শত ডানার প্রজাপতি পর্ব-০২

0
5646

#শত ডানার প্রজাপতি

#urme prema (sajiana monir )

পার্ট :২

সেদিন বাড়ি ফিরতেই দেখি । বাড়ি ভরা মানুষ । টিয়া আপু আর তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসেছে ।
মামার দুই মেয়ে । টিয়া আর হিয়া । টিয়া আপু মামার বড় মেয়ে । আর হিয়া আপু ছোট ।
রুমে যেতেই টিয়া আপুকে দেখতে পাই ।আপুকে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে বলি ,

– “কেমন আছো আপু ? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম ! তোমাকে দেখেই মন ফুরফুরে হয়ে গেছে । ”

টিয়া আপু বেশ বিরক্তি নিয়ে আমার হাত ঝাড়ি দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় ।বিরক্তি ভরা গলায় বলে উঠে ,

– “দেখ হুর ,তোকে হাজারবার বলেছি এই সব আদিক্ষেতা আমার পছন্দ না ।তার পরও কেন গায়ে পরে এমন করিস ? ”

আমি মলিন হাসি দিয়ে দূরে সরে যাই ।মৃদু স্বরে বলি,

– “সরি আপু ! আর এমন হবেনা । ”

আমার কথায় যেন আপুর বিরক্তি আরো বৃদ্ধি পায় । ঝাঁঝালো গলায় বলেন,

– উফফ হুর ! তুই এখান থেকে যা তো এখন । তোকে দেখেই আমার মাথা ব্যথা করছে । অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি আমি এখন একটু রেস্ট নিতে চাই । ”

আমি রুম থেকে বের হতে নিবো এমন সময়ই পিছন থেকে টিয়া আপু ডেকে বলেন,

– যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে যাবি । আর হ্যা আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সামনে আসবি না । নিজের রুপ দেখিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরতে হবেনা । ”

আমি আপুর কথা মত দরজা বন্ধ করে রুম থেকে চলে আসি । আপুর এমন ব্যবহার আমাকে তেমন একটা কষ্ট দেয়নি। কারণ এটা নতুন কিছু না । আপুর এমন ব্যবহারে আমি ছোট থেকে অভ্যস্ত । তাই এসব কথায় এখন আর কষ্ট পাই না । শরীরে সয়ে গেছে ।
টিয়া আপু ছোট থেকে কোনো এক অজানা কারণে আমাকে অপছন্দ করে।কিন্তু হিয়া আপু একদম তার বিপরীত । আমাকে বাচ্চাদের মত সবসবয় আগলে রাখে । সব সময় আমার সব দোষ নিজের উপর নিয়ে নেয় । আমাকে প্রটেক্ট করে ।
এসব ভাবতে ভাবতেই আপুর রুমের সামনে চলে আসি । দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই । থম মেরে যাই । বিছানায় বসে হিয়া আপু কান্না করছে ।

আপু আমাকে দেখতেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলেন ,

– “হুর আমার সব শেষ ,আমি সব হারিয়ে ফেলেছি । ”

বলেই হিয়া আপু আবার কান্না জুড়ে দিলো । আপুর কান্না দেখে আমার হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে । নিজেকে কোন রকম শান্ত করে বললাম ,

– “এসব কি বলছো আপু ? কিচ্ছু শেষ হয়নি । কি হয়েছে সেটা বলো । ”

– “আমি আবির কে ভালোবাসি হুর । খুব বেশি ভালোবাসি । আবির ও আমাকে ভালোবাসে ।কিন্তু আবিরের মা আবিরের বিয়ে অন্যকথাও ঠিক করেছে । আবির তার মা কে না করতে পারবেনা । আর আমাকেও ছাড়তে পারবেনা ।
এদিকে আবিরের সাথে একসাপ্তাহ দরে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না । তাকে বলতেও পারছিনা যে যে আ আ। আমি তার বাচ্চার মা হচ্ছি । আমি আবেগে বসে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি হুর ,অনেক বড় ভুল । ”

আপুর কথা শুনে আমি থম মেরে বিছানায় বসে পড়ি। আপু বলা প্রতিটা কথা কানে বাজছে । মাথায় শুধু একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে । মামা জানলে কি হবে ?
আপু এখনো কান্না করে যাচ্ছে।
আশ্চর্য হচ্ছি আবির ভাইয়ার কাজে । যদি মায়ের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে দাড়ানোর সাহস না থাকে তবে কেন ভালোবাসে ?
মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে । কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না । কিন্তু যাই হোক না কেন আমি হিয়া আপু আর তার বাচ্চাকে তাদের পাপ্য সম্মান আর অধিকার দিয়েই ছাড়বো ।
আপুকে কোনো ভাবে শান্ত করে নিজের রুমে চলে যাই । সারারাত ভর চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেই যে আমি আবির ভাইয়ার মায়ের সাথে সরাসরি দেখা করবো । উনাকে আবির ভাইয়া আর হিয়া আপু সম্পর্কের কথা জানাবো । কেন জানো মনে হচ্ছিলো উনি আমার কথা বুঝবে । আবির ভাইয়া আর হিয়া আপুর সম্পর্কটা মেনে নিবে ।
যেই ভাবা সেই কাজ !
পরের দিন সকাল হতেই আপু থেকে ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি আবির ভাইয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে ।

সেদিন ভার্সিটি না গিয়ে চলে যাই আদ্রিতা খাঁনের বাড়ী তে। বিশাল বড় বাড়ি । আমাকে দেখতেই দাড়োয়ান এগিয়ে এসে জিগাসা করে আমার কি চাই । আমি বললাম আমি আদ্রিতা খাঁনের সাথে দেখা করতে চাই । দাড়োয়ান ভিতরে ফোন করে পার্মিশন নেয়।বিরাট লোকের বিরাট কারবার । আমি ভিতরে যেতেই একজন মহিলা আমাকে বসার রুমে নিয়ে যায় । সম্ভবত কাজের লোক । আমি চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছি । কিছুক্ষণ পরই একজন সুন্দরি মহিলার আগমন ঘটে । আমার আর বুঝতে বাকি রইল না উনিই আদ্রিতা খাঁন । আমি সালাম দিতেই উনি মুচকি হেসে আমার সালামের উত্তর নেয় । আমি নিজের জড়তা ভেঙে আবির ভাই আর হিয়া আপুর সম্পর্কের ব্যপারে সবখুলে বলি । আমার কথা শুনে প্রথমে উনি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে । আমার বেশ ভয় করে যদি উনি মেনে না নেয় তো ? কিন্তু তিনি আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে । তার পর আবির ভাইয়াকে ডেকে সবটা যাচাই করে।আবির ভাইয়া থেকে সবটা শুনে বেশ রেগে যায় কিন্তু পরবর্তীতে সম্পর্কটা মেনে নেয় । আমার যেন আনন্দের সিমানা থাকে না । বাড়ি ফিরে আপুকে খবর দিতেই আপু খুশিতে লাফাতে থাকে । সাথে আমিও ।
পরদিনই আবির ভাইয়ার বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। মামা মামী কে আপু আর ভাইয়ার সম্পর্কের কথা জানাই । প্রথমে মামা মামী ও আদ্রিতা আন্টির মত বেশ রেগে ছিলো । কারণ কোন বাবা মায়ের কাছেই ব্যপারটা সিম্পল না। আর তা মেয়ের প্রেগন্যান্সি নিয়ে তো একদমই না । এমন একটা ব্যপারে রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক । কিন্তু পরে ঠান্ডা মাথায় সবটা ভেবে রাজী হয়। ছেলে ভালো ফেমেলি ভালো মামা মামী ও কোন আপত্তি করে না । সেদিনই বিয়ের তারিখ ঠি ক করা হয় । দু সাপ্তাহ পরে বিয়ের ডেট । সময় কম আর কাজ অনেক !
সেদিন থেকেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।

আজ হিয়া আপুর হলুদ। পুরোবাড়ি ভরা মানুষ । শত কাজ তার উপর আবার ডাকাডাকি । হুর এটা করে দে ,হুর ওইটা করে দে !
উফফ ,আমারও তো একটা ছোট্ট প্রাণ নাকি! এতকাজ একা কি করে সামলাই ?
এমন সময়ই শুনতে পাই ছেলের বাড়ি থেকে হলুদের তথ্য নিয়ে এসেছে ।খুশি মনে সেদিকে এগিয়ে যাই তাদের বরণ করতে । কিন্তু সেখানে যাবার পর হাজার বল্ডের ঝাটকা খাই ।
ওমাই গড ,ওমাই গড ,ওমাই গড !
সামনে অগ্নি ভাইয়া দাড়ানো ! এখানেই ব্যপারটা থেমে নেই ,এর পর যা শুনলাম তা শুনার পর আমি হার্টফেইল করার উপক্রম ।উনি ই আবির ভাইয়ার একমাত্র ভাই । ভাবা যায় ব্যপারটা ?
এখানে ব্যপারটা থামতে পারতো কিন্তু তা হলো না । মামী আমার কাছে এসে বেশ শক্ত গলায় বলল ,

– “হুর ,অগ্নি আমাদের বাড়িতে এই প্রথমবার এসেছে তুই তার খেয়াল রাখবি । ”

আমি শুধু বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ালাম । মামী অগ্নি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে ,

– “বাবা অগ্নি ,তোমার কিছুর প্রয়োজন হলে হুর কে বলবে । কেমন ? ”

বাবা অগ্নি ও মনে হয় এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো । আমার দিকে তাকিয়ে বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলে ,

– “আন্টি আপনি একদম চিন্তা করবেন না । হুর তো আমার সাথেই আছে । তাই না হুর ?

আমি জোরপূর্বক হাসি দিলাম ।মামী মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো । আমি ঠাই দাড়িয়ে ।
ওই যে কথায় আছেনা ? যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয় । আমার সাথে ও এমন কিছুই হলো । অগ্নি ভাইয়া আমার কাছে এসে ভ্রু নাচিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে ,

– “এবার কই পালাবে সুন্দরী ??? ”

বর্তমান_____________________

হ্ঠাৎ ই ঘড়ির এলাম বেজে উঠে । ঘুমঘুম চোখে বিরক্তির নিয়ে এলামটা বন্ধ করি । আসে পাশে তাকিয়ে দেখি আমি বিছানায় । গায়েঁ চাদর জড়ানো । এ কি আমি বিছানায় কি করে ? আমার যতটুকু মনে পরে কাল রাতে আমি নিচে ছিলাম তাহলে এখানে কি করে আসলাম !
ম্যাজিক নাকি ? এসব ভাবতে ভাবতেই কপালে কাটা জায়গায় হাত চলে যায় ।হাত লাগতেই বুজতে পারি সেখানে ব্যান্ডেজ লাগানো । এই ব্যান্ডেজ আবার কে করলো ? এই রুমে তো আমি আর অগ্নি ভাইয়া ছাড়া অন্যকেউ নেই । তবে কি অগ্নি ভাইয়া ?
সাথে সাথে উনার দিকে তাকালাম । উনি সোফায় ঘুমাচ্ছেন ।তার অর্ধেক টা শরীর সোফায় আর অর্ধেকটা ফ্লোরে । এক হাতে মদের বোতল । মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো বেশ বড় হয়েছে । একদম কাবির সিং প্রো মেক্স লাগছে ।
উনি কি করে এসব করবে তাছাড়া উনি আমাকে ঘৃনা করে আমি মরে গেলেও তার কোনো কিছু যায় আসে না । আমিই হয়তো রাতে ঘুমের ঘোরে এসব করেছি । আমার ঘুম খুব খারাপ । খুব বেশিই খারাপ । ঘুমের ঘোরে কি করি না করি হুস থাকে না । পরে তা ভেবে ভেবে নিজের মাথা খারাপ করি ।
মনে এক অদ্ভুত ইচ্ছা জাগলো । কেন জানো তার দাড়ি গুলোতে হাত বুলাতে ইচ্ছে করছে । তার কাছে যাবো একবার ? না থাক !
যদি ঘুম ভেঙে যায় তাহলে আমার আর রক্ষা নেই । কাল রাতে খুন করার ধমকি দিয়েছে কাছে গেলে খুনই না করে ফেলে । যা লোক বাপ রে !
ভেবে নিলাম শুনবো না মনের কোনো কথা । কিন্তু মন যে বড্ড অসভ্য ।ঠিক ছুটে চলেছে উনার দিকে সাথে শরীরটাও সায় দিচ্ছে । উনার সামনে হাটুঁ গেড়ে বসি। উনি শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। কেন জানো উনার মায়া ভরা চেহারা আমাকে উনার দিকে আকৃষ্ট করছে । আমি উনার দিকে আরো ঝুঁকে আরো গভীর ভাবে তাকে দেখতে লাগি । তার ফর্সা গালে দাড়িগুলো বেশ মানিয়েছে । উনি বাচ্চাদের মত নিচের ঠোঁট ভিতরে নিয়ে ঘুমাচ্ছে । আনমনেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে । যেই তার গালে হাত ছোঁয়াতে যাবো ওমনি উনি চোখ খুলে । আমি বরফের মত জমে যাই । উনি কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টি তে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । হয়তো কি হয়েছে বুঝার চেষ্টা করছে। আমি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে নেই । আচানক উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় । আমি নিচে পড়ে যাই । উনি সোফা থেকে উঠে আমার দিকে এক পা এক পা করে আগাচ্ছে । উনার চোখে মুখে ভয়ংকর রাগ ।আমার ভয়ে হাত পা কাপঁছে ।আমি মনে মনে আল্লাহ্‌ কে ডাকছি আর পিছনের দিকে যাচ্ছি ।

চলবে…….❤️