই প্রসঙ্গ চাপা পড়লো, পারুল বালাও মনে মনে শান্তি পেলেন, কারণ সেই মুহূর্তে বউয়ের কোনো উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে না পেরে নিজে হীন্যমন্যতায় ভুগছিলেন।

সবার নজর দরজার দিকেই ঘুরলো, পারুল বালার ইশারায় করুণা দরজার দিকে ঠিক যতটা জোরে দৌড়ে গেলো, ঠিক ততটা জোরেই হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এলো,

বউ দিদি, তোমার বাপের বাড়ি থেকে লোক এয়েছে গো,তোমার বাবার নাকি শরীল খারাপ!

খবরটা মৃণালের জন্যে এতটাই আকস্মিক ছিলো যে, কে খবর এনেছে সেটুকু দেখার মতো ক্ষমতাও তার ছিলো না, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ওখানেই মাটিতে বসে পড়লো মৃণালিনী।
ক্রমশ