মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-২৯+৩০

0
44

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – উনত্রিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

কোনো মানুষই নিখুঁত হয় না। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। একেকজনের একেকটা দুর্বলতাই তাকে অন্যের থেকে আলাদা করে এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে। নিজেকে বুঝতে ও ভালোবাসতে সাহায্য করে। মনের দুর্বলতা কাটিয়ে সাহসী হতে অনুপ্রাণিত করে। নিজেকে বুঝতে শিখার পর থেকে সাহসী ও প্রতিবাদী হতে শিখেছে উজমা। তার এই সাহস, নিজেকে ভালোবাসা ও অন্যায়কে অন্যায় বলে সাহসের সাথে তার মোকাবেলা করতে শেখার পিছনে ওয়াহিদা জামানের বিশেষ অবদান রয়েছে। খুব ছোটোবেলার সেই মানসিক আঘাত যখন শরীর ও মনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল, একা ও অসহায় করে দিয়েছিল তাকে, তখন থেকেই ওয়াহিদা জামান মেয়ের সাহস ও শক্তি হয়ে উঠেছেন। প্রতি পদে পদে মেয়েকে পর্যাপ্ত ভালোবাসা ও সাপোর্ট দেয়ার পাশাপাশি শিখিয়েছেন, ‘মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠিন জবাব দেয়া শিখতে হবে। অন্যায়কে যত প্রশ্রয় দিবে, নিজের প্রতি আস্থা হারানোর পাশাপাশি ভয় মনে দানা বাঁধবে। চলতে পথে অন্যের সাহায্য নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করবে কিন্তু কোনোদিন আত্মরক্ষা করার মতো সাহস ও মনের জোর তৈরী হবে না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় করুণা নিয়ে বাঁচার চেয়ে সহাস্যে প্রতিবাদ করাটাই হোক প্রতিটা সাহসী মেয়ের প্রথম পদক্ষেপ।’ মায়ের প্রত্যেকটা কথা, যুক্তি ও আদেশ-নিষেধকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই আজকের উজমার সৃষ্টি হয়েছে। মা তার সাহস ও শক্তি হয়েছিলেন বলেই, নিজেকে নিয়ে এখন আর তার ভয় না। কখনও নিজের অবস্থান নিয়ে হা-হুতাশ হয় না। উলটে সবসময়ই মনে হয়, সে যে অবস্থানে আছে, যেভাবে আছে, ভালো আছে। বহুদিন পর মায়ের কথার পর আরও একজন আস্থাশীল মানুষকে জীবনে পেয়ে এতদিনের জমে থাকা কষ্ট ও না পাওয়ার গ্লানিবোধটুকু মুছে যাচ্ছে তার। ফারশাদের প্রত্যেকটা কথা ও তার ভালোবাসার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি যেন, ঝলসানো রোদের মাঝে একটুকরো প্রশান্তির ছায়া। যে ছায়া ক্লান্ত-শ্রান্ত মন ও শরীরকে সতেজ হতে সাহায্য করে। মুহূর্তেই মনের কিনারে বইয়ে দেয় বসন্তের হাওয়া। সে হাওয়া কাঁপন ধরায় অস্তিত্বে। ঠোঁটেমুখে ফুটে উঠে লাজরাঙা হাসি। লাজ লুকোতে চুপ করে রইল উজমা। ফারশাদ অপেক্ষারত মন নিয়ে বলল,

-‘আমি কি এখন উসাইদের সাথে কথা বলে আগামী সপ্তাহেই বিয়ের দিন-তারিখ পাকা করে নেব? গার্ডিয়ান হিসেবে মাকে পাব কি-না জানি না, তবে একবার জিজ্ঞেস করে দেখব, আমার পছন্দের মেয়েকে মেনে নিতে তার কোনো আপত্তি আছে কি-না।’

এতক্ষণের সুখ সুখ অনুভূতির মাঝে মুনমুন হক্ব একটা যন্ত্রণারই নাম। হুটহাট এই নাম ও ভদ্রমহিলার প্রসঙ্গ আসতেই শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেল উজমার। আঁৎকে উঠলেও ভয়টাকে লুকিয়ে রাখল। এইমুহূর্তে ফারশাদের অভিভাবক তো তার মা-ই। মা অনুমতি না দিলে কিংবা উপস্থিত না থাকলে কীভাবে হবে? ভয়ের কারণে কোনো কথা বলতে পারল না উজমা। চুপ করে রইল। ফারশাদ বলল,

-‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমাকে ডিঙিয়ে মা আপনার ওপর টর্চার করার সাহস পাবেন না। আমার ওপর একটু ভরসা রাখুন। সবদিক সামলে নেব, ইনশা’আল্লাহ্।’

-‘আপনার মা যদি এই বিয়েতে মত না দেন?’

মধ্যবিত্ত পরিবার শোনে মুনমুন হক্ব নাক উঁচাবেন ফারশাদ এটা খুব ভালো করেই জানে। এজন্য অন্যপথও সে বেছে রেখেছে। শুধু মায়ের সাথে কথা বলা বাকি। সে এই কঠিন সমস্যার একটা সুন্দর সমাধান দিতে বলল,

-‘অসুবিধা নেই। আমার চাচ্চু ও ফুপিরা আছেন। তারা থাকলেই হবে। বিয়ে তো আমি একা এসে করব না। মুরব্বি নিয়েই আসব।’

-‘আপনার পছন্দের কথা মাকে জানিয়েছেন?’

-‘হ্যাঁ, জানিয়েছি। কিন্তু মেয়ে কে, সেটা এখনও বলিনি। তবে আজ-কালকের মধ্যেই বলব।’

-‘উনি যদি খুব বেশি রি’অ্যাক্ট করেন!’

-‘দেখা যাক উনি কী করেন। আমি তো ওনার রি’অ্যাক্ট শোনে বসে থাকব না। আমার যা করণীয়, সেটা আমি করব। এই নিয়ে আপনাকে ভয় পেতে হবে না।’

ফারশাদ যতই বলুক, ভয় না পেতে। মন তবুও মানছে না। মনের ভেতর অকারণ দুঃশ্চিতাদের মেলা বসেছে। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির লাগছে। এই মানুষটাকে মন থেকে দূরে সরাতে গিয়ে নিজের মনের সাথেই অনেক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছিল সে। সব দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে, মন হারিয়ে, দিক-দিশা ভুলে গিয়ে এখন এত দুঃশ্চিন্তা নিয়ে পথ চলতে ইচ্ছে করছে না। এত ভয়, এত সংশয় নিয়ে, মন হারানো কি ঠিক হলো? এখন যদি মুনমুন হক্ব এই সম্পর্কের মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান, কী হবে? এক হতে পারবে তো দুটো মানুষ? না-কি দূরে থেকেই আরও দূরে সরে যাবে? কী হবে সম্পর্কের শেষ পরিণতি? ঠোঁট কামড়ে এসব ভাবতে গিয়েই উজমা বলল,

-‘ভয় হয় আমার। খুব ভয় হয়।’

-‘কীসের ভয়? আমি থাকতে আপনার এত কীসের ভয়, বাটারফ্লাই?’

-‘আপনাকে হারানোর ভয়। জীবনে এই প্রথম কোনোকিছু হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে আমার। জীবন নিয়ে আকাশচুম্বী কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না কোনোদিন। কিন্তু না চাইতেও অসময়ে জীবনে যা এসেছে, তা খুব বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ। এটুকু যদি জীবন থেকে হারিয়ে যায়, আমি একদম শূণ্য হয়ে যাব।’

গুরুগম্ভীর মনের মেয়েটাও এত সুন্দর করে মনের ভাব প্রকাশ করতে জানে, ভালোবাসাকে নিজের করে চাইতে জানে, এই মেয়েটার অতলস্পর্শী ভালোবাসা তার মন স্পর্শ না করলে তো বোঝাই হতো না, ভালোবাসার মানুষের মনে তাকে নিয়ে কত আবেগ ও অনুভূতি জমা হয়ে আছে। ভালোবাসা সুন্দর এটা ফারশাদ জানে। কিন্তু আজ বুঝল, ভালোবাসার মানুষের মাঝেও ভালোবাসায় বেঁচে থাকা আরও বেশি সুন্দর। কারও জীবনের ‘বিশেষ’ হতে পারার ভাগ্য সবার হয় না। আবার যে এই ‘বিশেষ’ একজন হয়ে যায়, সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবানদের একজন হয়ে উঠে। নিজের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন মেনে নিয়ে জড়ানো গলায় বলল,

-‘ভয় নেই, রবের হুকুম হলে আমরা একসাথে বাঁচব ইনশা’আল্লাহ্। আপনি শুধু দোয়া করুন। আমাদের দু’জনার এই চাওয়া যেন পূর্ণতায় রূপ নেয়।’

***

দেশে ফিরে কোনো ঝামেলায় পড়তে চায় না ফারশাদ। এজন্য নিউজিল্যান্ডে থেকেই ফ্রি সময়ে কল করল মাকে। যা কিছু ঝামেলা ও সমস্যা, সেটা আগে আগেই সমাধান হয়ে গেলে সামনা-সামনি কোনো অপমানের মুখোমুখি পড়তে হবে না কাউকে। উজমাকে যেহেতু সে নিজের কাছে পর্যাপ্ত নিরাপদে ও যত্নে রাখবে, সেই কথায় ওয়াদাবদ্ধ। নিজের জবানের মর্যাদা রাখতে ভালোবাসাকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে সে সবসময়ই প্রস্তুত। এই কারণে মায়ের সাথে আগে কথা বলা জরুরী। তার মতামত ও মেজাজ বোঝা জরুরী। বেশ কয়েকবার কল বাজার পর রিসিভ হলে থমথমে গলায় মুনমুন হক্ব বললেন,

-‘হঠাৎ, কী কারণে ফোন করলে?’

নিউজিল্যান্ডে পা রেখে মায়ের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি ফারশাদের। বলাবাহুল্য, যে নারী স্বেচ্ছায় ঘর-সংসার ত্যাগ করেছে, তার সাথে কথা বলার আগ্রহ জাগেনি বলেই খোঁজখবর নেয়নি। ঘর-সংসার ও সন্তান ত্যাগ করে তাঁর তো এখন সুখী থাকার কথা। তিনি কেন সুখী নোন? কেন তাঁর কন্ঠস্বরে এত বিষণ্ণতা লুকানো? কতক্ষণ চুপ থেকে ফারশাদ বলল,

-‘কোথায় আছো, তুমি?’

-‘একটা রিসোর্টে।’

-‘মামা বাড়িতে উঠোনি?’

-‘না…।’

-‘ভালো আছো?’

-‘আমি কখনও খারাপ থাকি না। জরুরী কিছু বলতে চাইলে বোলো, আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ আছে।’

মায়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী, সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না ফারশাদ। সিরিয়াস কণ্ঠে বলল,
-‘আগামী সপ্তাহে আমি বিয়ে করতে চাইছি। পাত্রী আমার পছন্দের। যাকে আমি ভালোবাসি, তাকেই বিয়ে করব। তুমি কি বিয়েতে থাকবে?’

-‘বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছ, দিন-তারিখ নিজেই পাকা করেছ, পাত্রীও পছন্দ করেছ। সবকিছু যখন একাই করেছ, এখন কেন মাকে ডাকছ? মায়ের কি কোনো প্রয়োজন আছে?’

-‘তুমি আমার লিগ্যাল গার্ডিয়ান।’

-‘এজন্যই। আমার কোনো আপত্তি নেই, বিয়ে তুমি করতেই পারো।’

-‘তুমি আসবে না?’

-‘প্রয়োজন দেখছি না। আমি ছাড়াও তোমার অনেক গার্ডিয়ান আছে। তাদের যে কাউকে নিয়ে তুমি বিয়ের ঝামেলা শেষ করতে পারো। তাছাড়া, পবিত্র একটা কাজে আমার না থাকাটাই ভালো। যাই হোক, মেয়েটার স্ট্যাটাস কেমন? চলনসই তো? আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে তাকে মানাবে? ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীর বলে কথা। তার সাথে তো যাকে-তাকে মানাবে না। যাকে-তাকে বিয়ে করে সৈয়দ বংশের মান-মর্যাদা ডুবিও না, কেমন’

-‘সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীরের সৌভাগ্য যে, একটা সাধারণ মেয়ের মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে পেয়েছে। আমি যাকে বিয়ে করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার চোখে সে খুবই সাধারণ একটা মেয়ে, মা। আমি জানি, তার নাম-পরিচয় জানলে তুমি তাকে সহজে গ্রহণ করবে না। ছোটোলোক, লোভী, এগুলো বলেই তাকে অপমান করবে। কিন্তু একটা কথা কী জানো, সে সাধারণের মাঝেও অসাধারণ। যদি কোনোদিন তুমি তাকে সামনা-সামনি দেখো, প্লিজ অপমান করে কোনো কথা বোলো না।’

-‘মিডিয়াকে নিশ্চয়ই জানাবে। কী পরিচয় দিবে ওখানে তার? সোহানার চেয়েও খুব বেশি সুন্দরী সে?’

-‘তার প্রথম পরিচয়, সে মানুষ। দ্বিতীয় পরিচয়, সে বিশুদ্ধ মনের মেয়ে। সৎ ও সাহসী। তৃতীয় পরিচয়, সে ফারশাদ মুনতাসীরের বাগদত্তা। কিছুদিন পর, তার সবচেয়ে সম্মানজনক পরিচয় হবে কী জানো? সৈয়দ ফারশাদ মুনতাসীরের ‘জীবনসঙ্গিনী’ হবে সে। যে কাউকে তো আমি আমার জীবনের সাথে জড়াব না, তাই না? আমি যাকে আমার জীবনে স্বাগত জানাব, সে নিঃসন্দেহে আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যাবে। বলতে পারো, এখুনি হয়ে গেছে। সে জীবনে না এলে, এত ব্যর্থতার মাঝেও আমি বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম না। মৃত প্রায় মনটাকে বাঁচিয়ে দেয় যে নারী, সে তো সাধারণ কেউ নয়। আর যে সাধারণ নয়, তাকে কোনো স্ট্যাটাসের সাথে তুলনা দিতে হয় না, মা। ধন-সম্পদ দিয়ে তার ভালোবাসাকে বিচার করতে হয় না। কিংবা সোহানার মতো নোংরা-নর্দমার সাথেও তার তুলনা চলে না। সে অতুলনীয়। তার তুলনা সে নিজেই। তাই আমি আশা করব, মানো অথবা না মানো, তাকে নিয়ে কোনো প্রকার উস্কানিমূলক মন্তব্যে তুমি যাবে না।’

-‘আমাকে এসব বলে লাভ কী? মিডিয়াকে কি থামাতে পারবে? সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করছ, এটা জানলে তো নানানরকম সমালোচনা করবে লোকে। কীভাবে ঠেকাবে?’

-‘মিডিয়া তাকে নিয়ে নেগেটিভ মন্তব্য করবে, এমন কোনো সুযোগই আমি তাদের দেব না, মা।’

-‘বাহ, খুব সাহসী তুমি। নাম কী মেয়েটার?’

এত সহজে মায়ের ফাঁদে পা দিবে ফারশাদ? নাম বলে বিপদ ডেকে আনবে? মোটেও নয়। সে তো এত বোকা নয়। খুব চালাকির সাথে এই দিকটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,

-‘তুমি আসবে না, শিওর?’

-‘হ্যাঁ… শিওর। সাধারণ মেয়ের ভাব-ভালোবাসা দেখে তুমি পথ হারিয়ে ফেললেও আমি হারাব না। তোমার চাচ্চুদের খবর দাও। তারাই বিয়ের আয়োজন করুক। আমি এসবে নেই।’

মায়ের আত্ম-অহমিকা দেখে অবাক হলো ফারশাদ। এই নারী এখনও ঠিক হয়নি, শোধরায়নি। জীবনে ঠিক হবে বলে মনে হয় না। কেউ যদি নিজে থেকে দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকতে চায়, থাকুক। কোনো প্রয়োজন নেই জোর করে জীবনে ঝামেলা ও অশান্তি টেনে আনার। বাবার মতো মা-ও এখন না-ই হয়ে যাক জীবন থেকে। এমন মায়ের বেঁচে থাকার কি প্রয়োজন আছে? তার করণীয় যা ছিল, সেটা সে করেছে। এরবেশি বাড়াবাড়ি করাটা অপ্রয়োজনীয় বুঝেই চুপ হয়ে গেল। এজন্য মায়ের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে বলল,

-‘ঠিক আছে। তুমি যদি মনে কোরো, সন্তানদের জীবন ও তাদের সুখ-শান্তির খবর রাখা অপ্রয়োজনীয়, তাহলে তুমি দূরেই থাকো।’

***

মাঘ মাসের শুরু। কনকনে শীত, কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর। সবুজে ঘেরা মখমলি চাদরের বুকে শিশিরবিন্দু জমেছে। প্রতিটা শিশিরবিন্দুর ডগায় ঝিকিমিকি করছে সূর্যের প্রথম আলো। সোনাঝরা রোদ্দুর ও কুয়াশার আবরণ মিলেমিশে তৈরী করেছে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। দিনটা সুন্দর, সেইসাথে প্রকৃতিও। সকাল থেকে রান্নাবান্নার তোড়জোড় চলছে। ঊষা ভার্সিটিতে যাবে বলে মনস্থির করেছিল সবে। হাত-মুখ ধুয়ে সে আবায়া জড়িয়েছিল গায়ে। এরমধ্যেই উজমা এসে বলল,

-‘আজ কোথাও যাবি না। বাড়িতে থাক।’

-‘কেন?’

-‘বাসায় মেহমান আসবে।’

-‘কারা?’

-‘এতকিছু জানতে হবে না। হাত-মুখ ধুয়েছিস, একটু সাজুগুজু কর। এলেই দেখতে পাবি।’

ঠোঁটমুখ বাঁকিয়ে বোনের দিকে তাকাল ঊষা। বুঝে গেল, মেহমান কারা এবং কেন আসবে। এইমুহূর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয় সে। বড়োবোনের দিক বিবেচনা না করে নিজের দিক ভাববে, এতটাও স্বার্থপরতার মতো কাজ তাকে দিয়ে হবে না। সে অভিমানী স্বর নিয়ে বলল,

-‘তোমরা আমাকে এত তাড়াতাড়ি তাড়াতে চাইছ কেন?’

-‘তাড়াতে চাইব কেন? ভালো পাত্র কি সবসময় পাওয়া যায়?’

-‘আমি এখুনি বিয়ে করব না, আপু। তোমাকে রেখে আমি, ছিঃ ছিঃ। কীভাবে হয়?’

-‘কীভাবে কী হবে, সেটা তোকে ভাবতে হবে না। তুই শুধু মন থেকে রাজি হয়ে যা।’

মন থেকে সায় না পেলেও বোনের সাথে তর্ক করার সাহস হলো না ঊষার। ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে পরনের আবায়া খুলে ফেলল সে। মুখভার করে বিছানায় গিয়ে বসলো। অযথা কাজ দেখাতে ফোন হাতে নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করল। উজমা বলল,

-‘শোন, তোকে একটা গুড নিউজ দিই।’

ঊষা কোনো আগ্রহ দেখাল না। সে ফোনের স্ক্রিনেই মুখ ডুবিয়ে রইল। উজমা বলল,
-‘ভাইয়া চাইছে, দুটো বিয়ে একই দিনে হোক।’

বোনের মুখে এমন কথা শোনে যারপরনাই চমকাল ঊষা। ফোন রেখে হা করে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। বিশ্বাস না হওয়াতে জানতে চাইল,
-‘দুটো বিয়ে মানে?’

-‘ভাইয়া খুব স্বার্থপর। দুটোকে একসাথে বিদায় করবে বলে পণ করেছে। পাত্রও খুঁজে পেয়ে গেছে। এবার শুধু মুরব্বিরা মিলে সিদ্ধান্ত নিবে, এই আরকি।’

উজমা রহস্য রেখেই কথা বলছে। ফারশাদের কথা এখুনি বলতে চাইছে না। সব শোনে ঊষা বলল,
-‘ওহ, পাত্র কে?’

-‘কার পাত্র কে?’

এই প্রশ্নে ফের গাল ফুলালো ঊষা। উজমা খিলখিলিয়ে হেসে বলল,
-‘অকারণ দুঃশ্চিন্তা মাথায় আনিস না, ঊষা। ভাগ্যে যা আছে, তা-ই তো হবে।’

ঊষার মন খারাপ ও গাল ফুলানোকে পাত্তা দিল না উজমা। খুব সুন্দর করে, গর্জিয়াস একটা কুর্তি পরিয়ে, হালকা মেকাপে বোনকে সাজিয়ে দিল। ঊষাকে বসিয়ে রেখে বাকি কাজে হাত লাগাল উজমা। দুপুরের আগেই সব মেহমানদের আগমন ঘটলে মুরব্বিদের আলাপ-আলোচনার মেলা বসলো। ফারশাদের বড়ো চাচা ও বড়ো ফুপি এসেছেন। ফারিশাকে দেখে দু’জনেই অবাক। অনেকদিন পর রক্তের সম্পর্কের মানুষদের দেখে আবেগে কেঁদে ফেলল ফারিশা। ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে গাল ভাসাল। ভদ্রমহিলা তাকে সান্ত্বনা দিতে কতক্ষণ জড়িয়ে রইলেন, আগলে রাখলেন। সবাই মিলে দুটো বিয়ের দিন-তারিখ পাকা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সবকিছু ঠিকঠাক করা হলে উসাইদ ফোন দিল বন্ধুকে। রিসিভ হওয়ার পরপরই বলল,

-‘তোর কথাই রইল, আগামী শুক্রবারেই বিয়ে। একইদিনে ঊষাকেও উঠিয়ে দিব।’

ফারশাদ এখনও জানে না, ঊষার বিয়ে কার সাথে। সে অতি আনন্দ ও উৎসাহের সাথে বলল,
-‘আজ কি ঊষার বিয়েরও ফাইনাল কথাবার্তা হলো?’

-‘হ্যাঁ। কথা বলবি?’

-‘কার সাথে?’

-‘ঊষার জায়ের সাথে। আমার পাশেই আছেন, উনি।’

বন্ধুটা কি বোকা হয়ে গেল আজ? ঊষার জায়ের সাথে সে কি কথা বলবে? প্রশ্ন করতে চেয়েও থেমে গেল ফারশাদ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,

-‘কেমন আছিস, শাদ?’

ফারশাদের মনে হলো সে ভুল শুনছে। বুবুর কণ্ঠস্বর কেন ভেসে আসছে? এই আনন্দের দিনে বুবুকে কি সে খুব বেশি মিস করছে? দিবাস্বপ্ন ভেবে মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
-‘কে?’

-‘চিনতে পারছিস না? আমি…।’

পরমুহূর্তেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ফারিশা। ফোন কানে রেখেই ফুঁপিয়ে উঠল। ফারশাদ প্রথমে তব্দা খেল, পরপরই কণ্ঠস্বর, কান্না ও ভাঙা ভাঙা গলার অস্ফুটে আসা কিছু আওয়াজ শোনে নিজেও নিঃশব্দে কেঁদে গেল। খুশি হওয়ার বদলে অভিমান এসে ভীড় জমাল চোখমুখে। ফট করে বলে উঠল,

-‘এখন মনে পড়েছে না? এখন? এতদিন পর? তুমি আমার সাথে আর কথা বলবে না। যাও…। স্বার্থপর মেয়ে মানুষ। বেঁচে আছি না-কি মারা গেছি একটা খোঁজ তো নিতে পারতে, অথচ তুমি তা-ও নাওনি। আমাদের ছেড়ে গিয়ে ভালো থাকা শিখে গেছো, এজন্যই আমাদের মনে পড়েনি। তুমি কি জানো, ওই নরকে আমরা কীভাবে দিন কাটিয়েছি? কীভাবে এতদূর এসেছি? কিচ্ছু জানো না। দূরে গিয়ে তুমি ভালো থাকার পথ খুঁজে পেলেও তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছি আমি। এতদিন পর আজ ‘কেমন আছি’ জানতে চাইছ? বলব না, কেমন আছি। ফোন রাখো, বলছি।’

আনন্দঘন পরিবেশটায় হঠাৎ করে ঝড়ো হাওয়া নেমে এলো। ফারিশার কান্না যে শুরু হলো, সেটা আর থামানো গেল না। মেসবাহ শত বুঝালেও কাজ হলো না। ভাই তাকে ভুল বুঝছে, তাকে স্বার্থপর ভাবছে, এটাই মেনে নিতে পারছে না সে। মিশকাত তাকে শান্ত করতে আলাদা রুমে এনে বসালো। কান্না মুছে দিল। তবুও হলো না। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ধরিয়ে ফেলল। এক কাপ কড়া লিকারের চা নিয়ে রুমে এলো উজমা। ফারিশার চোখমুখ মুছে তার কান্না ও ব্যথাবেদনা ভুলাতে বলল,

-‘আপনি কষ্ট পাচ্ছেন কেন? উনি তো অভিমান থেকে এইভাবে কথা বলেছেন। উনি আপনার ভাই। বিশ্বস্ত ও আপন মানুষ। তবুও আপনি এতদিন ওনার সাথে যোগাযোগ রাখেননি। একটা ফোনও করেননি। বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে ভাই-বোনের সাথে বিচ্ছেদ টেনে দিয়েছেন। রাগ-অভিমান জন্মানো খুব স্বাভাবিক, বুবু। দেশে ফিরলে সব ঠিক হয়ে যাবে, ইনশা’আল্লাহ্।’

-‘ও আমাকে ভুল বুঝছে, উজমা। আমি তো পরিস্থিতির শিকার। ভালোবাসার সম্পর্ক জেনে যাওয়ার পর, যারা পশুর মতো আচরণ করে, অমানুষ হয়ে যায়। স্ট্যাটাস, ধন-সম্পদ এসব বিচার করতে গিয়ে জঘন্য সব অপরাধ করে বসে। বিয়ে করে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ও নিজের ভালোবাসাকে অসম্মানিত করার সাহস আমি পাইনি দেখেই দূরে থেকে ভালো থাকতে চেয়েছি। দূরে চলে গেলেও ওদের একমুহূর্তও ভুলে থাকতে পারিনি। আমার প্রতিটি প্রার্থনায় আমি ওদের সুখ ও সুস্থ জীবন চেয়েছি। এখনও চাই।’

আরও অনেকক্ষণ নীরব কান্নায় গাল ভাসালো ফারিশা। উজমা তাকে সান্ত্বনা দিতে পাশে বসে রইল। শান্ত হয়ে এলে চা পান করতে বলল। এই ক’দিন ধরে উজমাকে দেখে তার ভালো লেগেছে, মনে ধরেছে। মেয়েটাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা মনে হয়েছে। আজ তাকে নিজের ভাইয়ের হবু বউ হিসেবে আবিষ্কার করে ভীষণ খুশিও হয়েছে। সে কান্না মুছে স্বাভাবিক হয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,

-‘একটা সম্পর্ককে তুমি কীভাবে দেখো, উজমা?’

ফারিশা কেন এই প্রশ্ন করল, বুঝল না উজমা। উত্তর দিল,
-‘সম্পর্ক সবসময়ই আমার কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মানের। হোক সেটা বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধব, স্বামী-স্ত্রী কিংবা অন্য যেকোনো সম্পর্ক। সব সম্পর্কই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’

-‘আমার বাবা-মা সম্পর্ককে বোঝা ভাবত। বিশেষ করে, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ককে তারা খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। তাদের কাছে এই সম্পর্ক মূল্যহীন।’

মুনমুন হক্ব সম্পর্কে ধারণা থাকলেও ফয়জান মুনতাসীর সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই উজমার। তা-ই ফারিশার এরূপ কথার পালটা কোনো জবাব খুঁজে পেল না সে। চুপ করে রইল। ফারিশা বলল,

-‘আমি আমার ভাইকে বোঝা নয়, স্বস্তি দিতে চাই। তুমি কি তার স্বস্তি হতে পারবে, বোন?’

কথার অর্থ ধরতে পেরে নির্ভার হেসে মাথা নাড়ল উজমা। ফারশাদ তাকে কখনও বোঝা ভাববে না, তাদের সম্পর্কটা কোনোদিন মূল্যহীন হবে না, এটা সে নিশ্চিত। দু’জনেই দু’জনের কাছে বিশ্বস্ত, আস্থার, ভরসার। তবুও ফারিশাকে নিশ্চয়তা দিতে জোর দিয়ে বলল,

-‘আমি তার বোঝা নয়, স্বস্তি-ই হব। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টায়, আমাদের সম্পর্কটাকে পর্যাপ্ত যত্ন, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের সাথে বাঁচিয়ে রাখব, ইনশা’আল্লাহ।’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ত্রিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়াতে সমাজ, পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে খুব সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে ঊষা। পরিবারের সবার প্রতি যেমন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে তেমনি সবার সিদ্ধান্তের ওপরও পর্যাপ্ত আস্তা আছে তার। ভাই কোনোদিন তার খারাপ চাইবে না, এটাও সে বুঝে। এইমুহূর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত না হলেও পরিবারের মানুষগুলোর কথা ভাবতে গিয়ে না বলার সাহস হয়নি তার। প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহূর্তে বড়ো বোন যে যন্ত্রণা, গালিগালাজ, আট-দশজনের নানারকম নিন্দেমন্দ শোনে বড়ো হয়েছে, সেরকম পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ধৈর্য্য তার নেই। এমনিতে প্রেম-ভালোবাসা জীবনে আসেনি, এসব নিয়ে কোনো চিন্তাও মাথায় আসেনি, তবে জীবনসঙ্গী নিয়ে সুপ্ত কিছু গোপন চাওয়া লুকিয়ে আছে মনের অভ্যন্তরে। যা কাউকে বলা হয়নি কোনোদিন। একজন ভরসার সঙ্গী অথবা সঙ্গিনী প্রতিটা মানুষের কাম্য। সেই সঙ্গী বা সঙ্গিনী কারও জীবনে আগে আসে, কারও পরে। তার জীবনে এই ভরসার সঙ্গী হয়তো তানজীমই। নিয়তিই হয়তো তাদের এক করতে চাইছে বলেই, অসময়ে জীবনে জড়িয়ে যেতে চাইছে। ভাগ্য তাকে নিয়ে যা করতে চায়, তার কপালে যা রাখে, তাকে গ্রহণ করে নিতে কোনোপ্রকার দ্বিধা নেই মনে। জীবনে যা আসার তা আসবেই। হয়তো ক’দিন আগে-পরে, এইটুকুই তফাৎ। এজন্য পরিবারের কারও ওপর কোনোপ্রকার রাগ ও অভিমান নেই তার। আজ যখন বিয়ের দিন-তারিখ পাকা করে উসাইদ এসে জানতে চাইল,

-‘আগামী সপ্তাহেই বিয়ের দিন-তারিখ পাকা হয়েছে। এই বিয়েতে তোর আপত্তি থাকলে এখুনি বলতে পারিস। আমি কোনো জোরাজুরি চাই না।’

ভাইয়ের কথার উত্তরে ঊষা স্পষ্টবাক্যে বলল,
-‘আমার কোনো আপত্তি নেই, ভাইয়া। তুমি যা ভালো বোঝো।’

-‘তোদের দুটোকে সৎ পাত্রস্থ কর‍তে পারলে অনেক বড়ো দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবরে, ঊষা। তোরা সুখী হলে আমিও সুখী হব।’

ঊষা খুব আবেগী। উজমার মতো এত শক্ত ও ধৈর্য্যশীল নয়। ভাইয়ের এই সামান্য কথাতেই দু’চোখ ভরে উঠল তার। শব্দহীন কান্নায় মুখ নামিয়ে রইল। উসাইদ বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,

-‘কাঁদলে হবে না তো। দায়িত্ব নিতে হবে। এখন তো আর তুই ছোটো নোস। কত বড়ো হয়ে গিয়েছিস। ক’দিন পরই জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়ে পা রাখবি। আপন মানুষদের ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে জীবন সাজাবি। নতুন একটা পরিবার পাবি। সবাইকে আপন করে নতুনভাবে বেঁচে থাকার, ভালো থাকার সংগ্রাম করবি। এরজন্য তোকে অবশ্যই অনেক সাহসী ও ধৈর্য্যশীল হতে হবে।’

-‘আমি এসব পারব না, ভাইয়া। তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারব না আমি।’

-‘তুই হয়তো রাগ করছিস। অভিমান করছিস। ভাবছিস, আমরা তোকে তাড়াতাড়িই তাড়িয়ে দিচ্ছি। ব্যাপারটা এরকম নয়, ঊষা। উজমার জন্য কী করিনি আমি, সবটাই তো তুই নিজে দেখেছিস। বুঝিসও। তোরা এই পরিবারের কাছে, আমার কাছে, কখনওই বোঝা নোস। কিন্তু তবুও, ধর্মীয় নিয়ম, সামাজিক নিয়ম মেনে চলতে হয় আমাদের। যথাসময়ে কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয়। আমি তো আমার দায়িত্ব-কর্তব্যটুকু পালন করতে চাইছি মাত্র। বিয়ে দিলেই কি বোনেরা পর হয়ে যায়? কখনওই নয়। তোরা আগে আমার কাছে যেমন ছিলি, এখনও তাই আছিস, সারাজীবন এমনই থাকবি।’

ভাই-বোনের এমন আবেগঘন দৃশ্যের মাঝখানে উপস্থিত হলো ফারিশা। জীবনে এরকম একটা মুহূর্ত তার জীবনে না এলেও এই মুহূর্তের গুরুত্ব সে বুঝে। দু’জনকে হাসিখুশি মেজাজে ফিরিয়ে আনার জন্য খুক খুক করে কেশে বলল,

-‘বাব্বা, দেখে তো মনে হচ্ছে এখুনি কনে বিদায় হয়ে যাচ্ছে। আরেহ, এখনও এক সপ্তাহ পুরোটাই বাকি। আজ মাত্র বৃহস্পতিবার। সপ্তাহ ঘুরবে, এরপর বিদায়ের দিন আসবে। যখন বিদায়ী মুহূর্ত আসবে, তখন কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিও, আমি মানা করব না। কিন্তু এখন, আমার গুণধর দেবরকে একটু সময় দাও। ও তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে, ঊষা।’

তানজীম আবার কী কথা বলবে? শোনেই তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো ঊষার। সে কান্না ভুলে ভয়ে-আতঙ্কে জমে গেল। দুরুদুরু বুকে কতকিছু ভেবে গেল। ফারিশা বলল,

-‘দু’জনে কথা বললে কোনো অসুবিধা হবে, উসাইদ? আসলে, জীম ওর চয়েস জানতে চাইছে। আমি আজ আংটি, চুড়ি, জুতো ও জামার মাপটা নিয়ে যাব। যেহেতু সময় খুব বেশি নেই, এই ক’দিনের মধ্যেই সব শপিং শেষ করতে হবে। তাছাড়া, রেস্টুরেন্ট বুকিংও নিতে হবে।’

-‘ঠিক আছে, তুমি থাকো ওর পাশে। আমি রেস্টুরেন্টের ব্যাপারটা নিয়ে শাদের সাথে আলাপ করে আসি।’

উসাইদ চলে গেলে ঊষার ভয় আরও বেড়ে গেল। সে ভেবেই পেল না, তানজীমের সাথে কী কথা বলবে! ফারিশা কল কানেক্ট করে মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-‘পাঁচ মিনিট কিন্তু। এরবেশি একদমই সুযোগ দেব না।’

‘পাঁচ মিনিট কেন, আমি তো এই লোকটার সাথে পাঁচ সেকেন্ড কথা বলার ধৈর্য্য পাব না’ বিড়বিড়িয়ে এইটুকু বলতে চেয়েও চরম নার্ভাসনেস অবস্থায় মোবাইল হাতে নিয়ে জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলল ঊষা। প্রয়োজনীয় আর কী লাগে, সেটা নিয়ে মিশকাতের সাথে আলাপ সারতে গেল ফারিশা। যাওয়ার আগে সব প্রয়োজনীয় আলাপ-আলোচনা শেষ করেই যাক। ফোনে কতবার বিরক্ত করবে? ফারিশা রুম ছাড়লে ফোন কানে ঠেকাল ঊষা। আস্তেধীরে সালাম দিল। সালামের পরপর খুবই স্মুদলি জবাবটাও ভেসে এলো। শোনে, ভয়ে কলিজাটা নড়ে উঠল ঊষার। ক্রমাগত বুকে ফুঁ দিয়ে গেল। তানজীম বলল,

-‘আটকাতে পারলেন না তো? দূর দূর পর্যন্ত কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক কিন্তু নেই। তবুও খুব শীঘ্রই আমি আপনার কাছের একজন হতে চলেছি।’

উত্তরে কী বলা উচিত ভেবে পেল না ঊষা। এত সহজে হার মেনে নিতে ইচ্ছে করছে না। কোনো যুক্তি না দেখালে লোকটা ধরে নিবে সে হেরে যাচ্ছে। মোটেও এত জলদি হার মেনে নিবে না সে। এজন্য ভেবেচিন্তে বলল,

-‘কে বলেছে আপনি আমাদের আত্মীয় নোন? ফারিশাবু যেহেতু আমাদের আত্মীয় হয়, সেই হিসাবে আপনিও আমাদের আত্মীয়ই হোন। যাকে সোজা বাংলায় দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বলে।’

-‘ওকে, তাহলে এই দুঃসম্পর্কের আত্মীয়কে এবার সুসম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে গ্রহণ করে নিন, ঊষা। এতে লাভ কিন্তু আপনারই।’

-‘কত পার্সেন্ট লাভ হবে?’

-‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট। সম্পূর্ণ এই আমিটাই তো আপনার হয়ে যাব। তাই নয়, কী?’

এত সরাসরি কথা বলে কেউ? এইভাবে লজ্জায় ফেলে? তানজীমের এই সোজাসাপটা কথা শোনে ভয় সরে একগাদা লজ্জা এসে ভর করল মনে। ঠোঁটমুড়ে লাজুক হাসলো ঊষা। বলল,

-‘মেয়েদের পটানোর টেকনিক তো দেখছি ভালোই রপ্ত করেছেন।’

-‘উঁহু, আমি কাউকে পটাচ্ছি না। আগেই বলেছি, আমি কারও প্রেমিক হব না। আজও বলছি, আমি আপনার প্রেমিক হতে চাইছি না, চাইছি বিশ্বস্ত সঙ্গী হতে। যেহেতু আমি আপনার প্রেমিক হব না, তা-ই আপনাকে পটানোর কোনো প্রশ্নই আসে না।’

-‘হয়েছে, হয়েছে। বুবুর দেয়া পাঁচ মিনিট সময় শেষ, এখুনি ফোন রাখুন।’

তানজীম অবাক হয়ে বলল,
-‘টাইম ধরেবেঁধে ফোনে কথা বলা যায়?’

-‘জি, যায়। আপাতত এইটুকুই। এরবেশি আমি কিচ্ছু বলব না।’

-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। রেখে দেব। যা জানতে ফোন করলাম, সেটা তো জেনে নিই, আগে। পরে ফোন রাখব।’

-‘আবার কী জানতে চান?’

-‘আপনার চয়েস বলুন। কী পরবেন, শাড়ি, গাউন না-কি লেহেঙ্গা?’

-‘যা কিছু একটা হলেই হবে। আমার এত চয়েস নেই। আমি সবকিছুতেই কমফোর্টেবল।’

-‘আর রং? কী রংয়ের পোশাক কিনব?’

-‘আপনার ইচ্ছে।’

-‘আমি তো সাদা পাঞ্জাবীর সাথে খয়েরী রঙের শেরওয়ানী নিব। দু’জনেই কি সেইম রং হবে, না-কি আলাদা?’

-‘দূর, এসব আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন? আমি এসব বুঝি না। বুবু যা চয়েস করে, সেটাই হবে। এখন ফোন রাখুন, প্লিজ।’

-‘আশ্চর্য! এত তাড়া দিচ্ছেন কেন? আরও ঘণ্টাখানেক কথা বলি। অসুবিধা তো নেই। আমি আমার হবু বউয়ের সাথে কথা বলছি, এতে কার কী?’

-‘নো, আর এক মিনিটও নয়। যা কথা হওয়ার, সেটা বিয়ের পর হবে। এখুনি আর কোনো কথা হবে না।’

-‘এত বেরসিক কেন আপনি?’

ঊষা মুখে হাত দিয়ে বসে রইল। লোকটা তাকে বেরসিক বলল? সে নিজেই তো সারাদিন উজমাকে বেরসিক বলে ক্ষ্যাপায়। কখনও তো ভাবেনি, এটা শুনলে কেমন লাগে! নিজে যে স্বভাবের নয়, তা যদি কেউ বলে, রাগ হওয়া স্বাভাবিক। মুহূর্তের রেগেমেগে ব্যোম হয়ে গেল ঊষা। বলল,

-‘হ্যাঁ, আমি বেরসিকই। এই বেরসিককে নিয়েই জীবন কাটাতে হবে আপনার। বাই, এরপর আর কোনো কথা হবে না। সোজা, বিয়েতে দেখা হবে।’

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিজয়ীর হাসি হাসলো ঊষা। আবার বলুক, বেরসিক। বুঝিয়ে দিবে, কাকে কী বলেছে। কতবড়ো সাহস, হ্যাঁ। ঊষাকে বেরসিক বলতে আসে। ঊষা কি বেরসিক না-কি? একটু লাজুক। অচেনা কারও সাথে একদিনেই এত ফ্রি হয়ে কথা বলা যায়? লজ্জা তো লাগবেই। তাইবলে বেরসিক বলবে? পাজি ছেলে! এরকম অসংখ্য বকাঝকার মাধ্যমে নিজের সাথেই নিজে বকবক করল ঊষা। হাসলো, মন খারাপ করল, সবাইকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে, নীরবে কাঁদলও।

***

বিয়ের দিন-তারিখ পাকা করার সময় তাক্বদীম উপস্থিত ছিল। বাকিরা ব্যস্ত ছিল বলে কেউ আসতে পারেনি। হুটহাট এই খবর শোনে সবাই-ই আড্ডার একটা সময় আলাদা করে পরদিন বিকেলেই পৌরপার্কে দেখা করল। ব্যস, উজমাকে সামনে পেয়েই সবার হৈচৈ শুরু হলো। মেয়েরা তো ইচ্ছেমতো পঁচাচ্ছে। ‘ভালোবাসি’ কথাটা মুখে স্বীকার করে না অথচ বিয়ের কথাবার্তাও এগিয়ে গেছে। এই নিয়ে সবাই একটু রাগ-অভিমান দেখাচ্ছে। সবার ধারণা উজমা সবাইকে পর ভেবেছে বলেই নিজের মনের কথা শেয়ার করেনি। কিন্তু সে তো জানে, পরিস্থিতি কী ছিল আর তাকে সবকিছু কীভাবে সামলাতে হয়েছিল। বন্ধুদের অভিমানে ভরা কথা শোনে খুব খারাপ লাগল উজমার। কপালে হাত ঠেকিয়ে মুখভার করে রইল। উজমাকে এত নীরব দেখে মাইসারা বলল,

-‘দেখ সবাই, এখন এই মেয়ে ঢং করছে। সেদিন বলেছিলাম না, ফারশাদ মুনতাসীরের বাটারফ্লাই ও-ই? মিলল তো আমার কথা। আমি যা বলি, ভেবে-বুঝে বলি। সত্য এটাই যে, উজমা আমাদের পর ভাবতে শুরু করেছে। ভাবত একবার, এমন কী বিষয় নেই, যা আমরা একে-অপরের সাথে শেয়ার করিনি? যেকোনো সমস্যা হলে ছ’জন মিলে সমাধান করেছি। ওর বিয়ের পাত্র খুঁজতে মাঠে নেমেছি। অথচ ও মুখফুটে একবারও বলেনি, ফারশাদকে ভালোবাসে। বললে কী হতো? আমরা কি ওর খারাপ চাই যে, শুনলে ওর প্রেমে বাঁধা হয়ে দাঁড়াব?’

মাইসারার কথা হয়তো ঠিক, তবে পুরোটা নয়। যেকোনো পরিস্থিতি কিংবা সমস্যায় একজন মানুষের ওপর দিয়ে কী পরিমাণ ঝড় বয়ে যায়, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ সহজেই বুঝতে পারবে না। বন্ধুরা তার অতীত জানে না, বন্ধুরা তার মনের খবর জানে না, সরাসরি যতটা দেখে, ততটাই জানে। বুঝেও। সবাই তাকে ভালোবাসে, তারজন্য ভাবে, এটাও মিথ্যে নয়। কিন্তু তবুও, কিছু গোপন বিষয় একান্তই নিজের কাছে চেপে রাখা প্রয়োজন। সবকিছু যদি অন্যজনের কাছে শেয়ার করা হয়, প্রকাশ করা হয়, তাহলে নিজের বলে থাকে কী? সে তো ভেবেছিল, ফারশাদকে নিয়ে তার অনুভূতি সবসময়ই গোপন থাকবে, কখনও প্রকাশ হবে না, কেউ জানবে না। কিন্তু এটা কি জানত, মনের সাথে দ্বন্দ্ব করতে গিয়ে সে হেরে যাবে? ভালোবাসাকে প্রকাশ করে ফেলবে? এটা তো আগে বুঝেনি। এজন্যই কাউকে কিছু জানায়নি। বন্ধুরা তাকে ভুল বুঝুক, তার সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু ভাবুক, এটা সে চাইল না। তা-ই বলল,

-‘ব্যাপারটা এরকম নয়, সারা। তোরা আমাকে ভুল বুঝছিস।’

মাইসারা একগুঁয়ে মেজাজে জবাব দিল,
-‘মোটেও নয়। আমরা ঠিকই ভেবেছি। তুই-ই আমাদের পর করে দিয়েছিস। এমনিতেও ক্রিকেটারের সাথে বিয়ে হলে তুই দূরে সরে যাবি। শুধু দূরেই নয়, এই শহর ছেড়ে চলে যাবি। ভাবতেই খারাপ লাগছে যে, আমাদের ছ’জনের পথচলা এই অবধিই ছিল। এতদিনের সম্পর্কটার এতদ্রুত বিচ্ছেদ ঠিক মানতে পারছি না রে, উজমা। আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাচ্ছে, এত তাড়াতাড়ি? হাউ ফানি…।’

কথা শেষ করে বাঁধভাঙা জলের ন্যায় ভেঙে পড়ল মাইসারা। টুপটুপ করে তার চোখ থেকে পানি পড়তে লাগল। সেইযে, ছোট্ট মোমের জন্মের পর থেকে একসাথে পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই পথ আজ বেঁকে যাচ্ছে। আর এক সপ্তাহ পরই বন্ধুটা চলে যাবে, অন্যশহরে! একেবারে দৃষ্টিসীমার বাইরে। কী করে এই চরম সত্য মেনে নিবে? ধৈর্য্য হারিয়ে মাইসারা উঠে দাঁড়াল। সবার সামনে থেকে অন্যত্র সরে গিয়ে আলাদা একটা চেয়ারে বসলো। পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে চুপটি করে রইল। উজমা শুধু দেখে গেল, নিষ্পলক চোখে। কী করণীয় তার? নিয়তি যদি তাদের আলাদা করে দিতে চায়, এক হবে কী করে? হয়তো তাদের পথচলা এই পর্যন্তই ছিল। সবাইকে ছেড়ে সে কী ভালো থাকবে? নিজেকে এতদূরে টিকিয়ে রাখতে পারবে? তারও তো মন পুড়বে। স্মৃতিগুলো তাকে এলোমেলো করে দিবে। ফেলে আসা দিনগুলো মনে করে সে-ও তো কেঁদেকেটে গাল ভাসাবে! তাই বলে কি, সবাইকে সে ভুলে যাবে? পর ভেবে দূরে সরিয়ে দিবে? এমন তো নয়। তাহলে বোকা মেয়েটা এত কাঁদছে কেন? নিজেকে শক্ত রেখে বলল,

-‘তোরা একটু ওকে বোঝাবি? তোরা এমন করলে আমি থাকতে পারব? আমি জানি না আমার ভাগ্যে কী আছে! এমনিতেও জীবন আমাকে অনেক ভুগিয়েছে। এখনও আমি নিশ্চিত নই, শেষ পর্যন্ত এই বিয়েটা হবে কি-না। বার বার বিয়ে ভাঙার খেলা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ধৈর্য্যশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মন থেকে ভয় সরছেই না। এতদিন বিয়ে ভাঙলেও, দশজন খারাপ কথা বললেও সয়ে নিয়েছি। কারণ আমি জানি, যা কিছু হচ্ছে সবটাই রবের ইচ্ছেতে হচ্ছে। এবারও যদি এরকম কিছু হয়, খুব বেশি কষ্ট পাব কি-না জানি না, তবে এরপর আর বিয়ে, ঘর-সংসার, ভালোবাসা নিয়ে স্বপ্ন দেখব না।’

সবাই-ই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ল। চলতে পথে কত হাসিঠাট্টা হয়েছে, কত মান-অভিমান হয়েছে, কত ঝগড়াঝাটি, খুঁনসুটি হয়েছে। কখনও মনে হয়নি, সব একদিন অতীত হয়ে যাবে। সবকিছুকে একদিন পরিত্যক্ত ডায়েরির ভাঁজে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অথচ সময়, আজ তাদের কী কঠিন একটা সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কত সহজেই বুঝিয়ে দিচ্ছে, সবাইকেই একদিন আপনজনদের ছেড়ে দূরে যেতে হয়। এই দূরত্বটা এত দূরেই হবে কেন? কেন সবাই একসাথে থাকতে পারবে না? মন খারাপের এই সময়টায় অনিক বলল,

-‘ছাড়, যা হয় দেখা যাবে। এখুনি এত ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়নি।’

প্রতুত্তরে রাইদাহ বলল,
-‘তুই একটু সারাকে সামলা, প্লিজ। ওকে বোঝা, দূরে যাওয়া মানেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ নয়। এটা আধুনিক যুগ। এই যুগে দূরে গিয়েও কাছে আসা যায়।’

দূরে গিয়ে হয়তো মুঠোফোনের সাহায্যে কাছে আসা যায়, কিন্তু সময়ে-অসময়ে সবাই তো আর এইভাবে আড্ডার আসর জমাতে পারবে না। জমালেও পাঁচজন আড্ডায় বসবে আর একজন দূরেই থেকে যাবে। কাছে থেকে, পাশে বসে যে আনন্দ পাওয়া যায়, মুঠোফোন সেই আনন্দ কখনওই দিতে পারবে না। সবকিছুই তখন হয়ে যাবে যান্ত্রিক। কতকিছু ভেবে ভেবে মন খারাপ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল উজমা। অনিক গেল মাইসারার পাশে। তাকে বুঝাতে। কাঁধে হাত রেখে ধীরেধীরে বলল,

-‘তুই ছিঁচকাদুনে কবে হলি?’

-‘সর এখান থেকে।’

আলতোভাবে একটা ধাক্কা দিল মাইসারা। অনিক সরলো না। শক্তহাতে পেঁচিয়ে ধরল বউকে। কণ্ঠে আহ্লাদ মিশিয়ে বলল,
-‘প্রতিটা মানুষই চায়, ভালোবাসার মানুষের সাথে একটা বিশ্বস্ত নীড় গড়ে তুলতে। প্রতিটা মানুষই তো স্বপ্ন দেখে, তার জীবনেও ভরসার একটা মানুষ আসবে। কষ্ট পাচ্ছিস কেন? তুই-আমি, আমরা যদি ভালোবাসতে পারি, ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ঘর বাঁধতে পারি, একসাথে বাঁচতে পারি, তাহলে ও কেন পারবে না? ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার অধিকার তো ওর আছে, তাই না? বাচ্চাদের মতো জেদ না ধরে, ওকে একটু সাহস দে। ওকে হারিয়ে ফেললে আমাদের যেমন কষ্ট হবে, তারচেয়ে দ্বিগুণ কষ্ট ওর হবে, আমাদের সবাইকে ছেড়ে এতদূরে গিয়ে থাকতে। এমনিতেই জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা সামলেছে। অনেক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করে নিজের জন্য একটু ভাবতে শিখেছে। ওকে আর দুর্বল করে দিস না, সারা। ওর এখন সাহস দরকার, আমাদের সাপোর্ট, সহযোগিতা দরকার। আমরা যদি ওকে ভুল বুঝি, দূরে সরিয়ে দিই, পর করে দিই, ও ভালো থাকতে পারবে?’

মাইসারা মাথা তুলল। সোজা হয়ে বসলো। অনিকের মুখোমুখি হয়ে বলল,
-‘আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে, বিশ্বাস কর।’

অনিক তাকে আশ্বস্ত করতে চোখের পানি মুছে দিয়ে শান্তস্বরে বলল,
-‘কষ্ট হচ্ছে, আমারও। আমাদের সবার। জানি, ও দূরে সরে যাচ্ছে। কিছু তো করার নেই, তাই না? যেতে দিতে হবে। দূরে যাওয়া মানেই তো সম্পর্কের বিচ্ছেদ নয়। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল, আছে, থাকবে। এটা আমরা বিশ্বাস করি তো। করি না?’

-‘হুম…।’

-‘তাহলে? মিছেমিছি রাগ-অভিমানকে মনে জায়গা দিয়ে কেন নিজেদের মধ্যে ফাটল তৈরী করছিস? দূরে সরে গেলেও আমাদের এই সম্পর্ককে আমরা বাঁচিয়ে রাখবই।’

হারানোর ভয়, ভাঙনের ভয়, কিছুটা হলেও দূর হলো মাইসারার। সে ছুটে এসে উজমার পাশে বসে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,

-‘মনে রাখিস, এই বন্ধুত্বের সম্পর্কে ‘বিচ্ছেদ’ বলে কোনো শব্দ নেই। যদি কোনোদিন আসে, ধরে নেব, আমাদের সম্পর্ক কখনও বিশ্বস্ততার ছিল না।’

রাইদাহ দূরে থাকল না। সে-ও শামিল হলো, সুখটাকে ভাগ করে নিতে। তিনজনে একসাথে জড়াজড়ি করে ভাব জমালে দূরে থেকে একটা ছবি উঠাল কাইফ। বলল,

-‘বিয়েটা তো রেস্টুরেন্টে হচ্ছে, তাই না?’

উজমা তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
-‘না, শহরের সব রেস্টুরেন্ট ওইদিন রিজার্ভ। রিসোর্টে হচ্ছে। যদিও রিসোর্টে দু’দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হবে।’

-‘ওয়াও, তাহলে দারুণ হবে। ডিজে তো লাগবেই। সেইসাথে হলুদের আয়োজন করতে হবে। ওয়েট, বর কবে আসবে?’

-‘বিয়ের দিন।’

-‘আগে আসবে না?’

-‘তিনি চরম নার্ভাস। তাই আগে আসতে পারবেন না।’

সবাই হো হো শব্দে হেসে উঠল। হাসির মাঝে রিংটোনের আওয়াজ কানে আসতেই ফোন হাতে নিয়ে কানে ঠেকাল উজমা। ওপাশ থেকে ফারশাদ বলল,

-‘আর মাত্র একটা ম্যাচ বাকি। সোমবার দিন দেশে ফিরছি, বাটারফ্লাই।’

আজ শুক্রবার। এখনও বাকি তিনদিন। মনের ভেতর একঝাঁক সুখপায়রা ওড়াউড়ি করলেও তাদের দমিয়ে রেখে গম্ভীরমুখে বলল,
-‘আমার বন্ধুরা খুব মন খারাপ করছে, আমার বিয়ে হয়ে যাবে দেখে। ওদের ধারণা বিয়ে হয়ে গেলে আমি পর হয়ে যাব। দূরে সরে যাব আর ওদেরকে ভুলে যাব। ওরা তো আপনার ওপর ভীষণ চটে আছে।’

-‘আপনি ওদের বলুন যে, ফারশাদ মুনতাসীর ওদের বন্ধুকে কেড়ে নিচ্ছে না, শুধু বৈধ সম্পর্কের সিলমোহরটা দিচ্ছে।’

-‘এইটুকু বললেই কি ওরা মেনে নিবে?’

-‘কেন নিবে না? আমি ওদের কী ক্ষতি করেছি শুনি?’

-‘বিরাট ক্ষতি করেছেন। এত বছরের সম্পর্কটার মাঝে মাত্র সাতদিনের প্রভাব ফেলে কতদ্রুতই সবাইকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন।’

-‘ঠিক আছে। ভুল যেহেতু হয়ে গেছে, ভুল শোধরে নিচ্ছি। এমনিতেও আমি নার্ভাস। আগেই বলেছি। একেবারে সরাসরি এসে দেখা করব, কথা বলব। এর আগে আপনাকে বিরক্ত করব না আর। এই সাতদিন আপনি ওদের সময় দিন। বাই…।’

এই কথার পর উজমার মনে হলো, ফারশাদ রেগে গেছে। এভাবে কথা বলা হয়তো উচিত হয়নি। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
-‘আপনি রাগ করছেন, কেন?’

-‘আমি রাগ করিনি। ওদের খারাপ লাগা, কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। অনেক বছরের সম্পর্কের মাঝখানে আমি আজ অনাহুতই। আপনার জীবনে আমার চেয়ে ওদের প্রায়োরিটি বেশি। এটা বোঝা উচিত ছিল আমার। এখন রাখি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে টেক্সট করে রাখবেন, ফ্রি সময়ে রিপ্লাই দিব। আল্লাহ হাফেজ।’

পালটা উত্তর দেয়ার আগেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল ফারশাদ। উজমার তখন মাথায় হাত। কী হলো এটা? এইভাবে রেগে যাওয়ার মতো কী বলে ফেলল! সামান্য কথাতে কেউ এত রাগ করে? নিশ্চুপে বেশ কয়েকবার কল দিয়ে গেল। কিন্তু রিসিভ হলো না। বন্ধুরা সবাই জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে! কোনো সমস্যা কি-না! উজমা কিছুই বলল না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে ফোন হাতে নিয়ে সড়কে এলো। কী উপায়ে রাগ ভাঙাবে, ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে ভয়েস পাঠাল। মৃদুস্বরে আওয়াজ তুলল,

-‘আই লাভ ইউ মাই লাভ। আই লাভ ইউ মোর দ্যান, মাই লাইফ।’

এরপর হুমায়ূন আহমেদের ‘আমি খুব অল্পকিছু চাই’ কবিতার কয়েকটা লাইন দিয়ে নিজের সবটুকু আবেগ ও ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে বলল,

আমাকে ভালবাসতে হবে না,
‘ভালবাসি’ বলতে হবে না –
মাঝে মাঝে গভীর আবেগ নিয়ে,
আমার ঠোঁটদুটো ছুঁয়ে দিতে হবে না।
কিংবা আমার জন্য রাতজাগা পাখিও
হতে হবে না –
অন্য সবার মতো আমার সাথে রুটিন মেনে
দেখা করতে হবে না।
কিংবা বিকেল বেলায় ফুচকাও
খেতে হবে না।
এত অসীম সংখ্যক “না” এর ভীড়ে
শুধুমাত্র একটা কাজ করতে হবে।
আমি যখন প্রতিদিন এক বার “ভালবাসি” বলব
তুমি প্রতিবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
একটুখানি আদর মাখা
গলায় বলবে “পাগলি”।

***

চলবে…