যদি আমার হতে পর্ব-১৫+১৬

0
576

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ১৫
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

ঘরে গিয়েই বিছানার কর্নারের বালিশ উল্টে দেখলো, চিঠিটা ওখানেই আছে। ঠিক যেভাবে সে রেখে গিয়েছিলো! মন প্রশান্তি পেলেও হাতের চিঠিটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করলো আদ্রিশা। তারপর টুকরো গুলোকে রুমের ডাস্টবিনটায় ফেলে দিলো। হৃৎস্পন্দন এখনো দ্রুতগতিতে চলছে। শ্বাস টেনে বিছানার পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস উঠিয়ে এক চুমুক পানি খেলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে আদ্রিশা। দরজায় টোকা দিয়ে কেউ একজন ঘরে ঢুকলো তার। পাশ ফিরে দরজার সামনে মা কে দেখে খানিক চমকালো আদ্রিশা। রুমানা আহমেদ মেয়ের কাছে দাড়ালেন। আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”এখনো এই কাপড়ে! সারা গায়ে হলুদ মেখে একাকার! যা তাড়াতাড়ি গোসল করে নে। আর দেরি করলে পরে ঠান্ডা লাগবে তো!” আদ্রিশা বিরক্তির সুর তুলে বললো,”হুম,,,, যাচ্ছি!” রুমানা আহমেদ তাড়া দিয়ে বললেন,”যাচ্ছি বললে হবে না। এখনি যা। তারপর ঘুমোতেও তো হবে না কি! সকাল উঠতে হবে তো!” আদ্রিশা হাতের কানের অলংকার খুলতে খুলতে বললো,”কেনো? সকাল উঠে কোন রাজকার্য করবো আমি!?” রুমানা আহমেদ মুচকি হাসলেন। মেয়ের নিত্যদিনের অভ্যাস রাত করে ঘুমানো আর দেরিতে জাগা। কেউ যখন‌ই ভোরে ঘুম থেকে উঠতে বলে, ততক্ষনাত বলে দেবে, কোন রাজকার্য করবে সে! এই মেয়েই নাকি কাল বিয়ে করে শ্বশুড় বাড়ি যাচ্ছে, ভাবতেই অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে তার। তিনি আদ্রিশাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে বসিয়ে নিজ হাতে তার মাথা থেকে ওড়না, টিকলি, গলা থেকে ফুলের গয়না সব এক এক করে খুলছেন। আয়নার দিকে তাকিয়ে আদ্রিশার প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, “তুই ভুলে গেলি! কাল যে তোর বিয়ে! এখন কি আর দেরি করে ঘুম থেকে উঠা যাবে? এখন থেকে যে রোজ তোকে রাজকার্য করতে হবে আদু!” রুমানা আহমেদের চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো! আদ্রিশার চোখ‌ও মেঘে ঢেকে গেছে। যখন তখন বর্ষার বৃষ্টির মতো প্লাবিত করতে পারে মুখমন্ডল! ‌আদ্রিশা নিজেকে ছাড়িয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। রুমানা আহমেদ চোখ মুছে মেয়ের বিছানা ঠিক করছেন। তার মেয়ে যে কাল আর এ ঘরে থাকবে না। বিয়ের পর যখন আসবে তখন কি আর এ বাড়ির মেয়ের পরিচয়ে আসবে! আসবে তো শাহ পরিবারের ব‌উ এর পরিচয়ে! এসব কিছু ভেবে ভেবেই অশ্রু বিসর্যন করছেন তিনি। দরজার ওপাশে হামিদুর আহমেদ ঠোঁট কামরে কান্না আটকাচ্ছেন। তার ছোট্ট রাজকন্যা যে কাল চলে যাচ্ছে, সেটা তিনি মানতে পারছেন না। রুমানা আহমেদ বিছানা গুছিয়ে ঘর থেকে বেরুচ্ছেন দেখে হামিদুর আহমেদ‌ও প্রস্থান করলেন।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মাথার তোয়ালে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিলো আদ্রিশা। দুহাত দিয়ে চুল টেনে গোছানো বিছানাটাকে আবার‌ও অগোছালো করছে সে। হন্যে হয়ে নিজের ফোন খুঁজছে । রবিনের সাথে কথা হয়নি তার। দাদির কাছ থেকে কত কষ্টে ফোনটা উদ্ধার করেছিলো। এখন আবার কোথায় রাখলো কে জানে। হঠাৎই মাথায় এলো পার্লার থেকে বেরুনোর আগে নীলার সামনে ফোন রেখে এসেছিলো। নীলা কি ফোনটা এনেছে!? না কি খেয়াল‌ই নেই!? এনে থাকলে রেখেছে কোথায়? চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। তখনি আবার কেউ ঘরে ঢুকলো। আদ্রিশা দেখলো সামান্তা আর আদ্রিশার ছোট খালার মেয়ে ঐশি। ভ্রু কুঁচকে বিব্রত চেহারা নিয়ে এগিয়ে গেলো আদ্রিশা। দুজনেই ঘুমে ঢুলছে। আদ্রিশাকে পাশ কাটিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পরলো সামান্তা আর ঐশি। আদ্রিশা উল্টো ঘুরে সামান্তাকে ডাকতে যেতেই হাত উঠিয়ে আদ্রিশার ফোন তুলে ধরলো সামান্তা। ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বললো,”আপু তোর ফোন নীলা আপুর কাছে ছিলো। বললো তোকে দিতে! ডিস্টার্ব করিস না প্লিজ। ঘুমোতে দে!” নিজের ফোনটা পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো আদ্রিশা। রবিনকে কল করতে গিয়েও থেমে গেলো। সামান্তা আর ঐশিকে উদ্দেশ্য করে বললো,”তোরা আমার রুমে কেনো? বেরো বলছি! জানিস না আমি আমার রুমে কাউকে এলাও করি না!” ঐশি চোখ খুলার চেষ্টা করে বললো, “ধুর আপি, ঘুমোতেই তো এসেছি! তোর কোনো দামি জিনিস চুরি করতে তো আসি নি!” আদ্রিশা ঐশিকে টেনে শুয়া থেকে বসিয়ে দিলো। হাত ঝাকিয়ে বললো, “অন্য রুমে যা। আমি একা ঘুমোবো! বুঝেছিস তোরা। ভাগ তো!” ঐশি বসা থেকে শুয়ে পরছে দেখে আদ্রিশা তার হাত ধরে টানছে। ঐশি কান্না কান্না ভাব করে বললো, “আর কোথাও জায়গা থাকলে কি এখানে আসি! এমন করিস কেনো। আজকের রাত ইতো! এমন ভাব করছিস যেনো তোর আর তোর জামাইর মাঝখানে শুতে চাচ্ছি আমরা!” আদ্রিশা রেগেমেগে কিছু বলবে তার আগেই সামান্তা উঠে বসে বললো,”আজাইরা ঢং করো নাতো! কাল থেকে তো দুলাভাইর সাথে এক বিছানাতেই ঘুমাবা! আজ বোন দুইটার সাথে ঘুমালে কি ‌অসুবিধা হচ্ছে তোমার!” বলেই চিৎপটাং হয়ে আবার শুয়ে পরলো দুজন। আদ্রিশা রাগে কটমট করে ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলো।

সকাল হতে আর কিছুক্ষন বাকি। আধো আধো আলোতে আলোকিত হচ্ছে চারদিক। ব্যালকনির রেলিং ঘেসে মেঝেতে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিচে ঘুমুচ্ছে আদ্রিশা। রাতে রবিনের সাথে কথা বলে আর ঘরে যায় নি। এখানেই রাতটা পার করেছে‌। রবিনের সাথে কথা বলে আবার‌ও নতুন উপায়ে পালানোর প্ল্যান করেছে আদ্রিশা। এবারের প্ল্যান অনুযায়ি বাড়ির দেয়াল টপকে পেছনের মাঠ দিয়ে পালাবে তারা। রবিন‌ দেয়ালের পাশটায় অপেক্ষা করবে আদ্রিশার জন্য। এবার আর কোনো চিঠি লিখছে না আদ্রিশা। এতে অনেক রিস্ক আছে। কাল বড়জোড় বেঁচেছিলো, এবার‌ও যে বাঁচবে তার গ্যারান্টি নেই! কাউকে জানাবেও না পালানোর প্ল্যানিংএর ব্যাপারে। ধরা পরার ভয় থাকবে নাহয়! সূর্যের তীক্ষ্ণ আলো চোখে লাগতেই ঘুম ভাঙে আদ্রিশার। মাথা তুলে উপর নীচ তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে কোথায় সে। যখন বুঝতে পারলো ব্যালকনিতে তখন ধড়ফরিয়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো সে।ফোনের চার্জ শেষ হ‌ওয়ায় ফোনটা বন্ধ। ঘরে এসে ফোনটা চার্জে লাগিয়ে দেয়াল ঘরিতে তাকিয়ে দেখে সবে ৫ টা বাজে! ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো আদ্রিশা। সামান্তা আর ঐশি বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়েছে। আদ্রিশা ওদের ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে ব্যালকনির পর্দা টেনে দিলো। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিলো কিছুক্ষনের জন্য।

____________

লাল লেহেঙ্গা পড়ে বিছানায় বসে আছে আদ্রিশা। মেক আপ আর গয়নার ভারে অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছে সে। দুজন মেয়ে সাজাচ্ছে আদ্রিশাকে। আরেক জন হাতে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে। মনমরা হয়ে সবার কাজ কর্ম দেখছে আদ্রিশা। বাকি সদস্যরাও মোটামোটি তৈরি। গাড়িও এসে উপস্থিত সবাইকে বিয়ের স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওনেকে আবার পৌঁছেও গেছে। রুমানা আহমেদ আর হামিদুর আহমেদ অনেক আগেই ওখানে চলে গেছেন। আদ্র আগের দিন রাত থেকেই বিয়ের সেন্টারে সব তদারকি করছিলো। সাথে ছিলো তুহিন আর কাজিন ভাইদের দু একজন। আদ্রিশার চাচি আর খালারা কয়েকবার এসে তাড়া দিয়ে গেছেন মেয়েদের। যেনো তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সেন্টারে পৌঁছায়। বোনেরা জেদ ধরে বসলো আদ্রিশার সাথে এক গাড়িতে যাবে। তবে তাদের জেদ বেশিক্ষন টিকলো না। বড় দাদি স্পষ্ট বলে দিলেন আদ্রিশার সাথে যাবে ভাবি জেসমিন, বান্ধবী রুহি আর আদ্রিশার বড় খালা । নীলা ফুল আর চকলেট কিনে ভেনুতে যাবে।

ধীরে ধীরে বাড়ি খালি হচ্ছে। পার্লারের মেয়েরাও বিদায় নিয়ে চলেগেছে। ঘরে একা আদ্রিশা বসা। বাকিরা নিচে গাড়ির অপেক্ষা করছে। আর আদ্রিশা পালানোর প্রহর গুনছে। জেসমিন এসে আদ্রিশাকে নিয়ে গেলো।নিচে দুটো গাড়ি দাড়িয়ে আছে। একটাতে কনে আর তার সাথে কজন যাবে আর অন্য টাতে বাকি কয়েকজন সদস্য। তখন‌ই খেয়াল হলো কনের গাড়িতে ফুল লাগানো হয় নি। রুহি আর বাকি কজন মিলে গাড়ি সাজানোয় ব্যাস্ত। জেসমিন আদ্রিশাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো। রোদের তাপে ঘেমে নেয়ে বিচ্ছিড়ি হাল হবে নাহয়। আদ্রিশাকে ডাইনিং এর চেয়ারে বসিয়ে বাড়ির দরজা জানালা, লাইট সব বন্ধ আছে কি না চেক করতে গেছে জেসমিন। এই ফাঁকে আদ্রিশা রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাগানের দেয়ালের কাছে চলে এলো। পুরোনো একটা ভাঙা ম‌ই থাকায় তার সাহায্যেই দেয়ালের ওপরে উঠে পরলো আদ্রিশা। মনে মনে খালি আল্লাহকে ডাকছিলো ম‌ই থেকে পরে না যায়, কেউ দেখে না ফেলে! শেষমেষ কেউ দেখে নি। দেয়ালের ওপাড়ে রবিনকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হাত নাড়লো সে। রবিন এগিয়ে এসে হাত এগিয়ে দিলো আদ্রিশার দিকে। আদ্রিশা রবিনের হাতের উপর ভর করে লাফ দিয়ে নিচে নেমে গেলো। রবিন আর আদ্রিশা একে অপরকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হাতধরে ছুট লাগালো। মাঠ পেরিয়ে গেলেই মেইন রোড। ওখানেই কোথাও গাড়ি পার্ক করা আছে। একবার গাড়িতে উঠতে পারলেই কেউ তাদের নাগাল পাবে না। আদ্রিশা রবিনের মুখে উপচে পড়া খুশি লেগে আছে!

চলবে,,,,,,,

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ১৬
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

এদিকে মুগ্ধ বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার পরনে গোল্ডেন আর লাল রঙের গর্জিয়াস শেড়‌ওয়ানি। মাথায় পাগরি, বুক পকেটে একটা টকটকে লাল গোলাপ আর তার পাশে অতিরন্জিতো ব্রোচ! তার বন্ধুরাতো এনেছিলো নকল তলোয়াড় আর গলায় পরার জন্য ছোট পুতির মালা, দেখতে অনেকটা মুক্তর মালার মতোই ছিলো! কিন্তু মুগ্ধ সেসব পরলে তো! গম্ভীর গলায় বলে দিলো, “আমি কি যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি নাকি, যে উদ্ভট সাজতে হবে!” কারো কোনো কথাই সে রাখে নি। তবে মালিহা ইয়াসমিনের কাছে ছেলেকে এই রুপেও রাজপুত্রের চেয়ে কম লাগছে না। মুগ্ধর সাজ যেমন তেমন, স্নিগ্ধ নিজের সাজে কোনো কমতি রাখছে না! বর যাত্রীদের মধ্যে সব মেয়েরা নীল রঙের শাড়ি, ড্রেস পরেছে আর সব ছেলেরাই বেগুনি রঙের পান্জাবি পরেছে, ঘরিও সেম সবার। তবুও স্নিগ্ধকে অন্যরকম লাগছে! লাগার‌ই কথা। সবার মাঝে নিজেকে অনন্য প্রকাশ করার জন্য‌ই পান্জাবির উপর কালো রঙের হাফ কোট পরেছে সে। এক হাতে ঘরি আর অন্য হাতে ব্রেসলেট তার! চুলগুলো স্পাইক করে রাখা, আর পান্জাবির হাতা কুনোই পর্যন্ত গুটানো। মুগ্ধ স্নিগ্ধর দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকে নিরবতা ভেঙে বললো, “কি ব্যাপার রে তোর!?” স্নিগ্ধ চুইঙ্গাম চিবোতে চিবোতে বললো, “কিসের কি ব্যাপার?” মুগ্ধ পাগরি ঠিক করে বললো,”এই নিয়ে পাঁচ বার তোকে পারফিউম মাখতে দেখলাম! ‌আজ কি এই পারফিউম সুকিয়ে কাউকে বেহুস করতে চাস না কি!?” স্নিগ্ধ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো তার কথায়। নিজেকে সামলে ফোন স্ক্রোল করতে লাগলো। মুগ্ধ তার উত্তর না পাওয়ায় স্নিগ্ধর দিকে বাকা চোখে তাকিয়ে বললো, “রুহিকে ভালোবাসিস?” স্নিগ্ধ চোখ বড় বড় করে বসা থেকে দাড়িয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললো, “ভাই ওসব কিছু না। আমি তো শুধু ইম্প্রেশন জমানোর জন্য করছি এসব!” মুগ্ধ এক ভ্রু উচো করে বললো,” আমায় শেখাচ্ছিস! সত্যি করে বল, কিছু ফিল করিস ওকে নিয়ে?” স্নিগ্ধ মাথা চুলকে বললো, “একচুয়েলি ভাই, আই ডোন্ট নো স্টিল! ‌ওর সাথে ঝগড়া করতে, ওকে রাগিয়ে দিতে খুব ভালো লাগে আমার! ‌আসলে রাগাতে নয় বরং কথা বলতে ইচ্ছে হয়। সারাক্ষন ওর পাশে পাশে থাকতেই মন চায়। এমনি তে কি আর সব হয়, তাই ঝগড়া, খুনশুটি করি। এট লিস্ট সুযোগ তো পাচ্ছি ওর পাশে পাশে থাকার। ওর সাথে সময় কাটানোর। এখন এটাকে যদি ভালোবাসা বলো তবে তাই। কিন্তু কি জানো আমি জানি না ভালোবাসা কি!? আমি শুধু জানি ওকে খুব ভালো লাগে আমার। ওকে আমার চাই। ঝগড়া করার জন্য হলেও ওকে চাই!” কথাগুলো বলেই স্নিগ্ধ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর মুগ্ধ মুচকি হেসে স্নিগ্ধর যাওয়ার দিকে দেখছে। এর মধ্যেই বড় যাত্রীদের অনেকে ভেনুতে পৌঁছে গেছে। বরের গাড়িতে মুগ্ধ, স্নিগ্ধ, স্নেহা আর মুগ্ধর এক বন্ধু। বাকিরা অন্যান্য গাড়িতে। অল্প সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠানের স্থানে এসে পৌঁছালো সবাই। বরকে গেটেই আটকে দেয় কনের কাজিনরা। টাকা না দিলে এন্ট্রি নেই! ১০ হাজার টাকার আবেদন করলেও বরের মামা তাদের হাতে ৭ হাজার ধরিয়ে কোনোরকম প্রবেশ করলেন।

অন্যদিকে আদ্রিশা আর রবিন প্রাণপনে ছুটে মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাড়ায়। দুজনেই হাপিয়ে উঠেছে। আদ্রিশা রবিনকে জিগ্যেস করলো,”গাড়ি কোথায়? ” রবিন শ্বাস টেনে বললো,”এখানে গাড়ি কোথা থেকে আসবে! বন্ধুরা নিয়ে আসবে গাড়ি!” আদ্রিশা চোখ ঝাপটিয়ে বললো,”মানে? তুমি না বললে, রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে রাখবে!” রবিন আদ্রিশাকে মুখো মুখি দাড় করিয়ে বললো,”বোকা বোকা কথা কেনো বলছো? এখানে গাড়ি দাড় করানো পসিবল না তো! পার্ক কোথায় করবো বলোতো! ভেবেছিলাম ঐ ব্রীজটায় গাড়ি পার্ক করবো। কিন্তু পালাতে যদি বেশি সময় লাগে তাহলে ওতোসময় একটা গাড়ি রাস্তার পাশে দাড়াবে আর বন্ধুরাও হাটাচলা করবে, কেউ যদি সন্দেহ করতো!? তাই আনি নি সাথে! বাট ডোন্ট ওয়ারি এখনি বলে দিচ্ছি ওদের।” আদ্রিশা আবার‌ও বললো,”পালাচ্ছি আমরা তোমার বন্ধুরা কেনো আসবে?” রবিন নাম্বার ডায়েল করতে করতে বললো,”আরেহ কোনো সাহায্য লাগলে বন্ধুরাই তো করবে না কি? আর ধরো দাদুর বাড়িতে ঠাই পেলাম না তখন কোথায় উঠবো আমরা! ওরা সাথে থাকলে সাহস পাবো।” তারপর রবিন কারো সাথে ফোনে কথা বলে আদ্রিশাকে বললো, “কথা হয়েছে। ওরা আসছে। আমাদের আরেকটু হাটতে হবে। ঐ ব্রীজের উপর উঠে অপেক্ষা করতে হবে ওদের জন্য।” আদ্রিশার রাগ লাগছে প্রচুর। একে তো ভারি লেহেঙ্গা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সে তার উপর গা ভর্তি গয়নায় হাটাচলাতেও অসুবিধা হচ্ছে। রবিনের হাত ছাড়িয়ে বললো,”রবিন, আমরা এখনো বেশি দূর পালাই নি! এতোক্ষনে সবাই খবর পেয়েগেছে আমি পালিয়েছি। ধরতে পারলে আলাদা হতে হবে আমাদের। তোমার বন্ধুদের অপেক্ষা করতে হবে না। চলো না আমরা নিজেদের মতোই যাই। প্লিজ আমি মুগ্ধকে বিয়ে করতে পারবো না। বুঝার চেষ্টা করো। এখান থেকে যেকোনো গাড়িতে বাস স্টেন্ড পর্যন্ত যাই তারপর বাসে করেই নাহয় তোমার দাদুর বাড়ি যাবো। কি বলো?” রবিন মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো‌ । বুদ্ধিটা বেশ মনে ধরেছে তার। ফোন করে বন্ধুদের আসতে মানা করে এগিয়ে গেলো তারা।।

___________

সেন্টারে কনের সাথে যাদের আসার কথা ছিলো কেউই আসে নি দেখে রুমানা আহমেদ বাড়িতে ফোন লাগালেন। জেসমিন ফোন উঠিয়েই কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,”আদ্রিশা কোথাও নেই মা! কোথাও খুজে পাচ্ছি না আমরা। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজেছি। মনে হচ্ছে পালিয়ে গেছে ও।” রুমানা আহমেদের হাত থেকে ফোন পরে যায়। চোখের সামনে অন্ধকার দেখছেন তিনি।নীলা ঐশিরা রুমানা আহমেদ কে ধরে চেয়ারে বসায়। সানা বেগম আদ্র আর তার বাবাকে ফোন করছেন লাগাতার । তারা ভেনুতেও নেই আর ফোন‌ও উঠাচ্ছে না। নীলা রুমানা আহমেদকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসিয়ে তুহিনকে ফোন দিলো। তুহিন ফোন কেটে দিচ্ছে। যদিও রুহি , নীলা আর তুহিন জানতো আদ্রিশা পালাবে তবে টেনশন হচ্ছে তাদের। এবার কি হবে , বর যাত্রীদের কি জবাব দেবেন এসব ভেবেই মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে সবার। বড় দাদি মাথা ধরে বসে আছেন। চোখ থেকে অনড়গল পানি পরছে তার। উৎসব মুখর পরিবেশটা নিমিষেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো! হঠাৎ কনের পরিবারের সামনে এসে দাড়ায় স্নিগ্ধ। দুঃখ বিলাশ করার মাঝখানে স্নিগ্ধকে দেখে ঘাবড়ে যান সবাই। রুমানা আহমেদের ভয়ে হাত পা অসার হয়ে আসছে। ওরা কি জেনে গেছে আদ্রিশাকে পাওয়া যাচ্ছে না! ওরা কি এখন কথা শুনাবে? বিয়ে ভেঙে চলে যাবে নিশ্চয়! ‌এমনসব ভাবনা ভর করেছে রুমানা আহমেদকে। সবার ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্নিগ্ধ রুহির কথা জিগ্যেস করলো। সেন্টারে এসেই রুহিকে খুঁজে অস্থির সে। এখনো তার দেখা মেলে নি। বাধ্য হয়ে কনের পরিবারের কাছে জানতে এলো রুহি কোথায়। স্নিগ্ধর প্রশ্নে সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্নিগ্ধর খেয়াল হলো পরিবারের বড়দের সামনে বেয়ান খুঁজতে এসে পরাটা মানায় নি একেবারে। কথা ঘুরানোর উদ্দেশ্যে বললো, “আসলে,রুহির সাথে কাল বাজি ধরেছিলাম তো তাই খোঁজ নিতে এলাম। বাজি ও হারলো নাকি আমি দেখতে হবে না!এনিওয়ে,ভাবি কোথায়? ‌এখনো এলেন না যে!” স্নিগ্ধর প্রশ্ন শুনে রুমানা আহমেদ নীলার হাত জাপটে ধরলেন। নীলা ঝটপট বলে দিলো,”সাজছে!” স্নিগ্ধ নীলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,”এতো সাজতে হবে না বলে দিন। ভাইয়ের ভাবিকে এমনিতেই পছন্দ। তাড়াতাড়ি আসতে বলুন! আমরা আর কতক্ষন অপেক্ষা করবো?” নীলা মাথা নাড়তেই বেরিয়ে গেলো স্নিগ্ধ। তার খেয়াল হলো সবাই কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে! গেটে আদ্রিশার কাজিনরা যেভাবে হৈ হল্লুর করছিলো এখন তার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করছে। নিজের বোকা বোকা প্রশ্ন করায় কথা কাটাতে গিয়ে ওদের জিগ্যেস‌ই করলো না কি হয়েছে তাদের!নিজের উপর‌ই রাগ লাগছে তার। ভাবছে মুগ্ধকে গিয়ে বলবে বিষয় টা। যদি ও বুঝতে পারে এই নিস্তব্ধপুরির রহস্য!

চলবে,,,,,,,