যদি আমার হতে পর্ব-২৯+৩০

0
588

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ২৯
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে রান্নাঘরের কাজ ফেলে ছুটে গিয়ে দরজা খুললো জেসমিন। দরজায় মুগ্ধকে দেখে থম মেরে দাড়িয়ে র‌ইলো সে। মুগ্ধ‌ও অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। গলা খাকরি দিয়ে বললো, “ভাবি! কেমন আছেন?”

জেসমিনের ঘোর কাটলো। হাসার চেষ্টা করে বললো, “ভাইয়া, আপনি! মানে এসময়, এভাবে? কেমন আছেন?”

মুগ্ধ ঘরের ভেতরে চোখ রেখে বললো, “সব কথা এখানেই হবে! ভেতরে আসতে বলবেন না?”

জেসমিন গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললো, “এ মা! আমি, আসলে,,, আসুন না ভেতরে আসুন!”

মুগ্ধ ঘরে ঢুকতেই আরিয়া দৌড়ে এসে মুগ্ধর কোমর জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ বেশ ঘাবরে গিয়ে বললো, “হেই প্রিন্সেস!”

আরিয়া মুগ্ধকে জড়িয়ে রেখেই বললো, “হিরো, তুমি ফুপিকে একা আসতে দিলে কেনো? আর তোমার হাতে এগুলো কি?”

মুগ্ধ আরিয়ার থেকে কোনরকম নিজেকে ছাড়িয়ে বললো, “তুমিই তো বলেছিলো যেনো তোমার ফুপি কে তোমার থেকে দূরে না করি! আর একা কোথায়, এইতো আমি এসে গেছি!”

আরিয়া মুগ্ধর হাতের দিকে ইশারা করে বললো, “এগুলো কি বলবে তো!”

মুগ্ধ হাতের জিনিস গুলো সোফার সামনের টেবিল টায় রেখে আরিয়াকে কোলে তুলে নিলো। কানে কানে বললো, “তোমার ফুপির জন্য এগুলো!”

আরিয়া মুখ ফুলিয়ে মুগ্ধর দিকে তাকাতেই মুগ্ধ পকেট থেকে দুটো ক্যাডবেরি ধরিয়ে দিলো আরিয়ার হাতে। আরিয়া চোখ উজ্জল করে মুগ্ধকে জরিয়ে ধরলো। এতোক্ষনে বসার ঘরে এসে উপস্থিত হলেন হামিদুর আহমেদ আর রুমানা আহমেদ। মুগ্ধ আরিয়াকে নামিয়ে তাদের সালাম করলো। রুমানা আহমেদ জেসমিন কে ইশারা করে মুগ্ধর জন্য নাস্তা আনতে বললেন। জেসমিন‌ও শাশুড়ির কথা অনুযায়ি রান্নাঘরে গেলো। মুগ্ধ সোফায় বসে এদিক ওদিক দেখছে।

হামিদুর আহমেদ নাতনিকে ডেকে বলেন, “যাও তো দাদুভাই, ফুপিকে নিয়ে এসো। বলো মুগ্ধ ফুপা এসেছেন!” ‌

আরিয়া যেতে গিয়েও থেমে গেলো‌ । দাদুর সামনে দাড়িয়ে বললো, “ফুপি তো ঘুমে! বলেছে না ডাকার জন্য!”

জেসমিন মুগ্ধর সামনে চা বিস্কুট দিয়ে বললো, “তাতে কি হয়েছে, অনেকক্ষন ধরে ঘুমোচ্ছে! এখন ডাকলেই উঠে পরবে!”

আরিয়া মাথা দুলিয়ে আদ্রিশার শোবার ঘরে গেলো। হামিদুর আহমেদ বললেন, “আসলে বাবা মেয়েটা আমাদের খুব একঘুয়ে! যখন যা মাথায় ঢুকে সেটা তার চাই ই চাই! এভাবে হঠাৎ চলে আসায় বেয়াই-বেয়ান ওরাও খুব অপ্রস্তুত হয়ে পরেছেন নিশ্চয়। তোমার বাবা ফোন করেছিলেন বটে, তবে ঐ যে বললাম, একঘুয়ে! কি কথা বললো ওদের সাথে কে জানে। ফোন কেটে বললো, ‘যা বলার বলে দিয়েছি!’ তুমিও বোধহয় কিছুটা,,,”

মুগ্ধ হালকা হেসে বললো, “না না বাবা, তেমন কিছু না! মা বাবা কিছু মনে করেন নি। আর না আমি কিছু মনে করেছি। ওর তো আপনাদের কথা মনে হতেই পারে! এতে এতো ভাবার কি আছে? রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে নিতে এলাম!”

দরজা থেকে আদ্র বলে উঠলো, “সেই,শুধু নিতেই এসেছেন বুঝি? আপনার আনা জিনিসগুলো কিন্তু অন্য কথা বলছে!”

মুগ্ধ দাড়িয়ে আদ্রকে আলিঙ্গন করলো‌ । হেসে বললো, “আরে এসব কিছুনা।” মুগ্ধ খেয়াল করলো আদ্রর হাতেও কিছু আছে‌ । তবে জিজ্ঞেস করে নি সে। তখন‌ই মুখ গোমরা করে বসার ঘরে এলো আদ্রিশা। মুগ্ধ তার দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখ মুখ ফুলে আছে। এটা কি ঘুমের কারনে না কি অন্য কোনো কারন আছে। আদ্রিশাকি কাঁদছিলো? ভেবেই খুব অবাক হয় মুগ্ধ! ‌আদ্রিশার দিকে এগিয়ে কিছু বলতে নিলেই আদ্র বলে উঠে, “কি রে, এবার শান্তি হলো তো! বলেছিলাম না, মুগ্ধ কিচ্ছু ভুলে নি! তোকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলো বেচারা আর তোর জন্য এখন এখানে এসব আনতে হলো। ডাফার একটা!”

মুগ্ধ হ্যাবলার মতো দাড়িয়ে আছে। আদ্রর কোনো কথাই বুঝছে না সে। আচ্ছা,গিফ্টসগুলো এখানে এনে কি ভুল করলো মুগ্ধ?ওগুলো কি একা আদ্রিশাকে দেয়ার কথা ছিলো? ম্যানেজারতো কিছু বলে নি? কিছু বুঝে ওঠার আগেই আদ্রিশা মুখ খুললো। মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো, “আপনি জানতেন আজ আমার জন্মদিন!?”

মুগ্ধর পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গেলো জেনো! আজ আদ্রিশার জন্মদিন! আর তাই এতোসব কান্ড হলো। মুগ্ধ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রুমানা আহমেদ বললেন, “তো কি! না জানলে এতোসব নিয়ে আসতো বুঝি? কতো বুঝালাম তোকে! কিন্তু তুই বুঝলে তো!”

আদ্র জেসমিনকে তাড়া দিয়ে বললো,” আরে তুমি কেকটা বের করো! টেবিলে সাজাও গিয়ে সব। বোনটার মন গলেছে। এখন তো কেক কাটবি, বল?”

আদ্রিশা লাজুক মুখে হাসলো। বসার ঘর থেকে সবাই সরতেই সোফায় বসে পরলো আদ্রিশা। মুগ্ধর আনা জিনিসগুলোতে চোখ বুলিয়ে উত্তেজনা ভর করলো তার চোখে মুখে। প্রথমেই হাত ছুয়ালো মুগ্ধর আনা ফুলের বুকে তে! অনেক রকম ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করেই তৈরি করা হয়েছে বুকে টা! তার পাশেই রঙিন কাগজের মোড়ক খুলে, ৫ রঙের কাচের চুরি দেখেই হেসে উঠলো সে। আরেকটা প্যাকেট খুলে দেখলো, আলতা। তার কতোদিনের শখ ছিলো আলতা পরার, কিন্তু মায়ের ভয়ে কেনা হয় নি! মুগ্ধর থেকে উপহার পেয়ে এখন তার নাচতে মন চাইছে। আরো দুটো প্যাকেট আছে। ওগুলো খুলার আগেই ডাইনিং থেকে ডাকলো জেসমিন। জিনিসগুলো ওভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে হাসি মুখে ডাইনিংএর দিকে এগিয়ে গেলো আদ্রিশা। মুগ্ধ‌ও আদ্রিশার পেছন পেছন গেলো‌। এতোক্ষন আদ্রিশার পাশের সোফায়‌ই বসেছিলো সে। অথচ আদ্রিশা তাকে খেয়াল‌ই করে নি‌। তবে মুগ্ধ দেখেছে! সামান্য কটা উপহারে আদ্রিশার মুখের হাসিটুকু দেখেছে। তার চন্চলতা দেখেছে! তবে সে উপহারের থেকেও বেশি খুশি হয়েছে যখন বুঝতে পেরেছে, মুগ্ধ জানতো আজ তার জন্মদিন! মুগ্ধ এক ধাঁধায় পরে গেছে! গোলক ধাঁধা! প্রথমে মনে হয়েছিলো, আদ্রিশা কারন ছাড়া হুট করে রেগেছে! কিন্তু পরে জানতে পারলো মুগ্ধ তার জন্মদিন ভুলে গেছে বলেই সে রেগে ছিলো! আচ্ছা, মুগ্ধর কি এসব মনে রাখার কোনো কথা ছিলো? মনে রাখবেই বা কিভাবে, ও তো জানতোও না! আদ্রিশা কি ভেবে এতো টা আশা করছে মুগ্ধর থেকে? সব কি স্বাভাবিক? ভাবতে পারছে না আর মুগ্ধ!

__________________

গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছে মুগ্ধ আদ্রিশা। মুগ্ধ নিশ্চুপ হয়ে ড্রাইভ করে চলেছে। আর আদ্রিশা, বাইরের দিকে তাকিয়ে রাতের শহর দেখছে! বেশ উপভোগ করছে সে। গাড়ি থামতেই চমকে উঠে সামনে তাকালো আদ্রিশা। মুগ্ধ গাড়ি থেকে নেমে আদ্রিশাকে না নিয়েই ঘরে ঢুকে পরলো। আদ্রিশা মন খারাপ করে মুগ্ধর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে, আজ কি বেশিই করে ফেললো? মুগ্ধ নিশ্চয় খুব রেগে আছে! বাবা মাও কি রেগে থাকবেন ওর উপর? ঘরে ঢুকবে নাকি গাড়িতেই বসে থাকবে বুঝতে পারছে না আদ্রিশা! মুগ্ধ ঘর থেকে বেড়িয়ে জোড়ে ধমক দিয়ে বললো, “আজ কি গাড়িতে থাকার প্ল্যান আছে না কি? থাকলে বলুন দরজাটা লাগিয়ে দি!” আদ্রিশা গাড়ি থেকে নেমে উল্টো দিকে হাটা দিলো। মুগ্ধ ধমকে উঠে বললো, “বাড়ি ফিরে যাবেন না কি? যাওয়ার হলে আসলেন কেনো আমার সাথে? ওখানেই থেকে যেতে পারতেন!”

আদ্রিশা মুখ ঘুরিয়ে বললো, “পেছনের সিটে রাখা আপনার দেয়া উপহারগুলো তো আনতে হবে! নাকি রেখেই চলে আসবো। আমি না এলেও আপনি তো নিজের বাড়িতে আসতেন ! আমায় না আনতে পারলে বলে দিতেন, ভাইয়া দিয়ে যেতো। এতো দেমাগ কিসের আপনার?” এরপর পেছনের দরজা খুলে একে একে জিনিস নিচ্ছে। মুগ্ধ মুখ বাকিয়ে ভাবছে, নিজের এতো তেজ, সেদিকে খেয়াল নেই, অন্যের দেমাগ নিয়ে চিন্তা! কোথায় ভেবেছিলো, ধমক খেয়ে দৌড়ে ঘরে আসবে, তা না করে উল্টো মুগ্ধকে দু কথা শুনিয়ে দিলো!

আদ্রিশা হাত ভর্তি প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো‌ । সাথে সাথেই ঠাস করে কিছু একটা ফাটলো। আদ্রিশা দুচোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। হঠাৎই শুনা গেলো, “হ্যাপি বার্থডে” বলে চিৎকার। চোখ খুলে সামনে শ্বশুর শ্বাশুরি , স্নিগ্ধ আর মুগ্ধকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো আদ্রিশা! সবার মুখেই উপচে পরা খুশি! চারদিকে তাকিয়ে দেখলো বেলুন আর ফুল দিয়ে ঘর সাজানো। খাবার টেবিলের পেছনের দেয়ালে বড় করে লেখা ‘শুভ জন্মদিন’! দেয়াল থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই স্নিগ্ধ এগিয়ে এসে আদ্রিশার হাত থেকে প্যাকেট গুলো নিয়ে চেয়ারে রাখলো। মালিহা ইয়াসমিন আদ্রিশাকে টেনে খাবার টেবিলের সামনে আনলেন। আদ্রিশাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “মুগ্ধ বললো, তোরা ওখানে কেক কেটে আসবি। তাই আর এবাড়িতে কেক আনাই নি! আমি নিজে তোর পছন্দের সব রান্না করেছি! আজ নাহয়, পারিবারিক ভাবেই অন্যরকম জন্মদিন পালন করি। আগে থেকে জানলে আরো কতোকিছু করতাম! কিন্তু তুই! কিচ্ছুটি বললি না?”

শ‌ওকত শাহ স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আহা,,,,,, এখন এসব বাদ দাও। কতটা রাস্তা এসেছে! যাও তো মা ফ্রেশ হয়ে এসো। তারপর সবাই মিলে ডিনার করবো।” আদ্রিশা মাথা নাড়লো। স্নিগ্ধ‌ও তাড়া দিয়ে বললো, “ভাবি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো! ভাইয়ের জন্য আমি খাওয়ার ছেড়ে এসেছি। খুব খিদে পেয়েছে। আর তার‌উপর মামি যা রান্না করেছে! লোভ সামলাতে পারছি না।”

মুগ্ধ স্নিগ্ধর মাথায় চাটি মেরে বললো, “আবে, চুপ! ‌আমাদের ফ্রেশ তো হতে দিবি না কি? রাক্ষস একটা! চলুন আদ্রিশা!” আদ্রিশা চেয়ার থেকে প্যাকেট গুলো হাতে তুলে নিলো। তারপর মুগ্ধর সাথে নিজের ঘরে গেলো। এই পরিবারের মানুষগুলো কতো ভালোবাসে তাকে, দেখেই চোখে পানি এসে গেলো আদ্রিশার! কোথায় ও মুগ্ধকে কি ভাবছিলো! আর মুগ্ধ, আদ্রিশার জন্মদিন বলে ঘরে কতো আয়োজন করেছে!

চলবে,,,,,,,

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৩০
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

ঘরে ঢুকেই আদ্রিশা বিরাট বড় ধাক্কা খেলো। সারা ঘরময় গোলাপ ফুল সাজানো। দেয়ালে টানানো আদ্রিশা মুগ্ধর রিসেপশনের ছবি। ব্যালকনির রেলিংটায় লাইটিং করা হয়েছে। অনেকগুলো বেলুন দেয়ালে লাগানো আছে, আর কিছু ফুলের পাপড়ি মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। এক কথায় ঘরটা দেখে মনে হচ্ছে, বাসর রাতের জন্য সাজানো হয়েছে! ‌আদ্রিশা চোখ ঘুরিয়ে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে! আদ্রিশা হাতের জিনিসগুলো বিছানায় রাখতে গিয়ে দেখলো বিছানার উপর রাখা আছে কালো রঙের একটা শাড়ি আর তার পাশেই মুগ্ধর জন্য কালো রঙের পান্জাবি। আদ্রিশা মুগ্ধর পাশে দাড়িয়ে বললো, “এসব আপনি করতে বলেছেন?”

মুগ্ধ মাথা নাড়িয়ে বললো, “কিছুটা বলেছিলাম। বাকিটা স্নিগ্ধ‌ই করেছে। বিশ্বাস করুন কিছুই আমি প্ল্যানিং করি নি! শুধু বলেছিলাম ছোট করে আপনার জন্মদিনের অনুষ্ঠান করবো, একটু আধটু যেনো সাজানো হয়! ‌ও কি বুঝতে কি বুঝেছে আল্লাহ‌ই জানেন! বাকি তো সব আপনি দেখছেন‌ই!”

আদ্রিশা হাসলো। শাড়িটা হাতে উঠিয়ে নিয়ে বললো, “আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। নিচে যেতে হবে তো! সবাই অপেক্ষা করছেন।”

মুগ্ধ‌ও তার পান্জাবি হাতে তুলে নিলো। ঘরের দিকে আরো একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে স্নিগ্ধকে হাজারটা গালি দিলো সে।

_______________

বিছানায় শুয়ে আছে মুগ্ধ আদ্রিশা। আজ ইচ্ছে করেই বিছানায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে আদ্রিশা। উপরের দিকে তাকিয়ে আদ্রিশা আজকের ভালোবাসা গুলো অনুধাবন করছিলো। প্রতিবার জন্মদিনেই কেক কাটে সে। ধুমধাম করে না হলেও বন্ধু বান্ধবের সাথে পুরো দিন কাটিয়ে আত্মীয় স্বজনদের সাথে একসাথে সন্ধ্যেটা কাটাতো। তবে, আজ অন্যরকম কেটেছে দিনটা। আজ তার দুটো পরিবার! দুরকম ভাবেই জন্মদিন পালন করা হয়েছে তার। এক বাড়িতে কেক কেটে প্রতিবারের মতোই আনন্দ করেছে আর অন্য বাড়িতে একসাথে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করেছে। তার‌উপর ঘর সাজানোটাই যেনো তার চেহারায় খুশির ফোয়ারা এনে দিয়েছে! কালো শাড়ি আর কালো পান্জাবিতে দুজনকে বেশ মানিয়েছিলো। স্নিগ্ধ‌ও কিছু মুহুর্ত ক্যামেরা বন্দী করেছে। অবশ্য, মুগ্ধ অনেক ঝেড়েছে তাকে। কেননা, মুগ্ধ শুধু বলেছিলো হলরুমে আয়োজন করার জন্য। আর স্নিগ্ধ তাদের রুমকেই নতুন ভাবে সাজিয়েছে। বেচারার কি দোষ! ‌ও তো ভেবেছিলো তাদের রাতটা স্মরণীয় করে রাখবে। কিন্তু মুগ্ধ আদ্রিশার মধ্যে যে সেই সম্পর্ক‌ই নেই, তা তো তার অজানা! সে যাই হোক আদ্রিশার মুখে হাসি ফুটেছে বলেই অনেক খুশি মুগ্ধ!

“ধন্যবাদ মুগ্ধ!” -মুগ্ধ চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়েছিলো আদ্রিশার কথায় তার দিকে ফিরে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো, “ধন্যবাদ দিতে হবে না আদ্রিশা। আপনার জন্মদিনে এটুকু তো করতেই পারি!”

আদ্রিশা ছাদের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো, “না! পারেন না।”

মুগ্ধর ভ্রু যুগল আরো একটু কুঁচকে গেলো। আদ্রিশা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বললো, ” আপনি তো জানতেন‌ই না যে আজ আমার জন্মদিন! তথাপি, এতোসব উপহার, বাড়িতে এইটুকু সময়ের মধ্যে আয়োজন আর আমাকে এত্তো আনন্দ দিলেন। তার জন্য ধন্যবাদ তো আপনার প্রাপ্য!”

মুগ্ধ বললো, “আপনি কিভাবে জানলেন, আমি জানতাম না আজ আপনার জন্মদিন?”

আদ্রিশা এবার মুগ্ধর মুখোমুখি শুলো। মাথার নিচে বা হাত রেখে ডান হাতে কাঁথাটা কোমর অব্দি টেনে নিয়ে বললো, “আমি কি আপনাকে কখনো বলেছি আমার জন্মদিন কবে? অথবা, বিয়ের সময় কি আপনি আমার জন্ম নিবন্ধন কার্ড দেখেছেন না কি কারো কাছে জানতে চেয়েছেন?”

মুগ্ধ মাথা নাড়লো। আদ্রিশা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো, “তাহলে, কি করে ভাবি যে আপনি আমার জন্ম তারিখ জানেন!?”

মুগ্ধ আবার‌ও চিৎ হলো। এক হাত মাথার নিচে রেখে বললো, “তাহলে রাগটা কেনো ছিলো? কার উপর ছিলো আদ্রিশা?”

আদ্রিশা বললো, “আপনার উপর ছিলো। আর রাগের কারনটাও ছিলো জটিল। আপনি আমার জন্ম তারিখ জানেন না, এটাই ছিলো মূখ্য কারন!”

মুগ্ধ হতচকিত হয়ে আদ্রিশার দিকে তাকালো। আদ্রিশার কথা গুলো সব গুলিয়ে যাচ্ছে তার। বেশি না ভেবে আদ্রিশাকে জিগ্যেস করলো, “আপনি যখন জানতেন আমার পক্ষে আপনার বিশেষ দিন মনে রাখা সম্ভব নয় বা জানাও সম্ভব নয় তবে আপনি সেই কথাকে মনে রেখে কষ্ট পাচ্ছিলেন কেনো? আই মিন নিজেকে তো বুঝাতে পারতেন যে, আমি জানি না আপনার জন্মদিন কবে! আপনি আমায় জানাতে পারতেন আর তার পর‌ও ভুলে গেলে, তখন নাহয় রাগ ঝাড়তেন!”

আদ্রিশা মুগ্ধর থেকে চোখ সরিয়ে ছাদের দিকে দৃষ্টি দিলো‌। বললো, “কি জানেন তো, এমন অনেক কিছুই থাকে, যা আমরা জানি, বিশ্বাস করি তবুও ফলাফল অন্যকিছু চাই! আশা, আকাঙ্খা বেশি কি না! সত্যিটা জেনেও মিথ্যের পেছনে ছুটতে ভালো লাগে। মনকে প্রশান্তি দেয়া যায়!”

মুগ্ধ ফ্যালফ্যাল করে আদ্রিশার দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিশা খানিক থেমে আবার‌ও বললো, “এই যে দেখুন, আমি জানতাম আপনি আমার রাগের কারন জানেন না, অথচ চাইছিলাম রাগ ভাঙান! আমি জানতাম, আমার জন্মদিনের কথাটা আপনার অজানা তবুও চাইছিলাম যেনো আপনি আমায় উইশ করেন। আবার এটাও চাইছিলাম কারো থেকে না জেনেই যেনো আপনি জেনে যান! অদ্ভুত না!? আমার কাছে কিন্তু এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলো বেশ লাগে।”

মুগ্ধ বললো, “ব্যাপারগুলো!? আরো কি কি অদ্ভুত ব্যাপার ভালো লাগে আপনার?”

আদ্রিশা চমকে উঠে বললো, “শুনবেন?”

মুগ্ধ চোখ দিয়ে ইশারায় বুঝালো সে শুনবে। আদ্রিশা মুখে হাসির রেখা টেনে বললো, ” এই যেমন ধরুন, আপনি জানেন না আমার পছন্দ-‌অপছন্দ, অথচ আমি চাই একদিন হুট করেই আমার পছন্দের কোনো জিনিস নিয়ে এলেন! আমি চমকে উঠে জিগ্যেস করবো,’কি করে জানলেন এটা আমার পছন্দ’-‌উত্তরে আপনি হাসবেন হয়তো। আবার ধরুন, আমি মনে মনে কিছু বলবো, আর আপনি চট করে বলে দেবেন আমার মনের কথা। আমার মন খারাপের রাতে, আমার গল্প শুনবেন তবু বিরক্ত হবেন না। বা কোনো একদিন কারন ছাড়াই ঘুরতে নিয়ে যাবেন। বেশি না তবে একটু খানি আপন হবেন আমার! আমার ভয়, কষ্ট সব বিষয়েই আপনি অবগত থাকবেন, আমার অজানায়!”

মুগ্ধ যেনো ঘোরে পরে গেছিলো। আদ্রিশার প্রতিটা কথা ঘোর লাগানোর মতোই ছিলো। আদ্রিশা নিশ্চুপ হয়ে মুগ্ধর দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো উত্তরের অপেক্ষায় আছে! কিন্তু মুগ্ধর কাছে এর কোনো উত্তর নেই। কি বলবে ও? কি বা বলার আছে? আদ্রিশার কথার বিপরীতে কি কোনো প্রশ্ন করা যাবে? মুগ্ধর ভাবনার সুতো কাটলো আদ্রিশার কথায়।

“ভয় পেলেন না কি? পাবেন না! এসব কিছু আবেগ। আবেগের বর্শবর্তী হয়ে কখন যে কি করতে ইচ্ছে হয় বা কি করতে মন চায় তা বলাও দুষ্কর! খনিকের চাওয়া নিয়ে ভাববেন না। সব চাওয়া কি আর পূর্ণ হয়? হয় না। পূর্ণ না হলে তেমন ক্ষতির আশঙকাও থাকে না। তবে, কষ্ট হয়। খুব না হলেও প্রয়োজনের অধিক হয়! আসলে, এক্সপেক্টেশন বেশি ! কখনো কারো থেকে এক্সপেক্টেশন করা উচিত নয়!” কথাগুলো বলার সময় আদ্রিশার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। যা মুগ্ধর অগোচরে রয়েগেলো। আদ্রিশাও বুঝতে দেয় নি কিছু। দিব্যি কথার আড়ালে চোখের পানি লুকিয়ে নিলো।

মুগ্ধ কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো, “আপনিও কি আমার থেকে কিছু এক্সপেক্ট করছেন আদ্রিশা?”

আদ্রিশার নিশ্বাস তীব্র গতিতে বাড়তে লাগলো‌। চোখের পানিও বাধ ভেঙে উপচে পরছে। কোনোরকম নিজেকে স্থির রেখে শান্ত কন্ঠে বললো, ” আপনার কি মনে হয়?” মুগ্ধর উত্তরের অপেক্ষা না করেই উল্টো ঘুরে বললো, ” না চাইতেও অনেক কিছু চাইছি মুগ্ধ! আর আপনি আমার আবদার না জেনেও চাওয়া পূর্ণ করছেন! এগুলো কি এক্সপেক্টেশনের আওতায় পরছে না!? আমার তো মনে হয় পর্যাপ্তের অধিক এক্সপেক্ট করছি আমি। প্রত্যেকটা মানুষ‌ই এমন। শুধু সবাই প্রকাশ করে না! আমি করছি। কারন আমি চাই আমার এই অদ্ভুত কর্মকান্ড যেনো আপনি জেনে রাখেন। ভবিষ্যতে ভড়কে যাবেন না যেনো! সামলে নেবেন!”

আর কোনো কথা হয় নি এরপর। মুগ্ধ আদ্রিশার প্রত্যেকটি কথা ভেবে চলেছে অনবরত। চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না তার। আদ্রিশার কথাগুলোর পেছনে কি অন্য কোনো কথা আছে? যা আদ্রিশা বলতে চেয়েছে পারে নি অথবা চেয়েছে যেনো মুগ্ধ নিজ থেকে বুঝে নেয়! এদিকে আদ্রিশাও ঘুমাতে পারছে না। চোখের পানি থামার নাম নেই। কারন ছাড়াই কাঁদছে সে! সব কিছুর কি কারন থাকা জরুরী? যুক্তি ছাড়াও তো কাঁদা যায়! কাঁদুক না আজ! অকারণে কেঁদেই নাহয় নিজেকে শান্ত করুক! ‌এক‌ই খাটের দুপাশে দুটি গল্প। কেউ ভাবছে আর কেউ ভাবতেই পারছে না কিছু! কেউ অকারণেই কাঁদছে আর কেউ ভাবনার কারন খুঁজতেই ব্যাস্ত!

চলবে,,,,,,,,