রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0
355

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“মানে কি বলছেন আপনি? পাত্রী কেন দেখতে এসেছেন?”

আরশি মেসেজ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রৌদ্রর রিপ্লাই আসলো।

“কেন আবার! বিয়ের জন্য।”

রৌদ্রর মেসেজ দেখে আরশির রাগ জ্বলন্ত শিখার রূপ নেয়। আড়াল থেকে রৌদ্রর দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রৌদ্র খুব সুন্দর করে ভদ্র ছেলের মতো বসে আছে। ভদ্রমহিলাটা কি যেন বলছে রৌদ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে। আরশির মেজাজ আরও বিগড়ে হলো। রাগে গজগজ করতে করতে রুমে চলে আসে। দাঁতে দাঁত চেপে ফুসফুস করছে আরশি। কাসফিয়া আরশির রাগ দেখে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল-

“কিরে, রেগে আছিস কেন?”

“এমনি।”

কাসফিয়া দিকে না তাকিয়েই তিক্ত গলায় বলল আরশি। শব্দ করে পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে। নিস্তব্ধ রুমে আরশির পায়ের শব্দ যেন ধুপধাপ করে চার দেয়ালে বারি খাচ্ছে। নীলা, সুপ্তি আর কাসফিয়া ভীষণ বিস্ময় নিয়ে দেখে যাচ্ছে আরশিকে। হঠাৎ আরশির এমন পরিবর্তনের মানে বুঝতে পারছে না কেউ। সুপ্তি খানিকটা নেড়েচেড়ে মিনমিন করে বলল-

“আশু একটু থাম আমার মাথা ঘুরাচ্ছে তোকে এভাবে হাঁটতে দেখে।”

“আমি বলেছি তোকে, ড্যাবড্যাব করে আমাকে দেখতে!”

গম্ভীরমুখে কথাটা বলেই আরশি নীলার পাশে বসলো। নীলার হাত ধরে আতংকিত গলায় বলল-

“নিলু তুই জানিস পাত্র কে?”

নীলাসহ বাকি সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো আরশির দিকে।

“আমরা দুজন জানি। এই মাত্রই তো দেখে এলাম।”

আরশি ঝট দরজার দিকে তাকালো। নীল আর আদ্রাফ দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মুখ হাসি হাসি। তারা দুজন সামনে এগিয়ে আসতেই আরশি থমথমে গলায় বলল-

“পাত্র দেখেও তোদের মুখে হাসি!!”

নীল আরশির মাথায় হাল্কা থাপ্পড় দিয়ে বলল-

“বেকুব মাইয়া হাসি তো থাকবেই। ওনার মতো ভালো ছেলে পাওয়া খুব মুশকিল। আমি তো ভাবতেই পারিনি পাত্র আমাদের চেনা মানুষ হবে।”

নীলের কথায় আরশি বুক ধক করে উঠলো। কষ্টে কান্না আসতে না চাইলেও অতিরিক্ত রাগে তার দুচোখ দিয়ে অঝোরে কান্না আসতে চাচ্ছে। তার হারামি বন্ধুরা তার কষ্টে এভাবে হাসবে ভাবতেই রাগে তার গাঁ রি রি কিরছে।

“নির্বান ভাই আমাদের না জানিয়ে এমনি একটা কাজ করবে ভাবা যায়!!”

আদ্রাফের বলা আফসোস বানী শুনে নীলা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো-

“নির্বান ভাই মানে?”

আদ্রাফ হাসতে হাসতে বলল-

“নির্বান ভাই তোকে দেখতে এসেছে।”

“কিইই….!”

নীলা একপ্রকার চেচিয়ে উঠলো। কাসফিয়া আর সুপ্তিও অবাক। কিন্তু আরশি থম মে’রে বসে আছে। বেকুব হয়ে গেছে সে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। রৌদ্রকে ওখানে বসে থাকতে দেখে কতকিছু ভেবে ফেলেছে সে। অথচ নির্বানের কথা একবারও মাথায় আসেনি। মনে মনে নিজেকেই যাচ্ছেতাই গালি দিচ্ছে। নির্বান নীলাকে পছন্দ করে এটা আরশি কিছুটা হলেও টের পেয়েছিল এই কয়েকমাসে। আর এসব ভেবেই তার মন খারাপ ছিল। কিন্তু রৌদ্রকে এখানে দেখে মুহুর্তেই নির্বানের কথা ভুলে গেছে।
নীল বিছানার এক পাশে গাঁ এলিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“আসার সময় নির্বান ভাইকে দেখলাম গাড়ি পার্ক করছে। তখনই ওনার সাথে কথা হয়েছে। ওনার বাবা-মা না-কি অনেকদিন আগেই আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলেছে বিয়ে নিয়ে।”

আদ্রাফ নীলের পাশে বসে উদাসীন গলায় বলল-

“ভাইরে এই দুই বন্ধুর মনে কি চলে আল্লাহ-ই জানে। দু’জনের পেটের মধ্যে হয়তো জিলাপির থেকেও বেশি প্যাঁচ। রৌদ্র ভাইও আমাদের সামনে কতো ভালো সেজে হঠাৎ করেই ছক্কা মে’রে আশুকে নিয়ে গেল। আর এখন নির্বান ভাই তো ডিরেক্ট বিয়ার জন্য বাসায় এসে হাজির।”

“ডেঞ্জারাস অসভ্য এই দুই বন্ধু।”

আরশি ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করে বলে। আরশির কথায় সবাই শব্দ করে হেসে ওঠে। কিন্তু নীলা এখনো খানিকটা বিস্ময়ে। নির্বানের নাম শুনে সে খুশি হয়েছে না-কি অবাক হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছে না। আরশি কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল-

“আচ্ছা আংকেল আন্টি কিভাবে নির্বান ভাইয়ের জন্য রাজি হলেন। মানে উনি তো এখনো স্টুডেন্ট।”

“স্টুডেন্ট তো কি হয়েছে। রৌদ্র আর নির্বান ভাই তো পড়ালেখা পাশাপাশি ব্যবসাও করে। তারা চার বাপ ছেলে মিলে এক সাথে ব্যবসা করে। এটা তো আমরা অনেক আগে থেকেই জানি। তুই জানিস না?”

নীলের কথায় আরশি আরেক দফা চমকে উঠে। হঠাৎ করেই আরশি একটা অন্যায় বিষয় আবিষ্কার করলো। এতদিন পাড় হয়ে গেছে অথচ আরশি রৌদ্রর সম্পর্কে কিছুই জানে না। এ কথাটা ভেবেই ইচ্ছে করছে বারান্দা থেকে লাফিয়ে পরতে। এর থেকে লজ্জার আর কি আছে! তারা একে অপরের সাথে সম্পর্কে আছে, ভালোবাসা সম্পর্কে আবদ্ধ। আর সে কিনা মানুষটার সম্পর্কে কখনোই কোনো কিছুই জানতে চায়নি। এটা কি অন্যায় না!! আরশি বেকুবের মতো থ মে’রে বসে রইলো। এসব কথা তার হারামি বন্ধুগণদের সাথে শেয়ার করে লজ্জিত হতে চাচ্ছে না। তাই আপাতত চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করছে।

———————————

মেঘলা আকাশ। শীতল পরিবেশ। বৃষ্টি নেই তবুই আকাশ গর্জন করে উঠছে একটু পর পর। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নীলা আর নির্বান। তাদের ঠিক অপর পাশে আরশি আর রৌদ্র। নির্বান আর নীলার মধ্যে চলছে লজ্জাময় বিব্রতকর অনুভূতি৷ অন্যদিকে রৌদ্র আর আরশির মধ্যে চলছে চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একে অপরকে ঘায়েল করার প্রচেষ্টা৷

“আপনার না আমাকে ভয়াবহ ভয়ংকর মনে হয়! আপনি তো আমাকে ভয় পান। তাহলে বিয়ে করতে চাচ্ছেন কেন?”

নীলা নাক ফুলিয়ে কথাটা বলেই চোখ দুটো ছোট করে নির্বানের দিকে তাকালো। নির্বান হাসলো। শান্ত গলায় বলল-

“এখনো ভয়াবহ ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এখনো তোমাকে দেখে ভয় পাচ্ছি। তোমাকে ভয় পাই তাই তো তোমাকেই বিয়ে করতে চাচ্ছি।”

“এসব কেমন কথা? ভয় পেলে কেউ বিয়ে করে? আর শুধু শুধু আমাকে ভয় পাওয়ার কারণটা কি বলুন তো।”

নীলা বেশ কৌতূহল নিয়েই প্রশ্ন গুলো করে৷ নির্বান আবারও মৃদু হাসে। নীলার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলে-

“ভয় পাই তোমাকে ভালোবেসে ফেলার জন্য। তোমাকে দেখলেই খুব ভয়ংকর ভাবে ইচ্ছে করে ভালোবাসতে। ইচ্ছে করে খুব অচেনা শত শত এলোমেলো পথ তোমায় সাথে নিয়ে হাঁটতে৷ তোমায় নিয়ে নদীর পাড় বসে ডুবন্ত রক্তিম সূর্য দেখার লোভ জাগে তোমার দিকে তাকালে। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তোমার পাশে বসে তোমার বোকা বোকা কথা গুলো শুনে মনে মনে ভীষণ হাসি। আমার ভীতু মনটা খুব করে চায় তোমার হাত ধরে সারাজীবন পাড় করে দিতে। তোমাকে দেখলেই এতো এতো ভয়ংকর ইচ্ছেরা এসে হামলে পরে আমার বুকে। আমি অসহায় হয়ে পারি তখন। তাই এই ভয়ংকর ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে ভয়ংকর তুমিটাকেই বিয়ে করছি। এবার তুমিই বলো তোমার থেকে ভয়াবহ ভয়ংকর আর কিছু আছে কি-না!!”

নীলা হকচকিয়ে উঠে। নির্বান তাকে এমন সব কথা বলবে এসব যেন তার কল্পনার বাহিরে। গলা শুকিয়ে এসেছে নীলার। কথা বলার কিংবা নির্বানের দিকে তাকানোর মতো কোনো শক্তি বা সাহস কিছুই কাজ করছে না তার। ভীষণ লজ্জায় অন্য দিকে ঘুরে দাঁঁড়ায় নীলা। নির্বান মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

———————————

“আপনি একটা অসভ্য লোক।”

আরশির রাগান্বিত কন্ঠে রৌদ্র মুচকি হাসলো। পকেটে দু হাত গুজে দিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“ওহহ আচ্ছা!!”

রৌদ্র ভাবলেশহীন কথায় আরশি ভড়কে উঠে। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-

“আপনি আসলেই একটা খারাপ মানুষ।”

“হুম জানি তো।”

“মজা করছেন আমার সাথে!”

“সেই সাহস কি আমার আছে!”

আরশি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। এই মানুষটার সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না। আরশি রাগ এখন আর কাজ করছে না। হতাশ হয়ে ক্লান্ত গলায় বলল-

“আমাকে আগে বলেননি কেন এসব? আর পাত্রী দেখতে এসেছি, বিয়ের জন্য এসব কি ধরনের কথা! সোজাসুজি বলে দিলেই হতো নির্বান ভাইয়ের জন্য নিলুকে দেখতে এসেছেন।”

রৌদ্র রেলিঙের হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। পকেট থেকে দু’হাত বের করে আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে নেয়। গম্ভীর কন্ঠে বলল-

“আগে বলিনি তার দুটো কারণ। প্রথমত, আমরা তোমাদেরকে একটু সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। আর দ্বিতীয় কারণ হলো গতকাল তোমার মন খারাপ ছিল কিন্তু আমার কাছে লুকিয়েছো তাই আমিও তোমাকে একটু শায়েস্তা করছিলাম।”

আরশি গোমড়া মুখে বলল-

“খুব ভালো করেছেন।”

“আজকের পর থেকে হয়তো বেশ কিছুদিন আমাদের ভালো করে দেখা হবে না।”

রৌদ্রর কথায় আরশি চমকে তাকায় তার দিকে। বিস্মিত হয়ে বলে-

“কেন?”

“আমাদের ফাইনাল এক্সাম কিছুদিনের মধ্যে৷ তাই তোমাকে তেমন সময় দিতে পারবো না।”

আরশি ফিক করেই হেসে দিলো। হাসতে হাসতে মজা করে বলল-

“সারাবছর তো দুই বন্ধু ভাব নিয়ে ঘুরেছেন এবার না হয় সারাক্ষণ বইয়ের মাঝে মুখ গুজে বসে থাকবেন।”

আরশি হাসছে। আর রৌদ্র পলকহীনভাবে তাকিয়ে দেখিছে আরশির হাসি। আচমকাই খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরশিকে। মলিন কন্ঠে বলল-

“তোমাকে মিস করবো আরু।”

আরশি কিছু বললো না। আলতোভাবে রৌদ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো৷

“হায় হায় দোস্ত বিয়ে টা কার ঠিক হইছে? একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি। এখানে তো লাখ লাখ পাখির ছড়াছড়ি। বিয়ে ঠিক হয় এক বন্ধুর আর খুশিতে রোমান্স করে অন্য বন্ধু। ভাবা যায় এগুলা!”

আদ্রাফের কন্ঠস্বর শুনে আরশি এক ধাক্কায় রৌদ্রকে নিজের দিকে দূরে সরিয়ে দেয়। লজ্জায় মাথা নিচু করে হাতের উপর অত্যাচার শুরু কিরে দিয়েছে।। ছাদের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে কাসফিয়া, সুপ্তি, আদ্রাফ আর নীল। সবাই হাসছে। বাড়ি কাঁপিয়ে তোলার মতো হাসি হাসছে। নির্বানও তাদের সাথে তাল মিলিয়েছে। অন্যদিকে রৌদ্র ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। বিরক্তির সুর টেনে বলল-

“শেষ বারের মতো একটূ জড়িয়ে ধরলাম এতেও শা’লাদের বা পা ডুকাতে হবে।”

“শেষ বারের মতো মানে কি রৌদ্র ভাই?”

কাসফিয়া বেশ কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে রৌদ্রকে। নির্বান হাসতে হাসতে বলল-

“কারণ কিছুদিন পর থেকে আমাদের বাঁঁশ খাওয়া মানে ফাইনাল এক্সাম শুরু। তাই পরিক্ষা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা দুজন একসাথে বনবাস যাবো। না খেয়ে দেয়ে সারাক্ষণ বইয়ের পড়া গিলবো।”

নির্বানের কথায় সবাই একসাথে হাসা শুরু করলো। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে তাদের।

————————————

কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। ওইদিনের পর রৌদ্রর সাথে আরশির দেখা হয়েছে মাত্র দু’দিন। ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়েছে। আবার কখনো কখনো লাইব্রেরির বইয়ের মাঝে নীল রঙের চিরকুট পেয়েছে আরশি। এই কয়দিনে আরশি যেন রৌদ্রর প্রতি পুরোপুরি ভাবে দূর্বল হয়ে পরেছে। প্রতিটি মুহুর্ত রৌদ্রকে অনুভব করেছে। রৌদ্রকে মিস করেছে। রৌদ্রর প্রতি তার ভালোবাসা যেন আরও তিব্র হয়েছে। কিন্তু আজ কেন যেন আরশির মন বড্ড বেশিই খারাপ। খুব বেশিই মনে পরছে রৌদ্রকে। দেখতে চাচ্ছে রৌদ্রকে। সারাদিন ফোন দিয়েছে কিন্তু প্রতিবারই রৌদ্রর ফোন বন্ধ পেয়েছে। মনমরা হয়েই আজ সারাদিন কাটিয়েছে আরশি। রাত প্রায় দশটা। রুমে টানানো রৌদ্রর পেন্টিংটার দিকে অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে আরশি। রৌদ্রর কথা ভেবেই বুক চিড়ে বেরিয়ে আসলো এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস। হঠাৎই ফোনের শব্দ তার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটায়। মলিন মুখেই ফোন হাতে নিলো।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

ভালোবাসার মানুষের সাথে গড়ে ওঠা দূরত্বটা কি সবাই মেনে নিতে পারে? হয়তো চোখ বন্ধ করে মানুষটাকে অনুভব করা যাবে। মানুষটার সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো ভেবে ক্ষনিকের সুখ পাওয়া যাবে। কিন্তু চাইলেই তাকে ছোঁয়া যাবে না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখের তৃষ্ণা মেটানো যাবে না। এটা কি মেনে নেওয়ার মতো!! ভালোবাসার মানুষটাকে দেখতে চাওয়ার অসুখ হয়েছে তার। হঠাৎই খুব জটিল একটা ধাঁধার উত্তর খুঁজে পেল আরশি। যে ধাঁধাটা এতো দিন তার কাছে খুব জটিল মনে হয়েছে, ধাঁধাটা নিয়ে ভাবলেই মাথায় জটলা পাকিয়ে ফেলতো সেই ধাঁধাটা এখন খুবই স্পষ্ট।
আরশির ফোন বেজে উঠেছে। ক্লান্তিমাখা চোখ দুটো পেন্টিং-এর উপর থেকে সরিয়ে ফোনের দিকে স্থির করে। ফোন অনবরত বেজেই চলছে। আরশি নির্বিকার ভঙ্গিতে ফোন হাতে তুলে নেয়। অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। নাম্বার দেখেই বুক চিড়ে হতাশ নিঃশ্বাস বরিয়ে আসলো। হয়তো রৌদ্রর ফোন আসবে বলেই আশা করেছিল। কিন্তু সব আশা হয়তো পূরণ হয়না। আরশি অলস ভঙ্গিতে কল রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো। অপরপ্রান্ত থেকে কোনো শব্দ আসছে না। সে নিজেও কোনো কথা বলছে না। খানিকটা সময় পর ভেসে আসলো একটা মধুর কন্ঠ-

চোরাবালি মন তোমার
কেন শুধু লুকিয়ে থাকো!
একটু আড়াল হয়ে আমায় দেখো।

চোরাবালি মন তোমার
কেন শুধু লুকিয়ে থাকো!
একটু আড়াল হয়ে আমায় দেখো।

যদি কোনও চিত্র আঁকি
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী
সেই চিত্রতে তুমি perfectly বসো

কেন লাগে শূন্য শূন্য বলো
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো?

কেন লাগে শূন্য শূন্য বলো
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো?

আরশি প্রচন্ড রকম উত্তেজিত হয়ে বারান্দায় ছুটে গেল। রেলিঙের উপর হাত রেখে অস্থির চোখে রাস্তার দিকে তাকালো। হ্যাঁ রৌদ্র দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আরুর একটা পেন্টিং। কিছুটা দূরেই নির্বান বাইকের উপর বসে আছে। দুজনেরই কান্তিতে বিধস্ত অবস্থা। আরশিকে দেখেই রৌদ্র মুচকি হাসলো। সেই সাথে দূর থেকে নির্বানও হাসে হাত উচু করে নাড়লো।

তুমিও কি কাজের ফাঁকে
মনে করো আমার নাম
আমার মতো করে তোমায়
চাবে না কেউ বলে দিলাম।

তবু মনের কিছু আশা
এমন করে ভালোবাসা।
তোমার স্মৃতি আমার কাছে
খুব আদুরে ভালো আছে।
তবু মনে কিছু আশা
এমন করে ভালোবাসা।

কেন লাগে শূন্য শূন্য বলো
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো?

কেন লাগে শূন্য শূন্য বলো
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো?

আরশির চোখ পানিতে ছলছল করে উঠেছে। মানুষের চোখ বড়ই অদ্ভুত৷ ভীষণ কষ্টের মাঝেও চোখ বেয়ে পানি পরে আবার খুব আনন্দের সময়ও চোখ ছলছল করে ওঠে। হয়তো এই মুহুর্তে আরশির চোখ আনন্দে ভরে উঠেছে। রৌদ্রকে দেখতে পাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। আরশির চোখে অশ্রুজল চিকচিক করছে তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে।

“রুদ্রাণী হয়তো আমাকে খুবই মিস করছিল৷ যাক তাহলে সঠিক সময়েই এসেছি।”

রৌদ্রর থামে যাওয়ার সাথে সাথেই আরশি উত্তেজিত হয়ে বলল-

“সারাদিন কতবার ফোন করেছি আপনাকে। ফোন অফ ছিল কেন আপনার?”

আরশিকে অস্থির হতে দেখে রৌদ্র হাসলো। আরশির দিকে অপলক তাকিয়ে থেকেই নিম্নস্বরে বলল-

“ফোন চুরি হয়েছে তাই নতুন ফোন আর সিম কিনতে হয়েছে। কিন্তু তুমি তো দেখছি আমাকে মিস করতে করতে অসুস্থ হয়ে পরেছো আরু।”

আরশি কিছু বলল না। একটু পরেই ধ্রুব তার বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো রৌদ্রর কাছে। সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“আপনাদের জন্য কবে যেন আমার বাঁশ খেতে হয়।”

রৌদ্র হেসে রসিকতা করে বলল-

“তোমার আদ্রলিকা জন্য একটু আধটু বাঁশ খাওয়া হয়তো তোমার কাছে কোনো ব্যাপারই না। আর তুমি যদি চাও আমি নিজেই আরুকে পেন্টিংটা দিয়ে আসতে পারবো বাসায় যেয়ে।”

রৌদ্র আরশির বাসায় আসার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলেই ধ্রুব রৌদ্রর পথ আটকে দাঁড়ায়। রৌদ্র কাঁধে দু হাত রেখে বিরক্তির সুরে বলল-

“আরে আরে ভাইইইই কি করছেন কি? আপনি তো দেখি উঠে পরে লেগেছেন আমাকে বাঁশ খাওয়াতে। দিন দিন আরুকে কি কি দিতে হবে সব দিন। আমি একটু পরেই দিয়ে দিবো।”

রৌদ্র শব্দ করে হেসে উঠে৷ ধ্রুব হাতে পেন্টিংটা তুলে দিতেই ধ্রুব নিজের বাসায় চলে যায়। রৌদ্র ফোন কানে কাছের ধরে বলল-

“আরু আজ আসি। খুব ক্লান্ত লাগছে।”

“দু মিনিট দাঁড়ান আমি আসছি।”

আরশি রুমে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে আসে। একটা চিরকুট মুড়িয়ে গোলাকার করে রৌদ্রর দিকে ছুড়ে মা’রে। রৌদ্র ভ্রু কুচকে চিরকুটটা মাটি থেকে নিয়ে ভাজ খুলে পড়তে লাগলো-

রোদ,

অনেক দিক আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন- রোগমুক্ত করার ওষুধ-ই যখন রোগের কারণ হয়ে যায় তখন কি উচিত!! এর উত্তর হলো রোগটাকে ভালোবাসা উচিত।

আপনি নামক অসুখে আক্রান্ত হয়েছি আমি রোদ। আপনাকে দেখতে চাওয়ার অসুখ, ভালোবাসাতে চাওয়ার অসুখ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আর এই রোগের ওষুধটাও আপনি রোদ। আর আপনি নামক অসুখটা সারানোর জন্য আপনাকে খুব করে ভালোবাসাই যথেষ্ট। ভালোবাসি রোদ।

ইতি,
আপনার রোগে আক্রান্ত এক অসহায় রমনী।

রৌদ্র বরাবরের মতোই হাসলো। আরশির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে থেকে নির্বানের কাছে চলে যায়। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই নির্বান বাইক নিয়ে চলে গেল। আরশি এখনো তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। ঠোঁটের কোণে এখনো লেগেছে আছে তৃপ্তির হাসি।

——————————

কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা গুলো শুকিয়ে হলদেটে রঙ ধারণ করেছে। চারপাশে বয়ে যাওয়া শীতল বাতাশের ঝাপটায় গাছের ঝিরিঝিরি পাতা গুলো খুব সুন্দর করে ঝরে পরছে। সেই সাথে কাঁটা দিয়ে উঠেছে আরশির পুরো শরীর। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে শীতের আগমন বার্তা। সূর্যের তীর্যক রশ্মি শরীরে মিষ্টি উষ্ণতা অনুভব করায়। ভালো লাগছে এই রোদের মধ্যে বসে থাকতে। আরশি, কাসফিয়া আর সুপ্তি পাশাপাশি বসে আছে। কিছুটা দূরেই দেখা যাচ্ছে নীলা আর নির্বান খুব লাজুক ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে। নীলার দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির। ওড়নার এক পাশ হাতের মুঠোয় নিয়ে রাখা। আর নির্বানের দৃষ্টি অস্থির৷ কখনো নিচের দিকে, কখনো নীলার দিকে আবার কখনো বা সামনের দিকে। তাদের দু’জনের হাঁটার ভঙ্গি আর লাজুকতা দেখে যেন পায়ের নিচের মাটি আর এই পুরো ধরণীটা লজ্জায় নুয়ে পরতে চাচ্ছে। নীলা তাদের সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। খুব নম্রতার সাথে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল-

“কেমন আছিস তোরা?”

আরশি ভীষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে নীলা নামক রমনীটার দিকে। স্নিগ্ধতা যেন উপচে পরছে মেয়েটার মুখশ্রীতে। পূর্নিমার চাঁদের মতোই উজ্জ্বল আর মোহনীয় লাগছে নীলাকে। ‘বিয়ের পর মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়’ এই কথাটার প্রমাণ সরূপ এই মুহুর্তে নীলাকেই শ্রেয়তর মনে হচ্ছে। সবেমাত্র তিনদিন হয়েছে নীলার বিয়ের। এই অল্প সময়ে তেমন কোনো পরিবর্তন হওয়ার তো কথা নয়। তবুও কেন যেন নীলার মাঝে খুব পরিবর্তন লাগছে। আরশি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেও ভিন্ন কোনো পরিবর্তন বের করতে পারেনি। হয়তো নীলার চোখ দুটো ভালোবাসা আর খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছে। সঠিক মানুষকে জীবনসঙ্গী পাওয়ার আনন্দ যেন চোখমুখ দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।

“বাকিরা কোথায়?”

নির্বানের কথায় আরশির ধ্যান ভাঙলো। হাল্কা হেসে বলল-

“চা খেতে গেছে সবাই।”

“আচ্ছা ভাইয়া হঠাৎ করে সকাল সকাল কি বলার জন্য ডেকেছেন সবাইকে?”

কাসফিয়া খানিকটা কৌতূহল নিয়েই প্রশ্ন করলো। নির্বান চুপচাপ পাশের বেঞ্চিতে বসলো। সহজ গলায় বলল-

“বিয়ের তো তিনদিন পাড় হয়ে গেল। তাই ভাবলাম হানিমুনে যাবো তোমাদের সবাইকে নিয়ে।”

নির্বানের কথাটা শেষ হতে দেরি হলো কিন্তু সুপ্তির বোকা বোকা কথা বলতে মোটেও দেরি হলো না।

“আস্তাগফিরুল্লাহ। ছিঃছি ভাইয়া আমাদের নিয়ে হানিমুনে যাবেন কেন! নীলাকে নিয়ে যান।”

সুপ্তির কথায় নির্বান বেচারা বিব্রত হলো। মুহুর্তেই মুখের রঙ উড়ে গেছে। সুপ্তির কথার প্রতিত্তোরে কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। আরশি সুপ্তির দিকে চেয়ে চোয়ালে শক্ত খানিকটা কড়া গলায় বলল-

“আমাদের নিয়ে মানে তাদের হানিমুনে আমরা সবাইও ঘুরতে যাবো সেটা বুঝিয়েছেন।”

“অহহ এখন বুঝেছি।”

“দয়া করে কোনো কিছু না বুঝলে চুপ করে থাকিস কিন্তু উল্টাপাল্টা কথা বলে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করিস না সুপ্তি।”

আরশির কাঠকাঠ গলায় সুপ্তি মলিন মুখে মাথা নাড়ালো। আদ্রাফ, নীল, ধ্রুব আর রৌদ্র এসে হাজির হলো তাদের সামনে। রৌদ্র নির্বানের পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে রসিকতার ভঙ্গিতে বলল-

“যাক অবশেষে নতুন জামাইয়ের বাসর শেষ হলো এতদিনে।”

রৌদ্রর লাগামহীন কথায় নির্বান বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করে। নীলা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার অবস্থা। তাদের অবস্থা দেখে বাকি সবাই হাসছে। কিন্তু আরশি চোখ বড়বড় করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। রৌদ্রর এমন কথা বলতে পারে তা আরশির ধারণার মধ্যে ছিল না। আরশি তপ্ত শ্বাস ফেলে মনে মনে বলল- “উচ্চস্তরের অসভ্য লোক। তার অসভ্যতামি দিন দিন শুধু প্রোমোশন পাচ্ছে।”
নির্বান নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল-

“আমরা সবাই ঘুরতে যাচ্ছি আগামীকাল। ধ্রুব তুমি আরুর বাসায় ম্যানেজ করে নিও। আমি আর রৌদ্র নিজে বাকি সবার বাসায় পারমিশন নিয়ে নিবো।”

ধ্রুব মাথা ঝাকালো। কিছুটা কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করল-

“তা না হয় ম্যানেজ করবো। কিন্তু কোথায় যাওয়ার৷ প্ল্যান করেছেন?”

“সেটা সারপ্রাইজ। পরেই বুঝতে পারবে সবাই।”

নির্বানের কথায় রৌদ্র ক্ষীণ গলায় বলল-

“আমাকে অন্তত বল।”

“তোকে তো আরও আগে বলা যাবে না।”

রৌদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নির্বানের দিকে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। নির্বান রৌদ্রর চাহনিকে পাত্তা দেয় নি।

——————————

“ছোট মা নীলার বিয়ে উপলক্ষে আমরা সব ফ্রেন্ডরা ঘুরতে যাবো। নির্বান ভাই মানে নীলার হাসবেন্ড সব প্ল্যান করেছে। তোমার কোনো আপত্তি আছে?”

আরশি মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তরকারি নাড়তে নাড়তে বললেন-

“তুইও যাবি নাকি আরুরা একা?”

“আমিও যাবো।”

“তাহলে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু সাবধান থাকিস তোরা দুজন।”

আরশির মা’র কথা শুনে ধ্রুব ওনার কাধে হাত রেখে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল-

“চিন্তা করো না আমি ছোট থেকে যাভাবে আরুকে আগলে রেখেছি এখনো ঠিক সেভাবেই যত্নে রাখবো।”

ধ্রুবর কথা শুনে তিনি ধ্রুব মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

“সব সময় আরুকে ভালো রাখতে যেয়ে যে নিজের ভালো থাকাটা ভুলে যাস এটা কিন্তু সব সময় চলবে না ধ্রুব। আমি আরুকে যেমন ভালোবাসি তোকেও ভালোবাসি। কখনো আরু আর শাকিলের থেকে তোকে আলাদা মনে করিনি। কিন্তু আরুর থেকে বেশি আমার তোর জন্য চিন্তা হয়। আরুর খেয়াল তুই রাখিস কিন্তু তুই তো নিজের বেলাই খুব বেখেয়ালি। তুই তোর পুরো জীবনটাই পাড় করে দিচ্ছিস আরুর পেছনে। তোর বয়সী ছেলেরা এখন বন্ধুবান্ধব নিয়ে মজা করে, ঘুরে বেরায়, প্রেম করে আরও কত কি করে। আর তুই এখনই বুড়ো মানুষের মতো দায়িত্ববান হয়ে বসে আছিস।”

ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল-

“তোমার মাথায় এত চিন্তা!! এই জন্যই বলি কিছুদিন ধরে তোমার চুল পেকে যাচ্ছে কেন।”

“তুই জীবনেও মানুষ হবি না। যা সর আমার সামনে থেকে ফাজিল ছেলে।”

আরশির মা খুন্তি নিয়ে ধ্রুবকে তাড়া করতেই ধ্রুব হাসতে হাসতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৫
#Saiyara_Hossain_Kayanat

ভীষণ চেনা একজায়গা। খুব পরিচিত কিছু অনুভূতি। পুরাতন হয়েও যেন নব্য হয়ে রয় কিছু স্মৃতি। অতীত হয়েও যেন থেকে যায় বর্তমান আর ভবিষ্যতের হয়ে। রৌদ্র রুদ্রাণীর প্রথম দেখা এই দ্বীপে। রৌদ্র পেয়েছিল তার রুদ্রাণীকে। তার ভালোবাসাকে। তার প্রথম প্রেমিকা প্রথম অনুভূতিকে। দ্বীপে পা রাখার সাথে সাথেই যেন সব অনুভূতিরা একসাথে জেগে উঠেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আরশিকে প্রথম দেখার মুহুর্তটা। খুশিতে চোখ দুটো চিকচিক করেছে রৌদ্রর। চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলো।

“শা’লা আগে বললেই হতো সেন্টমার্টিন আসবি।”

রৌদ্র এক হাতে নির্বানের গলা জড়িয়ে ধরে। নির্বান অমায়িকভাবে হেসে আনন্দিত গলায় বলল-

“আগে থেকে বললে সারপ্রাইজ হতো কি করে! মাঝরাস্তায় বলেছি বলেই হয়তো একটু বেশি এক্সাইটেড ছিলি।”

রৌদ্র নির্বানের পেটে কনুই দিয়ে গুতা মে’রে বলল-

“বিয়ের পর দেখছি খুব বুদ্ধিমান আর দয়ালু হয়ে গেছিস!! এই যে নীলা!! সরি মানে ভাবি, বিয়ের পর নির্বান এত ভালো মানুষ হয়ে গেল কি করে! জাদু-টাদু কিছু করেছো না-কি!”

রৌদ্রর কথায় নীলা লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলে। ঠিক যেন এক লাজুক নতুন বউ। সবাই একসঙ্গে হেসে উঠেছে রৌদ্র কথায়। আদ্রাফ হাসতে হাসতে কৌতুক করে বলল-

“আপনার আর আশুর বিয়েটা হোক তারপর আপনিও বুঝবেন কীভাবে ভালো মানুষ হতে হয়।”

আদ্রাফের কথা বলা শেষ হতেই আরশি রেগে আদ্রাফের পিঠে ঘুষি মা’রে। আদ্রাফ মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে অসহায় মুখে বলল-

“ভাই.. এভাবে নিয়মিত মা’ই’র খাইলে আপনি বিয়ের পর একদম বাঁশের মতো সোজা হয়ে যাবেন কনফার্ম।”

“আদ্রাফের বাচ্চা!! তুই শুধু আরেকটা কথা বলে দেখ, এখনই ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিবো।”

আরশির রাগান্বিত কন্ঠে সবার হাসির পরিমান আরও বেড়ে গেল। এক এক জনের দাঁত যেন খুলে পরে যাচ্ছে হাসির চোটে। রৌদ্রর মুচকি হাসি দেখে যেন আরশির রাগ তরতর করে মাথায় উঠে বসলো। আরশিকে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব এগিয়ে আসলো। আরশির কাঁধে হাত রেখে সবাইকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলল-

“আদ্রলিকাকে আবার কেউ রাগালে সবাইকে এখানেই ফেলে রেখে যাবো।”

ধ্রুব হুমকিতে সবাই চুপসে যায়। তবুই যেন ঠোঁট চেপে হাসছে। সবার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে আরশি হাসতে লাগলো। আরশির হাসি দেখে ধ্রুবও হাল্কা হাসে।

“আচ্ছা শোনো সবাই৷ হোটেলে শুধুমাত্র তিনটা রুম বুক করা গেছে। তোমরা সবাই দুটা রুম ভাগাভাগি করে নিও। আমি গেলাম আমার বউ নিয়ে।”

নির্বানের কথায় শুনেই সবাই একসাথে চেচিয়ে উঠল। দুই রুমে সাতজন থাকা নিয়ে লেগে গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বেশ কিছুক্ষন তর্কবিতর্ক করার পরও কোনো উপায় খুজে পাওয়া গেল না। অবশেষে রৌদ্রর কথা মতো মেয়েদের জন্য এক রুম আর ছেলেদের জন্য এক রুম ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আর নির্বান নীলার যেহেতু হানিমুন। তাই তাদের প্রতি দয়া দেখিয়ে আলাদা রুমে থাকার পারমিশন দিয়ে দিয়েছে সবাই।

——————————

“আদ্রলিকা!”

রুমের যাওয়ার আগ মুহূর্তে ধ্রুবর ডাকে আরশি থমকে দাঁড়ায়। বিস্মিত হয়ে ঘাড় বাকিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুব আরশির কাছে এসে কিছু ব্যাগ দিয়ে বলল-

“এখানে নতুন কিছু ড্রেস আছে যেটা ভালো লাগে পরিস।”

“কখন কিনলি এসব?”

আরশি ব্যাগ গুলো দেখেই চমকে যায়। আরশির প্রশ্নে ধ্রুব কোনো জবাব দিলো না। নির্লিপ্ততার ভঙ্গিতে দেখছে আরশিকে। আরশি একটা একটা করে ব্যাগ খুলে দেখছে। সব গুলো ব্যাগ দেখা শেষ হতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল-

“সব গুলোই খুব সুন্দর হয়েছে। কিন্তু কখন কিনেছিস!”

ধ্রুব মৃদু হেসে বলল-

“কক্সবাজারে যখন তোরা সবাই ঘুরছিলি তখন কিনেছি। আচ্ছা এখন যা ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নে। আর হ্যাঁ রুম থেকে বের হওয়ার আগে অবশ্যই আমাকে কল দিবি। আমাকে না জানিয়ে রুম থেকে এক পা-ও নড়বি না।”

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।”

আরশি উৎকণ্ঠিত গলায় বলে। ধ্রুব আরশির নাকে হাল্কা টান দিয়ে বলল-

“হয়েছে এখন ভেতরে যা।”

আরশি ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে মনকাড়া হাসি দিয়ে রুমের ভেতর চলে যায়। “তুই এখনো বাচ্চা-ই র‍য়ে গেলি আদ্রলিকা” ধ্রুব আনমনে কথাটা বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খানিকটা দূর থেকে রৌদ্র আর নীল ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। নীল তপ্ত শ্বাস ফেলে মুগ্ধ গলায় বলল-

“আমরা সবাই ছোট থেকেই ধ্রুব ভাই আর আশুকে একসাথে দেখে আসছি। একজন আরেকজনকে ছাড়া একদিন থাকলেই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিতো। যদিওবা কান্নাকাটি সব সময় আশুই করেছে। ধ্রুব ভাই আশুকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আপনার আর আশুর সম্পর্কে গভীরতা দেখে হয়তো ধিরে ধিরে ওনার মধ্যে ভয় ঢুকে যাচ্ছে। আজ না হোক কাল আপনার আর আশুর বিয়ে হবে৷ আশু চলে যাবে আপনার বাসায়। হয়তোবা তারপর কি হবে ভেবেই ধ্রুব ভাই ভয় পাচ্ছে। আপনার কাছে অনুরোধ রৌদ্র ভাই। যাইহোক না কেন এই দুটো মানুষকে কখনো কষ্ট দিয়েন না।”

রৌদ্র ধ্রুবর দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নীলের দিকে তাকালো। নীলের কথার বিনিময়ে রৌদ্র একগাল হাসি উপহার দেয়।

——————————

“আশু শাড়িটা তাড়াতাড়ি পরে নে।”

নীলা আরশির সামনে একটা শাড়ি রাখলো। আরশি সরু চোখে তাকালো তার দিকে। ক্ষীন গলায় বলল-

“এই সন্ধ্যা বেলা শাড়ি পরে কি করবো!”

“উফঃ বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি পরে নে। কাসফি আর সুপ্তি তোদের জন্যেও দুটো শাড়ি আছে এই ব্যাগে। সবাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে বিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা বের হবো।”

নীলা কারও কাছ থেকে কোনো প্রতিত্তোরে আশা না করেই হড়বড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরশি বিছানায় রাখা শাড়িটার দিকে তাকালো। সবুজ রঙের শাড়ি। আরশি শাড়িটায় হাত বুলিয়ে স্মিত হাসে।

“কাসফি আমাকে শাড়ি পরিয়ে দে। আমি পারি না শাড়ি পরতে।”

“কিছু দিন পর বিয়ে হবে আর এখন বলিস শাড়ি পরতে পারিনা।”

কাসফিয়ার বিরক্তি ভাবকে আরশি উপেক্ষা করে বলল-

“তোরা আছিস বলেই তো এখনো শিখিনি।”

“কাসফি জান আমিও শাড়ি পরতে পারিনা।”

সুপ্তির আহ্লাদী ভঙ্গিতে বলা কথায় কাসফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

“খাইতে পারিস! নাকি এখন থেকে খাবারও আমি চিবিয়ে চিবিয়ে দিবো তোদের??”

সুপ্তি আর আরশি একে অপরের দিকে তাকালো। দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিয়ে একসাথেই বলে উঠল-

“তুই রাজি থাকলে আমাদের জন্য ভালোই হয়।”

নীলা জ্বলন্ত চোখে তাকালো তাদের দু’জনের দিকে। দুজনেই ঠোঁট চেপে মিটমিট করে হাসছে। তাদের হাসি দেখে কাসফিয়া উদাসীন গলায় বলল-

“হাসি বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি কর। মাত্র বিশ মিনিট সময় দিয়েছে।”

———————————

রুম থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসলো শাড়ি পড়া তিন রমনী। কাসফিয়া আর সুপ্তির গায়ে জড়ানো ধুসর রঙের শাড়ি। আদ্রাফের পলকহীন দৃষ্টি কাসফিয়াকে দেখতে ব্যস্ত। ধুসর রঙের শাড়ি পরে প্রায় রিকশা করে ঘুরি বেরিয়েছে আদ্রাফের সাথে। পুরনো কথা ভেবেই কাসফিয়া কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছে। আর এখন আদ্রাফের চাহনিতে যেন অস্বস্তির পরিমান দ্বিগুণ হচ্ছে। নীল আদ্রাফের কাধে হাত রেখে গলা খেকরিয়ে বলল-

“সুপ্তি এই প্রথম তোরে দেইখা আমি ক্রাশ খাইলাম। শাড়ি পড়ায় আজ প্রথম তোরে একটু বুদ্ধিমান মহিলা মনে হইতাছে।”

সুপ্তি চোখ ছোট ছোট করে তাকালো নীলের দিকে। সন্দিহান কন্ঠে বললো-

“কেন এর আগে কি আমি বোকা মহিলা ছিলাম না-কি??”

সুপ্তির বোকামিতে নীল আর আদ্রাফ দুজনের ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে। নীল হাসি চেপে রেখে বলল-

“যাক তাহলে তুই নিজেকে মহিলা হিসেবে মেনে নিয়েছিস!!”

কথাটা বলেই নীল আর আদ্রাফ এক সাথে হাসিতে ফেটে পরলো। সুপ্তি এখনও বোকাসোকা চেহারা নিয়ে তাদের দিকে চেয়ে আছে। তাদের কথাটা বুঝতেও তার আরও কিছু সময় লাগলো। রৌদ্র রুম থেকে বেরিয়ে এসে আরশিকে দেখেই থমকে যায়। কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে তার রুদ্রাণীর মাঝে। সবুজ রঙের শাড়ি পড়া ঠিক সেই কিশোরী মেয়েটা। যার মাঝে তার হৃদয় আটকে গিয়েছিল। ঠিক যেন তার অদেখা প্রথম ভালোবাসার মানুষ। রৌদ্রকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরশি অস্বস্তিতে মাথা নিচু করে ফেলে। রৌদ্রর পাশ থেকে ধ্রুবর কাশির শব্দে তার ঘোর কাটে। রৌদ্র নিজেকে সামলিয়ে নেয়। রৌদ্রকে অপ্রস্তুত হতে দেখে ধ্রুব নিঃশব্দে হাসলো। আরশির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে এগিয়ে আসলো। নিজের গায়ের উপর থেকে শাল নিয়ে আরশির গায়ে জড়িয়ে দেয়। আরশির চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে শাসনের গলায় বলল-

“বাহিরের আবহাওয়া খুব ঠান্ডা শাল না নিয়ে বেরিয়েছিস কেন!”

“মনে ছিল না।”

আরশি মিনমিন করে বলল। ধ্রুব আরশির মাথায় হাত রেখে বলল-

“আচ্ছা চল এখন।”

চলবে….

(রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)