মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-৩৯

0
58

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – উনচল্লিশ (প্রথমাংশ)

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

রিসেপশনে চেনা-পরিচিত সব আত্মীয়স্বজন জড়ো হয়েছেন আজ। ফারশাদের বিয়ের খবরে সবাই যেমন খুশি, তেমন অবাকও। এরমধ্যে বেশ কয়েকজোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি কেবল নতুন বউকে দেখতে ব্যস্ত। যদিও আজকের এই রিসেপশনে উজমার ইচ্ছেতেই তার সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করেছে ফারশাদ। গাউনের সাথে মিলিয়ে একটা ফেইস মাস্ক এনেছে, যা পরার পর শুধু চোখ ও কপাল বাদে, সম্পূর্ণ মুখটাই ঢেকে গেছে। আগত মেহমানদের কৌতূহলটা এটা নিয়েই। কেউ কেউ যখন এই উদ্ভট সাজপোশাকের কারণ জানতে চাইল, ফারশাদ ফট করে বলল,

-‘ওর আসলে ভাইরাস জ্বর। এই কারণে মাস্ক পরেছে। তিন ফুট দূরে থাকুন ওর থেকে। নয়তো জ্বর আপনাদের শরীরেও ছড়িয়ে পড়বে।’

আজ কিছু মিডিয়ার লোকজন এসেছে। যেহেতু নামী-দামী একজন খেলোয়াড়ের বিয়ের রিসেপশন, সেখানে চেনা-অচেনা মানুষের সমাগম তুলনামূলক একটু বেশি-ই। কিন্তু কিছু করার নেই। সঙ্গিনীকে সবরকম নিরাপত্তা ও সুখী জীবন দেয়ার চেষ্টা করাই ফারশাদের প্রধান লক্ষ্য। বিন্দুমাত্র এদিক-ওদিক হলেই যে, মিডিয়া নানারকম নেগেটিভ মন্তব্য ছড়াবে, এটা সে ভালোমতোই জানে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে কোনোপ্রকার হেনস্তা ও বাজে মন্তব্যের শিকার হতে দিবে না বলেই, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। তার এহেন কথা শোনে দূরের মেহমানরা নাকমুখ কোঁচকালেও চেনা-পরিচিতরা হেসে উঠল। ভাই-বোনগুলোর মুখে স্কচটেপ দিয়েও এদের হাসি ও মশকরা বন্ধ করা গেল না। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে তুলতে নাইমুর বলল,

-‘তুমি তো রিস্কের মধ্যে আছো, ভাইয়া। ভাইরাসের রোগীর হাত ধরে আছো। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছ। মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছ। দু’দিনের মধ্যে তোমারও ভাইরাস জ্বর হবে, শিওর। তুমি যদি এই কঠিন সিচুয়েশন থেকে বাঁচতে চাও, ভাবীর থেকে দূরে যাও। দূরে…।’

চোখ কটমট করে তাকালো ফারশাদ। সবাই আরেকদফা হাসলো। খুব সতর্কতার সাথে চারিদিকে চোখ বুলালো উজমা। শাশুড়ি মা এসেছেন কি-না এটাই দেখল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটাই, এত মেহমানদের ভিড়ে কোথাও মুনমুন হক্বকে দেখা গেল না। তিনি আসবেন কি-না এটাও নিশ্চিত নয়। ফারশাদ রিসেপশনের দাওয়াত দেয়ার পর তিনি ভালো-মন্দ কিচ্ছু বলেননি, ফোন রেখে দিয়েছিলেন। অহংকারী মানুষ বরাবরই এমন হয়, এটা উজমা জানে। কিন্তু সন্তানদের সাথে একজন মায়ের এত হেয়ালি আচরণ কোনোকালেই ঠিক মনে হয় না তার। বারবারই তার মনে ভয় জেগে উঠছে। থেকে থেকে মন ধরে নিচ্ছে, এই মহিলা নিশ্চয়ই অসুস্থ। সুস্থ নন। ওনার শীঘ্রই মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। যদি সুস্থই হোন, এমন কেন? এত উগ্র, বর্বর, নিষ্ঠুর মনোভাব সাধারণ কোনো মায়ের হতেই পারে না। দৃষ্টিতে হতাশা নিয়ে যখন ফারশাদের চোখে চোখ রাখল, তাকে আশ্বস্ত করতে ফারশাদ বলল,

-‘মা কোনোদিন আমাদের গুরুত্ব দেননি, আজও দিবেন না। এত আপসেট হওয়ার কিছু নেই।’

আজকের এই রিসেপশনে কনের বাড়ির সবাই এসে উপস্থিত হয়েছেন। শুধু আসেনি মিশকাত ও ছোট্ট মাশিয়াত। ছোটো বাচ্চা নিয়ে লম্বা জার্নি কষ্টের আবার শ্বশুরকে একা রেখে আনন্দ-ফুর্তি করবে, এতটাও স্বার্থপর হতে পারত না মিশকাত, এজন্য ভাই-বোন সবাইকে পাঠিয়েছে। দীর্ঘ বছরের বিচ্ছেদ ও রাগ-অভিমান ভুলে ফারিশা যখন নিজের জন্মস্থানে পা রাখল, সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসির মিশ্র অনুভূতিতে মনটা একেবারে কেমন সুরে কেঁদে উঠল। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বাবা-মায়ের ছায়া কোত্থাও পেল না। বাবা যে নেই, এটা স্মরণে আসা মাত্রই চোখের কোল ঘেঁষে চুয়ে চুয়ে পড়ল কয়েকফোঁটা অভিমানে ভরা পানি। চোখে পানি ও ঠোঁটে হাসি নিয়ে রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো কাছে গেল সে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল দুই ফুপিকে। কারিমা রওশন তো ফারিশাকে কেঁদে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। চোখেমুখে হাত বুলিয়ে বললেন,

-‘এমন করে তুই বাবা-মায়ের ওপর অভিমান করে থাকতে পারলি, রিশা? কত বছর…।’

কণ্ঠরোধ হয়ে এলো ভদ্রমহিলার। ফারিশা ঠোঁট কামড়ে ফারিশা বলল,
-‘কী করব, বোলো? তোমার ভাই আর ভাইয়ের বউ-ই তো চায়নি, আমি আর এই বাড়িতে আসি। আমি তো এমনি-এমনি দূরত্ব টেনে আনিনি, ফুপি। ভীষণ অভিমানে, অপমানে এই দূরত্ব তৈরী করেছি।’

চাচাতো, ফুপাতো ভাই-বোনেরা এমনিতেই আনন্দের মধ্যে ছিল। ফারিশাকে দেখে আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠল তাদের। ছোট্ট তাম্মিকে নিয়ে তারা হৈচৈ বাড়িয়ে দিল। ভাই ও ভাইয়ের বউয়ের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে এগিয়ে গেল ফারিশা। দু’জনের দিকে চমৎকার একটা গিফট বাড়িয়ে দিয়ে উজমার বেদনামিশ্রিত চোখের দিকে চেয়ে চেয়ে বলল,

-‘কী ব্যাপার? চোখে পানি কেন?’

ভাই-বোন ও বন্ধুবান্ধবদের দেখে আনন্দেই চোখে পানি চলে এসেছে উজমার। সে কান্নারত মুখ নিয়ে ড্রয়িংরুমে আগত সব মেহমানদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাত্র এক সপ্তাহ দেখেনি সবাইকে অথচ মনে হচ্ছে কত বছরের দূরত্ব। সবাইকে একসাথে দেখে স্থির থাকতে পারল না। ফারশাদ তার হাতটা আলগোছে ছেড়ে দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করল। উজমা ছুট দিল সবার কাছে। দৌড়াতে দৌড়াতে উসাইদের সামনে এসে থামলো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে শব্দহীন কান্নায় গাল ভাসাতে শুরু করল। পিছন থেকে বন্ধুবান্ধবরা একসাথে বলে উঠল,

-‘এ্যাই, এত কাঁদিস না তো। কাঁদলে তোকে খুব বাজে লাগে।’

কাঁদতে কাঁদতে হেসে উঠল উজমা। সবাইকে বসার ব্যবস্থা করে দিতে চাচাতো ননদদের ডাকল। রূম্পা ও নয়না এসে সবাইকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। উজমা নিজেদের মানুষজন পেয়ে তাদের সাথে একটু গল্পগুজব করছিল, সেই ফাঁকে ফারশাদ তার বুবুকে বলল,

‘আমি মাকে আসতে বলেছিলাম আজকে। কিন্তু মায়ের কোনো খবর নেই। মিডিয়ার লোকজনও জানতে চাইছে মা কোথায়। কী বলব বুঝতে পারছি না। এদিকে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। অভাবনীয় কিছু। দুঃস্বপ্নেও ভাবিনী এইসব। অথচ…।’

ভাইয়ের চিন্তিত ও শুকনো মুখ দেখে ফারিশা জানতে চাইল,
-‘দুর্ঘটনা?’

-‘হুম…।’

ফিসফিসিয়ে মায়ের প্রেগন্যান্সির কথা বোনের সাথে শেয়ার করল ফারশাদ। এটা জেনেই যে মাকে এখানে আসতে বলেছে, সেটাও পরিষ্কার করে বলার পর ফারিশা তব্দা খেয়ে বসে রইল নিজের জায়গায়। মায়ের বয়সটা হিসেব করে রীতিমতো স্তম্ভিত, অনড়, পাথর সে। জীবনে কোনোদিন এমন আজব কাহিনী, আজব ঘটনার মুখোমুখি পড়েনি, যতটা মায়ের জন্য পড়তে হচ্ছে। এই এক মা, যা সব নোংরা কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছেন, তাতে এই সমাজে মাথাউঁচু করে বাঁচা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই মিডিয়া অনেক ভুলভাল নিউজ তৈরী করে ফারশাদকে সবসময় অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়ে বিব্রত করে, এটা যদি প্রকাশ হয়, আরও বেশি সম্মানহানির মুখে পড়বে সে। বলা যায় না, এটা তার ক্যারিয়ারটাও নষ্ট করে দিতে পারে। টেনশনে মাথা খারাপ অবস্থা হয়ে গেল ফারিশার। উপায়ন্তর না পেয়ে নিশ্চুপে ভেবে গেল কিছু। তখনই গটগট পায়ের আওয়াজ তুলে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালেন মুনমুন হক্ব। গলা উঁচিয়ে ডাকলেন,

-‘কোথায় আমার, বৌমা? আমার ভাগ্যবতী মেয়ে, আমার আরেক মা। তাকে একনজর না দেখলে যে আমি শান্তি পাচ্ছি না।’

আচানক এই আওয়াজে মিডিয়ার লোকজন দৌড়ে এলো মুনমুন হক্বের সামনে। উজমা বিব্রতবোধ করল। ভাইয়ের পাশে থেকে হাতের বাহু খামচে ধরল। ভয়ে-আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো। মুনমুন হক্ব চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটা জায়গায় গিয়ে তার চোখদুটো স্থির হয়ে গেল আর তিনি আবিষ্কার করলেন, অনেক বছর আগের চেনা-জানা একটা মুখ। ফট করে সামনে এসে দাঁড়ালেন। উসাইদের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত রেখে কিছু একটা যেন মনে করার চেষ্টা করে বললেন,

-‘তুমি…। কী যেন নাম…। ভুলে গেছি।’

এরপর একটা ভয়ানক দৃষ্টি দিয়ে উজমার দিকে তাকিয়ে, জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
-‘তুমি কে? এভাবে মুখ ঢেকে বসে আছো কেন?’

মিডিয়ার লোকজন সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন শুরু করে দিতে চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে এসে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিল ফারশাদ। বলল,

-‘আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর পরবর্তীতে দেয়া হবে। এখন একটু স্পেস দরকার।’

এতেই কাজ হলো। সবাই দূরে সরে গেল। উজমার থেকে যথোপযুক্ত কোনো উত্তর না পেয়ে মুনমুন হক্ব মাত্রই তার ফেইস মাস্কে হাত দিয়েছেন। টেনে সরানোর আগেই ফারশাদ মায়ের হাত সরিয়ে এনে বলল,

-‘এত তাড়া কীসের, মা? বৌমা তো তোমারই। তুমি-ই তো দেখবে। কিন্তু এভাবে না। এইমুহূর্তে তো না-ই। আমাদের বংশীয় পরম্পরাটা যেন কী? শাশুড়ি যখন ছেলের বউয়ের মুখ দেখবে, তখন তাকে সবচেয়ে দামী উপহার দিয়ে, যথাযোগ্য মর্যাদা ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, তবেই তার মুখ দেখতে পারে। তুমিও নিয়ম মেনেই বৌমাকে দেখো।’

এরকম কোনো রেওয়াজ নেই। মিডিয়ার লোকজনের সামনে যেন আড়ালের খবর না আসে, এই কারণেই ফারশাদের এই অন্য উপায়। দেয়ার মতো কিছু নেই আপাতত মুনমুন হক্বের হাতে। সঙ্গে কিছু নিয়ে আসেননি। ছেলের দিকে একনজর তাকিয়ে তার চালাকি বুঝতে পেরে হাসলেন। অভিনয় তিনিও কম জানেন না। চোখের ইশারায় এটাই বুঝালেন। গলায় থাকা ডায়মন্ডের নেকলেস খুলে উপস্থিত সব মেহমানদের দেখিয়ে, যত্ন সহকারে সেটা উজমার গলায় পরিয়ে দিলেন। আলতোস্পর্শে মুখ ছুঁয়ে আদর দিয়ে বললেন,

-‘সুখী হও।’

মুখে বললেন সুখী হও। কিন্তু মনে মনে বিড়বিড়ালেন,
-‘তোমার সব সুখ নষ্ট করে দেয়ার জন্য এক মুনমুন হক্বই যথেষ্ট মেয়ে। এখনও তো কিছুই দেখোনি তুমি। ধীরেধীরে দেখবে।’

বিড়াবিড়ানি শেষে মুখে বললেন,
-‘এবার তো বৌমার মুখ দেখতে দে, শাদ। আর কত নাটক করবি?’

ফারশাদ তৎক্ষনাৎ বলল,
-‘মা… আমি চাইছি না, মিডিয়ার কেউ ওর ফেইস দেখুক। তুমি এসেছ, আমি খুশি হয়েছি। বোসো, বিশ্রাম নাও। সব ঝামেলা শেষে আমাদের পারিবারিক আলাপ-আলোচনা শুরু হবে। আপাতত মেহমানদের আপ্যায়নের দিকটা দেখো, পরে বউ দেখো। বউ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। ঘরের মানুষ ঘরেই থাকবে।’

ছেলের এই অপমানটা মুখবুঁজে সহ্য করে নিলেন মুনমুন হক্ব। ঠোঁট কামড়ে হেসে বাকি মেহমানদের সামলাতে যেতে চাইছিলেন, এরমধ্যেই ছোট্ট তাম্মির সাথে খুব জোরে ধাক্কা খেয়ে তিনিও পড়লেন, তাম্মিও পড়ে গেল। ব্যথা পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে ‘বেয়াদব মেয়ে’ বলে মাত্রই হাত উঠালেন, সঙ্গে সঙ্গে উজমা ও ফারিশা একসাথে তার হাতের কবজি চেপে ধরল। তাম্মি ততক্ষণে মেসবাহ’র সাথে সেঁটে গেছে ভয়ে। রাগতস্বরে কিছু বলতে চাইলে তিনি ঘাবড়ে গেলেন সামনে দাঁড়ানো দুটো রমণীকে দেখে। আরও অবাক হলেন ফারিশা ও মেসবাহকে পাশাপাশি দেখে। কিছু বলার আগেই উজমা চুপিচুপি বলল,

-‘সবাই আমার মতো দুর্বল নয়, আন্টি। তা-ই যখন-তখন সবার ওপর হাত উঠাতে পারেন না আপনি। বাচ্চারা ভুল করেই থাকে। বাচ্চাদের ভুলকে যারা ক্ষমার চোখে দেখে না, তাদেরকে আমি মানুষ মনে করি না। তাছাড়া, আপনাকে তো আমি অনেক আগেই মানুষের কাতার থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। আর আজ বাদ দিলাম মায়ের আসন থেকে।’

এরপর মেসবাহর দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ভাইয়া, আপনি তাম্মিকে নিয়ে বাকি গেস্টদের সাথে বসুন। ওনার সামনে না থাকাই ভালো।’

মেসবাহ মেয়েকে নিয়ে চলে গেলে মুনমুন হক্ব দুই রমণীর দুটো হাত ছাড়িয়ে উজমার দিকে তাকিয়ে বিস্মিতস্বরে বললেন,
-‘আমার বাড়িতে এসে আমার দিকেই আঙুল তুলছ! তোমার সাহস তো কম না। কে তুমি? এত সাহস পাও কোথায়?’

সতর্কতার সাথে চারিদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিল উজমা। মেহমানরা সবাই ব্যস্ত। কেউ তাদের এই ছোটোখাটো দ্বন্দ্বের দৃশ্য দেখছে না। সে আলগোছে গলায় হাত ছুঁয়ে সদ্য পরিয়ে দেয়া নেকলেসটা গলা থেকে খুলে যার জিনিস তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘আ’ম উজমা ওয়াজেদাহ্। ডোটার অব উসমান ওয়াজেদ এন্ড মিসেস ওয়াহিদা জামান। ইউ নোও মি, ভেরি ওয়েল। আই হোপ নাথিং মোর নিডস্ টু বি সেইড্।’

এরপর মিষ্টি করে একগাল হেসে বলল,
-‘নোংরা কাজ যারা করে এবং নোংরা কাজের সাথে যারা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত থাকে, তাদেরকে আমি ঘৃণা করি সেই ছোটোবেলা থেকেই। শৈশবে কিছু নোংরা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম বলেই একজন মা, একজন নারীকে আমি খুব বেশি ঘৃণা করে এসেছি এতকাল। দুর্ভাগ্যবশত সেই মা, এখন আমার শাশুড়ি মা হওয়া সত্বেও আমি তাঁকে মা বলে সম্বোধন করতে পারছি না কেবল একটাই কারণে, তিনি আপাদমস্তক নোংরা মন-মানসিকতার মানুষ বলে। ওই নোংরা মানুষের সাথে মায়ের মতো মমতাময়ী শব্দটা একদমই যায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনি আমার শাশুড়ি মা হলেও কোনোদিন আমি আপনাকে মা ডাকব না। মায়ের সাথে সন্তানদের সম্পর্ক সবসময় আত্মার হয়। আপনি যেহেতু আমার মা নন আপনার সাথে আমার সেই সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। আর যার সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে না, তার দেয়া উপহার আমি গ্রহণ করব না। আপনার এই নেকলেসটা আপনার কাছেই রাখুন। দামী উপহার দিয়ে আর যা-ই করুন, উজমাকে দুর্বল করতে পারবেন না।’

উজমার সম্পূর্ণ পরিচয় পেয়ে মুনমুন হক্ব যেন অবিশ্বাস্য কিছুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার চেহারা থেকে বিস্ময়কর ভাবটা সরছিলই না। কতক্ষণ চেয়ে থেকে নেকলেসটা হাতের মুঠোয় নিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

-‘তোমার মতো ছোটোলোকদের কাছ থেকে মা ডাকটাও আমি আশা করি না। যেমন স্ট্যাটাস তেমন তার ব্যবহার।’

-‘সেটা তো আপনার স্ট্যাটাস ও ব্যবহার দিয়ে বুঝিয়েই দিলেন। আমাদের ছোটোলোকদের আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, নিজস্ব একটা আত্মসম্মানবোধ আছে। যেটুকু আমাদেরকে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়, আপনারদের মতো মানুষদের দু’মুখো রূপটা চিনতে শেখায়।’

মুনমুন হক্ব এত সহজে ব্যাপারটা হজম করে নিতে পারলেন না কেবলই শক্ত চোখে চেয়ে রইলেন। মায়ের এই রূপ দেখে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল ফারিশা। ভদ্রমহিলাকে রাগাতে আলগোছে উজমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-‘ওর মতো একটা মেয়ের দরকার ছিল এই পরিবারে। যে সময়ে-অসময়ে তোমার নোংরা মুখোশটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উচিত জবাব দিবে।’

ফের ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে মেয়ের উদ্দেশ্যে মুনমুন হক্ব বললেন,
-‘এতে কী হবে? আমাকে দমিয়ে রাখবে? না-কি আমার ওপর অত্যাচার করবে? তোমরা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। তোমাদের বাবা-ই তো পারেনি।’

বাবার প্রসঙ্গ আসাতে চুপ হয়ে গেল ফারিশা। মৃত মানুষকে অপমান করে কথা বলার রুচি আপাতত নেই। সে শুধু মায়ের এই দাম্ভিকতা কমানোর চেষ্টায় বলল,

-‘তোমার যা স্ট্যাটাস তুমি তো সেদিকেই যাবে। এতে আমাদের কী? আমরা তো আর তোমার হাতে ঘরের দায়দায়িত্ব দিচ্ছি না। এখন থেকে এই ঘর, এই সংসার সবকিছু দেখে রাখার দায়িত্ব শুধু, ওর। আর ওই, এই বাড়ির একমাত্র যোগ্য কর্ত্রী।’

দূরের কিছু আত্মীয়স্বজন মুনমুন হক্বকে খুঁজছিল। উত্তরে কিছু না বলে উজমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে রাখলেন। বুঝালেন, এর জবাব তিনি দিবেন। সরে যেতে গিয়ে খেয়াল করলেন, ছেলে ও মেয়ে দু’দিক থেকে ভীষণ যত্ন ও ভরসার সাথে উজমাকে আগলে দাঁড়িয়েছে। ওই মুহূর্তে উজমার পোশাক-আশাক, কথাবার্তা, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের কারণে তাকে দেখে সাধারণ কেউ মনেই হচ্ছে না। হঠাৎই তিনি আবিষ্কার করলেন, এই মেয়েটা কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। এই সাধারণ সাজপোশাক ও কথাবার্তাতেই তার মাঝে অসাধারণ একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। যেটুকু তাকে এক লহমায় সাধরণের মাঝেও অসাধারণ করে তুলেছে। তিনি এ-ও বুঝে নিলেন, কেন ফারশাদ এই মেয়েটার মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে পেয়েছে। মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ঠিকই আওড়ালেন,

-‘এ যেন সাক্ষাৎ গোবরে পদ্মফুল।’

সদর দরজা দিয়ে তখন বাংলাদেশের টিমের সব খেলোয়াড় ও কোচদের আগমণ ঘটলে উজমার দিকে প্রশান্তিভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ফারশাদ বলল,

-‘তুমি বুবুর সাথে থাকো, আমি ওনাদের বসার ব্যবস্থা করি।’

নির্ভয়ে মাথা দুলিয়ে ফারিশার হাত ধরে বন্ধুবান্ধবদের কাছে এসে দাঁড়াল উজমা। উসাইদ এতক্ষণ শুধু ভয় পাচ্ছিল। এখন বোনকে দেখে তার একটু শান্তি লাগছে। যদিও ফারশাদ যেখানে আছে সেখানে ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু তবুও মুনমুন হক্বের স্বভাবের কথা মনে পড়লে অজান্তেই ভয় চলে আসে মনে। সে উজমাকে স্বস্তির সাথে বসে থাকতে দেখে শুধু জানতে চাইল,

-‘সব ঠিক আছে, উজমা?’

উপরনিচ মাথা নেড়ে উজমা বলল,
-‘হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক। তুমি টেনশন কোরো না।’

ঊষা, তানজীম ও বন্ধুবান্ধব সবারই মনের অবস্থা একই। উজমা সবার ভয় দূর করতে পরিস্থিতিটাকে সামাল দেয়ার জন্য বলল,
-‘আজ কিন্তু তোমাদের যাওয়া চলবে না। এখানেই থাকবে। আমার তো ইচ্ছে করছে তোমাদেরকে এখানেই রেখে দিই, সবসময়ের জন্য।’

এটুকু বলে আহ্লাদী স্বরে ফের বলে উঠল,
-‘তোমরা থেকে যাও না। যাওয়ার দরকার নেই।’

মুহূর্তের গুমোটবাধা পরিবেশটা রোদের উজ্জ্বল আলোর মতোই ঝিকঝিকয়ে উঠল। কাইফ বলল,
-‘হ্যাঁ, থাকি। আর তোর দাজ্জাল শাশুড়ির ক্যাটক্যাট শুনি। ওসব শোনার ধৈর্য্য তোর থাকতে পারে, আমাদের নেই।’

উজমা চাপা ধমকের স্বরে বলল,
-‘চুপ থাক বেয়াদব।’

মাইসারা বলল,
-‘কাইফ ওটা ওর ফ্যামিলিগত ব্যাপার, আমাদের ওই টপিকে না যাওয়াই বেটার। তাছাড়া উনি কেমন সেটা নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা হওয়া উচিত না। আমরা জানি, উজমা কেমন। ও ঠিক সবকিছু সামলে নিতে পারবে।’

এরপর উজমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘কী রে, পারবি না?’

উজমা মাথা নেড়ে হাসলো। ফারশাদের সঙ্গী-সাথীরা যারা এলো, সবাই এবার উজমার খুঁজে চলে এলো। বিবাহিত দম্পতি জোড়া বেঁধে এসেছে। তাদের বউয়েরা এসে উজমার সাথে কুশল বিনিময় করল। ভালোমন্দের খবরাখবর নিয়ে জম্পেশ একটা আড্ডার আসর জমালো। যতক্ষণ মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যস্ততা ছিল, ততক্ষণ সবাই উজমার পাশেই বসে রইল। এতে করে উজমার মনের যত লুকানো ভীতি ছিল সেটুকু একটু একটু করে হারিয়ে গিয়ে সীমাহীন ভালো লাগায়, সুখে ও নির্ভরতার অনুভবে ভরে উঠল মন। সবার সঙ্গ খুব উপভোগ করল সে। মুনমুন হক্ব দূর থেকে লক্ষ্য করলেন সবকিছু। একটা সাধারণ ঘরের মেয়ে তার বোনঝির জায়গায়, এটাই সহজে মেনে নিতে পারছেন না তিনি। দূর থেকেই যেন ভস্ম করে দিবেন এমন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন আর ক্ষ্যাপছেন। দাঁতে দাঁত চেপে এটুকু দৃশ্য হজম করে বিড়বিড় করলেন,

-‘তুমি যতই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী হও না কেন, এই মুনমুন হক্বকে টেক্কা দেয়ার মতো সাহস তোমার নেই। সময় একদিন আমারও আসবে। আজ যে নির্ভার হাসিটা তোমার ঠোঁটে দেখা যাচ্ছে সেটা একদিন ঠিকই কেড়ে নেব। শুধু একটা সুযোগের প্রয়োজন মাত্র।’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – উনচল্লিশ (দ্বিতীয়াংশ)

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

পারিবারিক আলাপ-আলোচনায় আত্মীয়-স্বজন থাকা অনুচিত মনে করে উজমার সব বন্ধুবান্ধব, ভাই, বোন, তানজীম, তাম্মি ও মেসবাহকে নিজের কাজিন ও ফাবিহার সাথে বসিয়ে রেখেছে দু’তলার অন্য একটা ড্রয়িংরুমে। যে রুম বাড়তি গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, খুব বেশি দূরের আত্মীয়-অনাত্মীয়দের জন্য। ফাবিহা এখনও মায়ের বর্তমান অবস্থার ব্যাপারে কিছু জানে না, তা-ই তাকে কিছু জানানোর প্রয়োজনবোধ করল না ফারশাদ। ছোটো মন, ব্যথা পাবে বেশি। সবাইকে আলাদা আড্ডা, হৈচৈ ও রাতের খাবারের সবরকম ব্যবস্থা রেখে উজমা ও ফারিশাকে সাথে নিয়ে মায়ের রুমে এলো। মুনমুন হক্ব তখন আলমারির প্রত্যেকটা অংশে কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত ছিলেন। ফারিশা ভেতরে পা রেখে বলল,

-‘যা খুঁজছ, সেটা আমার হাতে।’

খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে চমকে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন মুনমুন হক্ব। একসঙ্গে তিনজনকে দেখে জানতে চাইলেন,
-‘তোমরা একসাথে? কিছু বলবে?’

উপরনিচ মাথা নাড়লো ফারিশা। হাতের রিপোর্ট দেখিয়ে বলল,
-‘তুমি কি এটা খুঁজছ?’

মেয়ের হাতের রিপোর্টের দিকে দৃষ্টি দিয়ে লজ্জিত মুখে চেয়ে রইলেন শুধু। ফারশাদ দরজা আটকে বলল,
-‘বলেছিলাম আগে, পারিবারিক আলাপ-আলোচনা পরে হবে। যদি সময় দাও, কিছু কথা বলতাম তোমায়।’

মুনমুন হক্ব বুঝে গেছেন, সত্য সবাই জেনে গেছে। এখন আর এটা চেপে রাখার পর্যায়ে নেই। তিনি তাড়া দেখিয়ে বললেন,
-‘আমাকে যেতে হবে, শাদ। আগামীকাল আমার ফ্লাইট।’

একটুও চমকাল না দুই ভাই-বোন। মা যে নিজের প্ল্যানমতো এগোচ্ছেন এটা দু’জনেই বুঝে নিল এক নিমিষেই। মুচকি হেসে ফারশাদ বলল,
-‘দেশ ছাড়তে চাইছ যে?’

-‘ক’দিন ঘুরে আসব।’

-‘কোথায় যাবে?’

-‘ইংল্যান্ডে, সোহানার সাথে।’

ফারশাদ মাথা নেড়ে ফারিশার থেকে রিপোর্ট নিজের হাতে টেনে নিয়ে মায়ের সামনে মেলে ধরলো সেটা। প্রশ্নবোধক চাহনিতে চেয়ে থেকে বলল,

-‘সত্য হোক বা মিথ্যে, যাচাই করতে যাব না। এই বাচ্চার পিতৃপরিচয় জানতে চাইব শুধু। কাপুরুষটার নাম কী?’

নাম বললে কী হবে সেটা মুনমুন হক্ব খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। একবার যে পুরুষকে প্রাণের মায়া দেখিয়ে ছাড় দিয়েছে, দ্বিতীয়বার আর সেই ছাড় দিবে না। জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। ভয়ে তিনি আর নাম মুখে আনার সাহস পেলেন না। শুধু বললেন,

-‘নামে কাজ কী? যে জন্মাবেই না, তার তো পিতৃপরিচয়ের দরকার নেই।’

গভীর করে শ্বাস টানলো ফারশাদ। মা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার এই কথাতে এটাই স্পষ্ট যে, অ্যাবরশন নিশ্চিত। তবুও চিন্তিতমনে বলল,

-‘ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছ?’

-‘জীবন যেহেতু আমার, সিদ্ধান্তও আমার। ভেবেই নিয়েছি।’

-‘এখন বুঝতে পারছ, যার যার জীবন তার তার সিদ্ধান্ত?’

মুনমুন হক্ব উত্তর দিলেন না। তিনি এখানে বেশিক্ষণ থাকতে চান না। এমনিতেই ছেলে-মেয়ের সামনে তার মাথাউঁচু করে বাঁচার মুখ নেই আর, সামনে আত্মীয়-স্বজন যারা বাকি ছিল, তারাও জেনে যাবে। নিজের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রূপ যা-ই থাকুক, সেটা আর বাইরের কাউকে দেখাতে চান না। নতমুখে হাত বাড়িয়ে রিপোর্ট আনতে চেয়ে বললেন,

-‘এটা আমার হাতে দাও।’

ফারশাদ ঘাড়ত্যাড়ামি করে রিপোর্ট না দিয়েই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল। টুকরো করা প্রত্যেকটা কাগজ মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘এক্ষুণি এই বাড়ি ও আমাদের জীবন থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় হবে তুমি। আর কোনোদিন এখানে আসবে না। আজ থেকে, এইমুহূর্ত থেকে, মুনমুন হক্ব আমাদের জন্য মৃত। না তোমার কোনো সন্তান আছে, আর না তুমি কারও মা।’

মুনমুন হক্ব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
-‘এই বাড়িতে আমার অধিকার আছে, এটা কি ভুলে যাচ্ছ? তোমার বাবার সমস্ত প্রোপার্টির অর্ধেক মালিকানা কিন্তু আমার। সেই হিসেবে এই বাড়ির অর্ধেকের মালিক আমি। আমার বাড়ি থেকে আমাকে তাড়াবে?’

-‘কী চাইছ তুমি?’

মুনমুন হক্ব কিছুই বললেন না। রহস্যময়ী এক হাসি দিয়ে উজমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। নিচ থেকে উপর পর্যন্ত খুব ভালোমতোই দেখলেন। একেবারে চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বললেন,

-‘ভেবো না দু’দিনেই সবকিছুর দখলদারী পেয়ে গেছো। এই মুনমুন হক্ব যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন প্রতিমুহূর্ত তোমাকে অশান্তি দিয়ে মারবে। এত সহজে তোমাকে এই বাড়ির একজন হিসেবে মেনে নেব না।’

উজমা মোটেও ভয় পেল না এই কথায়। সাহস রেখে বলল,
-‘আপনার মানা না মানাতে কী আসে যায়? কে আপনি? প্রোপার্টির অর্ধেক মালিক, এজন্যই এত গলাবাজি করছেন? আপনার এসব হুমকি-ধমকি আমার কানের বা’পাশ দিয়ে যাচ্ছে। গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে। কেন অযথা গলাবাজি করছেন? আপনার মতো অচ্যুত মানুষের সাথে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। জাস্ট অসহ্য…।’

মুনমুন হক্ব অবাক হচ্ছেন এইভেবে যে, সেদিনের সে-ই ছোট্ট মেয়েটা বড়ো হয়ে এত কথা শিখেছে। সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা অনায়াসে বলে যাচ্ছে। অথচ সেদিনও কিছু বলতে পারেনি, যেদিন তার দেখা দৃশ্যকে তিনি মিথ্যে বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি হতবাক চোখে শুধু বললেন,

-‘আই থিংক, শাদের সাথে বিয়ে হয়েছে বলে নিজের অবস্থান তুমি ভুলে যাচ্ছ। তুমি যে একটা চরিত্রহীন মেয়ে…।’

কথা শেষ করার আগেই দুটো হাত আড়াআড়িভাবে বেঁধে ঠোঁটে একটা চমৎকার, নির্ভার ও পবিত্র হাসি ঝুলিয়ে উজমা বলল,
-‘আমার অবস্থান নিয়ে আমি সংকীর্ণ নই। আপনার অবস্থান নিয়েও আমার মনে কোনো ঈর্ষা নেই। পূর্বের আমি ও বর্তমানের আমির মধ্যে পার্থক্য শুধু একটাই, বিয়ের আগে আমি উসমান ওয়াজেদের মেয়ে ছিলাম আর বিয়ের পর ফারশাদ মুনতাসীরের স্ত্রী হয়েছি। আমার মন-মানসিকতা, শিক্ষা-দীক্ষা, মেজাজ, চরিত্র আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। মিথ্যে কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে সাময়িক আনন্দ আপনি পেয়েছেন, কার্যসিদ্ধি করেছেন, লোকের মুখের কটু কথা শুনিয়ে প্রতি পদে পদে অপদস্ত করে আমার শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের আনন্দ মাটি করে দিয়েছেন, কিন্তু গোড়া থেকে ভাঙতে পারেননি। আর মিথ্যে দিয়ে সত্যকে মাটিচাপা দিতে পারেননি। কারণ আমি জানি, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে। একটা কথা মনে রাখবেন, সত্যের কাছে মিথ্যে সবসময়ই নড়বড়ে। মিথ্যে কলঙ্ক দিয়ে সাময়িক আনন্দ পাওয়া গেলেও আধ্যাত্মিক তৃপ্তি আসে না।’

এত সহজে তিনি যে দমে যাবেন না সেটা স্পষ্টবাক্যে জানিয়ে উজমার দিকে আঙুল তুলে বললেন,
-‘যদি বেঁচে থাকি, সুদে-আসলে এর জবাব একদিন দিবই মেয়ে। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।’

আঙুল তুলেই ক্ষান্ত হোননি মুনমুন হক্ব, হাত বাড়িয়ে আঘাত করতে চাইছিলেন। মায়ের কথা ও হাতের অপবিত্র স্পর্শ থেকে অর্ধাঙ্গিনীকে বাঁচাতে ঝটপট মুনমুন হক্বের হাতের কবজি চেপে ধরল ফারশাদ। বলল,
-‘তোমার এই নোংরা হাত দিয়ে তুমি আমার পবিত্র ফুলকে ছোঁবে না। একদম ছোঁবে না। নোংরা মন-মানসিকতা নিয়ে ওর দিকে আঙুল তুলছ, লজ্জা হচ্ছে না তোমার? আজ হাত নামিয়েছি, আগামীকাল মচকে দেব।’

এরপর একহাতে উজমাকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বলল,
-‘আরেকটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও, যদি ভুল করেও ওর ক্ষতি করার চেষ্টা তুমি করেছ, তাহলে পুরো পৃথিবী দেখবে, ফারশাদ মুনতাসীর প্রয়োজনে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ওর শরীরে তুমি একটা কাঁটার আঘাতও দিতে পারবে না, ইনশা’আল্লাহ।’

মুনমুন হক্ব আর দাঁড়িয়ে থাকলেন না। গটগট পা ফেলে মধ্যরাতেই বাড়ি ছাড়লেন। মায়ের সিদ্ধান্ত ও মনোভাব বুঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফারশাদ বলল,

-‘বুবু, আগামী সপ্তাহে বাড়ির সম্পূর্ণ মালিকানা যদি মায়ের নামে দিয়ে দিই, তোমার কি কোনো আপত্তি থাকবে?’

এই বাড়ির কোনোকিছুর প্রতি কোনোপ্রকার আগ্রহ নেই ফারিশার। শুধু মানুষগুলোর প্রতি আত্মিক একটা টান ও ভালোবাসা আছে। যা আমৃত্যু থাকবে। সে নিজের স্পষ্টতা দেখিয়ে বলল,

-‘এসবে আমার কোনো আগ্রহ নেই, শাদ। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। তোর যা খুশি তুই তা-ই কর। তবে ফুপিদের কথা ভেবে করিস।’

উপরনিচ মাথা নেড়ে ফারশাদ বলল,
-‘যেহেতু আমি এখানে পার্মানেন্ট নই, তা-ই এই সম্পত্তি নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। দুই ফুপি ও ফাবিহার জন্য আমার একার রোজগার যথেষ্ট।’

***

বিয়ের আগে ফারশাদের জন্য দুটো সারপ্রাইজ ভেবে রেখেছিল উজমা। একটা ছিল ফারিশা আর অন্যটা ছিল ফারশাদের লেখা চিঠি। বিয়ের ঝামেলায় চিঠি নিয়ে তার যে আয়োজন ছিল, সেটা চাপা পড়ে গেছে। সম্পূর্ণ চিঠি আড়ালে রেখে দিয়েছিল। আজ রিসেপশনে আসার আগে ঊষাকে বলেছিল,

-‘রেপিং পেপারে মোড়ানো আলমারিতে একটা চারকোণা সাইজের পার্সেল তুলে রাখা আছে, মনে করে সেটা নিয়ে আসিস।’

ঊষা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
-‘কী ওটা? খুব দরকারী?’

-‘হ্যাঁ, দরকারী।’

-‘আমি কি একটু দেখব? না মানে… দেখলে সমস্যা হবে?’

-‘সমস্যা হবে না, কিন্তু তুই ওটা দেখবি না। এটা আমাদের ব্যক্তিগত।’

গালমুখ ফুলিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিল ঊষা। উজমা শুধু হেসেছিল। এইমুহূর্তে রেপিং পেপার মোড়ানো সম্পূর্ণ পার্সেলটা ফারশাদের হাতে তুলে দিয়ে বলল,

-‘এটা তোমার জন্য।’

ফারশাদ অবাক হলো। আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থেকে বলল,
-‘কী এটা?’

-‘নিজেই দেখো।’

কাঁধ নাচিয়ে হাতের ফোন রেখে পার্সেল খোলায় মনোযোগ দিল ফারশাদ। পাশে বসে ঠোঁট মুড়ে হাসছে উজমা। ঠোঁট থেকে যেন হাসি সরছেই না। কত যত্ন করে মুড়িয়ে রেখেছিল। অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। বিশাল সাইজের চারকোণা পার্সেল খুলতে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ সময় অপচয় হলো, তবুও লাভ হলো না। অধৈর্য্য ফারশাদ বলে উঠল,

-‘কী এমন সম্পদ লুকিয়ে রেখেছ এখানে? খুলছেই না। পার্সেল কেউ এইভাবে প্যাঁচায়? দেখি, কাঁচিটা নিয়ে এসো। এভাবে খুলছে না, বাটারফ্লাই।’

উজমা দেরী করল না। ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে রাখা কাঁচি নিয়ে এলো। ফারশাদ তড়িঘড়ি সেটা খুলতে গিয়ে সম্পূর্ণ পেপার কেটে, পার্সেলটা বিছানায় রেখে দু’হাতের সাহায্যে পেপার সরাতে গিয়েই চমকে গেল। চোখ তুলে একবার অর্ধাঙ্গিনীর হাসি দেখে পার্সেলের কাঁচে আঙুল ছোঁয়ালো। মধ্যিখানে রাখা ডায়েরি সরিয়ে ফ্রেমবন্দী চিঠি পড়তে গিয়েই আবিষ্কার করল, বিশাল সাইজের একটা চিঠি। তা-ও কি-না তার নিজের লেখা। প্রতিটা পৃষ্ঠায় কোণায় কোণায় পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন। সেই চিহ্নের পাশে আবার লাল ও সাদা গোলাপের পাপড়ি। আচমকা এই প্রাপ্তি ফারশাদকে একটু দুর্বল ও আবেগী করে দিল। পিছনের দৃশ্যগুলো মনে করে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। মুহূর্তটাকে সে নীরবেই উপভোগ করল। উজমা বলল,

-‘তুমি কি এখন এক কাপ চা বা কফি খাবে? নিয়ে আসব?’

উজমার মন পালাই পালাই করছিল। দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য উপভোগ করার সাহস সে পাচ্ছিল না। সীমাহীন আনন্দে হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে তার। নিজেকে লুকিয়ে নিতেই চা বা কফির কথা শুনালো। উদ্দেশ্য তো চা বা কফি বানানো নয়, এখান থেকে পালানো। ফারশাদ সেটা বুঝলো না। ঘাড় নাড়িয়ে শুধু বলল,

-‘হুম…।’

অনুমতি পেয়ে দৌড়ে পালালো উজমা। ভেতরটা কেমন ধড়ফড় করছে। এমন মনে হচ্ছে যেন কোনোকিছু চুরি করেছে। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে চলে গেল। কাজের ফাঁকে নিজের বুকে অনবরত ফুঁ দিল।

ফারশাদ তখনও অদ্ভুত অনুভূতিতে মোহাচ্ছন্ন। তার ঠোঁটে হাসি অথচ চোখে জল। কতক্ষণ সম্পূর্ণ ফ্রেমে হাত বুলিয়ে ডায়েরিটা হাতে তুলে নিল। তালা দেয়া ডায়েরি। খুঁজতে গিয়ে ফ্রেমের উপরেই ছোট্ট একটা চাবি পেয়ে গেল। তালা খুলে কভার সরিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা উলটে দেখল তাতে লেখা,

‘জীবন নিয়ে যখন আমি সম্পূর্ণ হতাশার সাগরে ডুবেছিলাম তখনই কেউ একজন আমার জীবনে এসেছিল, যে নিজের সততা, সাহসিকতা, বিশ্বস্ততা দিয়ে জয় করে নিয়েছিল আমাকে। আমার জীবনের আমূল পরিবর্তন যেখান থেকে হয়েছে, যার মাধ্যমে হয়েছে তাকে আমি নিঃসন্দেহে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলব। ভালোবাসা নামক অনুভূতি ও বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটে যেত আমার, যদি না তুমি আসতে। তোমার মুগ্ধ চোখের চাহনি, বিশ্বস্ততার হাত, সম্পর্ককে বিশ্বাসের সাথে বাঁচিয়ে রাখা প্রতিটা মুহূর্ত, সবকিছুই আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। এরজন্য আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাব না, শুধু বলব – শেষ পর্যন্ত থেকে যেও। তোমার হাতে হাত রেখে শুধু পাশাপাশি, কাছাকাছি থাকতে চাই না, ওই হাতে হাত রেখে বার্ধক্যে পৌঁছাতে চাই।’

এর পরবর্তী পৃষ্ঠায় কয়েক লাইনের একটা কবিতা লেখা। কবিতার শিরোনাম ‘মেঘের খামে উড়োচিঠি’। নামটা খুব অদ্ভুত মনে হলো ফারশাদের। উজমা বলেছিল একটা কবিতা লিখবে, এটাই কি সে-ই কবিতা? ভাবনারত মন নিয়েই চোখ বুলালো লেখায়। পড়ল,

আমি শব্দ দিয়ে বাক্য সাজাতে পারি না।
অনুভূতি দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না।
মুখফুটে বলতে পারি না, ভালোবাসি।
আমি চিঠি লিখতে পারি না।
চিঠি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি না।
সাদা কাগজে কলম ছুঁতে চাই অথচ মুখ দিয়ে একটা শব্দই আওড়াই, ভালোবাসি।

এরপর আর লেখা হয় না, শব্দ আসে না,
কারণ আমি চিঠি লিখতেই পারি না।
কেন, শব্দের সাথে আমার বন্ধন হয় না?
কেন অর্থবোধক লাইন আসে না?
কেন তোমার মতো বোঝাতে পারি না, ঠিক কতটা ভালোবাসি তোমায়?

মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয়, তোমাকে কিছু কথা বলি।
কখনও মুখের ভাষা দিয়ে, কখনও চিঠি দিয়ে, কখনও বা কবিতার প্রতি লাইনে।
যতবার চেষ্টা করেছি, ব্যর্থ আমি হাল ছেড়ে দিয়ে দিনশেষে আবিষ্কার করেছি, তোমাকে ঘিরে আমার যত অনুভূতি, সবকিছু থেমে যাচ্ছে একটা শব্দে, ভালোবাসাতে।

চার অক্ষরের ছোট্ট একটা শব্দ, ভালোবাসা।
অথচ এই ছোট্ট শব্দের গভীরতা এতটাই যে,
মানুষ জীবন দিতেও কার্পণ্য করে না।
মাঝেমধ্যে এ-ও ভাবি, তোমার জন্য জীবন দিতে পারব তো?
যদি এমন হয়, কোনোদিন অমাবস্যা নেমে এলো জীবনে।
হারিয়ে গেলাম আমি। তখন কি ভুলে যাবে আমায়?
কখনও কি মনে পড়বে না?

যদি কোনোদিন এমন হয়, যদি হারিয়ে যাই –
জ্যোৎস্নাভরা রাতের ভিড়ে খুঁজে নিও আমায়,
খুঁজে নিও, মেঘ-বৃষ্টি কিংবা শিশিরভেজা ঘাসে।
যদি আকাশে চাঁদ না হাসে, মেঘ না ভাসে, বৃষ্টি না হয়, বুঝে নিও –
তোমার শূণ্যতা, নিঃসঙ্গতা আমাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে। (সংক্ষেপিত)

কবিতার শেষে বিয়ের দু’দিন আগের তারিখের নিচে আরও কিছু লেখা,

এটা নামহীন, ঠিকানাবিহীন চিঠি অথবা কবিতা হতো, যে কারণে শিরোনাম দিয়েছিলাম, ‘মেঘের খামে উড়োচিঠি’। আমার ঠিকানা তো তুমি, গন্তব্য তো তুমি। ঠিকানাবিহীন চিঠি-কবিতা আমি লিখি কী করে? যার ঠিকানা ও গন্তব্য স্থির, তার দ্বারা উড়োচিঠি, উড়োকবিতা, এগুলো লেখা অসম্ভব প্রায়। কিন্তু তবুও আমি বলব, এটা আমার লেখা প্রথম কোনো কবিতা, যার শিরোনাম ‘মেঘের খামে উড়োচিঠি’। কেন, জানতে চাও? তোমাকে হারানোর ভয়ে বিষাদের সব রং যখন আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, তখনই এই কবিতার লাইনগুলো মাথায় এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে লাইনগুলো দিয়ে একটা কবিতা সাজিয়ে ফেললাম, নিজের মতো করে। চিঠির জবাবে চিঠি দিতে পারব না বলেই হয়তো, তোমাকে ঘিরে আমার সব অনুভূতিকে আমি এভাবেই তুলে ধরেছি। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিয়ের আগে আমরা তুমিতে আসিনি। তাহলে কবিতার ভাষায় তুমি সম্বোধন কীভাবে এলো? কারণ একটাই, তোমাকে ঘিরে মনে মনে যত শব্দ-বাক্য সাজিয়েছি, প্রত্যেকটাতেই তুমি সম্বোধন লুকিয়েছিল। অপ্রকাশ্যেই তোমাকে নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনায় রাতকে দিন আর দিনকে রাত করতাম। সব অনুভূতি থেমে যেত ওই একটা শব্দে, যদি হারাই, হারিয়ে যাই, কিংবা এক হতে না পারি? আরও কত-শত দুঃশ্চিন্তা। যদি প্রকাশ না করি তুমি কোনোদিন জানতেও পারতে না, তোমার জন্য ঠিক কতফোঁটা অশ্রু ঝরিয়েছি। ঠিক কতটা হৃদয়ব্যথা সঙ্গে নিয়ে দিন কাটিয়েছি। এখনও আমি ভয়ে আছি, আতঙ্কে আছি, শেষ পর্যন্ত এই ভালোবাসা সুখের মুখ দেখবে তো?

লেখা এখানেই শেষ। সামান্য কিছু কথা অথচ পড়তে গভীর ভাবাবেগে ভেসে গেল ফারশাদ। কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে বসে রইল নিজের জায়গায়। কবিতা ও চিঠিতে আঙুল ছুঁইয়ে শব্দহীন অনুভূতিতে বিবশ হয়ে রইল।

উজমা রুমে এলো পনেরো মিনিট পর। দরজা খুলে সম্পূর্ণ রুমটা অন্ধকার দেখে ঘাবড়ে গেল। বারান্দায় আলো অথচ রুম অন্ধকার, লাইট ফিউজ হলো কি-না দেখতে সুইচ টিপলো। সঙ্গে সঙ্গে আলোতে ভেসে গেল ঘর। বিছানার ওপর ফ্রেম ও ডায়েরিটা রাখা। ফারশাদ রুমে নেই। বাথরুম চেক করে সেখানেও পেল না। টি-টেবিলের ওপর কফি রেখে বেলকনিতে ঢুঁ মেরে অন্ধকারের মধ্যেও ফারশাদের ছায়া দেখে বলল,

-‘এখানে কী করছ?’

-‘খুঁজছি।’

-‘কী?’

-‘তোমাকে।’

উত্তরে শুধু হাসলো উজমা। বলল,
-‘তোমার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। দাঁড়াও, নিয়ে আসি।’

পিছু ঘুরতে গেলে হাতে টান অনুভব করল উজমা। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারল না। টালমাটাল দেহ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে ফারশাদের দু’হাতের মাঝখানে আটকে গেল। বেসামাল পরিস্থিতিতে পড়ে বলল,

-‘এটা কী হলো?’

কোনো আওয়াজ পেল না উজমা। বিশ্বস্ত দুটো হাতের বাঁধনে আটকে গিয়ে শুধু বুঝলো, কবিতার ভাষা দিয়ে প্রেমিক মনে আঘাত দিয়ে ফেলেছে। ফারশাদ তাকে যেভাবে জড়িয়ে রাখল, ছাড়ার নাম নিল না। কোনোমতেই ছাড়াতে না পেরে মুখ তুলে তাকাতে চাইলে উল্টোদিকে ঘুরে গেল ফারশাদ। চোখ ঘুরানোর অর্থ বুঝতে পেরে জোরপূর্বক তাকে নিজের দিকে ফেরালো উজমা। চোখের কোণে আঙুল ছুঁইয়ে, পায়ের পাতায় ভর রেখে উঁকি দিয়ে পুরো মুখজুড়ে পরপর অনেকগুলো আদর দিয়ে বলল,

-‘এত সহজে তোমাকে ছেড়ে যাব, ভাবছ? প্রকৃত ভালোবাসা কোনো বর্ষপঞ্জিকার দিনক্ষণ মাস হিসেব করে আসে না। মানব হৃদয়ে ভালোবাসা আসে, ষড়ঋতুর মতো বিভিন্ন রং ও রূপ নিয়ে। এই ভালোবাসা কখনও হাসায়, কখনও কাঁদায়, কখনও বা রংবেরঙের সুবাসিত ফুল ফুটিয়ে হৃদয় বাগিচাকে রঙিন করে তুলে। তোমাকে ভালোবেসে একটা কথাই উপলব্ধি করেছি, সময় পালটাবে, মাস পেরোবে, বছর ঘুরে যাবে, অথচ অনুভূতি ঠিক আজকের মতোই জীবন্ত থাকবে। এবং আমি এ-ও বিশ্বাস করি, জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি শুধু আমারই থাকবে।’

***

চলবে…