রেইনকোট আরোহী পর্ব-০৫

0
145

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
খুব একটা অপেক্ষা করতে হলো না তাদের। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিকাপ থেকে লাফিয়ে নেমে এগিয়ে এলো দুজন। তারা মোটরসাইকেলের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো এবং তাকিয়েছিলো দুজনের দিকেই। কিন্তু সেভাবে লক্ষ্য করেনি ছেলেরা। কাছে এসে যখন মোটরসাইকেলে উঠতে গেলো, তখনই তাকালো হঠাৎ। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু মনযোগেই হয়তো দেখে নিয়েছে। হঠাৎ চিনে ফেলেছে আবরারকে! মারফত সাহেব কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলো, তার আগেই বাইকার ছেলেটা আবরারকে বললো,
“আবরার আংকেল না?”
সরাসরি আংকেল! দুজনেই কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলেও মুখভঙ্গিতে প্রকাশ পেলো না সেটা। আবরার বললো,
“কে তুমি?”
“আংকেল, আমি এডভোকেট আব্দুল মান্নানের ছেলে।”
“ও, আচ্ছা।”
“আপনি এখানে?”
“এসেছি একটু কাজে। তুমি এখানে কেন?”
“আমিও একটা কাজেই এসেছি।”
“ওই পিকাপ থেকে নামলে দেখলাম?”
“জ্বি, আংকেল। আমাদের শো-রুমের কিছু প্রোডাক্ট এসেছে। চাচ্চু আসতে পারেনি, আমাকে বললো ঠিকঠাক এসেছে কি না একটু দেখে নিতে। আসি আংকেল, হুম?”
হেলমেট মাথায় তুলতে তুলতে পেছনের জন সহ উঠে বসেছে। আবরার বললো,
“হুম, যাও।”
মোটরসাইকেল ছেড়ে চলে গেলো স্টেশন। পিকাপ আরও আগেই চলে গেছে, ছেলেটা নেমে আসার পর। হাতের চা টা শেষ করে মারফত সাহেবের সাথে এবার রিকশায় উঠে আবরারও চলে এলো। রাস্তার মোড়ে নামতেই বাসভবন পর্যন্ত হেটে আসতে আসতে মারফত সাহেব বললো,
“স্যার, আপনার একটু সাবধানে চলা প্রয়োজন।”
“কেন?”
“আপনার এভাবে ঘুরাফেরা ঠিক হচ্ছে না। এই এলাকায় আপনি ধীরে ধীরে পুরাতন হয়ে উঠেছেন। এতোদিন নতুন ছিলেন, সমস্যা খুব একটা দেখা যায়নি। কিন্তু এখন অনেকেই জানে এবং চিনতে শুরু করেছে আপনাকে। কখন কি বিপদ এসে যায়, বলা তো যায় না। আইনের লোকেরা হচ্ছে পথেঘাটের শত্রু। এই শহরের জনসাধারণের বেশিরভাগই অপকর্মে লিপ্ত। তারা চায়ই আইনের লোকদের ধ্বংস করতে। নয়তো কাজে স্বস্তি আসবেনা তাদের। এই যে আপনি এভাবে একা একা ঘুরাফেরা করেন, সেটা শুধু আমিই জানি না। আশেপাশের অনেকেই ইতিমধ্যে জেনেছে। লোকজন একজনকে একাধিকবার দেখলেই মাথায় গেঁথে নেয়। সন্দেহ ছড়ায়। চিনে উঠতে লেগে পড়ে। আপনার জন্য ব্যাপারটা অনেক রিস্কি। যত্রতত্র হঠাৎ আক্রমণ করে বসলে ঠেকানো দায় হয়ে পড়বে। মালামাল গেলে তা ফিরে পাওয়া যাবে, কিন্তু একটা প্রাণ গেলে তা আর ফিরে আসবে না। অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে একটা ইন্ডাস্ট্রির, একটা পরিবারের।”
“হুম। কথা যৌক্তিক আপনার।”
“এজন্যই বলছি স্যার, এভাবে ঘুরাফেরা বাদ দিতে হবে। আপনাকে আশেপাশের সবাই ই চিনে উঠছে। জেনে যাচ্ছে আপনি গার্ডহীন একা একা পথঘাটে ঘুরাফেরা করেন। এইতো, যেখানে এডভোকেটের চেনার কথা নয়। সেখানে এডভোকেটের ছেলে পর্যন্ত আপনাকে এই বেশেও দেখে চিনে নিয়েছে। মানুষ কতটা সচেতন, ভাবুন এবার! আপনার মতো একজন লোককে পথে একা পেলে কিন্তু ছেড়ে দিবে না অপকর্মে লিপ্ত পশুরা। একটু ভেবে দেখুন স্যার।”
“জ্বি, দেখবো।”
“জ্বি, আসি স্যার। তবে ভালো লাগলো আপনার সাথে ঘুরাফেরা করে।”
“ধন্যবাদ।”
মারফত সাহেবের কথাগুলো একটাও ফেলার মতো নয়। সবগুলোই ঠিক। বিষয়টা আবরারের নজরেও স্পষ্ট। ভাবতে ভাবতেই রুমে এলো সে।
রুমে এসে এন্ড্রয়েড ফোনটা নিয়ে দেখলো বড় শ্যালিকা রিমির নম্বর থেকেও কল এসেছে, ছোট শ্যালিকা উর্মির নম্বর থেকেও কল এসেছে কয়েকটা! হঠাৎ এতো কল! কিছু হলো নাকি আবার! সাথে সাথেই রিমির নম্বরে কলব্যাক করলো আবরার। প্রথমবারেই রিসিভ হলো। আবরার সালাম দিলো কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। আবরার হ্যালো হ্যালো বলতে থাকলে কয়েক সেকেন্ড পর শ্বাশুড়ির কন্ঠ ভেসে উঠলো। বুঝতে পারলো কেউ এইটুকু সময়ে ফোনটা নিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছে কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছুক ছিলো না। কে আর হবে? হয়তো মিমি ই! নাকি রিমি? সে-ও তো কল করে ভাইয়ার সাথে কথা বলে না একবার। এইযে, মারওয়া কথা বলার সময় পাশে তারা কেউই থাকে না! শুধু শ্বাশুড়িকে দেখা যায় মাঝে মাঝে!
আবরার আবার সালাম দিলো। শ্বাশুড়ি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
“কেমন আছো, বাবা?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন, মা?”
“আছি, আলহামদুলিল্লাহ। সকাল থেকে ফোন দিলাম কতবার, পাওয়াই যাচ্ছে না তোমাকে!”
“একটু বাইরে গিয়েছিলাম ফোন রেখে। কোনো প্রয়োজন মা? কিছু হয়েছে কি?”
“না। প্রয়োজন আর কি। রিমির বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করতে মানুষ আসবে আজ। তোমাকে ছাড়া তো কোনো কাজই করতে চাই না। বড় ছেলে তুমি। তোমার শ্বশুরের অনুপস্থিতিতে তুমি গার্ডিয়ান এই পরিবারের। অথচ কোনো কাজেই পাই না সেভাবে।”
“মা, আসলে কাজের জন্য আমি…”
“হ্যাঁ, বাবা। বুঝি। কাজ খুব আছে তোমার। পরের অধিনে কাজ করো, ব্যস্ততা তোমার বেশি। কিন্তু আমরাও যে কোনো কাজে আনন্দ পাই না তোমাকে ছাড়া! এই যে, বিয়েটা তো আরও আগেই হয়ে যায়। শুধু তোমার জন্য অপেক্ষায় বসে রইলাম। গতকাল তোমার বাবা ফোন দিয়ে বললো অতিথিদের এতো অপেক্ষা করানো ঠিক হচ্ছে না। আজকেই যেন তাদের আসতে বলি। বেয়াই সাহেব সব সামলে নিবেন। এখন তোমরাই তো গার্ডিয়ান। তোমরা যা ভালো মনে করো, সেটাই ভালো মনে চাই আমি। তুমি তো আসবে না, কাজ তো আর সব ফেলেও রাখা যায় না। তাছাড়া পরের ঘরের কাজ। আবার নিজের ঘরের মানুষ দূরে রেখেও আমি কাজে হাত দিতে পারি না। তাই সকাল থেকেই ফোন দিচ্ছি।”
“না, মা। ঠিক আছে। আমার অপেক্ষায় শুভকাজে দেরি করবেন না। সম্পন্ন করে ফেলুন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“তুমি তো বলে সাড়লে। কিন্তু মন কি মানে! সবাই তোমার উপর ক্ষেপে আছে, বাবা। এবার কেউই একবার বলেনি ফোন দিয়ে তোমাকে জানাতে। বুঝো এবার…!”
“কষ্ট নিবেন না, মা। তারিখ নির্ধারণ করতে আসছে, সে আর তেমন কি! আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে রিমির বিয়েতে আমি ঠিক হাজির হবো ইনশাআল্লাহ। যত কাজই থাকুক, আমি আসবো। তারিখ নির্ধারিত হলে আপনি আমাকে জানাবেন। আমি অপেক্ষায় থাকবো।”
“ঠিক আছে। নিজের খেয়াল রেখো।”
“জ্বি।”
নিশ্বাস ফেলে ফোন রাখলেন তিনি। এবার না গেলেই নয়। ব্যাপারটা খুবই জঘন্য হবে, তা জানে আবরার। মনে মনে একটা অপেক্ষায় রইলো সন্ধ্যা হওয়ার। রিমির বিয়ের তারিখটা জানবে। বাবা রাগ করেই তাকে জানাতে কল করেনি, কিন্তু কাজটা ঠিক করেছেন। মানুষকে কত অপেক্ষা করানো যায়? আবরারের আশায় বসে থাকুক, সেটা চায় না আবরার। এ-ই ভালো হবে। বাবা যে তাদের মুরব্বি হয়ে কাজটা সামলে নিচ্ছেন, সেটাই বড় ভালো লাগছে আবরারের কাছে। সন্ধ্যায় আবার শ্বাশুড়ির কাছে নিজ দায়িত্বে কল করে জানতে পারলো পরবর্তী সপ্তাহের শুক্রবার নির্ধারিত হয়েছে রিমির বিবাহের দিন। জেনে খুশি হলো আবরার। সব ঠিকঠাক হলেই হয়। তারপর মেয়ের সাথে কথা বললো কিছুক্ষণ, তার পরপরই কথা বললো নিজের মায়ের সাথে। এভাবেই কেটে গেলো সন্ধ্যা।
পরদিন হেডকোয়ার্টারে তার অফিস-রুমে থাকাকালে হঠাৎ অপরিচিত এক নম্বর থেকে এমএমএস এলো ফোনে। কোনো একটা ক্যাম্পাসের ভেতর মাঠের সবুজ ঘাসের উপর একদল লোক জুয়ার আসর বসিয়েছে! ছবিটার সাথে টেক্সট এলো, “আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও জুয়ার আসর বসে দেখছি! বসে বসে ঘুমান নাকি আপনারা? মারাত্মক সুন্দর পরিবেশ আপনাদের আশেপাশের এরিয়াতেই!”
লেখাটা পড়ে ভ্রু কুচকে গেলো আবরারের। একে তো ঘটনাটা কুশ্রী! তারউপর এমন একটা নিউজ তার ফোনে এলো কি করে! তার নম্বর তো জনসাধারণের জানার কথা না! তাছাড়া এটা তো তার প্রফেশনাল নম্বরেও আসেনি যে, বুঝে নিবে কোনোভাবে কারো হাতে পড়েছে কিংবা কর্মীদের মধ্যে কেউ তাকে প্রেরণ করেছে! এটা তো তার পার্সোনাল নম্বর। ফ্যামিলি মেম্বার কিংবা নিকটাত্মীয় ছাড়া কারো কাছে থাকার কথা না। কর্মজীবনে এই নম্বরটা ব্যবহার করে না সে। আর আশেপাশের এরিয়া বলতে কি বুঝালো এখানে? তাদের এলাকার কোনো পরিবেশ তো এমন মনে হচ্ছে না। নাকি এই হেডকোয়ার্টারের আশেপাশে বুঝানো হয়েছে! মাঠটা মাঝারি আকৃতির, ভবনটা বহুতল। জায়গাটা কোথায় হতে পারে, আর প্রেরণকারী মানুষটাই বা কে? আবরার সাথে সাথেই সেই নম্বরে ফোন করলো কিন্তু ফোন সুইচ অফ! খবর দিয়েই নিজেকে ঢেকে ফেললো অপরিচিত! আবরার মারফত সাহেবকে ডেকে ছবিটা দেখালেন,
“দেখুন তো, জায়গাটা চেনা যায় কি না?”
“এটা তো লেকের পাড়ের হাইস্কুলের মতো দেখাচ্ছে, স্যার।”
“নামটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছে, খেয়াল করে দেখুন।”
“নাম তো সঠিক মনে পড়ছে না স্যার। কিন্তু মনে হচ্ছে সেটাই।”
“আচ্ছা, একটু অনলাইন সার্চ করে দেখুন। যদি সেটাই হয়, দুতিনজন লোক পাঠান। ছবিটা এখনকার মনে হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কুরুচিপূর্ণ একটা অবস্থা, কতটা দায়িত্বহীন কর্তৃপক্ষ!”
“জ্বি, স্যার। এক্ষুনি পাঠাচ্ছি।”
ঘন্টাদুয়েক পরে মারফত সাহেব এসে জানালো দুজন কনস্টেবল পাঠানোর পর লোকগুলোকে হাতেনাতে ধরা যায়নি। গাড়ি দেখেই নাকি দৌড়ে পালিয়েছে, জানান স্কুলের দারোয়ান। তারা ভেতরে প্রবেশ করে কিভাবে, সেই তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে এলাকার রাস্তাঘাটের ক্ষমতাবান লোক এরা। স্কুলটাকে নিরাপদ মনে করে সেখানেই বসে যায়। কেউ বাঁধা দিতে গেলে হুমকি ধামকি দেয়। গত একমাস যাবত এমনটা চলছে। প্রধান শিক্ষক আইনের সাহায্য নিবে নিবে করেও নেওয়া হচ্ছে না এই হুমকি ধামকির কারনে! জেলখানা তো এসব লোকদের মামাবাড়ি। যায় আর আসে! সভাপতিরাও নজর দিচ্ছেন না তেমন! কিন্তু এবার কঠোর ব্যবস্থা নিবে র‍্যাব কর্তৃপক্ষ। জবাবদিহিতায় আসতে হবে স্কুলের চেয়ারম্যান ও সভাপতি বর্গকেও।
সন্ধ্যায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে দেহে রেইনকোট চাপিয়ে আবার পথে বের হলো আবরার। কোয়ার্টারের সামনে থেকে রিকশায় উঠে গিয়েছে সেলুন ঘরে। সেখানে কাজ সেড়েই আবার রিকশা নেয়নি। খানিকটা পথ হেটে এগিয়ে গেছে রাজা মামা চা ঘরে। এতো খ্যাতিমান চা ঘরে এক কাপ চায়ের স্বাদ নেওয়াই যায় এই বৃষ্টির দিনে। ভাবনা মোতাবেক বসে গেলো এক কাপ চা হাতে। একা একা উপভোগ করতে হচ্ছে চায়ের স্বাদ। নিজেকে হাতের ফোনে অনলাইনে ব্যস্ত করে নিয়েছে যেন কেউ অগ্রসর হতে না পারে তার দিকে। কারো সাথে আড্ডায় বসার মানসিকতা একদমই নেই তার। এমনিতেই তো ছদ্মরূপ ধারণ করে বসেছে। আড্ডায় পড়ে পরিচিত হওয়ার সুযোগ কাউকে দিতে চায় না সে। হঠাৎই আবারও এক এমএমএস এলো তার ফোনে! ঠিক সেই নম্বর থেকেই! এবারের ছবিটা এমন যে, রাস্তার ধারে দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে বসে একদল ছেলে মাতালপ্রায় হয়েই গান ধরেছে। গান তো ঠিক শুনতে পায়নি, কিন্তু একেকজনের হা করা মুখ দেখে অনুমান করা যায়। সাথে টেক্সট, “বুঝলাম না, দেশে আইন কেন রাখা হয়েছে! এই সন্ধ্যার রাস্তাঘাটের পরিবেশই এমন, মধ্যরাত না জানি কেমন! করেন টা কি আপনারা বসে বসে?”

চলবে।