রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-৩+৪+৫

0
293

#রাজকন্যা_হূরিয়া 🌸❤️
#মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৩.

প্রভাতের স্নিগ্ধ আলো তেরছাভাবে এসে মুখের উপর পড়লো। রাজকন্যার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে এটুকুই যথেষ্ট হলো। আধবোজা চোখে তাকালো সে। বাইরের লালিত্যপূর্ন বাসাতে পর্দাগুলো নড়ছে। শরীর বেশ ক্লান্ত রাজকন্যার। প্রাসাদে ফিরেছে দুই প্রহর পূর্বেই। এক্ষনি ঘুমটা ভাঙায় মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম ভাব হচ্ছে। চোখ তুলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও উঠলো। তার যে পাতালঘরে একবার যেতেই হবে। কবিরাজ মশাইয়ের সঙ্গে তার কথা বলাটা অত্যন্ত জরুরি। আম্মাজানে বিষয়ে কবিরাজ মশাই এতবড় চক্রান্ত কিছুতেই করতে পারেন না। না না। এ অসম্ভব।

শয্যা ত্যাগ করলো রাজকন্যা। পোশাক বদলে নিয়ে বের হলো কক্ষ থেকে। এতো ভোরে চাচাজান,চাচীজান,ফুপুআম্মা,আদিম,আলিয়া ওরা কেউই জেগে নেই। তাই ভয়ের কোনো কারন নেই। অবশ্য লাবিবা থাকলে তাকে সঙ্গে রাখা যেতো নির্দিধায়। আদিম আর আলিয়া চাচাজানের সন্তান। ফুপুআম্মা নিঃসন্তান। আর লাবিবা হলো মন্ত্রী মশাইয়ের মেয়ে। রাজকন্যার সখীও বলা যায়। আলিয়ার সাথে রাজকন্যার সখ্যতা তেমন নেই বললেই চলে। তবে লাবিবার সাথে কেমন করে যে এতো ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠলো কারোরই জানা নেই।

পাতালঘরে নেমে এলো রাজকন্যা। হাতে একটা আধ-জ্বলা হারিকেন। নিভে নিভে জ্বলে। চারপাশে প্রহরীরা কঠিন পাহারায়-রত। তারা বিশ্বস্তের ন্যায় রাজকন্যার হুকুম পালনে নিয়োজিত।

“আসুন রাজকন্যা। আমরা আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।”

সেনাপতি আতাউল বলল। তিনি এখানকার দেখভাল করেন। রাজকন্যা মৃদু হাসি উপহার দিলো। বলল,

“চাচাজান এই খবর পাননি তো?”

“অসম্ভব রাজকন্যা। এখান থেকে শতশত লাশ বেরোবে তবুও আপনার হুকুমের হেরফের হবেনা।”

দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো সেনাপতি আতাউল। রাজকন্যা প্রশান্ত হলো। কারাগারের দিকে নির্দেশ করে বলল,

“জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে?”

“হয়েছে রাজকন্যা। কিন্তু উনি মুখ খুলছেন না।”

“মুখ খুলছেন না!” (অবাক কন্ঠে)

“না রাজকন্যা। আমার মনে হয় উনার এই কর্মের পেছনে খুব পাকাপোক্ত কোনো মাথা কাজ করছে।”

“কে হতে পারে? কাকে ধারনা করছেন সেনাপতি?”

“ক্ষমা করবেন রাজকন্যা। শুধু এটুকুই ভাবনাতে এলো।”

রাজকন্যা মাথা নাড়লো। পায়ে পায়ে এগোলো কারাগারের দিকে। ভেতরে দুর্বল শরীর নিয়ে শুয়ে আছেন কবিরাজ মশাই। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় উত্তম মাধ্যম দেওয়া হয়েছে নিশ্চয়ই। তাই ক্লান্ত শরীর টেনে তুলতে পারছেন না। এতো অস্ত্রাঘাত পড়ার পরেও মুখ খুললেন না? এ কেমন রহস্য! কি এমন বানীর রক্ষা করছেন কবিরাজ মশাই যে, নিজের জীবনের বিনিময়েও মুখ খুলছেন না! বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নাহ, এভাবে মুখ খুলবেন না কবিরাজ মশাই। হয়তো এখানে থেকে কারোর ভয়েও মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।

“সেনাপতি মশাই, কবিরাজ মশাইকে অতিদ্রুত কালা-পাহাড়িয়ার নীচে আমাদের পুরোনো কারাগারে বন্দি করার ব্যবস্থা করুন।”

রাজকন্যার হুকুম পেয়ে নতশির করলো সেনাপতি আতাউল। আজ্ঞা পালনে শুধু জবাব দিলো, ‘যথাআজ্ঞা রাজকন্যা’ বলেই ছুটলো। রাজকন্যা আর দাঁড়িয়ে রইলো না। ঠিক যেমন করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পাতালঘরে প্রবেশ করেছিলো ঠিক তেমন করেই আবার সবার চোখের আড়ালে নিজের কক্ষে ফিরে এলো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। ঘুমের অভাবে ভেঙে আসছে হাত-পা। আর তারউপর মস্তিষ্কে নতুন করে যোগ হলো কবিরাজ মশাইের চুপ থাকাটা। উনার মৃত্যুর ভয় নেই! হয়তো নিজের জীবন দিয়ে অন্য কারোর জীবন রক্ষা করছেন। হতে পারে তো! কিন্তু কার? উনি যদি কারোর প্ররোচনায় পড়ে এমন কার্য করেই থাকেন তবে কার প্ররোচনায়? কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এর পেছনে যা ফাঁস হওয়ার ভয়ে সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে! কি এমন রহস্য?

মাথার মধ্যে দপদপ করছে। আর কিছু ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্রামের চেয়েও অতিব প্রয়োজন এতো এতো রহস্যের জাল কেটে বেরিয়ে আসা। কিন্তু পারছেন না সে। যতই রহস্য উদঘাটন করছে ততই রহস্য একে একে সামনে এসে হাজির হচ্ছে।

“রাজকন্যা, আপনাকে বেগমজি স্বরন করেছেন।”

বেগমজি হলো ফুপুআম্মা। দাসীর আওয়াজ আসলো। রাজকন্যা উঠে দাঁড়ালো। ক্লান্ত স্বরে আওড়ালো,

“বলো গিয়ে আমি আসছি।”

“আজ্ঞে।”

দাসী গমন করলো। ফুপুআম্মা নিঃসন্তান! কথাটা বড় অদ্ভুত লাগে রাজকন্যার কানে। কেননা আম্মাজান বলতেন ফুপুআম্মা নিঃসন্তান এ কথা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। উনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা তার পুত্রকে হনন করেছিলেন জন্মাবার ঠিক কয়েক মুহুর্ত বাদেই। সে কথা কেউ জানেনা। কেননা, ফুপুআম্মা চোখ খুলে তার জীবিত পুত্রের মুখ না দেখলেও দেখেছিলেন এক মৃত পুত্রের মুখ। আর একথা জানেনা ফুপুআম্মার স্বামীও। তিনি অবশ্য এক কালে ডাকাতদলের ছিলেন। ডাকাতি করা,মানুষ খুন করাই তার নিত্যদিনের কাজ। এভাবেই দিন যেতো তার এবং তার দলের। দাদাজনের প্রথম সন্তান কন্যা হওয়াতে তিনি পন করেছিলেন এর পরের সন্তান যদি পুত্র হয় তবে তিনি ফুপুআম্মাকে কোনো ডাকাতদলের হাতে সমর্পণ করবেন। কেননা তিনি কন্যা সন্তান চাননা। কালের বিবর্তনে দাদাজানের মানত ফললো। অতঃপর তিনি তাই করলেন যেটা তিনি পন করেছিলেন। ফুপুআম্মার সন্তানের অপহরন হওয়ার পেছনে তার স্বামীরই কুকীর্তির ফল ছিলো। ফুপুআম্মার নামের পাশে এসে জুড়লো নিঃসন্তানের পদবি। আম্মাজান বলেছিলেন, যেদিন ফুপুআম্মার কোল ভরেছিলো, সেদিনই খালি হলো। শুধু তাই নয়, সেদিনের পর থেকে তার স্বামীও নিখোঁজ। এই প্রাসাদের প্রায় সবাই জানে ফুপুআম্মা নিঃসন্তান। তার কোনো কালে কোনো সন্তানই জন্ম হয়নি।

“ফুপুআম্মা। স্বরন করেছিলেন?”

নামাজের চৌকিতে বসে তছবিহ পড়ছেন তিনি। রাজকন্যার আগমনে শুধু পেছন মুড়ে দেখলেন। জবাব দিলেন না। রাজকন্যা বসলো পাশে। চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো ফুপুআম্মার কক্ষ। বড় এলোমেলো হয়ে আছে। কাউকে হয়তো আসতেও দেন না নিজের কক্ষে। গত পঁচিশ বছর ধরে ঘরকুনো হয়ে আছেন। না নিজে বাহিরে যান আর না বাহিরের কাউকে ঘরে প্রবেশ করতে দেন। কেবল সে একাই এ ঘরে আসার অনুমতি পায়। অথবা মাঝেমাঝে নিজেই ডেকে পাঠান তাকে।

“শুনলাম তোমার বিবাহের কথা হয়েছে।”

“জি ফুপুআম্মা।”

গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন ফুপুআম্মা। রাজকন্যা স্বাভাবিক গলাতেই জবাব দিলো। ফুপুআম্মা উঠে সোজা হয়ে দাড়লেন। দাঁড়ালো রাজকন্যাও।

“নগর রাজ্য থেকে রাজা রাজত আকবরের পুত্র রাজকুমার সাদ্দাত এসেছেন। উনার সাথেই তোমার বিবাহের কথা হয়েছে। শুনেছিলাম রাজা রাজত আকবর আর তোমার আব্বাজানের বড়ই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। এককালে তারা একসাথে থেকে নিজেদের পাঠ্যগ্রন্থ সম্পন্ন করেছেন। বড়ই উদার মনের মানুষ রাজা রাজত আকবর। আশাকরি তার পুত্র আমাদের রাজকন্যার অযোগ্য হবেন না।”

রাজকন্যা অবাক হলো। অবাক মনে আওড়লা, (তবে কি রাজকুমারের সাদ্দাতের সঙ্গেই তার বিবাহ হবে? কিন্তু কথা হলো, ঘরবন্দী থেকে ফুপুআম্মা বাইরের এতো এতো খবর কি করে রপ্ত করেন?)

“আমার কি এই বিবাহ করা উচিৎ হবে ফুপুআম্মা?”

সরল মনেই প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। ফুপুআম্মা তাকে নিরাশ করলেন না। আদুরে সুরে বললেন,

“তুমি বড়ই বিচক্ষণা রাজকন্যা। যা করবে ভেবেচিন্তেই করবে। এই রাজ্যের একমাত্র তুমিই সেই ব্যক্তি যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি। যাকে আমি দেখলেই বলতে পারি রাজা সিরাজ উদ্দীন আগামী কয়েক শতবর্ষ না ফিরলেও তোমার শাসনে এই প্রাসাদ শতশত বর্ষ জীবিত থাকবে। শত শত বর্ষ পেরোবে তোমার আমল কেউ ভুলবে না রাজকন্যা। এই বিবাহ হলেই তুমি রানীর অধিকার গ্রহন করতে পারবে। মনে রেখো, এই রাজ্য যেন তেমার হাতেই শাসিত হয়। এই রাজ্যে যেন পরবর্তী শাসক তুমিই হও।”

“এ কি হয় ফুপুআম্মা? আদিম থাকতে আবার আমি কেন?”

“এ তোমার অধিকার রাজকন্যা। নিজের অধিকারে অন্যকারোর হস্তক্ষেপ তুমি মেনে নিবে না।”

রাজকন্যা মলিন হাসলো। ফুপুআম্মা বড়ই গম্ভীর। অল্পতেই খুব উত্তেজিত মানুষ। এই যে এক্ষনি, কত গম্ভীর হয়ে এসব কথা বলছেন। যেন এক্ষনি সিংহাসনে রাজকন্যার পদার্পণ না হলে সব ধ্বসে পড়বে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে রাজপ্রাসাদ। যার অজস্র খন্ড হবে। রাজকন্যা এর গোড়া না ধরলে সবটা নিঃশেষ হয়ে যাবে।

“আচ্ছা। ও হবেক্ষন। আপনি কি কিছু্ আহার গ্রহন করেছেন?”

“আজকাল আমার ক্ষিদে পায়না।”

“আহারের অনিয়ম চলবেনা ফুপুআম্মা। এ আমার আদেশ।”

“এই রাজ্যের একমাত্র শাসক তুমি রাজকন্যা। ভুলে যাবেনা কিন্তু।”

“ভুলবো না। আগে বলুন আপনি সকালের নাস্তায় কি খাদ্যগ্রহন করতে চান। আমি নিয়ে আসবো।”

“সামান্য চিঁড়ে-দুধ যথেষ্ট।”

“আচ্ছা বেশ। আমি এক্ষনি নিয়ে আসছি।”

“তুমি কেন? দাসী আছে তো।”

দাসীকে আদেশ করলেন ফুপুআম্মা। দাসী ছুটলো আদেশ পালনে।

“তোমার আহারের কি হবে?”

ফুপুআম্মা প্রশ্ন করলেন।

“হবেক্ষন। আগে আম্মাজানের ভোজনের ব্যাবস্থা করি।”

“সবদিকে নজর। এই তো আমাদের আগামী দিনের শাসক।”

রাজকন্যা হাসলো। তবে এই হাসিতে কোনো খুশি নেই। আছে কেবল একরাশ অসহায়ত্বতা। কি করে সবটা একা হাতে সামলাবে সে। আব্বাজান,আম্মাজান আর এই প্রাসাদ! সব দায়িত্ব একা তার মাথায়। তারউপর নতুন পীড়া বিবাহ! এখনি বিবাহ করিবে? মন যে কোনো উত্তরই দিচ্ছেনা। হ্যাঁ বা না। কোনো উত্তর নেই।

কথা শেষ করে চলে এলো নিজের কক্ষে। এই মুহুর্তে জিন্নাতকে যে ভীষণ দরকার। কোথায় আছে ও? ফিরবেনা কি আর? মনেমনে স্বরন করলো জিন্নাতকে। কিন্তু এলো না জিন্নাত। রাজকন্যা হতাশ হয়ে বসে পড়লো। কোথায় আছে জিন্নাত? কবে ফিরবে সে?

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া
#লেখাঃমুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৪.

দুপুরের খাদ্যভোজনের আয়োজন করা হলো একত্রে। নিমন্ত্রণে রইলো রাজপ্রাসাদের অন্যতম অতিথি রাজকুমার সাদ্দাত। সবাই এক এক করে এসে বসল। চাচাজান,চাচীজান,ফুপুআম্মা,আদিম,আলিয়া। রাজকন্যাও বিলম্ব করলো না। যথাসময়ে উপস্থিত হলো। আত্নীয়ের ঘরে ভদ্রতা দেখাতে হয়। দাসী পাঠিয়ে ডাকার পরই দেখা মিলল রাজপুত্রের। সেও এসে বসলো ঠিক রাজকন্যার সম্মুখে। রাজকন্যা সম্পুর্ন দৃষ্টিতে না দেখলেও আঁড়চোখে দেখলো রাজপুত্রকে। শ্যামবর্ণের উজ্জ্বল মুখ তার। চোখা নাক, ভারী পল্লব বিশিষ্টি ভরাট চোখ,মোটা ভ্রু। অধর জোড়া বেশ মোহনীয়। একবার দেখতেই চোখ ফিরিয়ে নিলো রাজকন্যা। পরনে নীলাম্বর পোশাক। কি মানিয়েছে পেটা শরীরে। পেশিবহুল বাহু আঁকড়ে এঁটে আছে। তারউপর রাজকীয় সব গয়নার বাহার। হাতে,গলায়,কানে কোনো জায়গাতেই কমতি রাখেনি কিছু।

“রাজকন্যা? নগর রাজ্যের কথা শুনেছো তো! রাজা রাজত আকবর তোমার আব্বাজানের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তাদের শৈশব আর কৈশোর একত্রেই কেটেছে। বড় প্রিয় ছিলেন দু’জন দু’জনার। এই হলো রাজা মশাইয়ের একমাত্র পুত্র রাজকুমার সাদ্দাত। গতরাতে মধ্য প্রহরে এসে পৌঁছেছে সে এখানে। রাত করে তোমার সঙ্গে আলাপ করাবো হয়ে ওঠেনি। প্রভাতেও চেয়েছিলাম.. কিন্তু এতো পথ পেরিয়ে আসার পর রাজকুমারের শরীর নিশ্চয়ই ক্লান্ত ছিলো। সেজন্যই দুপুরের আহার-ভোজনের সময়টাই সঠিক বলে মনে হলো।”

কথাগুলো বলতে বলতে রাজকন্যা এবং রাজপুত্রের উভয়েরই সম্পুর্ন মনোযোগ আকৃষ্ট করলেন চাচাজান। তারা দু’জনেই কথাগুলো শুনতে শুনতে একে অপরের দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে দেখে নিলো। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির রেখাও টানল কিন্তু আগ বাড়িয়ে কেউই কিছু বলতে পারলো না। চাচাজান দু’জনের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু একরকম ব্যর্থতা ছাড়া তিনি কিছুই কুড়াতে পারলেন না।

“রাজকুমার সাদ্দাত।”

খাবার চিবোতে চিবোতে ফুপুআম্মা একবার আওড়ালেন রাজকুমারের নামটা। বড়ই চমৎকার নাম। নামের সাথের মুখের কি মিল!

“জি। আমি রাজকুমার সাদ্দাত।”

ভরাট কন্ঠ তার। কানে গেলেই ঝনঝন করে বাজতে থাকে। ফুপুআম্মার কথার পিঠে জবাব দিলো রাজকুমার। ফুপুআম্মা অত গুরুত্বের সহিত তাকালেন না আর। নিজের খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন।

“রাজকুমার? আমাদের রাজকন্যা কে তো তুমি আগেই দেখেছো। চিত্রকারের কাছে রাজকন্যার আঁকা ছবি?”

রাজকন্যা চমকে উঠলো। রাজকুমার জবাব দিলো,

“জি,দেখেছি। চিত্রকার উনার মুখটা ঠিক করে আঁকতে পারেননি। উনি ছবির থেকে বাস্তবে অনেক বেশি সুন্দর।”

ঠোঁট কাটা পুরুষ! চাচাজান হঠাৎ কোনো জবাব খুঁজে পেলেন না। রাজকন্যা আবারও চমকালো! কারোর থেকে রূপের প্রশংসা পেতে কেই না ভালোবাসে? তাই বলে গুরুজনদের সামনে একটু লজ্জা করবেনা? এ কেমন কথা?

“আব্বাজান? আমাদের সাথে রাজকুমারের আলাপ করাবেন না?”

আলিয়া বেশ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে আবদার করে বসল। চাচাজানের মুখের রঙ পাল্টে গেলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“চুপচাপ খেয়ে নিজের কক্ষে যাও। ভোজনের সময় এতো কথা আমার পছন্দ নয়!”

আলিয়ার মুখ খানা চুপসে গেলো। আব্বাজানের কথায় খাওয়া থেকে মনই উঠে গেলো। আব্বাজান সর্বদা তার সঙ্গে এ আচরণই করেন! এর কারন জানা নেই তার। তবে মন থেকে দোষারোপ শুধু রাজকন্যার উপরই আসে। মনেহয়, কেবল রাজকন্যার জন্যই তার আর তার আব্বাজানের সম্পর্কে এতো দূরত্ব। একদিন ঠিক এর হিসাব নিবে সে। ঠিকই নিবে।

“চাচাজান, আপনি আলিয়ার সাথে এমন রূপ আচরন করবেন না। রাজকুমারের সঙ্গে যেহেতু আমার পরিচয় হলো বাকিদের সাথেও হবে। শতহোক উনি আমাদের অতিথি।”

রাজকুমার খাবার খেতে খেতে এক ঝলক দেখলো রাজকন্যাকে। কি মোয়ালেম, মোহময়ী রূপ তার। যেন ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

চাচাজান ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বলল,

“তুমি ঠিক বলেছো রাজকন্যা। আসলে দোষ আমারই হয়েছে। শরীরের অবস্থা দিন দিন এমন হচ্ছে যে সবকিছুতেই হঠাৎ রেগে যাওয়ার স্বভাব হয়েছে। আমার ছোট রাজকন্যা? আব্বাজানের উপর ক্রোধ রেখোনা!”

আলিয়া হাসলো। স্তিমিত হাসি। চাচাজান আবার আওড়ালেন,

“রাজকুমার? পরিচয় পর্ব সেরে দেই। এই হলো আমার একমাত্র কন্যা আলিয়া,আর আমার পুত্র আদিম। ইনি আমি পত্নী। আর উনি আমাদের ভগিনী। সর্ব-জ্যেষ্ঠ্যা।”

রাজকুমার ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে সবার দিকেই একবার একবার করে তাকালো। সবাই তার সহিত হাসি বিনিময় করলো,একমাত্র ফুপুআম্মা ব্যতীত। তার মস্তিষ্কে বাহ্যিক কোনো ব্যাপার নেই। তিনি আপন মনে আহার গ্রহন করছেন। রাজকুমার কয়েক মুহুর্ত চেয়ে রইলো ফুপুআম্মার মুখপানে। একটু অদ্ভুত বটে মানুষটা। তাকাচ্ছেই না!

” রানী-মাকে দেখছিনা?”

রাজকুমার শান্তস্বরে প্রশ্ন করলো।

চাচাজান,চাচীজান,আর রাজকন্যা একত্রেই মুখ উঁচিয়ে তাকালো রাজকুমারের দিকে। যেন সে কোনো কঠিন কথা বলে ফেলেছে। প্রথম ভাগে সবার হঠাৎ এমন চাহনি দেখে সে ভড়কে গেলো কিঞ্চিৎ! তার ঘাবড়ানো মুখ খানা ধরতে পারলো সবাই। তাই ধীরেসুস্থে তাদের চাহনি স্বাভাবিক করলো। চাচাজান বললেন,

“তার শারীরিক অবস্থা একটু খারাপ থাকে। তাই নিজের কক্ষেই থাকেন তিনি। বাহিরে কমই আসেন।

রাজকুমার বুঝে নিলো। কোমল হাসলো। অতঃপর খাওয়াও মনোযোগ ঢাললো।

____

প্রসাদের পেছনে অবসর সময় কাটানোর জন্য রয়েছে মস্ত বড় উদ্যান। উদ্যানে হরেকরকমের ফুল গাছ,ফল গাছ,জংলী গাল.. বড়বড় অশ্বত্থ গাছ কোনো কিছুরই অভাব নেই। রোজ সাঁঝবেলাতে রাজকন্যা এখানে এসে একান্তে সময় কাটায়। রাজ্যের ব্যাপারে,আব্বাজানের ব্যাপারে আর সামনের ঐ রাক্ষদের উৎখাত করার ব্যাপারে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত থাকে। মনের অজান্তেই রাক্ষসদের প্রতি তার মন কাঁদে। কেন ওদের উৎখাত করা হলো। কি দোষ ছিলো ওদের? আব্বাজানকে কোথায় খুঁজবে? কোথায় খুঁজলে ফিরে পাবে! কে একটা খবর দিবে যে তার আব্বাজান,এই রাজ্যের রাজা এখানে আছে। তাকে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাও। কে আনবে এই সংবাদ।

“হূরিয়া! হূরিয়া নামের অর্থ কি জানেন?”

হঠাৎ কোনো পুরুষালি কন্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে চমকে উঠলো রাজকন্যা। তার ব্যক্তিগত সময়ে নাক গলায় এমন ব্যক্তি রাজপ্রাসাদে নেই। কিংবা এমন দুঃসাহসও কারোর নেই। থাকার কথাও নয়। তবে কে? পেছন মুড়ে তাকালো রাজকন্যা। চোখে ভাসছে বিরক্তি আর ক্রোধের মিশ্রিত ছায়া। সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার সাদ্দাত। হঠাৎ করে চোখের কালো ছায়াটা সরে গেলো। রাগটাও আর রইলো না। জবাবের ভান্ডারে তলানীতেও খুঁজে পেলো না কোনো জবাব। পাল্টা প্রশ্ন করলো,

“আপনি এখানে?”

“জি। আগামীকাল যাকে বিবাহ করবো তার সঙ্গে তো একান্তে একটা কথাও হয়নি। সে কি আমাকে আদৌও বিবাহ করতে চায়? নাকি চায় না.. জানতে হবে না?”

“ভালো বলেছেন।”

“সত্যি বললাম কি?”

“জি। সত্যি বলতে এই মুহুর্তে আমি আপনাকে বিবাহ করিতে চাইনা।”

“অন্যকাউকে চান?”

সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো রাজকুমার। তার মুখটা হঠাৎ আঁধারে তলিয়ে গেলো। কন্ঠে কেমন ফাঁক। রাজকন্যা মুখ তুলে চাইলো। আবার উল্টো ঘুরলো। সূর্যের অস্তাচল পর্বতের অন্তরালে গমন হচ্ছে। চারপাশ কুসুমিত হয়ে উঠছে ক্রমশ। রাজকন্যা সেদিকেই মোহিত হয়ে পড়লো। আর এদিকে রাজকুমার মোহিত হয়ে পড়ল রাজকন্যার সাঁঝবেলার স্নিগ্ধ মুখখানার প্রতি। লাল কুসুম আলো পড়লো রাজকন্যার মুখের উপর। চিকচিক করে জ্বলছে তা। রাজকন্যার নাকের নোলকটা সেই আলোটুকু নিজের গায়ে একটু একটু করে মেখে নিচ্ছে। রূপবতী রাজকন্যার মুখখানা গাঢ় থেকে গাঢ় করে তুলছে অদ্ভুত মায়ায়। কানের ঝুকমো,গলার হার,হাতের বালা এমনকি কোমরের বিছাতেও কুসুমিত আলোর রাজ বসেছে। হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছে রাজকুমারের মন। ক্রোধে ফেটে পড়ছে এই ক্ষনের উপর। এতো বড় দুঃসাহস কেন করছে এই আলো? কেন করবে? ওরা কি জানেনা, রাজকন্যাকে সে বিবাহ করিতে এসছে?

“অমন করে কি দেখছেন?”

“আপনাকে!”

রাজকন্যার প্রশ্নের বিপরীতে নির্লজ্জের মতো জবাব দিয়ে বসলো রাজকুমার। রাজকন্যা লজ্জা পেলো। নড়েচড়ে উঠে একটু পাশে সরে গেলো। রাজকুমার দৃষ্টি সামনের দিকে তুলে ধরলো। মনেমনে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছু বলতে পারলো না।

“এই মুহুর্তে কাউকেই চাই না বিবাহ করিতে। আমার যে অনেক দায়িত্ব!”

রাজকন্যা আওড়ালো। রাজকুমার পুনরায় পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাজকন্যার প্রতি। বলল,

“আমি আপনার পাশে থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে লক্ষপূরনে?”

“হয়তো হবে না। কিন্তু আপনি কেন হঠাৎ আমাকে বিবাহ করিতে চান?”

“হঠাৎ নয়! আমি আপনাকে…”

এটুকু বলেই থেমে গেলো রাজকুমার। রাজকন্যা উৎসুক নয়নে চেয়ে ছিলো। হঠাৎ তার থেমে যাওয়ার অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,

“কি?”

“বিশেষ কিছু নয়। আপনি বললেন না কিন্তু, আপনার নামের অর্থ কি?”

“জানিনা।”

“জান্নাতকি ফেরেশতা,খুবসুরাত,হাসিনা এবং হূর!”

রাজকন্যা চকিতে দেখলো। বলল,

“এতোগুলো অর্থ!”

“ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই। আপনি সত্যি হূরপরী রাজকন্যা। খুবসুরাত হাসিনা।”

রাজকন্যা বোবা দৃষ্টি মেলে তাকালো। তার এখানে কি বলা উচিৎ সে জানেনা। জাবাব আওড়াতে পারলো না। রাজকুমার হাসলো। অদ্ভুত হাসি। আবারও বলল,

“আমি আপনাকে বিবাহ করিতে প্রস্তুত রাজকন্যা। আশাকরি,আপনি দ্বিমত করিবেন না!”

“দ্বিমত করেও ফল নিতান্তই শূন্য, রাজকুমার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমাদের বিবাহ হইবে।”

কথাটা বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। রাজকুমার এক-কদম এগোলো রাজকন্যার দিকে। মুঠোকরা হাত খুলে জ্বলজ্বল করা একটা মুক্তোর মালা বের করলো। রাজকন্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনার জন্য সামান্য উপহার।”

রাজকন্যা হাত বাড়িয়ে নিলো। খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যাবে মালাটার গায়ে আরবি হরফে দুটো নাম লেখা আছে। ‘রাজকন্যা হূরিয়া’। রাজকন্যা লেখাটা পড়ামাত্রই মুখ উঁচিয়ে তাকালো রাজকুমারের পানে। রাজকুমার হাসলো। মোহনীয় হাসি। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঝরঝরা কন্ঠে বলল,

“সামান্য চেষ্টা।”

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মাৌমিতা
৫.

“ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিও না!”

কক্ষে জিন্নাতের উপস্থিতিতে আতরের খুশবু ছড়িয়ে পড়লো চারোধারে। রাজকন্যা শয্যায় শুয়ে তখন বিশ্রাম করছিলো। আকস্মিক এই খুশবু আর জিন্নাতের কন্ঠ পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো।

“এলে তুমি?”

অভিমানী কন্ঠে জানতে চাইলো রাজকন্যা। জিন্নাত ওর সজ্জিত শয্যায় বসলো নিরিবিলি। এখন রজনির প্রথম প্রহর। আকােশে উঠেছে পূর্নিমার মস্ত বড় চাঁদ। জিন্নাত সেদিকেই দৃষ্টি রাখলো। জবাব দিলো না।

“এখনও রাগ করে আছো?”

“বাহিরে তোমার বিবাহের আয়োজন হচ্ছে। দেখেই এলাম।”

“আমার কথার জবাব দাও।”

“দিয়েছি!”

“কোন বেলা দিলে?”

“ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিওনা।”

জিন্নাত কথাটা আবারও আওড়ালো। রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শয্যা ত্যাগ করে উঠে এলো অলিন্দে। চারপাশে তাজা ফুলের গন্ধে মোঁ মোঁ করছে। রাজকন্যা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। অতঃপর বলল,

“তুমি চলে গেলে, আর দেখো আমার জীবনের কত রঙ বদলে গেলো।”

“আমি সারাজীবন থাকবো না কি তোমার সঙ্গে?”

“থাকবে না বুঝি?”

“তোমার বিবাহের পর রাজকুমারই হয়তো তোমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে রাজকন্যে। হয়তো কি বলছি, এটাই যে সত্যি!”

“তুমি আমাকে এখনি পর করে দিচ্ছো তো?”

রাজকন্যের কন্ঠে কেমন অসহায় টান। জিন্নাত হাওয়ায় ভেসে ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। অমনি রাজন্যার নাকে এসে বারি খেলো আতরের খুশবু। রাজকন্যা পাশ ফিরে তাকালো জিন্নাতের দিকে। কিছু বললো না। পূনরায় দৃষ্টি বাহিরে স্থির করলো।

“রাজকুমারের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েছিলুম। কোনো খারাপ দিক তো খুঁজে পাইনি। তবে..”

রাজকন্যার বুক কাঁপল।

“তবে?”

“তবে একটু বদরাগী এই যা।”

রাজকন্যা দম ছাড়লো। বলল,

“ওটা পুরুষের থাকেই।”

“রাজা মশাই খুবই ভালো এবং আন্তরিক মানুষ ছিলেন। উনার মৃত্যুর পর কাল নেমেছিলো উনার রাজ্যে। রাজকুমার যা একটু ফিরিয়েছিলো.. কিন্তু এখন আবারও সেই করুন অবস্থায় ফিরে গেছে। মানুষ রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে। না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে। তাই রাজকুমার সিরাজদি রাজ্যে চলে এসেছে। নিজের করুন অবস্থা ফেরাতে আর তার আব্বাজানের কথা রাখতে।”

“সবই শুনেছি।”

“তোমার এই বিবাহে আমার কোনো আপত্তি নেই রাজকন্যে।”

রাজকন্যার চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো খুশিতে। চমৎকার হেসে জড়িয়ে ধরলো জিন্নাতকে। আনন্দিত গলায় বলল,

“সত্যি বলছো তুমি? আমি এই বিবাহ করে ভুল করছি না তো?”

জড়িয়ে ধরলো জিন্নাতও। সব অভিমান,অভিযোগ পাশে ঠেলে বলল,

“না। ভুল করছো না। তবে মনে রেখো, কখনও অন্যের উপর অন্ধবিশ্বাস করবে না। রাজকুমার, চাচাজান, চাচীজান যতই তোমার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিক না কেন, কখনও নিজেকে ছাড়া অন্যকে বিশ্বাস করবে না। তুমি একাই এই রাজ্য সামলাতে পারো,তাই তোমার অন্যের জ্ঞানের প্রয়োজন নেই।”

“আচ্ছা। জানো জিন্নাত, আম্মাজানের বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করছে! তার আসল মুখটা সামনে আনা এতো সহজ হবেনা। সে বড় চালাকি করে কবিরাজ মশাইকে ফাঁসিয়েছেন! আর উনি বেচারা এই বিষয়ে মুখ খুলতেই ভয় পাচ্ছেন। আমার মনে হয় উনাকে হয়তো ভয় দেখিয়ে চুপ রাখা হয়েছে।”

“তোমার কি কাউকে সন্দেহ হচ্ছেনা?”

“কাকে?”

“চাচাজান কে!”

“আবার শুরু করলে তুমি? আচ্ছা চাচাজান তোমার কি এমন ক্ষতিটা করলো শুনি?”

“উনাকে আমার কোনো কালেই পছন্দ নয়।”

“কাউকে পছন্দ না করাটা অন্যায়ের কিছু নয়। তাই বলে তাকে এভাবে দোষারোপ করাটাও কাজের কথা নয় জিন্নাত!”

“রাজকুমারকে তুমি ছোটো বেলা দেখেছো রাজকন্যে?”

“দেখেছি হয়তো। মনে নেই।”

“রাজকুমার তোমায় খুব নিখুঁত ভাবে চেনে। উনার চোখে তেমার প্রতি গভীর প্রেম!”

“যাহ্..”

“লজ্জা পেলে?”

জিন্নাত মুচকি হাসলো। রাজকন্যা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। বলল,

“তুমি উনাকে কখন দেখলে?”

“আসার পথেই দেখলাম।”

“কোথায়?”

উনার কক্ষে। আগামী দিনের জন্য পোশাক নির্ধারণ করছিলেন। সঙ্গে এক যুবকও ছিলেন। আদিম,অনিন্দ,তীর্থ সহ আরও অনেকে। সবার সঙ্গেই বেশ সখ্যতাপূর্ন আচরণ।

রাজকন্যার মন জুড়ালো। যাক, সারাজীবন যার সঙ্গে থাকবে বলে ভাবলো সে অন্তত মুখ চোরা নয়। কিংবা ঘরকুনোও নয়। সবার সাথে সখ্যতা গড়তে পারে অতি সহজে।

“গতরাতেই আমার রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।”

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কথাটা বলল রাজকন্যা। জিন্নাত চিন্তিত স্বরে বলল,

“কখন? আর কেমন করে?”

“আমি সুফিকে নিয়ে রোজকারের ন্যায় আব্বাজানের সন্ধানে বেরিয়ে ছিলাম। জঙ্গল পেরোতে বড় মাঠে কদম রাখতেই দেখতে পাই একটু অদূরেই একফালা অগ্নিকুণ্ড জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। হাতের তলোয়ার শক্ত রেখে এগিয়ে গেলাম ওদিকটায়। প্রথমে ভেবেছিলাম গুপ্তচর! অতঃপর দেখি পথচারী। হয়তো পথ হারিয়েছে তাই তাবু টানিয়ে রাত পার করছে। বারকয়েক ডাকলাম। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পায়নি। হঠাৎ মনে ভয় জাগলো! কোনো বন্যপ্রাণী আক্রমণ করলো না তো? ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে খচমচ করে শব্দ করছিলো। তখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম এ বন্যপ্রাণী ছাড়া আর কিছুই নয়। মানবের প্রাণহানি ঘটেছে নিশ্চিত। তাই আন্দাজেই তলোয়ার চালাই। প্রায় অনেক্ষন ধস্তাধস্তি হওয়ার পর প্রকট হয় তার মুখখানা।”

“রাজকুমার তোমার মুখ দেখেছিলো?”

চিন্তার মাত্রা একধাপ বেড়ে গেলো জিন্নাতের। রাজকন্যা মাথা নাড়লো। অর্থাৎ না। জিন্নাত হাফ ছাড়লো। বলল,

“জানতে দেওয়াটা উচিৎ হবে না!”

“হু। তাই নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিলাম। উনি বারবার জানতে চেয়েছিলেন। উদগ্রীব হয়ে পড়ছিলেন।”

বলে মুখে হাত চেপে হাসলো রাজকন্যা। জিন্নাতও হাসলো। জিন্নাত উপলব্ধি করতে পারলো এই হাসির মানে। সে বুঝে নিলো। এটা অন্তরের অন্তস্তল থেকে প্রগলিত।

_______________

রাজকন্যা তার ফুপুআম্মা, চাচীআম্মা আর জিন্নাতকে নিয়ে তার আম্মাজানের কক্ষে প্রবেশ করলো। জিন্নাত অবশ্য অদৃশ্য। তার উপস্থিতি রাজকন্যা ছাড়া আর কারোর বুঝতে পারার ক্ষমতা নেই। রানীমা শয্যায় আছেন। বরাবের মতোই আনমনে,চিন্তাহীন মনে শুয়ে আছেন তিনি। মুখে কোনো কথা নেই,কোনো হাসি নেই,কান্না নেই। তিনি বাহ্যিক কোনো কথা,আলোচনা শুনতে পান কি না সেটা নিয়েও ব্যপক সন্দেহ আছে। রাজকন্যা বসলো তার পায়ের কাছে। ডাকল কোমল গলায়। কাল তার বিবাহ্, অথচ এখনও তার আম্মাজান নির্বিকার! এই ঘটনা তাকে বড আঘাত করছে। তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। এমন তো ঘটার কথা ছিলো না কোনোদিন। তার জীবনটা তো অন্যরকম হওয়ার কথা ছিলো। অন্য রঙে,অন্যভাবে সাজ্জিত হওয়ার কথা ছিলো। এমন তো কথা ছিলো না।

“আম্মাজান। আম্মাজান? আপনি কি শুনতে পান আমাকে?”

কোনো জবাব দেন না রানিমা। এক মনে তাকিয়ে থাকেন শূন্যে। রাজকন্যার চোখ জোড়া টলমল করে। বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার। বুক ফেটে কান্না আসছে। কিন্তু কাঁদতেও যে পারছেনা। সে কখনও কারোর সামনে কাঁদেনি। আর কাঁদবেও না। চোখের টসটসে জলখানি হাতের উল্টোপিঠে মুছে ফেললো। উঠে দাঁড়ালো আম্মাজানের কাছ থেকে। তার বসার স্থানে চাচীজান বসলেন। পাশেই বসলেন ফুপুআম্মাও। তারা নানান কথা জুড়লেন তার সঙ্গে। দাসীরা তাকে ধরে উঠে বসালো। শরীরে সরে যাওয়া কাপড় ঠিকঠাক করে দিলো। অতঃপর রাজকুমারকে নিয়ে প্রবেশ করলো আদিম আর এক অচেনা যুবক। যুবককে রাজকন্যা আগে দেখেনি। জিন্নাত কি এই যুবকের কথা বলেছিলো?

রানীমার সামনে দাঁড়িয়ে নতশির করে সালাম দিলো রাজকুমার। অতঃপর কদমবুসি করলো। ফুপুআম্মা রানীমাকে ডেকে রাজকুমারের পরিচয় দিয়ে বললেন, “এই তোমার জামাতা রাজকুমার সাদ্দাত। রাজামশাইয়ের কাছের বন্ধু রাজা রাজত আকবরের একমাত্র পুত্র। দেখো তাকিয়ে। সেই ছোট্ট পুত্র বিবাহ যোগ্য হয়ে গেছে। তোমার কন্যাকে নিতে এসেছে। বিবাহের পর নিয়ে যেতে চাইলে কি বলবো? আটকাবো নাকি পাঠিয়ে দেবো গো?”

অনেক কথা বলে ফেললেন ফুপুআম্মা। তবুও কোনো হেলদোল নেই তার। রাজকন্যা আর টিকতে পারলো না এই দমবন্ধ অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে। কারোর দিকে আর না তাকিয়েই চলে এলো সে। এলো জিন্নাতও। পিছু পিছু ছুটে এলে রাজকন্যা বারন করে।

“আমাকে একটু একান্ত সময় দাও জিন্নাত! আমি একা থাকতে চাই।”

“কাল তোমার বিবাহ রাজকন্যে! এমন সুখের দিনে কি কেউ কাঁদে?”

“আমার ভাগ্যটা যে পোড়া!”

বলেই কক্ষে প্রবেশ করে দাসীদের হুকুম করলো তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। দাসীরা মাথা নেড়ে হুকুম শিরোধার্য করলো। রাজকন্যা ভেতরে ঢুকে সোজা অলিন্দে গিয়ে দাঁড়ালো। নেত্রকোন থেকে অঝোড়ে ঝর্না বয়ে চলেছে। রাজকন্যা হাঁটু ভাজ করে বসে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে কিছুক্ষন ঐ দূর আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাখলো। অতঃপর ফোপাঁতে ফোপাঁতে মুখ ঢাকলো হাঁটুতে। আব্বাজান আজ এখানে থাকলে এতো কষ্ট তাকে কখনই পেতে হতো না। একমাত্র আব্বাজানের নিখোঁজ হওয়ার জন্যই তার জীবনের সব সুখ,সাচ্ছন্দ্য, আনন্দ ভেসে গেছে। একমাত্র যেটা সঙ্গে থেকেছে তা হলো নিঃস্বঙ্গতা,একাকিত্বতা,বুক ভরা আর্তনাদ, একরাশ অপুর্ন চাহিদা,একরাশ যন্ত্রনা আর আব্বাজানের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার তীব্র আক্ষেপ!

“রাজকন্যা কাঁদেও বুঝি?”

ঠিক সম্মুখে কারোর প্রগাঢ় উপস্থিতি আর পুরুষালি কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠলো রাজকন্যা। তৎক্ষনাৎ মুখ উঁচিয়ে তাকাতেই সামনে দৃশ্যমান হয় রাজকুমারের শ্যামবর্ণ স্নিগ্ধ কোমল মুখ খানা। হঠাৎ রাজকন্যার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতির নদী বহমিত হয়ে যায়। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায় এই স্নিগ্ধ মুখ খানা দেখার আনন্দে। তারপর আবার হঠাৎ নিভে পড়ে। মনটা একরাশ দুঃখে আবার কাঁতরে ওঠে। তার থুঁতনি কেঁপে ওঠে। প্রশ্রয় চায় মানুষটার কাছে। খুব প্রশ্রয় চায়।

রাজকুমার রাজকন্যার মনের কথা ঠিক পড়ে ফেলে। চট করে হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় রাজকন্যার সিক্ত মুখবিবর। মুছে দেয় অক্ষিপটের অঝোর ধারা। রাজকন্যা হঠাৎ চমকে ওঠে। কি মনে হতে দূরে ছিটকে পড়ে। কাঠকাঠ গলায় বলে,

“এ কি আপনি! আপনি আমার কক্ষে কি চান? কেন এসেছেন?”

#চলবে