হৃদয় দহন পর্ব-০১

0
676

সূচনা পর্ব
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
#হৃদয়_দহন

সারারাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি কোথায় যেন ঘুমগুলো চলে গেছে শেষ রাতে একটু চোখটা লেগে আসলেও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি, অনবরত কাশি আসছে কাশতে কাশতে একপর্যায়ে নাক মুখ দিয়ে রক্ত পরা শুরু করলো মুখ চেপে ধরে দৌড়ে ওয়াসরুমে চলে গেল ঐশানি। ভালো করে রক্ত পরিষ্কার করে পুনরায় ঘরে চলে এলো বিছানা গুছাতে যাবে ঠিক সেই সময় বালিশের দিকে দৃষ্টি যেতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো কোমর পর্যন্ত ঘন লম্বা চুলগুলো ধীরে ধীরে পরে যাচ্ছে যার নমুনা শোয়ার বালিশে লেগে আছে।

চটজলদি চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বিছানা গুছিয়ে রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো ঐশানি। নিচে নামতেই যেন চারিদিকে সকলের ব্যস্ততা চোখে পড়লো, ব্যস্ত থাকারই কথা আর এক সপ্তাহ পর আহসান পরিবারের ছোট ছেলের বিয়ে তাই তো বাড়ি এতো সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে।

এতে যেন ঐশানির কোনো গুরুত্ব নেই সে নিজের মতো সবার পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছিল কিন্তু পথিমধ্যে কেউ তাকে আটকে দেয়,

– কিরে ঐশি এই সাত সকালে যাচ্ছিস কোথায়?

ঐশানি বিরক্তিকর চাহনিতে পিছনে ঘুরে,
– একটা কাজ আছে আন্টি সেখানেই যাচ্ছি।

– কি কাজ?

কথার মাঝখানেই সাদিক আহসান এসে হাজির, ঐশানির দিকে বাঁকা হেসে,

– তুমিও না মা অযথা প্রশ্ন করো। জানোই তো সেই একটাই কাজ প্রতিদিন খবরের কাগজ দেখবে আর সে অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় ঘুরবে চাকরির সন্ধানে।

ঐশানি তাচ্ছিল্যের স্বরে,
– কি আর করার চাকরি তো খুঁজতেই হবে আর কতোদিন তোমাদের ঘাড়ে বসে খাবো।

– তা অবশ্য ঠিক অবশেষে তোর সুবুদ্ধি হলো।

পাশ থেকে মিসেস সাবিনা আহসান তিক্ত গলায়,
– সাদিক কি হচ্ছে এসব এমন ভাবে কথা বলছিস কেন ঐশির সঙ্গে।

-বাদ দাও না আন্টি খারাপ কি বলেছে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর নিজের আত্মীয়রা সবকিছু দখল করে নিয়ে বের করে দিয়েছে আমায়,সেই ছোটবেলায় তোমরাই তো আশ্রয় দিয়েছো তোমার আর আঙ্কেলের কারণেই এখনও আছি কিন্তু আর কতদিন এবার তো নিজের একটা জায়গা করতে হবে।

একটানা কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল ঐশানি, সাবিনা আহসান দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এবার সাদিকের উদ্দেশ্য,

– কেন যে মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার করিস বুঝি না, যা গিয়ে তৈরি হয়ে নে বিয়ের অনেক কেনাকাটা বাকি আছে রাইশাও তোর সাথে যাবে আর হ্যা কেনাকাটা শেষে ওকে কিন্তু বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবি।

– ও কি বাচ্চা নাকি যে আমায় গিয়ে দিয়ে আসতে হবে।

– আর এক সপ্তাহ পর তোদের বিয়ে এইটুকু তো করতেই হবে এছাড়া বিয়ে কিন্তু তোর ইচ্ছেতেই হচ্ছে।

সাবিনা আহসান নিজের কাজে চলে গেলেন, সাদিক ও মুখ গোমড়া করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।
_________

বাইরে তিব্র রোদ এই রোদটাই যেন সহ্য হয় না ঐশানির, মাথায় কিছুটা যন্ত্রনা হচ্ছে কিন্তু তারপরও সব কিছু উপেক্ষা করে নিজের গন্তব্যে এগুচ্ছে একপর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত যায়গায় পৌঁছে গেল সে,বড় একটা অফিসের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। দাড়োয়ানকে একটা কার্ড দেখাতেই দাড়োয়ান গেইট খুলে দিল। ভেতরে প্রবেশ করে চারিদিকে মানুষ চোখে পড়লো এতো মানুষ থাকারই কথা বড় একটা কোম্পানি, এখানে অনেক মানুষ কাজ করে ঐশানিও এসেছে চাকরির খোঁজে, তার বান্ধবী মায়া তাকে এই চাকরির খবর দিয়েছে এবং সবকিছুর ব্যবস্থা মায়াই করেছে তাই তো ছুটে এসেছে এখানে ঐশানি।

একটা লোক এসে ঐশানিকে বসের কেবিন পর্যন্ত নিয়ে গেল তারপর তাকে ভেতরে যেতে বলে লোকটি চলে গেল। ঐশানি দরজা কিছুটা ফাঁকা করে বসের উদ্দেশ্যে,

– মে আই কাম ইন স্যার?

ভেতর থেকে একটা পুরুষ কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
– ইয়েস কাম।

ঐশানি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা বড় টেবিলের চেয়ারে সুদর্শন পুরুষকে দেখতে পায়। পুরুষটি মিষ্টি হেসে ঐশানির উদ্দেশ্যে,

– কি ব্যাপার মিস ঐশানি তানজুম দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।

ঐশানি চেয়ার টেনে লোকটির সোজাসুজি বসে পড়লো। লোকটি হাতে একটা ফাইল নিয়ে সেটার দিকে দৃষ্টি রেখে,

– আমার খালাতো বোন মায়া আপনার কথা বলেছে, আপনার নাকি একটা চাকরির খুব দরকার?

– চাকরির দরকার বলেই তো রাত দিন এক করে একটা চাকরি খুঁজছি।

– আর খুঁজতে হবে না আপনার চাকরি কনফার্ম।

– কিন্তু আপনি তো এখনও আমার সিভি দেখেননি।

– দেখার প্রয়োজন নেই মায়া আপনার সম্পর্কে সব বলেছে আপনারা একসঙ্গেই পড়াশোনা করেছেন।

– জ্বি।

– তো আজ থেকেই জয়েন করুন আমি কাউকে বলে দিচ্ছি আপনাকে কাজ বুঝিয়ে দিবে।

– আজ নয় কাল থেকে জয়েন করতে চাই আজ আমার কিছু কাজ আছে।

– ঠিক আছে মিস ঐশানি তানজুম আপনার যা ইচ্ছে।

ঐশানি লোকটির থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। অফিস থেকে বের হয়ে সোজা হাসপাতালে চলে গেল। ঐশানি বুঝতে পারছে কি হয়েছে তার কিন্তু তারপরও জানার ইচ্ছে তার ধারণা কি সঠিক। একজন সাদা এফ্রোন পরিহিত মধ্যবয়স্ক মহিলা তার দিকে এগিয়ে এসে,

– আপনার সমস্যাগুলো বলুন।

ঐশানি তার সমস্যা গুলো মহিলা ডাক্তারকে বলতেই তিনি একটা কাগজে কিছু লিখে ঐশানির হাতে দিয়ে,

– এই পরীক্ষা গুলো করিয়ে আসুন রিপোর্ট গুলো দেখেই বলা যাবে আসলে আপনার কি হয়েছে।

ঐশানি কেবিন থেকে বের হয়ে পরীক্ষা গুলো করতে গেল। একপর্যায়ে পরীক্ষা শেষ হতেই কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট গুলো হাতে পেয়ে ডাক্তারের কাছে চলে গেল।

ডাক্তার গভীর ভাবে রিপোর্ট গুলো দেখে মুখ গম্ভীর করে ঐশানির দিকে তাকিয়ে,
– আপনার সঙ্গে কি আপনার কোনো অভিভাবক এসেছে?

ঐশানি বাঁকা হেসে,
– আমার কোনো অভিভাবক নেই।

– অভিভাবক নেই!

– নাহ আমার আমি ছাড়া আর কেউ নেই এখন যদি বলতেন আমার কি হয়েছে?

ডাক্তার ইতস্তত ভঙ্গিতে,
– কিভাবে যে বলি।

– আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।

– আপনার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।

ঐশানির মুখে এখনও আগের ন্যায় হাঁসি বিদ্যমান,
– আর কতদিন বাঁচবো?

ডাক্তার ঐশানিকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে এমন একটা কথা শুনেও তার মুখের আবরণ পাল্টেনি তারপরও তিনি ঐশানিকে বললেন,

– তোমাকে তুমি করে বলছি বয়সে তুমি আমার থেকে অনেক ছোট,দেখ এটা চিন্তার কোনো বিষয় নয় তোমার মতো কত মানুষ ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার পরেও বেঁচে আছে শুধুমাত্র সঠিক চিকিৎসা এবং সঠিক জীবন পরিচালনার মাধ্যমে।

কথাগুলো বলতে বলতে একটা প্রেশক্রিপশন লিখে ঐশানির দিকে এগিয়ে,
– এতে যা যা ওষুধ লিখে দিয়েছি সব নিয়মিত খাবে আর তিনদিন পর আমার চেম্বারে এসে দেখা করবে।

– ঠিক আছে এখন তাহলে আসি আমি।

– হুম।

কাউন্টারে গিয়ে পেমেন্ট করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। এখনি বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। বাড়িতে গেলেই অনেক কথা শুনতে হবে যা শুনার মতো ইচ্ছে নেই ঐশানির।চেনা একটা পার্কে গিয়ে বসলো সে, এই জায়গা গুলোতে অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কিন্তু যার সঙ্গে স্মৃতি গুলো তৈরি হয়েছে সেই মানুষটাই তার বিকল্প বেছে নিয়েছে কথাগুলো ভাবতেই চোখ জোড়া ভিজে এলো ঐশানির।

বিকেলে এই নির্জন নগরীতে অনেকে ঘুরতে এসেছে, ঘুরতে এসেছে বললে বরং ভুল হবে যে যার প্রিয় মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে এসেছে। ঐশানি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো তার চোখে ভেসে আসলো পুরোনো স্মৃতি।

ছোট বেলা থেকেই সাদিক আর ঐশানি একসঙ্গে এক পরিবারে বড় হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মা মারা যাওয়ার পর অনাথ মেয়েটাকে তার বাবার ছোট বেলার বন্ধু ওয়াহিদ আহসান আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি এবং তার স্ত্রী নিজেদের মেয়ের মতোই ঐশানিকে বড় করেছেন। উনাদের ছোট ছেলে সাদিক আহসান, সাদিক ছোট থেকেই ঐশানিকে ভালোবাসতো ঐশানি যখন তার ভালোবাসা অগ্ৰাহ্য করে তখন রেগে গিয়ে সাদিক পরপর দুটো চড় মেরেছিল সেই চড় খেয়ে ভয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল ঐশানি। এই ভয় একদিন ভালোবাসায় পরিণত হয় কিন্তু আজ সব বদলে গেল। সাদিক নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে অন্য একটা মেয়েকে বেছে নিল।

এতটুকু ভাবতেই ভেতরটা কেমন করছে চোখ খুলে আবারো চারিদিকে তাকিয়ে উঠে গেল ঐশানি।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে ইচ্ছে করেই সে দেরি করেছে তাড়াতাড়ি ফিরলে আবারো প্রিয় মানুষকে অন্য কারো সঙ্গে দেখতে হতো সে চায়নি আর কষ্ট পেতে।

বাড়িতে এসে কলিং বেল বাজাতেই রাহেলা দরজা খুলে দিল। রাহেলা আহসান বাড়িতে কাজ করে কিন্তু কেউ তাকে কাজের লোকের চোখে দেখে না অনেক বছর ধরে এই বাড়ির সাথে জড়িত থাকায় সেও বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গেছে। রাহেলা ঐশানিকে অনেক ভালোবাসে তাই ঐশানিকে দেখেই বলা শুরু করলো,

– ঐশি মা আজ এতো দেরি হইলো তোমার?

ঐশানি কথাটা এড়িয়ে গিয়ে,
– ভালো লাগছে না আমি ঘরে গেলাম রেহু খালা পরে কথা বলবো।

– তোমার খাওন কি উপরে পাঠাইয়া দিমু?

– আমার খিদে নেই রাতে কিছু খাবো না।

বলেই ড্রয়িং রুম পার হয়ে সিঁড়িতে পা বাড়াতেই পেছন থেকে কেউ একজন বললো,
– এতো রাতে কোথা থেকে ফেরা হলো?

ঐশানি পেছনে ঘুরলো সিঁড়ি থেকে একটু দূরে সাদিকের বড় ভাই শিহাবের বউ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐশানির কোনো জবাব না পেয়ে তার বিরক্ত লাগছে,

চলবে……
🍁🍁