শুকনো পাতার বৃষ্টি পর্ব-০৩

0
613

#শুকনো_পাতার_বৃষ্টি [০৩]
#ফারজানা_আক্তার

নিস্তব্ধ বিকেলে নির্জন প্রহরে ঘুমিয়ে যায় সিয়া মায়ের বুকে। ঘুমের মধ্যেই মেয়েটা কেমন জানি বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে, এর নাম দীর্ঘশ্বাস। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আদিবার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। মেয়ের এমন অবস্থার জন্য বারংবার নিজেকেই দোষারোপ করছে আদিবা। সিয়া ঘুমিয়ে গেলে সিয়াকে খুব যত্ন সহকারে শুইয়ে দেয় ওর বিছানায়। তারপর নিজের মায়ের কাছে গিয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আদিবা। আদিবার মা ফাতেমা বেগমও শব্দ করে কেঁদে ফেলেন। মাকে কাঁদতে দেখে দ্রুত ঢুক গিলে ফেলে আদিবা তারপর নিজেকে কন্ট্রোল করে নিজের চোখের জলগুলো মুছে মায়ের দুই গালে আলতো করে হাত ছুঁয়ে বলে “আমার জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে মানুষের কাছে তোমাকে। ক্ষমা করে দাও শেষবারের মতো আমাকে। আর কখনো আমার জন্য কারো কাছে ছোট হতে হবেনা কথা দিলাম তোমাকে আমি।” এইটুকু কথা বলে মায়ের চোখের জল মুছে দেয় যত্ন করে আদিবা। আহান শুধু দেখছে সব আর মুগ্ধ হচ্ছে। পরিবার তো এভাবেই সুন্দর। তারপর আদিবার মা ফাতেমা বেগম বলেন “তুই জামাইকে নিয়ে সিয়ার পাশে বস। আমি কিছু নিয়ে আসি খাওয়ার জন্য অনেক দূর থেকে এসেছিস।।” তখন আহান শ্বাশুড়ির যাওয়ায় বাঁধা দিয়ে বলে “কোথাও যেতে হবেনা আপনাকে আন্টি, সব প্রয়োজনীয় জিনিস আমি সাথে করে এনেছি।” আদিবা অবাক হয় আহানের কথা শুনে কারণ ও কিছু নিতে দেখেনি আহানকে তবে কবে কিনলো আহান সব জিনিসপত্র। ফাতেমা বেগম মেয়ের জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছলছল নয়নে বলে “তোমাকে দেখলে একটা ছেলে সন্তানের যে অভাব ছিলো তা আর লাগেনা। অনেক সুখী হও বাবা।” আহান আর কিছু বলেনা শুধু মুচকি হেঁসে সব এনে শ্বাশুড়ির হাতে তুলে দেয়। ফাতেমা বেগম রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যান সব খাবার আর জিনিসপত্র নিয়ে। আর আদিবাকে বলে যান আহানকে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে।
ফাতেমা বেগম চলে গেলে আদিবা আহানের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ায়। আহানের চোখে মুখে বিষন্নতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আদিবা। আদিবা আহানের হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাতের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে “আমি জানি আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন সিয়ার কথায়। সিয়া পিচ্চি একটা মেয়ে, এতোকিছু বুঝেনা। মানুষের কথায় ভীষণ আ’ঘা’ত পেয়েছে মেয়েটা তাই কথাগুলো বলেছে। আর আপনিতো জানেনই সমাজে কিছু মানুষ এমন আছেন যারা অন্যের ভালো সহ্য করতে পারেনা। আপনি হয়তো জানেন না ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে আমার এই বাড়িতে থাকতে অনেক সমস্যা হয়েছে, মানুষের কটুবাক্যে প্রতিনিয়ত খু’ন হয়েছি আমি তবুও এই মেয়ের জন্য বাঁচতে হয়েছে আমাকে। আপনি কোনো চিন্তা করবেননা আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আপনাদের বাবা মেয়ের সম্পর্ক আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ, দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।”

আহান সিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে “সিয়ার অভিমান হয়েছে। যাইহোক আসো ফ্রেশ হয়ে আসি, ওয়াশরুম কোথায়?”
আহানের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে আদিবা। আহান লক্ষ করে আদিবা কেমন জানি হাত কচলাচ্ছে।
“কি হলো আসো, ফ্রেশ হতে হবে তো।”
আদিবা থেমে থেমে বলে “আসলে বাথরুম তো বাহিরে, আপনি এই বাথরুমে মানিয়ে নিতে পারবেননা আর হাত মুখ ধৌত করতে হলে পুকুরে যেতে হবে।”

এবার কুটকুট করে হেঁসে উঠে আহান। বোকা বনে যায় আদিবা। হাঁসতে হাঁসতে আহান বসে পরে মোড়া পেতে। হা হয়ে দাঁড়িয়ে আহানের অদ্ভুত কান্ড দেখছে আদিবা।
“কি হয়েছে, এতো হাঁসতেছেন কেনো আপনি?”
ভ্রু কুঁচকে বলে আদিবা।
“হাঁসবোনা তো কি করবো? পুকুরে কত কত সাঁতার কেটেছি বন্ধুদের সাথে একসময় তুমি জানো? জানোনা, কারণ বলা হয়নি কখনো তোমাকে। আর টয়লেট নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা তা আমি ম্যানেজ করে নিবো কোনোভাবে। চিল থাকো জনাবা চিল।”
এটা বলে আদিবার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে আসে আদিবাকে আহান। পুকুরঘাটে যেতেই কিছু মহিলা এসে আদিবাকে জড়িয়ে ধরে কৌশল বিনিময় করেন। আদিবা বারবারই চাপা স্বভাবের মেয়ে তাই সে বেশি কোনো কথা বললোনা তাদের সাথে। পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে চলে আসার সময় আহানের কর্ণধারে কিছু কথা প্রবেশ করে। কিছু মহিলা বলাবলি করছিলো “মেয়েটা এমনই লোভী, শুধু বড়লোক পরিবারের ছেলেদের পটিয়ে বিয়ে করে নেয়।” আরেকজন বলে “দেখিস তোরা আগের বার যেমন বিয়ের একবছর না হতে অন্তঃসত্ত্বা করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো এবারও তেমনই হবে।” অন্য আরেকজন বলে উঠে “হুম সেইদিন আর বেশি দূরে নেই, আবারো দেখবি আরেকটা বাচ্চা নিয়ে বুড়ো মা বাবার ঘাড়ে এসে বোঁঝা হবে।”
কথাগুলো শুনে আহান তাদের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই আদিবা ওকে আঁটকিয়ে দেয় আর বলে “ছাড়ুন ওদের কথা। অভ্যাস হয়ে গেছে এই কয়েকবছর ধরে এদের এমন কটুবাক্য শুনতে শুনতে। এখন আর গায়ে মাখিনা এদের কথা।”

“তাই বলে কি এভাবে ছেড়ে দিবো এদের। হাত ছাড়ো কিছু কথা বলে আসি ওদের আমি।”
ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে আহান। আদিবা শক্ত গলায় বলে “বলছিতো ছাড়ুন এসব কথা। এদের সাথে তর্কে গিয়ে নিজের সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়না। ঘরে চলুন।”
আদিবা কথাগুলো বলেই আহানের হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসে। মাথা খারাপ হয়ে আছে আহানের। নিজে নিজেই দাঁত কিড়মিড় করছে আর লাল চোখে আদিবার দিকে তাকাচ্ছে বারংবার। আদিবা ঢুক গিলে, সে বুঝতে পারে আহান রেগেমেগে আগুন হয়ে গেছে। এসব কথা প্রথমবার শুনলে শরীরে এমন রাগ চড়ে বসবে স্বাভাবিক কিন্তু আদিবার যে অভ্যাস হয়ে গেছে এসব শুনতে শুনতে। আদিবা চট করে গিয়ে একটা তোয়ালে এনে এগিয়ে দেয় আহানের দিকে, আহান তোয়ালে না নিয়ে পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুছে নেয় হাত ও মুখমন্ডল। আদিবা মন খারাপ করে নিজেই নিজের মুখ মুছে নেয় তোয়ালেটা দিয়ে। আহান বসে বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছে, মেজাজ আরো বেশি বিগড়ে যাচ্ছে আহানের কারণ গ্রামে নেটওয়ার্ক সমস্যা অনেক যা ওর কাছে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। আদিবা আহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে চোখ বড় বড় করে আদিবার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আহান। আদিবা আমতা আমতা করে বলে “না মানে জানতে চেয়েছিলাম আপনি তো গাড়ি কোথাও থামাননি তাহলে এতো নাস্তা+জিনিসপত্র কিনেছেন কখন?”
“ঘুমিয়ে থাকলে সারা রাস্তায় দেখবে কিভাবে কেউ। ”
শক্ত গলায় বলে আহান। আদিবা আর কিছু বললো না। আহানের মাথা ঠান্ডা হওয়া অব্দি আর কোনো কথা বলা যাবেনা বুঝতে পারছে আদিবা। ফাতেমা বেগম এসে বলে “আদিবা মা খেতে আয় জামাইকে নিয়ে।”
আদিবা আহানের দিকে এক নজর তাকালো। আদিবা ডাকার আগেই আহান নিজে নিজেই শ্বাশুড়ির সাথে খেতে চলে গেলো। খেতে এসে আরেক ঝামেলা নিচে পিঁড়াতে বসে খেতে হবে যা আহান পারবেনা কারণ অভ্যাস নেই। শ্বাশুড়িকে সেই কথা বললে আহান উনি একটা মাধুর এনে বিছিয়ে দেন। সেখানেও বসতে পারছেনা কোনোমতে আহান। পেন্ট পরিধান করে নিচে বসা খুব কষ্টসাধ্য তারউপর আহানের অভ্যাসও নেই তেমন একটা। আদিবা এতক্ষণ এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো চুপচাপ। ফাতেমা বেগম আদিবাকে ডেকে বলে “জামাই তো বসতে পারছেনা এখানে নিচে। তুই একটা ব্যবস্থা কর তো মা।”
আহান আদিবার দিকে আঁড়চোখে তাকায়। আদিবা তা লক্ষ করেও কোনো রিয়েক্ট না করে ওর রুমে গিয়ে দুইটা মোড়া আনে। একটা বড় আরেকটা একটু ছোট। ছোট মোড়ায় বসতে দিয়ে বড় মোড়ায় প্লেট রাখতে দিয়েছে। নিচে থেকে সব খাবার প্লেটে সাজিয়ে দিয়েছে আদিবা। আহান কোনোকথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করে দেয়। আদিবাও মৃদু হেঁসে খাওয়া শুরু করে।
খাবার খাওয়ার মাঝখানেই আদিবা ওর মাকে জিজ্ঞেস করে “বাবা কখন ফিরবে মা?”
“এই তো আর কিছুক্ষণ পর ফিরবেন। তুই খেয়ে নে মা। তোর বাবা দুপুরে খেয়েই বেরিয়েছেন।”

সন্ধ্যায় সিয়া ঘুম থেকে জেগে দেখে ওর একপাশে আদিবা আর অন্যপাশে আহান ঘুমিয়ে আছে। সিয়া এক পলক আহানের দিকে তাকিয়ে আদিবাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ দুটো বুঁজে নেয়। মেয়ের স্পর্শ পেয়ে জেগে যায় আদিবা।
সিয়ার কপালে আলতো চুমু খেয়ে আদিবা বলে “ঘুম পূর্ণ হয়েছে আমার রাজকন্যার?”
মুচকি হেঁসে হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায় সিয়া। তারপর আদিবা সিয়াকে ফ্রেশ করিয়ে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে তখন খেতে খেতে সিয়া বলে “আম্মু তুমি পঁচা বন্ধুকে বলো চলে যেতে এখান থেকে, পঁচা বন্ধু এখানে থাকলে তোমাকে আবার আমার কাছ থেকে নিয়ে চলে যাবে।”
“নাহ মা এমন করে বলেনা। উনি তোমার পঁচা বন্ধু কে বলেছে? উনি তো তোমার ভালো বন্ধু। তুমি জানো? তোমার বন্ধু তোমার জন্য অনেকগুলো চকলেট এনেছে আর সবচেয়ে বড় কথা কি জানো?”
“কি কথা আম্মু?”
“কথাটা হলো উনি তোমাকে আর আমাকে উনার সাথে উনাদের বাসায় নিয়ে যেতে এসেছেন। আমরা সবাই মিলে ওখানে অনেক আনন্দ করবো। খুব মজা হবে।”
“তুমি সত্যি বলছো? বন্ধু ভালো? বন্ধু আর আমাকে কাঁদাবে না।”
“হ্যাঁ মামণি আমি সত্যি বলছি। তোমার বন্ধু তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমার বন্ধু তোমার জন্য অনেক খেলনা কিনে রেখেছে, বড় বড় পুতুল কিনেছে। ভালো না বাসলে কি কেউ এসব করে কারো জন্য বলো তো।”
“তাহলে বন্ধু আমার কাছ থেকে সেদিন তোমাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল কেনো? সবাই বলেছে বন্ধু নাকি খুব পঁচা”
“মানুষের কথায় কান দিতে নেই মা। আম্মু কি কখনো মিথ্যা বলি তোমার সাথে? বলো।”
“নাহ, আমার আম্মু সবথেকে ভালো আম্মু।”
“তাহলে এখন থেকে শুনবে তো আম্মুর সব কথা?
“হুম শুনবো। ”
“আচ্ছা তাহলে তোমার বন্ধু ঘুম থেকে উঠলে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে আগের মতো আদর দিবে তো।”
মুখে মিষ্টি একটা হাঁসি এনে হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায় সিয়া।
আঁড়াল থেকে মা মেয়ের সব কথা শুনে আহান। ওদের কথা শুনে আহান খুব খুশি হলেও মনের ভেতর কোথাও একটা হারানোর ভয় লুকিয়ে আছে আহানের।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।