শুধু তোমারই জন্য পর্ব-০১

0
1592

#শুধু_তোমারই_জন্য
#সূচনা_পর্ব
#Ornisha_Sathi

ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে রাস্তার ধারে কানামাছি খেলছে সতেরো বছর বয়সী এক কিশোরী। লম্বায় ৫’৩, গায়ের রং ফর্সা। দেখতে কিছুটা গুলুমুলু টাইপের। গোলগাল মুখ আর কোমড়ের থেকে কিছুটা উপর অব্দি হালকা আঁকাবাঁকা চুল। দেখতে মাশাল্লাহ। এবার কলেজে উঠেছে। যে বাচ্চাটার চোখ বাধা সে মেয়েটিকে ধরে ফেলল। সব বাচ্চারা খুশিতে করতালি দিয়ে উঠলো। কেননা যতবারই ওরা খেলেছে একবারো মেয়েটিকে ধরতে পারেনি। তাই এবার ধরতে পেরে ওদের আনন্দের সীমা নেই। চোখ বেঁধে দেওয়া হলো মেয়েটির।

মেয়েটি এদিক ওদিক ঘুরছে। আর বাচ্চাদের ধরার চেষ্টা করছে। হুট করেই একজনের একটা হাত মেয়েটি ধরে লাফাতে শুরু করে। কার হাত ধরেছে বোঝার জন্য মেয়েটি ভালো করে হাতটা ধরে। মেয়েটি মনে মনে ভাবছে, বিচ্ছুগুলোর হাত তো এত বড় হবার কথা না। আর এত শক্তও হবে না। তাহলে কার হাত ধরলাম আমি? এসব ভেবেই মেয়েটি অন্য হাত দিয়ে চোখের বাঁধন খুলে ফেলে।

সামনে তাকাতেই দেখে সুদর্শন একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বায় ৬ ফুটের মতো হবে। হলদে ফর্সা গায়ের রং। মুখে কাট করা চাপ দাড়ি। সিল্কিচুলগুলো সুন্দর করে হেয়ার কাট দেয়া। তার উপর কিছুটা চুল কপালে পড়ে আছে। পরনে কালো জিন্স হলুদ রঙের টি-শার্ট আর কালো জ্যাকেট। পায়ে কেডস, চোখে সানগ্লাস আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো।

মেয়েটি এবার নিজের হাতের দিকে তাকাতেই দেখে সে ছেলেটির একটা হাত ও ধরে আছে। সাথে সাথেই হাতটা ছেড়ে দেয়। ছেলেটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখে ছেলেটি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তাই মাথাটা নিচু করে আমতা আমতা করে বলে,

–“সরি। আসলে চোখ বাঁধা ছিলো তাই না বুঝেই___”

–“ইট’স ওকে।”

চোখ বাঁধার উড়নাটা বাচ্চাদের হাতে দিয়ে উলটো ঘুরে চলে আসতে নিলেই সেই ছেলেটির সাথে আসা আর একটি ছেলে মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায়। এই ছেলেটাও দেখতে মাশাল্লাহ। দুজনেই দেখতে নজরকাঁড়া সুন্দর। ছেলেটি মেয়েটির সামনে এসে হাসিমুখে বলল,

–“এই যে কিউটিপাই এখানে ফাইয়াজ দের বাসা কোনটা?”

মেয়েটি কিছু বলবে তার আগেই পাশ থেকে কেউ একজন মেয়েটিকে ডেকে উঠে,

–“আনি বুড়ি কি করছিস এখানে?”

পাশে ফিরতেই মেয়েটি দেখে ফাইয়াজ। তবে কি এই ছেলেদুটো ফাইয়াজ এর বন্ধু? ওরা তো একটু আগে ফাইয়াজ এর খোঁজ করছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে সামনে তাকাতেই মেয়েটা দেখে তার পাশের ছেলেটা গিয়ে ফাইয়াজকে জড়িয়ে ধরেছে। ফাইয়াজও ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে। একটু বাদেই ছেড়ে দিয়ে বলে,

–“তোরা যে আজকেই আসবি সেটা তো আমাকে আগে জানাস নি তন্ময়?”

–“সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই না জানিয়ে আসা।”

–“আহিয়ানের কি হয়েছে বল তো? এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে যে। ও তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার মতো ছেলে না।”

–“আসলে এক সুন্দরী রমনী হাত ধরাতে তিনি স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছেন।”

কথাটা শুনে ফাইয়াজ হেসে উঠলো সাথে তন্ময়ও। ফাইয়াজ এবার আহিয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

–“তুইও কোনো মেয়ের স্পর্শে স্ট্যাচু হয়ে যাস আহিয়ান? আগে তো ভাবতাম শুধু মেয়েরাই তোর স্পর্শে স্ট্যাচু হয়।”

আহিয়ান ফাইয়াজের দিকে রাগি চোখে তাকাতেই ফাইয়াজ কানে হাত দিয়ে সরি বলে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে। আহিয়ান ফাইয়াজকে ছেড়ে আবার একপলক সেই মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটির আবারো বাচ্চাদের সাথে খেলায় মগ্ন। আহিয়ানকে ওভাবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তন্ময় ফাইয়াজকে জিজ্ঞেস করে,

–“ফাইয়াজ কে মেয়েটা? বড় হয়েও বাচ্চাদের সাথে খেলছে।”

ফাইয়াজ একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবার তন্ময় আর আহিয়ানের দিকে তাকায়। তারপর মেয়েটিকে ডেকে উঠে। মেয়েটিও গুটিগুটি পায়ে ফাইয়াজের সামনে এসে দাঁড়ায়।

–“ও হচ্ছে আনিতা। সম্পর্কে মামাতো বোন হয় আমার।”

এরপর ফাইয়াজ ওর দুই বন্ধুর সাথে আনিতার পরিচয় করিয়ে দেয়। আনিতা পিছু ঘুরে দেখে ওর মেজো চাচ্চু আসছে। তা দেখে আনিতা আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। দৌড়ে রাস্তার পাশের প্রথম বাড়িটাতে ঢুকে পড়লো। আনিতাকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে আহিয়ান আর তন্ময় বেশ অবাক হয়। ওদের দুজনকে আনিতা যাওয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফাইয়াজ বলে,

–“ওর চাচ্চু আসছে তাই ওভাবে দৌড়ে পালালো। এখন ভেতরে চল নাকি রাস্তাতেই থাকবি?”

ফাইয়াজের কথায় ওরা ক্ষানিকটা হাসলো। তারপর ফাইয়াজের সাথে ওদের বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লো। আনিতাদের পাশের বাড়িটাই ফাইয়াজদের।

*

পড়ার টেবিলে মাথা রেখে একমনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে আনিতা। ঘড়ির কাটায় তখন রাত আটটা বেজে পনেরো মিনিট। আনিতা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ওর আম্মু কোথাও নেই। সেই ফাকে ও ফোনটা হাতে নেয়। আর তখনই আনিতার আম্মু ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নেয়। আনিতা কাঁদোকাঁদো ফেস করে ওর আম্মুর দিকে তাকায়। ওর আম্মু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ফোন নিয়ে চলে যায়। আনিতা ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দেয়।

আধ ঘন্টা পর আনিতা পড়ার টেবিল ছেড়ে ওঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। এখনো রাত নয়টা বাজেনি। তারপরও মনে হচ্ছে গভীর রাত। গ্রামে এমনই মনে হয়। সন্ধ্যার পর পরই চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে গ্রামে সেজন্যই মনে হয় অনেক রাত।

পরপর দুটো বিল্ডিং। একটা আনিতাদের আর অন্যটা ফাইয়াজ দের। আনিতার রুম বরাবরই ফাইয়াজের রুম। ফাইয়াজের রুমের বারান্দায় একটা অবয়ব দেখা গেলো। সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে। আনিতা ভাবলো ফাইয়াজ হয়তোবা সিগারেট খাচ্ছে। সেজন্য আনিতা কিছুটা জোড়েই ডেকে উঠে,

–“ফাইয়াজ ভাইয়া আমি কিন্তু ফুপ্পিকে বলে দিবো তুমি স্মোক করো। মুখ বন্ধ রাখার জন্য অনেকগুলো চকলেট চাই আমার। নয়ত সত্যি ফুপ্পিকে বলে দিবো।”

আনিতার কথায় সেই অবয়বটা পিছু ফিরে তাকালো। রুম থেকে আসা হালকা আলোয় অবয়বের চেহারাটা স্পষ্ট হলো। আহিয়ানকে ঘুরতে দেখে আনিতা চমকে উঠলো। আহিয়ান আনিতাকে দেখে সিগারেটটা ফেলে দিলো। আহিয়ানও আনিতাকে কেমন করে যেন দেখছে। আনিতা রুমে চলে আসতে নিলেই ওপাশ থেকে আহিয়ান বলে,

–“তুমি চাইলে কিন্তু চকলেটটা আমিই কিনে দিতে পারি।”

আনিতা একবার পিছু ঘুরে, “লাগবে না” বলে আবার দৌড়ে রুমে চলে গেলো।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন দেখছিলো আনিতা। এমন সময় ফাইয়াজ আনিতাকে ডাকতে ডাকতে আনিতার রুমে ঢুকলো। আনিতা ফাইয়াজকে দেখে উঠে বসলো। ফাইয়াজ আনিতার মাথায় টোকা মেরে বলে,

–“কিরে সারাদিন রাত কি শুধু ফোনই টিপিস? আর কোনো কাজ নেই তোর?”

–“উফস ভাইয়া লাগে তো আমার।”

মাথা ডলতে ডলতে আনিতা কথাটা বলল। ফাইয়াজ আনিতার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ওর বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়লো। তা দেখে আনিতা বলে,

–“এই বের হও বলছি আমার রুম থেকে। ঘুমোবো আমি।”

–“রাতে খেয়েছিস?”

–“তোমাকে বলবো কেন?”

–“বুঝেছি খাসনি, চল আমার সাথে।”

–“যাবো না আমি।”

–“আম্মু ডাকছে তোকে।”

ফাইয়াজ কথাটা বলেই আনিতার হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে আনিতার আম্মুকে ডেকে বলে গেলো যে আনিতা আজকে রাতে ওদের বাসায় খাবে। ফাইয়াজের আম্মুর কড়া আদেশ যা কিনা মানতেই হবে। আনিতাও আর কিছু না বলে চুপচাপ ফাইয়াজের সাথে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।

ফাইয়াজ আনিতার থেকে অনেকটা বড়। তবুও সবসময় আনিতার পিছু লেগেই থাকে। দুজনে সারাক্ষণ টম & জেরির মতো ঝগড়া করে বেরায়। আবার একে অপরের জন্য জানও বের করে দিতে রাজি। আনিতা ফাইয়াজদের বাসায় এসে সোজা কিচেনে চলে গেলো। আনিতা পেছন থেকে ফাইয়াজের আম্মুকে জড়িয়ে ধরলে তিনি অভিমানের সুরে বলেন,

–“আজকে একবারো ফুপ্পির কথা মনে পড়লো না বুঝি?”

–“আহ ফুপ্পি! তুমি তো জানোই আমি কতটা ব্যস্ত থাকি।”

ফাইয়াজের আম্মু আনিতার একটা কান টেনে ধরে বলে,

–“খুব ব্যস্ত থাকেন আপনি তাই না? সারাদিন তো সেই বাচ্চাদের সাথে ছোটাছুটি করেই কাটান। এটাই বুঝি আপনার ব্যস্ততা?”

–“আহ! ফুপ্পি লাগছে তো। ছাড়ো আমাকে।”

ফাইয়াজের আম্মু আনিতাকে ছেড়ে দিয়ে আবার রান্নায় মনোযোগ দিলেন। আনিতা উঁকি দিয়ে দেখে ওর ফুপ্পি শামি কাবাব ভেজে ভেজে উঠাচ্ছেন। আনিতা একটা কাবাবে হাত দিতে গেলেই ওর ফুপ্পি আনিতার হাতে হালকা ভাবে থাপ্পড় মেরে বলে,

–“গরম তো হাত পুরে যাবে।”

–“আচ্ছা পরেই নিবো। রাতের জন্য কি রান্না করেছো শুনি?”

–“ফাইয়াজের বন্ধুরা বিরিয়ানি খেতে খুব ভালোবাসে তাই বিরিয়ানি রান্না করেছি। সাথে ডিমের কোরমা আর শামি কাবাব।”

–“ওয়াহ গ্রেট ফুপ্পি। সবই তো দেখছি আমার পছন্দের।”

–“হ্যাঁ সেজন্যই তো ফাইয়াজ আপনাকে ধরে আনলো।”

–“আচ্ছা ফুপ্পি খাবার তো টেবিলেই আছে তাই না? আমি একটু টেস্ট করে আসি কেমন?”

কথাটা বলেই আনিতা একটা কাবাব হাতে নিয়ে খেতে খেতে দৌড় লাগালো। ডাইনিংয়ে আসতেই আনিতা কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেলো৷ আনিতা ঠিকঠাক ভাবে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই দেখে আহিয়ান ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। আনিতা পাশ কেটে চলে আসতে নিলেই আহিয়ান বলে,

–“এই যে মিস, তুমি কি সবসময় এমন দৌড়ের উপরই থাকো?”

আনিতা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আহিয়ান আমতা আমতা করে বলে,

–“না মানে যখনই তোমাকে দেখি তুমি শুধু দৌড়েই পালাচ্ছো।”

–“সেটা আপনাকে কেন বলবো আমি?”

কথাটা বলে আনিতা টেবিলের কাছে গিয়ে ছোট একটা বাটি হাতে নেয়। তারপর বিরিয়ানির উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে সেই বাটিতে কিছুটা বিরিয়ানি তুলে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসে টিভি অন করে। আহিয়ান এখনো আনিতাকেই দেখে যাচ্ছে। তন্ময় এসে আহিয়ানের কাঁধে হাত রাখতেই আহিয়ান কিছুটা চমকে উঠে। তন্ময় আহিয়ানের দিকে কিছুটা ঝুকে বলে,

–“মামা কোচ কোচ হোতা হ্যায়?”

–“হুম…..”

আহিয়ান অন্যমনস্ক ভাবেই কথাটা বলে ফেলে। তন্ময় জোড়ে আহিয়ানের পিঠে থাপ্পড় মেরে বলে,

–“কি বললি? সত্যি? আমি এখনই ফাইয়াজকে বল___”

–“আরেহ না তুই যেমন ভাবছিস তেমন কিছু না। জাস্ট এমনি একটু ভালো লাগা কাজ করে। আর তাছাড়া তুই তো জানিসই আমার গার্লফ্রেন্ড এর অভাব নেই। এই বাচ্চা মেয়ের প্রেমে আমি কিভাবে পড়বো? তুই যা ভাবছিস তা নয়।”

–“আচ্ছা আহিয়ান ঠিক হবি না কখনো? এতগুলো মেয়ের সাথে রিলেশনে আছিস তুই। অথচ কাউকে ভালোবাসিস না। তাহলে কেন সেই মেয়েদের সাথে রিলেশনে জড়াস তুই? প্রায় সবগুলো মেয়েই তুই বলতে পাগল। যে কোনো একজনকে ভালোবেসে আপন করে নে।”

–“ওরা আমার জন্য পাগল। আমি না। আর তাছাড়া আমি তো ওদের সাথে রিলেশন করতে চাই না। ওরাই বাধ্য করে আমাকে। আর আমার মন তো আবার অনেক বড় সেজন্য ওদের ফিরিয়ে দিতে পারি না।”

–“শালা ভালো হইলি না আর।”

ফাইয়াজ ড্রয়িংরুমে ঢুকেই এ কথাটা বলে। তা শুনে তন্ময় আর আহিয়ান দুজনেই হেসে দেয়। সাথে ফাইয়াজও হেসে উঠে।



চলবে।