রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
422

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৬
#Saiyara_Hossain_Kayanat

দূর থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের কথোপকথন। ঢেউয়ের মাতাল করা ধ্বনি আর নারিকেল গাছের ঝিরিঝিরি পাতার শব্দ। হু হু করে দমকা হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো নেড়েচেড়ে উঠছে। নিয়ন আলোয় বালির বড় বড় কণা গুলো চিকচিক করছে। আরশিসহ বাকি সবাই নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র থেকে কিছুটা দূরত্বের ব্যবধানেই সবাই একত্রিত হয়ে দাঁড়ালো। চুপচাপ কিছুক্ষণ সমুদ্রকে উপভোগ করার পর ধ্রুব সহজ গলায় বলল-

“আরু এর আগের বার যে এখানে এসে গানটা গেয়েছিলি মনে আছে!! সেই গান আজ আবারও শুনতে ইচ্ছে করছে তোর কন্ঠে। গাইবি প্লিজ!”

আরশি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ধ্রুবর দিকে। দূরের হলদেটে বাতি গুলোর আলো আছড়ে পড়েছে ধ্রুবর মুখটা। হলদেটে আলোয় ধ্রুবর ব্রাউন কালারের চোখ দুটো চিকিচিক করছে। বাতাসের ঝাপটা এসে শরীরে লাগতেই যেন চোয়ালের শক্ত ভাবটা আরও শক্ত হচ্ছে। চুল গুলো এলোমেলো উড়ছে। ঠোঁটে ঝুলে আছে খুবই সহজ সরল একটা হাসি। এই হাসিটা যেন কিছু চাইছে। আরশি আর না করলো না। বাকিদের দিকে আড় চোখে চেয়ে ক্ষীণ গলায় বলল-

“যদি কেউ হাসে!”

“হাসবে না কেউ আমি বলে দিচ্ছি।”

ধ্রুব সবাইকে চোখের ইশারায় শাসিয়ে দেয়। রৌদ্র দিকে এক ঝলক তাকালো। ধ্রুবর থেকে দুয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে ভীষণ অস্থির অস্থির ভাব। হয়তো আরশির গান শোনার জন্যই মনে মনে অপেক্ষা করছিল। একদম সেই আগের-ই মতো শাড়ি পরা এক কিশোরী মেয়ের কন্ঠস্বর শোনার তীব্র ইচ্ছে উঁকিঝুঁকি করছিল তার মনে। ধ্রুব হাল্কা হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আরশি বেশ কিছুক্ষন প্রস্তুতি নিয়ে নিজেকে সামলায় গান গাওয়ার জন্য। সে জানে যতই নিজেকে সামলিয়ে নিবে ততই তার গানের মাঝে হাসির পরিমান বেড়ে যাবে। এ কেমন তার অভ্যেস সেটা আজও তার বুঝে আসেনি।

দূর দ্বীপবাসিনী,
দূর দ্বীপবাসিনী, চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনিরও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো
সুমন্দ ভাষিনী দূর দ্বীপবাসিনী

প্রশান্ত সাগরে, তুফানে ও ঝড়ে
প্রশান্ত সাগরে তুফানে ও ঝড়ে
শুনেছি তোমারি অশান্ত রাগিনী
শুনেছি তোমারি অশান্ত রাগিনী।

আরশির হাসি শুরু হতেই এক এক করে সবাই তাল মিলিয়ে তার সাথে সুর তুলেছে। সমুদ্রের পানিতে পা ভিজে হাঁটতে হাঁটতে গান গাইছে সবাই একসাথে। আরশির ঠিক বাম পাশেই রৌদ্র হাঁটছে। তার চোখ দুটো মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ। আরশির গাওয়া গান দারুণ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তার ঘোর লাগা দৃষ্টি আরশির হাসি দেখতেই ভীষণ ব্যস্ত। আরশির অন্য পাশে কাসফিয়া আর সুপ্তি। তার পেছনে নীলা আর নির্বান হাত ধরে হাঁটছে। সামনেই আদ্রাফ আর নীল পানি নিয়ে এক আরেকজনকে ভেজানো চেষ্টা করছে। ধ্রুব আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদের দেখছিল। পরক্ষণেই মুচকি হেসে তাদের দিকে এগিয়ে এসে গানে সুর মেলায়।

দূর দ্বীপবাসিনী, চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনিরও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো
সুমন্দ ভাষিনী, দূর দ্বীপবাসিনী ..

গান গাওয়া শেষ হতেই সবাই এক সঙ্গে চেচিয়ে উঠল। সকলের দৃষ্টি সমুদ্রের দিকে। যেখানে আকাশ আর এই নীল সমুদ্রের পানি একত্রিত হয়েছে। সকল বিষাদ, দুঃখ, কষ্ট যেন কিছুটা মুহুর্তের জন্য বিদায় নিয়েছে সকলের জীবন থেকে। এই সমুদ্রের মাঝেই যেন সকল দুঃখ কষ্টকে বিসর্জন দিয়েছে। সবার মাঝে এখন শুধু প্রকৃতির স্নিগ্ধতা আর ভালোবাসার ছড়াছড়ি। বন্ধুদের ভালোবাসা কিংবা প্রেয়সীর প্রতি ভালোবাসা। আর রইলো কিছু নাম না জানা সম্পর্কের প্রখর ভালোবাসা। যে ভালোবাসা কোনো সঠিক নাম হয় না।

“আদ্রলিকা!”

ধ্রুবর মৃদু ডাকে আরশি পাশ ফিরে তাকালো। ভ্রু নাচিয়ে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে৷ ধ্রুব কড়া গলায় বলল-

“পানি থেকে উঠে শুকনো মাটিতে যা। শুধু আদ্রলিকা না বাকি সবাই এখন শুকনো জায়গায় যাও। আবহাওয়া ভালো না। পানিতে ভিজে কেউ জ্বর বাধালে তাকে এখানেই রেখে যাওয়া হবে। এটাই ফাইনাল।”

ধ্রুবর হুমকিতে সবাই একসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। উদাসীন ভঙ্গিতে একে সাথেই হেঁটে যেতে লাগলো সমুদ্রের নীল পানি থেকে দূরে। সবার পেছনে রৌদ্র আর ধ্রুব হাঁটছে। সামনের মানুষ গুলোর মধ্যে হৈচৈ আর উত্তেজনায় গরম একটা পরিবেশ হলেও। পেছনের এই দুইজন মানুষের মাঝে ঠিক ততটাই শীতল নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে। নিরবতা ভেঙে রৌদ্র শান্ত গলায় বলল-

“থ্যাংকস এসব কিছুর জন্য।”

“আদ্রলিকাকে যখন সবুজ রঙের শাড়িতে দেখেছিলাম তখনই বুঝেছি আপনি আগের সেই মুহুর্তেটাকে রিপিট করতে চাচ্ছেন।”

ধ্রুবর সহজ ভঙ্গিতে কথা গুলো বলেই হাঁটায় মনোযোগ দিল। রৌদ্র বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে৷ কন্ঠে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল-

“তুমি কি সবার মনের কথাই বুঝতে পারো! মানে সবার সব কিছু এতো সজজে ম্যানেজ কর কিভাবে!!”

ধ্রুব তার গেঁজ দাঁত বের হাসলো৷ বেশ শব্দ করেই হাসলো। পরক্ষনেই গম্ভীর হয়ে বলল-

“আমি ছোট থেকেই অভ্যস্ত সবার খেয়াল রাখতে। আর এই অভ্যাসটা তৈরি হয়েছে ছোট থেকে আদ্রলিকার খেয়াল রাখতে রাখতে।”

“কখনো নিজেকে নিয়ে ভেবেছো!! মানে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি!!”

ধ্রুবর হাসির পরিমান এবার আগের থেকেও দ্বিগুণ হলো। হো হো করে হাসছে। হাসতে হাসতে চোখে কোণে পানি জমে গেছে। রৌদ্র হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে কোনো জোক্স বলেছে। যার কারণে ধ্রুব মজা পেয়ে এভাবে হাসছে। ধ্রুব হাসতে হাসতে বলল-

“সিনিয়র বড় ভাই হয়ে এসব শেখাচ্ছেন আমাকে!!”

ধ্রুবর কথা শুনে এবার রৌদ্র নিজেও হেসে ফেলল। হঠাৎই হাসির মাঝে ধ্রুব সহজ ভঙ্গিতে বলল-

“সঠিক মানুষের দেখা পেলেই হয়তো তাকে ভালোবাসার ইচ্ছে হবে। আপাতত তেমন কাউকে দেখিনি। তাই ইচ্ছেও করেনি।”

———————————

রাত বাতির আলোয় আলোকিত খানিকটা জায়গা। নিস্তব্ধ পরিবেশে দূর থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দমকা শীতল হাওয়ায় উড়ছে আরশির উন্মুক্ত চুল। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রানীর মুগ্ধতায় ডুবে থাকা রৌদ্র। খানিকটা দূরের বেঞ্চি গুলোতে জায়গা দখল করে আছে বাকি সবাই। সকলের হাতেই ধোঁয়া ওঠানো রঙ চায়ের কাপ। আরশি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঠোঁট ভিজে নিয়ে বলল-

“কি ব্যাপার আজ আপনাকে এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকছেন সারাক্ষণ৷ কোনো কথা বলছেন না। কি হয়েছে আপনার!”

রৌদ্র ভাবলেশহীন ভাবে শান্ত গলায় বলল-

“রুদ্রাণী পাশে থাকলে কথা বলার কোনো প্রয়োজন হয় না। তখন যা করার অনুভূতিরাই করে। আজকের দিনটা কখনো এভাবে ফিরে পাবো আসা করিনি।”

“হুম সব কিছুই আগের মতো আছে শুধু পূর্নিমার চাঁদটা মিসিং।”

আরশি মিহি কন্ঠে বলল। রৌদ্র মনকাড়া একটা হাসি দিয়ে বলল-

“কে বলেছে চাঁদটা মিসিং! পূর্নিমার চাঁদটা আজ আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছে। আমার জীবনিটাকে জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত করে দিয়েছে। আমার পাশেই তো দাঁড়িয়ে আছে পূর্নিমার চাঁদ।”

আরশি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো রৌদ্রর দিকে। আচমকাই লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলে। রৌদ্র নামক লজ্জারা এসে হামলে পড়েছে আরশির মাঝে। রৌদ্র মুচকি হাসলো আরশির লজুকতায়। হঠাৎই বেঞ্চিতে বসে থাকা বন্ধু নামক প্রানীগুলো একসাথে “একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি” বলে চেচিয়ে উঠলো। আশেপাশের কিছু অচেনা উৎসুক দৃষ্টি তাদের দিকেই স্থির। এবার আরশি আর রৌদ্র দুজনেই একসঙ্গে লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে পরলো।

——————————

ড্রয়িংরুমের কাছে আসতেই শোনা গেল কিছু অপ্রত্যাশিত কথা। অনুচিত অনুরোধ, ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভুল কথা। কানের মধ্যে যেন জ্বলন্ত আগুনের গোলার মতো প্রবেশ করেছে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য। নিজের প্রতি রাগ, ঘৃণা অথবা! অথবা অন্য কোনো ভয়ংকর অনুভূতিতে পুরো শরীরে অস্বাভাবিকভাবে কম্পন সৃষ্টি হলো।

“আপা আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমার ছেলেটা আপনার মেয়েকে খুব ভালো রাখবে। আপনি খুব ভালো করেই চিনেন আদ্রকে। কাসফির বিয়ের সময় ছেলেটা একদমই ভেঙে পরেছিল। তখন সবার কথা চিন্তা করে কিছু বলার সাহস দেখায় নি।”

কাসফিয়ার মা অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। ইতস্তত করে বিনয়ের ভঙ্গিতে বললেন-

“কাসফিয়ার সম্পর্কে তো আপনি সবই জানেন। ডিভোর্স হয়েছে। সমাজ কি বলবে!”

“সমাজ কি বলবে, কি ভাব্বে সে-সব নিয়ে চিন্তা করলে আমরা কেউ-ই সামনে আগাতে পারবো না। আমরা এক পা এগিয়ে যেতে চাইলে সমাজ আমাদের দশ পা পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। আমাদের সন্তানেরা ভালো থাকলে সেখানে সমাজের চিন্তা করে কি লাভ আপা! আর রইলো ডিভোর্স ব্যাপার! কাসফির ডিভোর্স হয়েছে অনেক গুলো মাস পেরিয়ে গেছে। ডিভোর্সের তাকমা লেগে গেছে বলে যে মেয়েটা নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে না তা তো নয়। কাসফিরও অধিকার আছে ভালো থাকার। মেয়েটার বয়স এখনও অনেক কম। সামনে পুরো জীবন পরে আছে।”

আদ্রফের মা’র কথায় তিনি চুপ করে রইলেন। কি বলবেন তিনি! ওনার বলা প্রতিটা কথাই তো সত্যি। আর তিনি নিজেও মনে মনে চান তার মেয়েটা অন্যসব মেয়েদের মতো সুখি হোক। কিন্তু কাসফি কি মানবে!

“কিন্তু আপা কাসফি!! ও কি মেনে নিবে এসব!”

“তা নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না।”

“আন্টি আপনি এসব কি বলছেন!”

কাসফিয়ার গলার স্বর শুনে তারা ঘাড় বাকিয়ে ডান পাশে তাকালো। থমথমে চেহারায় কাসফিয়া দাঁড়িয়ে আছে। বিধস্ত লাগছে তাকে। আদ্রাফের মা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাসফিয়ার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-

“রেগে যাস না মা। এবার একটু নিজের কথা ভাব। আদ্রাফের কথা ভাব। ছেলেটা তোকে ভীষণ ভালোবাসে৷ আর কেউ না দেখলেও ওর কষ্টটা আমি দেখেছি। আমারও বয়স হয়েছে আর কত একা থাকব! তোর মতো একটা মেয়ে পাওয়ার সুযোগ দে। আপারও বয়স হয়েছে বাকি দিন গুলো না হয় আমরা একসাথেই কাটয়ে দিব। আমরা দুই বুড়িও সঙ্গ পাবো আর তোরাও নতুন জীবন পাবি। আমাদের কথা ভেবে হলেও নতুন ভাবে সব শুরু কর।”

কাসফিয়া স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক যেন কাজ করে বন্ধ করে দিয়েছে৷ গলার মধ্যে মনে হচ্ছে সকল না বলা কথা গুলো দলা পাকিয়ে আছে। কাসফিকে চুপ দেখে আদ্রাফের মা নরম গলায় বললেন-

“আচ্ছা এখন তোকে এসব নিয়ে কিছু বলতে হবে না। জার্নি করে এসেছিস যা এখন রেস্ট নে। আমিও যাচ্ছি। আদ্রও হয়তো এতক্ষণে বাসায় চলে গেছে।”

কাসফিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলো। রুমে এসে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো বিছানায়৷ কি হচ্ছে এসব!!

————————

ধ্রুব আর আরশি একসাথেই ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো। আরশিদের ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। আর আড্ডার মূল অতিথি হলো ধ্রুবর নানু। মানে ধ্রুবর আম্মুর খালা। বয়স প্রায় পয়ষট্টির কাছাকাছি হবে। তবুও যথেষ্ট স্ট্রং। ধ্রুব তার নানুর পাশে বসে আনন্দিত গলায় বলল-

“কেমন আছো নানু! কবে এসেছো!”

“হুম ভালো। তোরা নাকি ঘুরতে গিয়েছিলি?”

“হ্যাঁ গিয়েছিলাম তো। এখনই আসলাম।”

বৃদ্ধ মহিলা এবার ধ্রুর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরশির দিকে তাকালেন। হাতের ইশারায় তার অন্য পাশে বসার আদেশ করলেন। আরশিও ভদ্র মেয়ের মতো তার পাশে বসে পরে৷ তিনি আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সামনের সোফার দিকে তাকালেন। ধ্রুব আর আরশির বাবা-মা বসে আছে একসাথে। কিছুটা দূরে একটা টুলে বসে আছে শাকিল। সবার উদ্দেশ্যে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন-

“দুজনেই তো এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। এবার না-হয় ওদের বিয়ের কাজটা সেরে ফেলো।”

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“কার বিয়ের কথা বলছেন খালা?”

ধ্রুবর মা’য়ের প্রশ্নে তিনি খুব সহজ গলায় জবাব দিলেন-

“কার আবার! ধ্রুব আর আরুর বিয়ে।”

হঠাৎই দমকা হাওয়ায় ঝুম বৃষ্টি নামলো। বড় বড় বৃষ্টির ফোটা গুলো তিব্র শব্দ করে মাটিতে আছড়ে পরছে। নভেম্বরের শুরু, এইসময়ের বৃষ্টি সাধারণত আবহাওয়া আরও ঠান্ডা করার জন্য জন্যই হয়। অসময়ের এই বৃষ্টিতে যেন চারপাশ কনকনে ঠান্ডায় জমে যেতে চাচ্ছে। আরশির বুক ধুকধুক করে উঠেছে। শীতের মাঝেও কপাল হাল্কা ঘেমে ভিজে আসলো। বার বার শুকনো ঢোক গিলছে। অল্প টেনশনে আরশির এমন হওয়ার কথা না। অল্পতেই সে বিচলিত হয়ে উঠে না। কিন্তু আজ তার ভয় হচ্ছে। সামান্য একটা কথাতেই ভীষণ রকম বিচলিত হয়ে উঠেছে সে। বাতাসের ঝাপটায় খোলা জানালাটা বেশ শব্দ করে লেগে গেল। ধ্রুব তৎক্ষনাৎ তার নানুর পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো। মুখে গম্ভীরতা এনে বলল-

“এসব কি বলছো নানু। আমাদের বিয়ে মানে কি! আমাদের মধ্যে তো তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।”

ধ্রুবর নানু হাল্কা নেড়েচেড়ে বসলেন। গায়ের চাদরটা ভালো ভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। গলা খেকরিয়ে কন্ঠস্বর পরিষ্কার করে বললেন-

“সম্পর্ক নাই তো কি হইছে! বিয়ের পর হইব।”

আরশির মা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন-

“খালা আপনি ভুল ভাবছেন। ওদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।”

ধ্রুবর নানু বীনা বেগমের কুচকানো কপাল আরও কিছুটা কুচকে এল। মনে হচ্ছে তাদের কথায় ভীষণ বিরক্তবোধ করছেন। তার মতে ছেলে মেয়ে দুটো একজন আরেকজনের জন্যেই তৈরি। তিনি হয়তো মনে প্রানে ভেবেই নিয়েছিলেন বড় হলে তাদের বিয়ে হবে।

“কি বলতাছো তোমরা! সম্পর্ক না থাকলে নাই বিয়ে করতে কি সমস্যা! ওরা দুজনেই একসাথে বড় হইছে৷ একজন আরেকজনরে বুঝবো ভালা। এখানে তো এতো অস্বস্তির কিছু দেখতাছি না।”

“নানু আমি আরুকে ভালোবাসি, স্নেহ করি ঠিক আছে। কিন্তু সেটা তুমি যেভাবে ভাবছো সেভাবে না। ছোট মা, আম্মু, আংকেল, শাকিল ওরা যেভাবে আরুকে ভালোবাসে আমিও সেভাবেই ওকে ভালোবাসি। আমি কখনো আরুকে অন্য নজরে দেখিনি। আরু এখনো আমার কাছে একটা বাচ্চার মতই আদুরে। যাকে ভালোবেসে আদর করা যায়, শাসন করা যায় আর আগলে রাখা যায়। কিন্তু বিয়ে!! এই বিষয়টা সম্পূর্ণই ব্যাতিক্রম।”

ধ্রুবর থামার সাথে সাথেই আরশির মা সায় দিয়ে বললেন-

“হ্যাঁ খালা, আমরা সবাই জানি ধ্রুব আরুকে নিজের বাচ্চার মতোই আগলে রেখেছে। আমরা সবাই ধ্রুবকে আরুর অভিভাবক হিসেবে মেনে নিয়েছি। কিন্তু বিয়ের বিষয়টা একদমই আলাদা। এমনটা না যে তারা একজন আরেকজনের জন্য যোগ্য না। হ্যাঁ ধ্রুব খুব ভালো ছেলে। আমি ওকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের জানা মতে ওরা দুজন কখনই নিজেদেরকে ও-ই নজরে দেখিনি। আমরা সবাই চাই ওদের সম্পর্কটা এতদিন যেভাবে ছিল ভবিষ্যতেও যেন সে-রকমই থাকে।”

বীনা বেগম আর কোনো কথা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। হয়তো তাদের কথা বুঝতে পেরেছেন। ধ্রুব চোখের ইশারায় আরশিকে রুমে যেতে বলে। আরশি জোড়ালো শ্বাস ফেলে তার ফ্যাকাসে বর্নের মুখ নিয়ে নিঃশব্দে রুমে চলে যায়। এক এক করে সবাই যে যার কথায় আবারও ব্যস্ত হয়ে পরেন। ধ্রুব চুপচাপ শাকিলের রুমে চলে আসে। ধ্রুবর পেছন পেছন শাকিলও এসে উপস্থিত হলো। বিছানায় ধ্রুবর পাশে বসেই শাকিল চাপা হাসলো। ধ্রুব ক্লান্ত চোখে তাকালো শাকিলের দিকে। শাকিল এখনো ঠোঁট চেপে হাসছে। ধ্রুব তপ্ত শ্বাস ফেলে। শাকিলের ঘাড় ডান হাতের বাহুতে চেপে ধরে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল-

“শা’লা একদম মজা নিবি না।”

শাকিল এবার শব্দ করে হাসলো। হাসতে হাসতে বলল-

“আমাকে তো শা’লা মেনেই নিয়েছিস এবার না-হয় বাকি কাজটাও সেরে ফেল।”

শুরু হলো তাদের মধ্যে যুদ্ধ। সব সময়ের মতো এবারও কেউ জিততে পারলো না। দুজনেই ক্লান্ত হয়ে হাঁপ ছেড়ে দেয়। বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে দুজনেই শুয়ে রইলো। শাকিল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-

“সত্যিই কি তুই আরুকে ভালোবাসিস না ধ্রুব!”

“নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। তোকেও ততটা ভালোবাসি না।”

“কখনো প্রেমিক হিসেবে অনুভূতি কাজ করেনি?”

ধ্রুব হাসলো। হাসতে হাসতে বিছানার মাঝে পা গুটিয়ে বসে। নরম গলায় বলল-

“যাকে নিজ হাতে বড় করেছি তার প্রতি শুধুই মমতাবোধ কাজ করবে। প্রেমিক হতে চাইনি কখনো। আমাদের সম্পর্ক বাকি সম্পর্কের মতো সাধারণ না হয়ে একটু আলাদা হোক। সম্পর্কের নাম না থাকুক তাতে কি! আদ্রলিকা সব সময়ই আমার কাছে আদ্রলিকা হয়ে থাকবে। ছোট বাচ্চা হয়েই থাকবে।”

“যাক তাহলে সঠিক মানুষের কাছেই ওকে বিক্রি করেছিলাম।”

শাকিলের কথায় দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলো।

————————————

“কি হয়েছে তোদের! এক একজনের চেহারা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন? তিনজনেরই একসাথে মুডের বারোটা বেজে আছে, কি ব্যাপার কিছুই তো বুঝিতে পারছি না আমি!”

নীলার কথায় আরশি, সুপ্তি আর কাসফি কারও মধ্যেই কোনো ভাবান্তর হলো না। নীলা এবার খানিকটা রাগী কন্ঠে বলল-

“কথা বলার ইচ্ছে না থাকলে ভিডিও কল দিয়েছিস কেন তোরা! তোদের এই কুমড়ার মতো মুখ দেখার ইচ্ছে আমার নেই।”

“থাকবে কিভাবে এখন তো নতুন জামাই আছে।”

আরশি মিনমিন করে বলল। নীলা গম্ভীরমুখে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। আরশি কথা পাল্টানোর জন্য বলল-

“কিরে সুপ্তি কি হয়েছে তোর? গাল ফুলিয়ে রেখেছিস কেন?”

আরশির প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই সুপ্তি ঠোঁট বাঁকা করে দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল-

“তোর ভাই আমাকে আবারও বকা দিয়েছে। বাসায় পৌঁছে তাকে জানাই নি এইজন্য ইচ্ছে মতো আমাকে বকেছে। আর এখন উল্টো উনি নিজেই রাগ করে বসে আছে।”

আরশি তার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুঞ্চিত করে৷ মুখে ভয়ংকর বিরক্তি ভাব নিয়ে বলল-

“তোকে আমি আগেও বলেছি তোদের এই ন্যাকামির কথা আমার সামনে বলবি না। আমি তো সেই তিন-চার বছর আগেই তোরে পই পই করে না করেছি। রিকুয়েষ্ট করছি বইন আমার ভাইয়ের সাথে রিলেশনশিপে যাইছ না। নিজের বোনরে বিক্রি করে ওয় আইসক্রিম খেতে একবারও ভাবে নাই। আমার ভাইয়ের মতো অসভ্য, বাটপার এই দুনিয়াতে আর একটাও নাই। তবুও তুই শুনলি না আমার কথা। ভালোবাসা তো তোদের উত্তলাইয়া পরছিলো তখন। লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ করতেও নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলি। তাহলে এখন আবার আমার কাছে বিচার দেছ কেন? যা না তোদের প্রেম তোরা কর আমারে বলছ কেন?”

“শোন আশু তুই ওনাকে যতটা খারাপ বলিস উনি কিন্তু অতটাও খারাপ না।”

সুপ্তি বেশ নরম গলায় বলে। আরশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কাসফিয়া আর নীলার উদ্দেশ্যে বলল-

“দেখলি তোরা! এই মেয়ে গিরগিটির থেকেও দ্রুত রঙ বদলায়। একটু আগে নিজেই বিচার দিলো আমার ভাইয়ের নামে এখন ওনার নিজেরই গাঁ জ্বলে যাচ্ছে।”

“এই তোরা চুপ থাক। কাসফি তুই বল তোর কি হয়েছে!”

নীলার ধমকে আরশি আর সুপ্তি চুপ হয়ে যায়। কাসফিয়া ইতস্তত করে বলল-

“আদ্রাফের আম্মু এসেছিলেন। আদ্রাফের সাথে আমার বিয়ে নিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলে গেছেন।”

“একদম ঠিক করেছে। তোদের ভালোবাসা সত্যি বলেই হয়তো আবারও সুযোগ পেয়েছিস। এবার আর হাত ছাড়া করিস না।”

নীলার কথা শেষ হতেই আরশি বলল-

“তুই রাজি না থাকলে এবার আমরা সত্যি সত্যিই তোকে তুলে নিয়ে যাবো। আদ্রাফের সাথে বিয়েও দিবো আর সাক্ষী হিসেবে আমি নিজে দু’পায়ে খাড়া।”

কাসফিয়া হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। মলিন কন্ঠে বললো-

“আচ্ছা বাদ দে এখন বল তোর কি হয়েছে?”

আরশি উত্তেজিত হয়ে খানিকটা উঁচু গলায় বললো-

“জানিস ধ্রুবর নানু আজ আমাদের বিয়ের কথা বলেছে। ধ্রুব সাথে নাকি আমার বিয়ে!! ভাবা যায় এসব? বুড়ি দিন দিন জ্ঞানহীন হয়ে যাচ্ছে। আমাকে এখন নাতবউ বানানোর জন্য উঠে পরে লেগেছে।”

আরশির কথায় সকলেই একসাথে অবাক হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে সবাই। নীলা বিস্ময়ের গলায় জিজ্ঞেস করল-

“ধ্রুব ভাই কিছু বলেনি?”

“হুম ধ্রুবই তো সামলিয়েছে সব।”

————————————

রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলের পাশাপাশি দুটো চেয়ার দখল করে বসে আছে আরশি আর ধ্রুব। ধ্রুব ভীষণ মনোযোগ দিয়ে খাবারের মেনু দেখছে। তার মনোযোগ দেখে যে কেউ ভাববে হয়তো খুব জরুরি কিছু পড়ছে। আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাতে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আরশি রাগে ফুসফুস করে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দুটো চেয়ারে বসে থাকা নির্বান আর রৌদ্রর দিকে। তাদের দুজনের ঠোঁটে-ই চাপা হাসি৷ হয়তো আরশির ভয়ে ঠিক মতো হাসার সাহস পাচ্ছে না। আরশি ঘাড় বাকিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুবর হাত থেকে মেনু কার্ড ছিনিয়ে নিয়ে সশব্দে টেবিলের মাঝে রাখে। চোয়ালে শক্ত করে রৌদ্রর উদ্দেশ্যে কঠিন গলায় বলল-

“নিলুর বিয়েতে নির্বান ভাইয়ার ফুপি বলে যার সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলেন উনি আপনার কি হোন!!”

“আমার একমাত্র মা আর তোমার একমাত্র হবু শ্বাশুড়ি।”

রৌদ্রর কথায় নির্বান খিক করে হাসতে গিয়েই আরশির তীক্ষ্ণ চাহনিতে হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসি আটকে ফেলে। ধ্রুব চুপচাপ তাদের কথা শুনছে। আরশি ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

“আপনার লজ্জা করেনি নিজের মা’কে আরেকজনের ফুপি বলে আমার সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে!!”

“লজ্জা কেন করবে!! আমার মা মানে নির্বানের ফুপি আর নির্বানের মা মানে আমার মামী। নির্বানের ফুপা মানে আমার বাবা আর নির্বানের বাবা মানে আমার মামা। আমার নানা মানে নির্বানের দাদা।নির্বান আমার মামাতো ভাই আর আমি নির্বানের ফুপাতো ভাই৷ আর নির্বানের বউ মানে আমার ভাবি+শা’লি। এটা তো খুবই সহজ হিসাব এখানে তো লজ্জার কিছু নেই।”

আরশি রেগেমেগে টেবিলে হাত দিয়ে জোরে আঘাত করে। আশেপাশের মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। আরশি জোর গলায় চেচিয়ে বলল-

“এগুলো সহজ হিসাব!! আমাকে পাগল করার ধান্দায় আছেন নাকি আপনি? পাগলের মতো কি সব হড়বড়িয়ে বলছেন!! কাল আপনার আম্মু মানে নির্বান ভাইয়ার ফুপি যখন আমাকে দেখতে এসেছিলেন জানেন কতটা বিব্রত হয়েছি আমি! তাকে ফুপি ফুপি ডেকে ভাব বিনিময় করছিলাম। পরে শুনি উনি আপনার মা। আর আমাদের বিয়ের জন্যেই এসেছেন।”

আরশির কথায় রৌদ্র কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। আরশিকে ভড়কে যেতে দেখে ধ্রুব খানিকটা নেড়েচেড়ে বসলো। নির্বানও এখন বিবর্ণ মুখ নিয়ে চুপসে বসে আছে। তারা বুঝতে পারছে আরশির রাগ এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রৌদ্র গম্ভীর কন্ঠে ডাকলো-

“ম্যানেজার এদিকে আসুন।”

রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আসলেন। মাথা নিচু করে বিনীত ভঙ্গিতে বললেন-

“জ্বি স্যার বলুন।”

“রেস্টুরেন্ট কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দিন। যারা বসে আছে তাদের বলুন কিছু জরুরী কাজে রেস্টুরেন্ট খালি করতে হবে।”

ম্যানেজার নিম্ন গলায় জ্বি স্যার বলেই চলে গেলেন। আরশি চুপচাপ হতভম্ব হয়ে বসে আছে। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই সে বুঝতে পারছে না। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রেস্টুরেন্ট খালি হয়ে গেল। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার কেন রৌদ্রর সব কথা মানছে!! আরশি প্রচন্ডরকম অবাক হয়ে বলল-

“কি হচ্ছে এসব?”

নির্বান আবারও ঠোঁট চেপে হাসলো। রৌদ্র চুপচাপ বসে আছে গম্ভীরমুখে।

চলবে….

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“কি হচ্ছে এসব?”

আরশির প্রশ্নে নির্বান দাঁত বের করে হাসলো৷ আরশির জ্বলন্ত দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষিপ্ত হতেই আবার হাসি আটকে ফেলে। রৌদ্র টেবিলের উপর দু-হাত তুলে খানিকটা সামনে ঝুঁকি আসে। আঙুলের ভাঁজে আঙুল মিলিয়ে রেখে নরম গলায় বলল-

“আব্বু আম্মু এখানে থাকে না সেটা তো জানোই। আমি ফ্ল্যাটে একা থাকি তাই নির্বানও আমার ছিল এতদিন। যদিও ওর বিয়ের পর এখন আমি একাই থাকি। যাইহোক এবার আসি নির্বান আর আমার কথায়। ভার্সিটির সবাই আমাদেরকে বেস্টফ্রেন্ড হিসেবেই জানে। তুমি বা অন্যকেউ কখনো তেমন করে জানতে চাওনি তাই আমিও কিছু বলিনি। আর তোমার তো একটু হলেও বোঝা উচিত ছিল আরু।”

রৌদ্র ভ্রু নাচিয়ে তাকিয়ে রইলো আরশির দিকে৷ আরশি মিহি কন্ঠে বলল-

“আমি ভেবেছিলাম আমার আর ধ্রুবর মতোই আপনাদের সম্পর্ক। বেস্ট ফ্রেন্ড তাই হয়তো ওনার আম্মুর সাথে আপনি এতো ক্লোজ। কিন্তু আপনারা যে ভাই সেটা একদমই মাথায় আসেনি। আচ্ছা যাইহোক এটা না হয় বুঝলাম কিন্তু আপনার আম্মু কিভাবে জানলেন এসব? আর আমাদের বাসায়ই বা আসলেন কি করে?”

“নির্বান অনেক আগে থেকেই আম্মুকে তোমার কথা বলেছে। আম্মুর পার্সোনাল গোয়েন্দা বলে কথা। আমি কি করি না করি সবই তো মুহুর্তের মধ্যে আম্মুর কাছে খবর চলে যায়। আর বাকি সব যা করার ধ্রুবই ম্যানেজ করেছে।”

আরশি ঘাড় বাকিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব হকচকিয়ে উঠে অপ্রস্তুত ভাবে হাসে। কিছুটা থেমে থেমে মিনমিনে বলল-

“আসলে যে দিন নানু আমাদের বিয়ের কথা বলেছিল তার পরেরদিনই আমি ছোট মা’কে সব বলে দেই তোদের সম্পর্কের কথা। আর ছোট মা’র বিশ্বাস ছিল আমি কখনো তোর জন্য খারাপ কোনো কিছু বেছে নিবো না। তাই তেমন কোনো প্রব্লেম হয়নি ছোট মাকে মানানোর জন্য। আর রৌদ্র ভাই তোকে বলতে নিষেধ করেছে তাই আমি তোকে এসব বলিনি৷ এছাড়া আমি আর কিছু করিনি আদ্রলিকা প্রমিজ।”

আরশি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে আবারও রৌদ্রর দিকে তাকালো৷ ক্লান্ত গলায় বলল-

“আর রেস্টুরেন্ট!”

“এটা তো আমার আর নির্বানের-ই রেস্টুরেন্ট। আব্বু আর মামা মিলেই আমাদেরকে সুযোগ দিয়েছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। গত তিন বছর পরিশ্রমের বিনিময়ে এই সামান্য সাফল্যটুকু হয়েছে। আর কিছু না।”

আরশি হাসলো। শব্দ করে কিছুক্ষণ হাসার পর মুহুর্তেই মুখে গাম্ভীর্যতার রূপ নিয়ে আসে। রৌদ্রর দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল-

“আর কিছু নেই আমাকে বলার মতো!! আমি কখনো আপনার কাছে কিছু জানতে চাইনি কারন আমি আপনাকে বিশ্বাস করতাম৷ কিন্তু আপনি যে এতটা-ই অসভ্য লোক তা আগে বুঝতে পারিনি। নিজের মা’কে নির্বান ভাইয়ার ফুপি বলে পরিচয় করিয়েছেন। নিজের রেস্টুরেন্টেই আমাকে নিয়ে আসেন প্রেম করার জন্য। আপনার আম্মু আমাকে বাসায় দেখতে এসেছে এটাও আমি জানি না। মানে আমাকে কি বোকা বানানোর আর কোনো কিছু বাকি রেখেছেন আপনি??”

রৌদ্র বরাবরের মতোই শান্ত গলায় বললো-

“বোকা বানিয়েছি বলে তো মনে হচ্ছে না। জাস্ট সব কিছু ডিটেইলসে বলিনি এইটুকুই তো।”

“সব কিছুই লুকিয়েছেন আমার কাছ থেকে। এই ধ্রুব ওঠ। বাসায় যাবো চল। আমি এই অসভ্য লোককে কিছুতেই বিয়ে করবো না। ওনাকে বিয়ে করলে সারাজীবন আমাকে বোকা বানিয়েই রাখবে।”

ধ্রুব চেয়ারে আগের মতোই বসে আছে। আরশি উঠে দাঁড়াতেই রৌদ্র মুচকি হেসে বলল-

“এখন আর এসব বলে লাভ নেই আরু। আম্মু বলেছে উনার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে নিজের পুত্রবধূ বানাতে চায়। আজ সকালেই হয়তো বিয়ে নিয়ে ফোনে আলোচনা করার কথা ছিলো। এতক্ষণে হয়তো সব কিছু ঠিকও হয়ে গেছে।”

আরশি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। ধুপ করে চেয়ারে বসে পরলো। কাঠকাঠ গলায় বলল-

“সব কিছুই তো আমার অগোচরে হচ্ছে। বিয়েটাও না হয় আমাকে না জানিয়েই করুন।”

“কি যে বলো ক্রাশ ভাবি!! বিয়ের জন্য তো তোমাকে মাস্ট লাগবেই। এইদিক দিয়ে কেছ খেয়ে গেল আমার বন্ধুটা। কারণ তোমার অগোচরে বা তোমাকে ছাড়া তো রৌদ্র বিয়েই করতে পারবে না।”

নির্বানের কথায় আরশি রাগ তরতর করে মাথায় উঠে গেল। রাগে গজগজ করে বলল-

“আপনাদের মতো অসভ্যদের দিয়ে সব কিছুই সম্ভব। তুই কি এখানেই থাকবি এখানে না-কি আমার সাথে যাবি?”

শেষের কথাটা আরশির ধ্রুবর উদ্দেশ্যে কটমট করে বলল। আরশির রাগে ধ্রুব আমতা আমতা করে বলল-

“হ্যাঁ হ্যাঁ যাবো তো। কিন্তু ওনাদের রাগ আমার উপর দেখাচ্ছিস কেন?”

“কারণ তুইও ওনার সাথেই তাল মিলিয়েছিস।”

ধ্রুব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আরশি চলে যাবে ঠিক তখনই রৌদ্র আরশির হাত ধরে ফেলে। আরশি রাগান্বিত চোখে তাকালো রৌদ্র দিকে। রৌদ্র সহজ ভঙ্গিতে হাসলো। আরশির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললো-

“রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী হবে তুমি? আমার অর্ধাঙ্গিনী নয় আমাকে পূর্ণ করে আমার সর্বাঙ্গিণী হবে আরু? সারাজীবন ভালোবাসবো তোমায় কথা দিচ্ছি।”

রৌদ্র পকেট থেকে একটা রিং বের করে আরশির সামনে ধরলো। আরশি কিছুক্ষন রৌদ্রর হাতের রিংটার দিকে তাকিয়ে রৌদ্র দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। রৌদ্র কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। আরশির পাশেই ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে।

“ক্রাশ ভাবি রাজি হয়ে যাও। তুমি রাজি হলেই রৌদ্র বাঘ থেকে বিড়াল হয়ে যাবে। এত বড় একটা চান্স মিস করো না ভাবি। আমিও তোমার পক্ষেই থাকবো কথা দিচ্ছি।”

নির্বানের রসিকতায় আরশি আনমনেই হেসে দেয়। সেই সাথেই ধ্রুব, রৌদ্র আর নির্বানও হাসলো।

————————————

নানান রঙের ঝাড় বাতির আলোয় আলোকিত পাশাপাশি দুই বাড়ি৷ দুই বাড়িতেই মানুষের হৈচৈ আর আনন্দমুখর পরিবেশ। তাজা ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারপাশ৷ এ যেন কোনো ফুলের রাজ্য। ধ্রুব, শাকিল, আদ্রাফ আর নীল বিয়ে সকল দায়িত্ব নিজেদের উপর নিয়ে নিয়েছে। যার কারণে বড়রা কোনো কাজই খুজে পাচ্ছে না করার মতো। তারা নিজেরাই সব কিছু সুন্দর মতো সামলিয়ে নিচ্ছে। কাসফি, নীলা আর সুপ্তি আরশিকে সাজাতে ব্যস্ত। আদিব হাসান(আরশির আব্বু) আর শাহরিয়ার সাহেব (ধ্রবর আব্বু) সোফায় বসে চারদিক চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন। আদিব হাসান ছোট করে শ্বাস ফেলে উদাসীন গলায় বললেন-

“নিজের মেয়ের বিয়েতেই নিজেকে কেমন মেহমান মনে হচ্ছে। এরা সবাই যে কবে এত দায়িত্বশীল হলো বুঝতেই পারলাম না। সব কিছু কত সুন্দর করে গুছিয়ে গুছিয়ে করছে। আর আমরা মেহমানের মতো বসে বসে দেখছি।”

শাহরিয়ার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন-

“আমার মা’র বিয়ে বলে কথা। সবাইকে তো দায়িত্ববান হতেই হবে।”

আদিব হাসান হাসলেন। পরক্ষনেই মলিন মুখ করে বললেন-

“মেয়েটা যে এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। বাড়িটা সারাক্ষণ আরুর জন্যেই আনন্দে মেতে থাকতো। আরু চলে গেলে আমাদের দিন কিভাবে কাটবে তা ভেবেই যেন আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।”

আদিব হাসান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। শাহরিয়ার সাহেব তার কাধে হাত রেখে আশ্বস্ত করছেন। তার নিজেরও খুব কষ্ট হচ্ছে। আরশিকে সে কখনো নিজের মেয়ে থেকে কম মনে করেনি। যাকে মা ডেকে সে নিজের মায়ের জায়গায়টা পূরণ করেছে সেই মেয়েটা চলে যাবে ভাবতে তারও বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে।
আরশির রুমের বাহিরে ধ্রুব আর বাকি সবাই চিল্লাচিল্লি করছে। নীল তার কন্ঠে ভয়ংকর বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“আর কতক্ষণ লাগবে তোদের সাজতে! রাত পাড় হয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান কখন শুরু করবো আমরা?”

সুপ্তি দরজা খুলে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল-

“উফফ! তোদের জন্য একটু শান্তিও নেই। এই দেখ আমাদের হলুদ পরি রেডি।”

আরশি দরজার কাছে আসলো। ধ্রুবসহ বাকি সবাই নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। কমলা পাড়ের হলুদ শাড়ি আর গায়ে জড়ানো নানান রকমের তাজা ফুল। হাত-পায়ে আলতা। মুখে তেমন কোনো মেকআপ নেই। তবুও যেন লজ্জায় লাল রাঙা হয়ে আছে আরশির মুখ। শাকিল গলা খেকরিয়ে বলল-

“হুহ্.. হলুদ পরি না। ফুলের মতো লাগছে। আজ প্রথম তোকে দেখে একটু মন ভরে প্রশংসা করতে ইচ্ছে করছে। যাইহোক তোর পেটে তো আবার আমার প্রশংসা হজম হবে না। তাই প্রশংসা করে লাভ নেই।”

আরশি সরু চোখে শাকিলের দিকে চেয়ে বলল-

“হজম হবে কিভাবে! কখনো পেত্নি বলা ছাড়া তো আর কোনো কথাই তোর মুখ দিয়ে বের হয়নি আমার জন্য।”

ধ্রুব আরশির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল-

“ছাদে চল সবাই। তাড়াতাড়ি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করা দরকার।”

ধ্রুবর কথা মতো সকলে ছাদে চলে আসলো৷ আরশিকে স্টেজে বসানোর পর ধ্রুব তার ছোট মা’র উদ্দেশ্যে বলল-

“ছোট মা তুমি আগে হলুদ লাগাও আদ্রলিকাকে।”

আরশির মা ধ্রুব কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

“আরুর সব দায়িত্ব তো ছোট থেকে তুই নিজেই পালন করেছিস। তাই আজ আরুকে হলুদ তুই-ই আগে ছোঁয়া। তারপর আমরা সবাই।”

“কিন্তু ছোট মা..”

ধ্রুব কথার মাঝেই আরশি নরম গলায় বললো-

“ধ্রুব তুই আগে আয় প্লিজ।”

ধ্রুব আর কোনো কথা বাড়ালো না। আরশির কাছে এসে গালে আর কপালে হলুদ লাগিয়ে দিলো। আরশি কপাল কুচকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল-

“ধ্রুব অল্প করে লাগা। প্রচুর শীত করছে।”

ধ্রুব হাল্কা হেসে আরশির নাকে টান দিয়ে বলল-

“কাল বিয়ে হবে আর আজকেও এমন বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস!! এত তাড়াতাড়ি বিড়ালের বিয়ে দিতে হবে কখনো ভাবিনি।”

ধ্রুবর কথায় উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো। আরশি গাল ফুলিয়ে বলল-

“আমি বিড়াল হলে তুই হলি শিয়াল।”

ধ্রুব শব্দ করব হাসতে লাগলো। একেক করে আস্তে আস্তে সবাই আরশিকে হলুদ লাগায়। রাত প্রায় দশটায় হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়। কুয়াশায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। কনকনে শীতে আরশির কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে রুমে আসতেই আরশির ফোন বেজে উঠলো। আরশি টেবিল থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রৌদ্র নাম্বার। এই সময় রৌদ্রর কল দেখে আরশি খানিকটা বিস্মিত হলো।

চলবে…