শঙ্খতেও ফাটল ধরে পর্ব-৩

0
130

#শঙ্খতেও_ফাটল_ধরে
পর্ব-৩
লেখনীতে-সঞ্চিতা

লোভ মানুষকে পশুতে পরিণত করে। একদিনে গড়া লোভ মানুষকে পশু থেকে পুনরায় মানুষে পরিণত করতে পারলেও, বছর বছর ধরে পোষা লোভ কোনোদিন মানুষকে পশু থেকে মানুষে রূপান্তরিত করতে পারেনা। হয়তো সেই মানুষটা দেখাতে পারে সে শুধরে গেছে কিন্তু তার মন মানসিকতা একই রকমই থেকে যায়।
শুভম আর প্রমিলা দেবীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বছর বছর ধরে পুষে রাখা লোভ তাঁদেরকে একটু একটু করে পশুতে পরিণত করেছে।
টাকা! টাকার লোভ তাদের মস্তিষ্ককে জেঁকে বসেছে। বিবেক, চেতনা হারিয়ে লোভে অন্ধ হয়ে বসেছে তারা।
টাকা হচ্ছে একদিনের সাথী কিন্তু বিবেক হচ্ছে সারাজীবনের সাথী। বিবেককেই যদি মানুষ পর করে দেয় তাহলে সারাজীবন মানুষকে মরীচিকা নামক টাকার পিছেই ছুটতে হবে।
টাকা, লোভ নামক মরীচিকার পিছে ছুঁটেই শুভম এতো বড়ো পাপ কাজে নিজেকে জড়াতে চাইছে। পাষণ্ড এর মতো নিজের অনাগত সন্তানকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।
শুভমের মস্তিষ্কে কথাটা চলা বন্ধ করে দিয়েছে যে,,
“পাপ কাজ করে হয়তো পাপকে ছেড়ে দেওয়া যায়, কিন্তু পাপের ফল তোমাকে কখনো ছাড়বেনা উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে”

শুভম কল্পনাও করতে পারছেনা যে পাপের ফল কতটা কষ্টদায়ক হবে। তাইতো নির্দ্বিধায় পাপ করে যাচ্ছে।
~~

-“আপনার ফেসবুক আইডির নাম (As Dibbo)! আপনি কি জানেন As তে আর্সেনিক হয়! আপনার নাম তাহলে কি আর্সেনিক দিব্য? (হাস্যকর কণ্ঠে)

খিল খিল করে হাসার মাঝে কারো উক্তি শুনে থমকালো দিব্য। কিছুক্ষন নীরব থেকে পিছু ঘুরলো। পিছে ঘুরেই একরাশ বিরক্ততা জেঁকে বসলো তার মুখশ্রীতে। নিধি খিলখিল শব্দে হাসছে, নিধিকে দেখে দিব্যর বিরক্ত লাগলেও নিধির উক্তি শুনে দিব্যর প্রচুর রাগ উঠলো। কড়া গলায় বলে উঠলো,,

-“এবাড়িতে যখন মন চাচ্ছে আসছেন আর যাচ্ছেন। এতে কিছুই বলছিনা আপনাকে, কিন্তু আমার প্রিয় মানুষের কথা কপি করে যে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ পাবেন এটা ভেবে স্বপ্নেও ভুল করবেন নাহ! (কড়া গলায়)

মুহূর্তেই নিধির মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো। ক্ষীণ গলায় সেও বলে উঠলো,,

-“মেয়েটার মধ্যে পেয়েছেন টা কি? মেয়েটার বিয়ে হয়েছে আজকে আট বছরেরও বেশি! হয়তো তার দুই তিনটা বাচ্চা কাচ্চাও আছে। আর আপনি কিনা সেই মেয়েকে ঘিরে বসে আছেন! (ক্ষীণ গলায়)

নিধির কোথায় নেহাৎ বিরক্ত ছাড়া আর কিছুই উপলব্ধি করলোনা দিব্য। চুপচাপ সে স্মোক করে মন দিলো। নিধি কিছুক্ষন চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর রাগে গিজগজ করতে করতে চলে গেলো।
এইদিকে দিব্য ভাবুক হয়ে উঠলো। নিধি বললো মেয়েটার দুই তিনটা বাচ্চা আছে, কিন্তু সে তো জানে এরকম কিছুই নাহ।
স্মোক করতে করতে আনমনেই বলে উঠলো,,

-“হতে পারে সে অন্যকারো, কিন্তু আমার মনের পুরোটা জুড়ে আছে সে। ভাবতেই অবাক লাগে, সে এখন আমার কাছেই আছে!তবে তার জানা নেই যে আমি তাকে কতটা নীরব ভাবে ভালোবাসি। (আনমনে)

দিব্যর কিছু একটা মনে হতেই সিগা*রেট ফেলে উঠে গেলো বাহিরে দিকে।

-“আপনার কিছু কি প্রয়োজন!

কারো কণ্ঠস্বরে মৃদু কেঁপে উঠলো লিখি। কণ্ঠটা তার অতীব পরিচিত, সে আগেও এই কণ্ঠস্বর শুনেছে কিন্তু মনে করতে পারছেনা এই কণ্ঠস্বর টা কার!
মিনমিন করতে করতে পিছু ঘুরলো লিখি। সামনে দিব্য দাঁড়িয়ে আছে শুকনো মুখে। লিখি আমতা আমতা করে বলল,

-“ন না মানে কিছুনা!

-” কিছুনা! আমি জানি আপনি এখন চলে যাচ্ছিলেন এবাড়ি থেকে। কিন্তু কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে যাওয়াটা কি ঠিক? (শুকনো মুখে)

লিখি খানিকটা বিপাকে পড়লো। আসলেই তো গত ছয়দিন ধরে সে এবাড়িতে রয়েছে। আজকে থেকে হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে যাচ্ছিলো অকৃতজ্ঞ ভাবে।

-” আপনি চাইলে এখানে থাকতে পারেন আপনার যতদিন মন চায় ততদিন। আপনি আপনার ফ্যামিলির কাউকে আপনার খবর দিতে মানা করেছেন অবশ্য কোনো সমস্যা থাকার কারণে, সেটা আমরা বুঝেছি তাই আপনি চাইলে এখানে থাকতে পারেন।

লিখি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে দিব্যর দিকে তাকালো। দিব্যর মুখ চোখ শুকানো। কেন জানি লিখির মনে হলো এই চেহারা তার পূর্ব পরিচিত। লিখি আরও মনে হলো দিব্য তাকে কিছু বলতে চাইছে,

-“এই ছয়দিনে আপনার সাথে আমার আজকে দেখা হলো সামনাসামনি। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি! আপনি কি আমাকে চিনতে পারেন নি? (শুকনো ঢোগ গিলে)

লিখি নিশ্চুপে দিব্যর মুখের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো। মস্তিষ্কে কিছুক্ষন জোর দেওয়া পর তার মনে পড়লো, সে দিব্যকে ভালো করেই চিনে।

-“আপনি!(অস্ফুষ্ট স্বরে)

দিব্য কিছু বললনা, নিশ্চুপে একটা শুখনো হাসি দিলো কিঞ্চিৎ। এরপরে কিছু না বলেই দ্রুত পায়ে সেখান প্রস্থান করল।
লিখি থমকে দাঁড়ালো। মনে পড়লো সেই এক রোদ্র ময় দুপুরের কথা, ঘামে একাকার হয়ে কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে লিখি। সেই অনেক ক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছে তার প্রাণের বেস্টু রাহার জন্য।
লিখির হঠাৎ নজর পড়লো দিব্যর উপরে, বন্ধুদের সাথে কথা বলছে আর মিটি মিটি হাসছে। লিখির মনে পড়লো গতকাল সে দিব্যর ফেসবুক আইডি পেয়েছে। সেখানে দিব্যর নাম ছিল (As Dibbo) এএস দিব্য।
লিখির আরও মনে পড়লো কেমিস্ট্রিতে পড়েছিল As তে আর্সেনিক। লিখি মনে প্রশ্ন নিয়ে দিব্যর কাছে গিয়ে হুট্ করে বলে উঠলো,,

-“আপনার ফেসবুক আইডির নাম (As Dibbo) এএস দিব্য, আপনিকি জানেন As তে আর্সেনিক! তাহলে আপনার নাম কি আর্সেনিক দিব্য! (হুট্ করে)

দিব্য সেদিন অবাকের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, মুখ দিয়ে টু শব্দও করেনি। লিখি বলেও পরে বেকায়দায় পরে গিয়েছিলো। তাই হালকা হেসে সেদিন সেখান থেকে চলে গেছিলো দ্রুত।
পর থেকেই দিব্যর সাথে দেখা হলে দিব্য তাকে একটা গম্ভীর লুক দিতো, কোনোদিন হাসতোও নাহ। শুভমের সাথে লিখির বিয়ের দুই দিন আগে দিব্যর সাথে লিখির দেখা হয়েছিলো, দিব্যকে বেশ উস্কো খুস্ক লেগেছিলো লিখির। লিখি দেখেছিলো দিব্য তাকে কিছু বলতে নিয়েছিল কিন্তু লিখি দিব্যকে উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলো। এরপর আর কোনোদিন তার সাথে আর লিখির দেখা হয়নি।
লিখি হতবাক, এতগুলা বছর পর দিব্যর সাথে তার দেখা হবে কোনোদিন ভাবেনি সে। সে এখন দিব্যর বাড়িতে আছে।
লিখির কেমন জানি লাগছে। ভাগ্য তার শেষ পর্যন্ত কোথায় যায় সে এখনো আন্দাজ করতে পারছেনা। তবে লিখি ভেবে নিয়েছে, যত ঝড় ঝাপ্টা আসুক নাহ কেন! যে করেই হোক সে তার সন্তানকে বাঁচাবেই। লিখি ভেবে নিয়েছে কোনোদিন শুভমের মুখোমুখি হবেনা সে, নিজের সন্তানকে সে কোনোদিন শুভমের সামনা সামনি হতে দিবেনা। লিখির হঠাৎ অস্বস্তি লাগছে, চুপচাপ সে নিজে যেই রুমে থাকে সেখানে চলে গেলো।
~~

-“তুমি এখানে! যা ভেবেছিলাম তোমার এই দুইটাকার পা’গল প্রেমিক তোমাকে একা রাখবেই নাহ! নিজের কাছে নিয়ে আসবে যে করেই হোকনা কেন। তাইতো বুদ্ধি করে এখানে আশা। তবে যাই করোনা কেন তোমার এবোর্শন তো হবেই সাথে তুমি আমার খাঁচাতেই বন্ধি থাকবে। চলো বাড়ি চলো।(ফিস ফিস করে)

আনমনে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল লিখি। হঠাৎ কারো এহেন কণ্ঠের বাণী শুনে কেঁপে উঠলো সে। আশ্চর্য হলো সে এটা শুভমের কণ্ঠস্বর।
ভীত চোখে পিছু ফিরে শুভমকে দেখে নিশ্চুপ হলো লিখি।
শুভম দাঁড়িয়ে আছে, সাথে তার মা প্রমিলা দেবী।
লিখির স্বপ্ন মনে হচ্ছে, সে যে এখানে আছে শুভম জানলো কিভাবে!

-“তুমি এমন কিভাবে করতে পারো আমার সাথে! তুমি কিভাবে এমন মুখোশধারী হতে পারো? (থমথমে কণ্ঠস্বরে)

-“আমি যে মুখোশ পরে থাকি অনেক ভাবেই দেখিয়েছিলাম তোমায়, তুমি বোকা বুঝোনি কখনো। তুমি যে তোমাকে আমার বউ ভাবো আসলে ব্যাপারটা তেমন নাহ, আমি তোমাকে আমার কাজের লোক ছাড়া কিছুই মনে করিনা। তোমার সাথে বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আমি মণিকে বিয়ে করি। এতো বছর তার সাথে আমি থেকে আসছি, আমাদের একটা পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাও আছে। (হালকা হেসে)

শুভমের কথায় লিখির ভেতরটা পুরা ছারখার হয়ে গেলো।

চলবে,,