শিকড় পর্ব-০৪

0
162

শিকড়
পর্ব-৪

পুকুর ঘাটে বসে আবিদ ভাবছে, মানুষের জীবন কি বিচিত্র। আর তিনদিন পর তার ত্রিশ বছর হবে। এতোগুলা দিন সে একরকম ছিলো, আর গত কয়েকদিন থেকে আরেকরকম। মোবাইল বের করে কল দেয় তার আব্বুকে।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আস সালাম।
-কি করো আব্বু?
-এইতো,আকাশ দেখি।
-আমিও তে আকাশ দেখছি আব্বু।অনেক তারা আজ।
-হুম।
-আম্মু কি করেন?
-তোর ফোনের অপেক্ষা।
চুপ হয়ে যায় আবিদ।এ কোন দোটানায় পরল সে।
-আবিদ।
-জি আব্বু।
-সবার সাথে দেখা হয়েছে?
-না।ঐ বাড়ির আর আশেপাশের কয়েকজন পুরুষের সাথে দেখা হয়েছে শুধু।
-ওহ।
-আম্মুকে একটু দাও আব্বু।
-হম।
-বাবা কেমন আছিস?
-আসসালামু আলাইকুম আম্মু। আমি ঠিক আছি।তোমাকে না বলেছি আমার জন্য একদম চিন্তা করবে না,এমনিতেই অসুস্থ তুমি।
-ওয়ালাইকুম আস সালাম। আর অসুখের কথা বলিস না তো বাবা।এই অসুখের কারনেই এতোগুলো বছর আমরা দেশছাড়া।
-এখন তোমার ছেলে ডাক্তার, আর সমস্যা নেই।এবার আমরা পাকাপাকিভাবে দেশে চলে আসবো।
-ওদিকের কি খবর,কিছু তো বললি না আমাকে।
-এইতো খাওয়া দাওয়া করে পুকুর ঘাটে এসে বসলাম।বেশ ভালো লাগছে এখানে বসতে।
-ঠিকমতো খেয়েছিস তো, কোন অসুবিধা হয়নি তো?
-না না আম্মু। ঠিকমতো না বরং বেশিই খেয়েছি। বেশ অনেকগুলো আইটেম ছিল, আর রান্নাটাও সেইরকম।
-ওহ।
-আম্মু
-হুম
-মন খারাপ হলো তোমার? সর‍্যি
-বোকা ছেলে, একটুও মন খারাপ হয়নি আমার।
-ঔষধ খেয়েছো?
-খেয়েছি।
-তাহলে ঘুমিয়ে পর তোমরা, কাল কথা হবে।একটুও রাত জাগবেনা বলে দিলাম।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
-আল্লাহ হাফেজ।
-আল্লাহ হাফেজ।

আরও কিছুক্ষণ ওইভাবেই বসে রইলো সে।এলোমেলো ভাবনাগুলো কিছুতেই গুছিয়ে আনতে পারছে না।
অনেক ছোটবেলায় যখন দেশে ছিলো, তখনকার কথা তেমন মনে পরে না ওর।ভিডিও কলের সুবাদে আত্নীয় স্বজনের সাথে পরিচিত হয়। আম্মুর চিকিৎসার জন্যই ওখানে যাওয়া।ধারাবাহিক চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয় বলে ওখানেই থেকে যান তারা।আসলে, দেশে আসতে ভয়ও পেতেন, যদি হঠাৎ বাড়াবাড়ি হয়।ক্যান্সারের প্রথম দিকেই সনাক্ত হওয়ায় এখনো আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।আব্বু আম্মু দু’জনই বলতেন,তুই ডাক্তার হলেই আমরা দেশে ফিরে যাবো। আর তো ভয়ের কিছু নেই তখন।
আসাদের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আবিদের।
-ডাক্তার সাব,ঘরে চলেন।মশা অনেক এইহানে।
-কই,মশা তো তেমন নাই।
-তাইলে মনে হয় আপনে মেহমান দেইখা সম্মান দিছে।
-হা হা হা।চলো যাই।
-চলেন।
-তুমি কি করো?
-কিচ্ছু করি না।
-মানে?
-আমার কামকাজ করতে ভালা লাগে না।
-এটা তো ঠিক না।সবারই তো কাজ করা উচিৎ। বিদেশে নারী পুরুষ সবাই সমানভাবে একই কাজ করে।
-আপনে জানলেন কেমনে?বিদেশে গেছেন কহনো?
-আমি তো গতকালই বিদেশ থেকে ফিরলাম।
আনন্দে চকচক করে উঠে আসাদের চোখ মুখ।
-আপনে বিদেশ ফেরত ডাক্তার? আমার বউডারে একটু দেহবেন?
-কি সমস্যা তোমার বউয়ের?
-সেইডা জানলে তো আর ডাক্তার লাগতো না।
-তাও তো কথা।
-পোলামাইয়া হইলো না এহনও।অবশ্য হেয় মনে করে অমঙ্গলের ছায়া পরছে তার উপরে।
-মানে??ঠিক বুঝলাম না।
কথা বলতে বলতে তারা ঘরে চলে আসে।চুপ হয়ে যায় আসাদ।জমির আলী বলেন,
-এই ঘরে ঘুমাইতে আপনের একটু কষ্ট হইবো,কিন্তু এরচেয়ে ভালা ব্যবস্হাতো আর এইহানে নাই।
-আমার কোন কষ্ট হবেনা।আপনি চিন্তা করবেন না।
-ডাক্তার সাব,আমার পরিবার আপনের সাথে দেখা করবে,আপনের কোন অসুবিধা নাইতো?
আবিদের হার্টবিট যেন সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। মুহূর্তে সামলে নেয় নিজেকে।
-না না। অসুবিধা থাকবে কেন?

ভিতরে আসেন আসমা বেগম। এগিয়ে যায় আবিদ। পা ছুঁয়ে সালাম করে। আসমা হতবুদ্ধি হয়ে দেখেন তার স্বামীর কথা একদম ঠিক। ছেলেটা দেখতে পুরো আসমার শ্বশুরের মতো।তাল সামলাতে না পেরে মাথা ঘুরে পরে যান তিনি। সাথে সাথে আবিদ ধরে ফেলে।বিছানায় শুইয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।একটু পর চোখ খুললেন আসমা।আবিদ জানতে চায়
-কেমন লাগছে এখন?
-ভালা।(কথা যেনো হারিয়ে ফেলেছেন)
-আপনার কি শারীরিক কোন সমস্যা আছে?
দুপাশে মাথা নাড়েন আসমা।
-আমি একটু চেকাপ করি??
-আচ্ছা।
-আবিদের স্পর্শ যেন আসমার মাতৃত্ব জাগিয়ে তুলে। এতো এতোগুলো বছর যেই অনুভূতিকে সে নিজে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল।

সেদিন তার ছেলের জন্মের পরের ঘটনা আজ অব্দি কাউকে বলেননি তারা।শূন্য হাতে বাড়ি আসার পর সবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েও মুখে কুলুপ এটেছিলেন।আদর করে,ভালোবেসে জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে অনেক খারাপ কথাও তারা শুনেছিলেন।জমির আলীর বড় বোনতো বলেই বসলেন,বাইচ্চা কি তোরা বেইচ্যা দিছস,কতো টেহা পাইলি ক!!
নিরুত্তর জমির-আসমার সাথে কথা বলে লাভ নেই, ভেবেই আস্তে আস্তে সবাই এই বিষয়টা এরিয়ে চলতে থাকেন।যে কারনে পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই জানেনা এই বিষয়টা। তারা আড়ালে আসমাকে বাজা বলে ডাকে।আসমা – জমির আলী দুজনেই জানেন এটা।তবুও তারা কখনো প্রতিবাদ করেন নি।কথায় কথা বাড়ে।তারা যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
-আপনার রান্না খুব মজা।এতো রান্না করতে গেলেন কেন?
আবিদের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আসমার।
-আপনের ভালা লাগছে বাবা।
-খু উ উ ব।
আবিদের ছেলেমানুষী দেখে আসমা হেসে উঠেন।
-বাবা,আপনের এইহানে থাকতে কষ্ট হইবো,গরমও লাগবো।
-হু,ভাবছি সকালেই চলে যাবো।

(চলবে)