শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-১৬

0
363

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(১৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

ফাহমিদা খাতুন পাগল প্রায় হয়ে উঠেছে। তিনি কিছুতেই মানতে নারাজ যে তার মেয়ে নিখোঁজ।

সবার মাথায় হাত!
কেউ কিছুই ধারনা করতে পারছে না ঠিক কি কারণে ফাইজা নিখোঁজ।
আত্মিয় স্বজনরা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করছেন কেউ কেউ বলছেন,ফাইজা ভালো একটা মেয়ে নিশ্চ‌ই কেউ তাকে কিডন্যাপ করেছে!
আবার কেউ বলছেন,দেখ গিয়ে কোন ছেলের সাথে লাইন ছিল!এখন পালিয়ে গিয়েছে। বিলেত ফেরত মেয়ে তার চরিত্র আর কেমন হবে? কেমন নিষ্ঠুর হলে ছেলেটা কে এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পালালো।

তায়েস তার পুলিশ ফোর্স কে ইনফর্ম করতে করতে কমিউনি সেন্টার থেকে বের হয়ে গেল।ফাইজা কে খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে সে।আর কেউ না জানলেও তায়েস খুব ভালো করেই জানে তার ভাই ফাইজা কে কতটা ভালবাসে। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে তায়েস।

আলো রামিসা কে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করছে,
-“তুমি এভাবে চুপ করে আছো কেন?আর এভাবে বিয়ের সাজেই বা সজ্জিত হয়েছো কেন!বলো না রামিসা ফাইজা আপু কোথায়? আমার মনে হচ্ছে তুমি জানো আপু কোথায় আছে!

ফয়জান এর মাথা কাজ করছে না। মস্তিষ্ক কেমন এলোমেলো লাগছে।সে আদৌও জানে না তার আদরের বোনের সাথে ঠিক কি হয়েছে? এলোমেলো পায়ে গন্তব্যহীন পথে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পাগলের মত মানুষজনের বোনের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে,এই মেয়েটাকে কোথাও দেখেছেন?
মাঝে মাঝে এলোপাথাড়ি হাঁটার কারণে এটা সেটার সাথে পায়ে হোঁচট খেয়ে ব্যথা পাচ্ছে কিন্তু সেদিকে তার কোন হুঁশ নেই।

ফাহমিদা খাতুন চিৎকার করে করে কমিউনিটি সেন্টারে ফুলে সজ্জিত ফুল গুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।আর বিলাপ করে বলছে, আমার মেয়েকে হাড়াতে হবে জানলে এই বিয়ে কখনোই চাইতাম না আমি। আমার মেয়েকে এনে দাও তোমারা।বার বার গিয়ে আয়েশার পায়ে পরছে আর বলছে আমার মেয়েকে এনে দিন ভাবী? আপনার পায়ে পড়ি।

আয়েশা চোখের পানি রোধ করতে পারছে না,কিছুতেই না।
ফাহমিদার জন্য নিজের ছেলেটার কাছেও যেতে পারছে না। না জানি ছেলেটার কি অবস্থা? সেই ছোট বেলা যখন ফাইজা বিদেশে চলে যায় তখন থেকে ছেলেটা কেমন চুপচাপ, মনমরা হয়ে যায়।
কিন্তু ফাইজা ফিরে আসার পর থেকে মনমরা ভাব কখনোই দেখা যায়নি কায়েসের মাঝে। সবসময় হাস্য‌উজ্জ্বল মুখশ্রী দেখা গেছে সর্বদা।

দুই বাবা মিলে ফাইজার পরিচিত জায়গায় খুঁজ নিচ্ছে এমনকি ফাইজার অফিসের হেড ম্যাডামদের ও কল করেছে। তাদের কলে না পেয়ে অফিসের অন্যান্য স্টাফ দের কল করেছে। সবার একই কথা তাদের সাথে ফাইজার যোগাযোগ হয়নি।
.
.
কায়েস দুই হাতে নিজের মুখশ্রী চেপে ধরে বসে আছে। আজকে ছেলে বলে চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না প্রিয় মানুষটির জন্য। কেননা ছেলেদের যে চিৎকার করে কাঁদার রিতী নেই।

কায়েস কখনোই ভাবেনি ফাইজা এভাবে তাকে ধোঁকা দিতে পারে। সে তো সবটা জেনেও নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিল তবুও কেন ফাইজা এরকম করলো? কেন?

সব প্রশ্নেরা জট পাকিয়ে বসেছে কিছুতেই জট খোলা যাচ্ছে না।

একটা ছোট্ট মেয়ে এসে বললো,
-“আংতেল?এই নিন!

কায়েস দুই হাত সরিয়ে পিচ্চি মেয়েটির দিকে তাকালে মেয়েটা তার হাতে একটা ছোট চিরকুট দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

কায়েস সাথে সাথে চিঠির বাজ খুলে চোখ দুটো স্থির রাখে চিঠিতে।

আসসালামু আলাইকুম।
কায়েস ভাইয়া আপনার মনে আছে সেদিন “বালুনদী” তে আপনি কথা দিয়েছিলেন আমি যা চাই আপনি আমাকে তাই দিবেন?

আমি চাই আপনি রামিসা কে বিয়ে করুন! আজ এবং এই মুহূর্তে!
এটাই আপনার কাছে আমার শেষ চাওয়া,যদি কখনো বিন্দু পরিমাণ আমাকে ভালবেসে থাকেন তাহলে আশা করি আপনি আমার ইচ্ছে পুরন করবেন।

যদি শুনি আমার ইচ্ছে পুরন হয়নি তাহলে আর কখনোই আমাকে দেখতে পাবেনা না।
“আল্লাহ হাফেজ”।
.
চিঠিটুকু পরে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে কায়েস মাহমুদ। সেদিন ফাইজার কষ্ট গুলোর সাক্ষী হয়েছিল সে। সে গুলো স্মৃতির পাতায় নতুন করে উল্টায়….

ছোট্ট বেলা থেকে আপনার আদর্শেই নিজেকে তৈরি করেছি। তবে কেন আজ আমাকে ধর্ষ’ণের শিকার হতে হলো! বলতে পারেন? বলতে পারেন কায়েস ভাইয়া? কি হলো জবাব দিন?

আপনি আমাকে বলেছিলেন পর্দা করলে,যেমন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আদেশ পালন করা হয় তেমনি মানুষ রুপি শকুনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। তবে কেন সেই পর্দা ভেদ করে, আমার সতীত্ব হর’ন করলো! বলতে পারেন কায়েস ভাইয়া? আমি জানি এর কোন জবাব আপনার কাছে নেই।

খোলা আকাশের নিচে বসে,আকাশের পানে তাকিয়ে একেরপর এক ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে কায়েস।ফাইজার একেকটা কথা তীরের মত আঘাত করছে কায়েস এর মস্তিষ্কে! আকাশের পানে তাকিয়ে থেকেই ফাইজার কষ্টগুলো অনুভব করার চেষ্টা করছে।

ধংস লিলার খেলায় মেতে উঠেছে মানুষ,তার কর্ম দোষেই ধংস হবে একদিন, পৃথিবীতে কেয়ামত আসার বেশি সময় বাকি নেই!

কায়েস নিজেকে ধাতস্থ করে বললো, তোমার সাথে যা হয়েছে খুবই জঘন্য কাজ হয়েছে আমি মানছি কিন্তু তুমি যা করছো ঠিক করছো না। ফিরে এসো এই দুর্গম পথ থেকে কথা দিচ্ছি সারা জীবন আমার সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব, কোন বিপদের আঁচ লাগতে দিবোনা তোমার গায়ে।
দুর্লভ হেসে ফাইজা বললো,তা আর কখনই হওয়ার নয়। নিজেকে কোন মায়ায় জড়াতে পারবো না।আর তা ছাড়া আমি তো ভা’র্জিন ন‌ই! আমার সাথে জড়ালে আপনার জীবন‌ও জড়িয়ে যাবে এই অন্ধকার জগতে।যার কোন নিশ্চয়তা নেই! এই আছি, তো এই নেই! জেনে শুনে কখনোই আমি হতে দিতে পারি না।

নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে নেয় কায়েস।ফাইজার দিকে শাহাদাত আঙ্গুল তুলে বললো, আমি তোমাকেই বিয়ে করবো! সেই ছোট্ট বেলায় আমাকে বলেছিলে যে “কথা দাও আমাকে তুমি বিয়ে করবে”!
আজ সব ভুলে গেলে? আমি ভুলিনি কিন্তু, ভুলবো না কখনো।

হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ফাইজা! হেসে কুটিকুটি হয়ে বললো, সেদিন তো আপনি কথা দেননি?
কায়েস থমথমে গলায় বললো, সেই সময় কথা দেওয়ার বয়স ছিল না আমার। তুমি যখন বিদেশে চলে গেলে, তখন থেকে তোমাকে উপলব্ধি করে চলেছি আমি!আর তখন নিজেই নিজেকে কথা দিয়েছি আমি তোমাকে বিয়ে করবো! সেই সময় এখন নিকটে। তোমাকে আমি বিয়ে করবোই!
আচ্ছা,চ্যালেঞ্জ এক্সসেপ্টটেড! তারপর হিজাবের নেকাব লাগিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায় ফাইজা।
কায়েস বসা থেকে শুয়ে পড়ে অজস্র সবুজ দুর্ভা ঘাসের উপর। তারপর আকাশের পানে তাকিয়ে নিজের কষ্ট গুলো আল্লাহ তা’আলা কে বলে।
মাঝে মাঝে বিপদে আকাশের দিকে মাথা তোলা। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের কষ্টগুলো আল্লাহ তা’আলা কে বলা।প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত।
[মুসলিম- ২৫৩১]
.
.
লন্ডন থেকে বাবা মায়ের সাথে দেশে ফিরে ফাইজা। তখন ফয়জান এবং রামিসা লন্ডনে ছিল।
প্রথমে তারা গ্রামের বাড়িতে উঠে। সেখানে থাকার মতো পরিবেশ তৈরি করে।
ফাইজা গ্রামের মানুষজনের থেকে কায়েস দের শহরের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে। এরপর একদিন ঢাকায় র‌ওনা হয়। বাড়ি থেকে যখন র‌ওনা হয় তখন খুব সুন্দর শুভ্র নীলাভ আকাশ ছিল। কোথায় কোন মেঘের আনাগোনা ছিল না। কিন্তু বাসে উঠার ঘন্টা খানেক পরে “শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা” শুরু হয়। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে।
ফাইজার ঠিকানা অনুযায়ী বাস থেকে নেমে যেতে হয়।নামার পর কোথাও কোন মানুষের গতানুগতি দেখতে পায় না। এখান থেকে একটা রিকশা করে কায়েস দের বাসায় পৌঁছাতে হবে।তাই যাত্রী ছাউনীর নিচে দাঁড়িয়ে থাকে।
তখন একটা প্রাইভেট কার এসে থামায়।মাস্ক পরিহিত ছেলেটার চেহারা স্পস্ট বোঝা যাচ্ছিল না। হাত নাড়িয়ে কথা বলার সময় হাতে থাকা ট্যাটু দেখা যাচ্ছিল।

ছেলেটা কাছে এসে ফাইজা কে বললো,
-“মিস আপনি চান তো চলুন আপনাকে লিফ্ট দিব?

ফাইজা প্রথমে রাজী হলো না। শেষে আকাশের অবস্থা অবলোকন করে দেখলো, মিনিট কয়েকের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি শুরু হবে। তখন আরো আগেই রিকশা পাওয়া যাবে না।তাই ফাইজা রাজি হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

এটাই যে তার জীবনের কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে কে জানতো?
.
.
ফাইজা কে বিবস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে দুজন মহিলা তাদের বাসায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে। ততদিনে তার গায়ে ধর্ষ’ণের তকমা লেগে গিয়েছিল!ফাইজা সুস্থ হয়েও ভেঙ্গে গুড়িয়ে গিয়েছিল। মহিলা দুটো ফাইজা কে বেঁচে থাকার পথ দেখায় আর সে কারণেই ফাইজা আজ পর্যন্ত আ’ত্মহ’ত্যার মতো মহা পাপ করেনি।

এ কথা বাবা মাকে বলার সাহস হয়ে উঠেনি। তারা যে সহ্য করতে পারতো না কখনোই।তাই আবার বিদেশে ফিরে যায়।

তারপর দেশে ফিরে ঐ মহিলা গুলোর আন্ডারে থেকে এনজিও তে কাজ করা শুরু করে…

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।