মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-৩৭+৩৮

0
46

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – সাঁইত্রিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

বাড়িভরা মেহমান দেখে সুস্থির নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছে না ফাবিহা। আসার পর থেকে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। মেহমানদের আপ্যায়ন করাচ্ছে। ফুপির কাজে সাহায্য করছে। এত কাজের ভীড়ে তার হাঁপিয়ে ওঠার দশা। একটু যে বিশ্রাম নিবে, সেই সুযোগ নেই। কাজিনেরা সবাই আড্ডা দিতে বসে গেছে। অলসের দলে নাম লিখিয়েছে সবাই। কেউ যদি তাকে সাহায্য করত, সব কাজ দ্রুত এগোতো। মাঘের গা কাঁপানো শীত, অথচ সে দৌড়ের চাপে পড়ে ঘেমেনেয়ে একাকার। রুমে এসেছিল পোশাক পরিবর্তন করতে। তখুনি তার ছোটো ফুপি কারিমা রওশন বললেন,

-‘এক কাপ চা নিয়ে আয় না, মা। মাথাটা খুব ধরেছে।’

ফুপির জন্য চা বসাতে গিয়ে আবারও কাজের ভীড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। ফারশাদ সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। সেই ফাঁকে তার ফোনে একটা ম্যাসেজ পাঠাল উজমা,

-‘পাঁচ মিনিটের জন্য ফাবিহাকে পাঠানো যাবে?’

স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে চারিদিকে ফাবিহাকে খুঁজলো ফারশাদ। না পেয়ে নিজেই উঠে দাঁড়াল। রুমের কাছাকাছি গিয়ে দরজায় আস্তে করে নক দিল। একবার, দু’বার, তিনবার। এরমধ্যেই দরজা খুলে হতভম্ব উজমা দাঁড়িয়ে থেকেই এলোমেলো শাড়ি নিজের শরীরে জড়িয়ে রেখে সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে বিছানায় বসে পড়লো। গা কাঁপানো হাসিতে পেয়ে বসলো ফারশাদকে। সে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-‘কী দরকার বোলো। আমি হেল্প করছি।’

চোখ তুলে তাকাল না উজমা। মুখ লুকিয়ে বলল,
-‘তোমাকে আসতে বলিনি।’

-‘আরেহ্ ফাবিহা ব্যস্ত। ড্রয়িংরুমে খুঁজে পেলাম না। আমি ভাবলাম জরুরী কিছু। এই কারণেই এলাম। তুমি এখনও শাড়ি পরোনি, এটা কি আমি জেনে বসে আছি?’

উজমা পরাজয় মেনে নিতে নারাজ। শাড়ি সে পরতেই পারে, কিন্তু আজ কুঁচিটা কোনোমতেই ঠিকঠাক হচ্ছে না। শাড়িতে অতিরিক্ত কাজ, ভারীও বেশি। এই কারণে ফাবিহাকে খুঁজেছিল। কেউ একজন কুঁচি ধরলে সহজেই শাড়ি পরে নেওয়া যেত। সে ফাবিহার খোঁজ করেই বলল,

-‘আমি পরতে জানি কিন্তু আজ কুঁচি মিলছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তুমি ফাবিহাকে ডেকে নিয়ে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।’

উজমার অস্বস্তি বুঝতে পেরে বেশ কয়েকবার ফাবিহার নম্বরে কল দিল ফারশাদ। ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। এদিকে দিলারা রওশন বউমাকে ডেকে চলেছেন। কেন কে জানে। উপায় না পেয়ে ফারশাদ তাড়া দেখিয়ে বলল,

-‘সামনে এসো, আমি কুঁচি ঠিক করে দিচ্ছি।’

-‘তুমি পারবে না। প্লিজ, ওকে আসতে বোলো।’

-‘ফোন ধরছে না। হয়তো বিজি। এসো তো। ফুপি তোমাকে ডাকছে।’

ততক্ষণে আবারও দিলারা রওশনের গলা ভেসে এলে ফারশাদ জবাব দিল,
-‘ফুপি একটু অপেক্ষা কোরো। আসছি।’

বেকায়দায় পড়ে অস্বস্তি শুরু হলো উজমার। কুঁচির অংশ বাড়িয়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে বলল,

-‘নিচে বসতে হবে।’

হাঁটুভেঙে নিচে বসলো ফারশাদ। বলল,
-‘এরপর কী করতে হবে?’

তার চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলা করছে। এত হাসছে ছেলেটা। চুল টেনে দৌড় দিতে ইচ্ছে করছে উজমার, অথচ পারছে না। বিপদে আছে বলে। উজমা কুঁচি ভাঁজ করার আগে বামপাশের অংশ কুঁচির জায়গায় এনে একটা সেফটিপিন বসালো। এরপর আঙুলের সাহায্যে বেশ কয়েকটা কুঁচি করে হাতের ইশারায় নিচের অংশ দেখিয়ে বলল,

-‘একদম সোজা ভাঁজ ফেলবে, যেভাবে আমি করেছি।’

কাঁধ নাচিয়ে ফারশাদ উত্তর দিল,
-‘ওকে ম্যাডাম।’

অনভিজ্ঞ হাতে কুঁচির ভাঁজ মিলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল ফারশাদ। একটা ধরে তো আরেকটা ছেড়ে দেয়। একটা লম্বা হলে আরেকটা ছোটো হয়ে যায়। এভাবে বেশ কিছুক্ষণের যুদ্ধ শেষে সবগুলো কুঁচি সমান হলে, ঝটপট কুঁচিতে আরেকটা পিন বসিয়ে সামনের দিকে গুঁজে দিল উজমা। ফারশাদ বলল,

-‘একটা শাড়ি সামলানো এত কষ্ট?’

-‘জি সাহেব, ভীষণ কষ্ট। এবার সরো। আর কোনো হেল্প লাগবে না।’

ফারশাদ সরেনি, কেবল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। কুঁচির কাজ শেষে আঁচল ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উজমা। পিছনে সেফটিপিন বসানোর জন্য হলেও দ্বিতীয়জনের সাহায্য লাগত। ফারশাদ যায়নি দেখে, আঁচলের শেষাংশ তার হাতেই ধরিয়ে দিল উজমা। বলল,

-‘এখানেও সমান কুঁচি হবে।’

-‘কেন?’

-‘আটপৌরে ভাঁজে শাড়ি পরব।’

আটপৌরে ভাঁজে কীভাবে শাড়ি পরে জানে না ফারশাদ। ফোন হাতে ছিল বলে ঝটপট গুগলে দেখে নিল। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,

-‘নো, আঁচল ছেড়ে দাও। এভাবে পরলে পেট দেখা যাবে।’

মুখ লুকিয়ে হাসলো উজমা। আটপৌরে ভাঁজে পেট ঢেকে রেখেও শাড়ি পরতে জানে সে। এটা এই মানুষটাকে বুঝানো যাবে না। তারচেয়ে আঁচল ছেড়ে দেয়াই ভালো। সে সম্পূর্ণ আঁচল একপাশে ছেড়ে দিয়ে, ফারশাদের হাতে একটা সেফটিপিন দিয়ে বলল,

-‘এটা পিছনে বসাও। একদম ব্লাউজের সাথে আটকে দিবে।’

সামনের দিক ঠিকঠাক হয়েছে কি-না সেটা দেখতেই আয়নার কাছাকাছি গেল উজমা। পিঠের চুল সরিয়ে নিল একপাশে। কোন জায়গায় পিন বসাতে হবে, সেটা দেখিয়ে দিলে খুব বাহাদুরের মতো উজমার পিছনে দাঁড়াল ফারশাদ। আঙুলের স্পর্শে ব্লাউজ সামান্য উলটে সেফটিপিন বসাতে গিয়েই বিপদে পড়ে গেল সে। সম্পূর্ণ অচেনা একটা অনুভূতি অথচ খুব আকাঙ্ক্ষিত, এমনভাবে দিশেহারা করে তুলল তাকে। নেশা জাগিয়ে দিল। হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিল। কম্পনরত হাতে পিন আটকে আঙুলের আলতো স্পর্শে উন্মুক্ত কাঁধের অংশটা ছুঁয়ে দিল। বেসামাল হৃৎস্পন্দনের স্পন্দিত অনুভূতি সামলাতে না পেরে, দু’হাতে কোমর জড়িয়ে রেখে, ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল কাঁধে। একবার, দু’বার, অসংখ্য বার। মাতালকরা স্বরে কিছু একটা বলে গেল। অসহনীয় আগুনের উত্তাপে মোমের মতোই গলতে শুরু করল উজমা। এই স্পর্শ, আদর, সম্পূর্ণ অচেনা হলেও ভালো লাগার আবেশে বুঁদ হয়ে রইল সে। অস্ফুটস্বরে বলল,

-‘এখনও সাজ কমপ্লিট হয়নি। প্লিজ…।’

ক্ষীণ সেই স্বর, ফারশাদের কর্ণকুহরে পৌঁছালো না। ভীষণ আবেগে অর্ধাঙ্গিনীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখল সে। বাইরের সবাই কী ভাববেন, এটা মাথায় আসতেই সতর্ক উজমা ড্রেসিংটেবিলের সামনে রাখা সেফটিপিন হাতে তুলে, খুব নীরবে ও গোপনে, সাবধানতার সাথে বুকখোলা জ্যাকেটের ফাঁক দিয়ে টি-শার্টের সাথে দাবিয়ে ফারশাদের পেটে গুঁতো মারলো। আচানক এই ব্যথায় বিরক্ত হওয়ার পাশাপাশি চমকেও গেল ফারশাদ। কী হলো বুঝতে বেগ পেতে হলো। এরমধ্যেই উজমা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে পিন দেখিয়ে বলল,

-‘মেকাপ বাকি, চুল আঁচড়ানো বাকি, এমনকি জুয়েলারি পরাও বাকি। স্যরি…।’

লাজুক হেসে মাথা চুলকে ফের উজমাকে ধরতে চাইলে, সেফটিপিন দিয়ে ভয় দেখাল উজমা। বলল,
-‘একদম কাছে আসবে না এখন। এলেই এটা দিয়ে ব্যথা দিব। আমি কিন্তু যে কাউকে ভীষণভাবে আহত করতে জানি।’

ফারশাদ দমে গেল না। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইলে লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল উজমা। ফারশাদ এগোলো, উজমাও দৌড় দিল। বিশাল রুমের মাঝখানে থাকা ফুলশয্যার খাটের চারপাশ ঘুরে ঘুরে তার দৌড় অব্যাহত রাখল আর বলল,

-‘বাইরে যাও প্লিজ। তোমার কাজিনেরা অপেক্ষা করছে। কীসব পাগলামি এটা?’

একটুর জন্য দৌড় থামিয়েছিল উজমা, তারমধ্যেই ফারশাদ তাকে ধরতে গেলে আবার দৌড় দিল। তীব্র প্রতিবাদের সুরে ফারশাদ বলল,
-‘পাগলামির দেখেছ কী? এখনও অনেক কিছু বাকি।’

এইমুহূর্তে এই ভিন্ন পাগলামির ডাকে সায় দিতে ইচ্ছে করছে না উজমার। সময় কি পালাচ্ছে? বাড়িভরা লোকজন কী ভাববে? এই কারণেই যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল, ফারশাদকে আটকানোর। দু’জনেই হার মানতে নারাজ। কেউ একজন না জিতলে এই দৌড়াদৌড়ি থামবে না বোধহয়। শাড়ি পরে দৌড় দেয়া যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়াল উজমার জন্য। ফারশাদ তাকে একটুর জন্য ছুঁয়েই ফেলেছিল, এরমধ্যেই শাড়ি ও ফারশাদের পায়ের সাথে প্যাঁচ লেগে ফুলে ফুলে সাজানো বিছানায় ধপাস করে পড়ে গেল দু’জনে। ফুল যেভাবে টানানো ছিল, তাতে ফুলের গায়ে ভর পড়েছে বেশি। একসাথে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে ফুলের সুতোয় টান লেগে সবগুলো ফুল তাদের উপরে পড়ে চোখমুখ ও শরীর ঢেকে দিল। কোমরের কাছে যে সেফটিপিন বসিয়েছিল, সেটা ত্যাড়াব্যাঁকা হয়ে গেঁথে গেল তলপেটে। ব্যথা পেয়ে সামান্য আর্তনাদ করে উঠল উজমা। ফারশাদ চকিতে সতর্ক হয়ে, হাতের সাহায্যে ফুল সরিয়ে উজমার মুখাবয়ব খেয়াল করে দেখল, ব্যথায় চোখমুখের ভাবভঙ্গিই পালটে গেছে তার। সে তড়িঘড়ি ওপর থেকে সরে ভীষণ যত্নে গালে হাত ছুঁইয়ে বলল,

-‘কী হলো, বাটারফ্লাই?’

হাতড়িয়ে সেফটিপিন খোঁজার চেষ্টা করলো উজমা। না পেয়ে সোজা হয়ে বসে, এলোমেলো শাড়ির ভাঁজে সেফটিপিন খুঁজতে লাগল। ফারশাদ বলল,

-‘কী হয়েছে বলবে তো।’

-‘পিন লেগেছে পেটে।’

আতঙ্কিত চেহারায় ফারশাদ বলে উঠল,
-‘কী বোলো? কোথায়? দেখি…।’

ফারশাদ সেফটিপিন খুঁজতে চাইলে উজমা বাঁধা দিয়ে বলল,
-‘তুমি সরো, আমি দেখছি।’

আহত চেহারায় সোজা হয়ে বসলো ফারশাদ। উজমা বিছানা ছাড়ল। সম্পূর্ণ শাড়ির কুঁচি মেলে অসভ্য সেফটিপিন খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে, ব্যথাতুর অংশে দু’একবার আঙুল ঘঁষে পূণরায় শাড়ি ঠিক করে গায়ে জড়াতে গেলে ফারশাদ বলল,

-‘এটা রেখে দাও। পরতে হবে না আর।’

-‘কেন?’

অবাক হয়ে জানতে চাইল উজমা। ফারশাদ বলল,
-‘এইসব সেফটিপিন দিয়ে শাড়ি সামলানোর দরকার নেই। আর জীবনেও শাড়ি পরবে না। এখুনি খুলো।’

আহা, বেচারা। বউকে শাড়ি পরাতে চাইছিল। একটা শাড়ি যে এরকম নাজেহাল অবস্থায় ফেলবে, ভাবেনি সে। তার এই চুপসানো চেহারা ভীষণ আনন্দ দিল উজমাকে। মুখে কিছু বলল না। আচমকাই সম্পূর্ণ শাড়ি খুলে ফেলতে হাত বাড়াল ফারশাদ। একপাশ টেনে ধরাতে ফের তার গায়ের ওপর পড়ে গিয়ে বুকের সাথে মিশে রইল উজমা। নড়াচড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলল। একঝাঁক লজ্জা এসে ঘিরে ধরল তাকে। হৃৎস্পন্দন ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলে একহাতে তার নুইয়ে রাখা মুখ কিঞ্চিৎ উপরে তুলে, লাজরাঙা মুখে ছোটো ছোটো আদর দিয়ে ফারশাদ বলল,

-‘খুব বেশি ব্যথা পেয়েছ?’

দু’দিকে মাথা নেড়ে না বুঝালেও আলগোছে সে-ই জায়গায় হাত ছুঁইয়ে দিল ফারশাদ। একে তো শীত, তারমধ্যে এমন শীতল হাতের স্পর্শ। উজমার মনে হলো, অসহ্যরকম সুখ এসে হুট করেই ছুঁয়ে দিল তাকে। ডানা ঝাপটানো পাখির ন্যায় ছটফট শুরু করল সে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলে দূরত্ব ঘুচে গেল একেবারে। ড্রয়িংরুম থেকে সাউন্ডবক্সে কেউ বোধহয় গান ছেড়েছে। স্পিকারে বাজছে,

ডুবিলে ডুবিব, ভাসিলে ভাসিব,
তোমারই দু’হাত ধরিয়া…
মরিলে মরিব, বাঁচিলে বাঁচিব,
কখনও যাব না ছাড়িয়া…
জনমে জনমে তোমারে গো চাই,
মরণেও পাই যেন ওপারে…
সখা তোমারে বাঁধিব, তোমারই থাকিব
বাসিব ভালো শুধু তোমারেই… (২)

পুরো রুমজুড়ে সুরের মূর্ছনায় ছেয়ে গেল। গানের প্রতিটা শব্দ বাক্য যেন তাদের পরিপূর্ণতার গল্প বলে গেল। অনুভূতির গভীরতা ক্রমেই বেড়ে গিয়ে গানের সুরে তাল মেলাতে শুরু করেছে। অনেকদিন পর উজমার মনে হলো, তার অনুভূতিও ঠিক এরকম, এই গানটার মতো। সে শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে ফারশাদকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে প্রিয়জনের কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘তুমি ছুঁয়েছ বলেই পৃথিবীর সব সুখ আজ ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়। দূর হয়ে যাচ্ছে প্রতিটা অচ্যুত, অপবিত্র, ঘৃণিত স্পর্শ। এমনকি তোমার সংস্পর্শে এসে পরিপূর্ণ এক জীবনের সাক্ষাৎ পেয়েছি। যে জীবনের সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসির প্রতিটা অধ্যায়ে শুধু তুমি, তুমি, এবং তুমি। শুধু এ জনমে নয়, মৃত্যুর পরবর্তী জীবনেও আমার তোমাকেই চাই, চ্যাম্প। শুধু তোমাকেই চাই।’

কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি যখন ছুঁয়ে দেয় ভালোবেসে, দুঃখ ভারাক্রান্ত মনের গহীনে তখন স্বর্গীয় সুখ নেমে আসে। মন বাগিচায় সুখছন্দে, রুমঝুমিয়ে, সুরে সুরে পুষ্পবৃষ্টি ঝরে পড়ে। দুটো মানুষ নির্জনে, নিভৃতে দাম্পত্য জীবনের কিছু সুখকর মুহূর্তকে একটু একটু করে উপভোগ করছিল কেবল, তখুনি একবালতি নিমসিদ্ধ পানি ঢেলে দিল ফাবিহার গলার আওয়াজ। দরজায় নক দিয়ে বলল,

-‘ভাইয়া, তাড়াতাড়ি নিচে এসো। ভাবীর সাথে সবার পরিচয়পর্ব বাকি।’

***

খাওয়া-দাওয়া শেষে নিজের লাগেজের কাপড়চোপড় বের করে সবকিছু গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখল ঊষা। তানজীম একপাশটা খালি করে বলেছে, ফাঁকা অংশে সবকিছু রেখে দিতে। যদি জায়গার ঘাটতি হয়, আগামীকাল নতুন একটা ওয়ারড্রব নিয়ে আসবে। একসাথে এতগুলো কাপড় বন্দী অবস্থায় থাকলে বোটকা গন্ধ ছড়াবে। এজন্যই পরিপাটি করে রাখা। হাতের কাজ শেষ হলে, বিছানা গুছাতে গিয়ে ইচ্ছে করেই একটা অকাজ করল ঊষা। মাঝখানে লাভ আকৃতির সম্পূর্ণ ফুল দু’হাতে তুলে ময়লার ঝুড়িতে রেখে, ঝাড়ু দিয়ে সম্পূর্ণ বিছানা পরিষ্কার করে, মেঝেটাও ঝকঝকে করে নিল। এরপর ধুলোমাখা হাত-পা পরিষ্কার করতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। বেশ খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে এসে দেখল, পা নামিয়ে বিছানায় বসে আছে তানজীম। তাকে বের হতে দেখেই জিজ্ঞেস করল,

-‘ফুলগুলো বিছানায় থাকলে কী ক্ষতি?’

ঊষা মারাত্মক অবাক হলো। ফুল বিছানায় রেখে কী করবে? থেতলে যাবে, শরীরে লাগবে, ফুল নিয়ে কী ঘুমানো যায়? সে বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে না পেরে বলল,

-‘ফুল দিয়ে কী করবেন? শরবত খাবেন? গোলাপের শরবত?’

খুক খুক করে কাশি দিয়ে তানজীম বলল,
-‘শরবত কেন খাব? আজ তো ফুলশয্যা। ফুলগুলো খাটেই থাকবে, স্বাভাবিক।’

-‘ওহ, তাইতো। ফুলশয্যায় তো ফুলের সাথেই শয্যা করতে হয়। ভুল হয়ে গেছে। আপনি শুয়ে পড়ুন, আমি ফুল দিচ্ছি।’

ঊষার মতিগতি কী, এখনও কিছু বুঝেনি তানজীম। ক্লান্ত থাকায় একটা বই হাতে নিয়ে আধশোয়া হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রুমের একপাশে থাকা ময়লার ঝুড়ি খুব সাবধানে হাতে তুলে নিল ঊষা। পা টিপে টিপে বিছানার কাছাকাছি এসে উপরে তুলে সম্পূর্ণ ঝুড়িতে থাকা ফুলসহ যত টিস্যু, চিপসের প্যাকেট ও বাড়তি কাগজ ছিল, সব ঢেলে দিল তানজীমের উপরে। হতবাক তানজীম কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকটা দাঁত বের করে হেসে উঠল ঊষা। বলল,

-‘করুন, ফুলশয্যা…। একটা ছবি তুলি? নতুন বর বলে কথা? ফুলের সাথে শয্যা করছে, ছবি না তুললে হয়? দাঁড়ান, আমি ফোন নিয়ে আসি।’

শরীরের ওপর একগাদা ময়লা দেখে গা জ্বলে উঠল তানজীমের। কিন্তু নতুন বউ, তারওপর বদের হাড্ডি দেখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ঊষা ফোন আনতে যেতে চাইলে, তানজীম বলল,

-‘দাঁড়াও।’

পিছু ঘুরে ঊষা বলল,
-‘কেন? ফুল কম মনে হচ্ছে? আরও এনে দিব?’

-‘না…। ফুল ঠিকঠাক আছে। একটা জিনিস মিসিং আছে। সেটা লাগবে। নিয়ে এসো।’

-‘কী লাগবে?’

-‘আমার বউকে। নিয়ে এসো, প্লিজ। বউ ছাড়া তো ফুলশয্যা হবে না, সোনা। যাও, বউকে ডাক দিয়ে বোলো, আমি অপেক্ষা করছি।’

ঠোঁট কামড়ে ছোটো ছোটো চোখে তানজীমের দিকে তাকিয়ে রইল ঊষা। তানজীম বলল,
-‘কী হলো? দাঁড়িয়ে রইলে কেন? আমার বউকে নিয়ে এসো। একা একা ফুলশয্যা করা যায় না-কি?’

ঊষা মোটেও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। তার মাথাভরা শুধু দুষ্টুমি আর দুষ্টুমি। সে তানজীমকে নাজেহাল করতেই বলল,
-‘ঠিক আছে, নিয়ে আসছি। আপনার বউ বোধহয় তাম্মির কাছে আছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

ফাঁকিবাজি করে তাম্মির রুমে যেতে চাইছিল ঊষা। যাওয়ার পথে পা বাড়ালে তানজীম তাকে আটকে নিয়ে বলল,
-‘শোনো…।’

-‘বলুন।’

-‘বউ যদি ওই ঘরে থাকে, এতক্ষণ আমি তাহলে কথা বললাম কার সাথে? আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে কে?’

মাথাভরা দুষ্টুমি নিয়ে দু’হাতের আঙুলের সাহায্যে চোখদুটো ইয়া বড়ো আকার দিয়ে, ভয় দেখিয়ে ঊষা বলল,
-‘আমি হচ্ছি প্রেতাত্মা… ঘাড় মটকে দেব। একদম কাছে আসা যাবে না।’

-‘তাই?’

-‘হ্যাঁ। দূরে থাকুন।’

-‘ঠিক আছে। কাছে আসছি। দেখি তো, কেমন ঘাড় মটকাও।’

ঊষার কোনো চালাকিই আর কাজে দিল না। বাইরে যাওয়ার আগেই দু’হাতে তাকে প্যাঁচিয়ে ধরল তানজীম। ঊষা ছটফটিয়ে উঠল, হাত-পা নাচাতে শুরু করল। ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। তার কোনো অনুরোধ কাজে দিল না। তানজীম তাকে বিছানার একপাশে শুইয়ে দিলে ঊষার ছটফটানি আরও বেড়ে গেল। একাধারে অনেকক্ষণ তার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দিল তানজীম। তাতেই শব্দ করে হেসে উঠল ঊষা। হাসির আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। রুমের বাইরে যেতে পারে, এ কথা মাথায় আসতেই ঠোঁটের ওপর হাত চেপে রাখল তানজীম। বলল,

-‘সাউন্ড কম। কেউ শুনলে কী ভাববে?’

ঊষার খিলখিল আরও বেড়ে গেল। হাসতে হাসতে বলল,
-‘শুনুক সবাই। বউয়ের ওপর অত্যাচার করছেন।’

-‘এটাকে অত্যাচার বলছ?’

-‘বলছি। এভাবে কেউ শক্তি কেড়ে নেয়? নড়তেই পারছি না।’

তানজীমের হাত তখনও থামেনি, সুড়সুড়ি দেয়াতে ব্যস্ত। হাসির ফাঁকে খেয়াল করল, কপালের ফুলে ওঠা অংশটা আগের চেয়ে ছোটো দেখাচ্ছে। পা থেকে হাত ছাড়িয়ে বউয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে ব্যথাতুর অংশটা ছুঁয়ে দিয়ে বলল,

-‘বেশি লেগেছিল?’

-‘না লাগলে ঢোল হয়?’

ধাক্কাটা বেশ জোরেই লেগেছিল। তা-ও আবার শক্তপোক্ত মাথা। ব্যথা পাওয়া স্বাভাবিক। সে অনুশোচনার সুরে বলল,
-‘তুমি ভীষণ ছটফট কোরো। নিজের দোষেই ব্যথা পেয়েছ।’

-‘হ্যাঁ তো, আর আপনি রাতকানা। চোখে কিছু দেখেন না। পালোয়ানের শক্তি আমার সাথে না দেখিয়ে আপনার তো বক্সিং খেলায় নাম লেখানো উচিত ছিল। গায়ে যা জোর। বাপরে…।’

ঊষার দুষ্টুমিষ্টি শুনতে খুবই ভালো লাগছিল তানজীমের। মনে হচ্ছিল গোটা রাতটা এভাবেই কেটে যাক। সময় এখানেই থেমে যাক। সে বিভোর হয়ে থাকুক, প্রিয়জনের হাসি, কথা ও দুষ্টুমিষ্টি অভিমানে। এই মেয়েটার মাঝে কী কে জানে! চোখে চোখ পড়লে আর সরানোই যায় না। সেদিন চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে পেরে নিজেকে আজ সে সুখী পুরুষ হিসেবে আবিষ্কার করে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকভরে শ্বাস নিয়ে অর্ধাঙ্গিনীর চঞ্চলতায় হারিয়ে, মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। এই হাসি, এই চোখ পিটপিট করে তাকানো, মাঝেমধ্যে লজ্জায় চুপসে যাওয়া, সবকিছুই তাকে ভীষণ সুখ দিচ্ছিল। একাধারে অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকায় তার চোখের মুগ্ধতা আরও বেড়ে গেল। সমস্ত সত্ত্বায় অচেনা এক সুখসঙ্গীত বেজে উঠল। দিকদিশা হারিয়ে খুব সাবধানে অথচ ভীষণ যত্নে, মায়াবী মুখশ্রীতে অনবরত ঠোঁট ছুঁইয়ে গেল। বলল,

-‘আমার মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, ঊষা। একটু নয়, অনেকখানি।’

এমন আদুরে সুরে জীবনসঙ্গীর মুখে ভালোবাসি শোনে সুখেদের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছিল ঊষা। বিবাহিত জীবনের প্রতিটা সুখ, প্রতিটা মুহূর্ত ছুঁয়ে দেখার তীব্র বাসনায় মন-প্রাণ আনচান করে উঠল। তার সমস্ত চঞ্চলতা হারিয়ে গিয়ে একনিমিষেই সর্বাঙ্গে নেমে এলো লজ্জা। ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে পড়ল লজ্জামিশ্রিত হাসি। সেই হাসিতে ডুবে ডুবে তানজীম বলে উঠল,

-‘হেই প্রিটি ওমেন, ডোন্ট ইউ লাভ মি?’

লজ্জায় মরি মরি অবস্থা নিয়ে উত্তর দেয়া যায়? দিলেই বা কী বলতে হয়? সে সরাসরি উত্তর দিতে পারল না। বন্ধ চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠল। তানজীম অধৈর্য্য ভীষণ। সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে ঊষা নিজের কোমল হাতের ছোঁয়ায় অর্ধাঙ্গর চিবুক ছুঁয়ে বলল,

-‘ভালোবাসা কীভাবে হয় আমি জানি না, জীম। এই উপলব্ধি কী করে আসে, সেটাও জানা নেই আমার। আমি শুধু জানি, আপনি আমার মানসিক স্বস্তি-শান্তি। আপনাকে দেখলে চোখে ও মনে তৃপ্তি নেমে আসে। আপনার কাছাকাছি থাকলে সব ভয় দূর হয়ে যায়। মনে হয়, আমি আর একা নই। আপনার কণ্ঠস্বর শুনলে, হৃদয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করে। এই সুর, এই মুখ, এই মানুষ, সম্পূর্ণ আমার, এটা ভাবতে গেলে নিজেকে আরও বেশি সুখী ও পরিপূর্ণ মনে হয়। এতসব উপলব্ধিকে কি ভালোবাসা বলে না?’

অর্ধাঙ্গিনীর এই কথাতে পুলকিত হলো তানজীম। আবেগঘন কণ্ঠে কিছু বলতে চাইলে ঊষা বলল,
-‘এখন সরুন, আপনার ফুলশয্যার ঠ্যালায় বিছানার বারোটা বেজে গেছে। বাড়তি কোনো বেটশীট থাকলে দিন, এটা চেঞ্জ করি।’

চুপসানো মুখে সোজা হয়ে বসে বিছানার দিকে দৃষ্টি দিল তানজীম। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-‘ফুলশয্যা আর করতে দিলে কই? এটা তো ডাস্টবিনশয্যা হয়ে গেল।’

পূণরায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ঊষা। তানজীম ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টিতে বলল,
-‘আমার ফুলশয্যার বারোটা বাজিয়ে এখন হাসা হচ্ছে না?’

-‘আচ্ছা, হাসি বন্ধ। এবার একটা বেডশীট দিন না।’

তানজীম বাড়তি চাদর খুঁজতে গেলে, আবারও বিছানার সব ফুল পরিষ্কার করে ঝুড়িতে তুলে, নোংরা হওয়া চাদরটা ওয়াশরুমে নিয়ে রাখল ঊষা। আরেকটা চাদর এনে দিলে সেটা বিছানায় ছড়িয়ে, ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবে, এরমধ্যেই ঊষার ফোন শব্দ করে বেজে উঠলে তানজীম মহা বিরক্ত হলো। বোনের নম্বর থেকে কল আসাতে ঝটপট সেটা রিসিভ করে কানে ঠেকাল ঊষা। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিয়ে বই হাতে তুলে তাতে চোখ বুলাতে শুরু করল তানজীম। ওদিকে ঊষা বকবক করছে,

-‘আমি একবার ভাবছিলাম তোমাকে ফোন করব। পরে ভাবলাম ব্যস্ত কি-না। কতদূরে চলে গেছো, তুমি। ভীষণ মিস করছি তোমায়। আবার কবে দেখা হবে আমাদের?’

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – আটত্রিশ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

একটা স্বচ্ছ-সুন্দর ও পরিপূর্ণ ভোরকে ছুঁয়ে দেখার আশায় কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে, সেই হিসেব জানা নেই উজমার। সে বিশ্বাস কর‍ত, জীবনে অন্ধকার মুহূর্ত পেরিয়ে আলো আসবে, দুঃখের দিন শেষে সুখের দেখা মিলবে। নিজেকে ও নিজের মনের দুর্বলতাকে এভাবেই পাশ কাটিয়ে আজকের এই ভোরের দেখা পেয়েছে। রুমের ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে একফালি রোদ্দুর যখন ছুঁয়ে দিল তার চোখমুখ, চোখ মেলে খুব নীরবে, চুপিসারে জীবনের অন্যতম সুখকর মুহূর্তটা উপলব্ধি করছিল সে। তখনই খেয়াল করল, ভোরের রোদ্দুর আজ শুধু তাকে নয়, খুব যত্ন ও মায়ার সাথে ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রিয়জনের মুখটাও। ঘুমের মধ্যেই বিরক্ত হচ্ছে ফারশাদ। এটা তার মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। বিরক্তি কমাতে আস্তে করে চোখ থেকে দুই ইঞ্চি উপরে নিজের হাত রাখল উজমা। চুপিচুপি আওড়াল,

-‘অসভ্য রোদ, তোর কি হিংসে হচ্ছে? এত বিরক্ত করছিস কেন?’

কতক্ষণ হাত দিয়ে ছায়া দেয়ার চেষ্টা করে দেখল, হাতে ব্যথা ধরে গেছে। এদিকে ফারশাদের বিরক্তি বাড়ছে। এদিক থেকে ওদিক মুখ ঘুরিয়ে শান্তিতে ঘুমাতে চাইছে। অথচ সূর্যের আলো সরাসরি চোখে এসে পড়াতে ঘুম হচ্ছে না ঠিকঠাক। ফারশাদের ঘুমের কথা চিন্তা করেই মুখোমুখি হয়ে রোদের আলোটা নিজের শরীরে নিয়ে, একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এবার একটু আরাম হওয়াতে নড়াচড়া থামাল ফারশাদ। কতক্ষণ মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আঙুলের আলতো স্পর্শে সম্পূর্ণ মুখখানি ছুঁয়ে দেখার লোভ হওয়াতে ধীরেধীরে আঙুল ছুঁলো চোখে, গালে, ঠোঁটেও। স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলল ফারশাদ। নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্বে তার অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে ছুঁয়ে দিতে হাত বাড়াতেই, কপালের মধ্যিখানে কোমল ঠোঁটের আদর বসিয়ে দিল উজমা। ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘গুড মর্নিং।’

উজমার মুখে যেমন লজ্জা মিশে আছে, তেমনই আছে হাসিও। যে হাসি একদম স্নিগ্ধ, নির্মল, পবিত্রতার সাক্ষর বহন করে। চেহারায় কোনোপ্রকার ভয় ও অস্বস্তি নেই। রাতের কথা মনে পড়তেই চেহারায় দুষ্টুমিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুলল ফারশাদ। তাতেই কুপোকাত উজমা লুকানোর পথ খুঁজল। ঝটপট পালাতে চাইলে আদুরে হাতে বাটারফ্লাইকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

-‘পালিয়ে যাচ্ছ কেন?’

উজমা মুখ লুকিয়েই জবাব দিল,
-‘তুমি দুষ্টুমি করছ।’

-‘কিছুই তো করলাম না। শুধু একটু দেখলাম। তোমাকে দেখতেও পারব না?’

-‘আর দেখতে হবে না। এখন উঠতে হবে। বেলা বেড়ে যাচ্ছে।’

-‘উঁহু, এখনই উঠছি না। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। এখন আমি ঘুমোবো।’

-‘তুমি ঘুমোও। আমি তো নিষেধ করছি না।’

হাত ছাড়িয়ে যেতে চাইলে ফারশাদ তাকে দু’হাতে চেপে ধরে বিছানায় ফেলে দিল। আঙুলের ভাঁজে আঙুলে আটকে অজস্র চুমুতে বেসামাল করে দিতে চাইল। বেকায়দায় পড়ে উজমা বলে উঠল,

-‘এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।’

থেমে গিয়ে ফারশাদ বলল,
-‘কোনটা ঠিক হচ্ছে না?’

-‘তুমি একটা…।’

ফারশাদ থামলো না। সুযোগ পেয়ে আদরের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। জানতে চাইল,
-‘কী আমি?’

-‘বেশরম। নির্লজ্জ। লজ্জার ছিঁটেফোঁটাও নেই তোমার মধ্যে। ছাড়ো বলছি।’

-‘ছাড়ব। আগে শান্তিতে ঘুমোতে দাও।’

-‘তুমি ঘুমোচ্ছ কই? বিরক্ত করছ।’

চোখ তুলে তাকিয়ে ফারশাদ গভীরস্বরে বলল,
-‘তুমিই তো আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছ না। আমি একটা শান্তির ঘুম চাইছি, বাটারফ্লাই। অসংখ্য যন্ত্রণার ভীড়ে তোমার সান্নিধ্যই আমাকে সুখ দিচ্ছে। অথচ তুমি…।’

বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না উজমা। শুধু বুঝল, বাইরে থেকে যতই শক্ত থাকুক না কেন, ভেতরে ভেতরে ফারশাদ অনেকখানি মনোঃকষ্টে ভুগছে। হয়তো বাবা-মায়ের শূণ্যতা তাকে ঘিরে ধরেছে। গতকাল রাতে তার সব আপনজন এই বাড়িতে ছিল, শুধু বাবা-মা ছিল না। সন্তানের প্রতি মুনমুন হক্বের এই কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্ম অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে মনে। একটা মা কী করে এত নির্বিকার থাকতে পারে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। ইতিমধ্যে ফারশাদ তার বুকের ওপর মাথা রেখে নীরব হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলগোছে তার চুলের ফাঁকে আঙুল ডুবাল উজমা। বিলি কেটে কেটে মাথার তালুতে ঠোঁট ছোঁয়ালো। বলল,

-‘তুমি যদি বুঝে থাকো, আমি তোমার সুখী হওয়ার কারণ। তাহলে একটা কথা জেনে রেখো, শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমি তোমাকে সুখী রাখব।’

***

নাশতার টেবিলে আবারও আড্ডার আসর জমালো সব ভাই-বোন। ফারশাদের ব্যস্ততা ছিল আজকে। রিসেপশনে কিছু কাছের মানুষদের দাওয়াত দিতে হবে। অনুষ্ঠানের সব কাজকর্ম এগিয়ে রাখতে নাশতা খেয়েই বিদায় নিতে হলো তাকে। ফারশাদ চলে যাওয়ার পর সবাই উজমাকে ঘিরে ধরলো, তাদের প্রেমকাহিনী শুনবে বলে। না শুনালে, ছাড় নেই এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরী হলো। ফুপাতো বোন নয়না বলল,

-‘দেখো ভাবী, একদম লজ্জা পাবে না। তোমাদের প্রেমকাহিনী না শোনে আজ তোমাকে ছাড়ছি না। প্লিজ, বোলো।’

নয়নার কথায় তাল মিলালো রূম্পা। বলল,
-‘সবাই যখন শুনতে চাইছে বলেই ফেলো, ভাবী। আর লুকোচুরি করে কাজ নেই।’

এরপর নাইমুর, সজল, আরিফ কেউ বাদ রইল না। সবাই অনুরোধ শুরু করল। সবার এত অনুরোধে লজ্জায় একেবারে একটুখানি হয়ে গেল উজমা। ফাবিহা বলল,

-‘তোমাদের কি আর কোনো কাজ নেই? খামোখা বিরক্ত করছ।’

ফাবিহার কথা শোনে রূম্পা বলল,
-‘তুই মাঝখানে আসবি না। আমাদের শুনতে দে।’

সবাই এমনভাবে কথা বলছিল, যেন এখুনি ঝগড়া লেগে যাবে। সবাইকে থামাতে উজমা বলল,
-‘তোমরা যদি ঝগড়া কোরো, আমি কিন্তু কিচ্ছু বলব না। তোমাদের সামনে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী অন করে রাখব, সেটা দেখেই তোমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিবে।’

ঝগড়া থামিয়ে সবাই প্রেমকাহিনী শুনতে উদগ্রীব হয়ে বসে রইলো। সবার আগ্রহ দেখে উজমার মাথায় দুষ্টুমি চাপলো। সে নিজেদের প্রেমকাহিনী তো শুনালোই না, তার বদলে বাংলা সিনেমার দৃশ্য মনে করে হুবহু গড়গড় করে বলে গেল। বলতে গিয়ে টের পেল, এরা কেউ কাহিনী ধরতে পারেনি। উল্টে সিনেমার গল্পকেই তাদের প্রেমকাহিনী ভেবে গিলে নিচ্ছে, কোনোপ্রকার বাড়তি কথা ছাড়াই। ওর দুষ্টুমিটা শুধু ধরতে পারল ফাবিহা। গল্প বলার মাঝখানে সে শব্দ করে হেসে উঠল। সিনেমার তখন একটা কঠিন ও কষ্টকর মুহূর্ত চলছে নায়ক-নায়িকার জীবনে। তার হাসিতে সবাই বেকুব বনে গেল। নাইমুর বলল,

-‘এই তুই হাসছিস কেন?’

হাসতে হাসতে পেটের ওপর সোফার কুশন চেপে রাখল ফাবিহা, তবুও তার হাসি থামলো না। নয়না বলল,

-‘নিশ্চয়ই কোনো কাহিনী আছে, বল কেন এত হাসছিস?’

অতিরিক্ত হাসির কারণে পেটের ভেতর কথা আটকে রাখতে পারল না ফাবিহা। চাচাতো ভাই-বোন সবাই ইংরেজি সিনেমা, ড্রামা, মিউজিক বলতে অজ্ঞান। কেউ বাংলাদেশী সিনেমা দেখেই না। সে যা হোক একটু দেখে, এজন্যই উজমার চালাকি ধরতে পারল। সবাইকে বোকা বানাতে বলল,

-‘এজন্যই আমি তোদের বার বার বলি, সারাদিন ইংরেজি সিনেমা না দেখে, দু’একটা বাংলা সিনেমা দেখ। তোরা তো কেউ আমার কথা শুনবি না। নে, এবার ফ্রিতে গোল খা।’

ফাবিহার কথায় উজমারও পেট ফুলে এলো হাসিতে। সে মুখে হাত চেপে হাসতে শুরু করল। দু’জনার এই হাসিতে বাকিরা বেকুব বনে বসে রইল। রূম্পা বলল,

-‘ভাবী, তুমি কাহিনী বোলো। এরপর কী হলো?’

রূম্পার আগ্রহ দেখে ফাবিহা হাসি থামিয়ে সিনেমার পরবর্তী দৃশ্য বলে গেল। সবাই অবাক হয়ে জানতে চাইল,
-‘তুই এত কথা জানিস কী করে?’

ফাবিহা বলল,
-‘শুধু আমি না। দেশের প্রায় অধিকাংশ সিনেমা পাগল মানুষ এই সিনেমার কাহিনী জানে।’

আরিফ অবাক হয়ে বলল,
-‘মানে?’

নিজের ফোন থেকে ইউটিউবে প্রবেশ করে ক্রিকেট খেলা নিয়ে বাংলাদেশের দর্শকপ্রিয় সিনেমা ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী ২’ সবার সামনে ওপেন করে বলল,
-‘ভাবী এতক্ষণ এই সিনেমার গল্পই তোদের শুনিয়েছে আর তোরা বোকার মতো শুনেছিস।’

সবাই তাজ্জব বনে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে উঠল,
-‘এটা কিন্তু চিটিং, ভাবী।’

মুখে হাসি ধরে রেখে উজমা বলল,
-‘আমাদের কাহিনীটা আহামরি কিছু না। খুবই সাদামাটা একটা গল্প। গল্পের শুরুতে আমরা কেউ-ই আগে থেকে টেরই পাইনি, এই সম্পর্ক এতদূর গড়াবে বা গড়াতে পারে। সবটাই আসলে ভাগ্য। আমি বরাবরই তাকদীরে বিশ্বাসী। আমি বিশ্বাস করি, যা আমার ভাগ্যে আছে, সেটা আমার কাছে আসবেই। দু’দিন আগে অথবা পরে। আমার জীবনে তোমাদের ভাইয়াও ঠিক এরকমই একজন। বিয়ে করব না বলে যখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তখনই মেঘমুক্ত আকাশে রংধনু হয়ে, ফারশাদের আগমন ঘটেছে। আমি কখনও ভাবিনী, অল্প সময়ের জন্য আসা রংধনুটাই আমার জীবন রাঙিয়ে দিবে। যখন বুঝলাম, জীবন সাজানোর জন্য বিশ্বস্ত একটা হাত দরকার, একজন মানুষ দরকার, যে আমার ভরসার। তখনই নিজের মনের ডাকে সাড়া দিয়ে, হঠাৎ আসা রংধনুর রংয়েই জীবন রাঙিয়ে নিতে চেয়েছি। হয়তো ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল, তাই এতদূর এগিয়েছে। পরিপূর্ণতায় রূপ নিয়েছে।’

***

দুপুরের এক ফাঁকে, বাড়ির নতুন কর্ত্রীকে সম্পূর্ণ বাড়িটা ঘুরে দেখাতে চাইল ফাবিহা। জোরাজুরি করাতে উজমা আর না বললো না। রুম ছেড়ে বেরিয়ে বিশাল করিডোর পেরিয়ে বাড়ির এক মাথা থেকে অন্য মাথায় কী কী আছে, ক’টা রুম আছে, কোন রুম কার, সেইসব কিছু দেখাচ্ছিল ফাবিহা। প্রথমে একদিকে বাবার রুম দেখাল, অন্যদিকে এসে মায়ের রুম, দুটো রুম আলাদা আলাদাভাবে দেখানোতে উজমা একটু অবাকই হলো। জানতে চাইল,

-‘বাবা-মায়ের রুম আলাদা কেন?’

ফাবিহা লজ্জিত হেসে বলল,
-‘ওনারা তো একসাথে থাকতেনই না। দীর্ঘদিন ধরে আলাদা। শুধু লোকদেখানোর জন্য একই ছাদের নিচে থাকতেন।’

উজমা আর কিছু জানতে চাইল না। জিজ্ঞেস করাটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। যেহেতু সে জানে, মুনমুন হক্বের চরিত্র, তাই জানাশোনা বিষয় নিয়ে অযথাই বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই। ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা ঘুরিয়ে নিতে চেয়ে বলল,

-‘চলো, ছাদে যাই। আজ রোদ একটু কম। ঠাণ্ডা যেন যাচ্ছেই না।’

-‘হ্যাঁ, চলো।’

এতক্ষণ ওরা মুনমুন হক্বের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলছিল। বাইরে থেকেই ভেতরটা যথেষ্ট দেখা যাচ্ছে। দরজা আটকে চলে যেতে পা বাড়ালে, উজমা বলল,

-‘দরজাটা আবার খুলো তো তুমি।’

-‘কেন, ভাবী?’

-‘বলছি। আগে খুলো।’

মা নেই, এই কারণেই রুম লক করা থাকে। উজমার কথায় লকটা আবার খুলে দিল ফাবিহা। সে বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। স্থির চোখ নিয়ে শাশুড়ি মায়ের রুমের প্রবেশ করল উজমা। চোখদুটো তার ড্রেসিংটেবিল ও আলমারির ফাঁকে আটকে থাকা একটা নীল ও সাদা রঙের ফাইলের দিকে। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এটা কীসের ফাইল। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে, ফাঁক থেকে ফাইলটা টেনে বের করল উজমা। ফাবিহা পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘কী দেখছ, ভাবী?’

ফাইলের ওপরে চোখ বুলালো উজমা। তারিখ খেয়াল করল। যতদূর মনে পড়ল, স্পষ্ট হিসেব দেখে বুঝে নিল, এটা ফয়জান মুনতাসীর মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগের ফাইল। উপরে থাকা ডক্টরের নাম ও ভেতরে থাকা কিছু রিপোর্ট দেখে ভয়ানক রকমের ধাক্কা খেল। দাঁড়িয়ে থেকেই টের পেল, তার শরীর কাঁপছে। যত দেখছিল, তত বিস্ময় বাড়ছিল। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, রিপোর্টটা সত্যি। মুখে হাত চেপে, বিস্ময় দূর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মনের ভেতর কত যে প্রশ্ন জেগে উঠল, সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে লজ্জা ও ঘৃণায় চেহারায় উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেল। ফাবিহা অস্থির হয়ে জানতে চাইল,

-‘কী হয়েছে বলবে তো? তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।’

রিপোর্টে কী দেখেছে, এটা যদি ফাবিহাকে বলে, অবুঝ মেয়েটা এই সত্যি মেনে নিতে পারবে না। সে এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাতে ঝটপট ফাইলটা বন্ধ করে নিজের হাতে নিয়ে বলল,

-‘তেমন কিছু না।’

-‘তুমি এত ঘাবড়াচ্ছ কেন? কী লেখা এখানে?’

ফাবিহা ফাইল ধরতে চাইলে, উজমা সেটা সরিয়ে নিয়ে বলল,
-‘ওসব বাদ দাও। চলো আমরা ছাদে যাই।’

খুব তাড়া দেখিয়ে উজমা এবার নিজেই রুমের দরজা আটকে দিল। বাইরে এসে বলল,
-‘তুমি দু’কাপ কফি নিয়ে এসো। আমি ছাদে যাচ্ছি।’

-‘ঠিক আছে।’

ফাবিহা রান্নাঘরে গেলে দ্রুতপায়ে ছাদে দৌড় দিল উজমা। রিপোর্টটাতে আবারও চোখ বুলিয়ে ফারশাদের নম্বরে ম্যাসেজ পাঠাল,

-‘তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসো। জরুরী কথা আছে।’

***

ম্যাসেজ দিয়ে তাড়া দিলেও ফারশাদ ফিরল বিকেলের শেষদিকে। এসে লম্বা সময় নিয়ে গোসল করে, হাতে ধোঁয়াওঠা কফি নিয়ে, উজমার মুখোমুখি বসে বলল,

-‘এখন বোলো, কী জরুরী কথা।’

আলমারিতে তুলে রাখা রিপোর্টটা ফারশাদের হাতে ধরিয়ে দিল উজমা। চোখের ইশারায় জানতে চাইল, কীসের রিপোর্ট। উজমা বলল,

-‘নিজেই দেখো।’

কফি রেখে ফাইল হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলালো ফারশাদ। একবার, দু’বার, অসংখ্যবার। এরপরই চোখেমুখে ফুটে উঠল বিস্ময়, রাগ, লজ্জা। কপালে হাত চেপে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

-‘এটা কী করে সম্ভব?’

ফারশাদ রীতিমতো আতঙ্কিত এই রিপোর্ট দেখে। প্রশ্ন করে আবারও রিপোর্টে চোখ বুলালো সে। উজমা বলল,
-‘অসম্ভব কিছু না।’

-‘মায়ের বয়সটা মাথায় রেখে বোলো, অসম্ভব কিছু না।’

-‘মেনোপজের আগে যেকোনো নারীই মা হতে পারে। আই থিংক, তোমার মায়ের ব্যাপারটাও সেরকমই।’

ফারশাদের মাথায় হাত। চেহারায় ভয়। কোনোকিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। এজন্যই কি মা তবে, বাড়ি ছেড়েছেন? লজ্জা থেকে বাঁচতে! তার কাছে সবকিছু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তাছাড়া দু’জনে আলাদা থাকতেন। এটা সম্ভব হলো কীভাবে? আর যদি হয়ও, এই সন্তানের বাবা কে? ভাবতে গিয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঘৃণায় ঘুলিয়ে উঠল শরীর। বলল,

-‘বাবা-মা আলাদা থাকতেন, বাটারফ্লাই। এটা… ও গড…।’

আর্তনাদ করে উঠল ফারশাদ। উজমা পাশে বসলো। কফির কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘মাকে ফোন কোরো, এখুনি।’

-‘কেন?’

-‘বোলো, বাড়ি আসতে। নয়তো কোথায় আছেন, সেই ঠিকানা জানাতে। আমরা ওনার সাথে দেখা করব। জানতে চাইব, বাচ্চাটা এখনও আছে না-কি উনি অ্যাবরশন করিয়ে নিয়েছেন।’

-‘অসম্ভব।’

কোনোমতেই এই জঘন্য মহিলার সাথে কথা বলা সম্ভব নয়। মা বলে ডাকাও সম্ভব নয়। মুনমুন হক্ব তার মা, এসব ভাবলেই তো দুঃখে, ঘৃণায় নিজেদেরকেও তুচ্ছ ও ঘৃণিত মনে হয় তার। এটা যদি মিডিয়ায় জানাজানি হয়, লজ্জার শেষ থাকবে না। সে নতমুখেই বসে রইল। কফিও মুখে নিতে পারল না আর। উজমা বলল,

-‘আমরা জানি যে কাজটা ঠিক হয়নি, ভুল হয়েছে। পাপও। কিন্তু নিষ্পাপ ভ্রুণ, তার কথা ভাবো একবার। কী দোষ তার? কিছুই না। অথচ…। তুমি আমার কথাটা শোনো। একবার ফোন কোরো। মাকে এখানে আসার কথা বোলো।’

-‘এখানে এলে যদি লোক জানাজানি হয়? কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে না?’

ফারশাদের মনের ভেতর কী চলছে, সেটা বেশ বুঝতে পারল উজমা। কিন্তু তবুও, ওই নিষ্পাপ ভ্রুণের কথা ভেবে, ভরসার সাথে হাতটা ছুঁলো। দু’হাতের মুঠোয় আগলে নিয়ে বলল,

-‘প্লিজ… শাদ। একবার ফোন কোরো। আমরা জানি, উনি ভুল, উনি পাপ করেছেন। এই বয়সে এসে লজ্জাজনক একটা কাজ করেছেন। উনি যদি এই বাচ্চাটার জন্ম দিতে চান, চারিদিক থেকে অপমানিত হতে হবে। কিন্তু তবুও, জেনে-বুঝেই বলছি, যদি অ্যাবরশন না করে থাকেন, ওই বাচ্চাটাকে বাঁচার একটা সুযোগ দাও।’

উজমার এই যুক্তিহীন আবদার মেনে নিতে পারল না ফারশাদ। গর্জে উঠল সে। চেঁচিয়ে ঘর মাথায় তুলে ফেলল। বলল,
-‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? একটা পাপী মানুষের পাপ কাজকে সাপোর্ট করছ তুমি? কী করে? তোমার কাছ থেকে তো আমি এই ধরনের ইলজিক্যাল কথাবার্তা আশা করিনি। ওই মহিলা একটা জঘন্য মহিলা। ওনার এই কাজের দায়ভার শুধু ওনার, আমার না। আমি এই অন্যায় সাপোর্ট করতে পারব না।’

দিলারা রওশন ও কারিমা রওশন সেই আওয়াজে ছুটে এলেন তাদের রুমের দরজায়। দাম্পত্য জীবনের শুরু হয়েছে, দু’দিন হয়নি, এরমধ্যেই ঝগড়াঝাটি দেখে দু’জনেই হতবাক। উজমা জানে, কাজটা ভুল, অন্যায়। কিন্তু ওই ভ্রুণ…। ওটার তো কোনো দোষ নেই। একটা পাপী মানুষের জন্য, সে কেন ভুগবে? নিষ্পাপ ভ্রুণের জন্য তার মায়া হচ্ছে, এটা সে কীভাবে বোঝাবে? ধমক খেয়েও কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য করল না উজমা। ঠোঁট কামড়ে ভেবে গেল, কীভাবে কী করবে। দিলারা রওশন রুমে এসে জানতে চাইলেন,

-‘চিৎকার করছিস কেন, শাদ? কী হয়েছে?’

মুখ লুকালেই বাঁচে, এরকম একটা ভাব দেখিয়ে বারান্দায় চলে গেল ফারশাদ। দুই ফুপি উজমার কাছে ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে উজমা বলল,

-‘কিছু হয়নি, ফুপি। মনে হয় মাথা ধরেছে। একটুপর ঠিক হয়ে যাবে। আপনারা যান, বিশ্রাম নিন। আমি দেখছি।’

ওনারা রুম ছাড়লে, খুব সাবধানে দরজা আটকে দিল উজমা। রিপোর্টটা আলমারিতে তুলে রাখল। বেলকনিতে গিয়ে ফারশাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেজাজের ওঠা-নামা আঁচ করে বলল,

-‘যার ওপর মেজাজ, তাকে মেজাজটা দেখাও। আমাকে কেন দেখাচ্ছ? আমি তো চাইলেই পারি এখন, রাগ দেখিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিতে। কিন্তু আমি সেটা করতে চাইছি না।’

ফারশাদ বুঝল, ভুল সময়ে, ভুল মানুষের ওপর মেজাজ দেখিয়ে ফেলেছে। উজমা ওপর চোটপাট করার, তাকে আঘাত করার ইচ্ছে নেই তার। এই মেয়েটাকে আঘাত দেয়া মানে তো, নিজেকেই ক্ষতবিক্ষত করা। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে হাত বাড়িয়ে অর্ধাঙ্গিনীকে আগলে নিয়ে বলল,

-‘স্যরি…।’

-‘এই ব্যাপারটা কিন্তু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেতে পারত, যদি আমি অভিমান দেখাতাম। তখন এই অভিমান ভাঙাতে তোমাকেই অনেক কষ্ট করতে হতো। কেন করিনি জানো?’

দু’হাতের আঁজলায় মায়াবী মুখখানি মুঠোবন্দী করে, কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফারশাদ জানতে চাইল,
-‘কেন?’

-‘একটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, দু’জনকেই কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সম্পর্কে ঝগড়াঝাটি, কথা কাটাকাটি, রাগ-অভিমান হবেই, এক্ষেত্রে একজন কঠিন হলে, অন্যজনকে নরম হতেই হয়। নয়তো, ইগোর চাপে পড়ে সম্পর্কটাই ভেঙে যায়। আমি চাই না, একটা সামান্য ভুল ও তুচ্ছ অভিমান তোমার আর আমার সম্পর্ক ভাঙনের কারণ হোক।’

এই ভুল আর কভু না হোক, এই বলে নিজেই নিজের মনকে সাবধানবাণী শুনালো ফারশাদ। আলগোছে প্রিয়তমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে, নাকের ডগায় চুমু এঁকে বলল,

-‘যদি কখনও এরকম পরিস্থিতি তৈরী হয়, সামলে নিও প্লিজ। প্রয়োজনে একটু বকে দিও, শাসন কোরো, তবু ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে হারাতে চাই না, বাটারফ্লাই। কোনোভাবেই হারাতে চাই না।’

রাগ-অভিমানের অধ্যায়টা আপাতত দূরে সরিয়ে রাখল উজমা। মুনমুন হক্বের ব্যাপারটা নিয়ে কী ভাবছে, এটা জানতে চেয়ে বলল,

-‘মাকে নিয়ে কী ভাবলে? কী করবে?’

ফারশাদ একটু সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে উত্তর দিল,
-‘আমি ফোন করব। রিসেপশনে আসতে বলব। যদি আসেন, তখন এই বিষয় নিয়ে কথা বলব। এখন ওইসব অপ্রয়োজনীয় চ্যাপ্টার তুলে রেখে, আমাকে পড়ো। দেখো তো, চোখ দিয়ে মনের ভাষা বুঝতে পারো কি-না।’

***

চলবে…