রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-৬+৭+৮

0
247

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৬.

বিবাহের আয়োজন হচ্ছে সুনিপুণ ভাবে। রাজকন্যাকে বিবাহের জন্য প্রস্তুত করতে দূর দূর থেকে বেশ কয়েক জন কন্যা নিয়ে আসা হয়েছে। অন্য দিকে রাজকুমারের জন্যও সব এলাহি আয়োজন। কেমন করে সাজাবে, কি পড়াবে তা নিয়ে মহা হৈচৈ। জিন্নাত বারবার এ কামরায় ঘুরছে তো ও কামরায় ঘুরছে। তার ব্যস্ততা যে সবার উর্ধ্বে। বারেবারে দৃশ্যমান হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহানন্দে। আবার বারেবারে অদৃশ্য হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। রাজকুমারের সঙ্গে থাকা যুবকটি এই ব্যাপারটা খুব ভালো করে খবরদারি করলো। ‘একটা জ্বিন রাজপ্রাসাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে আতরের খুশবু পেয়েছে। অস্তিত্ব ধরতে পারেনি। তবে আন্দাজ করেছে। কালো একটা ছায়ায় দেখেছে বেশ কয়েকবার। খবরটা রাজকুমারের কানে এনে তুলল। সে গম্ভীর হয়ে চিন্তা করলো একবার। অতঃপর ভুলে গেলো। যুবকটি রাজকুমারের বন্ধু আরহাম। তার প্রাসাদের মহামন্ত্রীর পু্ত্র। যুদ্ধের সময় রাজামশাইয়ের সঙ্গে সেও নিজের জীবন উৎসর্গ করে তাদের প্রাসাদকে দোষমুক্ত করেছিলো। সেদিন থেকেই রাজকুমারের প্রানপ্রিয় বন্ধু হয়েছিলো আরহাম। তাদের বড় হওয়া, শিক্ষা ব্যবস্থা সবই একত্রে ছিলো।

“রাজকন্যে.. ওরা তোমাকে আমার মনের মতো সজ্জিত করিতে পারিবেনা। ওঁদের বলো তুমি নিজ হাতেই সাজবে। কারোর সাহায্য চাইনে!”

ফিসফিসিয়ে রাজকন্যা কানের কাছে এসে কথাগুলো বলল জিন্নাত। রাজকন্যা তখন অর্ধ-সজ্জিত। গায়ে তার সোনালি পাথরের কাজ করা ভারী রাজকীয় পোশাক। হাতে স্বর্নের মোটা মোটা বালা। গলায় ভারি ভারি স্বর্নের গহনা। কান তখন খালি। একজন হাতে কানের দুল নিয়ে পড়াতে নিলে তখনই জিন্নাতের গলা পায় সে। শুনে মিটমিট করে হাসে। জবাব দেয়না। কানে দুল পড়ানো হয়ে গেলে রাজকন্যা আবারও শুনতে পায়,

“হাসছো যে? ওঁদের বলো না!”

“কি বলবো জিন্নাত?”

“এটাই যে,তুমি একাই সাজতে পারবে।”

“পেছনে দেখো, চাচীজান আর ফুপুআম্মা বসে আছেন। ওনাদের কি বলি?”

জিন্নাত হঠাৎ দৃশ্যমান হয়। আরশিতে তার প্রতিচ্ছবি ভাসে। সে রাজকন্যার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রাজকন্যা হাসলো। ভ্রু উঁচিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“তুমি সাজবে না?”

“না।”

“সে কি! কেন?”

“আমার বিবাহে আমিও সাজবো।”

রাজকন্যা ফিক করে হেঁসে দিলো।

“তা সে সুদিন কবে আসবে?”

“আসবে।”

“হু। পছন্দ করলে কাউকে?”

“মনুষ্য জাতি কে?”

“হু?”

“খামোশ! এই অধম মনুষ্য জাতিকে আমি কেন বিবাহ করিবো?”

“অধম বলছো কেন?”

“অধমই তো!”

“রাজকুমারও কি অধম?”

“বটেই।”

“ছি ছি.. এ কথা কেন?”

“মনুষ্য কুলের পুরুষ জাতি সত্যিই অধম। কখনও বুঝবে।”

“তবে কি এই বিবাহ আমার জন্য অনুচিত?”

“না।”

“তুমি যে বললে?”

“ভালোবাসা, মহব্বত তারা অধিক করিতে পারে। কিন্তু দিনশেষে সবাই অধম।”

“তবে তো আমার তোমার জাতিকেই বিবাহ করা উচিৎ হইতো।”

“বটেই তো।”

“ঘোড়ার ডিম!”

জিন্নাত মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। এতক্ষণ রাজকন্যা খেয়াল করলো তাকে সাজাতে ব্যস্ত থাকা মহিলাগুলো তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। একজন তো বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলেই বসলো,

“ক্ষমা করবেন রাজকন্যা! আপনি কি কারোর সঙ্গে কথা বলছেন?”

রাজকন্যার হুঁশ ফিরলো। সে নড়েচড়ে উঠলো। বলল,

“না তো। তোমরা তোমাদের কাজ করো।”

সবাই আবারও হুকুম পালনে লেগে পড়লো। রাজকন্যার সাজসজ্জা সম্পূর্ণ হলো। কি চমৎকার রূপ তার। কেউই যে নজর ফেরাতে পারছেনা। মনোহরণী স্নিগ্ধ কোমল আবেশ তার। আগুনের ন্যায় দৃষ্টি। যে পুরুষ একবার এই রূপ দেখবে সে নির্ঘাত প্রান উৎসর্গ করিবে।

রাজকন্যাকে নিয়ে যাওয়া হলো বিবাহের আসরে। রাজকুমার পূর্বেই সেখানে উপস্থিত ছিলো। রাজকন্যার আগমনে সোরগোল পড়ে গেলো চারপাশে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রজারা উপস্থিত হয়েছে এই বিবাহের সাক্ষী হতে। এদের মাঝে এমনও অনেক প্রজারা আছেন যারা রাজকন্যাকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য বহুবার ছুটে এসেছেন। রাজা সিরাজ উদ্দীন যবে থেকে এই প্রাসাদ ত্যাগ করেছেন তবে থেকেই তারা মুখিয়ে ছিলো রাজকন্যাকে এই রাজ্য শাসন করতে দেখার জন্য। তবে ছোট রাজামশাই মানে চাচাজান সাফ সাফ ঘোষনা দিয়েছিলেন,” যতদিন অব্দি রাজকন্যার বিবাহ না হইবে ততদিন সে এই রাজ সিংহাসনে বসিবে না।” এবার বুঝি তাদের অপেক্ষার প্রহর কাটবে। তাদের ইচ্ছে পূরন হবে।

“বিবাহ আরম্ভ করুন।”

চাচাজানের হুকুমে কাজী যত্রতত্র বিবাহ পড়ানো শুরু করলো। রাজকুমার সেই তখন থেকেই অপলক চেয়ে আছে রাজকন্যার প্রতি। এমন ভয়ংকর রূপ সে তার ইহজীবনে কোনোদিন দেখেনি। রাজকন্যা হূরিয়া। নামের ন্যায় তাহার রূপ। চোখ চকচক করছে তার। মাথা ঘুরছে। অস্থির অস্থির হচ্ছে বুকের ভেতরে। চিনচিনে এক ব্যাথার আবির্ভাব ঘটেছে সেই প্রথম পলকেই। এই মানুষটা তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ হতে যাচ্ছে ভাবতেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে যায়। বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করে। অবিশ্বাস্য লাগে এই ঘটনা। এই পৃথিবী,এই বর্তমান। মনে হয় যে সবটাই তার দুঃস্বপ্ন। সে ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভাঙ্গলেই সবটা এক নিমিষে শেষ হয়ে যাবে।

বিবাহের কার্য সম্পন্ন হলো। সবার মোনাজাত শেষ হলেও রাজকুমার প্রায় অনেক্ষন মোনাজাত ধরে বসে রইলো। সে তার প্রভুর কাছে একান্তে কিছু চাইলো। যা সে ছাড়া আর কেউ জানলো না।

জিন্নাত হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। রাজকন্যা একজন ভালো আর সৎ মানুষকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে পেলো। এই তো অনেক। তার জীবনের সব দুঃখ যেন এই প্রহরেই বরাবরের মতো শেষ হয়। হে প্রভু! দেখো তুমি।

ক্ষপ করে কেউ তার হাতটা চেপে ধরলো। আতংকে ছোট হয়ে গেলো সে। ভীত নয়নে সামনের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সেই যুবককে। অর্থাৎ রাজকুমারের বন্ধুুকে। কাঁপতে লাগে সে। যুবকটি কি তাকে চিনে ফেললো?

“হে রব! এ এ আমি কি দেখছি।”

আরহামের কম্পিত স্বরে কথাটা শুনতে ভ্রুকুটি করে জিন্নাত। চোখ জোড়া গোলাকার করে। আরহামের হাতের মধ্যে থেকে মোচড়াতে মোচড়াতে বলে,

“কি দেখছেন?”

“ত্ তুমি.. ত্ তুমি..”

“আমি কি?”

“পরী!”

“জি।”

“প্রাসাদে ঘুরছো কেন? মতলব কি?”

“মতলব! আমার?”

“জি। তোমার?”

“আপনারও যা আমার তা।”

“মানে?”

“হাত ছাড়ুন.. ব্যাথা পাই!”

জিন্নাতের কাতর গলায় দৃষ্টি নামায় আরহাম। জিন্নাতের নরম তুলতুলে হাতের দিকে তাকায়। যা তার হাতের জোরে রক্তবর্ণ ধারন করেছে। তবুও ছাড়লো না ওর হাত। ওর হাত টেনে কাছে নিয়ে এলো। জিন্নাত হকচকালো। আরহামের চোখের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল,

“একি! কি করছেন?”

“তুমি জ্বীন!”

“হ্ হ্যাঁ!”

“কাঁপছ যে?”

“আমাকে যেতে দিন। নয়তো আমি আপনার অনেক বড় ক্ষতি করে দিবো।”

“আচ্ছা? করো তবে!”

এই বলে আরেকটু কাছে টেনে নিলো তাকে। জিন্নাত এবার ভয় পেতে লাগলো। আজ অব্দি সে কোনো পুরুষের স্পর্শ পায়নি। যেটা আজ তার গোটা জীবনে এই প্রথমবার পেলো।

“আ্ আমি অনেক কিছু করতে পারি!”

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো জিন্নাত। আরহাম হেসে পড়লো। বলল,

“জানি তো।”

“জানেন না আপনি! জানলে আমাকে এভাবে ধরে রাখার সাহস করতেন না।”

“জানি বলেই তো ধরেছি। তুমি এতো সুন্দর কেন?”

“কারন তার মন সুন্দর!”

“কার?”

প্রশ্ন করলো আরহাম।

“যে আমাকে এই রূপ দিয়েছে।”

“কে দিয়েছে তোমায় এই মনহরণী রূপ?”

“যার কাছে আছে।”

“কো সে?”

“ছাড়ুন..”

“ছাড়বো না। আগে বলো কে দিলো তোমায় এই রূপ।”

জিন্নাত রাজকন্যার নামটা মুখে এনেও গিলে ফেললো। না, বলবে না সে। এই পুরুষের দ্বারা যদি রাজকন্যার কোনো বিপদ হয়?

“বলো?”

“ছাড়ুন আমায়!”

আরহাম জিন্নাতের হাত ছেড়ে দিলো। তার থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বলল,

“তুমি চাইলেই অদৃশ্য হতে পারতে। তোমাকে বেঁধে রাখার ক্ষমতা আমার ছিলো না। কিন্তু তুমি অদৃশ্য হলে না। কেন বলো তো? তবে কি আমার মতো তুমিও মোহিত হয়ে পড়েছিলো?”

শেষোক্ত কথাটা বলতে বলতে শয়তানি হাসলো আরহাম। জিন্নাত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। আরহাম ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলল,

“ভষ্ম করবে নাকি?”

জিন্নাত জবাব না দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলো। আরহাম দাঁড়িয়ে থেকেই হাসলো। সত্যি ভীষণ মায়াবী রূপ জিন্নাতের। কে দিলো তাকে এই রূপ?

জিন্নাত রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রাজকন্যার কাছে গিয়ে হাজির হলো। রাজকন্যাকে আসর থেকে নিয়ে আসা হলো তার কক্ষে। এতক্ষণ দাসীরা তার সঙ্গেই ছিলো। মাত্রই বিদায় করলো তাঁদের। জিন্নাতকে হঠাৎ এমতবস্থায় দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো। ভারী পোশাক তুলে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো তার নিকটে। বাহুতে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালো। চিন্তিত স্বরে জানতে চাইলো,

“কি হলো তোমার? এতো ক্ষুব্ধ কেন?”

ফোঁস করে উঠলো জিন্নাত। বড় ক্রোধের সহিত নাম নিলো আরহামের। বলল,

“ঐ যুবকের এতো দুঃসাহস যে আমার পথ রোধ করে!”

অবাক হলো রাজকন্যা। কিছু একটা ভেবে বলল,

“কি হয়েছে খুলে বলো আমায়?”

“ঐ যুবক..”

“কোন যুবক?”

“রাজকুমারের বন্ধু!”

“রাজকুমারের বন্ধু? উনি.. উনি তোমায় দেখলেন কেমন করে?”

রাগে ফেটে পড়ছে জিন্নাত। তবুও খুব নিখুঁত ভাবে সবটা খুলে বলল রাজকন্যাকে। রাজকন্যা তার কথা শুনে কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বলল,

“আহা বেচারা। তোমার রূপে সে আহত হয়েছে বড়।”

“রাজকন্যে তুমি হাসছো?”

“ও জিন্নাত… আমি তো আমার হাসি থামাতেই পারছিনা। আমি বড় খুশি হয়েছি।”

“কেন? এখানে কিসের খুশি?”

“এটাই যে আমার পরেও কেউ তোমার বিমোহিত রূপের প্রশংসা করেছে। এমনকি পুরো উন্মাদের মতো আচরন করেছে। সে তোমার রূপে ধরা পড়েছে জিন্নাত।”

জিন্নাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আর কোনো জবাব না দিয়ে হুড়মুড় করে প্রস্থান করলো। এদিকে মুখ টিপে হাসলো লাগলো রাজকন্যা। এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলো রাজকুমার। ডাকলো রাজকন্যাকে,

“রাজকন্যা?”

চমকে উঠলো রাজকন্যা। পেছন মুড়ে তাকালো রাজকুমারের দিকে। তার বুকের ভেতর ধুকপুক করে উঠলো। হাসি থেমে গেলো। মুহুর্তেই এক জড়তা এসে ভর করলো তার মনে। মাথা নীচু করে একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[৭]

রাজকুমার কক্ষে প্রবেশ করলো। রাজকন্যা লজ্জা মিশ্রিত মুখেই এগিয়ে এলো তার সন্নিকটে। আজ থেকে এই মানুষটা তার স্বামী। সর্বক্ষণের সঙ্গী। তার রাগ,অভিমান, অভিযোগকে প্রশ্রয় দিয়ে ভালোবেসে আগলে রাখা একমাত্র সঙ্গী। রাজকন্যা তার প্রেমে পড়েছে। ঠিক যেই মুহুর্তে সে এই মানুষটার জন্য কবুল পড়েছে ঠিক সেই মুহুর্তেই প্রেমে পড়েছে। খুব গভীর আর পবিত্র সেই প্রেম। ভীষন মায়াতেও জড়িয়েছে। রাজকুমারের শ্যামবর্ণ স্নিগ্ধ মুখের মায়ায়। তার ঐ বড়বড় ডাগরডোগর নেত্র জোড়ার প্রেমে পড়েছে। তার টকটকে লাল ওষ্ঠের প্রেমে পড়েছে। তার ঐ মসৃন মুখে চাপ দাঁড়ির প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়েছে তার একঝাক চুলের উপর যারা লম্বা হয়ে নেমে এসেছে রাজকুমাররে ঘাড়ের উপর। তার মাথার ঐ মুকুট,গলায় মুক্তোর মালা,হাতে হরেক রকমের বালা সবটার.. সবটার প্রেমে পড়েছে রাজকন্যা। তার শীতল চাহনি,মায়াবী হাসি সবটাই ভালোবেসেছে সে। সবটা।

“বাব্বাহ! এক দেখাতেই হজম করবেন কি আমাকে?”

সোজা কথার বান ছুড়লো রাজকুমার। রাজকন্যা চোখ বড়বড় করে তাকালো। হঠাৎ লজ্জায় মাথাটা মিশিয়ে নিলো চিবুকের সঙ্গে। ইশ,কি বেয়াড়া হয়েছে সে। এভাবে কি কাউকে দেখে নাকি?

“লজ্জা পেলেন?”

রাজকুমার মুখটা নীচু করে রাজকন্যাকে একবার দেখলো। সে যে লজ্জায় মুখই তুলতে পারছেনা। রাজকুমার স্মিত হাসলো। ফের বলল,

“লজ্জা পেতে হবেনা। আজ থেকে আমার গোটা জীবনটা এই রমণীর নামে দলিল করে দিলাম। সে যখন চায়,যেভাবে চায় আমায় দেখতে পাবে।”

বলতে বলতে রাজকুমার এগিয়ে এসে আলতো করে হাত রাখে রাজকন্যার মুখবিবরে। রাজকন্যা কেঁপে উঠে। রাজকুমার ওর চোখে চোখ রাখে। পলক ঝাপটে বলে,

“আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি রাজকন্যা। খুব ভালোবেসে ফেলেছি।”

রাজকুমারের অঙ্গীকারে সারা শরীরে অদ্ভুত এক শ্রোত বয়ে যায় রাজকন্যার। সে অপলক দৃষ্টি রাখে রাজকুমারের নেশালো নয়নে। রাজকুমার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার খুব কাছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে তার মুখবিবরে। রাজকন্যা চোখ বন্ধ করে নেয়। মনের অগোচরেই লজ্জিত হাসে। তার ওষ্ঠদ্বয় কাঁপে। অতঃপর টের পায় রাজকুমার মিশে যায় তার সাথে। খুব কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসার পরশ আঁকে ললাটে (কপালে)। রাজকন্যার নেত্রকোন ভরে ওঠে প্রশান্তিতে। সে চোখ মেলে তাকায় রাজকুমারের স্নিগ্ধ মুখে। ততক্ষণে রাজকুমার তাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে। রাজকন্যা কান পাতে তার বুকে। শুনতে পায় ভালোবাসার ডাক। সাড়া দেয় সেও। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাজকুমারকে। তার বুক জুড়ায়। তার ছোট্ট জীবনটাতে আজকের মতো এতোটা প্রশান্তি যে কখনও পায়নি সেটা উপলব্ধি করে। আজই এই নতুন আর সুন্দর অনুভূতির সৃষ্টি করে সে। পরম শান্তি অনুভব করে। বাবাকে হারানোর বেদনা ভুলতে তার এক ক্ষনও লাগেনা। মন বলে সে এই ধরণির সবচেয়ে সুখী মানুষ। হ্যাঁ-সেই তো এই বসুমতীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা। সবচেয়ে সুখী।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পড়ে। রাজকন্যা এবং রাজকুমার দু’জনেই সচেতন হয়ে দূরে সরে পড়ে। পেছন মুড়ে তাকায় একই সাথে। ওপাশ থেকে আরহামের গলা ভেসে আসে,

“মার্জনা করবেন রাজকুমার! এখখানা পত্র এসেছে।”

রাজকুমার একবার আঁড়চোখে তাকায় রাজকন্যার দিকে। অতঃপর নিজেকে আড়স্ত করে পূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার প্রতি। রাজকন্যাও তাকাও প্রশ্নবিদ্ধ মুখে। রাজকুমার চোখের ইশারায় রাজকন্যাকে ভরসা দেয়। অর্থাৎ, ‘দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই।’ এগিয়ে গিয়ে পাট(দরজা) খোলে রাজকুমার। পাটের ওপাশ থেকে অপরাধী দৃষ্টিতে তাকায় আরহাম। মাথা নত করে। অতঃপর পত্রটি এগিয়ে দেয় রাজকুমারের দিকে।

“তোমার রাজ্য ধ্বংস হতে চলল,যুবক!”

পত্রে এমন কিছু লেখা পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে পড়ে তার। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকালে সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

“আমাদের যেতে হবে রাজকুমার।”

ভেতর থেকে রাজকন্যা তাদের কথোপকথন ঠিকঠাক শুনতে পায় না। তাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে। যদিও রাজকুমার নিশ্চিত করেছে দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই তবুও মন মানছেনা। মন বলছে তার অগোচরে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে।

“যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি আসছি।”

বলে ভেতরে প্রবেশ করে রাজকুমার। রাজকন্যা না পেরে ছুটে আসে তার সামনে। চিন্তান্বিত মনে প্রশ্ন করে,

“কি হয়েছে? কোনো বিপদ নয়তো?”

“বিপদ তো বটেই রাজকন্যা। রাজ্যের উপর যুদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। আমাকে যে যেতে হবে।”

“সে কি! হঠাৎ..”

“চিন্তা করবেন না। আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো।”

রাজকুমার আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না রাজকন্যাকে। কাছে টেনে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো কয়েক মুহুর্ত। অতঃপর ললাটে পূনরায় ভালোবাসার ছোট্ট একটা ছোঁয়া একেই বেরিয়ে গেলো। রাজকন্যা হতাশ দৃষ্টে তাকিয়ে আছে রাজকুমারের যাওয়ার পানে। তার ভেতরে প্রবল ঝড় বইছে! না জানি কোনো বিপদ ওত পেতে আছে রাজকুমারের জন্য। যদি যুদ্ধই হবে তবে তার রাজ্যও যুদ্ধ করবে রাজকুমারের হয়ে। রাজকুমার একা নয়। সে তার পাশে আছে।

রাজকন্যা ছুটে গেলো মহলে। প্রহরীদের আদেশ করলো মহামন্ত্রীকে খবর দিতে। প্রহরীরা ছুটে গেলো রাজকন্যার আদেশ পালনে। মহলে সোরগোলের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এলেন চাচাজান। রাজকন্যাকে এমন চিন্তিত আর হাসফাস করতে দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?’

রাজকন্যা আদেশের ভঙ্গিতে বলল,

“রাজকুমারের রাজ্য সংকটের মুখে চাচাজান। আমাদের এক্ষনি উনার প্রয়োজন মাফিক সৈন্য পাঠাতে হবে। আপনি ব্যবস্থা করুন।”

এরই মধ্যে ছুটে এলেন মহামন্ত্রী।

“রাজকন্যা, এতো জরুরী তলব?”

“মন্ত্রী মশাই, নগর রাজ্যের জন্য সৈন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”

“যথাআজ্ঞা রাজকন্যা।”

এই বলে মন্ত্রীমশাই যেতে নিতে বাঁধ সাধেন চাচাজান। বলেন,

“দাঁড়ান মন্ত্রী মশাই। আগে ঘটনা কি বুঝতে হবে।”

মন্ত্রী মশাই দাঁড়িয়ে পড়ে। তবে থামার জন্য নয় যাবার জন্য। তাড়া দিয়ে বলে,

“রাজকন্যা না বুঝে কিছু করেননা ছোট রাজামশাই। আপনি বেশি ভাববেন না।”

এই বলেই ছুটে যায় মন্ত্রীমশাই। চাচাজানের মুখ খানা ছোট হয়ে আসে অপমানের সুক্ষ্ম রেখায়। পাশাপাশি এক অজানা ভয়ও কাজ করছে মনে।

“রাজকন্যা? রাজকুমারকে না বলে ওর রাজ্যে সৈন্য পাঠানো ওর জন্য অপমান জনক নয়?”

“এ আপনি কি বলছেন চাচাজান?”

“ঠিকই বলছি রাজকন্যা। রাজকুমার আমাদের রাজ্যের জামাতা। আর কোনো পুরুষই চাইবেনা তার শশুর বাড়ি থেকে তাকে কোনো ভেত পাঠানো হোক।”

“এটা ভেত নয় চাচজান। যদি উনি সত্যি সুপুরুষ হন তবে উনি আমার দুশ্চিন্তা বুঝবেন।”

রাজকন্যা প্রস্থান করে। চাচাজান দাঁড়িয়ে থাকে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে। ওদিকে মন্ত্রীমশাই এক মুহুর্তও বিলম্ব করে না সৈন্য পাঠাতে। রাজকন্যার আদেশ অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করে দেন তিনি।

“রাজকন্যে? হঠাৎ হলো কি?”

জিন্নাত প্রশ্ন করলো।

“রাজকুমার বিপদে জিন্নাত!”

“সে কি! হঠাৎ করে কি এমন হলো?”

“ওসব কথা ছাড়ো! আমরা কি যেতে পারিনা?”

“ও মা! এ কেমন কথা? কোথায় যেতে চাও তুমি?”

“উনার রাজ্যে?”

“না না! এ সম্ভব নাকি?”

“কেন সম্ভব নয়?”

“রাজকন্যে.. বোঝার চেষ্টা করো। ওখানে যুদ্ধ চলছে আর তুমি নববধূ। এমতবস্থায় এসব সম্ভব নাকি? তাছাড়া রাজকুমার জানতে পারলে ভাবতে পারছো কেমন ক্রোধে পড়বেন?”

রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ধপ করে বসে পড়লো সজ্জিত শয্যায়। তার এখানে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া যে আর কোনো উপায়ও নেই। কিন্তু এত দুশ্চিন্তাও যে করতে পারছেনা। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে খুব।

___

দু-দিন পেরিয়ে গেলো। রাজকুমারের খোঁজ এখনও পায়নি রাজকন্যা। দুশ্চিন্তায় তার শরীর ভেঙে আসছে। কোন অবস্থায় আছে,কেমন আছে কিছুই জানেনা সে। ঠিক সেই মুহুর্তে খবর এলো সেনপতি আতাউলের। কবিরাজ মশাই তাকে কিছু বলতে চায়! সে ছুটলো কালা-পাহাড়িয়ার কারাগারে। কাউকে কিছু না বলে বের হলো রাজপ্রাসাদ থেকে। ঘোড়াশাল থেকে সুফিকে নিয়ে রওনা হলো পথে। প্রায় অনেক ক্রোশ পথ অতিক্রম করার পর পেয়ে গেলো গন্তব্য স্থল। সুফিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। উপর থেকে হাটঁতে হাঁটতে পাতালে নেমে এলো। কারাগারের সামনে এসে পৌঁছাতেই উঠে আসলো সেনাপতি আতাউল।

“রাজকন্যা আপনার বিবাহের জন্য অনেক অনেক মোবারকবাদ।”

রাজকন্যা স্মিত হাসলো। মাথা নেড়ে কারাগারের বন্দির দিকে তাকালো। ঠোঁট নেড়ে আওড়াল,

“কবিরাজ মশাই কি বলতে চান আমাকে?”

মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে কবিরাজ মশাই। এই কয়দিনে তার অবস্থা নাজেহাল। চোখ মুখের অবস্থাও খুবই করুন। মনে হয় যেন অণ্যআহার ছুঁয়েও দেখেন না তিনি। ইচ্ছে করেই নিজের মৃত্যু ডেকে আনছেন।

অতিকষ্ট উঠে বসলো কবিরাজ মশাই। রাজকন্যা তার মুখ চেয়ে তাকিয়ে আছে। রাজকন্যাকে দেখতেই তার মুখে মলিন হাসির রেখা ফুটলো। মলিন হেসেই আওড়ালো,

“আপনার খুব বিপদ রাজকন্যা। সাবধানে থাকবেন আপনি।”

রাজকন্যার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। সেদিনের তুলনায় কবিরাজ মশাইকে আজ অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে যেন সে কোনো ঘোর থেকে বেরিয়েছেন।

“আমার বিপদ?”

“হ্যাঁ রাজকন্যা, আপনার বিপদ। খুব বিপদ।”

“কেমন বিপদ?”

“তা আমি বলতে পারবোনা রাজকন্যা। বললে আমার কন্যাকে ওরা বলি দিবে।”

“কারা?”

“আমি শুধু আপনাকে এটুকুই বলতে পারবো আপনি সাবধানে থাকবেন।”

“আপনি আমাকে নির্দিধায় বলুন কবিরাজ মশাই। আমি আপনাকে ওয়াদা করছি আমি আপনার কন্যাকে মুক্ত করবো।”

“আপনি আমার কন্যাকে কখনও সচক্ষে দেখেননি রাজকন্যা। তাই ওরা এই সুযোগে আপনাকে বারবার চোখের ধোঁকা দিয়ে যাবে আপনি টেরও পাবেন না। তাই আমাকে মার্জনা করুন। আমাকে বারবার একই প্রশ্ন করবেন না দয়াকরে। আমি কারোর নাম মুখে নিতে পারবোনা।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাজকন্যা। মায়া হচ্ছে কবিরাজ মশাইয়ের উপর। কে লুকিয়ে আছে এই নোংরা খেলার পেছনে? কার মুখ লুকিয়ে আছে?

“শুনলাম আপনার বিবাহ সম্পন্ন করেছেন ছোট রাজামশাই?”

” জি।”

“আপনার নব জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো। সুখী হন আপনি। আপনার সুখ মানেই এই রাজ্যের সুখ।”

“হু। সেনাপতি মশাই?”

“আজ্ঞে রাজকন্যা?”

“কবিরাশ মশাইকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করুন।”

“না। না না না! র্ রাজকন্যা এই কর্মটি ভুলেও করিবেন না?”

আতংকে কেঁপে উঠলো কবিরাজ মশাই। হাসফাস করতে করতে বলে উঠলো কথাগুলো। রাজকন্যা আর সেনাপতি উভয়ই অবাক হলো। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। রাজকন্যা অবাক স্বরেই বলল,

“কেন?”

“ও্ ওরা জানতে পারলে.. আ্ আপনাকেও মেরে ফেলবে!”

“কি জানতে পারলে?”

দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলো রাজকন্যা। কবিরাজ মশাই মিইয়ে পড়লেন। গুটিয়ে গেলেন কারাগারের এক প্রান্তে। কাঁপতে কাঁপতে বললেন,

“আমায় এখান থেকে মুক্ত করবেন না রাজকন্যা। আমি আপনার দুটি চরনে পরি!”

রাজকন্যা অবাকের চমর পর্যায়ে পৌঁছে কপাল চাপলো। কি হচ্ছে তার অগোচরে? কারা ওর শত্রু? কারা মেরে ফেলতে চায় ওকে? কবিরাজ মশাই কেন বন্দি হয়ে থাকতে চান? চারপাশে রহস্যের গন্ধে গা গোলাচ্ছে যে। কি করবে সে এখন?

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[৮]

রাজকুমার ফিরলো ঠিক পাঁচদিনের মাথায়। এসে পরিবারের সবার মাঝে দাঁড়িয়ে বিজয়ের হাসি দিয়ে ঘোষণা করলো সে এই যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরেছে। সে শত্রুপক্ষকে হারিয়ে নিজের রাজ্যকে আরও একবার শত্রু মুক্ত করতে পেরেছে। সবাই ভীষণ আনন্দে হৈহৈ করে উঠলো। ‘রাজকুমার সাদ্দাতের জয়’ নামে প্রতিধ্বনি করতে লাগলো। রাজকুমারও এতে সন্তুষ্ট হলো। সন্তুষ্ট মনে নিজের কক্ষের দিকে রওনা হলো। রাজকন্যা এতোদিনে অনেক উপায়েই তার খোঁজ জোগাড় করতে চেয়েছে। তার আপ্রাণ চেষ্টা শেষ পর্যন্ত গিয়ে কোনো না কোনো ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর সঠিক কারন কি সে জানতে পারেনি। কেউ তার পথে বারবার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজকুমারের খবর নিতে বারবার বাঁধা দিয়েছে। এমনকি সেই জয়ী হয়েছে। হেরে গেছে রাজকন্যা। সে কোনোমতেই রাজকুমারের খোঁজ আনতে পারেনি।

“রাজকন্যা..”

বড় উৎফুল্ল হয়ে রাজকন্যার নাম আওড়ালো রাজকুমার। এই পাঁচদিন স্রেফ দিন ছিলো না রাজকুমারের জন্য.. ছিলো অগুনিত মাস আর অগুনিত বছরের সমান। যুদ্ধ চলাকালীনও সে ভেবে গিয়েছে রাজকন্যার পবিত্র মুখ খানা। কি মনহরণী পবিত্র রূপ। যেমন রূপ তেমন সুন্দর হাসি তার। হাসে কম, তবে যখন হাসে তখন তরতাজা হয়ে ওঠে প্রকৃতি। আহা কি সুন্দর।

রাজকন্যা তার কক্ষ সংলগ্ন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অন্যমনস্ক হয়ে। তার মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে ঝিমঝিম করছে। তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি রাজকুমারের ডাক। সে শুনতে পায়নি একদমই। রাজকুমার ধীরেধীরে এগোলো রাজকন্যার পানে। দূর থেকে তার চোখে ধরা দেয় রাজকন্যার লম্বা ঘন-কালো কেশ। যা কোমর রেখেও বহুদূর গড়িয়ে নেমেছে। সাপের মতো আঁকাবাকা তাদের চলন। যার থোকে থোকে গোলাপের বিচরন। কাটাহীন গোলাপ। যার মিষ্টি সুঘ্রাণ অনেকদূর চলে এসেছে। রাজকুমার মোহনীয় হাসলো। সে বুঝলো সে আবারও প্রেমে পড়েছে তার প্রণয়নীর। এবার আর রূপের নয় তার ঘনকালো লম্বাকেশের। চমৎকার গড়ন তাদের। মন জুড়িয়ে এলো।

উন্মুক্ত কোমরে কারোর গভীর ছোঁয়া পেয়ে আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে রাজকন্যা। তার বুকের ভেতরে কাঁপে। অন্যমনস্ক হয়ে সে দিনদুনিয়া ছেড়ে বহুদূরে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ এমন ধাক্কা খেয়ে বর্তমানে অবতার করতে হবে ভাবনাতেও আসেনি। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে দেখতে নিলেও সে পথ বন্ধ করলো মানুষটা। পিঠে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোর মাঝে নাক ডোবালে। গভীর ভাবে নিঃশ্বাস টানলো। আহা কি মাতাল করা গন্ধ। মাথা ঘুরিয়ে গেলো মানুষটার। পরম শান্তিতে আরেকটু গভীর হতেই কাটা ফুটলো ঠিক ওষ্ঠদ্বয়ের নীচে। কাতর কন্ঠে অস্ফুট শব্দ করে পিছিয়ে পড়লো কয়েক কদম। রাজকন্যা এবার দেখার সুযোগ পেলো তাকে। পাঁচ পাঁচ টা দিন! কম ছিলো না তার জন্য। কিভাবে দিন কেটেছে একমাত্রই সেই জানে। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। চোখ জুড়িয়েছে তার শ্যামকে দেখে। তবে হঠাৎ দৃষ্টি কাঁপলো রাজকুমারের থুঁতনি দেখে।

“সে কি! কি হলো?”

বলে দ্রুত পায়ে ছুটে এলো রাজকুমারের সন্নিকটে। রাজকুমার চিনচিনে জ্বলা ভাবে হাত চেপে রেখেছে জায়গাটায়। রাজকন্যা চিন্তান্বিত মনে হাত বাড়ালো সেদিকে। রাজকুমার ওর চিন্তা দেখে প্রশান্তি পেলো যেন। ব্যাথা ভুলে হঠাৎ দু’হাতে আড়স্ত করলো রাজকন্যাকে। রাজকন্যা অবাক চৈতন্য মনে আওড়ালো,

“এই আঘাত কি করে লাগলো?”

“আপনার কাছে আসার শাস্তি!”

রাজকুমার নির্বিকার কন্ঠে আওড়ালো। রাজকন্যা লজ্জা পেলো। সেই সঙ্গে ভারী অবাকও হলো।

“কেমন করে কাটলো?”

“আপনাকে এতদিন নিজের থেকে দূরে রেখে নিজেই অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তাই আগেপিছে কিছু না ভেবে যখন এগিয়ে গেলাম তখন আপনার সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমার পথ রোধ করেছে।”

“আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র?” (অবাক কন্ঠ)

“জি।”

“কি সেটা?”

“এই যে.. আপনার কেশ!”

রাজকন্যা আরও বেশি অবাক হয়। বিচলিত হয়ে পড়ে। বলে,

“সে কি করে সম্ভব?”

রাজকুমার তার হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে। আরেকটু কাছে টেনে আনে তার প্রণয়নীকে। শীতল কন্ঠে আওড়ায়,

“জানিনা। তবে আঘাত যেতেহু করেছেন এর প্রতিক্রিয়াও আপনিই করবেন।”

রাজকন্যা আহত হলো। সে এখনও বুঝে উঠতে পারলো না রাজকুমারের এই আঘাতের সঠিক কারন! শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলো কতক্ষণ। রাজকুমারের কথার মমার্থও ধরতে পারলোনা। হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো রাজকুমারের কাটা-স্থানের ঔষধী খুঁজতে। রাজকুমার ছাড়লো না তাকে। বরং হাতের বাঁধন ধীরে ধীরে শক্ত করলো। রাজকন্যা অবাক হয়ে বলে,

“কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে! আমি আপনার জন্য ঔষধীর ব্যবস্থা করি।”

“ঔষধীতে তো এই ঘা সেরে যাবে রাজকন্যা। কিন্তু মনের ঘা কি শুঁকাবে?”

“এ মা! কি হলো আবার মনে?”

“দেখবেন?”

“দেখবো।”

রাজকন্যা সরল মনে বলে। রাজকুমার সত্যি সত্যি দেখাতে শুরু করে তার হৃদযন্ত্রের জখম। রাজকন্যাকে ছেড়ে নিজের পোশাক খুলতে আরম্ভ করে সে। রাজকন্যা উৎসুক নয়নে তাকায়। চোখ নামায় না। তবে বারবার ভেতরে লজ্জার বান উপচে পড়ে। দৃষ্টি স্থীর রাখতে পারেনা! কাঁপে,নড়ে। ভীত হয়। এক পর্যায়ে রাজকুমারের উন্মুক্ত শরীর ভেসে ওঠে রাজকন্যার লজ্জা মিশ্রিত চাহনিতে। সুঠাম দেহ তার। পেটানো শরীর। শক্ত পেশিবহুল বাহু। লোমহীন উদার বুক। রাজকন্যা কেঁপে ওঠে। কি করছে সে? এভাবে পলকহীনভাবে রাজকুমারের উন্মুক্ত শরীরে চোখ বুলাচ্ছে কেন? রাজকুমার কি ভাবছে! রাজকন্যা চোখ নামিয়ে নেয়। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। রাজকুমার মিটমিট করে হাসে। শয়তানি হাসি। এক পর্যায়ে রাজকন্যার হাতটা উঠিয়ে আনে। ঠিক বুকের পা পাশে চেপে ধরে। রাজকুমারের শরীর ছুঁতেই রাজকন্যা আবারও কাঁপে। তার ভেতরে প্রবল ঝড় শুরু হয়। সে স্পষ্ট শুনতে পায় কেউ তার বুকের ভেতরে অনায়াসে ঢোল পিটিয়ে চলেছে। যার শব্দে সে অতিষ্ট হয়ে পড়ছে। সে তার হাত গুটিয়ে নিতে চায়। কিন্তু রাজকুমার তা হতে দেয়না। সে বলে,

“অনুভব করছেন?”

রাজকন্যা ঢোক গিলে। একাকার মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে সে রাজকুমারের দিকে তাকায়।

“আ্ আপনি ঠাট্টা করছেন আমার সাথে? আমি কিন্তু বোকা নই।”

শব্দ করে হেসে ওঠে রাজকুমার। রাজকন্যা লজ্জায় গুটিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে রাজকুমার ইচ্ছে করে করছে এসব। যার ফলে লজ্জারা আরও জাঁতা দিয়ে ধরে তাকে। নিজেকে রাজকুমারের থেকে ছাড়িয়ে নিতে গেলেই তার অন্য হাত টাও আবদ্ধ হয় রাজকুমারের উন্মুক্ত বুকে। সে কেঁপে ওঠে আরও একদফা। লজ্জায় কথা আওড়াতে পারেনা আর। রাজকুমার তার হাত জোড়া নামিয়ে আনে রাজকন্যার উন্মুক্ত কোমরে। দু’হাতে ফের আবদ্ধ করে তাকে। রাজকন্যাকে টেনে নেয় নিজের খুব কাছে। রাজকন্যার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে বাজতে থাকা শব্দ অনায়াসেই টের পায় সে। অমনি শয়তানি হাসে। মুলত এই মুহুর্তে রাজকন্যাকে জ্বালানোই তার একমাত্র কাজ। রাজকন্যা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। যা রাজকুমারের মুখ আঁচড়ে পড়ে।

“ছ্ ছাড়ুন না।”

অতিকষ্টে মুখ খুলে রাজকন্যা। রাজকুমার হাসে। কোনো কথা বলেনা। রাজকন্যা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। জিন্নাত কক্ষে প্রবেশ করেছে। সে অনুভব করছে জিন্নাতের অস্তিত্ব। ইশশ! জিন্নাত তাদের এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে! ভাবতেই আরও বেশি লজ্জা লাগছে তার। রাজকুমার ওর কাঁপন দেখে কেবল হাসেই। হঠাৎ করে বসলো অনাকাঙ্ক্ষিত এক কর্ম। রাজকন্যার কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়ে এঁকে দিলো এক গভীর চুমু। যার সমাপ্তি কয়েক মুহুর্ত ঘটলো না। ঠিক কয়েক মিনিট গড়াতে মুক্তি পেলো সে। রাজকুমারের হঠাৎ কান্ডতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রাজকন্যা। স্থবির হয়ে তাকালো রাজকুমারের দিকে। রাজকন্যার এই আকস্মিক চেহারায় হাসি পেয়ে গেলো রাজকুমারের। সে তাকে আরেকটু কাছে টেনে আনলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“শোধ নিলাম। অখুশি হননি তো?”

“প্ পাগল আপনি!”

রাজকন্যা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। ও জিন্নাতের কথা ভাবলে আরও বেশি লজ্জায় মরছে সে। সে এখনও এখানে উপস্থিত আছে।

“হু খুব পাগল। এই রমনীর জন্য।”

ভাবলেশহীন ভাবে আওড়ায় রাজকুমার। অতঃপর রাজকন্যাকে মুক্ত করে নিজের হাতের বন্ধন থেকে। রাজকন্যা মুক্তি পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে। দ্রুত সরে পরে রাজকুমারের থেকে খানিকটা দূরে। এই মুহুর্তে তাকে জল খেতে হবে। নয়তো সে তেষ্টাতেই অর্ধমৃত হবে।

দ্রুত পায়ে কক্ষ থেকে বের হয় রাজকন্যা। কিন্তু কয়েক মুহুর্তের মাঝেই আবার ভেতরে প্রবেশ করে। রাজকুমার ওকে আবার ফিরে আসতে দেখে বলল,

“পালাতে চাচ্ছেন নাকি?”

“চাইলেই কি? পালাতে পারছি কই?”

“কেন? কে বাঁধা দিলো?”

“দাসীরা! আমাকে দেখে কেমন মিটমিট করে হাসছে দেখুন। আপনিও খুব বেশরম।”

রাজকুমার হাসে। কথা শেষ করেই হুট করে নিজের পোশাক পরে নেয়। অতঃপর ফের এগিয়ে আসে রাজকন্যার পানে। রাজকন্যা ভীত দৃষ্টিতে তাকায়। পালানোর পথ খোঁজে। যা বুঝতে পেরে রাজকুমার হাসতে হাসতে বলে,

“ভয় নেই কাছে আসছি না।”

“উফফ!”

রাজকুমার হো হো করে হেসে ওঠে। জিন্নাত চলে গেছে। আর তাকে কক্ষে দ্বিতীয়বার পাঠানোর মহৎ কাজটা সেই করেছে। তবে তার নাম সে রাজকুমারের সামনে নিতে চায়না। ইচ্ছে করেই চায়না। কারন বেশিরভাগ পুরুষই জিন্নাত জাতিকে বড় ঘৃনার দৃষ্টিতে দেখে। যদি রাজকুমারও সবার মতো হয়? যদি সেও তার দাদাজানের মতো জিন্নাত জাতিকে সমুলে উৎখাত করতে চায়? সে সহ্য করতে পারবেনা। জিন্নাত তার খুব প্রিয়। আর সেই সাথে জিন্নাত জাতিও। এই ধরণীতে সবারই সমান অধিকার আছে ভালোভাবে বেঁচে থাকার। তবে বরাবর মনুষ্য জাতির হাতেই কেন অন্য জাতি নির্যাতিত, পীড়িত হয়!

“জল।”

রাজকুমার জলের গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজকন্যার সামনে। রাজকন্যার এতক্ষণে সম্পূর্ণ মনোযোগ পড়লো রাজকুমারের কাটাস্থানে। বেশ খানিকটা কেটেছে। রক্ত মুখো হয়ে আছে জায়গাটায়।

“ভাববেন না,ঠিক হয়ে যাবে।”

রাজকন্যা কিছু বলবার পূর্বেই বলে ওঠে রাজকুমার। রাজকন্যা অবাক হয়। বলে

“আপনি কি করে বুঝলেন?”

“আপনার চোখ পড়েছি।”

“ইশশ! সে কি পড়া যায় নাকি?”

“প্রেমে পড়লে সম্ভব।”

“ও। আপনি পড়েছেন বুঝি?”

“খুব।”

“প্রেমে কিভাবে পড়তে হয়?”

“আপনি পড়েননি?”

“না তো!”

রাজকন্যার সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। রাজকুমার আহত হয়। অসহায় কন্ঠে বলে,

“ও।”

“এদিকে বসুন।”

রাজকন্যা তার হাত ধরে নিয়ে শয্যায় বসায়। অতঃপর দাসীকে আদেশ করে ঔষধীর ব্যবস্থা করতে।

“আপনি কাটা সহ গোলাপ পড়েন?”

“না তো। কাটা কই পেলেন?”

“আপনার ফুলের কাটাতেই আমার মুখ কেটেছে।”

“সে কি!”

রাজকন্যা চটজলদি তার চুলগুলো সামনে আনে। রাজকুমার যা বলছে তা যে কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। দাসীরা এতোভুল করেনি যে কাটাসহ ফুল দিয়ে তাকে সজ্জিত করবে। তাতে সে নিজেও তো আহত হতে পারে।

রাজকন্যা প্রত্যেকটা ফুল নিজের হাতে ধরে দেখলো। পূনরায় বাছাই করলো। কিন্তু কোথাও কোনো কাটা যুক্ত ফুল পেলো না। সে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে বলল,

“আপনি ভুল বলছেন। আমার চুলের কোনো ফুলেই তো কাটা নেই।”

রাজকুমার নিজেও ভীষণ অবাক হয়। তবে সে স্পষ্ট টের পেয়েছি এ রাজকন্যার মাথার ফুলেরই কাটা। এখন যে নেই। অদৃশ্য হয়ে গেলো কি? নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে। ফুলেও রহস্য? অদ্ভুত!

#চলবে