শঙ্খতেও ফাটল ধরে পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
186

#শঙ্খতেও_ফাটল_ধরে
পর্ব-৬
লেখনীতে-সঞ্চিতা

-“আমার স্ব-যত্নে রাখা শঙ্খ বলুন কিভাবে ভাঙতে দেই? আমার এতো শখের শঙ্খ। আমার শঙ্খকে আমি ফুলে সাজিয়ে রাখতে চাই সারাজীবন। (ধীর কণ্ঠে)

দিব্যর কথাতে লিখির গায়ে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেলো। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষন এভাবেই কেটে গেলো। দিব্য এক দৃষ্টিতে লিখির দিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষন লিখির অস্বস্তি না লাগলেও এখন বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। যদিও দিব্য তার থেকে চার, পাঁচ হাত দূরে আছে তবুও তার দৃষ্টি কেমন অস্বস্তিকর লাগছে লিখির কাছে।

-” যদি ভাবেন শঙ্খতে কোনোদিন ফাটল ধরেনা তবে ভুল ভাবছেন, শখের শঙ্খতেও ফাটল ধরে। লোহার ধর্ম মরিচাকে আপন করে নেওয়া, ঠিক তেমনি শঙ্খয়েরও ধর্ম এক সময় ফাটল ধরা। সেটা একদিনে হোক বা একশো বছরে হোক। (নিচু দৃষ্টিতে)

লিখির কথায় চুপ করে গেলো দিব্য, শূন্য দৃষ্টিতে কতক্ষন চেয়ে রইল লিখির মুখের দিকে এরপর নজর সরিয়ে ফেললো।

-“শঙ্খকে যত্নে রাখা ব্যাক্তিটা যতদিন বাঁচবে, শঙ্খটা ততদিন সেই ব্যক্তির সঙ্গ থাকলেই চলবে। সেই থাকাকালীন অন্তত শঙ্খকে ফাটল ধরতে দিবেনা ব্যক্তিটা। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)

দিব্যর কথায় লিখি কিছুই বল্লোনা আর। এক কথায় বলার মতো পর্যাপ্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছেনা সে। দিব্য আর দাঁড়ালোনা সেখানে, দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল।
দিব্যর যাওয়ার পথে না তাকিয়েই লিখি দীর্ঘশ্বাস ফেললো, আনমনে নিজের হাত পেতে স্পর্শ করে বলল।

-“আমার পৃথিবীকে রঙিন করার জন্য হলেও আমাকে আরও দুই দশক বাঁচতে হবে। যদি পৃথিবী সাজানোর শেষ পর্যায়ে বিলীন হয়ে যাই তাহলে হোক আমার সে বিলীন।(আনমনে)
~~

-“এই মাসে তোমাকে আমি ষাট হাজার টাকা দিচ্ছি। এর বেশি সম্ভব নাহ আমার পক্ষে।(গম্ভীর স্বরে)

শুভম কাচু মাচু হয়ে টাকাগুলো হাতে নিলো। সমরেস বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন কিছু একটা ভাবতে ভাবতে।
শুভম ভয়ার্ত দৃষ্টি মেঝেতে নিঃক্ষেপ করে আছে। সে ভাবছে সমরেস বাবু ত এখনো কিছুই জানেন নাহ, যদি জানেন তাহলে বিরাট এক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। রাজনীতিবিদ মানুষ, তার মেয়ের সাথে সে এতো বড়ো অন্যায় করছে। লিখি তার নিজের মেয়ে না হলেও নিজের মেয়ের থেকে কম ভালোবাসেন নাহ। শশুর বাড়িতে কোনো ঝামেলা না হওয়ার কারণে প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের টাকা দিচ্ছেন তিনি যদি জানতে পারেন যে লিখির সাথে সে ঘোর অন্যায় করছে। তবে শুভমকে তিনি যে কি করতে পারেন ভেবেই শুভমের খানিকটা ভয় লাগছে।

-” কালকে লিখিকে এবাড়িতে দিয়ে যাবে, বিগত দু মাসে মেয়েটাকে দেখিনা। বাবার মন জানোই ত মেয়ের প্রতি কেমন দুর্বল। দিয়ে যেও ওকে। (চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে)

বেশ শুভমে ভয়ে আঁতকে উঠলো, তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,,

-“আ আ আসলে কি বাবা! ওকে নিয়ে ত অনেক দিন হলো কোথাও ঘুরতে বের হইনা! ও গত কয়েকদিন ধরে খালি আবদার করছে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে। ত আমার প্ল্যান করেছি পরশু কোথাও থেকে এক সপ্তাহ ঘুরে আসবো। (তড়িঘড়ি করে)

সমরেস বাবু কি জানি ভাবলেন। এরপর বলে উঠলেন,

-“তা বেশ তো, ঘুরে আসার পর নাহয় লিখিকে দিয়ে যেও।

শুভম ছোট করতে বললো,
-“আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, আপনার কাছে ওকে রেখে যাবো। আজ তাহলে আমি আসি।

বলেই শুভম টাকার ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে গেলো।
বাড়ি থেকে বের হয়ে হাফ ছাড়লো সে। মনে মনে আওড়ালো,

-” কিভাবে এখন লিখিকে নিজের খাঁচাতে বন্ধি করি! যে করে হোক ওকে দিব্যর বাড়ি থেকে বের করতে হবে।

ভাবতে ভাবতে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো শুভম। টাকা গুলো যে হাতে পেয়েছে এটাতেই সে খুশি।
~~

-“তোমাকে আমার একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল, যদি কিছু মনে না করো! (আমতা আমতা করে)

মণির কথায় মিহাল ব্রু কুঁচকালো। খানিকক্ষন পর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠলো।

-“হ্যা বলো।

-“তোমার বাবা আর সমরেস নামের লোকটা কি অনেক আগের থেকে বন্ধু একে অপরের?

-“তা জেনে তুমি কি করবে? (ব্রু কুঁচকে )

-“না এমনি বলোনা!

-“হ্যা অনেক আগের থেকে তারা একে অপরের বন্ধু।

মণি কি জেনে ভাবলো, এরপর বল উঠলো।

-“সমরেস বাবু তো মনে হয় দুটো বিয়ে করেছেন তাইনা?

মিহাল বিরক্ত হলো মণির প্রশ্নে। এরপর বললো,

-“নাহ, একটাই করেছেন। ওনার স্ত্রী গর্ভবতী থাকা কালীন অন্য পুরুষের সাথে পালিয়ে জান বলে সবাই ধারণা করেন। তবে এটা সত্যি নাহ।

মণি চমকালো, কিছু একটা মেশালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“কি? সত্যিটা কি?

-“এটা আমাকে বাবা বলেছেন, এবং তিনি বারণ করেছেন কাউকে বলতেনাহ, তাও তোমাকে বলছি আমার স্ত্রী হও তাই। সমরেস বাবু ওনার বড়ো ভাইকে খু*ন করেছেন। এবং তার স্ত্রীর সতীত্ব হরণ করেছেন। ওনার বড়ো ভাইয়ের একটা নয় মাসের মেয়েও ছিল যাকে বর্তমানে ওনার নিজের মেয়ে বলে সবাইকে পরিচিত করেছেন।মেয়েটার নাম মনে হয় লিখি হবে।যখন তিনি এই ঘৃণ্য কাজ করছিলেন তখন ওনার স্ত্রী ওনাকে দেখে ফেলেছিলেন, উনি চাইছিলেন ওনার স্ত্রীকেও মে*রে ফেলতে কিন্তু পারেননি। ওনার স্ত্রী পালিয়ে গিয়েছিলেন। সমরেস বাবুর ভাইয়ের স্ত্রী তখনো বেঁচে ছিলেন, সমরেস বাবু ওনার ভাইয়ের স্ত্রীকে আগুনে পু*রিয়ে মে*রে ফেলেছিলেন। (এক নিঃশ্বাসে)

দীর্ঘক্ষন কথা বলায় একটু দম নিলো মিহাল। কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো,,

-“সমরেস বাবুর স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। জানা গিয়েছিলো ওনার একটা মেয়ে হয়েছিলো। সমরেস বাবু তা জানার পর ওনার স্ত্রীকে মারার জন্য প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু তখন তিনি কিছুই করেননি নতুন নতুন রাজনীতিতে পা দিয়েছিলেন কোনো সমস্যা চাননি তাই উনি যা করতে চাইছিলেন তা আমার বাবা করেছে। ওনার স্ত্রীকে গা*ড়ি চা*পা দিয়েছিলেন।সমরেস বাবু ওনার নিজের মেয়েকেও মা*রতে চেয়েছিলেন তবে পারেননি। ওনার স্ত্রীর দ্বিতীয় পক্ষের লোকটা ওনার মেয়েকে নিয়ে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)

মণির রিদয়ে যেন বাজ পড়ছে ক্ষনে ক্ষনে। ধা*রালো ছুঁড়ি তার বুকে গিয়ে বিধছে বারবার। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে মণির। আপনা আপনি তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মণি চোখের জল হাতে নিয়ে অবাক হলো, সে তার জীবনের শেষ কান্না করেছিল মায়ের লাশের পাশে বসে। আজ এতগুলো বছর পর সে আবার কান্না করছে। মণির বোধগম্য হচ্ছেনা সে কি খুশিতে কান্না করছে নাকি দুঃখে কান্না করছে। যদি কান্নাটা হয় খুশির তবে সে তার মায়ের প্রতিশোধ নিতে পারবে, আর যদি দুঃখের হয় তাহলে এটা ভেবে কান্না করছে যে মানুষ কতটা খারাপ হতে পারলে নিজের সেই ভাই-ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে এতটা অন্যায় করতে পারে।
মণি বুঝতে পারছেনা সে কেন কান্না করছে, তবে সে এতটুকুই জানে যে সে কান্না করছে।
মণি অন্যদিকে দিয়েও অবাক হচ্ছে, তার শশুর কিভাবে তার মাকে মে*রে ফেলতে পারলো! যদিও সে ওদের সাথে এতদিন ধরে নাটক করে আসছে, তবুও সত্যিটা জানতেই সে এমন করেছে।

মণি নিজের ব্যক্তিত্বটাকে জোরালো করলো, হাতে থাকা ইনজেকশন তা মিহালের ঘাড়ে পুশ করে দিলো। মণির আচমকা এরকম কাণ্ডে হতবাক হলো মিহাল, ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যাথা হতে লাগলো তার।
রীতিমতো তার ধীরে ধীরে অন্ধকার লাগছে সব কিছু।

-“প্রথমে ক্ষমা চাচ্ছি এতদিন তোমাদের সাথে নাটক করার জন্য। বিশ্বাস করো আমার মাকে যারা নির্মম ভাবে মে*রে ফেলেছে তাঁদের শাস্তি দিতেই আমার এই পন্থা অবলম্বন করা। তোমার বাবার এই ঘৃণ্য পাপকর্ম জেনেও তুমি ওনার বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নেওনি যেখানে তুমি নিজেকে ন্যায় বিচারক দাবি করো, একজন উকিলের কাজ সবসময় ন্যায়ের পথে থাকা আর তুমি ভালো করেই জানো ‘অন্যায় করে যে আর অন্যায় সহে যে উভয় সমান অন্যায়কারী”। তোমার এটাই প্রাপ্য ছিল। আমি আমার মায়ের এবং আমার সুন্দর শৈশব নষ্ট করার জন্য শাস্তি তো সবাইকে দিবই।(কাঠখোট্টা স্বরে)

মিহাল মেঝেতে পরে গেলো, মণি উঠে দাঁড়ালো।রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের কাপে বি*ষ সাথে এসিড মেশালো। তাচ্ছিল্যর একটা হাসি দিলো।
এরপর নিজের শশুরের রুম গিয়ে ওনাকে দিয়ে দিলো। উনি হাসি মুখে সেটা হাতে নিলেন,,

-“আরেহ বউমা চা কেন বানাতে গেলে? (হাসি মুখে)

মণি কিছুই বল্লোনা, উত্তরে একটা মিষ্টি হাসি দিলো। মণি অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে মিহালের বাবার চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার দৃশ্যটা দেখার জন্য। বাড়িতে শুধু মিহাল আর মিহালের বাবা থাকে, এছাড়া তাঁদের আর কোনো আত্মীয় স্বজন নাই মণির জানা মতে। কোনটা খারাপ কোনটা ভালো মণির বোধগম্য হচ্ছেনা, আপাতত মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবে সে ভাবে রেখেছে। তার জীবনটা তো সুন্দরও হতে পারতো, এতটা বিষাদমাখা না হলেও পারতো তার জীবনটা। জীবনে সুন্দর সেও জানে তবে জীবন সুন্দর হওয়ার জন্য পরিবেশ দরকার, মানসিক শান্তির দরকার যা বরাবরই সে পায়নি। মণি চেয়ে দেখছে কিভাবে তার শশুরের মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। কিভাবে কাতরাচ্ছে উনি।
প্রশান্তি! মণির কেন যেন প্রশান্তি লাগছে।

সমাপ্ত,,