যদি আমার হতে পর্ব-২৫+২৬

0
549

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ২৫
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

ফিরা যাত্রার সময় সমাপ্তি হয়েছে। আর একটু বাদেই আদ্রিশা মুগ্ধর সাথে শ্বশুর বাড়ি র‌ওনা দিবে! এখন থেকেই তার চেহাড়ায় কেমন দুখী দুখী ভাব। ব্রেকফাস্টের পর প্রায় আধঘন্টা জেসমিনকে জড়িয়ে ধরে বসে রয়েছিলো। জেসমিন আদ্রিশার পিঠে হাত বুলিয়ে কতকিছু বুঝালো তাকে। তাকেও যে সংসার করতে হবে, পরিবারের সবার কথা ভেবে চিন্তে কাজ করতে হবে, ওবাড়িই তার আসল ঘর, এসবের কিছুই বুঝতে নারাজ আদ্রিশা। কেউ না জানলেও সে তো জানে, এই সংসার সারাজীবনের নয় বরং কদিনের। ঐ পরিবার যে তার নয়! কোনো অধিকার নেই তার মুগ্ধর প্রতি, মুগ্ধর পরিবারের প্রতি! সব তো তিথির! শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। এই সংসার সুখ যে তার কাছে আমানত মাত্র। সময় হলে তিথিকে সব ফিরিয়ে দিতে হবে। তখনি,আরিয়া এসে বলে গেলো হামিদুর আহমেদ মেয়েকে ডাকছেন। আদ্রিশা চোখ মুছে বাবার ঘরের দিকে গেলো!

আরিয়া মুগ্ধর কোলে বসে আছে। মুগ্ধর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক গড়েছে সে। স্নিগ্ধ বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন ঘাটছে। আসলে, সে ফেইসবুকে রুহিকে খুঁজছে। আদ্রিশাকে ইনিয়ে বিনিয়ে রুহির কথা জিগ্যেস করায়, সে রুহির পুরো নামটা বলেছে! এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারবে না বলেই জানিয়েছে। বেচারা এখন হাজার‌ও রুহির মধ্যে থেকে তার রুহিকে খোঁজায় মশগুল। এদিকে আরিয়া আর মুগ্ধ গল্প করছে। গল্পের বিষয়বস্তু আদ্রিশা! আরিয়া তার ফুপিকে এতো ভালোবাসে যে মুগ্ধর কাছে বায়না ধরছে আদ্রিশাকে না নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুগ্ধ‌ও কতভাবে তাকে বুঝাচ্ছে। কিন্তু সব কথার শেষে আরিয়ার একটাই কথা, তার ফুপি শুধু তার! আর কেউ নিতে পারবে না। একসময় আরিয়া ফুঁপিয়ে উঠলো। মুগ্ধ ঘাবরে গিয়ে আরিয়াকে শান্ত করতে করতে বললো, “আরে, তুমি তো ব্রেইভ! ব্রেইভরা কাঁদে না কি?”

আরিয়া দৃঢ়তার সাথে বললো , “ওমা, ব্রেইভ হলে কাঁদবে না কেনো? ফুপি ওতো কত্ত ব্রেইভ! তারপর‌ও তো ঐদিন তোমার সাথে যাওয়ার সময় কাঁদলো!”

মুগ্ধ বললো, “হুম, তখন কাঁদলেও আজকি কাঁদতে দেখলে?”

আরিয়া চোখ ডলে বললো, “আজ কেনো কাঁদবে? তোমার সাথে যেতে চায় না বলেই কেঁদেছে! আমাদের বাড়ি আসার পর তো খালি হাসছে। দেখে নিয়ো আজ যখন তুমি ফুপিকে নিয়ে যাবে তখন‌ও সে কাঁদবে!”

মুগ্ধ ঠোঁট উল্টে স্নিগ্ধকে দেখলো। স্নিগ্ধর কোনো হেলদোল নেই। আরিয়ার কথাটা ষোল আনা সত্যি। মুগ্ধ জানে আদ্রিশা আজ আবার কাঁদবে! আর যদি তা হয় তাহলে এই পুচকি টাও তাকে শুনিয়ে দিবে ক কথা! এক দিনেই মুগ্ধর মাথার অর্ধেক চুল তুলে নিয়েছে আরিয়া। এর কারন‌ও আদ্রিশা! মজার ছলেই আদ্রিশা বলেছিলো, মুগ্ধ তাকে আরিয়া থেকে আলাদা করার জন্য সাথে করে নিয়ে যাবে! ব্যাস, শুরু হলো আরিয়ার অত্যাচার। ছোট বলে মুগ্ধ কিছু না বলে সহ্য করেছে। আর আদ্রিশাও আটকায় নি বাচ্চা মেয়েটাকে! এতে মুগ্ধ আদ্রিশার উপর ক্ষেপে গেছে। মনে মনে আদ্রিশার উপর প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞাও করে ফেলেছে। তবে, আরিয়ার অত্যাচার শেষ হয় নি এখনো। আগে হাত দিয়ে নির্যাতন করেছে আর এখন মুখের কথা দিয়ে! আবার‌ও আরিয়া বললো, “ফুপি তোমায় ভালোবাসে না গো! নিয়ে যেয়ো না তোমার সাথে!! পরে তোমায় মারবে দেখো! তখন কাঁদলেও চলবে না!” মুগ্ধ চোখ ঝাপটিয়ে একবার আরিয়া কে দেখলো। আরিয়া মুগ্ধর কোল ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে, মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিলো। মুগ্ধ আরিয়াকে দেখে ভাবছে, এইটুকুন মেয়ে এত্ত শয়তানি বুদ্ধি! কতো কথাই বলে দিলো! নিশ্চয় সব আদ্রিশা শিখিয়েছে। নাহলে, এতো কথা কিভাবে বলে! একদম আদ্রিশার কার্বন কপি! ইমোশনাল ব্লেকমেইল‌ও করতে জানে। সাঙ্ঘাতিক!!



হামিদুর আহমেদ চশমা ঠিক করে চেয়ারে বসলেন। আদ্রিশা বাবার কাছে দাড়িয়ে। হামিদুর আহমেদ ভনিতা না করে বললেন, “বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রকার খেলা খেলো না!” আদ্রিশা কেঁপে উঠলো। বাবার কর্কশ কন্ঠে ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকালো! তিনি মেয়ের দিকে না তাকিয়ে বললেন,

“তোমায় আমি তখন ভালোবেসেছি যখন তুমি এই পৃথিবীতে আসোও নি! কতো সপ্ন বুনেছিলাম! সব সপ্ন‌ই পূর্ণ করেছো শুধু অপমান সমেত ফেরত দিয়েছো। ভেবো না বাবা হয়ে তোমায় খোঁচা দিয়ে কথা বলছি! আসলে, কথা গুলো আগে তোমার সাথে বলা উচিত ছিলো। তাহলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতিতে দাঁড়াতে হতো না আমাদের। তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছা জানা উচিত ছিলো আমাদের, যা আমরা করি নি। ভেবে বসেছিলাম আমাদের পছন্দেই তুমি খুশি হবে। আমরা তো তোমার ক্ষতি চাই নি, তোমাকে সুখি করার জন্য, বেস্ট খুজেছি অথচ তোমার খুশি কোথায় তা জানতে চাই নি। জানতে চাইলে হয়তো আগেই তোমায় কষ্ট পাওয়া থেকে আটকাতে পারতাম! ‌তুমিও পারতে আমাদের ভুল ভাঙাতে। বুঝাতে! তা না করে,,,,,,”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হামিদুর আহমেদ। আর হয়তো বলতে চাইছেন না তিনি। আদ্রিশার চোখ শুষ্ক! কান্না নেই তার। কিন্তু বুকটা ফাকা ফাকা লাগছে। ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছে বাবার প্রতিটা কথায়। প্রকাশ করার কোনো উপায় নেই তার কাছে! হামিদুর আহমেদ আবার‌ও বললেন,”আমি তোমার মায়ের মতো ন‌ই, তুমি জানো! রুমি হুট করে রেগে যায়। আর তারপর সব রাগ ঝেড়ে শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু আমি এমন ন‌ই। রাগ ঝাড়ার আগে ঐ রাগকে মনে পুষে রেখে বিস্ফোরক তৈরি করি! এটা ঠিক নয়, তাও আমি জানি। তবে, রাগ ঝাড়লেই যে সব মিটে যায় এটা আমি মানতে পারবো না। হ্যাঁ, ক্ষমা করা যেতে পারে , কিন্তু অপমান ভুলা যায় না। আর গেলেও আমি এর ঘোর বিরুধী!! এজন্য, তোমায় ক্ষমা করেছি বলে ভেবো না অপবাদ ভুলেগেছি আমি!”

এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলেন হামিদুর আহমেদ। চশমা খুলে পাশের টেবিলে রেখে আদ্রিশার দিকে তাকালেন। আদ্রিশা চট করে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে র‌ইলো। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে খুটছে সে। হামিদুর আহমেদ মেয়ের কোনো রেসপন্স না পেয়ে বললেন,

” আদ্রিশা, আমাদের কি বিশ্বাস করা যায় নি? নাকি ভরসা করে উঠতে পারো নি?”

আদ্রিশার বুকটা ধক করে উঠলো। বাবা তার কাছে অভিযোগ করছেন, কথাটা ভাবতেই তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছে সে। মাথা নিচু করে রাখায় চোখের জল পায়ের পাতায় পরলো। বাবা আবার‌ও বলে উঠলেন, “আ হা, জানতে চাইছি না আমি! প্রশ্নগুলো আমি করলেও উত্তর টা তুমি তোমাকে দেবে। আমি আর সবার মতো বলবো না, বাদ দাও যা হয়েছে ভুলে যাও। আমি বলবো, যা হয়েছে সেটা নিয়ে পরে থেকো না। বরং যা হয়েছে সেটা মাথায় রেখে এগিয়ে যাও‌। তবে অতীত ভুলো না! অতীতে অনেক কিছু হারিয়েছো বলেই যে অতীতকে জীবন থেকে মুছে ফেলতে হবে এমন নয়। জীবনের সাথে মিলিয়ে ফেলো। এমন ভাবে মেশাও যেনো, পেছন না ফিরলেও সেই অতীত চোখে ভাসে! অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনা যেনো আবার‌ও রিপিট না হয়। যদি সব ভুলেই যাও তাহলে, বার বার সেই ভুলটাই করবে, যা থেকে তুমি বাঁচতে চাইছো। মনে রেখো অতীত থেকে বাঁচতে নয়, বর্তমানে বাঁচতে হবে তোমায়, ভবিষ্যতের জন্য!”

আদ্রিশা অবাক নয়নে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ওনার কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সে। যেখানে সবাই তাকে অতীত ভুলে এগিয়ে যেতে বলছে, সেখানে বাবা বলছেন অতীত মনে রাখতে! কেনো? হামিদুর আহমেদ দাড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।আদ্রিশার চোখের পানি মুছে দিলেন। হালকা হেসে বললেন, ” বাবা হয়ে মেয়েকে অতীত ভুলতে মানা করছি বলে ভাবছো বাবা খুব নিষ্ঠুর তাই না! খুব খারাপ! কিন্তু কি জানো, রবিনকে যদি তুমি ভুলে যাও, তবে ভুলে যাবে তোমার জীবনে মুগ্ধর আগমনকে! ভুলে যাবে তোমার করা ভুলকে! ভুলে যাবে কাদের তুমি কষ্ট দিয়েছো! সবাইকে করা অপমান ভুলে যাবে। রবিনকে, তোমার অতীতকে ভুললে তুমি ভুলে যাবে ভালোবাসা কি?? তোমাকে এতো বড় ধোকা দেয়ার পর‌ও আমি বলবো ভুলো না ওকে! ওর মিথ্যেকে না ভুলে মনে রেখো। যাতে ভবিষ্যতে তোমায় আর কেউ ঠকালেও নিজেকে সামলাতে পারো। যারা আজ তোমায় আপন করে নিয়েছে, তাদের কখনো পর ভেবোনা! তাদের যে অসম্মান তুমি করেছো তা ফিরাতে না পারলেও পর্যাপ্ত সম্মান দিয়ো। কখনো যেনো, তোমার জন্য তাদের মাথা নত করতে না হয়। আর যদি নত করতেই হয় তবে যেনো, পুরুষ্কার গ্রহণের জন্য‌ই হয়, সম্মানের সহিত!”

আদ্রিশার চোখ ছলছল করছে। বাবার কথা এখন সে বুঝতে পারছে। সত্যিই তো, অতীত ভুলে গেলে তো সে ভুলে যাবে, মুগ্ধর প্রতিদান! ‌ও বাড়ির মানুষগুলো তাকে আপন করে নিয়েছে সেটাও কি সে ভুলে যেতো।!?হ্যাঁ, রবিনের ভালোবাসা মিথ্যে হলেও তার ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিলো না। তাহলে রবিনকে কেনো ভুলবে? রবিনকে আর ভালো না বাসা গেলেও মন থেকে মুছা যাবে না। নিজেকে শক্ত করতে হলেও রবিনকে মনে রাখবে সে। রবিনের দেয়া ধোকা কখনোই ভুলতে পারবে না। বরং তা মনে রেখেই, এগুবে ভবিষ্যতের দিকে! আর ঠকবে না সে! ধোকা তো তার প্রাপ্য নয়।

________________

আবার‌ও বিদায় বেলা! আরিয়া এখনো মুগ্ধর কোলে। ফিসফিসিয়ে মুগ্ধকে বললো, “এখনো, সময় আছে! দিয়ে দাও ফুপিকে। নয়তো আবার তোমার চুল ছিড়বো!” মুগ্ধ অসহায় মুখ করে আদ্রর দিকে তাকালো। আদ্র মুখে হাত চেপে হাসছে। মুগ্ধ আদ্রকে ইশারায় আরিয়াকে কোলে নিতে বললেও আদ্র অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

মুগ্ধ মুখ ফুলিয়ে আরিয়াকে বললো, “দেখুন মেডাম, আপনার ফুপি তো আর খেলনা নয় না, যে আমি চাইলাম আর নিয়ে চলে গেলাম। তোমার ফুপি যেতে না চাইলে, আমি কি তাকে জোর করে নিতে পারবো বলো?” আরিয়া বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়লো। হাতের পুতুলটাকে মুচড়াতে মুচড়াতে বললো, “তাহলে, আজ যদি ফুপি কাঁদে, তুমি তাকে নিয়ে যাবে না তো!? কথা দাও!” মুগ্ধ নিজের কথার জালে নিজেই আটকা পড়লো। আরিয়ার পুতুলের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে হালকা কেশে প্রমিজ করলো আরিয়াকে‌ ।

আদ্রিশা সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে। অবাক করার বিষয় হলো, এক ফোটাও কাঁদছে না সে‌ । রুমানা আহমেদ কেঁদে ভাসালেও মেয়ে আদ্রিশা তাকে সামলে হেসেই বিদায় জানাচ্ছে। মুগ্ধতো ভুত দেখার মতো চমকালো। তবুও আরিয়ার সাথে প্রমিজ করে বেঁচে গেছে দেখে বেশ খুশি হলো সে। কিন্তু আরিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেলো‌। মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “মিস্টার হিরো, ফুপি তোমায় ভালোবাসে। দেখো কাঁদছে না! তুমি কিন্তু ফুপিকে আমার থেকে দূরে করবে না! ফুপি আমাকেও তো কত্ত ভালোবাসে!”

মুগ্ধ আরিয়ার কপালে ছোট্ট চুমু দিয়ে বললো, “একদম‌ই না। আরুর হিরো কি আরু কে তার ফুপি থেকে দূরে করতে পারে?”

আরিয়া এবার কেঁদেই দিলো। মুগ্ধর কাধে মাথা রেখে কাঁদছে এখন। মুগ্ধ‌ও তাকে জড়িয়ে আছে‌ আর ভাবছে, সারাদিন যাকে থ্র্যাড দিলো সন্ধ্যেতে তার কাধটাকেই কাঁদার জন্য বেছে নিলো! আবার‌ও আদ্রিশার ছায়া দেখতে পেলো আরিয়ার মধ্যে। কোনো এক অজানা কারনে আদ্রিশাকে তার সমস্ত কল্পনায় দেখতে পায় মুগ্ধ!

আরিয়াকে কোলে নিয়ে কানে কানে কিছু বললো আদ্রিশা সাথে সাথেই খিলখিল করে হেসে উঠলো আরিয়া। তার হাসির ঝংকারে পুরো পরিবারের বুকে প্রশান্তি খেলে গেলো‌ । হালকা হতে লাগলো বুকের বোঝ। স্নিগ্ধ‌ও মুচকি হাসছে। তবে তার হাসির কারন আরিয়ার জন্য নয় , রুহির জন্য। সারাদিন ঘোরার খাটুনি খেটে অবশেষে বিকেলে রুহির আইডির দেখা পেলো। খুশির অন্ত নেই তার। প্রোফাইলে রুহির ছবিটা দেখেই প্রথমে নাচতে ইচ্ছে করলো তার। পরোক্ষনেই রাগে চোখ দিয়ে আগুন বেরুতে লাগলো। এতো সুন্দর ছবি দেয়ার কি আছে ফেইসবুকে!? কতশত ছেলে দেখছে তাকে? ইচ্ছে করছে এক্ষুনি কষে থাপ্পর দিতে‌ । আবার‌ও হাসছে এটা ভেবে যে, সামান্য ছবি দেয়া নিয়ে এতো রাগছে সে! সত্যিই ভালোবাসে রুহিকে! হ্যাঁ, এটা ভালোলাগা নয় , ভালোবাসা। এই অনুভুতি শুধু কিছু দিনের খুনশুটির জন্য নয়, রুহিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য!

চলবে,,,,,,,,

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ২৬
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

বিয়ের আমেজ শেষ হতেই, বাড়িতে লোকজনের সমাগম কমতে লাগলো। ফিরা যাত্রার দু দিনের মাথায় বাড়ি একদম ফাকা হয়ে গেলো। মুগ্ধ‌ও অফিস জয়েন করেছে এর মধ্যে। আদ্রিশার খুব একা লাগে নিজেকে এই বাড়িতে।শাশুড়ি ছাড়া দিনের বেলা ঘরে আর কেউ থাকে না। কাজের লোক একজন আছে, সেও সকালে এসে দুপুরের আগে চলে যায়! ‌এত্তবড় বাড়িতে শুয়ে বসে কাটানো ছাড়া কিছুই করার নেই বলেই ধারনা আদ্রিশার। আজ সকালে মুগ্ধ আর তার বাবা বাইরে যেতেই শাশুড়ি মালিহা ইয়াসমিন আদ্রিশাকে নিয়ে বাগানে গেলেন। বাড়ির পেছনে বাগান আছে তা জানতো আদ্রিশা। তবে বাগানটা যে ফুলের তা তার অজানা ছিলো। ভেবেছিলো তার বাড়ির মতোই হয়তো অর্ধেক খালি মাঠ হবে। কিন্তু না। পুরো মাঠ জুরে ফুল! আদ্রিশার প্রিয় ফুল গোলাপ গাছ‌ও আছে! ফুলগুলো দেখেই কেমন আনন্দে নেচে উঠলো আদ্রিশা। মালিহা ইয়াসমিন হাতে পানির জগ নিয়ে এগিয়ে দিলেন আদ্রিশার দিকে। বললেন, “আমি মাঝে মাঝেই পানি দিই গাছগুলোতে। আর বাকি সময় তোমার বাবা দেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাগানে হাটতে তার ভালো লাগে। আমি বাবা, ওতো সকাল বাইরে আসি না! তবে, ছাদে যাই! ছাদের পরিবেশ ভালোই লাগে!”

আদ্রিশা ভ্রু কুঁচকে বললো, “মা, ছাদের চেয়ে তো এই বাগানের পরিবেশ‌ই ভালো। না মানে, ফুলের সুগন্ধ আর সতেজ হাওয়া অন্যরকম অনুভুতি হ‌ওয়ার কথা! কিন্তু আপনার কেনো অপছন্দ?”

মালিহা খানিক হাসলেন। গাছের গোড়ায় পানি দিতে দিতে বললেন, “আসলে তোমার বাবা, ভোরে মসজিদ থেকে ফিরে বাগানে আসেন। আর তারপর ৭/ ৮ টা অব্দি বাগানে কাজ করেন! ‌ঐ সময় বাগানে ফুরফুরে বাতাসের জন্য আসা মানে ফেসে যাওয়া। কাজ করতে করতে হাপিয়ে উঠলেও থামাথামি নেই! একদিন দুদিন না হয় করা যায়! কিন্তু রোজ রোজ কার ভালো লাগে বলতো? তাই ছাদে দাড়িয়ে ওনার কাজ দেখি। ওনি ভাবেন আমি ঘুমোচ্ছি!”

আদ্রিশা শাশুড়ির কথা শুনে হাসলো। ফুলের উপর হাত দিয়ে ছুয়ে চলেছে সে। মালিহা আদ্রিশার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন সে ফুলের উপর বসা ছোট্ট প্রজাপতিটাকে দেখছে! তিনি দ্বিধা ভরা কন্ঠে হঠাৎই বললেন, “আপার কথায় কিছু মনে করো না আদ্রিশা!”

আদ্রিশার ধ্যান ভেঙে গেলো। মালিহার দিকে না তাকিয়েই কথা ঘুরানোর জন্য বললো, “মা, ফুলের চারা গুলো কি বাবাই লাগিয়েছেন?”

মালিহা হালকা হেসে আদ্রিশাকে বললেন, “মারে, আমি জানি, তুই কথা ঘুরাচ্ছিস! ‌আমি তোর শাশুড়ি হতে পারি কিন্তু মাও তো! সবার থেকে লুকোতে পারলেও আমার থেকে লুকোতে পারবি না। তাই চেষ্টাও করিস না।”

আদ্রিশার মুখটা কালো হয়ে গেলো। সত্যিই সে কথা ঘুরাচ্ছিলো কারন ঐসব কথা মনে করতে চায় না। মুগ্ধর ফুফুর কথায় অনেক কষ্ট পেয়েছিলো সে। বিয়ের দিনের কথা বাদ দিলেও তার পর তিনি যা করেছেন তা কোনোভাবেই বাদ দেয়া যায় না। গত দিন মনোয়ারা বেগম তার বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। সেখান থেকেই প্রবাসে যাত্রা করবেন। যাওয়ার সময় আদ্রিশা তাকে সালাম করতে এলেই পা সরিয়ে নেন তিনি। আদ্রিশাকে উদ্দেশ্য করেই কটু কথা শুনিয়ে দেন। যদিও কথাগুলো সরাসরি বলেন নি তবে, প্রত্যেকটা কথাই দাগ কেটে গেছে আদ্রিশার মনে! মালিহা ইয়াসমিনকে সাবধানে থাকার কথা বলতে গিয়ে বলেন আদ্রিশাকে চোখে চোখে রাখতে। সবার থেকে বিদায় নেয়ার বাহানায় আদ্রিশাকে আবার‌ও চরিত্রহীনার পদবী ধরিয়ে দেন! বাকি ছিলো তার জন্ম নিয়ে কথা বলা! যাও তিনি বলতে শুরু করেছিলেন তবে আদ্রিশার শ্বশুড় শ‌ওকত শাহের জন্য সম্ভব হয় নি। বোনকে ধমকে চুপ করিয়ে দেন তিনি‌। এই অপমানটা হয়তো গায়ে লেগেছিলো মনোয়ারা বেগমের। তাইতো গাড়িতে উঠার পূর্বমুহুর্তে আদ্রিশাকে কখনো সুখি না হ‌ওয়ার অভিশাপ দেন। সারাটাজীবন চোখের জল ফেলেই কাটাতে হবে বলে ভবিষ্যত বাণী করেন। আদ্রিশা যদিও জানে, মুগ্ধর সাথে সংসার জীবন বেশিদিনের নয়, তবুও ফুফু শাশুড়ির কথায় আৎকে উঠেছিলো।

মালিহার ঝাকুনিতে বাস্তবে ফিরে আদ্রিশা। মালিহা তাকে বাগানের দোলনায় বসালেন। পাশে বসে বললেন, “উনি এমন না জানিস! খুব ভালোবাসতে জানেন! মনে আছে, শপিংএ তারপর হলুদে কেমন হেসে হেসে কথা বলছিলেন! তোর ঐ রিসেপশনের শাড়িটা! ওটাওতো আপার পছন্দের।তোকেও পছন্দ করেছিলেন খুব! বলেছিলেন,মুগ্ধর জন্য তোর থেকে ভালো মেয়ে পাওয়া অসম্ভব । বিয়ের আগে অব্দি সব‌ই ঠিক ছিলো, তবে অতীতকে আবার‌ও সামনে দেখে ভয় পেয়েছিলেন বোধহয়! তাই ওসব কথা বলছেন।”

আদ্রিশা মালিহার দিকে তাকালো। মালিহা বললেন, “হুম রে, অতীত! ভয়ঙ্কর অতীত!”

আদ্রিশা নড়েচড়ে বসে বললো, “কিসের অতীত, কার অতীত?”

মালিহা বললেন, “আপার অতীত!”

আদ্রিশা কোনো কথা না বলে, মালিহার দিকে মনোযোগ দিয়ে বসে আছে। মালিহা একটা লম্বা শ্বাস টেনে বললেন, “২৬ বছর আগে আপার বিয়ে ঠিক হয় মুগ্ধর বাবার বন্ধুর সাথে। আপাও মনে মনে তাকে ভালোবাসতেন। দুপরিবারের খুশি দেখে কে! মুগ্ধ তখন সবে একবছর। আমার মুগ্ধকে আপাই মানুষ করেছেন। আদরের কোনো কমতি নেই তার কাছে। বিয়ের ডেট আগাতে লাগলো‌। এদিকে মুগ্ধর বাবা আর তার বন্ধু দুজনে মিলেই বিজন্যাস শুরু করেছিলেন। বন্ধুত্ব, পার্টনার শীপ, আর তারপর এক নতুন সম্পর্কের শুরু হতে যাচ্ছিলো! কিন্তু ভাগ্যের লিখন কি আর পরিবর্তন করা যায়!? বিয়ের দিন কনের সাজে আপা আসরে বসেছিলেন। বর‌ও এলেন। তবে একা নয়। ভরা আসরে অন্য এক মেয়েকে নিয়ে আসেন তিনি! বিয়ের পোশাকে দুজনকে দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছিলো বিয়ে করে ফিরেছেন তারা। তবুও আমরা ভাবছিলাম সব মিথ্যে! নিশ্চয় ওরা মজা করছে! কিন্তু মজা ওরা করে নি করেছে আমাদের ভাগ্য! ‌মুগ্ধর বাবা আর তার বন্ধুর মাঝে মারামারি লেগে যায়! বরযাত্রী কোনোভাবে পালিয়ে বাঁচে! বন্ধুত্ব তো ওখানেই শেষ হয়! শুরু হয় দুশমনি! আপা আসর থেকে ছুটে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা দিলেন। কারো ডাকেই সারা দেন নি। দরজা ভাঙার পর আপাকে সিলিংএর সাথে ঝুলে থাকতে দেখে, ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে যায় আমাদের! হাসপাতালে নিয়ে অনেক কষ্টে বাঁচানো গেছিলো। আপার ঐ অবস্থা দেখে আমার শশুড়ের এট্যাক হয়! ২য় বার ছিলো তখন। শয্যাসায়ী হয়ে পড়ায় বাধ্য হয়েই আবার‌ও আপার বিয়ের আয়োজন হয়। আপার চিকিৎসক ঐ হাসপাতালের ডাক্তার বাবার দূরসম্পর্কের বোনের ছেলে ছিলেন। তিনি আপাকে বিয়ে করতে রাজি হন! এক সপ্তাহের মাথায় বিয়ে হয়ে যায় তাদের।” আদ্রিশা ভাবছে, এতোটা কষ্ট পেয়েছেন বলেই হয়তো আদ্রিশার করা কাজটা ভুলতে পারছেন না তিনি।

মালিহা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আবার‌ও বললেন,” ২৬ বছর আগে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা মুগ্ধর সাথে হচ্ছে বলে মেনে নিতে পারেন নি তিনি! তাই প্রয়োজনের অধিক বলে ফেলেছেন। কিন্তু বিশ্বাস কর, এতো বছরের পুষে রাখা রাগটাই তোর উপর ঝেড়েছেন তিনি! আসরাফ খানের দেয়া ধোকা আজ‌ও পুরায় তাকে!”

আদ্রিশা মন দিয়ে সব শুনছিলো। চোখ‌ও ভরে এসেছিলো তার । কিন্তু নামটা শুনে ভরকে গেলো আদ্রিশা। আমতা আমতা করে বললো, “কি নাম বললেন মা!”

মালিহা দাঁতে দাঁত চেপে থমথমে গলায় বললেন, “আসরাফ খান!”

আদ্রিশার মনে পরলো মুগ্ধর বলা কথাগুলো। এতোদিনে মুগ্ধর সাথে হাজার‌ও কথা হলেও, তিথির বাবার সাথে তাদের পারিবারিক শত্রুতার কথা জানতে চায় নি সে। মুগ্ধ‌ও নিজে থেকে বলে নি, তাই আদ্রিশাও ভুলে গিয়েছিলো বিষয় টা! কিন্তু এখন বুঝলো, সত্যিই এমন একজনের মেয়ের সাথে কিছুতেই মুগ্ধর বিয়ে মেনে নেবেন না শ‌ওকত শাহ। মালিহা আদ্রিশার কাধে হাত রেখে বললেন, “কিরে কি ভাবছিস?” আদ্রিশা চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “কিছুনা। ভাবছিলাম, ফুপি কতটা অসহায় বোধ করেছিলো তখন! কতটা আঘাত পেলে ২৬ বছর পর‌ও রাগটা পুষে রাখা যায়! আচ্ছা, মা আপনিও কি এই কথা ভেবেই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন?”

মালিহা মাথা নেড়ে বললেন, “ধরে নিতে পারিস! আসলে, মুগ্ধ যখন বললো, ও জানতো তুই বিয়েতে রাজি নস তারপর‌ও তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে আমি তখন‌ই বুঝে গেছি, ছেলে আমার তোকে ব‌উ করতে চায়! ‌আর তুইও নিজের ভূল বুঝতে পেরেছিলি! ভাবলাম অমত করলে যদি আমার ছেলেটাও উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে! ভাগ্য তো বদলানো যায় না! সব যখন ঠিক হয়েই গেছিলো তখন আর আমি বা আমরা বাধা দেয়ার কে?”

আদ্রিশা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মনে মনে বললো, “আপনার বুঝাতেই ভুল ছিলো। বিয়েতে অমত করলে আপনার ছেলে উল্টো পাল্টা কিচ্ছুটি করতো না, বরং নাগিন ডান্স দিতো! কিন্তু ভাগ্য ভাগ্য বলে আপনি আর আপনারা আমাদের ভাগ্য পাল্টে দিলেন! ‌আরে আপনারাই তো বাধা দেয়ার সব! একবার বলে দিতেন, এই মেয়ের সাথে বিয়ে দেবো না! তা না করে, আপনিই তো ছেলে আর ছেলের নকল ব‌উয়ের বিয়েটা করিয়ে ছাড়লেন! ‌যখন তিথি আর মুগ্ধর সত্যিটি সামনে আসবে তখন যে কি করবেন আল্লাহ জানে।”

মালিহা হঠাৎ বললেন, “কি রে আবার কোন ভাবনায় ডুব দিলি?” আদ্রিশা কিছু বলবে তার আগেই আবার বললেন,”ধ্যাত , আমি তোমায় কখন থেকে তুই তুই করছি আটকাবে না!?” আদ্রিশা মালিহার হাতে হাত রেখে বললো, “আপনি তুই করেই বলুন না! ভালো লাগছে শুনতে!” মালিহা হাসলেন। আদ্রিশাকে তুই বলার পরিবর্তে তার হাতে ধরিয়ে দিলেন শাশুড়িকে ‘তুমি’ বলার শর্ত! আদ্রিশার এখন শাশুড়িকে আপন লাগছে। খুব আপন! ‌এতোদিনেও যাকে আপন মনে হয় নি, আজ ছোট্ট একটা শব্দ ‘তুই’-তে আপন মনে হচ্ছে! ভেবেই হাসলো আদ্রিশা! আজ আর কোনো বাধা পাচ্ছে না সে। অপরাধবোধটাও কমছে হয়তো। ভালো লাগছে সবকিছুই! এক অন্যরকম ভালো লাগা!

চলবে,,,,,,,,,