মৃণালিনী পর্ব-১৫+১৬

0
334

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৫
সন্ধ্যার পর থেকে যেনো একটা ঝড় বয়ে গেলো তার জীবনে। বড়মার প্রবল চিৎকার করে তাদের শাশুড়ি, বউমা কে শাসনের মধ্যেই, করুণার ছুটে এসে বাবার অসুখের খবর দেওয়া, সব মিলিয়ে কিছুক্ষনের জন্যে কথা বলতেও ভুলে গিয়েছিল মৃণাল। নিজেকে সামলে উঠে দেখেছিলো বাড়ির চাকর ব্রজ দাদা আর বামুন মাসি দুজনেই ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

কর্তা বাবুর অসুস্থতার খবর দিয়ে শ্যাম সুন্দরের কাছে মৃণাল কে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার আবেদন জানালো ব্রজ,পাছে পরপুরুষ ব্রজর সঙ্গে একা তাকে ছাড়তে না চায় শ্বশুরবাড়ি র লোকেরা তাই সাথে করে বামুন মাসি কে নিয়ে এসেছে সে। সেই সঙ্গে শ্বশুরের অসুস্থতার খবর দিয়ে লেখা, বাবার কাছে পাঠানো সৌম্যর চিঠিও তুলে দিলো শ্যাম সুন্দরের হাতে।

ছেলের চিঠি পড়েই দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন শ্বশুরমশাই, মৃণালের কলকাতা যাবার ব্যবস্থা হতে লাগলো। ভোর বেলা আলোক কে গাড়ি বার করার নির্দেশ দিয়ে রাখলেন, কিন্তু ট্রেন তো আর সকালের আগে ছিলো না তাই সেই সময়টুকু তো অপেক্ষা করতেই হতো। সেদিনের মতো কুমুদ আর মৃণালের বিচার স্থগিত রইলো, পারুল বালা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পেরে দুঃখিত হয়ে পড়লেন।

তবে প্রসঙ্গ ঘুরে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি, এই মুহূর্তে বউয়ের বাড়ির ঠাকুর, চাকরের সামনে বিচার সভা বসালে তাতে যে আখেরে তাঁরই ক্ষতি সেটা বুঝেই সে চেষ্টায় আপাতত ইতি টানলেন। বউয়ের সাহস দেখে তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র রাগ দেখিয়ে রাতে না খাওয়ার প্রয়োগও তিনি করতে পারলেন না কারণ সবার সহানুভূতি সেই মুহূর্তে বাবার অসুস্থতার খবরে মৃণালের দিকেই গেলো। তাই বউয়ের এত বড় ধৃষ্টতা দেখেও নিজেকে সংযত রাখা ছাড়া সেই মুহূর্তে অন্য কিছু তাঁর করার ছিলো না।

রাতের খাবার মুখে উঠলোনা মৃণালের, কোনো মতে শাশুড়ির কথা তে জোর করে দু মুঠো মুখে দিলো সে। রাতে নিচের ঘরে আলোকের সঙ্গে ব্রজ র থাকার ব্যবস্থা হলো, রাত পর্যন্ত জিনিস পত্র গোছানোয় সাহায্য করার সুবিধার জন্যে মৃণালের ঘরের মেঝেতে বামুন মাসি শুলেন। সরমা তার মায়ের সঙ্গে শুতে গেলো।

আস্তে আস্তে সারা গ্রামের সঙ্গে চৌধুরী বাড়িও নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো, মৃণালিনী চোখের জল মুছতে মুছতে তোরঙ্গ খুলে জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো, চারপাশ ক্রমশ নির্জন হয়ে এসেছে দেখে এতক্ষনে বামুন মাসি তার কাপড়ের পুঁটলি খুলে এক খানা চিঠি মৃণালের দিকে এগিয়ে দিলো।

জামাই বাবু দিয়েছেন,

সৌম্যর চিঠি! অথচ সেটা তাকে লুকিয়ে দিচ্ছে বামুন মাসি! চিঠিটা খুলেই অবাক হয়ে গেলো মৃণাল, সৌম্য তাকে বাবা কে নিয়ে চিন্তিত না হয়ে বরং নিজের বই পত্র নিয়ে যেতে কিছু মাত্র ভুল যাতে না হয় সেদিকে বেশি নজর দিতে বলেছে! একই চিঠি প্রায় বার পাঁচেক পড়ে ফেলার পরে এটুকু মৃণালের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো যে বাবার অসুস্থতা নয়, ব্রজ আর বামুন মাসির এখানে আসার আসল উদ্যেশ্য তাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়া!

কিন্তু বাবা কি জানেন এসব! তিনি মিথ্যাচার পছন্দ করেন না, তাঁর অগোচরে ব্রজ দাদা বা বামুন মাসি এখানে কি করে এলো! ধৈর্য্য রাখতে না পেরে শেষে কথাটা জিজ্ঞেস করেই ফেললো মৃণাল,

জামাই বাবু কর্তা বাবু কে তোকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেই পাঠিয়েছেন, তিনি এসব জানেন না। পরে জামাই বাবু আমাদের এ বাড়ি এসে এরকম বলতে বলে দিয়েছেন,

মৃণালিনীর বুকের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে গেলো একদম, বাবা বা শ্বশুর মশাই পরে জানতে পারলে কি হবে সেটা ভেবেই পরীক্ষা দিতে যাওয়ার ইচ্ছেটাও কমে আসছিলো ক্রমশ। সৌম্য যে নিজের বিয়ের ক্ষেত্রেও এরকমই কিছু করে ছিলো সেই গল্প সে পরে স্বামীর মুখ থেকেই মজার ছলে শুনেছিলো আগে, কিন্তু সেখানে তার কোনো ভূমিকা ছিলো না। এখানে সে নিজেও জড়িত, ভয়ে তার মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে দেখে হেসে ফেললো বামুন মাসি,

তুই চলতো মা! কেউ জানতে পারবে না। একা ব্রজ এলে কোনো মেয়ে মানুষ সাথে নেই বলে তোর জ্যেঠ শাশুড়ি যে তোকে একা ছাড়বেন না সেটা জেনেই তো জামাই বাবু আমাকেও আসতে বললেন। না হলে নাকি উনি তোদের বাড়ির কাজের লোক কে সাথে পাঠিয়ে দেবেন! সে গেলে তো আর দেখতে হবে না! সবাই সব জেনে যাবে! জামাই বাবু সব দিক ভেবেই কাজ করেছেন, কর্তা বাবুও কিছু বুঝতে পারবেন না।

এতক্ষনে মুখে হাসি ফুটলো মৃণালের, মনে মনে সৌম্যর বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না সে। গত কয়েকদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, দুঃখ, মান অভিমান সব কিছু মিলিয়ে গেলো এক নিমেষে, রাত টা যেনো আর কাটতে চাইছে না, কলকাতা যাবার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো মৃণালিনী।

সকালে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই বাসি কাপড় ছেড়ে যাবার জন্যে তৈরী হলো মৃণাল, মুখে একটা দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে বড়ো দের প্রণাম পর্ব শেষ করলো, কুমুদ বেয়াই মশাইয়ের মঙ্গল কামনায় দিয়ে আসা পুজোর প্রসাদী ফুল, তার শাড়ির আঁচলে বেঁধে দিলেন।

বাপ সুস্থ হলেই কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো বাছা! বেশি দিন বাপের বাড়ি থাকা আমাদের বাড়িতে চলে নে,

গাড়ির পেছনে সব জিনিসপত্র ওঠানোর পরে, মৃণাল উঠে বসতে যাচ্ছিলো, বড়ো মা র কথায় ফিরে তাকালো। পারুল বালা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হয়তো, শ্যাম সুন্দর তাঁকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলেন।

আহ! যাবার মুখে আবার পিছু ডাকা কেনো! এসব কথা এখন থাক!

বলেই বৌমার দিকে ঘুরলেন শ্যাম সুন্দর,

সৌম্য কে বলো বেয়াই মশাইয়ের সুস্থতার খবর দিয়ে একটা তার করে দিতে,

শ্বশুরমশাই এর কথায় মুখ নিচু করে ঘাড় নাড়লো মৃণালিনী, সরমা জল ভরা চোখে বৌদির দিকে তাকিয়ে ছিলো, সে বাস্তবিকই দুঃখ পেয়েছে এই খবরে। খুব ইচ্ছা করলেও শেষ পর্যন্ত তাকেও কিছু না জানানোর সিদ্ধান্তই নিলো মৃণাল। অনেক সময়ই কিশোরী বয়সের উচ্ছাসে সে অনেক অপ্রয়োজনীয় কথাও বলে ফেলে।

গাড়ি বেরিয়ে যাবার পর দু হাত কপালে ঠেকালেন কুমুদ, “দুর্গা দুর্গা”। সরমা চোখের জল মুছে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো, শুধু একমাত্র কোনো কথা না বলেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলেন পারুল বালা। গত কালের আনন্দ আজ তার চিন্তায় পর্যবসিত হয়েছে। তিনি নিজেই সৌম্য কে এক মাস ছাড়া বাড়ি আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশ মেনেই সৌম্য এই শনিবার বাড়ি আসেনি। কিন্তু সে প্রচেষ্টায় লাভ হলো কই! বউই তো কলকাতা চলে গেলো! এখন বাপের অসুখে সেবার নাম করে কতো কাল ওখানে পড়ে থাকবে কে জানে!

পারুল বালার এই চিন্তিত মুখ অন্য কেউ খুব একটা লক্ষ্য না করলেও হারুর মার নজর এড়ালো না, উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে সবটাই লক্ষ্য রাখছিলো সে। এতক্ষনে সবাই চলে গেছে দেখে সে সামনে এগিয়ে এলো,

বলি কাজটা কি ঠিক হলো গো কর্তা মা! একদম তাকে একা ছেড়ে দেওয়া কি উচিত কাজ হলো! সঙ্গে কাউকে পাঠালে কি ভালো হতুনি!

কথাটা যে তাঁর নিজেরও মনে হয়নি তা নয়, কিন্তু তিনিই বা কি করবেন! শুধু ব্রজ এলে না হয়, একা তার সঙ্গে না ছাড়ার অজুহাতে সঙ্গে করুণা কে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু এখানে তো বাড়ির বামুন মেয়েটিকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে, এখন তিনি পাঠাতে চাইলেও তো দেওর শুনতেন না!

কিন্তু মনের মধ্যে থেকে খুঁতখুঁতে ভাবটা তাঁর কিছুতেই যাচ্ছে না, কে জানে বাপের বাড়ির লোকজন তাঁর চিৎকার শুনেছিলো কিনা! গিয়ে আবার তিল কে তাল করে বাড়ির কর্তার কানে তুলে দেয় নাকি! পারুল বালা কে অন্য মনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারুর মা খুব অবাক হলো, সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, পারুল বালা তাকে থামিয়ে দিলেন,

চুপ যা দিকি তুই! একে আমি মরছি নিজের জ্বালায় তার মধ্যে তোর বক বক! ওদিকে ছোটো কে দেখেছিস! ভোর না হতেই বেয়াইয়ের নামে পুজো দিয়ে এলেন! আমাকে বোকা ঠাওরেছে! এই করে বিদ্যেধরী বউ কে নাকি উনি হাত করবেন! ওই বউ যদি না ওর মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে, তবে আমার নামও পারুল বালা নয়।

হারুর মা আরও কিছু সঙ্গত করতেই যাচ্ছিলো, দূর থেকে এগিয়ে আসা কুমুদ কে দেখে থেমে গেলো। এখানে যে তাঁরই সম্বন্ধে কথা হচ্ছে সেটা কুমুদ দুজনকে এক সঙ্গে দেখেই বুঝতে পারলেন, কালকের করা বড়ো জায়ের অপমান তিনি একটুও ভোলেন নি এখনো।

মৃণালিনীর কথা কিছুটা হলেও তাঁর মধ্যে সাহসের সঞ্চার করেছিলো। নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হয়, বৌমার বলা এই কথা তাঁর মনের জোর বাড়াতে সাহায্য করছিলো। মনটা যথেষ্টই বিক্ষিপ্ত হয়েছিলো, কিন্তু বড়ো জা কে কিছু বলার সাহস এখনও তাঁর নেই, তাই সমস্ত রাগটাই গিয়ে হারুর মায়ের ওপর পড়লো,

বলি ঝাঁটা হাতে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেই কি চলবে হারুর মা, ওদিকে যে রাতের এঁটো বাসন গুলো সেই থেকে পড়ে আছে, তার কি হবে? বলো তবে, আমিই ওগুলো পুকুরে নিয়ে যাই না হয়! আমিও তো এবাড়ির ঝি বই আর কিছুই নই!

শেষের কথাটা যে তাঁরই উদ্যেশ্যে বলা, সেটা বুঝতে পারলেও চুপ করেই রইলেন পারুল বালা, কাল ছোটো জা কে ঘর থেকে বার করে দেবার কথাটা বলা যে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে সেটা মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে তিনি নিজেই জানেন। এই প্রথম বার দেওরও তাঁর কথায় সায় দেয়নি বুঝেই নিজের খাস লোকের অপমান আজ তিনি মুখ বুঝেই সহ্য করলেন।

হারুর মা কর্তা মা এর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো, আশা ছিল তার অপমান তিনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। কিন্তু তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে মনে মনে একটু ভীত হলো হারুর মা, বৌমার কথা যে ক্রমশ ছোটো গিন্নির মুখও খুলে দিচ্ছে সেটা বুঝেই আর দ্বিরুক্তি না করেই বাসনের ঝুড়ি কাঁকে পুকুরের দিকে রওনা দিলো সে।
ক্রমশ

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৬
কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছুটে চলেছে কয়লার ইঞ্জিন, কামরার জানলায় মাথা রেখে বসেছিলো মৃণালিনী। স্টেশন ছেড়ে ট্রেন চলতে শুরু করার পর যেনো অনেকটা হালকা লাগছিলো তার। কতদিন পরে আবার প্রিয় মানুষগুলোর কাছে ফিরে যাওয়া! পরীক্ষা দেবার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো মৃণাল, বিশেষ করে সৌম্য শনিবারে না আসায় আরও চিন্তা হচ্ছিলো তার।

যাই বলিস মা, তোর জ্যেঠ শাশুড়ি কিন্তু মানুষ একটুও ভালো নন, বড্ড কড়া কড়া কথা কন!

বামুন মাসির গলার আওয়াজে চমকে উঠে তাকালো মৃণালিনী, মনের মধ্যে একটু অশান্তি হলো, কাল রাতে বড়ো মার চিৎকার যে ওদের কানেও গিয়েছে সেটা বুঝতে পারলো। কিন্তু এসব খবর বাবার কানে গেলে তিনি যথেষ্টই দুঃখ পাবেন, হয়ত সৌম্য কে ডেকে দু চার কথা বলতেও পারেন। কিন্তু সেতো এসব কিছুই চায় না,

এসব কথা বাবাকে বলার দরকার নেই বামুন মাসি, বাবা শুনলে কষ্ট পাবেন। আর বড়ো মা একটু কড়া কথা বলেন ঠিকই, কিন্তু আমাকে খুব ভালো বাসেন। ওনার গলাটা একটু জোরে, এই যা, অন্য কিছু নয়,

বামুন মাসির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো মৃণাল, বামুন মাসি মাথা নাড়লেন। ওর এই কথাই যে যথেষ্ট সেটা ও জানে, আর তিনি বাবার সামনে মুখ খুলবেন না।

বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, রমণী বাবু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন মেয়ের জন্যে, এতদিন পরে বাবা কে দেখে মৃণালের চোখের জল বাঁধ মানছিল না আর। সন্ধ্যে বেলায় সৌম্য কলেজ থেকে ফিরে শ্বশুরবাড়িতে এলো, মৃণাল তখন অধীর আগ্রহে তার জন্যেই ছাদে অপেক্ষা করছিলো। সৌম্য কে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই সে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো।

সৌম্য সবে বউ কে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখে শ্বশুর মশাই কে কিছু না জানানোর অনুরোধ করতে যাচ্ছিলো তার আগেই রমণী বাবু তাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন।

সৌম্য একটু ভীত দৃষ্টিতে মৃণালের দিকে তাকালো, ইতিমধ্যেই তার তৈরি করা পরিকল্পনার খবর মেয়ের কৃপায় তাঁর কানে পৌঁছে গেছে কিনা চিন্তা করতে করতে সে শ্বশুর মশাইয়ের ঘরের দরজায় পৌঁছে গেলো।

যদিও রমণী বাবুর তাকে ডেকে পাঠানোর কারণ অন্য ছিলো। অতো বড় বাড়িতে তিনি ঠাকুর চাকর নিয়ে একা থাকেন, অনেক বার সৌম্য কে মেস ছেড়ে তাঁর বাড়িতে এসে থাকার জন্যে বলেছেন আগে, কিন্তু সে রাজি হয়নি। শ্বশুর বাড়িতে এসে থাকতে তার সম্মানে লেগেছিলো।

আমি চাই যতদিন মৃণাল এখানে থাকবে, ততদিন তুমি এখান থেকেই কলেজে যাতায়াত কর। তাতে ওরও সুবিধা হবে, আমি তো আছিই, তার সঙ্গে তোমার সাহায্য পেলে,ওর পরীক্ষার ফল আরও ভালো হবে।

সৌম্য কে ঘরে ঢুকে আসতে দেখে বললেন তিনি। এবার আর শ্বশুরের প্রস্তাবে অসম্মত হওয়ার কিছু ছিলো না সৌম্যর, এই প্রস্তাব তার জন্যে যথেষ্টই আনন্দের, তাই সানন্দে রাজি হলো সে। মৃণাল কিছু তার পরিকল্পনার ব্যাপারে বাবা কে জানায়নি এটা বুঝে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। মৃণালের সঙ্গে আসার আগে যথেষ্টই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিলো, সেগুলো মিটিয়ে নেবার এই সহজ সুযোগ হাতছাড়া করার মতো মূর্খ সে নয় একটুও।

রাতে ঘরে এসে প্রথম সুযোগেই বউয়ের কাছে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলো সৌম্য, এতো সহজে স্বামীর সাহায্যে পরীক্ষা দিতে আসার সুযোগ পেয়ে মৃণাল তো অনেক আগেই তার মান অভিমান ভুলে গিয়েছিলো তাই নিজেদের মধ্যেকার ভুল বোঝাবুঝি খুব সহজেই মিটে গেলো। বাপের বাড়ি আসার আনন্দ, এতো দিন পরে স্বামীর সাহচর্য, সব মিলিয়ে সে রাতটা মৃণালের কাছে একদম অন্য রকম ছিলো, দুজনের বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস ভাসিয়ে নিয়ে গেলো দুজনকেই।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচ থেকে বামুন মাসির করা চা, নিজের হাতে করে নিয়ে এসে সৌম্যর ঘুম ভাঙ্গালো মৃণাল, আগের বার চা করুণা নিয়ে এসেছিলো বলে যথেষ্টই ক্ষোভ ছিল সৌম্যর।

বাবা বলেছিলেন পৌঁছে টেলিগ্রাম করতে,

খাটে বসে স্বামী কে উদ্যেশ্য করে বললো মৃণালিনী, সৌম্য মাথা নাড়লো,

ঠিক আছে, আজ কলেজে যাবার সময় করে দিয়ে যাব না হয়,

আমি একটা কথা ভাবছিলাম, মা খুব মন খারাপ করেছিলেন তুমি শনিবার বাড়ি যাওনি বলে, জোর করে গাড়িও পাঠিয়েছিলেন স্টেশনে। তুমি বরং বাড়ি গিয়ে খবরটা দিয়ে এসো, রথ দেখা আর কলা বেচা, দুইই হবে একসাথে।

সংসার বড়ো জটিল মৃণাল, কতো কিছু যে ভেবে চলতে হয়! সংসারের থেকে বড়ো রাজনীতির জায়গা আর কি আছে!! বড়ো মা চান না আমি যাই, কিন্তু মা চান! তাই এমন কিছু করতে হবে যাতে দুজনেই দুঃখ না পান। এই প্রস্তাবটা ভালো, বাবার সুস্থতার খবর নিয়ে গেলে বড়ো মা নিশ্চয়ই রাগ করবেন না আর।

এতো ভালো মন্দ ভেবে কাজ করো তুমি! সব কিছুই কি পরিকল্পনা করে চলতে হয়!

হেসে বললো মৃণাল, তাদের বাড়িতে সে কখনো এসব নিয়ে ভাবে নি আগে। ভাবার প্রয়োজনও ছিলো না কখনো, তাদের পিতা পুত্রীর সংসারে রাজনীতি করার মতো কেউ ছিলনা কোনোদিনই। সৌম্য হাসলো,

ভাবতে হয় বৈ কি! যদি কোনো জিনিস সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই বিতর্ক এড়ানো যায়, তাহলে মিছিমিছি প্রতিবাদী হওয়ারই বা দরকার কি! এই যে যদি বাবা বা বড়ো মা জানতেন আমি নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চাইছি, তাহলে দুঃখ পেতেন। সেক্ষেত্রে আমাকে যে কোনো একটা দিক ছাড়তে হতো, কিন্তু আমি তো কাউকে হারাতে চাইনি! অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা যেমন ভাবতে পারিনি, তেমনি এটা করতে গিয়ে বাড়ির সবার বিরাগভাজনও হতে চাইনি। তাই ঘটক কে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠানোর ছোট্ট পরিকল্পনায় যদি সব দিক বজায় থাকে তাহলে এটুকু করতে অসুবিধা কি!

মৃণাল অবাক হলো, সে এগুলো কে কখনোই সমর্থন করে না। তার বাবার শিক্ষা তাকে এ ব্যাপারে সায় দেয় না। সারা জীবন সত্যের পথে থাকার শিক্ষাই তাকে তার বাবা দিয়ে গিয়েছেন।

কিন্তু এগুলো তো মিথ্যাচার! বাবা বলেন জীবনে কখনো মিথ্যাচার করা উচিত নয়!

একদম ঠিক বলেন, উনি বিদ্বান মানুষ, আমার শিক্ষক, ওনার সমালোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে পুঁথিগত শিক্ষা আর বাস্তবে তার প্রতিফলন দুটো এক হয় না কখনো। যেটাকে তুমি মিথ্যাচার বলছো সেটা আসলে সত্য গোপন। সংসারে শান্তি বজায় রাখতে গেলে কিছু সত্য গোপন রাখতে হয়। যেমন ধরো, আমি তোমাকে ছাড়া এক মাস থাকতে পারবো না এটা যেমন ঠিক, তেমনি শনিবারে বাড়ি গেলে বড়ো মা তাঁর কথা রাখা হয় নি বলে অসম্মানিত হতেন, এটাও ঠিক। তাহলে সবাইকেই ভালো রাখতে গেলে এটুকু সত্য গোপন তো করতেই হবে তাই না!

যদি ধরো এই পরিকল্পনা টুকু আমি না করতে পারতাম, তাহলে তোমার এতো দিনের পরীক্ষার প্রস্তুতি, সে তো বৃথাই যেতো তাই না! বাবার কথা মতো যদি তুমি সত্যি কথা বলতে, বড়ো মা বা বাবা কেউ তোমাকে পরীক্ষা দিতে আসতে দিতে রাজি হতেন না। যদি তোমার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতাম তাহলে ওনারা অপমানিত হতেন। এবার যদি তুমি জেদ দেখিয়ে চলেও আসতে, তাতে শুধু এইবারের মতোই পরীক্ষা দিতে পারতে, আর ভবিষ্যতে এগোতে পারতে না। বড়ো মা অন্ন জল ত্যাগ করতেন, বাবা তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দিতেন। সব কিছু হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতো, তার থেকে এটাই কি ভালো হলো না! তুমি নিজেই ভাবো! কার্যসিদ্ধি করতে গেলে মাঝে মাঝে সত্য গোপন করতে হয়, স্ব্য়ং যুধিষ্ঠির করেছেন আর তুমি আমি তো সাধারণ মানুষ!

অবাক দৃষ্টিতে সৌম্যর দিকে তাকিয়ে রইলো মৃণালিনী। সংসার অনভিজ্ঞ মৃণাল তার সংসার অভিজ্ঞ স্বামীর শিক্ষায় ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠছিলো। সংসারের এই ভয়ঙ্কর রাজনীতির সঙ্গে যে তার বাবার দেওয়া পুঁথিগত শিক্ষার কোনো মিল নেই এটা ক্রমশই প্রকাশ্য হচ্ছিলো তার কাছে। এই সংসারের জটিল আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে নিজের স্বপ্ন পূরণ যে যথেষ্টই কঠিন সেটা বুঝতে পেরে সে দুঃখিত হয়ে পড়লো।

দুঃখ পেয়োনা মৃণাল, সমস্যা যেমন আছে তেমনি তার সমাধানও আছে!! শুধু সব কথা গায়ে মাখতে হয় না। সংসারে তো কতো কথা হয়, সব কিছু গায়ে না মেখেও চলা যায়। তোমার জীবনে এই মুহূর্তে তো একটাই লক্ষ্য, আরও পড়া। সেটা নিয়েই ভাবো, দেখবে অন্য কোনো দিকে মন দেওয়ার সময়ই পাবে না। বড়ো মা কে লুকিয়ে কি ভাবে পড়বে তার বিভিন্ন উপায় বার করতে করতেই তোমার সময় চলে যাবে,

মুচকি হেসে বললো সৌম্য, মৃণালিনীও হেসে ফেললো। সৌম্যকে যে ও কতোটা ভুল বুঝেছিলো, সেটা ভেবে নিজেই লজ্জিত হচ্ছিলো এই মুহূর্তে।
ক্রমশ