শিকড় পর্ব-০৮

0
152

শিকড়
পর্ব-৮

সকালবেলা গায়ের পথ ধরে হাটতে বেশ ভালো লাগছে আবিদের।কি আরামদায়ক একটা পরিবেশ। ফজরের নামাজের পর কিছু একটা ওর খাওয়া লাগে,আজ নামাজ পরে বসে আছে, কি খাবে ভাবছে। এমন না যে বাড়ির সবাই ঘুমে।উনারাও নামাজের সময়ই উঠে পরেছেন।শব্দ পেয়েছে আবিদ।হয়তো বসে চা খাচ্ছেন কিন্তু সমস্যা হল ওর দরজা খুলতে ইচ্ছে করছে না। তাই উনারাও বুঝতে পারছেন না যে,ও জেগে আছে। হঠাৎ চোখে পরল রাতে ওর জন্য রুমে নিয়ে আসা খাবারের দিকে।ফল-মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। প্যাকেট খোলে দু পিস বিস্কিট খেয়ে নিল।আবারও কিছুক্ষণ ঘুমানোর আশায় বিছানায় গেল,কিন্তু না, ঘুম আর আসল না।আলগোছে দরজা খুলে হাটতে বেড়িয়ে গেল।
কিছুদূর যাওয়ার পর একটা মক্তব।ছুটি হয়েছে মাত্র। পিচ্চি পিচ্চি ছেলেমেয়েরা কি সুন্দর টুপি মাথায় দিয়ে,ওড়না মাথায় দিয়ে দলবেঁধে চলেছে। বাচ্চাগুলো ওকে ফিরে ফিরে দেখছে, অচেনা মানুষ বলেই হয়তো।ভীষণ খারাপ লাগছে আবিদের, লাগেজে কত্তো চকোলেট, কিছু সাথে আনলে তো ওদের দিতে পারতো।ওরাও খুশি হতো।মনে পরছে আসার আগে রেনু বলেছিলেন,
-তোর লাগেজগুলো নিবি না?
-নাহ,ওখানে ওগুলোর দরকার নেই।
-কখন,কোথায়, কি দরকার হবে তা কি সবসময় আগে থেকে বোঝা যায়?
-আম্মু, ওই গিফট আইটেম আমি ওখানে কাকে দিবো?
-এখানেই বা কাকে দিবে?সাথে করে নিয়ে যাও।কাজে লাগতে পারে।
আবিদ হাসে, আম্মু সবসময়ই ঠিক কথা বলে,এখন আবার প্রমান পেল ও।আনমনে হেটে হেটে অনেকটা পথ চলে এলো ও।হঠাৎ আসাদের ডাকে থমকে দাড়ায়।
-ও ডাক্তার সাব।কই যান।
-কই আর যাবো, এমনি হাটছিলাম।
-কাউরে কইবেন না,চাচা চাচীতো চিন্তায় শেষ এক্কেরে।
বেশ ভালো লাগছে আবিদের। ওর জন্য উনারা ভাবছেন। হঠাৎ ওর মনে পরল গতরাতের কথা।আসাদ কে কি সরাসরি জিজ্ঞেস করবে?না থাক,কথা বলতে বলতে হয়তো জানা যাবে।তাড়াহুড়ো করলে বরং সব আরও জট পাকিয়ে যাবে।
-আচ্ছা আসাদ
-জি
-তুমি কাল যে বললে তোমার স্ত্রীর নজর লেগেছে…..
-না না,আমি কই নাই।হেয় নিজেই কয়।
-কিসের নজর?
-হেয় জানে।
-তোমরা এগুলো বিশ্বাস কর।নজরে কি কখনো সন্তানধারন ক্ষমতা নষ্ট হয়?
-আমি বড় বিপদে আছি ডাক্তার সাব।হেয় তো খালি ওই একখান কথাই গান বানছে।
-তা ওর কি ধারণা, কিসের নজর লেগেছে?
-আমি কইতে পারুম না।
-তাহলে কিভাবে হবে,না জানলে তো তোমার স্ত্রীকে দেখে লাভ নেই। আমি কিছু ধরতে পারবো না।
-কি কন?
-হুম।
-ডাক্তার সাব
-বল
-আমার বউটা বেশি ভালা না,কারও সাথে মিলমিশ নাই।এহন আবার….
-তুমি বলো আসাদ।
-আমারে ছোটত থাইকাই এই চাচীই মানুষ করছে। আমি তার কাছে যতো সময় থাকতাম,মায়ের কাছেও ততোসময় থাকতাম না।কিন্তু এহন আর আমি চাচীর ঘরে বেশি যাইতে পারি না।
-কেন??
-গেলেই বউয়ে ঝগড়া করে।
-কিন্তু কেন?
-আমার এতো ভালা চাচীডা নাকি অপয়া।হের কাছে গেলে আমাদের ক্ষতি হইবো।
-মানুষ অপয়া হয় কিভাবে। আর ক্ষতি বলতে? কি ক্ষতি হবে?
-বউয়ে মনে করে চাচীর কুনজরে চাচীর মতো আমরাও বাইচ্চা পামু না।
-কি বলো?
-হ,ডাক্তার সাব।এইটা নিয়া যে কি অশান্তি করে,অনেক বুঝাইছি,বুঝেনা।
শেষ কথাগুলো আবিদের কানে পৌঁছে না।কেমন যেন একটা লাগছে ওর।বুকের ভিতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন?
-চলেন,চাচী পাডাইছে আপনেরে লইয়া যাইতে।
-তুমি যাও আসাদ,আমি একটু পরে আসছি।
– জি না,জি না।চাচী রাগ হইবো।
-চলো তাহলে।
গতকাল রাতে যখন ও আসে তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। এখন বুঝতে পারছে বাড়িটা আসলে কতো বড়।আসাদ ওকে নিয়ে ভিতরের উঠোনে যায়।আসমা এগিয়ে এসে মোড়া দিয়ে বলেন
-না কইয়া কই গেছিলা।আসাদরে কইলেই তো যাইতো।অচেনা পথঘাট।
-একটু হাটতে বেড়িয়েছিলাম।
-বসো,চা লইয়া আসি।
একটা বড় প্লেটে চার কাপ চা,সরিষা তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি ও আবিদের আনা কেইক নিয়ে আসেন তিনি।
-আপনারা খাননি?
-হুন কথা, মেহমান থইয়া কেমনে খাই।
হু হু করে উঠে আবিদের বুক।নিজের বাড়িতে ও নিজেই আজ অতিথি।
চা খাওয়ার পর ওকে নিয়ে ভিতরের ঘরে যান আসমা।ঘুরে ঘুরে দেখান নিজেদের ঘরগুলি।শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর গল্পও করেন।বেশ ভালো লাগে আবিদের।
-বাড়িটা অনেক আগের, তাই না?
-হুম
-জিনিসপত্র ও।এই খাটটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কি সুন্দর!!
-এইডা আমার শ্বাশুড়ির বিয়ার সময়ের খাট।তখনকার জিনিস কতো মজবুত দেখছো?
-জি,আচ্ছা উনাদের ছবি নেই?
-আছে, তয় পাসপোর্টের লাইগ্যা যে ছোট ছবি, সেইডা।আমরা কেউই ছবি টবি উঠাই না তেমন।এহনকার পোলাপানগুলা অবশ্য সারাক্ষণই মোবাইলে ছবি উঠায়।যতোটা কথা কয়,তার থেইক্কা ছবি উঠায় বেশি।
হেসে উঠে আবিদ।আসমার সাথে গল্প করতে ওর এতো ভালো লাগছে, ঘর শেষ করে পুরো বাড়ির সীমানা ঘুরা শেষ গল্প করতে করতে।
-চলো,চাউলের গুড়ির রুটি করছি।মাংস দিয়া খাইতে ভালা লাগবো।
আবিদও এতোক্ষণে ক্ষিদে টের পেল।অনেক সময় হাটা হলো।সকাল থেকে জমির আলীকে একবারও দেখেনি ও।জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কি ডেকে জানতে চাইবে।নিজের জন্মদাতাকে তো আর জেনেশুনে মামা চাচা ডাকা যায় না।আসমার সাথে সাথে চলে এলো ও রাতে যেই ঘরে ছিল, সেখানে।টেবিলে নাস্তা সাজানো। আবিদকে উসখুস করতে দেখে আসমা জানতে চান
-কি হইছে বাবা,এগুলা খাইবা না?না খাইলে কোন সমস্যা নাই, কি খাইতে চাও আমারে কও।
-না না তা না।আসলে আমি একা খেতে পারি না।আপনারা যদি আমার সাথে বসতেন।
-দেখো কান্ড,মানুষডারে কইলাম আইজ বাড়িত থাকেন।ঘুম থাইক্কা উইঠা কই যে গেল…….
-কই আর যামু, এই তো আইসা পরছি।
বলতে বলতে বাজার নিয়ে ঢুকেন জমির আলী। আসমা সব ভিতরে রেখে এসে তাদের নিয়ে খেতে বসেন।
-আপনি কি আবার বাইরে যাবেন?
-ক্যান।কিছু লাগবো?কি লাগবো কও।
-না কিছু লাগবে না। আপনার সাথে আমিও একটু ঘুরে আসতাম আর কি।
-আইচ্ছা, দোকানে যামু একটু পর।নিয়া যামু তোমারে।
আবিদ খুশি হয়।এবার উনার সাথে কিছু সময় কাটানো যাবে।
-খুব মজা করে খেলাম,আলহামদুলিল্লাহ।
-আরেকটা রুটি দেই?
-আর পারবো না,এক্কেবারে পেটপুরে খেয়ে ফেলেছি।
-চা দেই তাইলে।
-না থাক।
-থাকবো ক্যান,মন চাইলে খাও।

তিনজনে বসে চা খেতে খেতে আবার জমে উঠলো গল্প। গল্পের পুরোটা জুড়ে জমির আলীর পরিবার।মা-বাবা, বোনদের সাথে কাটানো অনেক স্মৃতি। আবিদ আসমার কাছে জানতে চায়
-আপনার বাবার বাড়ি কোথায়?
-পাশের গ্রামেই।
-কেউ নেই বাড়িতে?
-থাকবো না ক্যান।বাড়ি ভর্তি মানুষ। আমার মা বাপ আছে। দুই ভাইয়ের পরিবার আছে। আমার ছোড একটা বইন আর বড় একটা বইন আছে। ওদের বাড়ি অবশ্য অনেকটা পথ। ছোডটা তো এক্কেরে শহরের কাছাকাছি।
-আসেন না উনারা এখানে?
-আসে,কম আসে।বাইচ্চাগুলারে কতো কইরা কই আইসা দুইদিন থাইকা যা,তহন আসে না।আসলে আমি বুঝি, এইহানে তাগো তেমন ভালা লাগে না। একলা একলা তো।
-আপনি গিয়ে থাকলেই পারেন।
-যাই মাঝে মইধ্যে। থাহি না।মানুষডা একলা কেমনে কি খাইবো।তুমি যাইবা বাবা?
-কোথায়?
-আমার বাপের বাড়ি।
অপ্রস্তুত হয়ে যায় আবিদ।
-সময় হবে বলে মনে হয় না।
-ওহ।

জমির আলী আবিদকে নিয়ে বেড়িয়ে যান।সাথে যোগ দেয় আসাদও।আসাদ ওর চাচাকে বলে
-দেখছেন। কি সুন্দর ধান হইছে। খামোকা জমিগুলান বেচলেন।
-কি করুম এতো ধান দিয়া?
-বেচলে কম টাকা আইতো?
-টাকা দিয়াই বা কি করুম ক।
-সেইডাও ঠিক।জমি বেচনের বেশিরভাগই তো দান কইরা দিছেন, আর বাকিগুলা বিলাইছেন।
-ক্যান, তোরে দেই নাই?
-আমি কি কইছি দেন নাই,দিছেন তো।
-এহন ক,তুই টাকাটা কোন কামে লাগাইলি।
-…….
-নেও,কথা শেষ।হা হা হা।

-এগুলো আপনার ছিলো।
-আমার বাপের। আমিও কিছু বাড়াইছিলাম।এহন আবার সব কমাই দিছি।
-কেন??
-এমনি,কেডায় খাইবো।

বলতে বলতে দোকানে পৌঁছে যান তারা। অনেক মানুষের আসা যাওয়া দোকানে। সবাই যে কাজে আসেন এমন না,অনেকে জমির আলীর সাথে গল্প করতেও আসেন।
-বুঝলা বাবা,এই মানুষের কাছাকাছি থাহনের লাইগা দোকানে বই,নাইলে এইটা বেইচা দিতাম।তাছাড়া……
-তাছাড়া?
-দোকানডা আমার মায়ের স্মৃতি।
-মায়ের?
-হুম।বাবা মা হজে যাওয়ার লাইগা চেষ্টা নিছিল।বাবায় যাইতে পারলেও মার হয় নাই।খুব মন করছিলো মা। তহন আমারে দোকানের টেকা দিয়া কইছিল,”মানুষের কাছাকাছি থাকার একটা উপায় হইলো,ভালা কইরা চালাবি। মানুষের লাইগা ভালা কাম করবি এই দোকান দিয়া,গরীব কেউ যেন টাকার অভাবে জিনিস না লইয়া ফেরত না যায়।”বেচতে মন চায় না আর, থাউক।

জমির আলী আবিদকে সিংগাড়া, জিলিপী, গজা, মোয়া খেতে দেন।
-আমি উঠি এখন।
-কই যাইবা।একলগে বাড়ি যাইমু।
-না,গতকাল বললাম না,আমি হাসপাতালে যাবো।

আবিদ অপলক তাকিয়ে দেখলো জমির আলীর চেহারার রং বদলানো।
-আসি তাহলে।তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে চলে আসবো।
-আসাদরে নিয়া যাও।
-না,আমি একা পারবো।

দেরি না করে বেড়িয়ে পরে আবিদ।একটা রিক্সা ঠিক করে দে য় আসাদ।বারবার বলে দেয় যেন জায়গামতো নিয়ে যায় আবার নিয়ে আসে।আর কোন ভাড়া যেন না নেয়।আবিদ উঠে বসে।সে তো জানে তার গন্তব্য হাসপাতাল নয়,ওখানে গিয়ে সে কি করবে?এখন যাবেই বা কোথায়? একটু একা সময় কাটানো খুব দরকার। এদিকে রিক্সাওয়ালা কে জিজ্ঞেস করলেই তো তারা জেনে যাবেন সে হাসপাতালে যায় নি।ভাবতে ভাবতেই হাসপাতালের গেটে পৌঁছে যায় ও।নেমে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে এগিয়ে যায়। এসেই যখন পরেছে, একবার জানার চেষ্টা করে দেখতে পারে।কিন্তু ভাগ্য ভালো নয় ওর।ঔ সময়ের কোন ডাক্তার, নার্স কাউকেই পায়নি সে।একজন নার্স বললেন, আমাদের এখানে অনেক আগের একজন মাসী( আয়া) আছেন। যদিও উনি এখন চাকরিতে নেই তবুও এখানেই সময় কাটান আগের মতো। উনি জানতে পারেন। উনাকে ডেকে আনা হয়।প্রশ্ন শুনে উনি অবাক হয়ে বলেন
-এতোদিন পর এই ঘটনা জানতে আইছে কেউ?
-আপনি কি তখন ছিলেন এখানে?
-হ,আছিলাম।
-আমাকে সবটা বলবেন?
-বলুম না ক্যান।।।
মাসীর কাছ থেকে সবকিছু ধৈর্য নিয়ে শুনে আবিদ।ধৈর্য নিয়ে কারন একই গল্প দুইবার শুনলো সে।ওর আব্বুর বলা আর এই মাসীর বলার মাঝে কোন ব্যবধান পায়নি আবিদ।
-উনাদের কাউকে আপনি চিনেন?
-নাহ,শহরের মানুষরে আমি কেমনে চিনমু।আর কয়েকগ্রাম পরের যারা আছিলো তাদেরও চিনি না।আপনের যদি দরকার লাগে অফিসে যাইয়া নাম ঠিকানা লইতে পারবেন। অবশ্য একটু সময় লাগবো,অনেক আগের ঘটনা তো।
উনাকে কিছু টাকা দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বেড়িয়ে আসে ও।রেজিস্ট্রার ঘেটে কিছুই জানার নেই ওর।ওর আব্বু তো রেজিস্ট্রার থেকে পাওয়া ঠিকানায়ই ওকে পাঠিয়েছেন।

(চলবে)