যদি তুমি চাও পর্ব-২৮

0
301

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

২৮.
ছায়া তৈরি হচ্ছিলো ঠিক তখনই তার কাছে একটা ফোন কল আসে। মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে দেখেই মুচকি হাসে সে। রিসিভ করে কানে ধরে বলে,
-জনাবের এতো তাড়া কীসের?
-আমি অপেক্ষা করছি ছায়া, দ্রুত বেরিয়ে এসো।
-ইজ এভ্রিথিং অলরাইট, মেঘ?
-ইয়াহ। প্লিজ কাম ফাস্টার।
-আ’ম ট্রাইং বাব্বা।
-এন্ড আই এম ওয়েটিং।
-এতোটা উতলা তো আগে কখনো হওনি, ব্যপারটা কী হুম!
-আমি আবারও চলে যাচ্ছি ছায়া, এই দেশ ছেড়ে। আর হয়তো কখনো ফেরা হবে না।
কথাটা শোনার পরেই ছায়া যেনো স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখে এসে ভীড় জমায় অশ্রু কণা। তারা বেরিয়ে আসতে চায় এমনকি কয়েক ফোঁটা বেরিয়ে গাল বেয়ে ছায়ার গলা অবধি পৌঁছেও যায়। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
-মজা করছো তাই না মেঘ?
-না, আমি মজা করছি না। অন্তত এইসব বিষয়ে আমি মজা করি না ছায়া।
-তবে আমায় নিজের সাথে জড়ালে কেনো মেঘ?
-ভালোবাসি তাই।
-তবে ছেড়ে যাবে কেনো?
-ছেড়ে যাওয়ার কথা তো একটি বারের জন্যও বলিনি আমি।
ছায়া এবার কনফিউজড হয়ে যায় আর তাই সে বলে,
-তোমার কথাগুলো আমায় কনফিউশনে ফেলে দিচ্ছে মেঘ। আসলে তুমি কী চাও বলবে আমায়?
-উহু, এখন নয়। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। চলে এসো তারপর বলছি।
-না, এখনই বলো।
-বলছি তো চলে এসো তারপর বলবো।
এই বলেই লাইন কেটে দেয় মেঘ। ছায়া যতটা যত্নের সাথে সাজগোজ করছিল এবার তার চেয়েও বেশি দ্রুততার সাথে তৈরি হতে শুরু করলো। মেঘের কথাগুলো কেমন গোলমেলে ঠেকেছে তার কাছে। এসবের মানে তাকে জানতে হবে যে।

রাফিদ দাঁড়িয়ে আছে মেঘের পাশে মেঘকে দেখে যাচ্ছে সে। মেঘ তা খেয়াল করে প্রশ্ন করে,
-কিছু বলতে চাও?
-আপনি একেবারেই অন্যরকম একটা মানুষ, বাইরে থেকে দেখলে কেউ বুঝবেই না এমন কিছু নিজের মাঝে লুকিয়ে ঘুরছেন আপনি। আমার মা সবসময়ই আপনার শত্রু ছিল এরপরেও আমাকে মানে তারই ছেলেকে এতো বড় বিপদ থেকে বের করে এনে সঠিক পথে পরিচালনা করলেন আর এখন ছায়া….
-ছায়ার কথা থাক। ওসব পরে হবে, তোর তো খুশি হওয়া উচিৎ তোর বোনের উপর নজর রাখার আর কেউ থাকবে না। থাকবে না কেউ তোর পরিবারের ক্ষতি করার।
রাফিদ আবারও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু মেঘ তাকে আটকে দিয়ে বললো,
-যা এখন, এইদিকে আর ফিরে আসার চেষ্টাও করিস না। এটলিস্ট যতদিন আমি আছি ততদিন তো ভুলেও নয়।
মেঘ হাসে, সে হাসিতে এতো এতো জিতের মাঝেও দিন শেষে হেরে যাওয়া একটা মানুষকে দেখতে পায় রাফিদ। সে আর কথা বাড়ায় না। চলে যায় সেখান থেকে।

আবির তার মায়ের ওষুধগুলো ঠিক করে এগিয়ে দিচ্ছে তার কাছে তারপর বলে,
-খেয়ে এবার রেস্ট নেও আমার অফিসে যেতে হবে। বাবা, মায়ের খেয়াল রেখো।
-আর কতো করবি বাবা?
আবিরের মায়ের বলা কথা শুনে আবির যেতে যেতেও দাঁড়িয়ে যায়। ভ্রু-কুঁচকে তাকায় মায়ের দিকে। তার মা বলে,
-অফিসের কাজ, বাড়ির কাজ তার উপর আমার দেখাশোনা করা। এবার বিয়ে করে বউ আনলেই তো পারিস।
আবির অন্তির কথা বললো না এখন। অন্যভাবে জানাতে হবে বিষয়টা তাই এই মুহুর্তে চুপ করে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হলো তার কাছে। তবে এখন সংশয়ে পড়ে গেল সে। মা’কে কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না এমন সময় তার বাবা বলে,
-তোমার খালি বিয়ে বিয়ে, ছেলেটা অফিসে যাচ্ছে যেতে দাও না। আবির তুই যা।
আবির মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। এবার যে করেই হোক যত দ্রুত সম্ভব মা’কে তার বিয়ের কথাটা জানাতে হবে। উফফ, আর মিথ্যে বয়ে বেড়ানোর শক্তি তার মাঝে নেই।

ছায়া আপন মনেই এগিয়ে যাচ্ছিলো বড়ির সদর দরজার দিকে এমন সময় তার বাবা তাকে পেছন থেকে ডাক দেন। ছায়া দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,
-বাবা যা বলবে তাড়াতাড়ি বলো আমার কিন্তু…
কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে তার বাবার হাতের চড় এসে বসে যায়। ছায়ার চোখে জল টলমল করে আর সেই জলপূর্ণ চোখে আবছাভাবে রুবির চেহারা তার সামনে ফুটে ওঠে। রুবি ছায়ার বাবা’কে বলেন,
-ভাই ওকে মারবেন না, আমি এখানে ওর দোষ দেখছি না। আমি সিওর ওই ছেলেটাই আমাদের ছায়ার মাথা খেয়েছে। দু’দিন বাড়িতে বন্দি রাখুন দেখবেন মাথা থেকে সব নেমে গেছে।
ছায়ার বাবা রুবির কথা শুনলেন না। তিনি বললেন,
-আপনার কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ আপা। আপনি আমাদের কাছে এসে সবটা না বললে হয়তো জানতেই পারতাম না যে, আমি আমার যেই মেয়েকে সব’চে বেশি বিশ্বাস করে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলাম সে বাইরে গিয়ে পড়া বাদ দিয়ে এমন কিছু করে বেড়াচ্ছে। আপনি জানিয়েছেন আমাদের ব্যস এখানেই আপনার দ্বায়িত্ব শেষ এখন আমরা আমাদের মেয়েকে নিজেরাই সামলে নেবো।
-কিন্তু….
রুবি কিছু বলতে চাইলেন সেটা বলার আর সুযোগ হয়ে উঠলো না তার আগেই ছায়ার বাবা তাকে বিদায় জানিয়ে ছায়ার হাত ধরে নিয়ে ঘরের দিকে ছুঁটলেন। রুবি উপায়ন্তু না পেয়ে ছায়ার মায়ের কাছে গিয়ে বললেন,
-আপা, বাচ্চা মেয়ে একটা ভুল করেই ফেলেছে আপনি একটু গিয়ে দেখুন যাতে ওর সাথে বেশি কঠিন ব্যবহার না করা হয়।
-দেখুন আপনি আপনার দ্বায়িত্ব পালন করেছেন বাকিটা ওর বাবার উপরেই ছেড়ে দিন। আপনি এখান থেকে চলে গেলে খুশি হবো।
ছায়ার মাও এগোলো না মেয়েকে বাঁচাতে এদিকে ছায়ার বাবা রুবির কথা শুনছেন না। বাধ্য হয়েই রুবিকে চলে যেতে হলো সেখান থেকে।

-তোমার মোবাইল কোথায়?
ছায়া কাঁদছেঅনবরত, সে এই মুহুর্তে কোনো প্রকার উত্তর দেওয়ার অবস্থাতে নেই। সেটা দেখেই ছায়ার বাবা ওর মা’কে ডাকে। ভয়ংকর সেই হুংকার যুক্ত ডাক। ছায়ার মায়ের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তবুও তিনি এগিয়ে যান। আর যাওয়া মাত্রই স্বামীর আদেশ শুনেন এরপর কাজে লেগে পড়েন। ছায়ার ব্যাগ খুঁজে মোবাইলটা বের করে সেটা নিয়ে সুইচড অফ করে ছায়াকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রেখে বেরিয়ে আসেন। ছায়া অনেকবার দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে কিন্তু পেরে ওঠে না। মেঘ অপেক্ষা করে ছায়ার তবে তার দেখা আর মেলে না। ফোন করলে নাম্বার বন্ধ বলে। ভার্সিটির গেইটে দাঁড়িয়ে থাকলে তার দেখা মেলে না। এইদিকে মেঘের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে, এখন উপায়?

রাতের খাবার শেষ করে আবির ওর মা’কে ওষুধ দিয়ে নিজের ঘরে বসে ছিল তখন সেখানে ওর বাবা এসে উপস্থিত হোন। আবির একবার তার বাবার দিকে দেখে নিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।
-কীরে এখনও এইখানেই আছিস যে!
-একটুখানি কাজ বাকি আছে বাবা তারপরই বেরিয়ে পড়বো।
এইটুকু শোনার পরেই আবিরের বাবার স্থান ত্যাগ করার কথা কিন্তু তিনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন মানে কিছু বলতে চান নিশ্চয়ই।
-কিছু বলবে, বাবা?
-আসলে আমি বুঝে উঠতে পারছি না, বখতিয়ার স্যার হঠাৎ করেই সবকিছু থেকে পিছিয়ে গেলেন কেনো? তোকেও তো আর চারকি ছাড়তে হলো না আবার কোনো টাকাও ফেরত চাইলেন না উনি।
-সত্যি বলতে কী বাবা, আমি ওইখানে চাকরি আর করতে চাই না। উনি বের করেননি ঠিক আছে তবে আমি নিজে থেকেই রিজাইন করবো বলে ঠিক করেই রেখেছি আর টাকা ফেরত না চাওয়ার ব্যপারটা এখনও আমার মাথায় ঢুকছে না। যাই হোক তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না। ভবিষ্যতের চিন্তায় বর্তমানটা হারিও না। মা একা আছে তুমি যাও। আমিও কিছুক্ষণের মাঝেই বেরিয়ে পড়বো।

অন্তি বুকের উপর ভর দিয়ে শুয়ে আছে, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে একা একা বোর হচ্ছিল সে। আবির পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-তোমার মুখটা এমন উদাসীনতায় ছেয়ে আছে কেনো?
-তুমি পাশে ছিলে না যে তাই।
-মিস করছিলে?
-কেউ মিস করে না মানে তো এই নয় যে অন্যকেউও মিস করতে পারে না।
-বুঝেছি।
-কী?
-ওসব পরে বলবো, খেয়েছ?
-উহু।
-এটা কিন্তু বদ অভ্যাস অন্তরা।
-এই রাতের বেলাটাতেই তো তোমার হাতে খাওয়ার সুযোগ হয় আমার নইলে সকালে উঠে তো তোমাকে দেখার সুযোগই হয় না আমার, খাওয়ার কথা সে তো অনেক দূরে।
-হয়েছে। চলো ওঠো, আগে খাবে তারপর অন্য কথা।
-আচ্ছা যাচ্ছি। মা কেমন আছেন?
-ভালো। আজ মা আবারও আমার বিয়ের কথা বলছিল জানো।
-তুমি কী বললে?
বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে অন্তি। আবির জিহ্বা দিয়ে দাঁতের সাথে ‘ক্যাচ’ করে একটা শব্দ করে বলে,
-আমাকে কিছুই বলতে হয়নি, বাবা মাঝখানে ঢুকে সব সামলে নিয়েছে।
-মানে আমার কথা এখনও বলোনি? আবির আমার আর এইখানে একা থাকতে ইচ্ছে করে না।
আবির শার্টের বোতাম আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে অন্তি। আবির বলে,
-আর কিছুদিন অপেক্ষা করো তারপর তোমায় ওখানে নিয়ে যাবো।
-আচ্ছা আর এখানটার কী হবে?
-আমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি অন্তরা। নোটিশ দিয়েছি আর কয়েকদিন বাদেই সেটা কার্যকর হবে তারপর এই ফ্ল্যাটের চাবি সমেত রিজাইন লেটার দিয়ে আসবো।
-আমি এমনটাই আশা করেছিলাম তোমার কাছে।
-তুমি মানিয়ে নিতে পারবে তো, অন্তরা?
-উফফ, ইরিটেটিং কোয়েশ্চেন। চলো খেয়ে নিই।
-হ্যা, এসো।
আবির অন্তিকে নিয়ে গিয়ে তাকে খাইয়ে দেয় তারপর আবার ঘরে নিয়ে এসে দু’জনেই একসাথে শুয়ে পড়ে।

কেটে যায় আরও তিনটি দিন। ছায়ার কোনো খোঁজ পায়নি মেঘ এর মাঝে। লোক লাগিয়ে রেখেছে সে তার পরেও কোনো খোঁজ পায়নি সে। এই মুহুর্তে সে নিজের ঘরে রকিং চেয়ারে বসে আছে। হাতের দু’টো আঙুল দিয়ে কপালে ডলছে সে হয়তো মাথা ব্যথা হচ্ছে তার। দরজায় টোকা পড়তেই সোজা হয়ে বসে সে,
-খোলা আছে।
একজন সার্ভেন্ট আসে আর জানায় নিচে কেউ অপেক্ষা করছে তার জন্য। ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও তাকে যেতে হয়। গিয়ে দেখে তারই লোক দাঁড়িয়ে আছে। এই তাদের মধ্যেই একজন যাদেরকে মেঘ ছায়ার খোঁজ করার জন্য হায়ার করেছিল। মেঘ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটি বলে,
-কয়েকদিন আগে মেয়েটির বাড়ির সামনে মিসেস রুবি খানকে দেখা গিয়েছে এবং এরপর থেকেই মেয়েটিকে আর কেউ দেখেনি।
-রুবি খান, রুবি খান।
পায়চারি শুরু করে মেঘ সাথে বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে,
-উফফফ, রুবি খান। তুমি এমন কেনো? আমি চাইলাম তোমার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করা বন্ধ করতে আর সেই তুমি শেষে আবারও আমায় জাগিয়ে দিলে। তোমাকে মিটিয়ে তবেই এবার আমি ফিরবো।

চলবে…….