রেইনকোট আরোহী পর্ব-০৪

0
133

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ৪
(নূর নাফিসা)
.
.
তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কারণে ভোরেও উঠতে পেরেছে ফজরের সময়। বাসভবনের নামাজঘরে নামাজ আদায় করে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে ঘুম ভাঙলো ফোন কলের শব্দে। মারফত সাহেবের কল। আবরার রিসিভ করতেই মারফত সাহেব বললেন,
“আসসালামু আলাইকুম। স্যরি, স্যার। এতো সকালে ডিস্টার্ব করার জন্য।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ইটস ওকে, বলুন।”
“স্যার, ওই বাচ্চাটার বাবা-মা এসেছে আরও এক ঘন্টা আগে। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা নিশ্চিত না হয়ে বাচ্চাকে তাদের কাছে নিয়ে আসছি না।”
“কেন? বাচ্চা তো তার মাকে দেখলেই চিনবে। এখানে অনিশ্চয়তা থাকার কথা কেন?”
“নো, স্যার। তেমন কিছু না। আসলে বাচ্চাটা ঘুম থেকে উঠেনি। ঘুমের বাচ্চা তো তাদের কাছে দিতে পারি না। আপনি কখন আসবেন, জানালে সুবিধা হতো।”
“আমি আসছি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে।”
“ওকে, স্যার।”
আবরার ঘুম কাটাতে ফ্রেশ হয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হতে লাগলো। এমনি কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে দেখলো তাযিন সকালের নাস্তা নিয়ে হাজির। হাতে মিষ্টির প্যাকেটও।
“আসসালামু আলাইকুম। গুড মর্নিং স্যার।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এটা কি?”
“স্যার, আমাদের নতুন অতিথির মিষ্টি।”
আবরার মৃদু হেসে বললো,
“এতো মিষ্টি তো আমি খাবো না। এক পিস রেখে যাও।”
“সে কি, স্যার! আমি তো…”
“উহুম, এমনিতেই খুশি। এক পিস রেখে যাও। বেবি ভালো আছে তো?”
“জ্বি, স্যার। আলহামদুলিল্লাহ।”
আবরার আরেকটু সময় নিয়ে হালকা নাস্তা করেই বের হলো। জানালার বাইরে মেঘলা আকাশ দেখে ছাতা নিয়েছে সাথে। কার্য ভবনে এসে বাচ্চার মামা ও বাবামায়ের সাথে পরিচিত হলো। বাচ্চার টেনশনে মুখের অবস্থা প্রত্যেকেরই করুণ। ততক্ষণে বাচ্চাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। তাদের সামনে নিয়ে আসতেই পরিবারকে দেখে খুশি হয়ে গেছে সে। বাচ্চার মা কান্না জুড়ে দিয়ে সাথে সাথেই বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।
গতকাল দুপুরে বাড়ির গেইট থেকেই খেলায় ছোটাছুটি করতে থাকা এই বাচ্চাটাকে সাভার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। সাথে সাথেই সিএনজিতে তুলে ফেলায় চিৎকার করেছিলো বাচ্চাটা। কিন্তু তার মা ছুটে আসতে আসতে গাড়ি দৃষ্টির আড়ালে! বিকেলে বাচ্চার বাবার ফোনে কল করে পাঁচ লক্ষ টাকার দাবি! তারা তখন থেকেই পুলিশকে ইনফর্ম করে থানায় ছোটাছুটি করছিলো। মধ্যরাতে র‍্যাব কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি পেয়ে ভোরেই ছুটে এসেছে। পরিচিত মানুষ ছাড়া এমনটা অন্যকেউ করতে পারে না। টাকার জন্যই ইচ্ছাকৃত এমন কাজ করা হয়েছে পরিচিতদের মধ্য থেকে কারো দ্বারা। কিন্তু এই মুখোশগুলো খুঁজে বের করাই একটু কঠিন। বিশ্বস্ত মানুষগুলোর উপর যে সহজে সন্দেহ ডেকে আনা যায় না! মারফত সাহেব সেই নম্বরটাও সংগ্রহে রাখলেন। তারপর তাদের কাছে হস্তান্তর করলেন তাদের চোখের মণিকে। বাচ্চাটা যেন একটা দিন বিষণ্ণতায় কাটানোর পর মুখে হাসির ফেরি বসিয়েছিলো!
বাচ্চার মায়ের কান্না দেখে তৎক্ষনাৎ মিমির চেহারাটা ভেসে উঠলো আবরারের চোখে। তারা চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ একা বসে বসে মিমিকে নিয়েই ভাবলো। প্রথমবার যখন মারওয়ার জ্বর হলো, মিমির মতো এতো স্ট্রং একজন মা-ও সন্তানের অসুস্থতার কাছে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কত কান্নাই না করেছিলো। গায়ে মাখছিলো না কারো সান্ত্বনাই। প্রত্যেকটা মা-ই হয়তো এমন। তার মা-ও তো কত আগলে রাখে তাদের। একটু অসুস্থ জানলেই এখনো কত যত্ন নেয়। দূরে পড়ে থাকলে হাজারবার কল করে খোঁজ নেয়, “এখন কি অবস্থা!”
বাড়ি যাওয়া প্রয়োজন তার। স্বজনদের দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। মেয়েটাকে কতদিন কাছ থেকে আদর করা হয় না। প্রায়ই মনটা আকুপাকু করে। মিমির রাগটাও ভাঙানো দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো, তাকে যথেষ্ট সময় নিয়ে যেতে হবে। যা এই মুহূর্তে সম্ভব না। মিমি যদি বাড়িতে থাকতো, তবে একদিনের জন্য গিয়েও হুটহাট দেখে এবং চেষ্টা করে চলে আসতে পারতো। কিন্তু মিমি তার বাবার বাড়িতে অবস্থান করছে বিধায়ই ব্যাপারটা জটিল। শ্বশুর বাড়িতে তো সেভাবে হুটহাট যাওয়া আসা সম্ভব নয়। সেখানে গেলে ব্যাপারটাই অন্যরকম হবে। কয়েকটা পরিস্থিতি তাকে সামাল দিতে হবে মিমির রাগ ভাঙানোর জন্য। যা স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। কিন্তু এতো সময় যে এখন নেই তার হাতে।
.
রাতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাটাচলা তুলনামূলক বেশি থাকে রেলস্টেশন ও তার আশেপাশে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই সহ নানান অপকর্ম সংঘটিত হয় রাতেই। ইদানীং এই ঝোঁকটা বেড়েই চলেছে। পথে বসেই হাহাকার কান্না জুড়ে দিচ্ছে নিরিহ মানুষগুলো। পথেই ছুরি কিংবা অন্যান্য অস্ত্রের আঘাতে মারা পড়ছে নিরিহ প্রাণ। তাদের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে, অন্ধকার পথের ভয় কাটাতে আইনের লোকগুলোর বিচরণ ঘটছে কখনো বন্ধু হয়ে, কখনোবা কারণহেতু শত্রু হয়ে! কিন্তু তবুও মানুষগুলো জীবনের তাগিদে পা বাড়াচ্ছে তাদের উপর বিশ্বস্ত হয়েই।
ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে হাটতে বেরিয়েছে আবরার। একা একা হাটতে বের হলে সবসময়ই মুখে মাস্ক রাখে সে। এমনিতেও অধিকাংশ সময়ই মাস্ক রাখে ধুলাবালির জন্য। আজ নামাজের টুপিটাও রেখেছে মাথায়। পরনে লুঙ্গি ও টিশার্ট। বেশে বুঝার উয়াপায়ই নেই সে যে কোনো র‍্যাব কর্মকর্তা! প্রথমে বাসভবন থেকে বেরিয়ে হেটে একটু এগিয়ে এলো সে৷ তারপর মারফত সাহেবকে হঠাৎ মনে হতেই কল করলো। প্রথমবার রিসিভ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার ট্রাই করতেই ব্যস্ত দেখালো। তিনি কি ইচ্ছাকৃত কল কেটে দিয়েছেন, নাকি কলব্যাক করছেন, বুঝতে পারলো না আবরার। কিন্তু তৃতীয়বার আর কল দিবে না সে। এতো সকালে বিরক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই। সে তো একটু মনে পড়তেই দেখতে চাইলো অবসর আছে কি না। কিন্তু সাথে সাথেই কলব্যাক হলো। আবরার রিসিভ করে সালাম দিতেই মারফত সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললো,
“স্যরি স্যার। ফোনের কাছে না থাকায় ফোনটা রিসিভ করতে পারিনি।”
“ইটস ওকে।”
“কিন্তু স্যার, এতো সকালে? কোনো কিছু হয়েছে কি স্যার?”
“না। তেমন কিছু নয়। আপনি অবসর আছেন কি না, দেখতে চাইলাম।”
“কেন স্যার?”
“অবসর থাকলে একটু ভ্রমণে যেতাম আপনাকে নিয়ে।”
মারফত সাহেব মৃদু হেসে বললেন,
“রিয়েলি স্যার! কোথায় যেতে চান? কখন যাবেন? কোনো মিশন আছে নাকি?”
“না, মিশনের বাইরেও একটু ভ্রমণ করা যায়। আপনি চাইলে যোগ দিতে পারেন আমার সাথে। এখনই ভ্রমণে যাচ্ছি আমি।”
“এখন! কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন, স্যার?”
“আপনি কি যেতে ইচ্ছুক?”
“জ্বি, স্যার। আমার কোনো প্রব্লেম নেই।”
“তবে রাস্তায় চলে আসুন। দক্ষিণ গেইটের দিকে আছি আমি।”
“ওকে স্যার। আমি এখনই রেডি হয়ে আসছি।”
“আপনার বাসায় কি লুঙ্গি আছে?”
আবরারের অদ্ভুত জিজ্ঞাসায় অদ্ভুত প্রশ্ন জুড়ে দিলো মারফত সাহেব।
“লুঙ্গি! কেন স্যার?”
“না, মানে আমি লুঙ্গি পরে বেরিয়েছি আর আপনি যদি আমার পাশে স্যুট, জিন্স পরে হাটেন। লোকজন তাকিয়ে থাকবে না সব? তাই বলছিলাম, লুঙ্গি নাহয় ট্রাউজার পরে আসুন। মর্ণিং ওয়াকে যাবো আপনাকে নিয়ে।”
মারফত সাহেব যেন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো আবরারের কথায়। হঠাৎ আবরারের চমৎকার প্রস্তাবে পুলকিত সে। দু-তিন মিনিটের মধ্যেই তিনি চলে এলেন রাস্তায়। তার পরনেও লুঙ্গি ও টিশার্ট। আবরার বুঝতে পেরেছে ঘরে যেমন বেশে ছিলেন, সেভাবেই বেরিয়ে এসেছেন। আবরারকে দেখে হাসলেনও মারফত সাহেব।
“স্যার, মন্দ লাগছে না কিন্তু আপনাকে।”
“বাঙালির আসল পরিচয়।”
“জ্বি, স্যার। কিন্তু হঠাৎ এমন কিছুর সিদ্ধান্ত কেন?”
“এমনি। গতকালই ভেবে রেখেছি একটু হাটাচলা করবো। তাই বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল। ভাবলাম, আপনাকে সাথে নিয়েই যাই।”
“চলুন স্যার। হাটতে হাটতে কথা বলা যাক।”
দুজনেই হেটে হেটে কিছুটা পথ এগিয়ে উঠে পড়েছে রিকশায়। একটু পরিদর্শনে চলে গেছে রেলস্টেশনের দিকে। সকালের হালকা নাস্তা তারা এখানেই করেছে। তেমন কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে আসেনি এখানে৷ মূলত এই ধরনের জায়গাগুলোতে খুবই অনৈতিকতার ছড়াছড়ি থাকে। তাই পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে উঠার জন্য অবসরে একটু পরিদর্শনে বের হয় আবরার। প্রতিনিয়ত নিউজ পেপারে রেলস্টেশন সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনা চোখে পড়ায় গতকাল হঠাৎ মনে হলো রেলস্টেশনের কথা। তখনই ভেবে নিয়েছে সকালে একটু যাবে সেদিকে। পরিকল্পনা মোতাবেক চলেও এসেছে। এপাশ থেকে ওপাশে মারফত সাহেবের সাথে হেটে হেটে কথা বলেছে। স্টেশনের কোলাহল মাথা ঘামিয়ে তুললেও বিরক্তি আনেনি তাদের। বরং একটু সার্থকতা নেমে এলো এই কষ্টের বিপরীতে! তারা অবশ্য পরবর্তী ট্রেন আসার অপেক্ষা করছিলো। অপেক্ষাটা পূর্বপরিকল্পিত নয়। এখানে আসার পরই শুনেছে কয়েক মিনিট পর ট্রেন আসবে। তাই এসেছেই যখন, কোলাহলপূর্ণ পরিবেশটা দেখার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করলো নিজেরা গল্প করতে করতে। ট্রেন আসার পর একপাশে দাঁড়িয়ে ওয়ান টাইম কাপে দুইকাপ চা নিয়েছে দুজন। চোখে এঁকে নিয়েছে ট্রেন যাত্রীদের ছোটাছুটির দৃশ্য। কেউ নামছে, কেউ উঠছে, কেউ মালামাল নামিয়ে গাড়ি ঠিক করছে, কেউ মালামাল তুলে নিচ্ছে। কোলাহল, সে আর বলতে কি! হঠাৎই আবরারের চোখ পড়লো পাশেই রাখা একটা মোটরসাইকেলের দিকে! বেশ দামী ও খ্যাতিমান ব্রান্ডের মোটরসাইকেল। বিত্তশালীদের ঘরের মডার্ন ছেলেপুলেরাই এসব নিয়ে চলে সাধারণত। আবরারের নজরটা কিছুক্ষণ এদিকেই স্থির রইলো। সাধারণ মানুষের কোলাহলের ভীড়ে বিত্তবান কাউকে তো ঠিক নজরে পড়ছে না। তবে কার মোটরসাইকেল এটা, এইখানে পার্ক করে রেখেছে! আবরারের নজরকে কেন্দ্র করে একটু এগিয়ে গেলো মারফত সাহেব। মোটরসাইকেলটা কাছ থেকে ধরেই দেখলো। আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“মোটরসাইকেলের মালিককে তো দেখা যাচ্ছে না, স্যার। ফেলে রেখে কোথায় চলে গেলো? কাউকে রিসিভ করতে এসেছে নাকি মোটরসাইকেলে।”
মৃদু হাসলেন মারফত সাহেব। আবরার বললো,
“দাঁড়ান, দেখি মালিক কে। ফেলে রাখার জিনিস তো আর নয়। আসবে ঠিক।”

চলবে।