যদি আমার হতে পর্ব-১৭+১৮

0
611

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ১৭
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

বাসস্ট্যান্ডে দাড়িয়ে আছে রবিন আদ্রিশা। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাস ছাড়বে। বাসে বসার চেয়ে বাইরে খোলা হাওয়ায় অপেক্ষা করাটা রবিনের কাছে উত্তম মনে হলো। তাই বাসের সামনেই ফুটপাতে দাড়িয়ে আছে দুজনে। রবিন আদ্রিশাকে জিগ্যেস করলো কিছু খাবে কি না। আদ্রিশা রবিনের দিকে তাকিয়ে বললো, “পানি খাবো!” আদ্রিশার পানির তেষ্টা পাচ্ছিলো পালানোর পর থেকেই। পানি খাওয়ার সুযোগ তখন পায় নি। এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত বলেই পানি খেতে চাইলো সে। রবিন মুচকি হেসে আদ্রিশাকে দাড়াতে বলে দোকান থেকে পানি আনতে গেলো। এক বোতল পানি আর এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে পেছনে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিশা তার জায়গায় বাসের দিকে মুখ করে অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িয়ে আছে। রবিন একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে দোকানের আড়ালে গিয়ে কাউকে ফোন করলো।

—– ঐ কখন আসবি তোরা? এভাবে আর কতক্ষন ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখবো?
—–চিল দোস্ত। পালাতে যখন পেরেছিস তাহলে এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো? আর একটু অপেক্ষা কর। মোটামোটি এসে গেছি আমরা।
—– রাখ তোর চিল! ‌আরে মেয়েটা প্রশ্ন করে করে পাগল করে দেবে আমায়। আর ঐ বাসটা যদি ছেড়ে দেয় না তাহলে তো সব শেষ। আমার এতোদিনের প্ল্যানিং ভেস্তে যাবে! অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে আজকের এই দিনে আসতে বুঝেছিস! ‌আর কোনো ভুল আমি মেনে নেবো না!
—– শাট আপ ইয়ার! ভুল কেনো হতে যাবে! তুই ক্লোরোফোর্ম রেডি রাখিস শুধু!
—– না ক্লোরোফোর্ম সুকানো যাবে না এখানে। অনেক ভীড়। মানুষজন বুঝতে পারলে খবর হয়ে যাবো।
—– তাহলে আমারে দিয়া অত্তো বড় ক্লোরোফোর্মের বোতল কেনো কিনালি?
—– গাধা কোথাকার!আমি তো প্ল্যান করেছিলাম ব্রীজের ওপর‌ই ওকে অজ্ঞান করে তোদের হাতে তুলে দেবো! কিন্তু শালা তোদের জন্য এখান অব্দি আসতে হলো! গাড়ি নিয়ে আসার আগে চেক করতে পারলি না গাড়িতে তেল আছে কি না? তাহলে তখন ওভাবে তেল ভরার জন্য যেতে হতো না আর আমাকেও এই মেয়েটার সাথে এতো দূর আসতে হতো না!
—–ওসব ছাড়। এটা বল ওরে আমাদের সাথে নেবো কিভাবে?
—– আমি জানতাম কিছু না কিছু ভুল হবে আমাদের দ্বারা! আর তাই সাথে করে ঘুমের ঔষধ এনেছিলাম। এন্ড ইউ নো হোয়াট, পানির বোতলে দুটো ঔষধ‌ও মিশিয়ে দিয়েছি! এখন শুধু ওর এই পানি খাওয়ার পালা। তাহলেই কেল্লাফতে! রাখছি তাড়াতাড়ি আয়। তোদের হাতে ওকে তুলে দিয়ে আমিও আমার রাস্তায় যাবো!

ফোন কেটে বুক ফাটা হাসিতে মত্ত হলো রবিন। বোতল ঝাকিয়ে ঔষধ পানির সাথে পুরোপুরি মিশিয়ে নিলো। পেছন ঘুরেই দেখলো আদ্রিশা দাড়িয়ে আছে। চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে সে। রবিন থতমত খেয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো, ” কি হয়েছে আদু? কাঁদছো কেনো?”

আদ্রিশা এগিয়ে এসে রবিনকে বললো, “কিসের প্ল্যানের কথা বলছিলে তুমি? আমায় কার হাতে তুলে দেয়ার কথা বলছিলে?”

রবিন আমতা আমতা করে বললো,”কি,,, স,,ব যাতা ব,,,ল,,ছো? আমি তো যাস্ট ক,,,,থা,, ব,,লছি,,,লাম!” ‌আদ্রিশা রবিনের কলার ধরে বললো,”সত্যি করে বলো রবিন! কি চলছে তোমার মনে? আমি স্পষ্ট শুনলাম তুমি আমায় ঘুমের ঔষধ মেশানো পানি খাইয়ে বেহুশ করতে চাও। কেনো? কার সাথে কথা বলছিলে বলো প্লিজ!” ‌আদ্রিশা রবিনের কলার ধরে টানছে আর অঝোরে কাঁদছে।

রবিন আদ্রিশার হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে বললো, “এই একদম চুপ! ‌এতো কথা কিসের হ্যাঁ? শুনেছিস‌ই যখন তখন বুঝিস নি কি করতে চাইছি আমি? তোকে বিক্রি করে দেবো , আমার ঐ হারামী বন্ধুদের কাছে!” কথাটা শুনা মাত্র‌ই মাথা ঘুরে উঠলো আদ্রিশার। কি বলছে তার রবিন? তার মনে হচ্ছে কোনো সপ্ন দেখছে সে। ঘুম ভাঙলেই হয়তো সপ্নটা ভেঙে যাবে! কিন্তু তার এই ভাবনা কে চুরমার করে দিলো রবিন। আদ্রিশার মুখে ডান হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরে বলতে লাগলো,” ন্যাকামো করবি না একদম। আমার বন্ধুরা আসবে ভালোয় ভালোয় চলে যাবি ওদের সাথে! এখন না তুই তোর বাপের বাড়ি যেতে পারবি আর না আমার হাত থেকে পালাতে পারবি! এখানে থাকলে মানুষরুপি হিংস্র জানোয়ার গুলো তোকে ছিড়ে ছিড়ে খাবে! এর থেকে ভালো হলো আমার বন্ধুদের সাথে এনজয় কর!”

আদ্রিশার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো। কোনো রকম নিজেকে ছাড়িয়ে গায়ের জোড়ে থাপ্পর লাগিয়ে দিলো রবিনের গালে। তারপর আবার‌ও তার কলার ধরে বলতে লাগলো, “নিজের প্রেমিকা কে অন্য ছেলেদের হাতে তুলে দিতে লজ্জা করে না তোমার? তোমায় বিশ্বাস করে তোমার হাত ধরে ঘর ছেড়েছি আর তুমি আমার বিশ্বাসের এই মূল্য দিলে!” রবিন অট্টহাসি হাসলো। আদ্রিশার হাত মুচরে ধরে বললো, “প্রেমিকা! কে কার প্রেমিকা? তোর এখনো মনে হয় আমি তোকে ভালোবাসতাম!?” আদ্রিশা অসহায় চাহনি দিয়ে রবিনকে দেখছে। এ রবিনকে তো সে চেনে না! তার রবিন এমন কিছু করতেই পারে না। রবিন আদ্রিশার হাতে চাপ দিয়ে বললো,” কখনো ভালোই বাসি নি তোকে আমি! সবকিছু নাটক ছিলো! প্রতিশোধের জন্য করেছি সব!” আদ্রিশা হাতের ব্যাথায় ছটফট করছে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্রমাগত। তবে রবিনের কোনো ভাবাবেগ নেই। আয়েস করেই বললো, “এক বছর আগে তোর ভাইয়ের জন্য চাকরি হারিয়েছি আমি! কি এমন করেছিলাম যে তোর ভাই আমার নামে পুলিস কম্প্লেইন করলো!” আদ্রিশা ভাবছে আদ্র কি ভাবে রবিনকে চেনে। কিছু প্রশ্ন করার আগেই রবিন বললো,

” জানতে চাস কিসের প্রতিশোধ! শোন তবে! অফিসে আমি যেমন প্রজেক্টস করতাম তেমনি তোর ভাই ও করতো। কিন্তু ডিল সাইনের সময় ওর প্রজেক্টস‌ই হতো টপ লেভেলের। দুজনের কাজ করার পদ্ধতি এক হ‌ওয়ার পর‌ও ঐ আদ্র প্রমোশন পেতো আর আমি! কিছু টাকার জন্য যখন লোনের আবেদন করলাম তোর ভাই তা খারিজ করে দেয়! বাধ্য হয়ে যখন অফিসের লকার থেকে কিছু টাকা সরিয়েছিলাম তোর ভাই আমাকে, এই রবিনকে কাজ ছাড়া করেছিলো। তারপর আমার নামে কেইস‌ও করেছিলো সে। বেকার ছিলাম আমি। কোনো কাজ পাই নি। পালিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছি আমি। প্রতিশোধের আগুনে যখন জ্বলছিলাম তখন তোর হদিস পাই। ভাইয়ের কলিজা! হাহ,,,,! তোর প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই বুঝলি! তবে আমার ঐ বন্ধুদের খুব লোভ! ভেবে চিন্তে ছক কসেছিলাম ! তোকে আমার প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে পালানোর নাটক করে বিক্রি করে দেবো! এতে দুটো কাজ হাসিল হবে। এক , তোর পরিবার তোর জন্য পাগল হয়ে যাবে, কাওকে মুখ দেখাতে পারবে না ।আমার প্রতিশোধ নেয়া হবে । আর দুই, কিছু টাকাও পাবো আমি। তাই তো তোর মতো একটা মেয়েকে নিয়ে ৭ মাসের ভালোবাসার নাটক করতে হলো আমায়! হাহাহা,,,,,, আজ তার সমাপ্তি হবে!” আদ্রিশা কেঁপে কেঁপে বললো, “তার মানে সেদিন যে বলছিলে বাবা মা তোমায় পুলিসে দেবে সেটাও এই জন্য যে তুমি অফিসের টাকা নিয়ে গাফিলতি করেছো!” রবিন বিজ্ঞদের মতো ভাব নিয়ে বললো, “অফ কোর্স!”

তখনি একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থামলো তাদের সামনে। গাড়ি থেকে চার পাঁচজন ছেলে নামলো। তাদের দৃষ্টি আদ্রিশার দিকে। আদ্রিশা এতক্ষন রেগে থাকলেও এখন খুব ভয় পাচ্ছে সে। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। ওরা রবিনের দিকে তাকিয়ে কিছু ইশারা করতেই রবিন বললো, “দেরি করে ফেললি তোরা।সব জেনে গেছে। এনিওয়ে নো প্রবলেম এভাবেই নিয়ে যা। অজ্ঞান করতে হবে না আর!” আদ্রিশা বিস্ফোরিত চোখে রবিনকে দেখছে। এই ছেলেকেই কি সে ভালোবেসেছিলো! সব কিছু উপেক্ষা করেও রবিনকে জড়িয়ে ধরে বললো আদ্রিশা, “প্লিজ রবিন, এমন করো না আমার সাথে! খুব ভালোবাসি আমি তোমায়! ‌আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিও না তুমি! প্লিজ এদের হাতে তুলে দিয়ো না আমায়! আমি তোমায় কথা দিচ্ছি ভাইয়া কেইস উঠিয়ে নেবে। তোমার জেল হবে না! আমার সর্বনাশ করো না প্লিজ।যেতে দাও আমায়। রবিন!!!” ‌ছেলেগুলো আদ্রিশাকে টেনে হিচরে নিয়ে যাচ্ছে। আর রবিন পাথরের মতো দাড়িয়ে তামাশা দেখছে। আদ্রিশা রবিনের সামনে হাত জোর করছে, পায়ে পরছে এসব কিছুর‌ই কোনো মূল্য নেই রবিনের কাছে। রবিন খেয়াল করলো, আশেপাশের মানুষজনে ঘিরে আছে চারদিক। আদ্রিশা আর রবিনের চিৎকার চেচামেচিতে সবাই জড়ো হয়ে গেছে। এরা ওদের মেয়েটাকে নিয়ে যেতে দেবে কিনা সন্দেহ। তবে কেউ এগিয়ে আসে নি আদ্রিশাকে বাঁচাতে! আদ্রিশাকে টেনে গাড়িতে তোলার আগেই কেউ একজন আদ্রিশার ডান হাতে ধরে থাকা ছেলেটার মুখে পান্চ করলো। ছেলেটা মুখ থুবরে নিচে পরে গেলো। আদ্রিশা চোখ খিঁচে বন্ধ করেছিলো। বুঝতে পারলো তাকে ধরে রাখা হাত গুলো ধীরে ধীরে হালকা হচ্ছে। চোখ খুলে দেখলো সামনে চোখ মুখ লাল করে দাড়িয়ে আছে আদ্র আর তুহিন। আদ্র আরেকটা ছেলে মারতে যেতেই পুলিশ এসে আটকে দেয় তাকে। পুলিশ অফিসার ওখানে উপস্থিত জনতার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন তাদের কে ফোন করে ডেকেছিলো আর কাদের বিরুদ্ধে এফ আই আর করতে চায়। ভীড় ঠেলে এক ব্যাক্তি এগিয়ে এসে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বললো। গুন্ডাদের আটকানোর সামর্থ্য তাদের নেই বলেই পুলিশ ডেকেছিলো তারা। রবিন আর আদ্রিশার মধ্যকার কোনো কথাও বাকি রাখে নি লোকটি। দাড়ি কমা সমেত সব বললো। আদ্র একেতো রেগে ছিলো তার উপর রবিনের করা আচরন আর কথা গুলো শুনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। এগিয়ে গিয়ে রবিনকে মারতে শুরু করলো। আর চিৎকার করে বলতে লাগলো, ” কু**** বা****, কতো বড় কলিজা তোর! আমার বোনের দিকে বাজে নজর দিস! আমার বোনকে, আমার কলিজার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস হয় কিভাবে?” রবিনের নাক মুখ থেকে রক্ত আসছে। পুলিশ রবিনকে ধরে রেখেছে আর তুহিন আদ্রকে জাপটে ধরে সরিয়ে আনে। যে লোকটা পুলিশে ফোন করেছিলো সে এফ আই আর লিখতে এবং সাক্ষি দিতে পুলিসের জিপে উঠলো। ছেলেদের এরেস্ট করে পুলিশ জিপে তুলতেই তুহিন এসে রবিনের সামনে দাড়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “আজ বেঁচে গেলি! খোদার কসম কিছুক্ষন আগে যদি আমি এখানে থাকতাম তাহলে আজ তুই বেঁচে ফিরতি না। আমাদের জানের দিকে নজর দিয়েছিস তুই। যা সাজাই তোকে দেয়া হোক না কেনো সেটা খুব কম। আগে আদালত থেকে সাজা পেয়ে নে তারপর আদুর সাথে করা প্রত্যেকটা ধোকার সাজা পেতে হবে তোকে!”

আদ্রিশা মাটিতে বসে কেঁদে চলেছে। আদ্র তাকে উঠিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে গাড়ির দিকে নিয়ে গেলো। আদ্রিশা গাড়িতে উঠতে যেতেই দেখলো তার বাবা হামিদুর আহমেদ গাড়ির সামনে দাড়ানো। আদ্রিশা বেশামাল হয়ে পড়ে যেতে নিতেই তুহিন আর আদ্র তাকে সামলে নেয়। হামিদুর আহমেদ শুধু বললেন, “তুহিন, তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাও। সবাই অপেক্ষা করছে!” তুহিন ড্রাইভিং সিটে বসেছে আর তার পাশে হামিদুর আহমেদ। পেছনে আদ্র আর আদ্রিশা। আদ্রিশা নিজের বাবার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। নিজের বাবাকে ছোট করেছে সে। মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্যন করছে শুধু! হামিদুর আহমেদ ফোন করে বললেন যেনো অতিথিদের খাবার পরিবেশন করা হয় আর পরিবারের সবাই সেন্টারের হলরুমে উপস্থিত হয়। মেয়েকে নিয়ে আসছেন তিনি।

চলবে,,,,,,

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ১৮
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

গাড়িতে আর কোনো কথা হয় নি কারো। অনুষ্ঠানের স্থানে এসে গাড়ি দাড়াতেই গাড়ি থেকে নেমে হন হন করে ভেতরে ঢুকে পরেন হামিদুর আহমেদ। পেছন ফিরে মেয়ের দিকে তাকান নি একবারো। আদ্রি‌শা সবার সামনে আসতে নাকচ করলেও আদ্র আর তুহিন জোড় করে ভেতরে নিয়ে আসে তাকে। অতিথিদের মধ্যে অনেকেই এগুলো লক্ষ করছে। তবে দূর থেকে দেখছেই শুধু। আদ্রিশা দরজার কাছে আসতেই ঠাস করে এক থাপ্পর লাগিয়ে দিলেন রুমানা আহমেদ। তাল সামলাতে না পেরে দরজার কোনায় কপাল লেগে বেশ ব্যাথা পায় সে। আদ্র‌ও মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ছোটবেলায় আদ্র প্রচুর মার খেলেও আদ্রিশার গায়ে কখনো হাত তুলেন নি মা। এমনকি মা বকলেও বাবা তাকে ধমকে চুপ করিয়ে দিতেন আর আজ মা থাপ্পর মারার পর‌ও বাবার কোনো ভাবাবেগ নেই। আদ্রিশা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মা আবার‌ও তাকে মারতে উদ্যোত হলে আদ্র মায়ের হাত ধরে আটকে বলে, “কি করছো মা!”

রুমানা আহমেদ হাত ঝাড়া দেয়ে আদ্র কে সরিয়ে দিয়ে বললেন, “বেশ করেছি! এই মেয়েটা আর মুখ রাখলো না আমাদের! ভেবেছিলাম আর কিছু না হোক নিজের বাবার কথাটা অন্তত বুঝবে। কিন্তু নাহ! ‌এতো লোকের মাঝে আমাদের মাথা নিচু করে দিলো।” আদ্রিশার দুবাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলেন, “কেনো করলি এমন বল! বিয়ে করতে না চাইলে বলতে পারতি। আমরা তো তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিচ্ছুটি করতাম না! আমাদের ভালোবাসা, বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলি! ছিহ!! তোর মতো মেয়ে যেনো আর কারো না হয়! ‌এমন মেয়ে জন্ম দিয়েছি যে কিনা মান সম্মান তো দূরে থাক ভালোবাসা আর সম্পর্কের মানেই বুঝে না‌ । ঐ পরিবারটাকেও ধোকা দিলি তুই! কি জবাব দেবো ওদের আমি! অনেক বুঝিয়েছি ওদের। অনেক অপেক্ষা করেছে তারা, আর করবে না আর না তোকে ও বাড়ির ব‌উ করবে! কেনো? আমাদের ভালোবাসা ইচ্ছে সপ্ন সব এভাবে শেষ করেদিলি। কি করে মুখ দেখাবো এই সমাজে!!”

আদ্রিশা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো, ” আমায় ক্ষমা করে দাও মা! আমি ভাবিনি আমার জন্য তোমাদের এতো কষ্ট পেতে হবে! বিশ্বাস করো, আমি চাই নি তোমাদের কষ্ট দিতে। তোমাদের অসম্মান হোক এমন কাজ‌ও করতে চাই নি আমি। কিন্তু ভুলটা যে করে ফেলেছি! ভালোবেসেছিলাম তাকে। কি করে বুঝবো আমি নিজের স্বার্থে নিজের সাথে সাথে তোমাদের‌ও এতো বড় ক্ষতি করে দেবো!”

আদ্রিশার কান্নার বেগ বাড়ছে। চোখ মুছে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, “আমি নিজের অজান্তেই ওকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু কোনো সম্পর্কে জড়ানোর বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার ছিলো না। যথাসম্ভব তাকে ইগনোর করে গেছি। কিন্তু একটা সময় পর তা আর করতে পারি নি। মনের কাছে , আবেগের কাছে আমি হেরে গেছি। অনেক চেষ্টা করেছি জানোতো যাতে আমার অনুভুতিগুলো ওর থেকে লুকাতে পারি। তাও হয়ে উঠে নি। ভালোবাসা কতদিন‌ই বা লুকিয়ে রাখা যায় বলো। তার উপর আমার জন্য ও কতো পাগলামি করেছিলো! আমিও তখন তার ডাকে সারা দি! বার বার বলেছিলাম তাকে তোমাদের সাথে কথা বলার জন্য রাজি হয় নি। বলেছিলো বেকার বলে না কি তোমরা ওকে মেনে নেবে না। আমি চেয়েছিলাম তোমাদের ওর কথা জানাবো কিন্তু রবিন মানা করে দিলো। বললো এতে নাকি বিপদ আমাদের‌ই হবে! আমার জন্য আনা সম্মন্ধ‌ও ভেঙে চলেছিলাম ওর কথায়। এই বিয়ে ভাঙার‌ও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ব্যার্থ হয়েছি বার বার। তাই বাধ্য হয়ে পালানোকেই শেষ আর প্রধান উপায় বলে মেনে নিয়েছিলাম! ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম আমার পরিবারের কথা। আমার বাবা মা আমার এই কাজে কতোটা কষ্ট পাবে সেটা মাথায় এলেও মনে জায়গা করে নিতে পারে নি! আজ যখন রবিনের হাত ধরে পালিয়েছিলাম একবারের জন্যেও মনে হয় নি তোমরা আমায় কতটা ভরসা করেছিলে বরং ভেবেছি কিভাবে রবিনের সাথে বাকি জীবন সুখে কাটাবো! আমি ভাবিনি তোমরা কষ্ট পাবে, ভেঙে গুরিয়ে যাবে বরং ভেবেছি আমায় মেনে নেবে না!! শুধুমাত্র রবিনকে সারাজীবনের জন্য পাবার আশায় তোমাদের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করেছি। আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ‌্য মা!তবুও আমায় একটু বুঝো! আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না মা!”

রুমানা আহমেদ‌ও কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন! মেয়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে স্বামীর সামনে গিয়ে দাড়ালেন তিনি। চোখ মুখ শক্ত করে বললেন, ” কেনো নিয়ে এলে একে! যে মেয়ে সমাজের সামনে তোমায় নিচু করলো, তোমার ভালোবাসা বিশ্বাস ধু্লোয় মিশিয়ে দিলো তাকেই ফিরিয়ে আনলে! মুগ্ধর মামা জেনে গেছেন সব। এতোক্ষনে হয়তো বরযাত্রীর সবাই জেনে গেছে! ও বাড়িতে তো মেয়ের বিয়ে হবে না আর আমার বাড়িতে এই মেয়ের জায়গা কিছুতেই হবে না!” রুমানা আহমেদের কথায় কেঁপে উঠলো আদ্রিশা। বড় দাদি এখনো নিরব দর্শকের ভুমিকায় আছেন। রুমানা আহমেদ রুহির সামনে এসে বললেন,” রুহি যাও তো, দেখে আসো ওরা চলে গেলো কি না! এখনো তো কিছু শুনাতেও এলো না কেউ!” কথাটায় মিশ্রিত ছিলো তাচ্ছিল্য আর অপমান! আদ্রিশা অপরাধ বোধে মাটিতে মিশে যাচ্ছে।

রুহি মাথা নেড়ে বেরুতে গেলেই থামিয়ে আদ্র। মায়ের সামনে গিয়ে বললো, “আদুকে এখানে কেনো এনেছি জানো মা! কারন ও শুধুমাত্র এক শয়তানের প্রতিশোধের পন্থা ছিলো! আমার উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য‌ই ঐ ছেললেটা আমাদের আদুকে ব্যাবহার করেছে। ”

আদ্রর কথায় সবাই জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। আদ্র বললো , “রবিন আর আমি এক‌ই অফিসে কাজ করতাম। ওর প্রজেক্টস ভালো হলেও উন্নতমানের হয় নি কখনো। ফলে ডিল সাইনের সময় আমার প্রজেক্টসের মূল্য হতো বেশি। প্রমোশন পাওয়ায় ওর থেকে উচ্চ লেভেলের পদে উন্নীত হ‌ই। আর ওকে আমার আন্ডারে কাজ করতে হয়। হিংসা জেদ আর লোভের কারনে আমার সাথে কম্পিটিশন করতো ওলয়েজ। একবার ওর টাকার দরকার ছিলো কিন্তু কোম্পানির লকারে তখন শুধু প্রজেক্ট শুরু করার মতোই টাকা ছিলো। তাই ওর আবেদন খারিজ করেছিলাম আমি। তবে এর ফল এতো ভয়ানক হবে আমি সত্যি জানতাম না। আমাদের নিউ প্রজেক্টটাকে নষ্ট করে দিয়েছিলো সে। আর তারপর লকার থেকে টাকা নিয়ে পালিয়েছিলো। ধরা পরে যাওয়ায় কাজ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিলো। আর অফিসের ডিল আর টাকার সাথে করা গাফিলতির জন্য ওর নামে কেইস করা হয়েছিলো। কিন্তু পরে তা উইথড্রো করা হয়। যা তার অজানাই ছিলো। ও ভাবতো ওকে পুলিশ ধরতে পারে আর তাই পালিয়ে পালিয়েই থাকতো! আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে আমার বোনের জীবনের সাথে খেলতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। আদুকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে ওকে নিয়ে পালানোর ধান্দায় ছিলো সে‌ । তারপর তার মতোই নিকৃষ্ট কিছু ছেলের কাছে আদুকে বিক্রি করে দিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো। এতে সমাজের সামনে আমাদের অসম্মান হতো আর আমি গোমরে গোমরে মরতাম। এটাই হতো ওর পরিপূর্ণ প্রতিশোধ।আজ ঠিক সময়ে ওখানে যেতে না পারলে আদুকে হয়তো বাঁচাতে পারতাম না। ওরা আমার বোনটাকে,,,,,,,”

আদ্রর কথায় রুমানা আহমেদের অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। উপস্থিত সবাই একপ্রকার শিউড়ে ওঠে। আদ্রিশা গলা ছেড়ে কাঁদছে এখন। পরিবারের কাছেই তো সে সবচেয়ে নিরাপদ। মন উজার করে কাঁদছে সে! হামিদুর আহমেদ এখনো নিশ্চুপ আছেন। তার চোখে পানি নেই আর না মুখে রাগী রাগী ভাব। খুব স্বাভাবিক আছেন যেনো। কারো কোনো কথাই যেনো তার কানে পৌঁছচ্ছে না। না মেয়ের চিৎকার করে কান্না আর না স্ত্রীর হাহাকার! দরজার কাছ থেকে কেউ চিৎকার করে বললো,

“মেয়ের দোষ ঢেকে এখন কি লাভ, আদ্র? ঐ চরিত্রহীন মেয়ে আর আমাদের ঘরে উঠবে না! বিয়ে ভেঙে দিলাম আমরা!”

হামিদুর আহমেদ পেছন ফেরে দরজার দিকে তাকালেন। তার চোখে এখন উপচে পড়া পানি! হাত দিয়ে চোখ মুছে এগিয়ে গেলেন দরজায় দাড়িয়ে থাকা মানুষের কাছে।

চলবে,,,,,,,,