যদি আমার হতে পর্ব-২৭+২৮

0
569

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ২৭
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

রান্নাঘরে শাশুড়ি ব‌উ মিলে রান্না করছেন আর গল্প করছেন। মুগ্ধ রান্নাঘরের পাশ কেটে যাওয়ার সময় আদ্রিশার হাসির আওয়াজ শুনে দাড়িয়ে পড়ে। মাত্র‌ই অফিস থেকে ফিরলো মুগ্ধ। ঘরে আসতেই এরকম দৃশ্য দেখবে তা তার অজানা ছিলো। তবে এই দৃশ্যে মন ভরে উঠলো মুগ্ধর । আনমনে হেসেই শোবার ঘরে ঢুকলো সে।

টেবিলে খাবার সাজিয়ে মুগ্ধকে ডাকতে গেলো আদ্রিশা। মুগ্ধ ল্যাপটপে কাজ করছিলো। আদ্রিশা দরজার পাশ থেকে দুবার ডাকলেও মুগ্ধর কোনো জবাব পেলো না। ঘরে ঢুকে মুগ্ধর পাশে দাড়িয়ে বললো, “এই যে শুনছেন না ডাকছি আপনাকে?”

মুগ্ধ ল্যাপটপে চোখ রেখেও বললো, “হুম”

আদ্রিশা আবার বললো, “খেতে আসুন। কখন থেকে ডাকছি আপনাকে! কি হলো আপনি শুনেছেন আমি আপনাকে কি করতে বলছি?”

মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো, ” হুম হুম। আসছি!”

আদ্রিশা চোখে মুখে রাগ ফুটিয়ে বললো, “কোথায় আসছেন?”

মুগ্ধ ভ্রু উচিয়ে বললো, “আসছি আসছি। আপনার সাথেই আসছি!”

আদ্রিশার বুঝতে বাকি নেই যে মুগ্ধ তার কথায় কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। কাজের প্রতি এতো মনোযোগ অথচ পাশে দাড়িয়ে তার ব‌উ যে কতকিছু বলছে তাতে কোনো খেয়াল‌ই নেই। যত‌ই হোক ব‌উ তো! রাগ যেনো ধরছেই না তার। হুট করে মুগ্ধর সামনে এসে এক টানে ল্যাপটপটা নিজের হাতে নিয়ে বন্ধ করে দিলো আদ্রিশা।আদ্রিশার এহেন কাজে মুগ্ধ তব্দা মেরে বসে র‌ইলো। ব্যাপারটা বুঝে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে বললো, “হোয়াট দ্যা হেল! কাজ করছিলাম তো আমি, না কি?”

আদ্রিশা চুল কানের পাশে গুজে না জানার ভাব করে বললো, ” ওহহ,, তাই বুঝি! আপনি কাজ করছিলেন?”

মুগ্ধ দাঁত কটমট করে বললো, “আপনি দেখেন নি?”

আদ্রিশা ঠোঁট উল্টে হাত নেড়ে বললো, “ক‌ই না তো!”

মুগ্ধ এক হাত কোমরে দিয়ে আর অন্য হাত দিয়ে কপাল ডলে বললো, “একটা জলজ্যান্ত মানুষ সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আর আপনি দেখেন‌ই নি! ওয়াও! বাট হাও?”

আদ্রিশা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো, ” যেভাবে আপনার পাশে দাড়িয়ে একজন জলজ্যান্ত মানুষ খাওয়ার জন্য ডাকছিলো অথচ আপনার কানে ঢুকলোই না, ঠিক সেভাবে আমিও আপনাকে দেখে নি!”

মুগ্ধ জিব কেটে বললো, “ওহ, আসলে কাজ খুব ইম্পরটেন্ট ছিলো তাই খেয়াল করি নি!”

আদ্রিশাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মুগ্ধ। আদ্রিশা বোকার মতো এখনো দাড়িয়ে আছে। কি হলো কিছুই বুঝলো না সে। কথা বলার মাঝখানে এভাবে চলে যাওয়ার মানে কি? ওর কি খিদে পেয়েছিলো না কি? খিদে পেলে আগে এতো ডাকার পর‌ও কাজ ছাড়লো না আর যখন ডাক কানে গেলো ওমনি খেতে চলে গেলো! আজব! ‌একা একা বকবক করে ডাইনিংএ গেলো আদ্রিশা। গিয়ে দেখে বাবা মা আদ্রিশার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, আর মুগ্ধ খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আবার‌ও রাগ লাগলো আদ্রিশার। সবাই একসাথে খেলে কি হতো? এতো তাড়াহুড়ার কি আছে? রাক্ষস না কি ও? ব‌উয়ের জন্য অপেক্ষাও করা গেলো না! সারাক্ষন কাজ কাজ করে, রোমান্টিকতা না‌ই থাকতে পারে কিন্তু ভালো করে কথাও বলতে পারে না, না কি? এই বোরিং ছেলেটা, যে কি না প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না তার গার্লফ্রেন্ড আছে!? বিশ্বাস যোগ্য মনে হচ্ছে আদ্রিশার। ভাবছে, কে সেই তিথি, যে কিনা মুগ্ধকে সামলাতে পারছে? মুগ্ধকি ওর সাথে হেসে হেসেই কথা বলে? নিশ্চয়, বলে! তিথিকে তো ভালোবাসে মুগ্ধ। আর আদ্রিশা! ওতো শুধুই তার রেসপন্সিবিলিটি!!

_____________

রাতে শোবার সময় আদ্রিশা বিছানা ঠিক করছে। এখন আর তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় নি‌ । দুজন‌ই নিজেদের ঘুমানোর জায়গা ডিসাইড করে ফেলেছে। আদ্রিশা বালিশ ঠিক করে বিছানায় রেখে মুগ্ধকে বললো, “মুগ্ধ এমন কোনো কথা আছে কি, যা আপনি আমাকে এখনো জানান নি?বা ভুলে গেছেন!”

মুগ্ধ বেডসাইড ড্রয়ারে ফাইল রেখে বললো, “না, এমন কোনো কথা তো আছে বলে মনে হচ্ছে না!”

আদ্রিশা মুখ ফুলিয়ে বললো, “মনে করার চেষ্টা করুন!”

মুগ্ধ কাধ ঘুরিয়ে আদ্রিশাকে বললো, “বললাম তো মনে পরছে না আদ্রিশা! আপনি বলুন কি জানতে চান। বলছি আমি!”

আদ্রিশা বিছানায় শুয়ে উল্টো দিকে ঘুরে মিন মিন করে বললো, “মনোযোগ দিয়ে মনে করতে চাইলে ঠিক‌ই মনে হতো আপনার। আমি কেনো বলবো যে, আপনার হবু শশুড়ের সাথে আপনাদের পারিবারিক শত্রুতার কারন কি তা আমায় এখনো বলেন নি!? হুহ,,, বলবো না আমি, জানতেও চাইবো না!”

আদ্রিশার কথাগুলো কর্ণগোচর হলো মুগ্ধর। বালিশে হেলান দিয়ে বললো, “আচ্ছা ,তো আপনি এই বিষয় জানতে চাচ্ছিলেন!? ‌কাজের চাপে ভুলেই গেছিলাম। আপনিও তো বলতে পারতেন!”

আদ্রিশা মুখ ঘুরিয়ে মুগ্ধর দিকে তাকালো‌ । মুগ্ধ‌ও বলতে লাগলো আসরাফ খান আর শ‌ওকত শাহের মধ্যে দুশমনির কারন। আদ্রিশা মুগ্ধর বলা কথাগুলো শুনছে। যদিও মালিহার থেকে সব জেনেছে তবুও, মুগ্ধর থেকে শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তার। ভেবেছিলো, মুগ্ধ কথা ঘুরাবে, বলবে না বা কিছু লুকিয়ে যাবে! কিন্তু মুগ্ধ এসবের কিছুই লুকোয় নি। আদ্রিশা এই পরিবারের কেউ না হ‌ওয়া সত্ত্বেও কতো সুন্দর তাকে এ পরিবারের একজন করে নিলো‌ । আদ্রিশার কাজগুলো তো খুব বিরক্তিকর লাগার কথা মুগ্ধর কাছে, অথচ আদ্রিশার সাথে খুনশুটি করে, বিরক্তিকে গায়েই মাখছে না মুগ্ধ! স্ত্রী না মানলেও স্ত্রীর সম্মান দিচ্ছে। অধিকার ঠিক‌ই দিচ্ছে না তবুও বিশ্বাস করছে। বন্ধু ভাবছে! প্রেমিকা থাকার পর‌ও অন্য এক মেয়ের সাথে এক‌ই ছাদের নিচে, এক‌ই ঘরে ঘুমুচ্ছে! কখনো এক‌ই বিছানায় মাঝখানে বালিশের স্তুপ তো, কখনো ঝগড়ায় ক্লান্ত হয়ে সোফায় শুয়ে পরছে বেচারা। তবুও নেই কোনো অভিযোগ! রাগের মাথায় ওতো বলতে পারে কিছু! হাসি মুখেই সবার সামনে নাটক করছে, আবার ঘরের ভেতর নাটক ছাড়াই ঐ এক‌ই ব্যবহার করছে, যা বাইরে সবার সামনে প্রযোয্য! ‌আদ্রিশার দেখা সবথেকে ভালো, ভদ্র, আর অতীব সম্মানীয় ব্যাক্তিদের মধ্যে মুগ্ধ‌ও একজন! তিথিও কি সব জানে? আদ্রিশা মুগ্ধর সাথে এক‌ই বিছানায় থাকছে, ব্যাপারটা ও কি ভাবে নেবে, ভেবেই বুক ধক করে উঠলো আদ্রিশার। একটা মেয়ে সব সহ্য করতে পারলেও ভালোবাসার ভাগ আর কাউকে দিতে পারে না। তৃতীয় ব্যাক্তির প্রবেশ তো কখনোই সহ্য করার মতো নয়। তবে কি মুগ্ধ তিথিকে জানায় নি এসব বিষয়? প্রয়োজনীয় কথা রেখে অপ্রয়োজনীয় কথা বলায় নিজের উপর‌ই রাগ লাগছে আদ্রিশার। যে কথা আগেই শাশুড়ি বলেছেন, সেই কথা রেখে যা অজানা তাও তো জানতে পারতো! মুগ্ধকে পরীক্ষা করার জন্য শুধু শুধু সময় আর সুযোগ হারালো সে‌ । মনে মনে ভাবলো, কাল যেভাবেই হোক, তিথির সম্পর্কে সব জানবে সে! তারপর, বিছানা থেকে নেমে নিজের কাথা বালিশ নিয়ে সোফায় চলে গেলো‌ । মুগ্ধ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আদ্রিশার সাথে কথা বলা শেষ হতেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে সে‌ । এখন তার এই ঘুম ভাঙবে না‌ । মুগ্ধর শরীরে ভালো করে কাথা জড়িয়ে দিয়ে পেছন থেকে একটু ঠেলে দিলো আদ্রিশা। মাঝখানে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে একেবারে কোণায় শুয়েছিলো মুগ্ধ। আদ্রিশার হালকা ধাক্কানোতে কোণা থেকে বেশ অনেকটা সরে আয়েশ করে শুলো মুগ্ধ। আদ্রিশাও সোফাতে নিজের জায়গা করে নিলো।

চলবে,,,,,,,,

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ২৮
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

অনবরত কানের কাছে টু টাং আওয়াজ হ‌ওয়ায় ঘুম ভাঙে মুগ্ধর। আওয়াজ অনুসরণ করে চোখ বন্ধ করেই হাত বাড়ালো মুগ্ধ। বালিশের পাশ থেকে ফোন উঠিয়ে কানে লাগালো সে। ওপর পাশ থেকে চিন্তিত সুরে ম্যানেজার ম‌ঈন উদ্দীন বলে উঠলেন, “স্যার, এতো দেরি করছেন যে! তাড়াতাড়ি আসুন।”

মুগ্ধ বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো, “হু, আসছি। রাখুন।”

ম‌ঈন উদ্দীন কি ভেবে আবার‌ও বললেন, “আপনার মনে আছে তো আজকের মিটিংএর কথা?”

মুগ্ধ রাগি স্বরে বললো, “মনে না থাকার কি আছে‌ । আমার আপনার মতো ভুলো মন নেই, আদ্রিশা!”

ম‌ঈন উদ্দীন চমকে উঠে বললেন, “কি বলছেন স্যার এসব!? আপনি ঠিক আছেন তো?”

মুগ্ধ উঠে বসলো।ঘার থেকে গলা অব্দি হাত বুলিয়ে বললো, “আমার আবার কি হবে? আর কি এমন বললাম?”

ম‌ঈন উদ্দীন আমতা আমতা করে বললেন, “আপনি আমায় আদ্রিশা বললেন কেনো?”

মুগ্ধ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। ও যে ম্যানাজারকে আদ্রিশা বলে সম্মোধন করছে তা তার খেয়াল‌ই ছিলো না। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ম‌ঈন উদ্দীন সন্দেহী গলায় বললেন, ” সামহাও আপনি কি অসুস্থ স্যার। না মানে, কাল‌ও কেমন ছন্নছাড়া ব্যাবহার করছিলেন, আর আজ এতো বেলা অব্দি অফিসে এলেন না, আমাকে আবার আপনার ব‌উ মনে হচ্ছে, আবার কি বলছেন না বলছেন তার‌ও খেয়াল নেই! আপনি চাইলে আমি কোনো হুজুরের থেকে,,,, ”

মুগ্ধ দিলো এক ধমক। সফ্টোওয়ার কোম্পানির ম্যানেজার হলে কি হবে, পীর হুজুরের প্রতি তার অধিক বিশ্বাস। যাকে বলে অন্ধ বিশ্বাস। মুগ্ধর রাম ধমকে, থতমত খেয়ে ফোন কেটে দেন তিনি‌। এদিকে হাত থেকে ফোন নামিয়ে নিজের অবস্থান বুঝে ভড়কে যায় মুগ্ধ। রাতে বিছানার কোনায় শুলেও এখন মধ্যেখানটায় বসে আছে। বালিশ আর কাঁথার স্তুপ আদ্রিশার ঘুমানোর স্থানে! মুগ্ধ চারদিকে তাকিয়ে আদ্রিশাকে দেখতে না পেয়ে বালিশের উপুর হয়ে বিছানার অন্যপাশের মেঝে চেক করলো। ভেবেছিলো, হয়তো কোনোভাবে আদ্রিশা নিচে পড়ে গেছে। ঘুমের ঘোরে উঠে নি হয়তো। কিন্তু না। আদ্রিশাকে নিচে না দেখে একটু স্বস্তি পেলো মুগ্ধ। ভাগ্যিশ নিচে পড়ে নি, নয়তো মুগ্ধকে ঝেড়ে দিতো একদম! কিন্তু এতো সকালে রুম থেকে গেলো ক‌ই? বাজে কয়টা, ভেবেই ফোনের স্ক্রিণে তাকিয়ে আৎকে উঠলো মুগ্ধ। ১০ টা বাজতে চলেছে! অথচ আজ তার মিটিং সারে ১০ টায়! কেউ ডাকলোও না তাকে! রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে তার। তবে এখন রেগে সময় নষ্ট করা যাবে না। ঝটপট বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে ছুটলো মুগ্ধ।
______________

টেবিলে ফাইলের পাহাড় সাজিয়ে হাতে গরম কফির মগ নিয়ে বসে আছে মুগ্ধ। মাঝে মাঝে কাপে চুমুক‌ও দিচ্ছে। কেবিনের দরজায় টোকা পড়ায় ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো মুগ্ধ। ম্যানেজার ম‌ঈন উদ্দীন ঠোঁটে রহস্য জনক হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে এলেন মুগ্ধর দিকে। তার হাসি সুবিধার ঠেকছে না মুগ্ধর কাছে। মুগ্ধ কফির মগ টেবিলে রেখে এক গাদা ফাইল তুলে দিলো ম‌ঈন উদ্দীনের হাতে। সাথে সাথেই মিলিয়ে গেলো তার হাসিটুকু। মুখ গোমরা করে ম‌ঈন উদ্দীন বললেন, “স্যার, আমায় কেনো দিলেন? এগুলো তো মিস্টার সেলিমের জন্য ছিলো না!” মুগ্ধ মাথা নেড়ে বললো, “এক্সেক্টলি তাই! বাহ মনে আছে দেখছি! যান যান, ওনাকে দিয়ে আসুন!” ম‌ঈন উদ্দীন ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বললেন, “ওকে স্যার। দিয়ে আসছি আমি।” ম‌ঈন উদ্দীন দরজার দিকে অগ্রসর হতেই তাকে থামিয়ে দিলো মুগ্ধ। বললো, “আর আসার দরকার নেই আমি ব্যাস্ত আছি!” ম্যানেজার চোখ বড় বড় করে বললেন, “মাত্র‌ই না আরাম করে কফি খাচ্ছিলেন! এতো তাড়াতাড়ি ব্যাস্ত হয়ে গেলেন?” মুগ্ধ হাত দিয়ে টাই টেনে বললো, “হ্যাঁ, এখন অনেক কাজ আমার। নিউ প্রজেক্ট আছে না, ঐটা নিয়েই খুব চিন্তায় আছি। সো এখন আমায় একদম বিরক্ত করবেন না। কি হলো দাড়িয়ে আছেন যে, যান। ফাস্ট!” ম‌ঈন উদ্দীন ফাইলের বুঝা নিয়ে প্রস্থান করলেন।

মুগ্ধ আনমনে বসে আছে। কফির মগে চুমুক দিতে গিয়ে খেয়াল হলো কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। মগ পাশে রেখে আবার ভাবনায় মগ্ন হলো সে‌ । আজ আদ্রিশার ব্যবহার বেশ উদ্ভট ছিলো মুগ্ধর প্রতি। আফিসের তাড়াহুড়ায় চটজলদি রেডি হয়ে ডাইনিং এ গিয়ে দেখে আদ্রিশা ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে। মুগ্ধ রেগে আদ্রিশাকে শুধু বলেছিলো, “সকালে ডাকতে পারলেন না! এমনি তো সারাদিন অদরকারি কাজে বক বক করে পাগল করে তুলেন। আর আজ এতো বেলা হয়ে গেলো! ডাকেন নি কেনো আমায়?” আদ্রিশা তেতে উঠে বললো, “আর জালাবো না! শান্তি দেবো আজ থেকে!”

আদ্রিশার কথায় মালিহা আর শ‌ওকত শাহ‌ও অবাক হয়েছেন। মুগ্ধ আর কিছু না বলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু মালিহা ছেলেকে টেনে খাবার খেতে বসিয়ে দেন। অগত্যা খাবার খেতে হয় মুগ্ধকে‌ । আদ্রিশাও পাশে বসে ছিলো সম্পূর্ণ সময়। কিন্তু একটা কথাও বলে নি। মুগ্ধ‌ও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অফিসে আসতেও অনেকটা দেরি হয় তার। ফলস্রুতিতে মিটিং দেরিতে শুরু হয়। মিটিংএ যেনো ডিস্টারবেন্স না হয় তাই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলো মুগ্ধ। আর এর মধ্যেই প্রায় শো খানেক ফোন করে বসে আদ্রিশা। মিটিং শেষে ফোনে আদ্রিশার এতো মিসড কল দেখে ঘাবরানোর সাথে অবাক‌ও হয় মুগ্ধ। হঠাৎ করে তাকে ফোন করার কোনো কারন খুজে পেলো না‌ । কল ব্যাক করেও কোনো লাভ হয় নি। বার বার ফোন বন্ধ বলছে। বাধ্য হয়ে ঘরের ল্যান্ডলাইনে ফোন করে মুগ্ধ। মা জানান, আদ্রিশা তার বাপের বাড়ি গেছে। বাবা মায়ের জন্য মন কেমন করছিলো তাই ওদের সাথে দেখা করতে গেছে, মুগ্ধকে ফোন দেয়ার ব্যাপারে কিছুই জানেন না তিনি। এরপর আদ্রিশার বাপের বাড়ি ফোন করেছিলো মুগ্ধ। এবার‌ও হতাশা ছাড়া কিছু জুটলো না। জেসমিন ফোন রিসিভ করে বললো, আদ্রিশা পাশে নেই এলে বলবে ফোনের কথা। অথচ এখনো ফোন করেনি আদ্রিশা‌। মুগ্ধ বুঝতে পারছে না কি হয়েছে আদ্রিশার। যে মেয়ে ঝগড়ার হাজার‌ও ছুতো বের করতে পারে সে কথাই বলছে না! মুগ্ধর মনে হচ্ছে, নিশ্চয় রাতে ঘুমের ঘোরে আদ্রিশার উপর হাত পা তুলে দিয়েছে! আর না হলে, ওর কোনো কাজে আদ্রিশা ব্যাপক কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এমন কোনো কাজের কথা মনেও পরছে তার। এই নিয়ে তিন বার গত রাত থেকে সকাল অব্দি করা সবকিছু ফ্ল্যাশব্যাকে দেখেছে সে! তবুও নিজের কোনো ত্রুটি পাচ্ছে না‌। এদিকে মালিহা কড়া গলায় ছেলেকে জানিয়ে দিয়েছেন রাতের মধ্যেই যেনো ব‌উ ঘরে আসে। মান অভিমান ভাঙিয়ে অতি শীঘ্র‌ই তাকে খুশি করতে হবে, এই আদেশ‌ও দেয়া হয়েছে বাবা মা দুজনের পক্ষ থেকে। বেচারা কোনো উপায় না পেয়ে কপাল চাপরাচ্ছে! আবার‌ও এন্ট্রি হলো, ম্যানেজারের! মুগ্ধর কোনো হেলদোল নেই। ম‌ঈন উদ্দীন দরজার বাইরে থেকে কয়েকবার টোকা দিয়েও মুগ্ধর সারা শব্দ পেলেন না। তাই অনুমতি ব্যতিত কেবিনে ঢুকলেন‌ । মুগ্ধকে চেয়ারে কপালে হাত রেখে বসে থাকতে দেখে মুখটা কালো করলেন তিনি‌ । মুগ্ধ বলেছিলো ব্যাস্ত কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চিন্তে আরাম করছে। গলা খাকরি দিয়ে বললেন ম‌ঈন উদ্দীন,

“স্যার, আপনি কি ব্যাস্ত?”

মুগ্ধ হকচকিয়ে উঠে ম্যানেজারকে দেখে বললো, “না!”

“তাহলে আমাকে যে বললেন ভীষন ব্যাস্ত! আর এখন দেখছি বসে আছেন।”

“ছিলাম। ব্যাস্ত ছিলাম। এই একটু আগে শেষ হলো কাজ!” ‌নিচু স্বরে বললো মুগ্ধ।

“কি কাজ করলেন জানতে পারি স্যার?” কৌতুহল নিয়ে বললেন ম‌ঈন উদ্দীন।

“কেনো নয়! তেমন কিছু না, মেডিটেশন করছিলাম!” দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললো মুগ্ধ।

“মেডিটেশন! কেনো?” ম‌ঈন উদ্দীন গভীর কৌতুহল নিয়ে বললেন।

“যাতে করে নিজের রাগ কে কন্ট্রোল করতে পারি!” বেশ শান্ত কন্ঠে মুগ্ধ বললো কথাটা। কিন্তু ম‌ঈন উদ্দীন এই শান্ত কন্ঠের পেছনে ভয়ানক রাগ উপলব্ধি করতে পারছেন। নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রেখে আবার‌ও বললেন ম‌ঈন উদ্দীন, “আমি দুঃখিত আপনার ব্যাক্তিগত বিষয়ে কথা বলার জন্য তবে আমার মনে হয় আপনার ম্যাডামকে কোনো উপহার দেয়া উচিত!এতে ম্যাডামের রাগ মিটবে।”

মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে ম‌ঈন উদ্দীনের দিকে এগিয়ে গেলো‌। এক ভ্রু উচিয়ে বললো, “আপনাকে কে বললো,ম্যাডাম রেগে আছেন? আর গিফ্ট‌ই বা কেনো দেবো?”

ম‌ঈন উদ্দীন একটু পিছিয়ে গেলেন। শুকনো ঢোক গিলে বললেন, “স্যরি স্যার। আসলে ঐ, বড় স্যারের সাথে কথা বলে একা একা বক বক করছিলেন, থুরি কথা বলছিলেন আমি শুনে নিয়েছিলাম! মনে হলো ম্যাডাম রেগে আছেন হয়তো। আর আমিও তো বিবাহিত পুরুষ! অভিজ্ঞতা আছে আমার। স্রীর যতোই রাগ থাকুক না কেনো, উপহার দিলে রাগ গলে জল!!”

মুগ্ধ হালকা কেশে বললো, “কিন্তু আমি তো জানিই না, কেনো উনি রাগ করেছেন?”

ম‌ঈন উদ্দীন চোখ পাকিয়ে বললেন, “উনি?”

মুগ্ধ চোখ কটমট করে তাকাতেই জোরপূর্বক হেসে, বললেন, “আরে স্যার, ওরা কেনো রাগে তা কি ওরা জানে ? আমি হরক করে বলতে পারি, ম্যাডামের রাগ গলে গেলে আপনি যখন জানতে চাইবেন, কেনো রেগেছিলেন, তিনি মোটেও বলতে পারবেন না কারন। আর এসব বিষয় না ভেবে, ওনার পছন্দের কিছু কিনে নিয়ে যান! দেখবেন, শুধু রাগ‌ই জল হবে না বরং খুশিতে আটখানাও হবেন!”

মুগ্ধর আইডিয়াটা খুব পছন্দ হলো। মুখে হাসি‌ও ফুটলো। কিন্তু আবার‌ও হাসি মিলিয়ে গেলো এই ভেবে যে, কি দেবে আদ্রিশাকে‌ । আদ্রিশার পছন্দের জিনিস সম্পর্কে তো কোনো ধারনাই নেই তার! মুগ্ধর অস্বস্তি হয়তো বুঝতে পারলেন ম‌ঈন উদ্দীন। অভিজ্ঞ গলায় বললেন, “চুরি, ফুল, আর চকলেট বা আইসক্রিম অথবা কোনো স্ট্রিট ফুড! মেয়েরা এসব ভালোবাসে স্যার!”

মুগ্ধ বুঝলো বোকার মতো আদ্রিশার পছন্দ খুঁজতে গেছিলো সে। সব মেয়েদের পছন্দ‌ই আদ্রিশার পছন্দের তালিকায় থাকার কথা। ম্যানেজারকে থ্যাংকস দিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পরলো মুগ্ধ। হালকা হেসে মনে মনে নিজেকেই বকলো। ভাবলো, তিথি এমনি এমনি তাকে ‘বুদ্ধু’ বলে না! সত্যিই তো কতো সহজ জিনিসটাকে জটিল করে তুলেছিলো সে‌। এখন শুধু আদ্রিশার মান ভাঙিয়ে তাকে বাড়ি আনার পালা।

চলবে,,,,,,,,,