রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-২১+২২+২৩

0
242

#রাজকন্যা_হূরিয়া
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[২১]

জঙ্গল পেরিয়ে সেই অদৃশ্য ঘরগুলোর সামনে পা রাখতেই কেউ পেছন থেকে আক্রমণ করে বসে। ঠিক মাথার মাঝখানটাতে স্বজোরে বারি বসিয়ে দেয়। রাজকন্যা টের পায়নি তার আগমন। আকস্মিক আক্রমণে কিছুই করার ছিলো না রাজকন্যার! প্রচন্ড ব্যাথায় আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। দম বন্ধ হয়ে এসেছে যেন! কয়েক মুহুর্ত দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথাটা সহ্য করার প্রয়াস চালালো। কিন্তু কতটুকু সফল হলো জানেনা সে। দম বন্ধ রাখা অবস্থাতেই চোখ বুঁজে গেলো তার। আগন্তুক বিকৃত হাসলো। হাতের মোটা লাঠিতে দূরে ছুঁড়ে মেরে তার লোভাতুর দৃষ্টি খানা বুলিয়ে নিলো রাজকন্যার গতরে। লালসায় জিহ্বাখানা ঝুলে পড়ছে কুকুরের মতো। নিশপিশ করা হাতটা বারবার ছুটে যাচ্ছে সেদিক পানে। এই মুহুর্তে নিজেকে দমিয়ে রাখাও যেন অগ্নিপরীক্ষার সমান হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার কাছে। তবুও নিজেকে সামলে নিলো আগন্তুক। ওস্তাদজীর কঠিন আদেশ! একটু হেরফের হলে জান যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

আগন্তুক নিজের মনের অতৃপ্ত বাসনাগুলো দমিয়ে রেখে পাঁজা কোলে তুলে নিলো রাজকন্যাকে। এখন তাকে নিয়ে কুঠুরিতে ফেরা যাক। জঙ্গল পেছনে রেখে অন্যপথ দিয়ে রাজকন্যাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো আগন্তুক। রাজকন্যার অচেতন শরীরটা ঘোড়ার পিঠে তুলে নিজেও উঠে বসলো। অতঃপর ঘোড়া ছুটিয়ে চলল ডাকাতদের কুঠুরিতে।

__

কয়েক প্রহর কেটে গেলো ঠিক এমনই করে। রাজকন্যা আর ফিরলো না প্রাসাদে। রাজকুমার সহ প্রাসাদের সকল লোক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। এত সময় পেরিয়ে গেলো অথচ এখনও রাজকন্যার দেখা নেই। কোথায় আছে সে? কোথায় গেল?

রাজকুমার দুশ্চিন্তায় হাসফাস করছে। কক্ষে বসে কেবল পায়চারি করে যাচ্ছে সেই তখন থেকে। না, আর বসে থাকা সম্ভব নয়। তাকে এক্ষনি রাজকন্যার খোঁজে বের হতে হবে। রাজা সিরাদউদ্দীনের ইতিহাস পূনরায় ঘটতে পারেনা রাজকন্যার জীবনে। অসম্ভব! সে থাকতে তো কোনোদিন এই অন্যায় হতে দিবেনা।

“রাজকুমার? আপনি কি যাচ্ছেন রাজকন্যার খোঁজে?”

আদিমের বিচলিত কন্ঠ শোনা গেলো। রাজকুমার তৈরী হয়ে নিলো। আদিমকে দেখে হঠাৎ ভালো লাগলো তার। এই প্রাসাদে হয়তো এই একটা মানুষই আছে যে রাজকন্যাকে নিয়ে ভাবে। চিন্তা করে। এবং রাজকন্যার বিপদে যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাকে সাহায্য করবার।

“হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি রাজকন্যার খোঁজে। তুমি কি যেতে চাও আদিম?”

“নিশ্চয়ই যেতে চাই রাজকুমার। আমি ভেবেছি আপনি এখনও যেতে না চাইলে আমি একাই বেরোতাম রাজকন্যার খোঁজে।”

“বেশ। চলো তবে।”

রাজকুমার বেরোবার জন্য পা বাড়াতেই পিছু ডাকে আদিম।

“রাজকুমার?”

“হ্যাঁ।”

রাজকুমার পেছন মুড়ে জবাব দেয়। দেখতে পায় আদিমের অসহায় মণ্ডিত মুখখানা। রাজকুমারের বুকের ভেতর কেমন করে। সংকুচিত মনে প্রশ্ন করে,

“কি হয়েছে?”

“রেদোয়ানকে কেউ মুক্ত করেছে! এবং আরহামকে পাহারা দেওয়া প্রহরীসহ অপহরণ হয়েছে সে। রাজকন্যা আমায় প্রশ্ন করলে আমি কি জবাব দিবো তাকে?”

রাজকুমারের মুখের ভঙ্গিমা খুবই স্বাভাবিক,শান্ত। এ-কথার পৃষ্ঠে আদিমের আশংকা করা রাজকুমারের আচরণ তেমন কিছুই হলোনা। বরং খুবই স্বাভাবিক রইলো। আদিম সন্দেহজনীতে দৃষ্টিতে তাকায় রাজকুমারের দিকে। তবে সন্দেহ টা মনে মনেই রাখে। বাইরে প্রকাশ করেনা।

“এই মুহুর্তে আমাদের রাজকন্যাকে খুঁজে পাওয়াটা বেশি দরকার আদিম। আরহাম আর রেদোয়ানকে আমরা পরেও খুঁজে বের করতে পারবো।”

“যথাআজ্ঞা রাজকুমার।”

রাজকুমার আর আদিম বেরিয়ে পড়ে রাজকন্যার তালাশে। রাজপ্রাসাদের বাকি সদস্যরা ওখানেই পড়ে থাকে। তাদের দায়িত্ব দিয়ে যাওয়া হয় মন্ত্রী মশাইয়ের উপর। রাজকন্যা ব্যতীত এই প্রাসাদ আজ শূন্য। বেশ অনুভব করেছিলো রাজকুমার। তাই যেকোনো মূল্যেই হোক সে রাজকন্যাকে ফিরিয়ে আনবে এই প্রাসাদে। এই রাজপ্রাসাদে রাজ করার অধিকার একমাত্র রাজকন্যা হূরিয়ারই আছে। আর কারোর নেই! আর কারোর না।

__

রেদোয়ান পাহাড়া দিচ্ছে তার ভাইকে। একটু আধটু সেবাও করছে। সে ততটাও খারাপ নয় যতটা তার ভাই তাকে ভাবে। ছোট বেলায় যেটাই হয়েছিলো সেটা কেবলই হিংসের কবলে পড়ে করেছিলো সে। আব্বাজানের ভালোবাসা কম পড়ায় সে এমনটা ভেবে নিয়েছিলো তার ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছে আরহাম। কেবল এতটুকুই ছিলো! কিন্তু বড় হয়ে যখন ওস্তাদজীর প্ররোচনায় পড়ে ভাইয়ের সঙ্গে এতোবড় একটা অন্যায় করেছিলো তখন ঠিকই কষ্ট হচ্ছিলো। তবে মুখে বলে কি হতো? কে শুনতো ওর কথা? কে বারন করতো এই অন্যায় না করতে। যাই হয়ে যাক না কেন, সে তো এদেরই খেয়ে-পড়ে এতো দিন বেঁচেছিলো।

দু’জন আহত ব্যক্তি শুয়ে আছে পাশাপাশি। একজন আরহাম আর অন্যজন…

আর ভাবার সুযোগ হলো না রেদোয়ানের। বিকট শব্দে চমকে উঠলো সে। আরহামের পাশ থেকে উঠে দৌঁড়ে এলো বাইরে। ভোর হয়েছে অনেক্ষন। চারপাশে প্রকৃতির আলোয় ঝলমল করছে। একটু দূরেই কয়েকটা লা/শ পড়ে আছে। তাঁদের শরীরের তাজা র’ক্তে বনবাদাড় ভিজে উঠেছে প্রায়। রেদোয়ানের কপাল কুঁচকে এলো। এঁদের খু/ন করলো কে? তার মস্তিষ্ক সতর্ক বার্তা দিচ্ছে। বিপদ নয়তো? সরদারও যে নেই এখানে? আরহাম আর ঐ মানুষটাকে নিয়ে কি এক্ষনি প্রস্থান করা উচিৎ তার?

___

অন্ধকার পাতালপুরীতে বন্দী রাজকন্যা। তার হাতেপায়ে শিকল পড়ানো। মাথার পেছনটায় র’ক্ত শুঁকিয়ে আছে। শরীরের ব্যাথায় নড়াচড়া দায়। এখানে এমন বন্দী হয়ে ঠিক কত সময় ছিলো হিসেব করতে পারলো না সে। হুঁশ ফিরলে যখন চোখ মেলে তাকালো তখন এই অন্ধকার পাতালপুরীকে কবরস্থান বলেই বোধ হয়েছে তার। হঠাৎ মনে পড়লো জঙ্গলের কথা। কেউ তাকে আক্রমণ করেছিলো! আর তারপর..

মনে করতে পারলো না রাজকন্যা। মাথার পেছনটা কেমন ব্যাথায় টানটান করে উঠলো। মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে আর্তনাদ করলো। কোথায় আছে সে? কে বন্দী করলো তাকে? ডাকাতদল?

রাজকন্যার মনে শঙ্কা ভর করলো। প্রথমে খানিকটা ভয় পেলেও ধাতস্থ করলো নিজেকে। এখন প্রভাত না রজনী বোঝার চেষ্টা চালালো। অতঃপর একাই হাসলো। মনেমনে বাক্য আওড়ালো,

“স্বাগতম ওস্তাদজী। সু-স্বাগতম।”

বলতে বলতে নড়ার চেষ্টা করলো সে। নড়তে পারছেনা! এই শিকল ভাঙ্গবে কেমন করে সে?

একটু দূরেই কারোর পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো। রাজকন্যা সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো। কেউ আসছে এদিকে! ওস্তাদজী নয়তো? নাকি নাজিমউদ্দীন? যেই হোক। দুর্বল হলে চলবেনা। শক্ত হও রাজকন্যা। দৃঢ় মনোবল জোগাড় করো।

হারিকেনের আলো প্রজ্বলিত হলো ধীরেধীরে। একখানা অচেনা মুখ ভেসে উঠলো ক্রমশ। রাজকন্যা কোনোদিন দেখেনি তাকে। তাকে দেখতেই কেন যেন বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। তার প্রত্যাশা অনুযায়ী ইনি ওস্তাদজী নন! অন্যকেউ। অল্প বয়সের এক যুবক। তবে কি সে ভুল ভেবেছে? ডাকাতদলের হাতে সে বন্দী হয়নি? হয়েছে এই অচেনা যুবকের কাছে? কে এই যুবক?

রাজকন্যার দৃষ্টি কুটিল হয়ে এলো। ডাকাতদল ব্যাতীত এতো বড় স্পর্ধা কেউ করবেনা বলে সে জানতো। কিন্তু এ আবার কোন দল এলো?

যুবকটি রাজকন্যার কাছে এসে দাঁড়ালো। হাতের হারিকেনটা উঁচিয়ে ধরলো মুখের কাছে। কেমন অদ্ভুত কিসিমে’র হাসি দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“সুপ্রভাত রাজকন্যা।”

বলেই খ্যাকখ্যাক করে হাসলো। বিকৃত হাসি। রাজকন্যার মন কু-ডাকলো। এ কোন নতুন বিপদ জুটলো কপালে।

“ইশশ! একি দশা হয়েছে রাজকন্যা তোমার? এলোমেলো পোশাক,কা/টা/ছেঁ/ড়া হাত,পা। র/ক্তে ভেজা কপাল,মাথা! শিকল বন্দী! কষ্ট হচ্ছে খুব তাই না?”

যুবকের কৌতুক স্বরে রাজকন্যার দৃষ্টি বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে কটাক্ষ করে উঠলো সে,

“কাপুরুষ!”

যুবকের হাসি উবে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে উধাও হলো তার কৌতুক আচরণ। চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো,

“কি বললে তুমি?”

রাজকন্যা গুরুত্ব দিলোনা তার কথার। সে এক বাক্যেই যেন সবটা বুঝিয়ে দিয়েছে যুবককে। যুবক রাজকন্যার চুপ থাকায় যেন আরও ক্ষেপে গেলো।

“এতো বড় স্পর্ধা তোমার তুমি আমায় কাপুরুষ বলো? শুনে রাখো,তোমাকে এই পাতালে আমি বন্দী করেছি৷ এই আমি। মেরাজ। কই,তখন তো তোমার হুঁশই ছিলো না! হাহা। আটকাতে পারলেনা আমায়?”

রাজকন্যা তাচ্ছিল্যের সহিত হাসলো। মেরাজের গা পুড়িয়ে বলল,

“তুমি যে কাপুরুষ তার আরও একটা প্রমান দিয়ে আমায় ধন্য করলে তুমি। এক কন্যাকে কেবল বন্দী করতে এতো কৌশল? তাকে কাপুরুষের মতো পেছন থেকে আঘাত করলে। এতোই যখন পুরুষত্বের অহংকার তোমার তবে কেন লড়লে না আমার সঙ্গে? কেন পরাজিত করে আমায় বন্দী করলেনা হে অধম?”

রাজকন্যার ভাবলেশহীন কথায় গায়ে ফোস্কা পড়লো মেরাজের। সাপের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করছে। এই পুঁচকে মেয়ের এতো দুঃসাহস? কি করতো সে সামনাসামনি লড়াই করে? তার তলোয়ারের এক আঘাতে তক্ষনি তো ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে যেতো। আর সে কিনা তাকে কাপুরুষ বলছে? তাকে অধম বলছে?

হঠাৎ মস্তিষ্কে ভর করলো বিকৃত চিন্তা। তাকে কাপুরুষ বলছে তো? তাহলে এখন সেও দেখাবে তার পুরুষত্ব। বন্দী রাজকন্যা কেমন করে আটকাবে তাকে? সেও দেখতে চায়।

মেরাজের ঠোঁটের কোনের ওমন বিকৃত হাসিতে বুক কেঁপে উঠলো রাজকন্যার। সে যেন বুঝে ফেললো মেরাজ কি পরিকল্পনা করছে মনেমনে। রাজকন্যা সতর্ক হলো। মেরাজ তার দিকে পা বাড়ালেই বন্দী অবস্থাতেই আক্রমণ করবে তার উপর। কিন্তু তা সম্ভব হলো না! তার হাত-পা যেমন করে বাঁধা আছে তাতে সে এক ইঞ্চিও নড়তে পারবেনা।

মেরাজ হাত থেকে নামিয়ে রাখলো হারিকেনটা। বিকৃত হাসতে হাসতে বসলো রাজকন্যার পায়ের কাছে। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি বোলাতে লাগলো রাজকন্যার শরীরের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে। রাজকন্যার গা গুলিয়ে উঠলো। মনেমনে আর্তনাদ করছে সে। এই পশুকে কি করে আটকাবে এই মুহুর্তে?

“রাজকন্যা বন্দী আজ,
ডাকাত-পুরীর ডেরায়!
রাজকুমার কি আসবে ফিরে?
এটাই তো তার কাজ!
হায় রে কপাল পোড়া,
রাজকুমার তো সেই কবে মরা!
কি করে সে আসবে নিতে?
বন্দী যে ঐ ধরণীতে।

নাটকীয় সুরে বলতে বলতে বিকৃত শব্দে হেসে ওঠে মেরাজ। রাজকন্যা আতংক গলায় চেঁচায়,

” অসম্ভব! আ্ আমার রাজকুমার কিছুতেই বন্দী হতে পারেনা।”

“তুমি বড় বোকা রাজকন্যা। বড্ড বোকা।”

ফিসফিসিয়ে বলতে বলতে মেরাজ হাত বাড়িয়ে দেয় রাজকন্যার শরীরের দিকে। রাজকন্যা হুংকার ছাড়ে,চেঁচায় কিন্তু কোনে কিছুতেই থামেনা মেরাজ। সে তার কুচিন্তায় নিমজ্জিত। রাজকন্যাকে ছুঁবে প্রায় ঠিক এমন মুহুর্তে বাতাসের তীব্র তেজে ছিটকে পড়ে দূরে। কেউ তাকে পেছন থেকে লাথি মেরেছে। আর এমন জোরে মেরেছে যে তার বসে থাকার জো হলো না। ছিটকে একদম শেষ মাথায় পড়লো। চাপা আর্তনাদ করে সামনের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়ার পূর্বেই সে হুংকার করে উঠলো,

“জা/নো/য়া/র! তোর এতো বড় দুঃসাহস হয়েছে যে তুই..”

রাজকন্যা চমকে উঠলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুখ উঁচিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো তার প্রত্যাশার মুখ খানা। আনন্দে তার মনটা ছটফট করে উঠলো। না চাইতেও ঠোঁটের কোনে এসে জড়ো হলো প্রশান্তির হাসি। হা করলো ব্যাক্তিটার নাম উচ্চারণ করবেই বলে। কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তে তাকে থমকাতে হলো। তার আনন্দ, প্রশান্তি সব একসাথে ধামাচাপা পড়লো এই পাতালপুরী। মেরাজ আক্রোশ নিয়ে নাম জপ করলো তার,

“আয়াস! তুই এখানে কি করছিস?”

#চলবে__

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌺💞
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২২.

মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কঙ্করগুলো মেরাজের শরীরে প্রায় গেঁথে গেছে। মেঝেতে ভর দিয়ে উঠতে উঠতে বেশ বেগ পেতে হলো তাকে। আয়াসটা একটা দানব! তার আরও একবার প্রমান পেলো সে। কিন্তু সেই বা কম কিসে? আজ তার প্রমান দেবে সে। আর আজ তো ওর বাপেও নেই। এই সুন্দরী রমণীর সামনে নিজের পুরুষত্বের এক দৃষ্টান্ত উদাহরণও হতে পারবে। তারপর একে ছুঁয়ে দিক বা ছিঁ‘ড়ে খাক দেখার জন্য কেউ আসবেনা।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে পৈশাচিক আনন্দে বুক জুড়িয়ে এলো মেরাজের। ওদিকে র’ক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে আয়াস। যেন এক্ষনি কে/য়া/মত ঘটিয়ে দিবে এখানে! ধ্বং/স করে ফেলবে এই নোং/রা দুর্বিনীতকে।

রাজকন্যা স্তব্ধ হয়ে গেলো। মেঝেতে শরীর আঁটকে থাকার মতো আঁটকে গেলো তার কন্ঠনালি। শরীরে কেমন শীতল ভাব ছড়িয়ে পড়লো ক্ষনকালেই। অক্ষিগোলক ভরে উঠলো অবিশ্বাস্যের কালো ছায়ায়। মনটাও বিষিয়ে উঠলো ঐ একই অনুভূতিতে। সে, কি শুনলো কানে? আয়াস! মেরাজ রাজকুমারকে আয়াস বলে ডাকলো? কিন্তু কেন? সে তো আয়াস নয়,সাদ্দাত। রাজকুমার সাদ্দাত! নাহ্! অবিশ্বাস করলে চলবেনা। সে কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তির সামান্য ডাকে তার ভালোবাসার মানুষকে সন্দেহ করতে পারেনা। অসম্ভব।

রাজকন্যা নিজের মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একপ্রকার জোর করেই মেনে নিয়েছে এই অজ্ঞাত ব্যাক্তি মেরাজ এই নামে ভুল করে ডেকেছে রাজকুমারকে। হ্যাঁ, ভুল করেই ডেকেছে।

আয়াস হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়েই এগিয়ে গেলো মেরাজের পানে। মেরাজও এগিয়ে এলো। মুখোমুখি যু/দ্ধ হবে আজ। আয়াস ক্রোধে ফেটে পড়ে কিছু বলতেই যাবে তার পূর্বেই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে গা জ্বলিয়ে বলে ওঠে মেরাজ,

“এই অব্দিও এসে গেলি তবে? আচ্ছা তোর কি কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে আমার পিছু নেওয়ার স্বভাব কখনও যাবেনা?(মুখ উঁচিয়ে তাকিয়ে) কি রে? স্বভাব সেই একই রয়ে গেলো তোর তাইনা? এবার তো নিজেকে একটু সামলা ভাই! আর কতো?”

“রাজকন্যাকে কেন তুলেছিস?”

ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো আয়াস। মেরাজ খানিকটা অবাক হলো। আয়াস সেভাবে ওর পানে হেঁটে এলো তাতে আয়াসের এমন প্রশ্ন যেন আশা করেনি সে। ভেবেছিলো আয়াস এক্ষনি হামলে পড়বে তার উপর।

“কেন আবার? তোর আব্বাজানের আদেশে!”

রাজকন্যা হোঁচট খেলো। কান খাঁড়া করে তাদের কথোপকথন শুনতে গিয়ে একি কানে এলো তার? রাজকুমারের আব্বাজানের আদেশে সে তাকে তুলে এনেছে? কিন্তু রাজামশাই তো অনেক কাল পূর্বেই
মৃ/ত্যু/বরণ করেছেন! তবে কে আদেশ করলো মেরাজকে?

“দেখ ভাই, আমি জানি ওস্তাদজী তোকে খুব ভালোবাসে।”

রাজকন্যা চমকে উঠলো! ওস্তাদজী? মানে ডাকাতদের ওস্তাদজী? হে রব! এ আমি কি শুনছি?

“কিন্তু ততটাও ভরসা আজ অব্দি করতে পারেনি যতটা ভরসা আমার উপর করে এসেছে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে, সেই ছোট্ট বেলা থেকে ওস্তাদজী সব কাজে আমাকে আগে হুকুম করেছে। যদি আমি কোনো ভাবে ব্যর্থ হয়ে যেতাম তারপর সে তোকে ঐ কাজের দায়িত্ব দিতো। মনে নেই?”

আয়াস দুর্বোধ্য হাসলো। এ হাসির মানে খুঁজে পেলোনা মেরাজ। সে আবারও বলতে লাগলো,

“মাত্র কয়েক বর্ষ হলো আমি এই কুঠুরি ছেড়ে অন্য দেশে পারি জমিয়েছি কি? এর মাঝে তো দেখি তুই এই ডেরার লায়েক হয়ে গেছিস! সবার মাথায় চড়ে নাচতে আরম্ভ করেছিস। ওস্তাদজী তোকে বলেনি মেরাজ আসছে? বলেও বা কি করবে বল? বলেনি বলেই তো আমি এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছি। দেখ! দেখ তাকিয়ে? তোর আকাশের চাঁদকে আমি কি করে এই ডেরায় তুলে এনে বন্দী করেছি।”

রাজকন্যার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। নিজের কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা সে। মেরাজের একেকটা কথা কাঁটার মতো ফুটছে শরীরে। আর্তনাদ করছে ভেতরে ভেতরে। ছটফট করছে ক্রমশ।

“আকাশের চাঁদ!”

আয়াস শীতল কন্ঠে আওড়ালো। তার ভেতরেও ঝড় বইছে তুমুল বেগে। হয়তো সে ছটফট করছে তার রাজকন্যার চেয়েও বেশি। কিন্তু দেখাতে পারছেনা। বোঝাতে পারছে। কেবল গিলে খেতে পারছে। পেছন মুড়ে একবার তাকালো তার বন্দিনীর দিকে। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। কি ভেবে ছুট্টে গেলো রাজকন্যার কাছে। হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো ঠিক তার সামনে। কেমন অচৈতন্য মনে দৃষ্টি বোলালে রাজকন্যার বন্দী শরীরে। ভারী শিকল দিয়ে বাঁধার কারণে কালশিটে দাগ পড়ে গেছে অনেক জায়গায়। র/ক্ত জমাট বেঁধেছে শরীরের কিছু কিছু জায়গায়।
মুহুর্তেই আক্রোশ চেপে বসলো তার আহত মনে। ইগলের ন্যায় ভয়ানক দৃষ্টি মেলে তাকালো মেরাজের দিকে। গর্জে উঠে বলল,

“মুক্ত কর রাজকন্যাকে। নয়তো আজ এই ডেরায়
র/ক্তে/র বন্যা বয়ে যাবে। যার শুরুটা আয়াস তোর থেকেই প্রারম্ভ করবে মেরাজ।”

দাঁত বের করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মেরাজ। হাসতে হাসতে দু‘পা এগিয়ে এলো তাদের পানে। হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুঁকে এলো আয়াসের দিকে। রাজকন্যাকে একবার দেখলো লোভাতুর দৃষ্টিতে। অতঃপর বলল,

“মুক্ত করবো। অবশ্যই করবো। তার আগে তোর সহধর্মিণীকে বল মেরাজের হাতে স্বইচ্ছায় নিজেকে সঁপে দিতে। কতকাল কোনো নারী সঙ্গ পায়নি বলতো..আজ একদম… আআআ”(বিকট শব্দ করে)

মেরাজের কথা শেষ হলোনা। তার পূর্বেই আয়াসের তলো/য়ারের এক কোঁ/পে ফ্যাচ করে কে/টে গেলো তার বাহুর দিকটা। আর্তনাদী গলায় চেঁচিয়ে উঠেই ছিটকে পড়লো অদূরে। আয়াস চোখের পলকে দাঁড়িয়ে গেলো। আক্রোশ ভরা দৃষ্টি নিয়েই এগিয়ে গেলো মেরাজের দিকে। মেরাজ মেঝেতে পড়ে গেলো। বাহু ধরে চেঁচাতে নিলেই মেরাজের বুকের উপর আয়াস পা তুলে দেয়। পিষে ধরে তাকে কঙ্কর বিশিষ্ট মেঝেতে। মেরাজের পিঠে কয়েকটা কঙ্কর ঢুকে যায়। মেরাজ চেঁচায়! কেমন ভাঙা গলায় চেঁচায়। কিন্তু শোনেনা আয়াস। রাজকন্যা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের পানে। তার দৃষ্টি অসহ্য হয়ে ওঠে। গা গোলায়। মাথায় ভারযুক্ত কিছু অনুভব করে। সহ্য করতে পারেনা এই চেঁচামেচি।

আয়াস তলো/য়ার ঠে/সে ধরে মেরাজের গলার কাছটাতে। রাগে,ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গেছে সে। তার রাজকন্যাকে নিয়ে এতো বড় কথা কি করে বলে ফেললো এই জা/নো/য়া/র। ওর কত বড় কলিজা হয়েছে দেখতে চায় সে।

“আমার সহধর্মিণীকে তোর হাতে সঁপে দেবো? যে আয়াস তার এক বাক্য কাউকে ফেরায় সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে তোর মতো একটা
জানো/য়ারের কাছে সঁপে দেবে? যে আয়াস তার মাথার একটা কেশ কাউকে স্পর্শ করতে দেয়না সে তার প্রণয়নীকে তোর মতো একটা জানো/য়ারের কাছে সঁপে দেবে? যে আয়াস আজ অব্দি একটা তার একটা ছেঁড়া পোশাক তোকে ছুঁতে দেয়নি সেই আয়াস তার সবচেয়ে দামী,মূল্যবান জিনিসটা তোর মতো একটা কুলাঙ্গারকে সঁপে দেবে? এতোই সহজ রে? এতোই সহজ আমার চাঁদের দিকে চোখ মেলে তাকানো? এতোই সহজ হু?”

শেষোক্ত কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে বলেই আয়াস হাতের তলো/য়ারটা ঠে/সে পুরে দিলো মেরাজের বাঁ চোখটায়। মেরাজ ব্যাথায় ভুবন কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল। এমন একটা নৃ/শংস কান্ড করতে আয়াসের একদণ্ডও হাত কাঁপলো না। এক খাবলা তাজা র’ক্ত আয়াসের চোখমুখ ঢেকে দিলে সে অন্যহাতে তা মুছতে মুছতে দুর্বোধ্য হাসলো। রাজকন্যা গুঙিয়ে উঠলো এমন নৃ/শংস কান্ড দেখে। তার চোখ লেগে আসার পর্যায় হলো। চাপা আর্তনাদ করলো সে। কিন্তু সেই আর্তনাদ কানে এলোনা আয়াসের। সে একটানে মেরাজের চোখ থেকে তলো/য়ারটা বের করে আনলো। তারপর আচমকাই হুংকার করে বলে উঠলো,

“ঐ চাঁদ কেবল আমার! আর ঐ চাঁদকে যে চোখ মেলে দেখবে তারও ঠিক একই, এই একই দশা হবে।”

মেরাজ আর্তনাদী গলায় চেঁচিয়েই চলেছে। এক্ষনি ওর চিকিৎসা না হলে ও ম/রেও যেতে পারে। এ কথা জানে আয়াস। আর সে মনেপ্রাণে চায় যেন মেরাজ ম/রেই যায়। কিন্তু সে চাইলেও এ কাজ সম্ভব নয়। মেরাজ আর কেউ নয়, তার আব্বাজানের প্রানপ্রিয় বন্ধু নাজিমউদ্দীনের একমাত্র পুত্র। এখানেই তার বাঁধা। নাজিমউদ্দীনের পুত্রকে সে এভাবে হ/ত্যা করতে পারেনা। তবে যেটুকু পেরেছে তাতেই মনের ক্ষোভ অনেকটা কমেছে।

মেরাজের পোশাকের পকেট কেটে রাজকন্যার শিকলের চাবি বের করে উঠে দাঁড়ালো আয়াস। চাবির দিকে কয়েক মুহুর্তে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মেরাজের পানে তাকালো। বাঁকা হেসে পূণরায় পা রাখলো মেরাজের বুকে। দুর্বোধ্য হেসে শান্ত স্বরে বলল,

“তোর মতো নর্দমার কীটের জায়গাটা ঠিক কোথায় তার আরও একটা প্রমাণ দিয়ে দিলাম। চেয়ে দেখ! ওহ্! চেয়ে দেখবি কেমন করে? তোর তো চোখই উ/পড়ে দিলাম। দুঃখিত ভাই, কিছু মনে করিসনা। আব্বাজানকে জানিয়ে দিস,আয়াস তার উদ্দেশ্য বদলে ফেলেছে।”

বলতে বলতে পায়ের জোর বাড়িয়ে দিতেই দম আঁটকে এলো মেরাজেরে। তার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস নিতে না পারার যন্ত্রণায় কাশতে কাশতে আয়াসের পা চেপে ধরলো। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলে ছেড়ে দেয় আয়াস। অতঃপর পাশ ফিরে একবার রাজকন্যার ফ্যাকাসে মুখখানার দিকে তাকায়। সেই পুরনো অনুভূতি ফের পিষে নেয় তাকে। বুকের ভেতর পূনরায় শুরু করে তোলপাড়। রাজকন্যা স্নিগ্ধ অক্ষিপটে আজ তার জন্য কেবলই এক অবিশ্বাস্যের কালো ছায়া। যা তাকে ক্রমশই বিধ্বস্ত করছে,পোড়াচ্ছে।

অসহনীয় যন্ত্রণা দিচ্ছে। বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। আর দাঁড়িয়ে রইলো না। দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো রাজকন্যার পানে। কয়েক মুহুর্ত স্থবির দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটু ভেঙে বসলো। দৃষ্টি মাটিতে বিদ্ধ। কোন মুখে রাজকন্যার চোখে চোখ রাখবে জানেনা সে। বক্ষজুড়ে এক বিষ ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশই। আর তার হলো রাজকন্যার ঘৃণা দৃষ্টি। রাজকন্যা ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়াসের মুখপানে। কেমন করে পারলো সে? এতোবড় ধোঁকা দিতে!

আয়াস রাজকন্যার হাতেপায়ের শিকল খুলে দিলো। তার দৃষ্টি এখনও নীচে। রাজকন্যার পায়ের কাছে। রাজকন্যা শিকল থেকে মুক্ত হতেই দূরত্ব করে নিলো আয়াসের কাছ থেকে। যা বুঝতেই আয়াস আহত দৃষ্টিতে তাকালো রাজকন্যার পানে। কম্পিত কণ্ঠে ঢোক গিললো একবার। আজ তার কিছু বলার শক্তি নেই। আর সে কিছু বলতেও চায়না। সে জনতো একদিন না একদিন ঠিক এমন একটা মুহুর্তের স্বীকার তাকে হতে হবে! তাই বলে এতো দ্রুত তা ঘটবে ভাবতে পারেনি।

“বিশ্বাসঘাতক! আমার স্বামী একজন বিশ্বাসঘাতক। দিনের পর দিন নির্লজ্জের মতো সে আমায় ঠকিয়ে গেছে! এই ভালোবাসা, এই বিয়ে,এই মিলন.. স্ সবটাই তবে ধোঁকা ছিলো? প্রতি ক্ষনে ক্ষনে স্বীকার করা,সে আমায় ভালোবাসে!’ সবটাই ধোঁকা ছিলো? রাজকুমার! রাজকুমারকে ভালোবেসে ভুল করেছিলাম আমি? অবশ্যই ভুল করেছিলাম! তাই না রাজকুমার?”

আয়াস আহত হলো। দুমড়েমুচড়ে গেলো তার বক্ষদেশ! অক্ষিপটে ভরাট হলো হাহাকার। সে তার পাপী দৃষ্টি তুলে তাকাতে পারলোনা। নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতেও কিছু বলতে পারলোনা। পারলো কেবল অপরাধ বোধে জ্বলতে।

রাজকন্যা কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। তার দৃষ্টি এলোমেলো। অক্ষিপটের আঙ্গিনা গলিয়ে জল পড়ছে। ক্ষত হাতের উল্টো পিঠে সে চোখের জল মুছলো। এই ছোট্ট জীবনটা তাকে আরও একবার অসহায় করে দিলো প্রিয়জনের শূন্যতায়! আজ অব্দি তার একটা প্রিয় মানুষ হলো না।

“রাজকন্যা…”

আয়াস এলোমেলো পায়ে এসে দাঁড়ালো রাজকন্যার সামনে। নিজের অধিকারবোধ থেকেই হাত জোড়া বাড়িয়ে দিলো আহত রাজকন্যার দিকে। কিন্তু ছুঁতে পারলো না। রাজকন্যা হাতের কৌশল আয়াসের তলোয়ার নিজের হাতে তুলে নিয়েই ঠেকিয়ে ধরলো আয়াসের বক্ষস্থলে। বজ্রকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“খবরদার! ঐ পাপিষ্ঠ মুখে আমি আমার এই নাম শুনতে চাইনা। খবরদার!”

একটু থামলো রাজকন্যা। অতঃপর আবারও আওড়ালো,

“রাজকুমার কোথায়? কোথায় বন্দী করেছেন তাকে?”

“সে ভালো আছে রাজকন্যা। চিন্তা করার কোনো কারন নেই।”

“আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

“জোহুকুম।”

আয়াস মাথা নত করে নিলো। অমনি নেত্রকোন গলিয়ে দু’ফোটা জল এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো তার গাল। ঢোক গিললো সে। কিছু বলতে চায় রাজকন্যাকে। কিন্তু বলতে পারছেনা!

“দাঁড়ান!”

রাজকন্যা পিছু ডাকে। আয়াস আনন্দিত মনে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ। পেছন মুড়ে তাকায় উৎফুল্ল দৃষ্টিতে। তার ঠোঁটের কোনে বিরাজমান হয় স্নিগ্ধ কোমল হাসি। কিন্তু তা কেবল অবাঞ্ছিত কয়েক ক্ষণের ভ্রম। রাজকন্যার পরবর্তী প্রশ্নে হারিয়ে যায় তা,

“আপনার উদ্দেশ্য কি কেবল আমাকে নিঃশেষ করাই ছিলো? সত্যিকারের ভালোবাসননি কখনও?”

আয়াসের দম আঁটকে পড়ে। ইচ্ছে করে চিৎকার করে জানান দিতে, “কসম আল্লাহ-র,আমি আপনাকে ভালোবাসি রাজকন্যা!” কিন্তু বলতে পারেনা। কথা গুলো দলা পাকিয়ে যায় কন্ঠনালিতে। এতো অপরাধ করার পরও সে কোনমুখে তাকে বলবে, সে তাকে ভালোবাসে। নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।

#চলবে____

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌺
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
২৩•

“সুফি!”

রাজকন্যার গলার আওয়াজ পেতেই চিঁহি চিঁহি করে ছুটে এলো সুফি। রাজকন্যাও এগিয়ে গেলো তার পানে। সুফির সাদা শরীরে লাল র/ক্তে/র ছোপ ছোপ দাগগুলো শুকিয়ে আছে। রাজকন্যা হাত বুলালো সেখানে।

রাজকন্যা ফেরত না আসায় সুফি প্রবেশ করেছিলো সেই জঙ্গলে। আর রাজকন্যাকে খুঁজতে গিয়েই তার শরীরের এই দশা।

“সুফি এখানে কি করে এলো?”

প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। আয়াস মুখ উঁচিয়ে তাকালো। একপলক সুফিকে দেখতেই তার মনে পড়লো সেদিন রাতের সেই মুহুর্তের কথা। যেদিন প্রথমবার রাজকন্যা আর তার দেখা হয়েছিলো খোলা প্রান্তরে। রাজকন্যা তাকে অধম বলে ডেকেছিলো। নানাবিধ কথার একপর্যায়ে রাজকন্যা যখন চলে যাচ্ছিলো তখন একবারের জন্য তার মনে হয়েছিলো এই কন্যা আর কেউ নয়, রাজকন্যা হূরিয়াই হবে।

ভাবনার ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো আয়াস। ছোট্ট করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“আমি নিয়ে এসেছি।”

“কিন্তু ওকে আপনি পেলেন কোথায়?”

“আপনাকে খুঁজে না পেয়ে আমি প্রথমে ঐ জঙ্গলটাতেই আসি যেখানে আব্বাজানের বন্ধু নাজিমউদ্দীন ছিলেন। আমি জানতাম আপনি কোথাও গেলে এখানেই আসবেন। আর যখন আপনাকে খুঁজতে কুটিরে যাই তখন দেখতে পাই আপনার ঘোড়াকে। পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিলো জঙ্গলের ভেতর। ওকে এই অবস্থায় দেখে ঠাওর করে নিয়েছিলাম হয়তো আপনি..”

রাজকন্যা পেছন মুড়ে তাকালো আয়াসের দিকে। রাজকন্যা ফিরে তাকাতে আয়াসের গলার আওয়াজ ওখানেই বন্ধ হলো। আয়াস শুঁকনো গলায় ঢোক গিললো। রাজকন্যা হঠাৎ তাচ্ছিল্য করে হাসলো। আহত স্বরে আওড়ালো,

“আমায় বন্দী করে এখানে নিয়ে আসার কথা আপনার ছিলো। তাই না?”

আয়াস বিষাদে তলিয়ে গেলো। মানুষের জীবনের বাস্তবতা এতো কঠিন কেন হয়? রাজকন্যার সহজ সরল প্রশ্নটায় তো এক রত্তিও ভুল নেই। এটাই তো তার উদ্দেশ্য ছিলো! সেই শুরু থেকে শেষ অব্দি। তবে কেন হঠাৎ এতো কষ্ট হচ্ছে সামান্য এক বিষয় নিয়ে। কষ্ট হওয়ার কারন কি?

“নিয়তি কত নিষ্ঠুর! চিন্তা করবেন না,আজ থেকে আপনার আর আমার পথ আলাদাই হবে। আপনি আপনার আব্বাজানের হুকুম পালনে পূনরায় নিয়োজিত হতে পারবেন। কেউ আর আপনার বাঁধা হবেনা। কেউ হবেনা। এমনকি রাজকন্যাও নয়।”

রাজকন্যা আবারও বলল। তার কন্ঠনালি কেমন কেঁপে কেঁপে আসছিলো। আয়াস আঁটকে রাখা দমটা ছেড়ে দিলো সন্তর্পণে। অপরাধী গলায় বলার চেষ্টা করলো,

“আমাদের এবার যাওয়া উচিৎ রাজকন্যা। এই ডেরায় বেশিক্ষন থাকাটা আমাদের জন্য ঠিক হবেনা। বিপদ চারিদিকে বিষাক্ত সাপের ন্যায় ফ্যানা ধরে আছে। সুযোগ পেলেই ছোবল মেরে দিতে দু’বার ভাববে না।”

রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আর কথ বাড়ালো না। কয়েকমুহুর্ত আয়াসের মুখ পানে তাকিয়ে থেকে উঠে পড়লো সুফির পিঠে। আয়াসও আর দাঁড়িয়ে রইলো না। রাজকন্যার পেছনে উঠে বসলো সেও। রাজকন্যা সুফির পিঠ চাপড়ে দিতে ধীরে ধীরে পা বাড়ালো সুফি। ডাকাতদের ডেরা পেরিয়ে বাইরে আসতেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো সুফি। রাজকন্যা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো সুফির দিকে। সুফি দাঁত খিঁচিয়ে ডেকে উঠলো। এবার অবাক হয় আয়াসও।

“সুফি, কি হলো তোমার? আমাদের দেরী হচ্ছে..”

সুফি আবারও ডাকে। রাজকন্যা বিরক্ত হয়। গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে আয়াসের উদ্দেশ্যে বলে,

“সুফি ক্ষুধার্ত। তাই চলতে পারছেনা।”

আয়াস কিছু বলল না। আস্তে করে নেমে পড়লো। রাজকন্যাও নেমে পড়তে চাইলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো আয়াস,

“আপনাকে নামতে হবেনা। আপনি বসুন। সামনে কয়েকটা মাঠ আছে। সুফিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

“ওর কষ্ট হচ্ছে আমার ভারে। আমার নেমে পড়াই শ্রেয়।”

“আমি বলছি তো। বসুন আপনি। একবার নিজের অবস্থাটাও দেখুন দয়াকরে।”

আয়াসের কন্ঠে অধিকার বোধ পেলেই বুকটা কাঁপে রাজকন্যার। মনটা কেমন ভেঙে আসে। হঠাৎই বলে বসে,

“মানুষ কেবল শরীরের ক্ষতই দেখে, মনের ক্ষত দেখার সাধ্য এই ধরণীর কারোর নেই।”

আয়াস থমকায়। তার বুকের ভেতর টা ছ্যাঁত করে পোড়ে। কিন্তু কোনো জবাব দিতে পারেনা। আজ তার জবাবের ভান্ডারে শূন্য। একদম শূন্য।

রাজকন্যা আর নামেনা। মনে শত রাগ,অভিমান চেপে রেখেই মেনে নেয় আয়াসের কথা। চুপটি করে বসে থাকে সুফির পিঠে। আয়াস সুফিকে নিয়ে এগিয়ে চলে মাঠের দিকে। মাঠের এক প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা তা দেখেও না দেখার ভান করে আস্তে ধীরে নেমে পড়ে সুফির পিঠ থেকে। সুফি এগিয়ে যায় ক্ষুধা মেটাতে। রাজকন্যা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে আয়াসও। তবে বারবার আঁড়চোখে দেখে তার প্রনয়নীকে। মুখবিবরের ছিলে গিয়ে র/ক্তমুখো হয়ে আছে। পোশাকের বাইরে খোলা হাত দুটো ভারী শিকলের চাপে কালশিটে দাগ হয়ে গেছে। কয়েকটা আঙ্গুল কেটে র/ক্ত ঝড়ে সেটাও এখন শুঁকিয়ে আছে। আয়াসের হঠাৎ দৃষ্টি কাঁপলো কিছু একটা দেখে। সে নিজেকে আর আঁটকে রাখতে না পেরেই এগিয়ে গেলো রাজকন্যার কাছে। কোমরের কাছ থেকে পাতলা ওড়নাটা সরিয়ে হাত রাখলো র/ক্তমুখো হয়ে থাকা জায়গাটায়। রাজকন্যা চমকে ওঠে আয়াসের শীতল ছোঁয়ায়। নেত্রজোড়া কেমন ফাল পেড়ে তাকায় আয়াসের চিন্তান্বিত মুখ বিবরে। কেমন করে গলা জড়িয়ে আসলো তার। হাসফাস করে উঠে পিছিয়ে পড়তে নিলেই আয়াস তার কোমর জড়িয়ে আরও কাছে টেনে আনে। রাজকন্যা ভড়কে যায়। ধমকের সুরে বলে ওঠে,

“করছেন টা কি? দূরে সরে দাঁড়ান!”

আয়াসের কানে গেলোনা রাজকন্যার গলার স্বর। সে নিজের চেতনায়, চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে।

“এতখানি ছিলে গেছে.. আপনি একবারও মুখ ফুটে কিছু বলছেন না? কেমন মানুষ আপনি?”

অভিযোগ করে বলে উঠলো আয়াস। রাজকন্যা অবাক হয়ে গেলো। স্থির দৃষ্টিতে একবার তাকালো আয়াসের অস্থিরতায় মুষড়ে থাকা মুখমন্ডলে। কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। কেন? কারন,তার সামান্য একটু খানি ছিলে গেছে বলে?ব্যস? আর কিছুই নয়। এসব দেখেও কি তাকে ভাবতে হবে এই মানুষটা তার ক্ষতি করতে এসেছিলো? তাকে এতবড় ধোঁকা দিয়েছে! তাকে মিথ্যে বলেছে! তার ভালোবাসা নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছে!

ভাবতে ভাবতেই রাজকন্যার মনটা বিষিয়ে উঠলো। আয়াসের বুকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো আকস্মিক। আয়াস ধাক্কা খেয়ে আকস্মিক নিজেকে সামলাতে পারলোনা। পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। মুখ তুলে করুন দৃষ্টিতে রাজকন্যার দিকে তাকাতেই হুংকার ছাড়লো রাজকন্যা,

“খবরদার! একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না আপনি।”

আয়াস মাথা নীচু করে নিলো। ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো। অতঃপর মুখ উঁচিয়ে তাকালো রাজকন্যার দিকে। সহায়হীন কন্ঠে বলল,

“আপনার শরীরের এমন অবস্থায় এতপথ যাওয়া ঠিক হবেনা রাজকন্যা। আগে এই জখম গুলো সারাতে..”

“নিজের ভালোটা রাজকন্যা জানে। আপনাকে কষ্ট করে এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে বোধহয়।”

“আমি আপনার স্বামী!”

শক্ত গলায় বলল আয়াস। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো রাজকন্যা,

“একজন ঠকবাজ আর মিথ্যাবাদী। অধিকারবোধের পূর্বে এই শব্দ গুলোও জুড়ে দিন নিজের নামের সঙ্গে। মানায় ভালো।”

আয়াস দমে গেলো। এই জেদী কন্যার সঙ্গে সে পেরে উঠবেনা। তাই আর কিছু বললোনা। আশেপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু খুঁজতে লাগলো। রাজকন্যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো তাকে। কিছু বলবে তার পূর্বেই আয়াস দ্রুত পায়ে ছুটলো কোথাও। রাজকন্যা অবাক হলো কিঞ্চিৎ। তড়িঘড়ি তার পিছু নিয়ে দু’পা এগোতেই আবার থমকে দাঁড়ালো। ___নাহ্! সে যাবেনা তার পিছে। যেদিকে ইচ্ছে যাক সে।

আয়াস আবার ফিরে এলো। কিন্তু খালি হাতে গেলেও ফিরে এলো কিছু জংলী ঔষধী পাতা নিয়ে। রাজকন্যা টের পেলোনা আয়াসের আগমন। সে আনমনে বনের উপর বসে রইলো। আয়াস চুপটি করে বসলো তার পাশে। হাতের ঔষধি পাতা গুলো ভালো করে দলাই-মলাই করে খানিকটা রস বের করে নিঃশব্দে লাগিয়ে দিলো রাজকন্যার কোমরের উপর। রাজকন্যা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। আয়াসের পূণরায় একই কাজে এবার বেশ রেগেও গেলো। কিন্তু সেই রাগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলোনা। ব্যথা জায়গায় ঠান্ডা শীতল কিছু অনুভব হতেই চুপসে গেলো সে। তবে সেই ভালোও সইলোনা কপালে। কয়েক মুহুর্ত পেরোতেই আকস্মিক জ্বলে উঠলো জায়গায়টা। মনে হলো কাটা স্থানে মরিচের গুঁড়ো পড়েছে। আঁতকে উঠে হাত চেপে ধরলো আয়াসের। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো গোঙানির শব্দ। আয়াস বিদিব্যস্ত হয়ে উঠলো হঠাৎ,

“ক্ কি হলো?জ্বালা করছে? বেশি? বেশি জ্বলছে?”

রাজকন্যা ছিটকে পড়লো দূরে। রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলল,

“আপনি কি ডাকাত? মায়াদয়া নেই আপনার?”

আয়াস নিজের হাতের দিকে তাকালো একবার। ফের মুখ তুলে রাজকন্যার কোমরের কাছটাতে তাকালো। আয়াসকে এভাবে তাকাতে দেখে রাজকন্যা তড়িঘড়ি ওড়না দিয়ে ঢেকে দিলো জায়গাটা। আয়াস বাচ্চাসুলভ কন্ঠে আওড়ালো,

“আমি তো ডাকাতই!”

রাজকন্যা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে তেতে ওঠা গলায় বলল,

“কে বলেছে আপনাকে আমার এতো যত্ন নিতে। কতটা জ্বলছে এখানটায়। আমার ভালো আপনার সহ্য হয়না তাইনা?”

“এমনটা নয় রাজকন্যা..”

বলতে বলতে আয়াস এগিয়ে আসতে নিলেই রাজকন্যা আবারও চেঁচায়,

“কাছে আসবেন না! একদম না।”

আয়াস থেমে যায়। গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

“এটা খারাপ কিছু নয় যেটাতে আপনার কষ্ট হতে পারে। এটা ঔষধি পাতা। আপনার জখম গুলো দ্রুত সারিয়ে তুলবে।”

“ধন্য হয়েছি আপনার ঔষধি পাতায়। আমার সত্যি প্রয়োজন নেই।”

আয়াস কপাল কুঁচকায়। রাজকন্যার বারণ না মেনেই এগিয়ে যায় রাজকন্যার দিকে। একপ্রকার জোর করে টেনে আনে তাকে,

“আপনার কি প্রয়োজন আর কি প্রয়োজন নয় সেকথা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা।”

রাজকন্যা এই মুহুর্তে বন্দী আয়াসের বাহুডোরে। আয়াস শক্ত করে চেপে ধরেছে তাকে নিজের সঙ্গে। যেন ছুটে যেতে না পারে। রাজকন্যা ছটফট করতে করতে বলল,

“ছাড়ুন আমায়। আমি এসব লাগাবো না।”

“চুপ করে বসুন তো।”

“কেন বসবো? আপনি কি শুনতে পাননা?”

“আপনি কি শুনতে পাননা? বলছি তো এগুলো দিলে জখম শুঁকিয়ে যাবে। ব্যাথাও থাকবেনা। ঘাঁ-ও থাকবেনা।”

রাজকন্যা নিশ্চুপ হয়ে যায় কয়েকমুহুর্তের জন্য।

“আর মনের জখম? মনের ঘাঁ? কেমন করে শুঁকাবেন সেগুলো?”

আয়াসের হাতের জোর আলগা হয়ে আসে। রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার নেত্রকোন ভিজে ওঠে মুহুর্তেই। কিছু বলতে চায় মানুষটাকে। কিন্তু কি বলবে? সে তো তাকে আদৌও ভালোবাসেনি কোনোদিন। ভালোবাসেনি!

“আমি আপনাকে ঠকায়নি রাজকন্যা!”

রাজকন্যা আয়াসের বক্ষস্থল ছেড়ে উঠে আসতে নিলেই কথাটা বলে আয়াস। কেমন করুন শোনায় তার গলাটা। রাজকন্যা হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছতে মুছতে হাসে। তাচ্ছিল্য মিশ্রিত হাসি। বলে,

“এতকিছুর পরও বলবেন আপনি আমায় ঠকাননি?”

“এসব নিয়ে আমরা পরেও কথা বলতে পারি রাজকন্যা। আপনি একটু চুপটি করে বসুন না। আমি এগুলা লাগিয়ে দেই।”

“ছোঁবেন না আমায়। আপনার ছোঁয়ায় ঘৃনা হয় আমার।”

আয়াস রাজকন্যাকে ছুঁতে নিলেই রাজকন্যার এমন বানিতে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় আয়াসের। আহত হয় সে। আহত দৃষ্টিতে রাজকন্যার দিকে তাকাতেই পাশে সরে পড়ে রাজকন্যা। সে ঢোক গেলে জড়ানো গলায়। হাহাকার করে বুকের বাঁ পাশটায়। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। রাজকন্যা ঠিক মতো বসার পূর্বে আবারও হেঁচকা টানে তাকে নিয়ে আসে নিজের কাছে। এবার একটু বেশিই কাছে টেনে আনে। রাজকন্যা ভড়কানো দৃষ্টিতে তাকালে সে কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে,

“আমার অধিকার আছে আপনাকে ছোঁয়ার। কাছে টানার। গভীর ভাবে ভালোবাসার। আপনার উপর জোর খাটাবার। আপনার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার। আপনার অস্তিত্ব নিজেকে হারিয়ে ফেলার। আমার অধিকার আছে.. আছে আমার অধিকার!”

রাজকন্যার নেত্রকোন গলিয়ে জল পড়লো কয়েক ফোঁটা। সেও ঠিক একই কন্ঠে আওড়ালো,

“আমি মানিনা। মানিনা..”

রাজকন্যা থেমে গেলো। না,থামলো না। থামিয়ে দিলো আয়াস। গাঢ় ছোঁয়ায় আঁকড়ে ধরলো রাজকন্যার কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়। রাজকন্যা কেঁপে উঠে খিঁচে বন্ধ করে নিলো তার নেত্রদ্বয়। পূণরায় ভরাট নেত্র থেকে ফোট কেটে জল গড়ালো। শিরশির করে উঠলো সমস্ত অঙ্গ। বন্ধ হয়ে গেলো নিঃশ্বাস। আয়াস হাত বাড়িয়ে দিলো রাজকন্যার কোমরে। জেদ নিয়েই ঠেসে ধরলো ব্যাথা জায়গাটা। রাজকন্যা অসহ্য ব্যাথায় কেঁপে উঠে মিশে গেলো আয়াসের সঙ্গে। একদম লেপ্টে পড়লো। আয়াস মনেমনে হাসলো। দু’হাতে বাড়িয়ে শক্ত করে মিশিয়ে নিলো রাজকন্যাকে। অতঃপর অধর রেখে মুখ ডুবালো রাজকন্যার গলায়। উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে হঠাৎই কামড় বসালো ধারালো দাঁত দিয়ে। রাজকন্যা ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো। আয়াসকে নিজের থেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় লেগে পড়তেই বলে উঠলো আয়াস,

“আপনি মানেন আর না মানেন,আপনি আমার আমানত। আপনি আমার অধিকার। আপনি আমার। কেবলই আমার। আপনাকে আমার থেকে আলাদা করার সাধ্য কারোর নেই। আপনারও না।

রাজকন্যা রেগেমেগে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে এলো আয়াসের থেকে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

“জোর করে আমাকে আপনি হাসিল করতে পারবেন না।”

আয়াস দুর্বোধ্য হাসলো। রাজকন্যার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

“আপনাকে পেতে যদি আমায় মরতেও হয়,আমি তাতেও পিছপা হবোনা মনোহরীনি।”

#চলবে___