শুকনো পাতার বৃষ্টি পর্ব-০২

0
478

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি [০২]
#ফারজানা_আক্তার

লজ্জা করছেনা তোর একটা ফ’কি’ন্নি’র জন্য নিজের মায়ের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে? তুই তো এমন ছিলিনা, কি জাদু করেছে ওই ডিভোর্সি মেয়ে তোর উপর?”
মায়ের কথা শুনে মুচকি হাসলো আহান। তারপর কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো “তবে কঠিন সত্যি টা শুনে রেখো আম্মু সিয়া আমার মেয়ে, সিয়া আমার পরিচয়ে বড় হবে আর তুমি এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা শুনাবেনা আদিবাকে বলে দিলাম। আর হ্যাঁ আরেকটা কঠিন সত্য আছে আমার জীবনের যা একমাত্র আমি ছাড়া কেউই জানেনা আর কখনো জানবেনাও কেউ।”

“আহান তুই কিন্তু ভুল করছিস বাবা। আদিবা মেয়েটা যদি এতোই ভালো হতো তবে ওর ডিভোর্স হয়ে যেতোনা বিয়ের একবছর না ঘুরতেই। তুই ওই মেয়েকে ছেড়ে দে বাবা, আমি আমার ভাইয়ের মেয়ে আফিফাকে বিয়ে করাবো তোকে। আফিফা অনেক সুন্দরী আর আমার ভাইয়ের অনেক টাকা পয়শা আছে তুই সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবি। আর সবথেকে বড় কথা হলো আফিফা তোকে ছোট থেকেই পছন্দ করে।”

“ছিঃ মা এতোটা লোভী তুমি আমি ভাবতেই পারিনি কখনো। সানিয়া ঠিক বলেছে তুমি খুব লোভী একটা মহিলা তুমি কখনো কারো ভালো চাওনা শুধু নিজের লোভটা সব তোমার কাছে। শুনো মা আমি তোমার মতো লোভী না, আমি আমার বাবার মতোই খেটে খাওয়া মানুষ।”
খালেদা খাতুন একদম চুপ হয়ে গেলেন নিজের ছেলের চোখে নিজের জন্য এতো তীক্ষ্ণ ঘৃণা দেখে। খালেদা খাতুন কে চুপ থাকতে দেখে আহান আবারও বলে “যাইহোক আমি আদিবাকে নিয়ে সিয়াকে আনতে যাচ্ছি কেউ যেনো এই ব্যাপারে আর কোনো কথা না বলে। আমার মেয়ে আমার সাথেই থাকবে। আর হ্যাঁ আজ রাতে ওখানেই থেকে যাবো। চললাম, আল্লাহ হাফেজ।”

কথাগুলো বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো আহান। খালেদা খাতুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আহানের যাওয়ার দিকে। হঠাৎ করে খুব কষ্ট হচ্ছে খালেদা খাতুনের আবার ভীষণ রকম রাগ হচ্ছে আদিবার উপর।
আহান রুমে যেতে যেতে আফজাল খানের সাথে কথা বলে জানিয়ে দিলো সে শ্বশুড়বাড়িতে যাচ্ছেন। ছেলের সততাই ভীষণ খুশি আফজাল খান। আফজাল খান সবসময়ই মনে মনে চেয়েছেন তার ছেলে যেনো কোনো গরিব ঘরের অসহায় মেয়েকে বিয়ে করে আর আহান তার সেই আশাটাই পূরণ করেছে অজান্তেই। আফজাল খান মনে মনে এটা চাইলেও মুখে কখনো উচ্চারণ করেনি আহানের সামনে এই বিষয়ে কোনো কথা।
আহান রুমে প্রবেশ করে আদিবাকে উদ্দেশ্য করে বলে “হয়েছে তোমার?”
খুব নরম সুরে আদিবা বলে “হু হয়েছে।”
এই মিষ্টি কন্ঠের ছোট্ট শব্দটা আহানকে মুগ্ধ করে বারংবার। যতই মন খারাপ থাকুক আদিবার কাছে আসলেই মন ভালো হয়ে যায় আহানের। আদিবা তৈরি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর খুঁটে খুঁটে দেখছে নিজেকে। আহান ধীর পায়ে আদিবার পেঁছনে গিয়ে কানে কানে বলে “এভাবে দেখোনা আমার হুরপরীকে নজর লেগে যাবে।” সাথে সাথেই লজ্জায় মাথা নুঁইয়ে নেয় আদিবা। আদিবার ঠোঁটের চিকন হাঁসি স্পষ্ট ফুটে উঠছে। আহান মৃদু হাঁসে আদিবাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে। মেয়েটা বেশ লাজুক, একটুতেই লজ্জায় লালছে হয়ে যায়। শ্যামবর্ণ চেহারার মায়াবী সুন্দরী আদিবা আহানের দৃষ্টিতে। আহান একটু কেঁশে বলে “এতোটা লজ্জা পেওনা গো মায়াবতী নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবোনা এই ভরদুপুরে।”
ফিসফিস করে কথাটি উচ্চারণ করেই ওয়াশরুমে চলে যায় আহান। আদিবা বেশ লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে। মানুষটা বড্ড সরল, যা বলার স্পষ্ট ভাবে বলে দিবে কোনো সংকোচ ছাড়া। এই কারণেই হয়তো আদিবার এতো দ্রুত এই মানুষটাকে পছন্দ হয়ে গিয়েছে। সিয়ার কারণেই এই সৎ মানুষটাকে আদিবা নিজের করে পেয়েছে।সিয়ার প্রতি এক অদ্ভুত টান আছে আহানের। তবে এখনো একটা সত্যি আদিবার কাছে অজানা।

আহান ড্রাইভ করছে আর আদিবা ওর পাশে চুপচাপ বসে আছে। আদিবাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আহান বলে “সিয়ার কাছে যাচ্ছি আমরা তোমার তো খুব বেশি খুশি হওয়ার কথা কিন্তু তা না করে মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে আছো কেনো?”
আহানের করা প্রশ্নের উত্তরে আদিবা শুধু এইটুকুই বললো “কিছু সত্য পৃথিবী সমান খুশি দেয় আমাদের আর কিছু সত্য আছে যা ভ’য়ং’ক’র অ’গ্নি’তে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে।”
আদিবার এমন কথায় হুট করেই ধুকপুক করে উঠে আহানের বুক। কেঁপে উঠে সমস্ত শরীর। গাড়ির জানালা খোলা এতো এতো বাতাসের মধ্যেও কপালে ঠোঁটের নিচে ঘেমে গেছে আহানের। কোনো ভয় প্রবেশ করলে আহানের মনে তখনই কপাল আর ঠোঁটের নিচে ঘেমে যায় ওর। হঠাৎ এই কোন সত্যির কথা বললো আদিবা বুঝতে পারছেনা আহান। কখনো কোনো কথা স্পষ্ট করে বলেনা মেয়েটা। অদ্ভুত ধরনের এক মেয়ে। মনের কথাগুলো কখনোই স্পষ্ট করে কারো সাথে শেয়ার করবেনা। শুধু গম্ভীর হয়ে একাকী চিন্তা করবে যা আহানকে কাঁপিয়ে রেখে দেয়। আহানের গোপন সত্যটা জেনে গেলো না তো আদিবা? এই ভয়েই ঘামছে সে।
আহান ঠা’স করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আদিবার দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে “কিছু কিছু কথা স্পষ্ট বলতে হয়, সব কথা অস্পষ্ট রাখলে বুঝতে বড় কষ্ট হয়।”

“গাড়ি স্টার্ট করুন, সিয়ার সাথে দেখা করার অপেক্ষা আর হচ্ছে না আমার। আমি তেমনভাবে কিছুই বলিনি যে আপনার বুঝতে অসুবিধা হবে।”

আদিবা কথাটি বলতেই লক্ষ করে আহানের মুখ ঘেমে আছে। সে দ্রুত হাত ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ঘামগুলো মুচে দিলো খুব যত্নে আর মৃদু করে একটা হাঁসি দিলো।
আহান হতাশ হলো। এই মেয়ের পেট থেকে কথা বের করা মোটেও সহজ কাজ নয়। আহান গাড়ি স্টার্ট দিলো।
আদিবা আহানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবতে থাকে কিভাবে বলবো মনের লুকানো কথাগুলো? আপনার মতো একজন মানুষ পেয়েছি ভাগ্য করে। আপনাকে আর কতোই বা জ্বা’লা’বো। আমার তো শুধু নিজের উপরেই খুব ঘৃণা হচ্ছে, এতোদিন পর নিজের মেয়ের সামনে কোন মুখ নিয়ে যাবো আমি? সিয়া কি পারবে ক্ষমা করতে আমায়? আমি যে কিছুতেই সিয়ার মুখোমুখি হতে পারবোনা। আমি তো আমার মিষ্টি মেয়েটার মা হওয়ারও যোগ্য না। আমি যদি ভালো মা হতাম তবে কখনোই এইটুকুন বাচ্চা মেয়েটাকে একা রেখে নিজের সুখ খুঁজতে বেরিয়ে পরতাম না। আমি খুব খুব খারাপ মা। আমি একজন স্বার্থপর মা। আমি একবারও নিজের মেয়ের কথা ভাবিনি শুধু নিজের কথায়-ই ভেবে গিয়েছি। বিয়ের দিন বিদায়ের ঠিক আগ মুহুর্তে শ্বাশুড়ি মা বলেছিলেন যদি সিয়াকে আমি আমার সাথে করে ওই বাড়িতে নিয়ে যায় তবে উনি আমার মেয়েটাকে আমার থেকে চিরদিনের জন্য আলাদা করে দিবেন সেই ভয়ে আমি আর ওকে আমার সাথে ওই বাড়িতে নিতে চাইনি। এখন সিয়াকে ওই বাড়িতে নিলে উনি সত্যি সত্যি যদি আমার মেয়েটাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেন তবে কি নিয়ে বাঁচবো আমি? আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো আমার প্রাণটাকে ছাড়া। সব সত্যি তো আর আপনাকে বলতে পারছিনা সিয়ার বন্ধু। কিছু সত্যি খুব তিতা হয় যা সবাই সহ্য করতে পারেনা আপনিও হয়তো সহ্য করতে পাবেননা নিজের মায়ের এমন আচরণ।

গাড়ি থামতেই ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে আদিবা। আহানের দিকে তাকিয়ে বলে “সিয়ার বন্ধু আমরা এতো দ্রুত কিভাবে এসে পৌঁছালাম?”
“সারা রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকলে সময়ের হিসাব কিভাবে মিলাবেন সিয়ার আম্মু। ঘড়ি দেখো বিকাল হয়ে এসেছে।”
মৃদু হেঁসে বলে আহান। আদিবা বেশ লজ্জা পেয়ে যায়।
“আর লজ্জা পেতে হবেনা নেমে আসুন এবার।”
গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলে আহান।”

গাড়ি বাসা থেকে একটু দূরে একটা সাদা মাঠে পার্ক করেছে তাই আরো কিছুটা পথ হেঁটে বাসায় যেতে হবে।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দু’জনের কর্ণকুহর হলো সিয়ার চিৎকার চেঁচামেঁচির, কাঁদতে কাঁদতে যেনো হাঁপিয়ে উঠেছে ছোট্ট প্রাণটা। আদিবা সিয়ার কান্নার শব্দ শুনে আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলোনা। দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে। মা মেয়ে দু’জনেই সমান তালে কেঁদে যাচ্ছে। আহান শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দৃশ্যটা। আহানের চোখের কোণেও জল জমাট বেঁধেছে। এতোদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে যেনো দেহে প্রাণ ফিরে পেলো আদিবা। মেয়ের চোখমুখ সব মুচে দিয়ে আহানের দিকে আঙুল তুলে আদিবা বলে “দেখো আম্মু কাকে নিয়ে এসেছি তোমার বন্ধুকে এনেছি।”
সিয়া একবার তাকিয়ে আহানের দিকে আবার মুখ ফিরিয়ে আদিবার বুকে মুখ গুঁজে ফেলে। আহান অবাক হয় যে মেয়ে ওর জন্য পাগল ছিলো সেই মেয়ে ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানতে পারছেনা সে। আদিবা খুব যত্ন করে সিয়াকে জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে আমার মামণিটার? বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে আদর দিচ্ছে না কেনো আজ?”
সিয়া মুখ ফুলিয়ে হ্যাঁচকি তুলতে তুলতে বলে “আমি জানি আম্মু বন্ধু পঁচা খুব পঁচা, বন্ধু তোমাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে চলে গেছে। বন্ধু একটুও ভালোনা।”
সিয়ার কথা শুনে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আহানের। মেয়েটা মাকে ছাড়া খুব ভেঙ্গে পরেছে বুঝতে পারছে আহান।
আদিবা আদর মাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে “এসব কথা তোমায় কে বলেছে মা?”
“কেনো সবাই-ই তো বলে। আমি যখন তোমার কাছে যাওয়ার জন্য জোরে জোরে কান্না করি তখন পাড়ার মহিলারা এসে এগুলো বলে আর নানুকেও খুব কথা শুনায়।”
থেমে থেমে ধীর কণ্ঠে কথাগুলো বলে সিয়া। আদিবা সব বুঝে গেছে এসব কারা বলতে পারে তাই সে আর সিয়াকে জেরা করেনি। সমাজে এমন মানুষের অভাব নেই। মানুষকে খোঁটা দিয়ে কথা না বললে মানুষকে বিনা কারণে কষ্ট না দিলে তাদের দিন চলেনা। বরাবরই এসব মানুষকে অপছন্দ করে আদিবা এবং দূরত্ব বজায় রাখে এসব মানুষের কাছ থেকে।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।।