রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-৩৯

0
427

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat

সাদা রঙে পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আরশির দিকে৷ রৌদ্রর মুখে লাগানো হলুদ শুকিয়ে কালচে হলুদের রঙ ধারণ করেছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নির্বান। তার মুখেও হলুদে লেপ্টে আছে।

“আপনারা এই অবস্থায় এখানে এসেছেন কেন?”

আরশির প্রশ্নে রৌদ্র বেশ উৎকন্ঠিত হয়ে জবাব দিলো।

“শেষবারের মতো প্রেম করতে আসলাম। কাল থেকে তো আর এরকম সুযোগ পাবো না৷ আমিও আসবো না এই রাস্তায় আর তুমিও আসবে না এই বারান্দায়। আমি তুমি হীন এই রাস্তা আর বারান্দা থমকে যাবে। একা পরে যাবে সব কিছু।”

নির্বান রৌদ্র কানের কাছে মাথা এগিয়ে দিল। খানিকটা উচ্চস্বরে বলল-

“ক্রাশ ভাবি! আমিও শেষবারের মতো তোমাদের প্রেমের সাক্ষী হতে এসেছি। আর তারচেয়েও বড় কথায় হলো আমি আমার বউকে খুব মিস করছিলাম।”

আরশি ফোন কান থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে আসলো৷ কপাল কুচকে সরু গলায় বললো-

“আস্তে কথা বলুন ভাই।”

আরশির কথায় যেন তার পাগলামি আরও বেড়ে গেল। নির্বান কিছুটা দূরে গিয়ে জোরে চেচিয়ে বলল-

“কি বললা ক্রাশ ভাবি!”

আরশি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আর রৌদ্র ঘাড় বাকিয়ে নির্বানের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। নির্বান রৌদ্রকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল-

“কিরে ভাবি তোর মুখে ভালোবাসার কথা শুনিতে চাচ্ছে তুই বলছিস না কেন! বল বল তাড়াতাড়ি বল। এর পর আর প্রেমিকা হিসেবে ভালোবাসি বলার সুযোগ পাবি না।”

নির্বান এতটাই জোরে জোরে কথা বলছে যে আরশি বারান্দা থেকে স্পষ্ট সব শুনতে পাচ্ছে। নির্বানের কথায় আরশির চোখ দুটো এবার বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। তার থেকে বেশি অবাক হলো রৌদ্রর কাজে। রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে চেচিয়ে বলল-

“একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি।”

“রাতের বেলা আকশে পাখি নেই রৌদ্র ভাই। তবুও বলছি একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি।”

ছাদের উপর থেকে নীলসহ বাকি সবাই একসাথেই চেচিয়ে বলল। সবাই ঝংকার তুলে হাসছে। রৌদ্র আর নির্বানও হাসছে। বাইকে উঠে হাত নাড়িয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে মুহুর্তেই চলে গেল তারা দুজন। আরশি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে প্রশ্ন করলো- সব গুলো মানুষ এতো অসভ্য হলো কি করে!!

————————————

“কোথায় যাচ্ছিস?”

সুপ্তি খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে নিম্নস্বরে বলল-

“কোথায় আবার ঘুমাতে যাচ্ছি।”

শাকিল দু’হাত আড়াআড়ি ভাজ করে সুপ্তির দিকে এগিয়ে এসে বলল-

“আমি কাছে আসলেই তুই এমন করিস কেন? ফোনে তো খুব ভালো মতোই কথা বলিস।”

সুপ্তি অস্বস্তি নিয়ে আশেপাশে তাকালো। দেয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিনমিনিয়ে বলল-

“সামনে থেকে সরুন কেউ দেখে ফেলবে।”

শাকিল আরেক পা এগিয়ে আসলো তার দিকে৷ গম্ভীর গলায় বললো-

“বড়রা সবাই ধ্রুবদের বাসায় থাকবে। তাই তাদের দেখার চান্স নেই। আর নীল ওরা দেখলেও আমার কোনো প্রব্লেম নেই। ভালোবাসি তোকে। কোনো চুরি তো আর করিনি। এখন সোজাসুজি উত্তর দে। আমাকে সামনে দেখলে এমন কাঁপা-কাঁপি করিস কেন?”

শাকিলকে এতটা কাছে দেখে সুপ্তি এবার থরথর করে কাঁপতে লাগলো। মাথা নিচু করে শুকনো ঢোক গিলে। আমতা-আমতা করে বলল-

“আপনাকে সব সময় ফোনে দেখেছি। আর ফোনেই বেশি কথা হয়েছে। তাই সামনা-সামনি দেখা হলে ভয় লাগে।”

“কেন আমি খেয়ে ফেলবো তোকে?”

সুপ্তি চুপ করে আছে। তার দৃষ্টি এখনো তাদের দু’জনের পায়ের সামান্য দূরত্বটুকুর মাঝেই স্থির। শাকিল মুচকি হাসলো। দু হাতে সুপ্তির গাল আঁকড়ে ধরতেই সুপ্তির চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে শাকিলের দিকে। শাকিল নির্মল হেসে সুপ্তির কপালে হাল্কা করে ঠোঁট ছুয়ে দেয়৷ শাকিল সুপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে পকেটে হাত গুজে নরম গলায় বললো-

“তোকেও একেবারে আনার ব্যবস্থা করছি। কিছুদিন অপেক্ষা কর। তারপর দেখবো তোর এই ভয় কতদিন থাকে। আমি নিচে ঘুমাতে যাচ্ছি তুইও রুমে যা।”

সুপ্তি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম শাকিল তার এতটা কাছে এসেছে। এত গুলো বছর তাদের সম্পর্ক ফোনের মাঝেই নিবদ্ধ ছিল। কখনো ঘুরতে যাওয়া কিংবা আলাদা করে দেখা করাও হয়নি তাদের মাঝে। আর আজ হঠাৎ করেই কি হয়ে গেল এসব!

“কিরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?”

নীলার ধাক্কায় সুপ্তির হুশ ফিরলো। অপ্রস্তুত হয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল-

“হুম শুনছি। আমি রুমে যাচ্ছি তুই আয়।”

সুপ্তি এলোমেলোভাবে পা ফেলে তৎক্ষনাৎ স্থান ত্যাগ করলো। নীলা এখনও বিস্মিত হয়ে সুপ্তির যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। কোনো কিছু বুঝতে না পারে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

——————————

“এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস কাসফি।”

আদ্রাফের কন্ঠে কাসফিয়া ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকালো। রঙিন ঝার বাতির আলোয় আদ্রাফের মুখও রঙিন লাগছে। রেলিঙের উপর হেলান দিয়ে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। কাসফিয়ার কাছে কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল-

“এতো রাতে ছাদে কি করছিস?”

“তেমন কিছু না। এমনি দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

আদ্রাফ ভ্রু জোড়া কুচকে ক্ষীণ গলায় বলল-

“বাই এনি চান্স তুই এখানে থেকে লাফিয়ে পরার চিন্তা করছিস না তো? যদিও এখান থেকে পরলে হাত পা ভাঙ্গা ছাড়া এর বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না। তবে যাইহোক তোর প্ল্যান আপাতত স্থগিত করে রাখ। কাল আশুর বিয়েটা ঠিকঠাক হোক তারপর যা করার করিস।”

কাসফিয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আদ্রাফের দিকে। কত সুন্দর ঠান্ডা মাথায় ম’রার প্ল্যান বলে দিচ্ছে। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলছে। মানুষটা পালটে গেছে। আগের মতো পাগলামো তার মাঝে নেই। গম্ভীর হয়ে উঠেছে। ম্যাচুরিটি এসেছে তার স্বভাবে৷ আর এসেছে ভীষণ রাগী রাগী ভাব।

“কি আমি পালটে গেছি!! যদি তা-ই মনে হয় তাহলে সত্যিই মনে করেছিস। তোর জন্য নিজেকে পাল্টিয়েছি। গাঁ ছাড়া ভাব দূর করেছি। আম্মুর সাথে ব্যবসায়ের কাজ করা শুরু করেছি। নিজেকে ভালো রাখতে আর অন্যকে ভালো রাখার চেষ্টা করছি। অনেক কিছু শিখেছি। এত কিছুর পরও যদি তোর কাছ থেকে ‘না’ শুনতে হয় তাহলে আমি নিজেই তোকে ছাদ থেকে ফে’লে দিবো। দু’দিন পর আম্মু আবারও যাবে তোদের বাসায় বিয়ের ডেট ঠিক করতে। তখনও যদি আম্মুকে নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয় তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আরু আর নীল মিলে প্ল্যান করেই রেখেছে তোকে তুলে নিয়ে আসার।”

“তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস?”

আদ্রাফ মৃদু হেসে কাসফিয়ার দিকে এগিয়ে আসলো। খানিকটা ঝুঁকে শীতল কন্ঠে বললো-

“নাহ,, ভালোবাসা দিয়ে সারাজীবন আগলে রাখতে চাচ্ছি। জীবন আমাদেরকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছে এক হওয়ার। আমার ভালোবাসা পূর্ণ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তাহলে তুই কেন ডিভোর্সের মত তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে এত দ্বিধাবোধ করছিস! আমি ভালোবাসি তোকে। তোর সব কিছুকেই ভালোবাসি। তুই ডিভোর্সি কি-না এতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি তোকে চাই। সেটা যেমন অবস্থাতেই হোক না কেন। আমার চুপ থাকার কারণেই তুই দিনের পর দিন কষ্ট পেয়েছিস। এখানে তো তোর কোনো দোষ নেই।”

কাসফিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রাফ কাসফিয়ার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নেয়। আকুতি ভরা গলায় বলল-

“অনেক তো হয়েছে কাসফি৷ এবার একটু ভালো থাকার সুযোগ দে। তুই তো জানিস তোর আদ্র তোকে কতটা ভালোবাসে। কথা দিচ্ছি আগের মতো রিকশা নিয়ে পুরো শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়াবো৷ নদীর পাড়ে হাত ধরে হাঁটবো সারা বিকেল। নিয়ম করে বৃষ্টি ভেজা কদমফুল তোর হাতে এনে দেব। শুধু একবার তোর আদ্রকে সুযোগ দিয়ে দেখ।”

কিছু একটা হয়তো ছিল তার আদ্রর কন্ঠে। এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা মিশ্রিত অনুরোধ নিয়ে হাত পেতেছে তার কাছে। এই অনুরোধে বিনিময়ে কি কখনো ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে কারও পক্ষে!! হয়তো কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না এই নিষ্ঠুর কাজ। তার পক্ষেও সম্ভব হয়নি। কাসফিয়া ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। আদ্রাফ কাসফিয়ার হাসির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠেছে।

—————————

রাত দুটা বেজে পঁচিশ মিনিট প্রায়। নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারপাশ আবছায়া আলোয় অস্পষ্ট সব কিছু। শাকিল নিঃশব্দে ধীর পায়ে দোতালায় আরশির রুমে আসলো। আরশির রুমের দরজা খোলা দেখে কিছুটা অবাক হলেও তা আর বেশিক্ষণ রইলো না। সে বুঝতে পেরেছে এখন রুমে কেউ আছে। শাকিল রুমের ভেতর আসলো। আরশি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আরশির মাথার কাছেই চেয়ার নিয়ে বসে আছে এক পুরুষালী দেহের মানুষ। ড্রিম লাইটের আলোয় মানুষটার পেছন সাইড স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শাকিল এগিয়ে গেল মানুষটার দিকে। মানুষটার কাধে হাত রেখে গলার স্বর নামিয়ে বলল-

“আমি জানতাম তুইও এখানে আসবি।”

ধ্রুব পেছন ফিরে তাকালো। কিছু বলার আগেই রুমের ভেতর আরশির মা আর বাবা এসে উপস্থিত হলো। শাকিল বিস্ময়ের গলায় জিজ্ঞেস করল-

“তোমরা এখানে কেন? তোমরা তো ওইবাসায় ছিলে।”

শাকিল আর ধ্রুবকে এখানে দেখে আদিব হাসান খানিকটা ইতস্তত করে বললেন-

“তোর মা আরুকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল তাই নিয়ে আসলাম।”

আরশির মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। শক্ত গলায় বললেন-

“আপনিই তো ছটফট করছিলেন। আর এখন আমার একার দোষ দিচ্ছেন?”

ধ্রুব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তাদের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল-

“থাক আর ঝগড়া করতে হবে না তোমাদের। আমরা জানি তোমরা কেন এসেছো।”

তারা আর কথা বাড়ালেন না। নিঃশব্দে আরশির দিকে এগিয়ে গেলেন। আরশির বাবা মা আরশির ডান পাশে গিয়ে বসলেন। আরশির মাথা হাত রাখতেই আদিব হাসানের চোখ দুটো ভিজে এলো। অশ্রুসিক্ত চোখে আরশির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-

“ওকে ছাড়া আমরা থাকবো শাকিলের মা? মেয়েটা কেন এত তাড়াতাড়ি বড় হলো বল তো!”

আরশির মা’র গাল বেয়ে কয়েক ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। শাড়ির আঁচলে চোখে মুছে তার স্বামী কাধে হাত রেখে ধরা গলায় বললেন-

“এটাই তো মেয়েদের জীবন।”

ধ্রুব আর শাকিলও আরশির বাম পাশে যেয়ে বসলো। চুপচাপ বসে আছে সবাই। কেউ কোনো কথা বলছে না। কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে সবাই কিন্তু কেউ-ই সফল হচ্ছে না। আরশিহীন তাদের দিন গুলোর কষ্ট যেন এখনই তাদের চোখ বেয়ে বেয়ে পরছে অশ্রু হয়ে। আরশি খানিকটা নেড়েচেড়ে উঠলো। বা পাশে ফিরে ঘুম ঘুম চোখে ধ্রুব আর শাকিলকে দেখে জড়ানো কন্ঠে বললো-

“তোরা এখানে কি করছসি! একদম জ্বালাবি না আমাকে।”

ধ্রুব আর শাকিল চোখের পানি আড়াল করে মলিন হাসি দেয়। ধ্রুব নরম গলায় বললো-

“আচ্ছা জ্বালাবো তুই ঘুমা।”

ধ্রুবর কন্ঠে আরশি আবারও চোখ মেলে তাকায়। ঘুমের ঘোরে কি বলছে না বলছে কিছুই তার খেয়ালে নেই। অন্য পাশে তার বাবা-মাকে দেখে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো-

“আমাকে মিস করছিলে তোমরা?”

কেউ কোনো কথা বলল না। আরশিও তাদের উত্তরে অপেক্ষা করেনি। তার আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

চলবে…