মেঘের খামে উড়োচিঠি পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
73

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
শেষপর্ব (প্রথমাংশ)

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

রিসেপশনের পরবর্তী সপ্তাহে নিজেদের পরিচিত অ্যাডভোকেট জাবির হাসানকে বাড়িতে আসার অনুরোধ করেছিল ফারশাদ। আজ তিনি এসেছেন। ফয়জান মুনতাসীর মারা যাওয়ার পর এই বাড়িতে এটাই প্রথম আসা তার। তিনি এসে খোশমেজাজে ড্রয়িংরুমে বসে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা চালিয়ে গেলেন। কারিমা রওশন চা-নাশতা নিয়ে এসে নিজেও আলোচনায় যোগ দেন। সবশেষে দিলারা রওশন ও ফাবিহা উপস্থিত হলে ফারশাদ বলল,

-‘আংকেল আপনাকে যে কারণে আসতে বলেছিলাম – আমরা প্রত্যেকেই চাইছি, বাবা যেটুকু সম্পত্তি, ব্যাংক-ব্যালেন্স আমার নামে দলিল করিয়ে রেখেছিলেন, সবকিছু মায়ের নামে ট্রান্সফার করে দিতে। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন, নতুনভাবে কাগজপত্র তৈরী করুন।’

সব সম্পত্তি মানে তো অনেককিছু। এইভাবে কেউ নিজের জায়গা-সম্পত্তি হাতছাড়া করে? তিনি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,

-‘কেন বাবা? হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ কেন?’

ফারশাদ সোজাসাপটা বলল,
-‘আংকেল আমি তো এখানে থাকব না। মাসে কিংবা বছরে একবারও আসতে পারব না। অযথা এত জায়গা-জমি দিয়ে কী করব? কে দেখবে? তারচেয়ে মায়ের নামে থাকলে, মা নিজে এসবের দেখাশোনার জন্য লোক রাখতে পারবেন।’

-‘আর ফুপি ও দুইবোনের অংশ?’

-‘আমাদের সবারই একই ইচ্ছে। সবকিছুই মায়ের নামে হবে।’

উত্তর জানতে জাবির হাসান দু’জনের দিকে তাকালে দিলারা রওশন বললেন,
-‘জি, ভাই। শাদ ঠিক বলছে। আমরা কেউ-ই বাবার বাড়ির সম্পত্তিতে অংশীদারত্ব চাই না।’

তিনি নির্বিঘ্নে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
-‘শুনলাম তুমি না-কি তোমার বাবার পজিশনে যাবে। জনগণকে হ্যান্ডেল করতে পারবে তো?’

গত কয়েকদিন ধরেই মিডিয়াতে কিছু গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে লোকজন। কে এসব করছে, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়, তবুও ফারশাদ নিশ্চিত এসব তার মায়ের কাজ। ছেলের জীবনের শান্তি কেড়ে নেওয়াই তার প্রধান লক্ষ্য এখন। তাই তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন, ঠিক কী কী ভাবে ছেলেকে অপদস্ত ও হয়রানি করা যায়। ফারশাদ ভেবেছিল, ঢাকায় যাওয়ার পর এই নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তটা স্পষ্ট জানাবে। তা-ই এখন অবধি নিজের অফিশিয়াল পেইজ থেকে কিছুই সে জানায়নি। জাবির হাসান যেহেতু তাদের কাছের লোক, তাই তার কাছে নিজের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিয়ে বলল,

-‘সেরকম কিছু আমি ভাবিনী, আংকেল। এই বিষয়ে কখনও কোনো নিশ্চয়তাও দিইনি। আমি যা করছি, সেটাই তো আমার জন্য যথেষ্ট। বাবার নাম বিক্রি করে এই উপজেলা চেয়ারম্যানই পদ, জনসেবা, এগুলো আমাকে দিয়ে হবে না, আমি এসব করতে চাই না। যা করব, যতটা করব, সবটা নিজের যোগ্যতা দিয়ে করব, ইনশা’আল্লাহ।’

-‘তুমি যদি সিদ্ধান্ত না জানাও, তাহলে জনগণের মুখে এসব কেন?’

-‘কেউ যদি ইচ্ছে করে বিভ্রান্তি ছড়ায় আমি কি করতে পারি? তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন, বেঁচে থাকতে আমি এই ধরনের কোনো প্রফেশনে জড়াব না। আমার যা প্রফেশন আমি সেটাই করব।’

-‘ঠিক আছে, আমি কাগজপত্র গুছিয়ে একদিন আসব, তোমরা সাইন করে দিও।’

-‘আংকেল, আমি আজই ঢাকায় চলে যাব। এরপর আর এখানে আসব না। আমার মিরপুরের অ্যাড্রেসে আপনি সবগুলো পেপার পার্সেল করে দিলে ভালো হয়।’

মিরপুরেই কাগজ পাঠিয়ে দিবেন বলে জাবির হাসান বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কারিমা রওশন বললেন,
-‘তুই কি একেবারে ঘর ছাড়তে চাইছিস? আমাদের জন্যও আসবি না?’

আহ্লাদী হয়ে ছোটো ফুপিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে কণ্ঠে কৌতুক ধরে রেখে ফারশাদ বলল,
-‘তোমাদের জন্য? হমম, ভেবে দেখব।’

-‘তুই এতটাও পর হতে পারবি? আমাদের রক্ত কিন্তু এক। রক্তের সাথে বিচ্ছেদ টানার মতো সাহস তোর আছে?’

-‘নেই বলছ?’

-‘একফোঁটাও নেই।’

মুচকি হেসে কারিমা রওশনের একটা হাত নিজের গালে ঠেকাল ফারশাদ। আলতোস্পর্শে চুমু খেয়ে বলল,
-‘ঠিকই বলেছ। রক্তের সাথে বিচ্ছেদ টানার মতো সাহস আমার নেই। এই জীবনে পারবও না। মন খারাপ কোরো না, যখন আমাদের দেখতে ইচ্ছে হবে, ঢাকায় চলে যাবে। যদি সেটা না পারো, আমাকে ফোন কোরো। সময় পেলে আমি-ই ছুটে আসব।’

কারিমা রওশন আবেগী হয়ে পড়লেন। চোখেমুখে অশ্রু দেখা দিল। তিনি ম্লানমুখে বললেন,
-‘ভাই-ভাবীর ওপর অভিমান থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। অথচ এই বাড়িতে যা কিছু আছে, সবটাই তোর। নিজের সম্পদকে এইভাবে হাতছাড়া করছিস কেন?’

নতমুখী হয়ে ফারশাদ বলল,
-‘এগুলো দিয়ে কী হবে, ফুপি? প্রয়োজনের সময় বাবা-মাকে কাছে পাইনি। কোনো কাজে তাদের সাপোর্ট পাইনি। আদর-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, এসব থেকেও বঞ্চিত ছিলাম। ধন-সম্পদ প্রয়োজন কিন্তু বাবা-মায়ের ভালোবাসার চেয়ে বেশি নয়। অথচ আমাদের জীবনে এটারই অভাব থেকে গেল সারাজীবন। আফসোস, কোনোদিন এই অভাবটা দূর হবে না। জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেলেও এই একটা অভাব আমাকে ভীষণ পীড়া দিবে।’

***

নতুন শহরে পা রেখে জীবনের নতুন অধ্যায়টাকে খুব করে আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় এখন উজমা। ধারণা করেছিল, রংপুরে মুনমুন তাকে দেখলে পুরনো কথা তুলে অপমান করতে পারেন, কিন্তু ফারশাদের কারণে কোনোভাবেই তিনি তাকে অপমান কেন, সামান্য কটু কথা বলেও নিস্তার পাননি। মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস বের হয় এইভেবে যে, বাবা-মায়ের সাথে সন্তানদের আচরণ ও সন্তানদের সাথে বাবা-মায়ের আচরণ সবসময় কোমল হওয়া উচিত, অথচ এই তিন ভাই-বোনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টো। হাবিজাবি সব ভাবনা নিয়ে জানালায় দৃষ্টি দিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের দিকে দৃষ্টি দিয়ে গভীর করে শ্বাস টানলো সে। মুনমুন হক্বের চ্যাপ্টার তাদের জীবনে নেই আপাতত। না আসুক, এইটুকুই চাওয়া। জীবনের বাকিটা দিন, এখানেই কেটে যাক, এরকম একটা সুপ্ত বাসনা মনে উঁকি দিল তার। ঘুরে-ঘুরে সবকিছু দেখল। লাগেজে রাখা চিঠির ফ্রেমটা বের করে দেয়ালের একটা জায়গায় সেট করার চেষ্টা করল। ফারশাদ রুমে আসতেই বলল,

-‘এটা বেডরুমের দেয়ালে থাকলে খারাপ দেখাবে? বাইরের কেউ দেখবে না তো?’

অনুভূতির এই গভীর প্রকাশ আর কারও চোখে পড়ুক, চাইল না উজমা। এজন্যই জানতে চাইল। ফারশাদ বলল,

-‘বেডরুমে কেউ আসে না। নিজেদের লোক ছাড়া এখানে বাড়তি কেউ নেই। যে আছে, সে তোমার ননদ। অনুমতি না দিলে জীবনেও এই রুমে পা রাখবে না।’

-‘আচ্ছা, তাহলে এখানেই রাখি।’

ফারশাদ এই কাজে বাঁধা দিয়ে বলল,
-‘এগুলো পড়ে হবে। আগে বোলো, ঢাকার কোন কোন জায়গায় ঘোরাঘুরি বাকি তোমার? যতদিন ফ্রি আছি, ঘোরাঘুরি চলবে। চাইলে তোমার বন্ধুদের ডেকে নিতে পারো। এরপর তোমার পাসপোর্টের কাজ এগিয়ে নেব। কারণ, মাস তিনেক পর জিম্বাবুয়ে সফরে যেতে হবে। আমি চাইছি, বিয়ের পর তোমাকে সাথে নিয়ে দেশের বাইরে পা রাখি। আর ফিরে এসে রিল্যাক্সমুডে হানিমুনে যাব। হবে না?’

নিজের পাসপোর্ট নেই এটা তো খেয়ালই করেনি উজমা। কখনও প্রয়োজন হয়নি বলে পাসপোর্ট তৈরী করেনি। তবে সব কথার ভিড়ে হানিমুনের কথা শোনেই লজ্জা পেয়ে গেল। কথা এড়িয়ে যেতে বলল,

-‘ঢাকায় ঘোরাঘুরির মতো কী কী আছে?’

-‘অনেককিছু।’

-‘সবাইকে আসতে বলব?’

-‘অবশ্যই বলবে।’

-‘কবে?’

-‘যেকোনোদিন।’

-‘আচ্ছা, এটা দেয়ালে রাখো। আমি টেবিলে খাবার সাজাই।’

জার্নি করে এতদূর এসে সবাই-ই ক্লান্ত ভীষণ। রাত দশটা এখন। নতুনভাবে কিছু রান্না করার সময়-সুযোগ নেই। ক্লান্ত শরীরের বিশ্রাম দরকার। তা-ই রাতের খাবার অনলাইনেই অর্ডার করেছে ফারশাদ। কিছুক্ষণ আগেই ডেলিভারিম্যান খাবার দিয়ে গেছে। ফাবিহা একা হাতে সবকিছু গোছাচ্ছিল। উজমা এসে বলল,

-‘কী ব্যাপার ননদিনী, আমাকে ডাকোনি যে?’

ফাবিহা একটু হেসে বলল,
-‘তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, এজন্য ডাকিনি।’

দু’জনে মিলে ঝটপট হাতে খাবার সাজিয়ে নিল টেবিলে। একসাথেই খেতে বসলো। ফাবিহাকে আজ ভীষণ আনন্দিত মনে হচ্ছে। তার চেহারার উজ্জ্বলতা বলে দিচ্ছে, মনে কোনোরকম চাপ নেই। সে হাসিখুশি মন নিয়ে বলল,

-‘আমার চাওয়াটা এভাবে পূরণ হয়ে যাবে ভাবিনী।’

ফাবিহার কথা ফারশাদ বুঝতে পারলেও উজমা বুঝল না। দুই ভাই-বোনের মুখের হাসি দেখে জানতে চাইল,
-‘কী চেয়েছিলে তুমি?’

-‘ভাইয়া নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার আগে তোমার কথা শেয়ার করেছিল। তোমার ছবিও দেখিয়েছিল। তখন আমি খুব করে চাইছিলাম, তুমি এই বাড়ির একজন হয়ে আসো। অবশেষে, তুমি এলে। বিশ্বাস কোরো আজ আমি ভীষণ খুশি।’

একটুখানি হেসে কটমটে চোখে ফারশাদের দিকে তাকিয়ে রইল উজমা। সন্দিহান আচরণ তার মাঝে। কিছুটা বিস্ময়ও লুকিয়ে আছে চেহারায়। হুটহাট এই রাগের কারণ বুঝতে পারল না ফারশাদ। হাতের ইশারায় জানতে চাইল,

-‘এভাবে তাকাচ্ছ কেন?’

-‘তুমি আমার ছবি কোথায় পেয়েছ?’

ফোন হাতে নিয়ে মাঝখানে টাচ্ করে সেদিনের তোলা ছবিটা উজমার সামনে রেখে বলল,
-‘এটাই দেখিয়েছি।’

ছোট্ট মাশিয়াতের সাথে নিজের এই আবেগপ্রবণ ছবি ফোনের ওয়ালপেপারে দেখে খুব বেশিই অবাক হলো উজমা। বলল,
-‘তুমি লুকিয়ে আমার ছবি তুলেছিলে? এটা কিন্তু ঠিক হয়নি।’

-‘জানি, ঠিক হয়নি। কিন্তু তবুও, এরকম একটা দৃশ্য নিজের কাছে আগলে রাখার ইচ্ছে থেকেই এই কাজটা করেছি। ছবি কিন্তু আমি তুলিনি, ফারিণ তুলেছে। যখন তুমি প্রত্যাখান করলে, তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এই একটা ছবি নিয়েই বাকিজীবন কাটিয়ে দেব। তোমাকে পাব না নিশ্চিত, তাই একজীবনের যত তৃষ্ণা জমত, সব এই ছবি দেখেই মিটিয়ে নিতাম।’

উজমা আর কিছু জানতে চাইল না, চুপ করে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। ফারশাদ তাকে ভালোবাসে জানত, অনুভব করে জানত, কিন্তু এত অভিমান নিয়ে অনুভব করত, এটা জানত না। অন্য কেউ হলে অনুমতি ছাড়া ছবি তোলার জন্য বকে দিত, নিজের মানুষ বলে রক্ষা পেয়ে গেল। দু’জনের কেউ আর কোনো কথা বলল না। কে জানে, ছোটো বোনের সামনে নিজেদের অনুভূতি নিয়ে আর কিছু বলা অনুচিত ভেবেই হয়তো চুপ রইল দু’জনে। নীরবতা দেখে ঝটপট নিজের খাওয়া শেষ করল ফাবিহা। দু’জনকে পর্যাপ্ত স্পেস দিয়ে চলে গেল রুমে। চেয়ার টেনে উজমার পাশাপাশি ঘেঁষে বসলো ফারশাদ। যত্ন করে মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলে নিঃশব্দে সেই খাবার খেয়ে নিল উজমা। এক হাতে খাওয়াল, অন্য হাতে আগলে নিয়ে মাথার তালুতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

-‘তোমাকে অনুভব করার জন্য শুধু একটা ছবিই যথেষ্ট নয়, বাটারফ্লাই। তোমার সাথে কাটানো সুখ-দুঃখের প্রতিটা মুহূর্ত আমি হৃদয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি। যেগুলো কোনোদিন মুছে ফেলার নয়। এই ফোনে থাকা ছবি হয়তো ভুলবশত ডিলেট হয়ে যাবে, গ্যালারি থেকে হারিয়ে যাবে। কিন্তু হৃদয় থেকে কীভাবে মুছবে? পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজে আঁকা ছবি মুছে ফেলার ইরেজার আছে, কিন্তু হৃদয়ের ক্যানভাসে তোমার যে ছবি আমি এঁকেছি, সেটা মুছে ফেলার মতো ইরেজার এই পৃথিবীর কোথাও সৃষ্টি হয়নি। হবেও না কোনোদিন। হৃদয়টা তো অদৃশ্যে। অদৃশ্যে থাকা ছবিও অদৃশ্য। অদৃশ্যে থাকা যা কিছু আছে, সবকিছু শুধু অনুভব করা যায়, মুছে ফেলা যায় না। তোমাকেও মুছে ফেলতে পারব না। রবের নিকট আমি শুধু ইহকালের জন্য তোমাকে চাইনি, পরকালের জন্যও চেয়েছি। প্রতিটি প্রার্থনায় শুধু এইটুকুই চাই, পরকালেও আমরা যেন একসাথে থাকি। যাকে আমি প্রতি মোনাজাতে পরকালের জন্যও চাই, তাকে হৃদয় থেকে মুছে ফেলা সম্ভব?’

***

পরবর্তী সপ্তাহ থেকে দলবেঁধে ঘোরাঘুরি শুরু হলো সবার। একেকদিন একেক জায়গায়। কখনও পার্কে, কখনও জাদুঘরে, কখনও চিড়িয়াখানায়, কখনও খেলার মাঠে। এভাবে মিরপুরে যত দর্শনীয় স্থান ছিল, কিছুই বাকি রাখেনি ওরা। জোড়া বেঁধে ঘুরেছে। দম্পতি ও প্রেমিকদের ঘোরাঘুরির জন্য বেড়িবাঁধ উপযুক্ত একটা জায়গা। আজ সবাই এখানেই এসেছে। খোলা আকাশের নিচে থাকা টলটলে পানির বুক ছিঁড়ে ভেসে চলা নৌকায় পা দুলিয়ে বসেছে উজমা। অন্যরাও নদীর পানিতে হাত ডুবিয়ে, পা ডুবিয়ে সময়টাকে মুঠোবন্দী করার চেষ্টায় ব্যস্ত। এর আগে অনেক জায়গায় ট্যুর দিয়েছে সবাই, কাপল ও সিঙ্গেল হয়ে। প্রত্যেকটা ট্যুর সুন্দর ও স্মরণীয় হলেও জোড়াবেঁধে ট্যুর দেয়ার আনন্দটা অন্যরকম। বন্ধুদের কেউ আর একা নয়, সবারই নিজের মানুষ আছে, এটাই সবচেয়ে আনন্দের বিষয় সবার জন্য। সবাই যখন নানানভাবে ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন ফারশাদকে উদ্দেশ্য করে তাক্বদীম বলল,

-‘এই ট্যুরটার জন্য তোমার কিন্তু বড়োসড়ো একটা থ্যাংকস প্রাপ্য।’

ফারশাদ হেসে বলল,
-‘তোমাদের সবাইকে একসাথে পেয়েছি, এটাই আমার জন্য বিরাট সৌভাগ্যের। সবচেয়ে বড়ো কথা, এরজন্য তোমাদের বন্ধুর মুখে হাসি ফুটেছে। তার হাসির জন্য আমি আরও অসংখ্যবার এমন ট্যুর দিতে রাজি আছি। তোমরা শুধু সময় করে চলে এসো, বাকি যা কিছু আছে সব আমি সামলে নেব।’

কথার মাঝখানে অনিক বলল,
-‘সবকিছু তুমি একা করবে কেন? আমাদেরকেও কিছু করার সুযোগ দিও। এরপর থেকে যত ট্যুর হবে সবকিছুতে আমরা চারজন জড়িত থাকব।’

কাইফ, তাক্বদীম, নিজে ও ফারশাদকে একত্রিত করে বলল অনিক। সবাই-ই সম্মতি জানাল। কাইফ বলল,
-‘ঠিকই তো। তুমি একা সবকিছু সামলাবে, এটা কেমন দেখায়? নিজেদেরকে স্বার্থপর স্বার্থপর মনে হয়। এ পর্যন্ত আমরা যা করেছি, সবকিছুতেই সবাই জড়িয়ে ছিলাম। যদি সম্ভব হয়, বাকিজীবন তা-ই থাকব।’

ফারশাদ মুগ্ধ হয়ে বলল,
-‘তোমাদের বন্ধুত্বটা খুবই সুন্দর, বিশ্বস্ত ও ভরসার। আমি খুব ভাগ্যবান যে, তোমাদের একজন হতে পেরেছি।’

নৌকার মাঝি খুবই অবাক হয়ে দাঁড় টানছিল আর ওদের কথা শুনছিল। সে খুব অবাক হচ্ছে, কিছু সাধারণ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ক্রিকেটার ফারশাদ মুনতাসীরকে দেখে। আজ ফারশাদ মাস্ক ব্যবহার করেনি, তা-ই তার চেহারা উন্মুক্ত। মাঝি নিজেও ক্রিকেট খেলার ভক্ত। এই কারণে নামী-দামী এই খেলোয়াড়কে চিনতে ভুল হয়নি তার। সে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকে সুন্দর এই দৃশ্য দেখছে, মনে মনে হাসছেও। অনেকক্ষণ দাঁড় টেনে নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে সবাইকে একটা নিরাপদ জায়গায় নামিয়ে দিল। একেকজন খুব ভরসা ও বিশ্বস্ততার সাথে সঙ্গিনীকে নৌকা থেকে পাড়ে নামতে সাহায্য করল। ফারশাদ মাঝির দিকে টাকা বাড়িয়ে দিলে মাঝি আমতা-আমতা স্বরে বললেন,

-‘টাকা লাগব না, ভাইসাব।’

-‘কেন ভাই?’

গামছা হাতে নিজের গাল চুলকে নিল মাঝি। লাজুক মুখে বলল,
-‘ওইযে, কী বলে, হাতে আর খাতার মইধ্যে লেইখা দেয়। টিভিতে দেখছিলাম, হেইটা দ্যান।’

ফারশাদ অবাক হলেও হেসে ফেলল মাঝির কথা বলার ধরনে। নিশ্চিত হতে বলল,
-‘আপনি কি অটোগ্রাফ চাইছেন?’

মাঝি ঘাড় নাড়লে পকেট থেকে কলম বের করল ফারশাদ। জানতে চাইল,
-‘কোথায় দেব?’

কাগজ নেই সাথে, মাঝি বড্ড লজ্জায় পড়ল। হাত দিতে চেয়েও সরিয়ে নিল। হাতের লেখা মুছে যাবে। সে চায় নামকরা এই খেলোয়াড়ের অটোগ্রাফ সারাজীবন তার সাথে থাকুক। কোনোকিছু না পেয়ে হাতের গামছা দেখিয়ে বলল,

-‘এইটাতে দিয়া দ্যান।’

-‘হাতে দিলে সমস্যা?’

-‘পানি লাগলেই মুইছা যাইব না?’

-‘হ্যাঁ, মুছে যাবে।’

কাপড়ে লেখা কষ্ট তবুও গামছার কোণায় বড়ো বড়ো অক্ষর দিয়ে নিজের সম্পূর্ণ নাম, তারিখ ও বাংলাদেশের টিমের সহঅধিনায়ক এইটুকু লিখে গামছাটা মাঝির গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘ভালো থাকবেন।’

এরপর পকেট থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ড বের করে, মাঝির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘এটা রাখুন। যদি কোনোদিন মনে হয়, আমাকে আপনার দরকার। ফোন করবেন। অথবা এই ঠিকানায় চলে আসবেন। আপনার যেকোনো প্রয়োজনে পাশে থাকব, ইনশা’আল্লাহ।’

এরপর ওরা হাঁটতে হাঁটতে ফুচকার দোকানে এসে আড্ডা জমালো। সন্ধ্যে হওয়ার আগমুহূর্তে নদীর এই পাড়ের সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ প্রকাশ পেল। আলো-আঁধারীর মায়ায় ডুবে-ভেসে সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে প্রথমদিনের মতোই মুগ্ধ হলো ফারশাদ। চোখে চোখ পড়লে সকলের অগোচরে ‘ফ্লায়িং কিস’ ছুঁড়ে দিল। উজমা চোখ পাকিয়ে তাকালে ফারশাদ আবেশজড়ানো কণ্ঠে গানের লিরিক শুনিয়ে মনের কথা বুঝিয়ে দিতে সুরে সুরে গাইল,

হও যদি তুমি নীল আকাশ,
আমি মেঘ হব আকাশে।
হও যদি অথৈ সাগর,
আমি ঢেউ হব সাগরে।
হও যদি ওই হিমালয়,
তোমাকে করব আমি জয়।
তোমাকে, চাই তোমাকে..
তুমি যে আর কারও নও।

বলতে পারি আমি নির্ভয়ে,
তুমি আছ হৃদয়ে…
বলতে পারি আমি নির্ভয়ে,
তুমি আছ হৃদয়ে…।

***

চলবে…

#মেঘের_খামে_উড়োচিঠি
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
শেষপর্ব (দ্বিতীয়াংশ)

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

ঋতু বদলের মৌসুমে প্রকৃতি অন্য এক রঙে, রূপে, সৌন্দর্যে সুসজ্জিত হয়ে উঠে। শীত, বসন্ত পেরিয়ে ঋতু এখন গ্রীষ্মে পা রেখেছে। বাইরে কড়ারোদ্দুরে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে। আকাশের কিনারে কালবৈশাখী মেঘ জমতে দেখা যায়। কখনও কখনও শিলাবৃষ্টি ঝরে উত্তপ্ত প্রকৃতিকে শীতলতায় ভরিয়ে তুলে। এই সময়ে একটু অসতর্কতার কারণেই অসুস্থতা এসে ভর করে শরীরে। কনকনে শীতে যে মেয়ে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে, সোয়েটার ছাড়া রাত-দিন সামাল দিতে পারে, প্রচণ্ড গরমের কারণে সেই মেয়ে বিদ্রুপ আবহাওয়ার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। ক’দিন ধরে শারিরীক দুর্বলতা, অসুস্থতায় দিন কাটছে উজমার। বুঝতেই পারছে না হুট করে আকাশ-পাতাল জ্বর কেন আসছে তার। রাত হলে জ্বরটা ঝেঁকে বসছে, একেবারে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে, আর দিন হলে পালিয়ে যাচ্ছে। আজ সকাল থেকে একটু হালকা লাগছিল দেখে সকালের চা-নাশতা তৈরী করেছে নিজেই। দুপুরের খাবার কী রাঁধবে সেটা ভাবতে ভাবতে রান্নাঘর গোছাচ্ছিল। বাইরে যাওয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ফারশাদ রান্নাঘরে এসে উজমার পাশে দাঁড়িয়ে গালে, কপালে ও গলায় হাত ছুঁইয়ে জ্বর চেক করে বলল,

-‘তুমি বড্ড হেয়ালি করছ, বাটারফ্লাই। আমি জানি, টেস্টের কারণে তোমাকে সময় দিতে পারছি না। প্লিজ, আমার কথা রাখো। একবার ডাক্তার দেখিয়ে আসো। এটাকে আমার সাধারণ জ্বর মনে হচ্ছে না।’

যেদিন থেকে মিরপুরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে বাংলাদেশের টেস্ট খেলা শুরু হলো, সেদিন থেকেই দুর্বলতা, অসুস্থতা দেখা দিল উজমার শরীরে। যদিও সে চেপে গেছে সবকিছু। ভেবেছে সাধারণ জ্বর সেরে যাবে দু’একদিনে। কিন্তু এখন তার নিজেরই মনে হচ্ছে, এটা সাধারণ জ্বর নয়। সে দুর্বল শরীর নিয়ে ফারশাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-‘তুমি খামোখা চিন্তা করছ। এটা এত কঠিন কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।’

ফারশাদ না শুনলো না। কঠিন গলায় বলল,
-‘আজই ডাক্তার দেখাবে, এটা আমার আদেশ। না মানলে কঠিন শাস্তি দেব তোমায়।’

-‘আজ সম্ভব হবে না। এখন আমি তোমার সাথে যাব।’

-‘তুমি ডাক্তার দেখাবে না?’

-‘আজ না প্লিজ।’

অনুরোধের সুরে বলে আদুরে আবদার বাড়িয়ে দিল উজমা। ফারশাদ ঝটপট একটা হিসেব করে বলল,
-‘আজই। খেলা শেষে আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। না শুনব না। ইদানীং তুমি খুববেশি ফাঁকিবাজি শুরু করেছ।’

রান্নাঘরের জানালার ফাঁক গলে সূর্যের তীর্যক রশ্মি সারাঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু আলো উজমার চোখেমুখেও পড়েছে। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিন্তিতমনে সরাসরি সূর্যের দিকে উজমার চেহারা নিয়ে আঁৎকে উঠে ফারশাদ বলল,

-‘তোমার জন্ডিস হয়েছে বোধহয়। বমি হয়েছিল?’

গা কাঁপিয়ে জ্বর আসা, বমি, খাবারে অরুচি, মাঝেমধ্যে পেট ব্যথা, যা কিছু লক্ষ্মণ সবটাই ছিল অল্পস্বল্প। কিন্তু ফারশাদের ব্যস্ততার কথা ভেবে এতকিছু চেপে গেছে উজমা। মাঝখানে কয়েকদিন বিজ্ঞাপনের শুটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল আর এখন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত। সাধারণ জ্বর ভেবে মাথা ঘামায়নি এতটা। এখনও খুব একটা গায়ে মাখলো না। বলল,

-‘কী ডাক্তারের মতো টর্চার শুরু করলে? আমি এখন সুস্থ আছি। জ্বর নেই একদম।’

জ্বর নেই সেটা ফারশাদ নিজেও দেখেছে। কিন্তু যেকোনো সাধারণ অসুস্থতা হলেও এসবকে এত সহজভাবে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। রোগ বাড়তে বেশিক্ষণ লাগে না। সুযোগ পেলেই হলো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, খেলা শেষ হলেই আজ সন্ধ্যায় উজমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেই। সে জোরাজুরি না করলে এই মেয়েটা সবকিছুকে সাধারণ অসুস্থতা ভেবে বসে থাকবে। বাইরে বের হলে এই উছিলায় ডাক্তার দেখানো যাবে। এরকম একটা চিন্তাভাবনা সাজিয়ে ফারশাদ বলল,

-‘ঠিক আছে, তুমিও চলো।’

যেহেতু গরমের সময়, মাঠে তুলনামূলক বেশি রোদ থাকবে। মনে করে ছাতা, পানি ও প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধ একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল ফারশাদ। উজমা চেয়ে চেয়ে সবকিছু দেখে বলল,

-‘তুমি অকারণ চিন্তা করছ। আমি এতটাও অসুস্থ নই।’

আলতোহাতে উজমার নাকের ডগায় আঙুল ছুঁইয়ে ফারশাদ বলল,
-‘মানুষটা তুমি বলেই চিন্তা একটু বেশি, বুঝেছ?’

***

টেস্ট খেলা হলেও গ্যালারিতে দর্শকদের উপচেপড়া ভিড়। এই প্রথম সরাসরি খেলা দেখতে, খেলার মাঠে প্রবেশ করল উজমা। ফাবিহাকে সাথে নিয়ে দর্শকসারিতে বসলো। দু’জনের হাতে পপকর্ণ। খেলা শুরু হয়েছে ধীরেধীরে। দু’দিন আগে দুই দলের দুই ক্যাপ্টেনের মাধ্যমে টস দিলে, টসে হেরে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। এখনও সেটা চলছে। সাদা পোশাকে সবাইকে কী সুন্দর লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে, সবুজের বুক ছিঁড়ে একঝাঁক সাদা বকপক্ষীর ছোটাছুটি চলছে। দূর থেকে দেখলেও চোখে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করল উজমা। পপকর্ণ মুখে নিতে নিতে একধ্যানে তাকিয়ে রইল প্রিয়জনের দিকে। চোখের কোণে, ঠোঁটের কোণে মুগ্ধতার হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার। তা দেখে ফাবিহা পাশে থেকে বলল,

-‘ফিলিংস কেমন?’

উজমা প্রশস্তচিত্তে হেসে বলল,
-‘বোঝাতে পারব না।’

একঘণ্টা ধরে খেলা চলছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের রানরেট মোটামুটি ভালোই বলা যায়। যেহেতু টেস্ট, ধীরেধীরে খেলা হবে, টানা কয়েকদিন ধরে চলবে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সূর্যের তেজ ক্রমাগত বাড়ছিল। বিরক্ত ফাবিহা চোখে সানগ্লাস দিয়ে উজমাকে বলল,

-‘এত রোদের মধ্যে খেলা যায়? আমারই তো শরীর জ্বলে যাচ্ছে।’

উপরনিচ মাথা নাড়লো উজমা। কাঠফাটা রোদে ব্যাট-বল নিয়ে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করা খেলোয়াড়দের জন্য কষ্টই। যদিও তারা এসবে অভ্যস্ত কিন্তু উত্তপ্ত পরিবেশ ও প্রিয়জনের কুঁচকে থাকা চেহারা দেখে ভীষণ খারাপ লাগল উজমার। বলল,

-‘রোদ কম হোক কি বেশি, খেলতে তো হবেই। আমি যদি কোচ হতাম, আজকের খেলা বাতিল করে দিতাম। দেখো তো, কারও মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।’

ফাবিহা খেয়াল করে দেখল মাঠের মধ্যে কড়ারোদ। এত রোদ যে চোখমুখ জ্বলসে যাওয়ার উপক্রম। একেকজনের শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার তবুও সবাই কী দারুণ সাহসিকতার সাথে প্রিয় দেশকে জেতানোর জন্য বিপরীত দলের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। বোলার ছুটে ছুটে বল করছে, সেই বলে ব্যাট ছুঁইয়ে চার-ছয় মারছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়। একটা সময় ব্যাট বলে ছোঁয়ার পরপর সেটা এত উপরে উঠল যে, উড়ে উড়ে বলটা ফারশাদের সোজাসুজি এসে নিচের দিকে নামছিল। বলটা লুফে নেওয়ার জন্য দুটো হাত মাত্রই বাড়িয়েছিল ফারশাদ, কিন্তু দুর্ভাগ্য সূর্যের মাত্রাতিরিক্ত তেজ ও আলোর ঝলকানি সরাসরি পড়ে গেল তার চোখে। দু’চোখে রাতের আকাশে জ্বলে ওঠা তারার মতোই ঝিকমিক ঝিকমিক দেখল সে। ঠাহর করে হাত বাড়িয়ে বল লুফে নেওয়ার আগেই সেই বলটা তীব্র গতিতে নেমে এলো তার মাথায়। এতজোরে আঘাত লাগল যে, সঙ্গে সঙ্গে মাথায় হাত দিয়ে আর্তনাদ করে মাঠের মধ্যেই ঢলে পড়ল সে। ভাষ্যকারসহ মাঠে থাকা সমস্ত দর্শকেরা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। কী হলো কিছুই যেন বুঝলো না। দলের বাকিরা ও ফিজিও মোহাম্মদ হাসান ছুটে এলেন ফারশাদের কাছে। মুহূর্তেই ভিড় জমে গেল সেখানে। দৃশ্যটা কতটা ভয়ংকর আন্দাজ করতে পারল না উজমা, শুধু মনে হলো, সে নিজেও চোখের সামনে অন্ধকার দেখছে। দুর্বল শরীর নিয়ে গ্যালারি থেকে বেরিয়ে মাঠে এসে, সবাইকে ঠেলে দূরে সরিয়ে নিচু হয়ে ফারশাদের মাথা দু’হাতের মাঝখানে নিয়ে পালস ও নিঃশ্বাস চেক করে বুঝল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। মাফিন পানির বোতল থেকে পানিঝাপটা দিল। অসংখ্য বার, কিন্তু লাভ হলো না। ফিজিও নিজেও প্রাথমিক চিকিৎসার চেষ্টা করলেও ফলাফল খারাপ দেখে দ্রুত হসপিটালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফিজিওর কথা শোনে ভয়ে সারাদেহ কেঁপে উঠল উজমার। ভয়মিশ্রিত মন ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাফিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘দেরী করছেন কেন, মাফিন ভাই? তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন, প্লিজ। ও তো একেবারেই চোখ খুলছে না।’

***

উজমা যখন চোখ খুলল তখন রাত বারোটা। চোখ মেলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, পাশে বসে আছে নয়না। আস্তে-ধীরে পুরো কেবিনে চোখ বুলালো, মনে করার চেষ্টা করল, শেষ কী হয়েছে। খেলার মাঠে খেলছিল সবাই, এরমধ্যেই দুর্ঘটনা। ফারশাদের নিশ্চুপে থাকা মুখটা চোখের পর্দায় ভেসে উঠতেই জোরপূর্বক বসার চেষ্টা করল। শরীরে জোর নেই একদম। হঠাৎ করে সব জোর কোথায় গেল তার? সোজা হতে চাইলে নয়না পাশে এসে বসে, পিঠের দিকে নরম বালিশ দিল একটা। চিন্তিতমনে উজমা বলল,

-‘আমার আবার কী হয়েছে? এখানে কেন আমি? তোমার ভাই কোথায়, নয়না?’

চিকিৎসার জন্য ফারশাদকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়, মাফিন ও নিহাদ উঠেছিল সাথে, উজমাও পাশে ছিল। হসপিটালে আসার পর ফারশাদের চিকিৎসা শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল উজমা। জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তার তার ট্রিটমেন্ট শুরু করেছেন। বিভিন্ন টেস্ট করেছেন। দুর্বল শরীর নিয়ে কিছুই মনে রাখতে পারছিল না সে। যতক্ষণ জেগেছিলল, চোখ শুধু ঘুম খুঁজছিল, ভেঙেপড়া শরীর বিশ্রাম চাইছিল। কড়া ডোজের ঔষধের কারণে দীর্ঘক্ষণের ঘুম জড়িয়ে এসেছিল চোখে । যেহেতু শারিরীক অবস্থা ভালো না, জন্ডিস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, ইমিডিয়েট তারও পর্যাপ্ত চিকিৎসার দরকার। এরপর কী হয়েছে, সে কিছুই জানে না। ফারশাদের শারিরীক অবস্থা ও টেস্টের রিপোর্ট দেখে, রাতের ফ্লাইটেই তাকে দেশের বাইরে ট্রান্সফার করার সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তার। এসব কথা উজমাকে বলার সাহস পেল না নয়না। শুধু বলল,

-‘আছে তো, ভাইয়া ভালো আছে।’

নয়নার কথা বিশ্বাস হলো না উজমার, চোখের দেখা না দেখে বিশ্বাস করা অসম্ভবই বটে। যে অবস্থা দেখেছিল ফারশাদের তাতে মনের ভয় কাটিয়ে স্বাভাবিক থাকা দায়। লাফ দিয়ে বেড থেকে নামতে চাইল উজমা, পারল না। নয়না তাকে ধরেবেঁধে আটকে রাখতে গেলে উজমা বলল,

-‘কী হলো? তুমি আমাকে আটকাচ্ছ কেন? আমি একটু দেখে আসি তোমার ভাইকে। জ্ঞান ফিরল কি-না।’

নয়না কী বলবে ভেবে পেল না। তার এত কান্না পাচ্ছে। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল। কোনোকিছু না বলে সে আটকানোর বাহানায় বলল,

-‘জ্ঞান ফিরেছিল একবার, এখন ঘুমোচ্ছে।’

-‘আচ্ছা, একবার দেখে আসি।’

-‘তোমার যাওয়ার দরকার নেই, ভাবী।’

-‘কেন?’

-‘ডাক্তারের নিষেধ আছে। কেউ যেতে পারবে না সামনে।’

-‘ডাক্তারকে ডাকো, আমি কথা বলব। আমি ওর ওয়াইফ। সুস্থ, অসুস্থ সর্বাবস্থায় ওকে দেখার অধিকার আমার আছে। দুনিয়ার সবার জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আমার জন্য নয়, আর থাকলেও এমন অদ্ভুত রুলস্ মানব না আমি। দেখি সরো…।’

নয়নাকে ঠেলেঠুলে বাইরে বের হতে চাইল উজমা। কেবিনের ভেতর রীতিমতো নয়নার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে সে। চেঁচামেচি শোনে তড়িঘড়ি কেবিনে প্রবেশ করল উসাইদ ও তাক্বদীম। ভাই ও প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেখে দুর্বল শরীরে প্রাণ ফিরে পেল উজমা। অভিযোগের সাথে বলল,

-‘দেখো তো, ভাইয়া। এই মেয়েটা এত খারাপ। আমাকে শাদের কাছে যেতে দিচ্ছে না। ডাক্তার না-কি নিষেধ করেছে। ডাক্তার আমার জন্য কেন নিষেধাজ্ঞা দিবে? আমি তো ওর কাছের মানুষ তাই না? আমি তো যেতেই পারি। একবার ডাক্তারকে বোলো না, দূর থেকে দেখব। শুধু একবার বোলো, ভাইয়া। না দেখে শান্তি পাব না তো আমি। প্লিজ, কেউ বোঝো আমায়।’

বোনকে সামলাতে তাকে বেডে বসাল উসাইদ। নিজেও পাশে বসলো। দুর্ঘটনার খবর শোনার পরপরই রওনা দিয়েছিল দু’জনে। এখানে এসে বাকি কথা জেনেছে। একহাতে আগলে নিয়ে বোনের অসুস্থ শরীরের কথা তুলে বলল,

-‘এত জোরে কথা বলিস না। তুই নিজেও অসুস্থ।’

উজমা খেয়াল করল, সবাই ফারশাদের ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছে। কেন? মনে সন্দেহ জাগলো। জানতে চাইল,
-‘তোমরা এমন করছ কেন?’

-‘কেমন করছি?’

-‘কিছু কি লুকাচ্ছ? ও ঠিক আছে না?’

উসাইদ নিজেও যথেষ্ট ভয় ও দুঃশ্চিন্তায় আছে। উজমাকে সত্যিটা বলা মানে, দুর্বল ও অসুস্থ মনের দুর্বলতা আরও বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু লুকাবে কতক্ষণ? সে ভাবনায় পড়ে গেল। না বলে উপায় নেই দেখে তাক্বদীমকে ইশারা দিল। পাশ থাকে তাক্বদীম বলল,

-‘তুই তো অনেক সাহসী একটা মেয়ে, তাই না? আমরা বরাবরই তোর সাহস দেখে মুগ্ধ। অনেক কঠিন মুহূর্ত কাটিয়ে এই পর্যন্ত এসেছিস। মনে কর, সৃষ্টিকর্তা তোকে আবারও কোনো একটা পরীক্ষায় ফেলেছেন। ধৈর্য্য ও বিশ্বাস নিয়ে রবকে ডাক, তিনি নিশ্চয়ই তোর ডাক কবুল করবেন।’

ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল উজমার। খারাপ কিছু কি হয়ে গেল? কারও মুখে হাসি নেই, সবাই চিন্তিত। যেন বড়োসড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বলের আঘাত কতটুকু ছিল? এই আঘাত কতটা ক্ষতি করতে পারে? মনে পড়ল, জ্ঞান ফেরার পর ঘুমঘোরে শুনেছিল, নয়না ও সজলের কথা। বেশ কয়েক বছর আগে কোনো এক দেশের খেলোয়াড় ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বলের আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। নাম পরিচয় কিছুই মনে করতে পারল না উজমা। ঢোক গিলে বলল,

-‘কী হয়েছে?’

তাক্বদীম একটু সাহস নিয়ে বলল,
-‘ডাক্তার বলেছেন, মাথায় আঘাতটা বেশি। এই আঘাতে প্যারালাইজড হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। এমনকি কথাবার্তা ও স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যেতে পারে। ব্রেইনে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে। যত দেরী হবে, বাঁচার চান্স কমে আসবে। যতবার সিটিস্ক্যান করা হচ্ছিল, ততবারই দেখা গেছে, ব্রেইনের অবস্থা ভয়াবহ। সজল, নাইমুর ও ফারশাদের পরিবারের সবাই এখানে চিকিৎসার ঝুঁকি নিতে নারাজ তাই ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, রাতের শেষ ফ্লাইটে ওকে সিঙ্গাপুর পাঠাবেন। এখন অবজারভেশনে আছে।’

কেউ বোধহয় ধাঁরালো অস্ত্র দিয়ে নিঃশব্দে প্রাণটা নিয়ে নিল উজমার। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল মন। চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে এলো। কারও বাঁধাই আর শুনলো না। তাক্বদীমের হাত ধরে বলল,

-‘একবার ওর সামনে যাই, প্লিজ? একটু দেখব। নিয়ে যাবি?’

***

উজমা যেহেতু খুব বেশি অসুস্থ, এই অবস্থায় তার দেশের বাইরে যাওয়াটা ঠিক না। ওখানে গেলে সারাক্ষণ ফারশাদের চিন্তায় অস্থির থাকবে, পরিবারের কাউকে পাশে পাবে না, মনের জোর পাবে না, এসব ভেবে তারজন্য ফ্লাইটের টিকিট কাটা হয়নি। নাইমুর এরমধ্যেই ইমার্জেন্সি টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এখন শুধু বিদায় নিয়ে রওনা দেওয়া বাকি। ফ্লাইটের আর বেশি সময় বাকি নেই। সজল, নাইমুর, ফাবিহা ও ক্রিকেট টিমের একজন কোচ ফারশাদের সঙ্গী হয়ে এই ফ্লাইটে যাবেন। তখন ফারশাদকে দেখতে চেয়েও পাশে যেতে পারেনি উজমা। দূরে দাঁড়িয়ে একনজর দেখেই শরীরের সব শক্তি হারিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। কতক্ষণ যে ফ্লোরে বসেছিল, সে নিজেও জানে না। নয়না ও উসাইদ তাকে খুব করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আগলে রাখল। লাভ হলো না। উজমার আর্তনাদ ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। স্ট্রেচারে করে যখন ফারশাদকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো, দুর্বল শরীর নিয়ে কাছে এগিয়ে গেল উজমা। ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা হাত রাখল মাথায়। অন্যহাতে ফারশাদের আঙুল ছুঁয়ে আস্তে করে আঁকড়ে ধরল। এমন যদি হয়, এই মানুষটা তাকে চিরদিনের জন্য ভুলে যায়, কী হবে? জীবন এত কঠিন কেন বুঝতে পারল না উজমা। প্রচণ্ড কড়ায় শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আছে মনের জমিন। ভয়, যন্ত্রণা, কষ্ট বুকে আগলে নিয়ে শেষ একবার প্রিয়তম’র কপালের মধ্যিখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করল,

-‘আমার রব নিষ্ঠুর কেন, শাদ? কেন বার বার এত কঠিন পরীক্ষায় ফেলছেন আমাকে? জীবন থেকে যদি তোমাকে কেড়ে নিতেই চান, তাহলে এত ভালোবাসা দিতে কাছে পাঠিয়েছিলেন কেন? তোমার এত ভালোবাসা ভুলে, তোমাকে ভুলে আমি বাঁচব কী করে বোলো তো?’

দেরী হচ্ছে দেখে নাইমুর তাড়া দিল। একটু একটু করে ফারশাদের হাতটা উজমার হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল। চেয়েও আটকাতে পারল না। দূরে থেকে হাউমাউ করে কাঁদল। নয়না তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিল। এরকম পরিস্থিতিতে কাছের মানুষকে কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়, জানে না সে। তবুও চেষ্টা করল। বলল,

-‘এভাবে কেঁদো না, ভাবী। তুমি যদি সাহস ও মনের জোর হারিয়ে ফেলো, আমরা কী করব? তোমাকে একটু স্ট্রং থাকতে হবে, তাই না? তুমি নিজেও এত অসুস্থ। একটু শোনো আমার কথা।’

কাঁদতে কাঁদতে উজমা বলল,
-‘দেখলে তো নয়না, তোমার ভাই আমার সাথে কথাই বলল না। আজ সকালেই বলেছিল কঠিন শাস্তি দিবে, এইভাবে শাস্তি দিল? আমি ডাক্তার দেখাইনি বলেই এইভাবে অভিমান দেখাল, কঠিন শাস্তি দিল, না? আমি তো ডাক্তার দেখাচ্ছি, খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাব। তবুও ও পারল এমন করতে? কেন এমন করল? কেন আমার সাথে একবার কথা বলল না? কেন? আমি কি এতই খারাপ? আমার সাথে কথা না বলে দূরে সরে যাচ্ছে! ও কি বুঝে না, ও যদি একবার দূরে চলে যায়, আমি থাকতে পারব না?’

উজমাকে বেডে রাখল উসাইদ। সম্পূর্ণ শরীরের ভর ছেড়ে দিয়েছে মেয়েটা। আবারও অজ্ঞান হয়ে গেছে। এভাবে যদি চলতে থাকে, বোনকে বাঁচানো কষ্ট হয়ে যাবে। উসাইদ ভেবে দেখল, উজমাকে এখানে একা রেখে যাওয়া যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিল, মৌলভীবাজারে ফেরার পথে বোনকেও নিয়ে যাবে। এখানে থাকলে সুস্থ হওয়ার বদলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। বেশ কিছুক্ষণের দখল সামলে চোখ মেলে কাছের মানুষ সবাইকে পাশে দেখে নীরবে চোখের পানি ফেলে গেল। একজন নার্সকে রেখে ডাক্তারের সাথে বোনের চিকিৎসা ও রিলিজ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে বাইরে গেল উসাইদ। নয়না পাশে বসে উজমার মাথায় হাত বুলিয়ে গেল। একেবারে শেষরাতের শেষমুহূর্তে ফারিশা, তানজীম ও ঊষা এসে উপস্থিত হলো হসপিটালে। বোনকে এত দুর্বল, অসুস্থ ও অসহায় অবস্থা দেখে কাছে ছুটে গেল ঊষা। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে চাইল। কাছের মানুষদের পেলে আর নিজেকে ধরে রাখা যায়? উজমাও পারল না। বাচ্চাদের মতো ডুকরে কেঁদে উঠল। প্রচণ্ড অসহায় ফারিশা শুধু নীরবে প্রার্থনা করে গেল।

প্রতিদিনের মতো আজও রাত গেল, ভোর হলো, বাইরে আলো ফুটল, সেই আলোয় সমস্ত আঁধার কেটে গেলেও উজমার জীবনের আঁধার দূর হলো না। পূণরায় অনিশ্চিত আঁধারে তলিয়ে গেল জীবন। ভোরের আলোটাও তার কাছে আজ জঘন্য মনে হলো। বেডে শুয়ে জানালার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখল উজমা। মনে পড়ল, ফারশাদের বলা কথা। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটা ভোরকে একসাথে ছুঁয়ে দেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল মানুষটা। অথচ সামান্য একটা দুর্ঘটনায় আজকের এই ভোর দু’জনকে এতটাই দূরে সরিয়ে দিল যে, কেউ কাউকে চোখের দেখাও দেখতে পারছে না, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারছে না। আদৌ আর দেখা হবে কি-না, হলে কবে হবে সেসব ভাবতে গিয়েই চোখের কোণে পানি জমে উঠল। একদৃষ্টিতে রোদ ঝলমল আলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এই পরিস্থিতিও বেশিক্ষণ রইল না। রোদের তীব্র আলো হঠাৎ করে মিইয়ে যেতে লাগল। খণ্ড খণ্ড মেঘেদের দল এসে ঢেকে দিল সূর্যকে। ধীরেধীরে ঝড়োহাওয়া বইতে লাগল। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর পাশাপাশি ঠাসঠাস বজ্রপাত শুরু হলো। মিনিট দশেক পর আবারও শান্ত হয়ে গেল পরিবেশ। আকাশের কিনারে আবছাভাবে সূর্য উঁকিঝুঁকি মারলো। মেঘে-রোদের এই কানামাছি দেখে মনে মনে আওড়াল,

-‘আজ খুব ইচ্ছে করছে, মনের সবটুকু অনুভূতিকে শব্দ দিয়ে সাজিয়ে একটা বেনামি চিঠি লিখে মেঘের খামে বন্দী করে ঝড়ো হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে। মেঘে-মেঘে ভেসে-ভেসে সেই চিঠি কি তোমার গন্তব্যে পৌঁছাবে, শাদ? তুমি কি দেখবে তা, পড়বে, বুঝবে কি তোমার বাটারফ্লাইয়ের শব্দহীন আর্তনাদ?’

***

সমাপ্ত…