রঙীন ফানুস পর্ব -০৩

0
2046

#রঙীন ফানুস
#পর্ব -০৩

—–“পরী নিচে নেমে যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।
কিচেনে গিয়ে ভাবতে লাগলো, পরী কী সত্যি সত্যি রাজের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।
পরী নিজেকে নিজে বললো,” না পরী তুই কখনো কারো প্রেমে পড়তে পারিস না। কাউকে ঠকানো ঠিক নয়।
তুই নামে মাত্র সুন্দরী, তোর সৌন্দর্যে যে ঝাঁপ দেবে সেই পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে।
পরীর দু’চোখ ভিজে আসলো।
চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে পরীর। পরীর খুব জানতে ইচ্ছে করছে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েও ভালোবাসার অধিকার কেন দেয়নি বিধাতা ?”

“আবছা আলোতে কাউকে আসতে দেখে পরী চোখ মুছে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো।
পরী ঘোমটাটা টেনে মাথায় দিলো।”

“পরী দেখতে পেলো ওর শ্বাশুড়ি এগিয়ে আসছে।”

“পরী কে এসে বললো, ” কি রে মা, তুই সবেমাত্র আমাদের বাসায় আসলি, এসেই কিচেনে ঢুকে পরলি।
না এটা হয়না,তুই রুমে যা, রাজের সাথে গল্প কর। তাছাড়া তোর শ্বশুর দেখলেও খুব খুব রাগ করবে।”

“পরী অভিমানী স্বরে বললো, কেনো মা, আপনি কী আমাকে বউ হিসেবে দেখেন,না-কি মেয়ে হিসেবে ?
আমি কী আপনার মেয়ে হওয়ার যোগ্য নই।”

পরীর শ্বাশুড়ি এগিয়ে এসে পরীর হাতে চুমু দিয়ে বললো,” এগুলো কী বলছিস তুই?
“তোর মতো পরী কে যে কেউ মেয়ে হিসেবে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করবে বুঝলি।”

“আর একদিন এগুলো বলছিস তো আমি খুব খুব রাগ করবো বলে দিলাম।”

“পরীও ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,” শ্বাশুড়ি আম্মা আমিও আপনাকে আজ এখন থেকে মা বলে ডাকবো।
অন্য কিছু ডাকতে পারবো না।
আপনার ছেলের মতো মম,মাম এগুলোও না।”

“পাগলি মেয়ে আমার, ঠিক আছে, তোর যা খুশি তাই ডাকিস।
এখন সর আমাকে কাজ করতে দে।
পরীর শ্বাশুড়ি পরীর হাতে কিছু ফল তুলে দিয়ে বললো, এই নে এগুলো ব্লেন্ড করে জুস বানিয়ে নে, একটু পর সবাই চলে আসবে।”

“পরীও চুপচাপ ফলগুলো নিয়ে জোস বানিয়ে, শ্বাশুড়ির সাথে হাতে হাতে কাজ করে দিলো।”
.
.
.
“সকল কাজ শেষ হলে,পরীর শ্বাশুড়ি পরী কে ডেকে বললো,” যা মা রুমে যা, এতোক্ষণ অনেক কাজ করেছিস্, একদম ঘেমে গেছিস। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।
আর শোন সকাল সকাল উঠে কিচেনে আসতে হবে না।
আমি আর রেশমা ( কাজের মেয়ে)
সব করতে পারবো।
তুই শুধু আমার রাজকে ভালোবাসবি বুঝলি তো ।
আর আমার কিন্তু নাতনীই চাই প্রথম ।
খুব তাড়াতাড়ি আমার একটা সইয়ের দরকার বুঝলি তো। ”

“পরী কোনো কথা বললো না। মায়ের স্নেহ কেমন হয় পরী তা জানে না।
মাথা নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।”
.
.
“পরী রুমে ঢুকতে না ঢুকতে কেউ একজন পরী কে জড়িয়ে ধরলো। ”

“সেকেন্ডের মধ্যে কাজটা হওয়াতে পরী বোকা বনে গেলো।
কিছুই যেনো বুঝে উঠতে পারছে না।
হঠাৎ কারো স্পর্শে পরীর বুঝতে আর বাকি রইলো না এটা কে?”

“এ যে রাজ, যার স্পর্শ বুঝতে পরীর একটুও ভাবতে হয়নি।
স্পর্শে আছে যেনো হাজারো আকুলতা, ব্যাকুলতা পাগল করার অনূভুতি। যাকে একবার দেখলে দেখার ব্যাকুলতা বার-বার বেড়ে যায়।”

“রাজ পরী কে আরো কাছে টেনে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো,” কী ব্যাপার মহারানী আমি তো ভেবেছি, আপনি নামে পরী।
এখন তো দেখছি কাজেও পরী।
পরীর মতো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন। আপনার যে একজন অবলা স্বামী আছে তা কি ভুলে গেছেন।
আমার কাছে আসলেই আপনার শত শত বাহানা। কাছে গিয়ে ভালোবাসতে চাইলেই পরীর শক্তি চলে আসে আপনার কাছে ।”

একেতো পরী রান্না ঘর থেকে এসেছে, তাঁর মধ্যে আবার রাজের হুটহাট জড়িয়ে ধরা,আর এদিকে পরীর যে একটা লুকায়িত সত্য আছে যা প্রতিনিয়তই কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে পরীকে।
এতোকিছু কিভাবে সামলাবে পরী।সব সামলে উঠতে পরী যেনো হাঁপিয়ে উঠেছে।”
.
.
.
“পরী রাজকে উত্তর দিলো, ” আসলে তা নয়, আমি যদি এখন পরে পরে ঘুমাই লোকজন আমাকে কি বলবে ভাবুন তো একবার।লোকে তো বাজে কথা বলে বেড়াবে।”

“রাজ ভাব নিয়ে বললো,” এ বাবা বলো কী, বাজে কথা বলবে বুঝি।”
“আচ্ছা বলোতো বাজে বলবে কেনো।
আমি তো জানি বিয়ের পর বর বউকে হুটহাট জড়িয়ে ধরবে,বউ বর কে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে।
আরো—–

“পরী অস্ফুটে জিজ্ঞেস করে ফেললো,”আর কী?”
কথাটা বলেই পরী জ্বীভ কাটলো।”

“রাজ নেশা ভরা চাহনিতে বলতে লাগলো , বর বউকে আদরে আদরে বাঁদর বানাবে বলে চোখ মারলো।”
আর কিছু জানতে চাও?

পরী নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,” মা আমাকে নিচে যেতে বলেছে। ”
আর আপনি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। এগুলো করলে বুঝি পেট ভরবে?

“রাজ দুষ্টু হেঁসে বললো,”পেট না ভরলেও অনেক কিছু ভরে। ”

“ছিহ্ রাজ আপনি খুব পঁচা, এতো এতো পঁচা কথা বলেন যে,শুনলেই মাথা ঘুরে যায়।”

“রাজ পরীর কাছে এসে বললো,” শুধু কী মাথাই ঘুরে, আর কিছু?
আহ্ পরী আর লজ্জা পেতে হবেনা। আমার বউ তো দেখছি লজ্জাবতী পরী।
আচ্ছা পরী বলো তো তোমার মধ্যে কী রোমাঞ্চ বলতে কিছুই নেই?

—“রোমাঞ্চের কথা শুনে পরী ঢোক গিললো।”

“রাজ আবার বলতে শুরু করলো, আচ্ছা আমার বউ যেহেতু লজ্জাবতী তাহলে প্রথম আমিই শুরু করি বলে, হুট করেই পরীর কপালে চুমু দিয়ে বসলো।

“রাজের স্পর্শ পেয়ে পরী চোখ বন্ধ করে ফেললো।”
“চোখ বন্ধ অবস্থায় পরীর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ”

“রাজ অবাক হয়ে পরী কে দেখছে, চোখের জল দেখতে পেয়ে কোমল হাতে পরীর চোখের জল মুছে দিলো।
পরী এই পরী শুনছো?”

“পরী কোনো সাড়া দিলো না।”

“রাজ আবার বলতে শুরু করলো ,”পরী আমি কী কোনো ভুল করেছি,প্লিজ বলো।
আমি নিজেকে শুধরে নিবো।
এই পরী কিছু বলছো না কেনো?
শুনতে পাচ্ছো পরী।

পরী চোখ খুলে রাজের দিকে তাকিয়ে বললো,” নিচে যেতে হবে,আপনাকে মা ডাকছে। আমিও ফ্রেশ হয়ে আসছি বলে ওয়াশরুমে দৌড়ে চলে গেলো।
ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো পরী।
নিজের মধ্যে কোনো খুঁত তো দেখতে পাচ্ছে না। রাজকে ভালোবাসতে তাহলে কেনো এই বাঁধা।
আল্লাহ কেনো এই বাঁধা টা সৃষ্টি করলো, মেয়ে হওয়া সত্বেও আমাকে কেনো ভালোবাসার ক্ষমতা দিলো না।
পরী চায় আজ খুব করে কাঁদতে চোখের জলগুলো সব জড়িয়ে ফেলতে।
ঝর্ণার জল,আর চোখের সব মিশে একাকার।
পানির টুপটুপ শব্দগুলো যেনো বুকে এসে আঘাত করছে।
ব্যাথাগুলো বুকে এসে লাগছে।
বুক টা চেপে ধরলো পরী।
নিজেকে স্থির করে নিচে গেলো।”

“নিচে গিয়ে দেখলো সবাই পরীর জন্য অপেক্ষা করছে।
পরী রাজের পাশের চেয়ার টেনে বসলো।
রাজের মা সবাই কে খাবার সার্ভ করে দিলো।
খাওয়ার সময় পরীর সাথে একটা কথাও বলেনি রাজ।
চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। ”

“পরী বিষয় টা একটু হলেও খেয়াল করলো। ”

“খাবার শেষে রাজ বলে গেলো অফিসে যাবে আজ। ”

“রাজের মা শুনে অবাক!
রাজ তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে। সবেমাত্র বিয়ে হলো, আর তুই আজ ই অফিস যেতে চাইছিস। লোকে কী বলবে বল?
শুন আমরা কিন্তু তোর জন্য পরী এনেছি।
আর তুই পরী কে ছেড়ে আজই অফিসে যাবি?

“রাজের বাবাও বলতে শুরু করলো, রাজ তোমাকে আজ অফিস যেতে হবে না।
অফিসের জন্য আমি তো আছিই।
তুমি বরং একটু পর পরী কে নিয়ে, বাহিরে ঘুরে এসো।”

“রাজ আর কোনো কথা বলে নি।
চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো।”

“পরীও খুব অল্প খেয়ে শাশুড়ির সাথে সব গুছিয়ে উপরে গেলো।
উপরে গিয়ে দেখলো, রাজ রুমে নেই।
রাজ কে দেখতে না পেয়ে পরীর কেমন যেনো খালি খালি লাগছে।
বিষন্নতায় চারদিক যেনো ছেয়ে যাচ্ছে।
পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলছে। কিন্তু রাজ কে কোথাও দেখতে পেলো না। ”

পরীর কানে হঠাৎ কোনো একটা সুর ভেসে আসলো। সম্ভবত হারমোনিয়ামের মিষ্টি সুর। কেমন যেনো ব্যাথিত হৃদয়ের সুর। যে সুরে আছে মুগ্ধতা,আছে কান্না।
পরী এই সুর ব্যাকুল হয়ে খুঁজতে লাগলো।
হঠাৎ সুরটা থেমে গেলো।
পরীও হাঁপিয়ে উঠলো।
বারান্দায় একটি চেয়ারে পা দুলিয়ে বসলো।
রুমের সাথে এডজাস্ট করা যে একটা বারান্দা আছে পরী তা কেবলই দেখতে পেলো।
চারপাশ থেকে মনমাতানো বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে প্রাণে, নেই কোনো কোলাহল,নেই কোনো হইচই, আছে শুধু পাগল করা বাতাসের স্নিগ্ধতা।

“পরী—–”

“হঠাৎ পরী বলে কেউ ডাকাতে পরী ভয় পেয়ে গেলো।
পরী পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো রাজ।
রাজের চেহারাটা কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে।
গোছালো ভাবটা যেনো আর নেই, চোখগুলো কে কেমন যেনো ক্লান্ত ক্লান্ত লাগছে।
যেনো হাজার বছরের ক্লান্তি এসে রাজের চোখে ভিড় জমিয়েছে। ”

রাজকে দেখে পরীর বুকটা মুচড়ে উঠলো।
তাহলে কী রাজ পরীর জন্য নিঃশেষ হয়ে যেতে শুরু করেছে।
দায় টা তাহলে পরীর নিজেরই, পরী আর কিছুই ভাবতে পারছে না।!”

“পরী রাজকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কী মন খারাপ?”

“রাজ নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,না মন খারাপ হবে কেন?
পরীর মতো বউ থাকতে মন কী খারাপ হতে পারে ?”

“পরী রাজের পানে তাকিয়ে দেখলো, মায়া ভরা চেহারায় কালো মেঘ এসে ভিড় জমিয়েছে, যেনো ঝড়ের পূর্বাভাস।
যেনো দমকা হাওয়ায় সব মিলিয়ে যাবে।”

রাজ পরী কে ডাকলো, পরী …… যে জেনেও না জানার ভান করে তাকে না জানানোই শ্রেয়।
যে নিজেকে আড়ালে রাখতে চায়, তাঁকে ঐভাবেই থাকতে দিতে হয়।
যে নিজের সৌন্দর্যে আঁচড় লাগবে বলে কাউকে বিরহের আগুনে পুড়িয়ে খুশি থাকে তাকে ঐভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”

“কথাগুলো শুনে পরীর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো।
টাল সামলাতে না পেরে পরী পড়ে যেতে লাগলো।
বিয়ের ধকলে আজ কয়েক দিন ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করেনি পরী।
যার কারনে এই বেহাল দশা।
বহুকষ্টে পরী গ্রিল ধরে নিজেকে সামলালো।”

“রাজ যাওয়ার সময় পরী কে বলে গেলো, রেডি হতে।
পরী কে নিয়ে পরীর বাবার বাসায় যাবে।”

“পরী বাবাকে দেখতে পাবে শুনে একমনে কিছুটা খুশি হলেও খুশিটা বেশিক্ষণ থাকেনি।
রাজের কথাগুলো মনে মনে ভাবতে লাগলো ।
রাজ কী তাহলে পরীর দেওয়া ব্যাথায় ব্যাথিত । পরীর যে আগেও একটা বিয়ে ভেঙেছে।
একি কারণে বুঝি রাজের আর পরীর সম্পর্ক টাও ভাঙতে শুরু করেছে?
পরী ভাবছে আর ভাবছে।
যে ভাবনার নেই কোনো ইতি।”

“পেছন থেকে কেউ একজন পরীর চোখ চেপে ধরলো । পরীর ভীষণ অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। এতো এতো শক্ত করে ধরে রেখেছে যে, অজানা ব্যাক্তি না চাইলে পরী কখনোই চোখ ছুটাতে পারবে না।
পরী চোখ থেকে হাত সরাতে ভীষণ ব্যাতিব্যাস্ত।”

“পরী ভাবছে চোখ চেপে ধরা ব্যাক্তিটা আসলেই কে হতে পারে ?”

চলবে________